প্রিয় অমিতাভ
১
আমি যখন মেড়ামেড়ির ঘরের জন্য
কুড়োচ্ছিলাম পাইনের বাদামি শবদেহ,
আমি যখন মেঘকে নিয়ে লোফালুফি
খেলতে খেলতে খুঁজে পেলাম বন্ধুর মত ঝর্নাদল
আমি যখন খাসিমামার পাশে বসে
শুনছিলাম গিটারের স্ট্রামিং,তুমিও তো তখন
মেঘপাহাড়ের অপু,হাতে নিয়ে মেঘের দলা,
দৌড়ে যাচ্ছ,উঁচুনিচু টিলা।কেঞ্চেস স্ট্রিটের
ঝর্নাধ্বনি তোমাকে ঘুম পাড়াত। চাঁদের পাথর দেখতে
যখন গিয়েছিলে স্টেট লাইব্রেরি,আমি ঠিক
তোমার পেছনেই ছিলাম,বাবার আঙুল ধরে।
দুই বিস্ময়-বালক,পরিচয়হীন,তাদের নিশ্চিন্দিপুরে।
নাসপাতি,প্লাম,পাহাড়ের গন্ধ থেকে দূরে,
আমরা দুই প্রবীণ,বাতাসের সঙ্গে পাইনের প্রণয়ের
সেই অবিশ্বাসী কথোপকথন থেকে দূরে,বড় হয়ে
যাওয়া অপু,এই আমরা,সন্ধ্যার নীরব বিস্তারের ভেতর
কাছাড় ক্লাবে মুখোমুখি।স্বর্গের দ্বার খুলব,
তখন কেন আমাদের দেখা হল না মেঘপাহাড়ে,অমিতাভ?
২
পল গগাঁ ও ভ্যান গঘ যখন ট্রেন থেকে নেমে
পা রাখলেন তারাপুর রেলস্টেশনে,তখন
অমিতাভ,তুমি রাত্রির স্তনে মুখ গুঁজে চাঁদের
ফ্রেসকো আঁকছ।শিলচরের আকাশের দিকে তাকিয়ে
অভিভূত গঘ ভাবলেন,স্টারি নাইট কী করে,এই আকাশে,
মধ্যরাতে! গগাঁ বন্ধুর মন পড়ে নিয়ে বললেন,
এরকমই হয়;সেন্ট রেমিতে একশ বছরেরও আগে
তুমি যা এঁকেছিলে,পৃথিবী যতদিন বাঁচবে,ততদিন
যে কোনও দেশের আকাশ স্টারি নাইটই হবে।
দুই বন্ধু পা চালালেন,আর্যপট্টি যেতে হবে।
সেখানে এক কবি ঈশ্বরের সঙ্গে সংলাপরত।
সেই কথোপকথনের ঐশ্বর্য রঙে রাঙাতে হবে।
কণ্টক এবং কুসুমকে রাঙানো সহজ তো নয়,
বিশেষ করে সে যখন বাঙালি।
৩
ব্যানার্জি পুড়ছেন। পুড়বেন মুখোপাধ্যায়,ভট্টাচার্য,
দে,সরকার।আমিও পুড়ব, তুমিও একদিন।
দেহতত্ত্বের গান গাইবে শ্মশানে এক ভবঘুরে।
আমাদের শীর্ণ কবিতার দেহ থেকে শব্দগুলি
ছন্দ,মাত্রা,যতি,ধ্বনি,উপমা,রূপক,প্রতীকসহ
ছিটকে বেরিয়ে মুখ থুবড়ে পড়বে,
বরাক ব্রহ্মপুত্রের জলে।সেই গন্তব্যে
পৌঁছনোর পূর্বে চলো অমিতাভ, কাছাড় ক্লাব।
সুদৃশ্য লনে আর কাকে চাই?
প্রবুদ্ধ,রাহুল,জয়দেব,তুষার?
থাক।শুধু তুমি আর আমি,এই মধুর যামিনী,
ঝরুক মধুর শ্রাবণে মধুরস।পৃথিবী সিক্ত হোক।
যাবার আগে অন্তত এইটুকু।স্কচই তো,প্রতিবারের মত?
৪
রাত আড়াইটে।জেগে রয়েছে প্রেমিক,উন্মাদ ও কবি।
সকলেই সৃষ্টিশীল,ঈশ্বরের মত।ঘুম নেই দুই বালকেরও।
নম্র বালক,সোসো থাম এবং লাপিনসাইয়ের
মাঝে বসে শুনছে কবিতা, রবীন্দ্রসঙ্গীত।
বিভোর বালক,সিজারিয়ান ভাষায় লিখে চলেছে
দেশভাগের চিত্রনাট্য।শনবিলের জলের ধারে বসে
শুনছেন অস্থির ঋত্বিক।
লাংটিঙের পরিরা শনবিলে মেতে উঠেছে খুনসুটিতে।
মাছের টেঙা দিয়ে ভাত খাচ্ছে নম্র বালক।
বিভোর বালক মোমকাহিনি লিখছে ফরসেপে।
এইসকল দৃশ্যকাব্য আমরা রেখে যাব শ্রীভূমিতে।
সকলেই একদিন অদৃশ্য হব,আমি, তুমি, অমিতাভ।
আমাদের শব্দযাপন,সুরযাপনের আলাপচারিতার
প্রতিধ্বনি ঘুরে বেড়াবে বড়াইলে,নীলাচলে।
৫
মনখারাপ হলে কোথায় যাব অমিতাভ?
তোমার ছেলের আঁকা পেন্সিলরেখা ধরে গতজন্মে?
যেখানে উমপ্লিংমেঘ আস্তে এসে বসে ঝর্নার পায়ের কাছে,
ঘুড়ির বন্যায় ভাসে আকাশ,লাট্টু ঘুরে ঘুরে কেমন
বাউলপাগল।টায়ার চালিয়ে দূরদেশে যায় অচিন বালক,
রবিগানের বৃষ্টিতে ভিজব শ্রাবণে,আলি আকবরের
আহির ভৈরোঁতে জেগে উঠব পুনর্বার নতুন জন্মে,প্রিয় নারীর সঙ্গে
সাগরতীরে প্রেমে ও সংরাগে,বন্ধুদের কাঁধ ছুঁয়ে বলব,
চল,অরণ্যে।প্রিয় বই,গান,সুস্বাদু খাবার,গ্লাসভর্তি মদ,
কী নিলে করতলের গ্রহণে,আমার মন ভালো হবে?
মনখারাপ হলে আঙুলে ধরাও তো যায় ঝকঝকে ব্লেড।
প্রিয় মানুষের থেকে দূরে,গলে যাওয়া ভীষণ নীলের
ভেতর সেরে নিতে পারি লাস্ট সাপার,হেমলক পানে।
৬
শক্তিপদর কবিতা সুরে বেঁধে গান গাইছে শুভপ্রসাদ,
বঙ্গভবনে।আমি আর তুমি তখন কাছাড় ক্লাবে।
চুইয়ে পড়ছে প্রজাপতির পাখনার রং বেঠোভেনের সোনাটায়।
একটু পরেই আসবেন লেনন আর ম্যাকার্টনি,
আ্যবে রোডকে দাঁড় করাবেন প্রেমতলায়।শুভ আসবে
গান সেরে, আসবেন শক্তিপদও।আমাদের আখড়ায় আজ রাত গুলজার।
এর আগে পৃথিবীকে একটু গুলে খাওয়া যাক।
যে শূন্যতাকে গ্রহণ করেছি বেখেয়ালে,তার গোড়ায়
আন্তরিক জল ঢালার কোনও প্রয়োজন নেই আর।
একা থাকা ভালো,একাই ভালো,আমাদের গানের
বারান্দা,শব্দের খেত,রাত্রির তরল,নারীর নাভিকুণ্ডে
তলিয়ে যাওয়া,এইসব খুচরো পয়সা নিয়ে,
নৌকো ভর্তি করে দেব পাড়ি।
চতুর্দিকে জল আর জল,শুধু জল,জলকে ভয় করি।
৭
অমরত্ব চাই?শীর্ণ জীবনে এই জিজ্ঞাসা শূন্য থেকে
বহু মুদ্রায় ভাঙনের বিপন্নতা ডেকে আনে
এই লালিত জীবনে।দিগন্তকে গুটিয়ে এই ঝোলায়
পুরলাম।বাউলযাপনে দোতারা,অন্ন একমুঠো।
জগাখিচুড়ির সঙ্গে গান হবে রাত্রিজুড়ে।
প্রতিবিম্বরা দাঁড়িয়ে রয়েছে সারিবদ্ধভাবে।
আমাদের কোমল মা কোথায়,অমিতাভ?
কোথায় সর্বজয়া,নিশ্চিন্দিপুর?
জীর্ণ একতারা খুঁজে গান হবে হাসনে,লালনে।
ছায়ার ওপর উঠে বসেছে শরীর।
তৃণের শিয়রে কুয়াশার বাড়িঘর।
যাব না আর তোমার কাছে,ছেলেবেলার গ্রাম।
এই ভালো,একলা চলা,ময়লা আলো।
সকলই ফুঁ।ভাসে ব্র়হ্মাণ্ডে,অন্তহীন।
৮
নংক্রেম উৎসবে আমি যাইনি কখনও।
গিয়েছিলে তুমি,কং-এর আঙুল ধরে,
যে আঙুলে লেগেছিল মেঘের কুয়াশাগুঁড়ো?
চেরাপুঞ্জির মেঘ,আমাদের দুখি শার্টপ্যান্টের পকেটে
লুকিয়েছি দুজনেই।ঝিরঝির বৃষ্টির ছাঁটে,
আমরা দুজনই তখন মম চিত্তে নিতি নৃত্যে।
এখানে শ্রাবণ বুনো গন্ধ মেখে কবরীমুক্ত কেশ।
এখানে রাগ দেশ পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে অবিশ্রাম ঝরে।
পাইনের অরণ্যে বালকের মুগ্ধ চোখ হারায়।
তুমি কি এখনও মেঘের গন্ধ পাও,জলের অসহনীয়
সেই ছুঁয়ে যাওয়া,ঝর্না কুড়োও রাতদুপুরে,পাইনের
পালক উড়ে এসে বসে,মাথায়, বুকে,পাহাড়ের ঘ্রাণ
এখনও আনমনা করে,তোমাকে,ডাকে
সবুজ শিস-এ, অমিতাভ?
কাছাড় ক্লাবের নীল নীল সন্ধ্যায়,হঠাৎ
গ্লাসের তরলে ছেলেবেলার মেঘ নেমে আসে।
৯
ঘুমহীন রাত দুটো।কাকে ভাব,অমিতাভ,
ফুরিয়ে-আসা জীবন,না ফেলে-আসা কলকাকলি?
নতুনেরা এসেছে,ওরা পথে পথে গান করুক।
আমরা দূর থেকেই দেখব,চাঁদ,তারা, আকাশ।
ঘড়িতে বালি ঝরে পড়ছে,ক্রমে যেতে হবে।
বাংলা কবিতা অন্যেরা পড়বে কবিসম্মেলনে।
এক ফর্মার কবিতার বইগুলি
পৃথিবীকে সুন্দর করবে আরও ।
মানুষেরা যথারীতি মুখ ফেরাবে।
কবিরা শব্দকে ভালোবেসেই যাবে।
তখন আমরা কিছুটা গুছিয়েছি,কিছু অগোছালো।
কাছাড় ক্লাবের ওই গাছের নীচ থেকে
একটি বাংলা কবিতা,নিদ্রাহীন তাকিয়ে রয়েছে,
একই সঙ্গে তোমার আমার দিকে।
ছেড়ে আসা শূন্য গ্লাস,রাত দুটোয়
এই দৃশ্য বন্দি করল কাচের মসৃণে।
১০
আমাদের কোনও প্রোমনাইট ছিল না।মেয়েদের স্কুলের
সামনে দাঁড়িয়ে,কমলা শাড়ি,সাদা ব্লাউজ,বিনুনিদোলানো
কিশোরীদের দেখেই পিউবার্টির রহস্যরোমাঞ্চসিরিজ।
ওয়ান্ট আ বিয়ারের পরিবর্তে,এই নে, টান,বলে
গাঁজায় দম দেওয়া ছাড়া আর কোনও গত্যন্তরের
দিনরাত্রি ছিল না।এইসব কুণ্ডলীর ভেতরই একটি জীবন,
তার শব্দরাজি।কুড়োতে কুড়োতে বহুদূর।কী পেয়েছি
আর কী দিয়েছির এই দেশে ক্রমে পালটে যাচ্ছে
তোমার আমার পৃথিবী, অমিতাভ।ফুলেরা বর্ণ হারালো,
পাখিরা গান।নদীর জল মানুষের অসহায়তা দেখে
বিষণ্ণ হল।শহরে সন্ধ্যা নামলে মৃত্যুশোক ধুয়ে মুছে
তোরঙ্গে তুলে রাখি যতনে।ওই মেয়েকে বলি,কুড়িয়ে
নে যে কোনও ধূলিকণা,সে তোর ভালো বন্ধু হবে।
১১
কত আঘাত নিলে বুকে,একটি সার্থক জনম?
দীর্ঘ,শুনশান পথ।রোদ শুয়ে আছে ময়নাতদন্তের
ঘরে।মৃত্যুকে আর কত মৃত্যু দেওয়া যায়,বলো
অমিতাভ?যারা চলে গেছে অসময়ে,অভিমানবশত
ওদের ফেরাব না আর।যে জীবন রেখে গেছে
কুসুমে কণ্টকে,প্রতিদিন তার শেকড়ে দেব জল।
আঁজলা ভরে রোদ দেব,রবিগান শোনাব স্বকণ্ঠে।
তাকে রাখব যতনে,প্রেমে।যে জীবন রেখে গেছে
অনাদরের তো নয়।গুছিয়ে রাখব চশমা,চিঠি,
প্রিয় বই।জন্মদিনে পায়েস বানাব,আলো জ্বালাব আঁখিজলে
স্মৃতির সরণি বেয়ে থাকবে পাশেই,যেমন বুকের চলাচল।
১২
নামহীন হই যদি একদিন,তুমি অমিতাভ নও,
আমি সঞ্জয়।সাগরতীরের বালুকায় দুটি মৃতদেহ
শুয়ে পাশাপাশি,মাথার ওপর অসংখ্য গাঙচিল।
আমাদের লেখালেখি নিয়ে গেছে ওদের উড়ান।
এই যে যাওয়া, একাকী,তাকে অলংকৃত করতেই
পারেন অখিলবন্ধু,ডিলান।দূর থেকে হেঁটে আসছেন
র্যাঁবো ও ভের্লেন।একটি ঋতু যে রচিত হল নরকে,
সে কার?যে কবিতাটি লিখতে চেয়েছিলাম, তার
না-লেখাকে নিয়ে এই শুয়ে থাকা,দুটি লাশ,সাগরতীরে,
এই তো গন্তব্য ছিল।দূরে রাধারমণকে কণ্ঠে নিলেন কালিকাপ্রসাদ।
১৩
আমরা কি লিখে যাব, এপিটাফ?আমাদের কোনও
সেমেটারি নেই।কোথায় রাখব শেষ শব্দসমূহ।
মহাশ্মশানে গান গাইছেন রামপ্রসাদ।
আমাদের কোনও কনফেশন বক্স নেই;
হাঁটু মুড়ে বলা যেত,ফাদার,আই হ্যাভ সিনড্।
যে কবিতাটি লিখতে চেয়েছিলাম,না-লেখার
অক্ষমতাকে ঢেকে কাছাড় ক্লাবে গিয়ে গলায়
ঢেলেছি মহাকাশ নাড়িয়ে দেওয়া তরল।
বুঁদ হয়ে শুনেছি হাসন,ব্রামস,লাপিনসাই,অতুলপ্রসাদ।
সারাজীবন অনেক অপছন্দের কাজ সেরে এবার
গুছানোর পালা।সমস্ত দিনের শেষে সায়ংকালের আলোয়
কোথাও তো আমাদের ফিরে যেতে হবে,অমিতাভ।
ছবি- ভ্যান গঘ