রবি-মায়ের গানের আঁচল
অনুজপ্রতিম কবিবন্ধু আগরতলার প্রবুদ্ধসুন্দর করের বাড়িতে ঢাকার কবি ও চিত্রশিল্পী সঞ্জীব পুরোহিতের আঁকা রবীন্দ্রনাথের একটি ছবি দেখেছিলাম। শিরোনাম : ‘রবীন্দ্রনাথ আমার মা’। ছবিতে রবীন্দ্রনাথের কপালে লাল সিঁদুরের একটি ফোঁটা দেওয়া ছিল।
মা মানে আশ্রয়। মা মানে আঁচল।
তাই আজকের পৃথিবীতেও, আজকের ভারতেও , যখন ধর্মান্ধতা উগ্র হয়ে ওঠে, প্রতাপের রাজনীতি এসে ঢেকে দেয় মানবিকতার মুখ , ঘৃণার ঘূর্ণি এসে উড়িয়ে নিয়ে যায় ভালবাসার ফুল, হৃদয়বান আর বিবেকবান মানুষ আশ্রয় খুঁজে পান রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিতেই—- খুঁজে পান আশ্রয় এমনকী তাঁর গানেও—যে গান কিনা বাস্তবের সঙ্গে কখনও প্রত্যক্ষ সম্পর্ক স্থাপন করে না, যে গান সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ নিজেই বলে গেছেন :
‘ গান সম্পূর্ণ আলাদা জিনিস। গানের সুরে যেন অসীমের সঙ্গে একমুহূর্তে একটা যোগাযোগ ঘটে যায়। এমনটি আর কিছুতে হয় না।’ ( গুরুদেব, রানী চন্দ, পৃ.৭৬)
অমন যে অসীমতার শয্যাসঙ্গী গান, তার ভেতরেও রবীন্দ্রনাথ ছড়িয়ে দেন সীমার বীজ। ঠিক যে ভাবে তাঁর নিজের সমকালীন গানের জাতীয়তাবাদী হুংকার কিংবা ওজস্বিতাকে তিনি হারিয়ে দেন তাঁর এমনকী স্বদেশপর্যায়েরই গানে। সেখানেও তিনি বিছিয়ে দেন তাঁর নিজের ভেতরে বাস করা এক মায়েরই আঁচল।
‘ তোমার ছেঁড়া কাঁথা আছে পাতা, ভুলতে সে যে পারব না মা!’
‘শাসনে যতই ঘেরো
আছে বল দুর্বলেরও…’
‘ আছে যারা বোবার মতন
তারাও কথা কবেই কবে।’
‘ও মা,আমার যে ভাই তারা সবাই,
ও মা তোমার রাখাল তোমার চাষি।’
সর্বোপরি, সেই অত্যাশ্চর্য
‘আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে—’
এগুলোকে কী বলব আমরা? নবজীবনের গানের আদিরূপ, বাঙালির গণসঙ্গীতের পূর্বাভাস? জীবনমুখী গানের সলতে- পাকানো? নাকি রবীন্দ্রনাথেরই লেখা গণসঙ্গীত?
* * * * *
পরিপ্রেক্ষিত থেকে বাইরে এনে general truth হিসেবে নয়, পরিপ্রেক্ষিতের ভেতরে ফেলে particular truth হিসেবে রবীন্দ্রনাথের গানকে ব্যাখ্যা করার একটা ধারা প্রচলিত আছে। কিন্তু রবীন্দ্রসঙ্গীত তো হিন্দিছবির গান নয় যে কোন দৃশ্যে হিরো হিরোইনকে
কোলে তুলে কৃত্রিম ফুলবাগানে তার সঙ্গে নাচতে নাচতে গানটি গেয়েছিল— তার কথা মনে রাখতেই হবে। রবীন্দ্রনাথের গান তো কালজয়ী। তাকে আবার তার পরিপ্রেক্ষিতে টেনে এনে ফেলার মানে কি এরকম দাঁড়ায় না যে
‘ আনন্দধারা বহিছে ভুবনে’ গানের আগে খানিকটা মালকৌষ ভেঁজে নেওয়া হল?
এক একটা রাগ তো এক একটা অভ্যাস। এক একটা ছক। আর রবীন্দ্রনাথ, যেমন তাঁর জীবনে ও কর্মে, যেমন তাঁর ভাবনায় অভ্যাসকে অতিক্রম করে গেছেন বারে বারে— তেমনি তাঁর গানে, গানের সুরে ও কথায় তিনি মুক্তি খুঁজেছেন সমস্ত বদ্ধতা থেকে। টপ্পাঙ্গের গান তাঁর অবশ্যই আছে, কিন্তু তা শেষ পর্যন্ত বৈঠকখানায় বন্ধ হয়ে থাকে না। বেরিয়ে পড়ে খোলা হাওয়ায়, উন্মুক্ত প্রান্তরে, আঁধার রাতের একলা পথিকের প্রশ্নে প্রশ্নে, খোলা হাওয়া পালে লাগিয়ে, তুফানের মধ্যে। এও কি জেগে-ওঠার গান নয়? গণসঙ্গীত নয়?
* * * * *
রবীন্দ্রনাথের গানের একটা অভিমুখ নির্জন এককের পথে, কিন্তু আর একটা মুখ আছে তার। সেই মুখটা বাইরের দিকে ফেরানো। অনেকের দিকে ঘোরানো। সকলের দিকে ফেরানো। মানুষের সঙ্গে মিশে যাওয়ার মুখ। মা তো তিনিই যিনি নিজের ব্যক্তিগতর চেয়ে সন্তানের চাওয়া-পাওয়াকে বেশি প্রশ্রয় দেন। এই যুক্তিতে রবীন্দ্রনাথের এই গানগুলি একজন মায়ের লেখা গান বলে মনে হয় আমার । যে লোকটা
‘ ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার’ লিখছেন, লিখছেন ‘আজি বিজন ঘরে নিশীথরাতে আসবে তুমি’, লিখছেন ‘ভ্রমর সেথা হয় বিবাগী নিভৃত নীল পদ্ম লাগি’, সেই একই লোক লিখছেন
‘ আজি বরষার রূপ হেরি মানবের মাঝে’। ভাবা যায়?
অর্থাৎ তাঁর একটা গান চলছে নিজের দিকে, ভেতরবাড়ির দিকে, জীবন দেবতার দিকে, আর একটা গান চলছে মহামানবের দিকে। এই মহামানব —যার কথা রবীন্দ্রগানে ফিরে ফিরে আসে, তা নিশ্চয়ই
কোনও Superman বা Spiderman নয়?
এই মহামানবের একটা খুব সহজ সংজ্ঞা তো লুকিয়ে আছে প্রকৃতি’র ‘বর্ষা’ পর্যায়ের ‘ বরষার রূপ হেরি মানবের মাঝে’র মধ্যে । আর একটা রূপ আছে স্বদেশ পর্যায়ের সেই ‘ হে মোর চিত্ত’ গানে। যেখানে কেবলমাত্র ‘ ব্রাহ্মণ’ কেই মন শুচি করে সবার হাতে হাত ধরার কথা বলছেন রবীন্দ্রনাথ। যেখানে ভারতবর্ষকে হিন্দু- মুসলমান-আর্য-অনার্য-খ্রিস্টান-পতিত-নিরপেক্ষ এক ইতিহাসের বহমান ধারা হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেছেন তিনি। সে গানে মহামানব মানে তো জাত-ধর্ম-বর্ণ-নিরপেক্ষ মানব-সমুদয়। এই গান যদি আজকের ভারতের প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক গান না হয়, তাহলে প্রকৃত রাজনৈতিক গান কোনটা? মনে রাখতে হবে এই রবীন্দ্রনাথই অচলায়তন ভাঙার কথা বলেছেন, তোতাপাখিদের স্কুলে শেষপর্যন্ত যে প্রাণেরই মৃত্যু হয় তা দেখিয়েছেন, আবার ভিন্ন ধর্মের, ভিন্ন দেশের গোরাকে অনায়াসে ভারতীয় বলে গ্রহণ করেছেন।
* * * * *
১৯৩০ -এর গ্রীষ্মে জার্মানিতে আইনস্টাইনের সঙ্গে দ্বিতীয় আলাপচারিতায় রবীন্দ্রনাথ অত অত বাংলা গানের ধারার মধ্যে একমাত্র কীর্তনের কথাই বলছিলেন ,অবশ্য আলতো করে ছুঁয়ে গিয়েছিলেন হিন্দুস্থানি গানের ধারাটিকেও। ‘ In Bengal we have a kind of song— Kirtan, we call it—which gives freedom to the singer…’ প্রসঙ্গ অবশ্যই গায়কের স্বাধীনতার । কিন্তু আমাদের তো কীর্তন প্রসঙ্গে এ কথাও মনে পড়ে যায় যে কীর্তন বাউলগানের মত একক মানুষের গান নয়, অনেকের গান তা, মনের মানুষের গহন, নির্জন পথের দিকে না গিয়ে সবাইকে নিয়ে মেতে ওঠার গান। হয়ত এই কীর্তনই, এই ‘হরিবোল’ ধ্বনিই ছিল বাঙালির প্রথম স্লোগান, বাংলার প্রথম গণসঙ্গীত। অনেকে এমনটা ভাবেন, বলেনও।
আমাদের কবীর সুমন যেমন, ‘জনগণমন’র ‘জয় হে জয় হে জয় হে’র সুরে ‘হরিবোল হরিবোল হরিবোল’ ধ্বনির সুর আবিষ্কার করে সবাইকে বিস্মিত ও মুগ্ধ করে দিয়েছিলেন।
* * * * *
দেখুন, এটা কী রকমের আশ্চর্যের ব্যাপার না? বঙ্কিমের ‘বন্দে মাতরম’ ধর্মীয় কারণে বাদানুবাদের জন্ম দিলেও (আমাকে ভুল বুঝবেন না, আমি ব্যক্তিগতভাবে অসম্ভব বঙ্কিমভক্ত), যে- ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগ হল, সেই একই মানচিত্র যখন ভাষার ভিত্তিতে দ্বিতীয়বার আবার ভাগ হল তখন কিন্তু ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটিকে জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে গ্রহণ করতে কেউ বিরূপ হলেন না। অথচ ওই গানেও তো দেশকে ‘মা’ই বলা হয়েছে। কিন্তু এই মা কোন মা? এ তো বাঙালির ঘরের মা! এর তো হিন্দু-মুসলমান ভাগ হয় না। তাই এই মা-র চরণেতে মাথা পেতে দিতে কারও কোনও আপত্তি ওঠে না।
কারণ এই মা গরিবের ধন, রাখাল, চাষি সকলের মা।
কারণ এই গান গণজনতার সঙ্গীত।
কারণ এই গান যে লিখছেন, শেষ বিচারে, একজন মা-ই!!
ছবি- সূরজ মোহান্ত