Daruharidra
  • ধান্যগৃহ
  • কবিতা
  • গল্প
  • গদ্য
  • প্রবন্ধ
  • উপন্যাস
Daruharidra
  • ধান্যগৃহ
  • কবিতা
  • গল্প
  • গদ্য
  • প্রবন্ধ
  • উপন্যাস
Daruharidra
No Result
View All Result
Home গদ্য

সপ্তর্ষি বিশ্বাস

একরাত্রি-দুইরাত্রি

Daruharidra by Daruharidra
04/06/2020
in গদ্য
0
সপ্তর্ষি বিশ্বাস
36
VIEWS

একরাত্রি,দুইরাত্রি


 

… তারপর “সর্বস্য জগতো ধাত্রী শর্বরী প্রত্যপদ্যত”। এই মহাবিশ্বের মহাধাত্রী রজনীর আগমন হল মঞ্চে। “অস্তে গেল দিনমণি; আইলা গোধূলি”। গ্রহনক্ষত্রতারার অলঙ্কারে উদ্ভাসিত রাত্রির আকাশছায়ায় রাত্রিচরেরা উৎফুল্ল, উল্লসিত হয়ে উঠল। ” এখানে নামল সন্ধ্যা। সূর্যদেব,এখানে সবাই ধূসর আলোয় দিনের শেষ খেয়া পার হল।.. পান্থশালার আঙিনায় এরা কাঁথা বিছিয়েছে; কেউ বা একলা, কারো বা সঙ্গী ক্লান্তা; সামনের পথে কী আছে অন্ধকারে দেখা গেল না, পিছনের পথে কী ছিল কানে কানে বলাবলি করছে; বলতে বলতে কথা বেধে যায়, তার পরে চুপ করে থাকে; তার পরে আঙিনা থেকে উপরে চেয়ে দেখে, আকাশে উঠেছে সপ্তর্ষি”। অথচ যাদের পেছনে আততায়ী, গুপ্তচর – তারাই জায়গা পেলো না কোনো পান্থশালায়। জায়গা পেলো না নাকি নিল না যাতে আততায়ীরা, গুপ্তচরেরা তাদের সন্ধান না পায়? হয়তো তা’ই। তাই তারা নিল বনপথ। অরণ্যসংকুল অন্ধকারের ভিতর দিয়ে নিল পথ সূচীভেদ্যতার।
কারা এরা? এই পলাতকেরা? যদি এরা হয় কাহিনির প্রথম রাত্রির অন্তর্গত চরিত্রেরা তাহলে এদের আবহে দাউদাউ আগুন। মরা পোড়া গন্ধ। যদি এরা হয় কাহিনির দ্বিতীয় রাত্রিটির অন্তর্গত তাহলেও এদের আবহে দাউদাউ আগুন। মরা পোড়া গন্ধ। তবে তফাৎ এই, যে, প্রথম রাত্রির অন্তর্গত আগুনে শুধু পুড়ে যাচ্ছে একটি অট্টালিকা আর তার ভিতরে মাতাল হয়ে ঘুমিয়ে থাকা ছ’জন নারীপুরুষ। হত্যাকারীরা পলাতক। তাদেরও পেছনে ঘুরছে চর, আততায়ী। দ্বিতীয় রাত্রির অন্তর্গত আগুনে দাউ দাউ জ্বলছে চিতা। অনেক অনেক চিতা। পুড়ে পুড়ে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে কত তাঁবু, কত গৃহ, কত আঙিনা। এখানে হত্যাকারী বলে চিহ্নিত করা যায় না কাউকে, করা যাবে না কাউকে। সংগত যুদ্ধে একদল হারিয়ে দিয়েছে আরেক দলকে। সুতরাং যারা হারল তাদের সকলেই আততায়ী, তাদের পেছনে ঘুরছে চর। তারা পলাতক। ফেরার তাদের রাজা।…আর এই দুটি রাত্রিকেই একটি রেখায়, একটি শ্লোকরেখায় ধরে রাখতে চাইছেন এক কবি, দ্বীপবাসী এক কবি। বেজন্মা তবু অমর এক কবি।
রাত্রি এক আশ্চর্য রহস্য। আশ্চর্য বিস্তার। প্রশান্তি। হলাহল। জলবিন্দু জমতে জমতে যেমন বরফ, তুষার, তুষারে আবৃত মহাপর্বত তেমনি সন্ধ্যা জমে জমে রাত। রাত্রি। প্রদীপের, মোমের আলো জমতে জমতে তারা, জোনাকি, হলাহল। রাত্রির যোনিতে ফুটে ওঠে রজনীগন্ধা, রাত্রির স্তনে দাঁত বসায় হিংস্র চিতা, রাত্রির নাভিতে ঝলসে ওঠেন কালপুরুষ, রাত্রির চুলে জমাট বাঁধে নরকের মেঘ। রাত্রির অরণ্যের ভিতর দিয়ে চলতে চলতে শ্রান্ত হয় তারা। তারা ঘুমিয়ে পড়ে। সক্কলে। না, সক্কলে নয়। একজন জেগে থাকে। দুইটি রাত্রির গহনেই একজন করে জাগ্রত মানুষ। তাদের মাঝখানে প্রায় তেরো চোদ্দ বছরের ব্যবধান, তাদের মাঝখানে একটি জতুগৃহের পুড়ে যাওয়া, তাদের মাঝখানে সংখ্যাতীত মানুষের, হস্তি-অশ্বের লাশ, লক্ষ লক্ষ ভগ্ন রথ, ভগ্ন ঊরু, কাদায় গেঁথে যাওয়া রথের চাকা। বাতাসে বারুদঘ্রাণ , ভয়, অহং,কামনা…
প্রথম রাত্রির অন্তর্গত মহারণ্যের গহনে পিস্তলের ঘোড়ায় আঙুল রেখে ঝোপঝাড়ের আড়ালে ঘুমন্ত মা আর ভাইদের পাহারা দিয়ে বসে আছে যে অনুপম যুবক, গরমে, ঘামে যে খুলে রেখেছে তার গায়ের জিনজামা,অব্যবহিত পূর্বে তাকেই আমরা দেখেছি অরণ্যের অলিগলি ঘুরে সন্ধান করতে পানীয় জলের, দেখেছি চর্মপাত্র ভরে জল নিয়ে ফিরতে। ফিরে এসে দেখে মা আর ভাই রা ঘুমিয়ে পড়েছে ততক্ষণে। অতএব চর্মপাত্রটি পাশে রেখে গায়ের জামা খুলে বসে পড়ল সে। কোমর থেকে খুলে হাতে নিল পিস্তল। জেগে রইল মা আর ভাইদের পাহারাদার হয়ে। জেগে জেগে কি ভাবল সে? ভাবে সে? সে কি ভাবে তাদের অনাগত ভবিষ্যের কথা? নাকি প্রতিশোধ স্পৃহায় খলবল করে ওঠে তার শোণিতের সমূহ শ্বেত আর লোহিত কণিকারা? তার শোণিতের আগুনেই কি সে জ্বেলে নিল তার কড়া সিগারখানি অনেকটা “গুড্, ব্যাড, আগ্লি” র ক্লিন্ট ইস্টুড স্টাইলে? নাকি সে ভাবে ওই প্রাসাদটির কথা যেখানে এখন মদ আর মেয়েমানুষের সেলিব্রেশনে লাউডস্পিকারে বাজছে “তু চিজ বড়ি হ্যায় মস্ত মস্ত” আর এই ভিড়ের নাভিতে বসে এক অন্ধ পিতা কিছুতেই নিঃশঙ্ক হতে পারছেনা… নিঃশঙ্ক হতে পারছে না কেননা বারবারই তার মনে হচ্ছে সুরা আর গন্ধকে বানানো ওই মৃত্যুফাঁদটি ত পুড়েছে ঠিক কিন্তু তার ভিতরে যারা ছিল তারা কি… যুবক কি এও ভাবে, যে ওই প্রাসাদে বাস করবার কতখানি অধিকারী সে আর তার ভ্রাতারা এবং মাতা? সে ত জানে না সে নিজে, না তার ভাই রা কেউ তাদের মার বিয়ে করা বাপের ছেলে, সে ত জানে বাপ মরবার পর মা কিভাবে এদের এনে প্রতিষ্ঠিত করবার চেষ্টা করেছে অন্ধ জ্যাঠামশাই এর এই প্রাসাদে.. কিন্তু অন্তিমে প্রতিষ্ঠা নয়, তারা থেকে গিয়েছে আশ্রিতই। তথাপি নির্মিত হয়েছে এক প্রতিযোগিতার, প্রতিদ্বন্দ্বীতার পটভূমি। এই প্রতিযোগিতার, প্রতিদ্বন্দ্বীতার দায় কি শুধু অন্ধ জ্যাঠামশায়ের ছেলেদের আর অন্ধ জ্যাঠামশাইটির? এই উড়ে এসে জুড়ে বসা ভ্রাতাদের কি কোনো দায়ই নেই? কখন, কিভাবে এই প্রতিযোগিতা, প্রতিদ্বন্দ্বীতা পরিগ্রহ করলো এই খুনে চেহারা, এই অমানুষিক অবয়ব যাতে জ্যাঠতুতো ভাইদের বানাতে হল, জ্যাঠামশাই এর যোগসাজশেই সুরা আর গন্ধকের মরণফাঁদ – এই “উড়ে এসে জুড়ে বসা”দের নিধন নিমিত্ত?… রাত্রি হয়ে ওঠে নিবিড়তর। রাতপাখিদের ডানা যেন উড়ে যায় এই সূচীভেদ্যতার সতীচ্ছেদচ্ছিন্ন করে। ভেসে আসে অচেনা ফুলের অজানা ঘ্রাণ। রাত্রির নাভিতে ক্রমে উঠে আসেন কাল। মহাকাল। কালপুরুষ। যুবক অকস্মাৎ টের পায় উপস্থিতি। প্রাণীর উপস্থিতি। দ্বিপদ প্রাণীর উপস্থিতি। তবে কি – তার আঙুল সামান্য চাপ দেয় পিস্তলের ঘোড়ায়। তীব্র তবু মা-ভাইদের ঘুমের ব্যাঘাত না ঘটানো গলায় সে বলে নড়বেনা। যেই হও নড়বেনা। আমার পিস্তলের নল তোমার দিকেই তাক করা। আর আমাকে জানলে এও নিশ্চয় জানো অন্ধকারেও আমার গুলি ফস্কায় না।
রাত্রি হয়ে ওঠে নিবিড়তর। দ্বিতীয় এই রাত্রির গহনেও রাতপাখিদের ডানা যেন উড়ে যায় সূচীভেদ্যতার সতীচ্ছদচ্ছিন্ন করে। ভেসে আসে অচেনা ফুলের অজানা ঘ্রাণ। রাত্রির নাভিতে ক্রমে উঠে আসেন কাল। মহাকাল। কালপুরুষ। তিনজন শ্রান্ত, পরাজিত পুরুষ বসে পড়ে বৃক্ষতলে। তাদের একজন আজ দেখেছে হত্যা, নিজ পিতার। দেখেছে পিতার কাটামুণ্ড দিয়ে প্রতিপক্ষের গুণ্ডাদের ফুটবল খেলা। তারা সক্কলে দেখেছে। দেখেছে আঠারোটি দিনরাত্রি ধরে মৃত্যুকে। শিয়ালকুকুরের মতন মরেছে মানুষ। মরেছে এই তিনজনের হাতে। তারা যে পক্ষের খুনি তাদের হাতে। মরেছে বিপক্ষের হাতে। তারা দেখেছে কালা যাদু। দেখেছে গণ সম্মোহন বিদ্যার প্রয়োগে একটা মানুষ কিভাবে ধুলো ছুঁড়ে দিতে পারে সমবেত যুযুধানদের চোখে। জাগাতে পারে ভয়। ভয়জনিত সমীহ। তারা দেখেছে কিভাবে নিয়ম ভাঙে রেফারি। বিলো দ্য বেল্ট চাকু চলে। বার হয়ে আসে লুকানো বাঘনখ। ভাঙা ঊরু নিয়ে তাকেই পালিয়ে যেতে হয় লোকচক্ষুর আড়ালে, জান বাঁচাতে, যে ছিল আসলে রাজা, তাকেই। তারই ত প্রাসাদে এসে জুটেছিল ওই বেহায়া মহিলা, তার কাগুজে বর জঙ্গলে মরলে, তার বেজন্মা ছেলেদের নিয়ে। আজ দেখো সেই উড়ে এসে জুড়ে বসা বেজন্মার দলই রাজা। আর আসল রাজা.. হায়। শ্রান্তিতে চোখ বন্ধ হয়ে আসে। আসে ঘুম। ঘুমের যোনিতে আশ্রয় নেয়, হামাগুড়ি দিয়ে, দুইজন। তৃতীয় জন, যে বয়সে সর্বকনিষ্ঠ, যার বাপ খুন হয়েছে আজই, ঘুম আসেনা তার চোখেই শুধু। সে দেখে রাত্রি হয়ে ওঠে নিবিড়তর। সে দেখে রাত্রির গহনে রাতপাখিদের ডানা যেন উড়ে যায় সূচীভেদ্যতার সতীচ্ছদচ্ছিন্ন করে। ভেসে আসে অচেনা ফুলের অজানা ঘ্রাণ। রাত্রির নাভিতে ক্রমে উঠে আসেন কাল। মহাকাল। কালপুরুষ। সে টের পায় একটি উড়ে আসা। একটি ডানার সম্মানিত সঞ্চার। সে তাকায় উর্ধে। বৃক্ষশাখার দিকে। রাত্রিকে ভেদ করে তার দৃষ্টি উড়ে যায় বৃক্ষশীর্ষে। সে দেখে…
” আমাকে গুলি করে অযথা গুলি আর পুণ্য দুই’ই খরচ কর না, হে পুরুষশ্রেষ্ঠ! আমি, হই এক অবলা নারী “ – বলেই দিয়াশলাই কাঠি জ্বেলে ধরল যে, সে সত্যই, হয়, একটি মেয়েমানুষ। ষোড়শবর্ষদেশীয় মেয়েমানুষ ,দিব্যাভরণ-ভূষিতা । যুবক দেখল কামিনী লজ্জাবনতসহাস্যবদনে মৃদুমন্দগমনে এগিয়ে আসছে তার দিকে। চনমন করে উঠল তার শরীর। মাত্র ঘন্টা তিন আগে খোয়ানো প্রাসাদ-যাপনের দিনগুলি তার মর্মে দপদপিয়ে উঠল বেলোয়াড়ি ঝাড়হেন। গণিকা বল, সাধারণী, পুংশ্চলী নগরশোভিনী আর মুহূর্তিকা যাই বল, তাদের প্রত্যেকের সঙ্গে কাটানো প্রতিটি মুহুর্ত যেন শরীরী হয়ে জ্বলে উঠল এই পূর্ণশশিসম বদন, এই পুষ্পমালায় পরিবেষ্টিত কবরী ,ভ্রূ, চক্ষুঃ ও কেশান্ত একান্ত মনোহর, সৰ্বাঙ্গ বিচিত্রাভরণ-ভূষিত ও সূক্ষ বস্ত্র পরিহিতা এই মেয়েটির অবয়বে, উপস্থিতিতে। যেন এই নিশ্ছিদ্র অন্ধকারেও যুবক দেখতে পেলো মেয়েটির আগুন-শরীর, তার জ্বলন্ত বদ্বীপ, তার করুন শঙ্খের মতো স্তনযুগ। লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল যুবক। যেন এই মুহূর্তেই সে আলিঙ্গন করবে ঐ মেয়েকে। ছিঁড়ে ফেলবে তার সূক্ষ বসন। কামড়ে খাবে … কিন্তু যদিও তখন দূরের রেডিওতে ভেসে আসছিল গানের কলি, “রাত নশিলী, মস্ত্ সমা হ্যায়, আজ নেশে মে সারা জাঁহা হ্যায়” তথাপি হঠাৎই থমকে গেল যুবক। তার শিরদাঁড়া বেয়ে উঠে এল সন্দেহের এক সরল সর্পিনী। কে এই রমণী? চর নয়তো সেই অন্ধ রাজার বজ্জাৎ ছেলের? মুহূর্তমাত্র এই থামা। তারপরই ছুটে গিয়ে কোমর চেপে ধরল সে মেয়েটির। কন্ঠনালীতে পিস্তল ঠেকিয়ে বলল “কে তুই? তুই কে? কে তোকে পাঠিয়েছে আমাদের ফোলো করতে?” মেয়েটি আলতো হাতে পিস্তলের মুখ সামান্য সরিয়ে দিয়ে বলল, “গুলি করতে চাইলে সে সময় তুমি পাবে। আমি পালাচ্ছিনা। ” তোমরা কি জান না যে, এই গহনবন ডাকাতদের আবাসস্থান? এদের সর্দার হরি সিং অক্কা পেলেও হরি সিং’এর ছেলে গব্বর সিং নামে এক পাপাত্মা এখনকার সর্দার। সেই দুরাত্মা আমার ভ্রাতা। সে তোমাদের লুট করবার জন্যই তোমাদের বধসাধনাৰ্থ আমাকে পাঠিয়েছিল। যাই হউক, তুমি যখন ওই মোটকা বিড়িটা জ্বালালে তখনই, এক ঝলকে, আমি তোমার রূপলাবণ্য দর্শনে মোহিত হয়েছি। আমার খাকি জামা প্যান্ট আর কোমরের পিস্তল রেখে, এই দেখো, বুলেট-বেল্টের দাগ বসে গেছে কোমরে, সব পাল্টে নিরস্ত্র হয়ে এসেছি তোমার কাছে, তোমাকে পতিত্বে বরণ করিতে ইচ্ছা করি, হে ধর্মেন্দ্র! এক্ষণে যাহা-তোমার উচিত হয়, কর। আমি কামাতুর! এই দেখো, বিশ্বাস না করলে হাত দিয়ে দেখ, এখানে, দেখছ… ভিজে সপ্ সপ্ করছে – ইঃ – আমি স্বয়ং তোমাকে বরণ করবার প্রার্থনা করছি…”
যুবকের হাত কোন যাদুবলে যে মেয়েটি কখন নিয়ে গিয়েছে, সূক্ষবস্ত্রের অন্দরে, তার সিক্ত কোমলাঙ্গে, যুবক জানেনা।
“এখন বল, তুমি কে? তোমরা কে? কোত্থেকে আসছ? এই যে দেবরূপী পুরুষগণ কুন্ডলী পাকিয়ে ঘুমিয়ে রয়েছেন এঁরা তোমার কে? আর এই যে তপ্তকাঞ্চনসন্নিভ রূপশালিনী সুকুমারী নিজের বেডরুমে শুয়ে ঘুমানোর মতো করে এই নির্জন বনে বিশ্বস্তচিত্তে নিদ্রা যাচ্ছেন, ইনিই বা তোমার কে?”
যেন মুহূর্তে সমস্ত ঝোপেঝাড়ে জ্বলে উঠল অসংখ্য জোনাকি। উলুধ্বনি দিয়ে উঠল ঝিঁঝিঁর দল। রাতপাখিদের ডানা যেন জাগালো ঝড় – অন্দরে বাহিরে। ঘুমন্ত মা আর ভাইদের কাছ থেকে মেয়েটিকে নিয়ে খানিকটা দূরে সরে এল যুবক – ঠিক যেমন বাঘ তার শিকারকে মুখে নিয়ে সরে আসে। তার মনে হল আর-সমস্ত যেন জলমগ্ন হয়ে গেছে কেবল-হাত-পাঁচ ছয় দ্বীপের উপর এই দুটি প্রাণী । যেন অপরূপ এক প্রলয়কাল, তখন আকাশে শুধুমাত্র তারার আলোই ছিল। পৃথিবীর সমস্ত প্রদীপ নিবে গেছে। যুবকের মনে হল “আজ সমস্ত বিশ্বসংসার ছাড়িয়া এই নারী আমার কাছে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে। আজ আমি ছাড়া তাহার আর কেহ নাই। কবেকার সেই শৈশব, বনে বনে খেলিয়া বেড়ানো কোন্-এক জন্মান্তর, কোন্-এক পুরাতন রহস্যান্ধকার হইতে ভাসিয়া, এই সূর্যচন্দ্রালোকিত লোকপরিপূর্ণ পৃথিবীর উপরে আমারই পার্শ্বে আসিয়া সংলগ্ন হইয়াছে এই মেয়েটি; আলোকময় লোকময় পৃথিবী ছাড়িয়া এই ভয়ংকর জনশূন্য প্রলয়ান্ধকারের মধ্যে সে স্ব ইচ্ছায় একাকিনী আমারই পার্শ্বে আসিয়া উপনীত হইয়াছে। এখন কেবল আর-একটা ঢেউ আসিলেই পৃথিবীর এই প্রান্তটুকু হইতে বিচ্ছেদের এই বৃন্তটুকু হইতে, খসিয়া আমরা দুজনে এক হইয়া যাই” … তৃণশয্যায় বিপরীত বিহারে রত হয়ে যুবক দেখল আকাশে লক্ষ লক্ষ তারা। দেখল তাদের মাঝখানে কাল। মহাকাল। কালপুরুষ। দেখল হেঁটে চলেছেন…
ঠিক তখুনি চার ব্যাটারী টর্চের জোরালো আলোয় ধাঁধিয়ে গেল যুবকের চোখ। রমণীর রতি বিহারে পড়ল ছেদ। মঙ্গলগীতের মতন ঝিঁঝিঁধ্বনি পরিণিত হল সাইরেনে। জোনাকিরা চোখ ঢাকল। যেতে যেতে থমকে দাঁড়ালেন কালপুরুষ।
যেতে যেতে থমকে দাঁড়ালেন কালপুরুষ। থমকে দাঁড়িয়ে তিনি দেখলেন নিরালোক অরণ্যমধ্যে কোনো এক বিরাট বটবৃক্ষের উর্ধ্ব শাখায় অসংখ্য বায়স স্ব স্ব আবাসস্থানে সুখে নিদ্রিত। আর তখুনি গরুড়ের ন্যায় বেগবান পিঙ্গলবর্ণ উলুক, যার সঙ্গে জীবনানন্দের পেঁচাদের কোনো মিলই নেই, যার মুখ ও নখর সুদীর্ঘ ঝাঁপিয়ে পড়ল সেই কাকের বাসায়। কালপুরুষ দেখলেন আরেক বৃক্ষতলে দুই ঘুমন্ত সঙ্গীর পাশে জেগে বসে থাকা এক যুবকও দেখছে পেঁচার এই সৌপ্তিক আক্রমণ। সে দেখছে, সে জেগে জেগে চেয়ে চেয়ে দেখল সুমহান পেঁচাটি কিভাবে ঘুমের মধ্যে এক এক করে খুন করে ফেলল তার চিরশত্রু কাকেদের। খুন করে ফেলল যুবা, বৃদ্ধ, বালক – সক্কলকে। তারপর শোণিত-আচমনহেতু তৃপ্ত হয়ে, তৃপ্ত মুখে সে ডানা মেলে দিল – যেনবা কালপুরুষেরই দিকে। অমনি ভেসে এল গান, রেডিওতে বাজানো গান, নির্ঘাৎ শত্রূ শিবিরের রাজপ্রাসাদের মস্তি-সংগীত,“বস্ আজ কি রাত হ্যায় জিন্দেগী, কাল হাম কাঁহা তুম কাঁহা, ইয়াম্মা ইয়াম্মা …” মনশ্চক্ষে ছবিটি দেখতে পায় যুবক, দেখতে পায় প্রাসাদটির ছবি যেখানে এখন মদ আর মেয়েমানুষের সেলিব্রেশনে লাউডস্পিকারে বাজছে “তু চিজ বড়ি হ্যায় মস্ত মস্ত” আর এই ভিড়ের নাভিতে বসে এক অন্ধ পিতা। সদ্য সমস্ত পুত্র হারানো এক পিতা। তার সামনে সমানে ধানাই পানাই করে চলেছে ধর্মরাজ আর তার যাদুকর ইয়ার। প্রবল শোকের মধ্যেও কিছুতেই নিঃশঙ্ক হতে পারছেনা অন্ধ পিতাটি।… নিঃশঙ্ক হতে পারছেনা কেননা বারবারই তার মনে হচ্ছে – এরা আমার ছেলেদের মেরেছে। আমাকেই বা এরা ছাড়বে কেন? কিম্বা আমার বৌ’কে? এখন ছেড়ে দিলেও কদ্দিন আর ছেড়ে রাখবে? এর চেয়ে ছেলেদের সঙ্গে যুদ্ধে গিয়ে …
যুবকটি ত্রস্তে জাগাল তার দুই ঘুমন্ত সঙ্গীকে। ভীতি আর স্মৃতির সঙ্গে এসে জুটেছে হাহাবাতাস হুহুবাতাস। হাওয়া উঠে আসছে সেই হ্রদ থেকে যেখানে তাদের প্রিয় রাজা, পরাজিত রাজা, ভগ্ন ঊরু রাজা … হায়, এখনো কি বেঁচে আছে? “ওঠো হে, সাথীরা ওঠো”
সাথীরা ওঠে। ধচমচিয়ে জেগে ওঠে। কেউ কি তাহলে খুঁজে পেয়ে গেল তাদেরও? তারাও কি খুন হবে ধর্মরাজের ঘাতক কিংবা গুপ্তঘাতকের হাতে? তুমুল বাতাস আসে দ্বৈপায়ন হ্রদ থেকে। ঝরে পড়ে গাছের পাতারা। সঙ্গে, যুবক দেখে সদ্য নিহত বায়সকূলের মৃত পাখা, মৃত ডানা ঝরে যায়। উড়ে যায়। সঙ্গীদের দৃষ্টি সন্দিগ্ধ। “কি ব্যাপার?”
“চল ঝাঁপিয়ে পড়ি। এই তো সুযোগ। প্রাসাদে বাঈজি নাচ চলছে ঠিকই। কিন্তু সৈন্য শিবিরে সব শালারা মাল নাহলে পাতা খেয়ে মস্তির ঘুম মারছে। গণিকা বলো, সাধারণী, পুংশ্চলী নগরশোভিনী আর মুহূর্তিকা যাই বলো, ট্রাক ভরে শিবিরে সাপ্লাই পাঠিয়েছে ধর্মরাজ। সেই বিকেলেই। এখন সব শালা কেৎরে আছে। এখনই সময় …”
সাথীদের চোখে, মনে তখনো শ্রান্তি, তখনো ভীতি। অতএব কোমরপকেট থেকে চর্মপাত্রটি বার করে আনে যুবক। কড়া ওল্ড মংক রাম ঢালে নিজের গলায়, ঢালে সাথীদের গলায়। তারা যেন একটু চাঙ্গা হয়। বলে,
কি ব্যাপার? এরকম তো কোনো পরিকল্পনা …
তোমাদের পরিকল্পনার মুখে ইয়ে করি। দেখলে না পেঁচার কান্ডখানা?
পেঁচার কান্ড? কোন কান্ড?
যা শাল্লা। তোমরা কি করে দেখবে? তোমরা তো ঘুম মারছিলে …
এইবার সবিস্তারে উলুপ-বায়স কাহিনীর বর্ণন দিল যুবক। বলল,“এই তো সুযোগ… এসো ওই বিদগ্ধ পেঁচকটিকে অনুসরণ করি। তারই মতো ঝাঁপ দিয়ে পড়ি শত্রুর ঘুমন্ত শিবিরে…”
“কিন্তু যুদ্ধের নিয়মে, বিশেষ করে ধর্মযুদ্ধের নিয়মে অস্ত্রহীন শত্রুকে, অপ্রস্তুত শত্রুকে, ঘুমন্ত শত্রুকে …”
“তাহলে বলি শোনো। অস্ত্রহীন শত্রু, হাঃ, আমার বাবা কি অস্ত্রহীন ছিলেন না যখন তাঁকে ওরা খুন করল? ভীষ্ম কি ছিলেন না অস্ত্রহীন? কর্ণ? কিংবা আমাদের রাজা দুর্যোধন? এঁরা কি আক্রান্ত হওয়ার কালে ছিলেন না অপ্রস্তুত? তাঁরা কি সময় চাননি? আর ধর্মযুদ্ধ? পরশুরামকে জিজ্ঞেস কর, সে বলবে দুনিয়ার সব ক্ষত্রিয়কে যেন তেন প্রকারেণ খুন করাই ধর্মযুদ্ধ, হিটলারকে জিজ্ঞেস কর, সে বলবে দুনিয়ার সব ইহুদিকে যেন তেন প্রকারেণ খুন করাই ধর্মযুদ্ধ, ভিএইচপি বলবে দুনিয়ার সব মুসলমানকে যেন তেন প্রকারেণ খুন করাই ধর্মযুদ্ধ, স্তালিন বলবে দুনিয়ার সব না-বলশেভিককে যেন তেন প্রকারেণ খুন করাই ধর্মযুদ্ধ। ওরা বলবে আমাদের সব্বাই কে ঝাড়ে বংশে নাশ করাই ধর্মযুদ্ধ। তোমরা আসতে চাইলে আসো, নয়তো এই আমি চল্লাম …”—অন্য দুই সঙ্গীজনকে ধোঁয়াশায় স্তম্ভিত করে রেখে যুবক চলল তার নিজ অশ্বের সন্ধানে।
“অরে বিপ্রিয়কারিণি ! বেটি ছিনাল! তুই ব্যাটামানুষ দেখেই মজেছিস আর তাই তোর এত দেরি! আমার চোখকে ফাঁকি দিয়ে আবার সাজগোজ করে আসা হয়েছে এ হারামজাদাকে পটিয়ে শোয়াশোয়ি করতে! আর এর জন্যে তুই আমাদের জাত ব্যবসায় বিঘ্ন উৎপাদন করতে উদ্যত হয়েছিস? রে ছিনাল মাগি, পরপুরুষাবিলাসীনি অসতি! তোকে ধিক্! তুই যার আশ্রয়বলে আমার এই মহৎ অপ্রিয়ানুষ্ঠান করলি, আমি তাহাকে তোর সমক্ষে এখনই পটল তোলাচ্ছি আর সঙ্গে তোকেও…” বিপরীত বিহারে স্থিত অবস্থায়, সঙ্গমবদ্ধ অবস্থায়ও যে মেয়েটি কাঁপছে তা টের পেলো যুবক। মেয়েটি শুনল যুবক বলছে, তার হাতে হাত রেখে বলছে, কানে কানে, প্রাণে প্রাণে বলছে “গো পৃথুশ্রোণি স্থির হও” আমরা শুনলাম যুবকের তীব্র কিন্তু অনুচ্চ স্বর, শুনলাম
“When you have to shoot, shoot. Don’t talk.” তারপরই একটি চাপা, যান্ত্রিক আওয়াজ। একটি অনুচ্চ আর্তনাদ। একটি পতনের শব্দ। তখুনি সমস্ত ঝোপেঝাড়ে আবার জ্বলে উঠল অসংখ্য জোনাকি। আবার উলুধ্বনি দিয়ে উঠল ঝিঁঝিঁর দল। পর পর তিনবার তুঙ্গ সহবাসের পর মেয়েটি এইবার উঠে গেল। স্খলিত পায়ে গিয়ে বসল উবু হয়ে, ভ্রাতার মৃত দেহের কিনারে। কিঞ্চিত দ্বিধাগ্রস্থ পায়ে যুবকও অনুগমন করল তার। বসে পড়ল তার কিনারে। বলল, আমি ,মানে ঠিক এটা চাইনি …

মেয়েটি যুবকের উপরে নিজ দেহের ভার ছেড়ে দিয়ে বলল, তুমি উচিত কর্মই করেছ। হে ধর্মেন্দ্র, তোমাকে দেখামাত্রই আমি জেনে গিয়েছিলাম পিতা হরি সিং এর ছেলে গব্বরের আজই শেষ রাত্রি। দিয়াশলাই এর আলোতে তোমাকে দেখামাত্র মনে মনে স্থির করলাম যে, এই মহাবাহু সিংহস্কন্ধ, কম্বুগ্রীব, কমলনয়ন, সুরূপ, যুবা পুরুষকে আমি পতিত্বে বরণ করব। আমি কখনই ভ্রাতার ক্রুর বাক্যানুসারে কাজ করিব না। পতিস্নেহ সহোদরস্নেহ অপেক্ষা বলবান।  বিশেষতঃ আমি তোমাদের বধ করে, তোমাদের যথা সর্বস্ব লুঠ করে ভ্রাতৃসন্নিধানে উপস্থিত করলে তা বেচে মাংসভক্ষণ ও মদ্য পানদ্বারা আমার ক্ষণকাল মাত্র তৃপ্তি হবে, কিন্তু যদি তা না করে এই যুবা পুরুষকে , তোমাকে, পতিত্বে বরণ করি, তাহলে আমি চিরকাল পরম সুখভোগে কালহরণ করতে পারি। অতএব, হে আমার আর্যপুত্র, তুমি এনিয়ে কিচ্ছু ভেবোনা। যত খারাপই হোক আর যতো ভালই হোক প্রত্যেক সম্পর্কই একটা অভ্যাস মাত্র। তাই আমার এই বিচলিতাবস্থা।

গব্বর মরেছে। এই বনে তোমার মা-ভাই’দের আর কোনো ভয় নেই। তাঁরা আরেকটু ঘুমিয়ে নিন । চলো আমি তোমাকে এই বনটা একটু ঘুরে দেখাই…

আর এর লাশ?

থাকুক। পরে শিয়ালে, শকুনে এর ব্যবস্থা করবে

হঠাৎই ঝিঁঝিঁরা যেন জেগে ওঠে। কে জানে এরাই সেই ঝিঁঝিঁ কিনা যারা প্রায় তেরো চোদ্দ বৎসর আগের আরেক রাত্রে, আরেক অরণ্যে প্রথমে দিয়েছিল উলুধ্বনি, তারপরে বাজিয়েছিল সাইরেন-স্বর, অন্তিমে আবার উলুধ্বনিতে পূর্ণ করেছিল বৃত্ত … যদি এরাই হয় সেই জোনাকি কিংবা তাদেরই নাতিপুতি, ভাগ্নেভাগ্নি, ভাইভাতিজা – ইত্যাদি, তাহলে এরা জানে যদিও রাত্রি দুটি আর তাদের অন্তর্গত চালচিত্র অনেকটাই একই ছাঁচের তবু এই দুই রাত্রির মাঝখানে পড়ে আছে সংখ্যাতীত প্রেম-পিরিতের, হিংসার, ঈর্ষার, লালসার, চক্রান্তের, প্ররোচনার, ছলনার, বন্ধুত্বের, শত্রুত্বের অলিপথ, গলিপথ। আর সেই সমস্ত অলিপথ, গলিপথ, অন্তিমে এসে মিলেছে এই ব্রহ্মান্ডহেন ধুধু ময়দানে, আঠারো দিনের তুমুল খুনাখুনিতে, সংখ্যাতীত শবের আর শব-রক্তের ভিড়ে, কাদায়। তারপর এই পথ চলে গেছে সেই প্রাসাদে যেখানে এখন অন্ধ রাজাকে ঘিরে সবরমতী আশ্রমের, “ঈশ্বর-আল্লা তেরে নাম, সব কো সুমতি দে ভগবান” গানাসহ, শান্তির আবহ নির্মাণে ব্যস্ত অন্ধরাজার ছেলেদের খুনিরা। এসব হচ্ছে পার্টিহলের এক কোনে। আর গোটা পার্টিহল্ জুড়ে বইছে সোমের বন্যা – শেম্পেন। গণিকায়,সাধারণীতে, পুংশ্চলী  আর নগরশোভিনী আর মুহূর্তিকাতে ভরে আছে পার্টিহল্‌। প্রাসাদের আনাচ কানাচ।

হঠাৎই ঝিঁঝিঁরা যেন জেগে ওঠে। এক্ষণে তাদের স্বর যেন দামামা। শোণিত মিশ্রিত কর্দমের উপর দিয়ে ছুটে যাচ্ছে তিনটি অন্ধকার অশ্ব। তিনজন অন্ধকার আরোহী। আকাশ ঘিরে ফেলেছে মেঘে। সময় সময় চমকাচ্ছে বিদ্যুৎ। দ্বৈপায়ন হ্রদের থেকে ভেসে আসা হিমবাতাসের সঙ্গে মিশে আছে হ্রদের কোনো আবডালে আশ্রয় নেওয়া, ভগ্ন ঊরু, পরাজিত রাজার হতশ্বাস, মৃত্যু যন্ত্রণা। ঘোড়ার খুরে খুরে ধূলি নয়, ছিটকে যাচ্ছে রক্ত। পরিচিতের রক্ত, অপরিচিতের রক্ত, বন্ধুর রক্ত, শত্রুর রক্ত। দূরের গ্রাম থেকে মাঝে মাঝে উঠে আসছে নারকীয় ক্রন্দনের কোরাস।

ঘোড়া থামে। তিনটি ঘোড়া। সৈন্য ছাউনির তোরণ পার্শ্বে। ঘোড়া থেকে নামামাত্র আরোহীরা আশ্চর্য হয়ে দেখল তাদের সামনে, যেন, সূচীভেদ্যতার গহন থেকেই, আমদানি হয়েছে তিনটি … তিনটি নটী, নটীই, তবে এরা বৃদ্ধা নটী। সামগ্রিক অন্ধকারের মধ্যে তাদের অবয়ব তাদের ত্বকের দীপ্তিতে সুস্পষ্ট। ভীত বোধ করল অশ্বারোহীরা। দিশাহারা বোধ করল। একি স্বপ্ন? একি মায়া? একি মরণের মাধুরীতে রঞ্জিত কোনো ছায়া? তিন সঙ্গীই হাত রাখল নিজ নিজ পিস্তলের ঘোড়ায়। একি দুরাত্মা ধর্মরাজের সেই কালোযাদুওয়ালা বন্ধুর কোনো নতুন কারসাজি? অপেক্ষাকৃত বয়স্ক দুইজন যুবাটিকে বলল, “ফিরে চল”। হয়তো যুবাও ফিরে যেত কিন্তু তখুনি নৃত্যে মেতে উঠল তিন বুড়ি মাগি। তাদের গলার মণিহারগুলি পলকে হয়ে গেল নৃমুন্ডের হার। তারা গেয়ে উঠল–

 

“কোথায় ছিলে, ছিলে কোথায় বোন?”

“আজকে ছিল আমার নিমন্ত্রণ”

“পুড়বে তবে আজকে এসব বন?”

“পুড়বেই তো, পুড়বে নিজের পাপে”

“সিংহাসনে চড়বে ধাপে ধাপে”

“যেই না চড়া অমনি খাবে সাপে”

 

তিন সঙ্গীর বয়োজ্যেষ্ঠজন আর পারলেন না। পিস্তল হাতে ছুটে গেলেন একটি অদ্ভুতের দিকে। “তোমরা কারা?” আশ্চর্য।  ছুঁতে পারা গেলনা সেই অলৌকিক নর্তকীজনকে। বরং কোত্থেকে যেন তাদের হাতে উঠে এল একেকটা জ্বলন্ত মোমবাতি। আরো আশ্চর্য এই যে, এই তুমুল ঝড়বাতাসেও কাঁপল না মোমের শিখা এক রতি। মোম হাতে এদের একজন এসে শিখাটি তুলে ধরল কনিষ্ঠতম জনের মুখের সামনে। বলল, গাঁইয়া-গাবর বুড়িদের ছড়াকাটার সুরেই বলল, সত্যি সত্যি অমর হবে তুমি , রাত্রিগুলি হবে তোমার অশ্বমেধের ভূমি।

আরেক নর্তকী জ্যেষ্ঠজনকে, ভাবনা নেই, ভাবনা নেই তোমার কোনো , বাপ, শুকাবে সব পাপের দাগ।

মধ্যমজনের প্রতি, নিজের মানুষ ছাড়া

সম্ভব নয় অন্য কারোর

তোমাকে খুন করা।

তারপর তিনজনকেই ধোঁয়াশায় স্তম্ভিত করে রেখে তারা মিলিয়ে গেল …

মিলিয়ে গেল হাওয়ায়, নাকি অন্ধকারে?

রাত্রির যোনি থেকে প্রকাশ ঘটল দিনের।

দিনের আলোয়, জেগে উঠে, মা আর ভাইরা দেখল তাদের শয্যার অনতিদূরেই পড়ে আছে অচেনা একটি পুরুষের গুলিবিদ্ধ মৃতদেহ। সামান্য দূরত্বে মেয়েলি জামা কাপড়, অন্তর্বাস ইত্যাদি। দেখল তাদের মধ্যম ভাই’এর জিন প্যান্ট, জিন শার্ট, গেঞ্জি, জাঙ্গিয়া, মোজা ইত্যাদিও জড়াজড়ি করে পড়ে আছে ওই মেয়েলি কাপড়চোপড়ের সঙ্গে। মেয়লি কাপড়ের মালকিন আর জিন প্যান্ট, জিন শার্ট, গেঞ্জি, জাঙ্গিয়া, মোজা’র মালিক – উভয়কেই দেখা গেলোনা দৃষ্টিসীমার অন্দরে। এক ভাই উঠল, কোমরের পিস্তলে হাত রেখে বলল, যাই, আমি দেখে আসি। – সে গেল। কিন্তু সে’তো দিনের গল্প। রাত্রির নয়। সে গল্প বলবে অন্য কেউ অন্য কোথাও।

রাত্রির যোনি থেকে প্রকাশ ঘটল দিনের।

দিনের আলোয় ধর্মরাজ সিং আর তার ম্যাজিশিয়ান বান্ধব, অন্যান্য ভাইরা আর তাদের কয়েকজনের গোটা কয়েকজন পত্নী ফিরে এল সৈনিক ব্যারাকে। তাঁবুতে পা দেওয়ামাত্র তারা দেখল রক্তের বন্যা। দলের একটি মানুষও নেই জীবিত। যেন চতুর উলুকের ঘুমন্ত বায়সকূল নিধনের মতন কোনো দুর্বৃত্ত এসে নিধন করে গিয়েছে সক্কলকে। দলের মহিলারা কান্নায় ভেঙে পড়ল।  ধর্মরাজ সিং আর তার ম্যাজিশিয়ান বান্ধব বার হয়ে এল তাঁবু থেকে। খানিক পরে এল ধর্মরাজ সিং। “কানাইলাল, এসব কার কান্ড বলে মনে হয় তোমার?” … কানাইলাল জবাব দিয়েছিল কি? সে জবাবের সত্যতাই বা ছিল কতদূর বা এই জবাবের ফলে আর কি কি ঘটেছিল – সে আরো অনেক কথা। যেন মহাভারত। কিন্তু সে’তো দিনের গল্প। রাত্রির নয়। সে গল্প বলবে অন্য কেউ অন্য কোথাও।

আমি রাত্রির সন্ততি। এই দুইটি রাতের কথাই গেলাম লিখে যে দুই রাত্রির মাঝখানে পড়ে আছে সংখ্যাতীত প্রেম-পিরিতের, হিংসার, ঈর্ষার, লালসার, চক্রান্তের, প্ররোচনার, ছলনার, বন্ধুত্বের, শত্রুত্বের অলিপথ, গলিপথ। আর সেই সমস্ত অলিপথ, গলিপথ, অন্তিমে এসে মিলেছে এই ব্রহ্মান্ডহেন ধুধু ময়দানে, আঠারো দিনের তুমুল খুনাখুনিতে, সংখ্যাতীত শবের আর শব-রক্তের ভিড়ে, কাদায়। তারপর এই পথ চলে গেছে সেই প্রাসাদে যেখানে এখন শুধু বল্মীকের বাস।

 

২রা মে – ৯ই মে

২০২০

বেঙ্গালোর

অলংকরণ- সপ্তর্ষি বিশ্বাস

Tags: একরাত্রি-দুইরাত্রিসপ্তর্ষি বিশ্বাস
Previous Post

মিলনকান্তি দত্ত | তৃতীয় সংখ্যা

Next Post

মনোজমোহন চক্রবর্তী | দ্বিতীয় সংখ্যা

Daruharidra

Daruharidra

Next Post
মনোজমোহন চক্রবর্তী | দ্বিতীয় সংখ্যা

মনোজমোহন চক্রবর্তী | দ্বিতীয় সংখ্যা

Leave a Reply Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

No Result
View All Result

RECENT POSTS

সঞ্জয় চক্রবর্তী

সঞ্জয় চক্রবর্তী

08/02/2021
শংকরজ্যোতি দেব

শংকরজ্যোতি দেব

24/01/2021
ঠাকুরমার খাতা

ঠাকুরমার খাতা

16/01/2021
রবীন্দ্রনাথ ও বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী জনগোষ্ঠী : রাবীন্দ্রিক সম্পর্কের  একশো বছর | প্রথম পর্ব

রবীন্দ্রনাথ ও বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী জনগোষ্ঠী : রাবীন্দ্রিক সম্পর্কের একশো বছর | প্রথম পর্ব

08/01/2021
মনোজমোহন চক্রবর্তী | দ্বিতীয় সংখ্যা

মনোজমোহন চক্রবর্তী | দ্বিতীয় সংখ্যা

05/09/2020

পলিয়ার ওয়াহিদ | তৃতীয় সংখ্যা

05/09/2020
পার্থজিৎ চন্দ | তৃতীয় সংখ্যা

পার্থজিৎ চন্দ | তৃতীয় সংখ্যা

03/09/2020
বিশ্বজিৎ | তৃতীয় সংখ্যা

বিশ্বজিৎ | তৃতীয় সংখ্যা

03/09/2020
সঞ্জয় চক্রবর্তী | তৃতীয় সংখ্যা

সঞ্জয় চক্রবর্তী | তৃতীয় সংখ্যা

03/09/2020
রজার রবিনসন | তৃতীয় সংখ্যা

রজার রবিনসন | তৃতীয় সংখ্যা

03/09/2020

RECENT VIDEOS

https://www.youtube.com/watch?v=77ZozI0rw7w
Daruharidra

Follow Us

আমাদের ঠিকানা

দারুহরিদ্রা
কুঞ্জেশ্বর লেন
(বরাকভ্যালি একাডেমির নিকটবর্তী)
নতুন ভকতপুর, চেংকুড়ি রোড
শিলচর, কাছাড়, আসাম
পিন-788005

ডাউনলোড করুন

সাবস্ক্রাইব

Your E-mail Address
Field is required!
Submit
  • আমাদের সম্পর্কে
  • লেখা পাঠানো
  • যোগাযোগ

Copyright © All rights reserved Daruharidra | Development by Prosenjit Nath

No Result
View All Result
  • ধান্যগৃহ
  • কবিতা
  • গল্প
  • গদ্য
  • প্রবন্ধ
  • উপন্যাস
  • সাক্ষাৎ পাতা
  • অনুবাদ পাতা
  • আর্কাইভ
  • আমাদের সম্পর্কে
    • লেখা পাঠানো
    • যোগাযোগ

Copyright © All rights reserved Daruharidra | Development by Prosenjit Nath