Daruharidra
  • ধান্যগৃহ
  • কবিতা
  • গল্প
  • গদ্য
  • প্রবন্ধ
  • উপন্যাস
Daruharidra
  • ধান্যগৃহ
  • কবিতা
  • গল্প
  • গদ্য
  • প্রবন্ধ
  • উপন্যাস
Daruharidra
No Result
View All Result
Home উপন্যাস

মিথিলেশ ভট্টাচার্য

বাবলির-জন্য-রূপকথা

Daruharidra by Daruharidra
04/06/2020
in উপন্যাস
0
মিথিলেশ ভট্টাচার্য
226
VIEWS

বাবলির জন্য রূপকথা | প্রথম পূর্ণাঙ্গ উপন্যাস


 

উফ্, আমাদের যে কী হবে–!
কিছুটা উদাস, কিছুটা হতাশ সুরে কথাটা নিজেকেই শোনাল জপমালা।

রান্নাঘরের পাট চুকিয়ে এই প্রায় বিকাল চারটায়, যা শুরু হয়েছিল সকাল আটটা থেকে,– ছেলে মেয়ে দুটিকে বিদায় করা ( ছেলের স্কুলের চাকরি, মেয়ের টিউশন), ওদের বাবা,ঠিকে ঝি ও নিজের জন্য একটা কিছু সকালিক খাবার তৈরি, পান সুপারি কাটা,ঠিকে ঝিকে দিনের কাজ বুঝিয়ে দেওয়া, দুপুরের রান্নার জোগাড়, চান, ঠাকুর পুজা, গয়লা দুধ আনলে তা জ্বাল দেওয়া, মাঝে মাঝে মোবাইলে এর তার কথার জবাব দেওয়া তারপর দিনের খাওয়া-দাওয়া,–। ওসব কিছু সেরে ক্লান্ত শরীরে বিছানায় সটান শুয়ে সকালে আসা খবরের কাগজে চোখ বুলিয়ে ওই উক্তি জপমালার।

ওর কাছেই আসনপিঁড়ি করে পূর্বাস্য হয়ে বিছানায় বসে গোপাল ভাঁড়ের ভাঁড়ামি দেখতে টিভির পর্দায় চোখ রেখেছিল মৃগাঙ্কমোহন। ছোটবোনের উক্তিটা কানে এল। পলকে ভাবল সে, কোন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ওমন শ্লথ, উদাস কন্ঠে কথাটা উচ্চারণ করল জপমালা।
সেকী এন আর সি নাকি ধর্ষণ?
দুটি খবরই তো এখন দৈনিক পত্রিকার প্রথম পাতা দখল করে আছে দীর্ঘদিন থেকে–।
এমন সময় পর্দা কাঁপিয়ে ছুটে এসে ঘরে ঢুকল বাবলি। খাটের সামনে দাঁড়িয়ে তার দীদনের উদ্দেশ্যে অভিমানী কন্ঠে বলল, ও দীদন, আমার কোনো মামা নেই কেন, মায়ের তো মেজোমামা আছে–!
মুখের সামনে থেকে হাতে ধরা কাগজ সরিয়ে বাবলির দিকে তাকিয়ে হাসির সুরে জপমালা বলে, কেন, তোমার মামা আছে না শিলং-এ?
মামাটাতো আসে না, তাকে দেখিও না–! চটপট জবাব বাবলির।
এখন থেকে তুই আমাকে মেজমামাদাভাই বলে ডাকিস,– মৃগাঙ্কমোহন হাসিমুখে বাবলির অভিমানহত গোমড়া মুখের দিকে তাকিয়ে বলে–।
ডাকব–। বলেই বাবলি আবার বাইরের দিকে ছুট লাগায়।
আয়, আমার কাছে শুবি একটু – জপমালা নাতনির ছুটন্ত ভঙ্গির দিকে তাকিয়ে স্নেহের সুরে ডাকে।
ততক্ষণে বাবলি ভোকাট্টা।
বাচ্চারা সব একইরকম। বড্ড খেয়ালি। এই একটা বলল তো ওই আরেকটি করল!
সারাদিনে দু’চোখের পাতা এক করবে না, সন্ধ্যা হলেই ঘুমানোর জন্য মাকে জ্বালাতে শুরু করবে,– হালকা অভিযোগের সুরে কথাগুলি বলে জপমালা আবার খবরের কাগজে চোখ রাখে।

নাতনির প্রতি জপমালার সস্নেহ অনুযোগ শুনে মনে মনে ভাবে মৃগাঙ্কমোহন একদিন, একসময় জপমালাও তো কত ছোট্টটি ছিল! চোখের সামনে সেসব অতীতদিনের ছবি যেন চকিতে ঝলসে ওঠে। তাদের সাত ভাই বোনের মধ্যে সবচেয়ে ছোট জপমালা। মা-বাবার একটু বেশি বয়সের সন্তান। তাদের তিন ভাইয়ের চোখের মণি জপমালা। কত আদরে-আহ্লাদে-শাসনে কোলে-পিঠে করে ওকে বড় করেছে। সবচে ছোট বলে অনেকখানি স্বাধীনতাও পেয়েছিল জপমালা। বাবার মৃত্যুর কয়েকবছর পর ওর বিয়ের জন্য তিনভাই উঠেপড়ে লেগেছিল। ওদের উপরের তিন দিদির বিয়ে হয়ে গেছিল বহুদিন। অতএব পুরো দায়িত্বটা ভাইদের উপরই বর্তেছিল। আর সেসময়ে ওরা জানতে পেরেছিল দীর্ঘদিন থেকে জপমালা একটি ছেলের সঙ্গে ভালবাসার সূত্রে আবদ্ধ।
সেসবদিনের প্রেম-ভালবাসা অনেকটা নিষিদ্ধ বস্তুর মতো ছিল। সাধারণ লোকে সহজে ব্যাপারটি মেনে নিতে পারত না। কোনো গুরুতর অন্যায়-অপরাধের সঙ্গে তুলনা হতো যুবক যুবতীর প্রেম- ভালবাসার সম্পর্ক!

মৃগাঙ্কমোহনের মনে আছে একবার তাদের পাড়ায়, পাড়ার দুই গার্জেনের মতো দাদা টুনুদা ও ঝুনুদা– ছেলে-মেয়েদের প্রকাশ্যে মেশামেশি নিষিদ্ধ করে নিদারুণ সতর্কতা জারি করেছিলেন। তখনকার সময়ে বাড়ির অভিভাবকেরাও ওদের মান্য করতেন, সমীহ করতেন। সে এক দিন গেছে, সময় গেছে, যুগ গেছে–!

জপমালা অবশ্য এগিয়ে এসে ভাইদের বলেনি যে সে তার নির্দিষ্ট প্রেমাস্পদকেই বিয়ে করতে চায়। বরঞ্চ উলটে তারা তিনভাই-ই ব্যাপারটি জানার পর থেকে যেন পড়েছিল বিষম ফাঁপরে । মৃগাঙ্কমোহন নিজে উদ্যোগী হয়ে ছেলেটির খবর নিয়ে জেনেছিল ছেলেটি সরকারি চাকুরে, তাদের পালটি ঘর। একটু স্বস্তি লাভ করেছিল এই ভেবে যে তাদের আদরের প্রিয় বোনটি রুচি বিগর্হিত কোনো কাজ করেনি।
তিনভাই নিজেদের মধ্যে পরামর্শ করে একদিন বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে হাজির হয়েছিল ছেলেটির বাবার কাছে। শান্ত, সৌম্য, সজ্জন, বিপত্নীক বৃদ্ধ ভদ্রলোক তাদের ফিরিয়ে দেননি, সাদরে গ্রহণ করেছিলেন তাদের প্রস্তাব। এবং তিনভাই ফেলছিল স্বস্তির নিঃশ্বাস।
আজ সেসব দিনের কথা অবিকল মনে পড়তে থাকে মৃগাঙ্কমোহনের।
জপমালার বড়মেয়ে জবার সন্তান বাবলি। বয়স বছর পাঁচ হবে। টোপা টোপা দু’খানি গাল, কাজল কালো টানা টানা ডাগর চোখ, গোলপানা মুখমণ্ডল, ববছাটের মতো মাথায় গুচ্ছ চুল, উজ্জ্বল শ্যাম গায়ের বর্ণ। ওকে দেখলেই কাছে টেনে আদর করতে ইচ্ছে করে। চটপটে দুরন্ত বাবলি। কথা বলে চটাস চটাস। কোনো জড়তা নেই জিভে, স্পষ্ট উচ্চারণ। এহেন বাবলির আকর্ষণেই মৃগাঙ্কমোহন জপমালার বাড়ি এসেছিল।একবেলা অন্ততঃ বাবলির সঙ্গে সময় কাটানো যাবে।
ফোন করে জপমালা বলছিল, অনেকদিন আসিসনি মেজদা ভাই, তোর প্রিয় নাতনি এসেছে বেড়াতে, দুপুরবেলা চলে আয়–!
এরকম মাঝেমাঝেই বিপত্নীক ভাইকে কাছে ডাকে জপমালা। মাঝে মাঝে দু’চারদিন গিয়ে ওর বাড়িতে ডেরাও পাতে। ভাবে মৃগাঙ্কমোহন, আমার আর কি, যেখানে রাত, সেখানে কাত-!

বেলা সাড়ে এগারোটা নাগাদ তুমুল ঝড়-বৃষ্টি মাথায় করে মৃগাঙ্কমোহন পৌঁছেছিল বোনের বাড়ি। ভাইবোন দু’জন শহরের দু’প্রান্তে বাস করে কী না। জপমালা থাকে তারাপুর শিববাড়ির শ্রীদুর্গা লেনে আর মৃগাঙ্কমোহনের বাড়ি হচ্ছে মেহেরপুর- ঘুংঘুরে বড় রাস্তার কাছে।
বাড়ি থেকে যখন মৃগাঙ্কমোহন বেরিয়েছিল তখন আকাশ ভাসানো রোদ থাকলেও কেমন একটা গুমোট গরম বোধও হচ্ছিল তার। বৈশাখ মাস তো এরকম হবেই৷ অটোতে ওঠার আগে হঠাৎ পশ্চিমের ফাঁকা আকাশের দিকে দৃষ্টি গিয়েছিল একঝলক, দেখেছিল সাদা কুয়াশার মতো মেঘ যেন ওখানে ক্রমে দানা বাঁধছে। বাঁধুক, শিববাড়ি রোড আর কতক্ষণ, তবে ইন্ডিয়া ক্লাবের চৌমাথায় অটো বদলাতে হয়। এই অদল-বদলেই যতটুকু দেরি। আর একটা জিনিস আছে যা প্রায় সময়ই যাত্রাপথের সময়কে দ্বিগুণিত করে দেয়। ওটা হচ্ছে জ্যাম। সকাল-দুপুর-বিকাল-সন্ধ্যা যে কোন সময় যেকোনো জায়গায় দীর্ঘ-দীর্ঘতর যান জট ।

যাহোক, যখন অটো রাংগিরখাড়ির তেমাথায় নেতাজি স্ট্যাচুর সামনে এসে পৌঁছল তখন সহসা দিক্ অন্ধকার করে ঝড় উঠল। উফ্ সে কী ঝড়, সেকী উন্মাদ তাণ্ডব! পথের ধুলাবালি কুটোকাটা আবর্জনা সব একাকার হয়ে উড়তে লাগল, ঠিক ওড়াও নয় যেন, একবারে দিকবিদিক শূন্য তাণ্ডব নৃত্য। পথের ধুলার ঝাপটা এসে মুহুর্মুহু অটোর ভিতর ঝাঁপিয়ে পড়ছে।
বড় বড় গাছের মাথাগুলো বাতাসের বেগে যেন ছিঁড়ে পড়বে, দোকান-বাড়ির পলকা সাইন বোর্ডগুলো ভেঙে পড়ার ধাতব শব্দ,– এক হুলুস্থুল লণ্ডভণ্ড কাণ্ড চারিদিক জুড়ে। এরই মধ্যে চকিতে একটি দৃশ্য বিমোহিত করে দিয়েছিল মৃগাঙ্কমোহনকে। ঝড়ের ত্রস্ততায় যখন জনজীবন ভীষণভাবে ছত্রভঙ্গ তখন পথের পাশে একটি দুধেল গাভী স্থির ও শান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে তার নধর বাছুরকে মাই দিচ্ছিল–!

মাঝপথে দাঁড়াতেই হল মৃগাঙ্কমোহনকে। বাতাস ও ধুলাবালির ঝাপটা খেয়ে অতদূর পথ পাড়ি দেওয়া সম্ভব নয়। গাড়ির ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে কোনরকম সে দাঁড়াল প্রেমতলা পয়েন্টের ফুটপাতের ওপর। তারপর গিয়ে ঢুকছিল এই শহরের অন্যতম সাজানো-গোছানো বইয়ের দোকানে। তাণ্ডব একটু থামলে পর বেরুবে সংকল্প নিয়ে।

তারাপুরের ওভারব্রিজের উৎরাই পেরিয়ে যখন নীচের দিকে নামছিল অটো তখনই বড় বড় ফোটায় বৃষ্টি নামল।
জপমালাদের গলির সমুখে পৌঁছতে পৌঁছতে ঝেঁপে বৃষ্টি এসেছিল। তখন সে শুধু একাই বসেছিল অটোতে। চালককে বলে গলির ভিতরে জপমালাদের বাড়ির গেটের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে ওকে ফোন করাতে শান্তনু, জপমালার বর, ছাতা মাথায় বেরিয়ে এসেছিল।তবুও দু’চার ফোঁটা বৃষ্টির জল ওর গায়ে, মাথায় পড়ছিল।
ঘরে ঢোকার পরই নাতনি বাবলি কোথা থেকে ছুটে এল। ওকে দেখেই দু’হাতে জাপটে ধরে কোলের মধ্যে নিয়ে পিঠে মৃদু চাপড় দিতেই ফিচকে হাসি হেসে বলল, দাভাই আমি তবলা নাকি বাজাচ্ছ যে, তবলা ঘরে আছে, বাজাও গিয়ে–!
তারপরই মৃগাঙ্কমোহনের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, দাভাই তুমি যখন এসেছিলে পবন আর বৃষ্টির মধ্যে খুব যুদ্ধ হচ্ছিল, না!
হ্যাঁ তো।খুব হচ্ছিল।
তোমার ভয় করে নি।
না, করেনি।
তোমার মাথার উপর যুদ্ধ করছিল না ওরা?
করছিল,তবে ওদের আমি হাত দিয়ে সরিয়ে দিয়েছিলাম!
বাবলি তখন বলল, দাভাই, তোমাকে আমি ম্যাজিক দেখাব–।
ঠিক আছে। দেখিও, এখন চা খেয়ে নেই–।
চা খেয়ে নাও, আমি আসছি- বলেই বাবলি বাইরের বারান্দার দিকে ছুটে গেল। বোধহয় উঠানের জলে তার কাগজের ময়ূরপঙ্খী নাও ভাসবে–!
খুব জোরে বৃষ্টি পড়ছিল তখন। মৃগাঙ্কমোহন চা খেয়ে সামনের বারান্দায় হাতলঅলা চেয়ারে বসে একটি সিগারেট ধরাবে ভাবছিল। তখনই সামনে বাবলি এসে হাজির।
দাভাই, তোমাকে আমি ভানুমতীর খেল দেখাব। আমার ড্রেসটা না ঘরে রেখে এসেছি, না হলে ওটা পরে দেখাতাম–!
কোন ড্রেস? মৃগাঙ্কমোহন কৌতূহলী গলায় জানতে চায়।
ভানুমতীর ড্রেস। কালো পাঞ্জাবি,কালো টুপি, লাঠি–
ওগুলো নিয়ে এলে না কেন তবে?
মা আনতে দেয়নি–সামান্য অনুযোগের সুরে বলে বাবলি।
তাহলে কেমন করে খেল্ দেখাবে?
তুমি আমাকে এখন ম্যাজিক দেখাও–। বাবলি পালটা বায়না করে।

বাবলির কথা শুনে মৃগাঙ্কমোহন ভিতরে একটু অস্বস্তি বোধ করে। তাকায় সে এই কচি, ডাগর চোখের খেয়ালি শিশুর মুখের দিকে। যেখানে নিয়ত স্বর্গের আলো খেলা করছে। ভাবে, ওকে কী ম্যাজিক দেখাবে, ওসব কিছুই তো জানা নেই তার।
দাভাই ম্যাজিক দেখাবে না? মৃগাঙ্কমোহনের নীরব মূর্তির দিকে তাকিয়ে বাবলি জানতে চায়।
হ্যাঁ হ্যাঁ, দেখাব, তোকে আমি পাঁচ আঙুলের জাদু দেখাব–মৃগাঙ্কমোহন উজ্জ্বল মুখে বলে।
পাঁচ আঙুলের জাদু,– বলে সামান্য বিস্ময়ে নিজের হাতের কচি আঙুল-গুলো চোখের সামনে তুলে ধরে বাবলি।
হ্যাঁরে–
কিরকম দাভাই–?
দাঁড়া একটু, এক্ষুনি দেখাব–।
শার্টের বুক পকেট হাতড়ে মৃগাঙ্কমোহন পেয়ে গেল প্রায় সিকি সাইজের একটি একটাকার কয়েন। পথে- ঘাটে, দোকানে-বাজারে যেসব খুচরো পাঁচটাকা, দু’টাকা বা এক টাকার ছোটবড় কয়েন পায় মৃগাঙ্কমোহন, তা ব্যবহার করা শার্টের বুকপকেটেই থেকে যায় যতদিন না জমতে থাকা কয়েনে পকেট ভারী হয় এবং ওগুলো কয়েনের নির্দিষ্ট কৌটায় চালান না করে দেয়। কয়েনটা হাতের তালুতে রেখে
মৃগাঙ্কমোহন নাতনির দিকে তাকিয়ে বলে, ওটাকে এখন আমি নেই করে দেব–!
বাবলির কচি গোলাপি মুখে বিস্ময়ের হাসি। দাভাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে সে বলে, দাও তো দেখি–!
মৃগাঙ্কমোহন ওর চোখের দিকে তাকিয়ে হাত মুঠো করল। তারপর কায়দা করে তর্জনী আর মধ্যমা দিয়ে ঠেলতে ঠেলতে দু’আঙুলের ফাঁকে কয়েনটা চেপে রাখল। তারপর খুব সতর্কতার সঙ্গে মুঠো খুলে হাসি মুখে বলল, দেখছিস, কয়েন ভ্যানিশ–!
মৃগাঙ্কমোহনের শূন্য চেটোর দিকে দু’দণ্ড তাকিয়ে বাবলি ওর হাতটা ধরে বলল, দেখি দেখি–
হাতের আঙুল গুলো বাবলি টান মেরে ধরতেই ফাঁক শিথিল হল এবং কয়েনটা টুপ করে মেঝেতে পড়ে গেল।
তখুনি বাবলি নিচু হয়ে ওটা কুড়িয়ে নিয়ে মৃগাঙ্কমোহনকে বলল, দাভাই, কয়েন তো ভ্যানিশ হল না–!

হয়নি? ছদ্ম অবাক কন্ঠে বলল মৃগাঙ্কমোহন।
না। এইতো-। বলে বাবলি হাতে ধরা কয়েনটা দেখাল।
ঠিক আছে। তোকে একটা সত্যিকারের ম্যাজিক শিখিয়ে দেব।
কী ম্যাজিক দাভাই? বাবলি সাগ্রহে প্রশ্ন করে।
ছুরি দিয়ে লেবুর বুক কেটে রক্ত বার করার ম্যাজিক–!
এখনই শেখাও না–বাবলি আবদারের সুরে বায়না ধরে।
এখন না। তুই যখন আমাদের বাড়িতে বেড়াতে যাবি তখন, সবাই দেখে অবাক হয়ে যাবে–।
কবে তোমাদের বাড়িতে যাব, বলনা দাভাই–বাবলি অধীর কন্ঠে বলে।
তোর মাকে গিয়ে বল, ও দিন ঠিক করুক, তারপর–।
শুধু ম্যাজিক না, আমাকে গল্পও বলতে হবে দাভাই–।
ঠিক আছে শোনাব–।
তুমি আমাকে রূপকথার গল্প শোনাবে কিন্তু, অনেক গল্প, দীদান তো এখানে এলেই শোনায়–।
ঠিক আছে ভাই, শোনাব–।
দাঁড়াও, মাকে গিয়ে বলি, কবে তোমার বাড়ি নিয়ে যাবে আমাকে, বলেই বাবলি মাকে খুঁজতে চোখের পলকে ঘরের ভিতরে দৌড়ে ছুটে যায় –।

সন্ধ্যার দিকে মৃগাঙ্কমোহন যখন বাড়ি ফেরার উদ্যোগ করে তখন জপমালা ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলে, মেজদা ভাই, বেশ ক’দিন আগে পণ্ডিতজি তোর ভাগ্নির জন্য বেশ ভাল একটা আলাপ দিয়েছিলেন, তুই একবার যাবি ওর কাছে?
দিয়েছিলেন বুঝি? তা ছেলে কী করে?
ছেলে এম.আর। বেশ ভাল মেডিকেল কোম্পানি নাকি।
ঠিক আছে যাব। এমনিতেই পুরোনো পাড়ায় একদিন যাব ভাবছি। গোপালের বউ তো প্রায় সময় ফোন করে ভালমন্দ জানতে চায়, যেতে বলে।
বড় চিন্তায় পড়েছি জুঁইকে নিয়ে, বয়স হয়ে যাচ্ছে তো–!

পণ্ডিতজির সঙ্গে পরিচয় অনেকদিনের। বি এ পাশ করার পর মৃগাঙ্কমোহন যখন কিছুদিনের জন্য সরকারি বালক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার কাজে যোগ দেয় তখন পণ্ডিতজির সঙ্গে পরিচয়। সংস্কৃত সাহিত্যের শিক্ষক বলে সকলে ওকে পণ্ডিতজি সম্বোধন করত। আসল নাম ছাপিয়ে আজও যে পরিচয় প্রধান। ওর পৈতৃক নাম হল ফুলেশ্বর ত্রিবেদি। কয়েকপুরুষ আগে ওরা বিহারের দারভাঙা জেলা থেকে দক্ষিণ আসামের খাঁটি বাঙালি মুলুকে চলে এসেছিলেন। এতদিনে ওরা পুরোদস্তুর বাঙালি। বাঙালি পরিবারের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্কে আবদ্ধ হয়েছেন দু’পুরুষ পূর্ব থেকে।
বেঁটেখাটো গোলগাল চেহারা, গায়ের ঢলঢল জামার ওপর সর্বদা নধর ভুঁড়ি বেরোনো, শ্যামবর্ণ পণ্ডিতজি সদালাপী, সদাহাস্যময় সজ্জন লোক। দুদিনেই মৃগাঙ্কমোহনের সঙ্গে বেশ ঘনিষ্ঠতা হয়ে গেছিল। উনি যে শুধু সংস্কৃত সাহিত্যের পণ্ডিত এমন না, ইংরেজিও ভাল জানেন। শিক্ষক হিসাবে খুব জনপ্রিয়। ছোটবোন জপমালার গৃহশিক্ষক হিসেবে ওকে নিয়োগ করেছিল মৃগাঙ্কমোহন।তারপর থেকে তাদের পুরো পরিবারের সঙ্গে বিশেষ ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন পণ্ডিতজি। মৃগাঙ্কমোহনের পিতৃদেবের সঙ্গে সংস্কৃত সাহিত্য নিয়ে আলাপ-আলোচনায় যোগ দিতেন। সংস্কৃতে সুপণ্ডিত বলে মৃগাঙ্কমোহনের বাবা ওকে সবিশেষ মূল্য দিতেন। উনি অর্থাৎ মৃগাঙ্কমোহনের বাবাও সংস্কৃত সাহিত্যের দিকপাল পণ্ডিত। তার নামের পিছনে সর্বদা বেদান্ততীর্থ ও আয়ুর্বেদশাস্ত্রী শব্দ দুটি জোড়া থাকত।

ঘর ছেড়ে বেরোনোর কালে নাতনির খোঁজ করল মৃগাঙ্কমোহন। আমার নাতনি গেল কোথায়?
এখানেই কোথাও আছে, দাঁড়া ডাকছি ওকে, বাবলি এই বাবলিসোনা–!
জপমালা উঁচু সুরে হাঁক পাড়ে নাতনির উদ্দেশ্য।
বাবলি আর ওর মা তো যাবে আমার ওখানে। বাবলি তো রূপকথার গল্প শোনার জন্য অস্থির–!
আর বলিস কেন, রোজ রাতে ঘুমানোর সময় ওকে যে কত গল্প বলতে হয় আমার–
ভালো, ভালো। ওকে বাংলাটা শেখাতে বলিস জবাকে, নিজের মাতৃভাষা–!
আর শেখাবে তোমার ভাগ্নি, বললেই বলে সময় নেই, আমিই বর্ণবোধ এনে ওকে অক্ষর চিনিয়েছি, একটু একটু করে পড়তে শেখাচ্ছি– জানিস মেজদাভাই, বাবলি কিন্তু খুব সুন্দর ছবি আঁকে–
তাই?
হ্যাঁ রে–।
আর ঠিক এমন সময় ওদের দু’জনের কথার সত্যতা প্রমাণ করতেই যেন বাবলি হাতে একটি ড্রইংখাতা নিয়ে ঘরে আসে। দু’জনের মাঝখানে খাতাটি মেলে ধরে বলে, দেখ, দীদন, দেখ দাভাই, ভারতমাতার ছবি এঁকেছি–
মৃগাঙ্কমোহন হাত বাড়িয়ে খাতাটি ওর কাছ থেকে নেয়। আঁকা ছবির দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকায়। জপমালাও মাথা ঝুকিয়ে ছবির দিকে তাকায়। লাল-নীল-হলুদ-সবুজ দিয়ে সুন্দর একটি ছোট্ট মেয়ের ছবি এঁকেছে বাবলি। কচি হাতে উঁচু করে ধরা জাতীয় পতাকা–

বাঃ বাঃ খুব সুন্দর তো, অপূর্ব–! নাতনির টোপা গালে হাত ছুঁইয়ে আদর দেয় মৃগাঙ্কমোহন।

⚫ দ্বিতীয় অধ্যায় ⚫

ভাগ্নি জুইয়ের বিয়ের সমন্ধ নিয়ে পণ্ডিতজির সঙ্গে কথা সেরে তপ্ত বৈশাখ রোদ মাথায় করে ধনুকের মতো বাঁকা পিঠ শুঁড়ি পথ বেয়ে মৃগাঙ্কমোহন এসে দাঁড়ায় নতুনপাড়ার সদ্য ব্লক বিছানো সড়কের ওপারে নরসিং স্কুলের ঢেউ খেলানো বিশাল বোর্ডিং মাঠ। মাঠের দক্ষিণ প্রান্তের সীমা নির্ণয়কারী দাশগুপ্তদের পড়ো জমি সংলগ্ন আগাছা আকীর্ণ বেশ বড় নালা বয়ে চলছে ময়লা জলস্রোতসহ। কেমন সম্মোহিতের দৃষ্টিতে মৃগাঙ্কমোহন তাকায় মাঠের অবশেষ নাবাল জঙ্গলাকীর্ণ প্রান্তের দিকে। এই মাঠের রোদে-ঝড়জলে ঘাসে-কাদায়- জঙ্গলে তার বাল্য-কৈশোর-যৌবনের প্রথম দিনগুলি কেমন বুঁদ হয়ে আছে যেন। মাঠের ওপর পলকহীন চোখে তাকিয়ে থাকতে গিয়ে মৃগাঙ্কমোহনের মনে পড়ে এই শহরে তার প্রথম আসার দিনটির কথা–!
তখন মৃগাঙ্কমোহনের বয়স কত ছিল?
মনে মনে হিসাব কষে সে। বড়জোর চার কী পাঁচ। আজও পর্যন্ত, জীবনের এই পড়ন্ত বেলা অবধি দিনটি ঠিক মনে আছে তার। মাঝে মাঝে ওই দিনটির কথা এমনিতেই মনে পড়ে তার। এবং মনে পড়া মাত্র নাকে কাঁচা কয়লা পোড়ার মিষ্টি গন্ধ পায় সে। স্মৃতির অতলান্ত মণিকোটায় রূপ- গন্ধ- স্পর্শ-বর্ণ সব যেন একীভূত হয়ে আছে। কোনো ঘটনার সঙ্গে রূপ ও রস, কোনোটির সঙ্গে গন্ধ আবার কোনোটির সঙ্গে স্পর্শ ও বর্ণ–!
ওই চার-পাঁচ বছর বয়সের পূর্বে মৃগাঙ্কমোহন যখন মাতৃগর্ভে ছিল তখনকার কথাও বড্ড জানতে ইচ্ছে করে মাঝে-মধ্যে। গর্ভে যখন, ‘যোগী তখন/ ভূমে পড়ে খেলাম মাটি–!’ ওই যোগী অবস্থা কীরূপ তা খুব জানতে ইচ্ছা হয়। একজন জ্ঞানীপুরুষ তাকে বলেছিলেন, মন স্থির হলে পর জন্মের পূর্বাবস্থা জানা সম্ভব। বহু বহু প্রাচীন সংস্কার, কামনা-বাসনায় মন কলুষিত, ময়লা জল আচ্ছন্ন জলাশয়ের মতো, তাকে স্থির করতে হলে, পরিশ্রুত করতে হলে নিরন্তর চেষ্টা করতে হবে। তারপর তুলসীদাসের একটি শ্লোক আউড়ে ছিলেন।

রাজা করৈ রাজ্য বশ, যোদ্ধা করৈ রণ জই।
আপন মনকো বশ করৈ জো সবকা সেরা ওই।।

মৃগাঙ্কমোহন লক্ষ করছিল অনেককাল আগের মতো ওই শুঁড়ি পথের দু’ধারের ছন্নছাড়া বুনো চেহারা অপরিবর্তিত। বেশ বড় কটা গাছ, একটি সম্ভবত রিটা, জলা- জঙ্গল আর ছড়ানো- ছেটানো দোচালা টিনের ছাউনি দেওয়া ইতস্ততঃ কয়েকটি ছোটবড় নিঝুম বাড়িঘর। ছোট ও বড় গাছের ডালপালার আড়ালে পড়ে থাকা বাড়িগুলো জংধরা, বিবর্ণ ছাদ চোখে পড়ছিল মৃগাঙ্কমোহনের।

পথের বাঁ পাশে অনেকখানি জায়গা নিয়ে দত্তদের সেই আদ্যিকালের এজমালি পুকুর। এখন আর ওটাকে চট করে পুকুর বলে চেনার উপায় নেই। জার্মানিপানা, বড় বড় ঘাসে ও কচুর জঙ্গলে কেমন দমচাপা হয়ে আছে। ওই ঘন কচুবনের ভিতরে এক রাতের বেলা দু’জন চোর লুকিয়েছে অনুমান করে পথের পাশের বাড়ির বিমলা চৌধুরী ভীষণ হাঁকডাক শুরু করেছিলেন। গোটা পাড়া হাতে লন্ঠন, টর্চ ও লাঠি নিয়ে জড়ো হয়ে গেছিল কচুবনের দুরন্ত জঙ্গলের কাছে। বিমলা চৌধুরী সম্পর্কে মৃগাঙ্কমোহনের পিসেমশাই। লোকনাথ ফার্মেসির বুড়োদের সান্ধ্য আড্ডার একজন নিয়মিত সদস্য। আড্ডা সেরে বাড়ি ফেরার কালে চালসে পড়া চোখে আলো-আঁধারির কুহকে তিনি নাকি দুটি কালো মূর্তিকে ওই বনে সেঁধতে দেখেছেন। তাই ওর হাঁকডাকে সেখানে জড় হয়ে গেছিল পাড়ার লোকেরা।পাড়ার দুই ডানপিটে দাদা, টুনুদা ও রানাদা বড় দুটি লাঠি হাতে নেমে পড়ছিল কোমর সমান কচুবনে। লাঠির গায়ে ছিন্নভিন্ন হয়েছিল কচুবন, তবুও চোরের হদিশ মিলেনি সেদিন রাতে। মাঝে মাঝেই পাড়ার বুড়োরা অহেতুক ছেলেমানুষী কাণ্ডে নতুনপাড়াকে সরগরম করে দিতেন–! জার্মানিপানায় বেগুনি রঙের গুচ্ছফুল, কচু গাছেও হলদে রঙের অজস্র কলি। ওসব নিবিড় জঙ্গলের মধ্যে ডাহুক পাখি এসে বাসা করে ডিমে তা দেবার জন্য। মাঝে মাঝে ওদের ও্ক ও্ক ডাকে দুপুরের স্তব্ধতা কেমন নিবিড় হয়ে আসে। মৃগাঙ্কমোহন কল্পনায় ডাহুক পাখির ডাক শুনছিল আর ভিতরে ভিতরে কেমন রোমাঞ্চিত বোধ করছিল!
ওই এজমালি পুকুরে একসময় মৃগাঙ্কমোহন ও তার ভাইয়েরা সকাল -বিকাল ছিপ হাতে কত কত মাছ ধরেছে। ডিমঅলা বড় বড় পুঁটি, টাংরা, চ্যাং, মাগুর, কাংলা, সউল। ওদিকে দত্তবাড়ির দত্ত মাসীমা, শান্ত- মান্ত-কুটির মা, আধময়লা লাল পেড়ে শাড়ি হাঁটু অবধি তুলে হুঁকো হাতে তামাক টানতে টানতে পুকুরের জলে পা ডুবিয়ে ছিপ হাতে মাছ শিকারে মগ্ন,– ছবিটি এত বছর পরও কেমন চোখে লেগে আছে। পাড়াগাঁ’র একটুকরো ছবি শহরের এমন শান্ত পল্লীতে যেন ধরা দিয়েছিল সেদিন–! কালে কালে ওই অতিসাধারণ, আটপৌরে রমণী যে রত্নগর্ভা বলে খ্যাত হবেন, কে জানত! শান্ত অর্থাৎ সুশান্ত দত্ত তো মহা সেলিব্রেটি। পৃথিবী জোড়া তার আঁকা ছবির সুখ্যাতি। জীবন যে কাকে কখন কী দেয়, তা আগে থেকে কেউ জানতে পারেনা–!

শুঁড়ি পথের ডানপাশে বড়নালা সংলগ্ন দাশগুপ্তদের প্রায় ছ-সাত কাঠা জমি টল্ টল্ জলের মস্তপুকুর উত্তর আধুনিক সময়ের ভোজবাজিতে উধাও। এখানে এখন নির্মীয়মাণ বিশাল হাইরাইজ ফ্ল্যাটবাড়ি। নিকট অতীতে ওই পুকুরের কাকচক্ষু, স্ফটিক স্বচ্ছ জলে দাশগুপ্ত বাড়ির গৌরবর্ণ বলবান পুরুষেরা, সোনারবরণ যুবতী বউ ও মেয়েরা সাঁতার কেটে চান করত আর পালা-পার্বনে পুকুরের বড় বড় রুই, কাতলা, মৃগেল, চিতল টানা জাল মেরে টেনে তুলত জেলেরা। আজ ও’সমস্ত কিছুই যেন অলীক!

নতুনপাড়ার পথের ওপর যেখানে দাঁড়িয়েছে মৃগাঙ্কমোহন পূব-মুখো হয়ে সেখান থেকে দক্ষিণ দিকে সামান্য উজিয়ে গেলে দাশগুপ্তদের বিশাল বাড়ির সীমানা, সেখানে শেষ হয়ে শুরু হয়েছে রণবীর রায়ের বাড়ির সীমানা, সেখানে পথের পাশে বহুকালের পুরোনো বেশ বড় একটি ডোবা। ডোবাটির জল দেখা যায় না, বড় বড় জার্মানিপানায় বছরের পর বছর আচ্ছাদিত থাকে। এককোনায় মাটির সিঁড়ি কেটে নীচে নামার কাঁচা ঘাট রয়েছে। ওই ঘাটই শুধু, কেউ ডোবায় নামে না। বর্ষাকালে জার্মানিপানার গম্বুজাকৃতি গুচ্ছ গুচ্ছ নীলচে-বেগুনি রঙের ফুলে এমন সুন্দর রূপ ফোটে ডোবাটির যা চোখের পলক না ফেলে তাকিয়ে থাকতে হয়, অনেকসময় ওয়ার্ডসওয়ার্থের Daffodils দেখার অভিজ্ঞতা মনে পড়িয়ে দেয়।

Ten thousand saw I at a glance
Tossing their heads in sprightly dance.

ডোবাটি আছে, না সেখানেও হাইরাইজ বিল্ডিং-এর সংক্রামক কাঠি দেখা দিয়েছে, কে জানে? ডোবার পাড়েই রাস্তার পাশে ইষৎ ঝুঁকে থাকা বহুকালের একটি পুরোনো চালতা গাছ ছিল। কী সুন্দর বড় বড় সব পাতা আর সবুজ সাদাটে রঙের চালতা ফল। ফলগুলো পেঁকে উঠলে হলুদ বর্ণ ধরত। সন্ধ্যাবেলা মৃগাঙ্কমোহন বা ভাইয়েরা চালতা গাছের নীচ দিয়ে একা একা দোকানে যেত না। চালতা গাছে নাকি ভূত থাকে! কখনও সন্ধ্যায় ওপথ দিয়ে সুবোধ মহাজনের দোকান থেকে কেরোসিন কিনে আনতে হলে তিনভাই একসাথে যেত, কেরোসিনের বোতলে এক আনা দু’আনার মুদ্রা ঠুকে বাজাতে বাজাতে–!
ওই চালতা গাছ ও ডোবার উল্টোদিকে পথের পাশে দু’খানি খড়ের চালের ঘর ছিল একসময়।তার পিছনের জমি ঢালু হয়ে নেমে গিয়েছে বড়নালার পাড়ে। ওই নাবাল জমি এককালে ভেরেণ্ডার বনে আচ্ছাদিত ছিল। সবুজ, সতেজ ভেরেণ্ডা পাতা, ডাঁটা আর কাণ্ডে জায়গাটা সবুজাভ হয়ে থাকত। ওদিকে তাকালে চোখের বেশ আরাম হত। ভেরেণ্ডা হচ্ছে ওষধি গাছ। মৃগাঙ্কমোহনের কবিরাজ বাবা ও কাকা দুজনে ভেরেণ্ডার ডাঁটা, পাতা, কাণ্ড কুচি কুচি করে কেটে রোদে শুকিয়ে অন্য অনেক জড়িবুটি সঙ্গে মিশিয়ে পাচন তৈরি করতেন। তাদের ছেলেবেলায় ওই পাচন ছিল জ্বরাজরির মহৌষধ। এখনও শহরের এখানে-ওখানে নালার পাড়ে কখনও ভেরেণ্ডার ইতস্তত: বন চোখে পড়ে মৃগাঙ্কমোহনের। আবেশমাখা স্নেহের দৃষ্টিতে দু’দণ্ড তাকায় সে ভেরেণ্ডার সবুজ বিস্তারের দিকে। ওগুলো যে তার শৈশবের প্রিয় সাথি!

ওই খড়ের দোচালা কুঁড়েঘরের একটায় থাকত গাড়োয়ান সুখি গোয়ালার পরিবার। দুই ছেলে বড়কন ও ছোটকন আর তাদের মা। অন্যচালাটা ছিল গোয়ালঘর। রোজ সকালবেলা পিতলের ঘটি করে ওদের কাছ থেকে দুধ নিতে আসত মৃগাঙ্কমোহন ও পাড়ার অন্য বাসিন্দারা। বড়কন ও ছোটকনের মায়ের ছিল দশাসই চেহারা। পরণের শাড়ির আঁচলের আড়ালে মাচা থেকে দুলতে থাকা লাউয়ের মতো দুলত ওর বুক। কু লোকে বলত ও নাকি দোয়ানো গরুর দুধের সঙ্গে ওর বুকের দুধও খানিক মিশিয়ে দিত–!

পথের ওপর দাঁড়িয়ে মাঠের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ করে মাঠটিকে কেমন ছোট মনে হল মৃগাঙ্কমোহনের। সেই সুদূর বাল্য-কৈশোর অথবা প্রথম যৌবনের লীলাভূমি এই মাঠ তখন আরও বড় আরও প্রাণবন্ত ছিল যেন! মাঠের যে প্রান্তটি ক্রমশঃ ঢালু হয়ে নিচে নেমে বড়নালার পাড়ে এসে থেমেছে। ওই নাবাল নিচু অংশটিকে কেমন যেন ছোট মনে হচ্ছে। ওখানে হাডুডু’র কোর্ট ছিল। মাঝে মধ্যে ব্যাটবল নিয়ে ক্রিকেট খেলায়ও মত্ত হয়ে পড়ত মৃগাঙ্কমোহন ও তার বন্ধু-বান্ধবের দল। মাঠটি যেখানে গড়িয়ে নেমেছে নিচের দিকে সেখানে একটি ঝাঁকড়ামাথা বেশ বড় কুল গাছ এখনও দিব্যি দাঁড়িয়ে আছে। কতকাল আগের গাছটি! এখন কেমন রুক্ষশুষ্ক বুড়োটে মেরে গেছে। অজস্র ডাল-পালা-পাতায় আকীর্ণ গাছটির সতেজ সবুজ রূপ কেমন ঝরে গেছে। গাছটি কি দীর্ঘদিন থেকে মৃত? নাহ্, দেখে কিন্তু মনে হয় না। শুকনো ডালে ডালে কিছু সবুজ পাতা এখনও দেখা যাচ্ছে। গাছের পানে তাকিয়ে থেকে একদিন সকালবেলার এক নিষ্ঠুর ঘটনা মনে পড়ে মৃগাঙ্কমোহনের।

পাড়ার সৌখিন ধনী পরিবারের কর্তা বিরাজ চৌধুরী তার পালিত ফুটফুটে সাদা বিলাতি কুকুরটাকে কুলগাছের কাণ্ডের সঙ্গে শেকল দিয়ে বেঁধে গুলি করে মেরেছিলেন। কুকুরটা নাকি পাগল হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু গাছের গুঁড়িতে বাঁধা কুকুরটা কেমন স্থির ও শান্ত হয়ে দাঁড়িয়েছিল মনিবের দিকে তাকিয়ে। মুখে শুধু কুঁইকুঁই করে একটানা অস্পষ্ট শব্দ করছিল। ওকে মোটেই পাগল বলে মনে হচ্ছিল না। কোনো লাফঝাঁপ নেই, হিংস্র সুরে ডাকছিলও না কুকুরটি। বন্দুকের ‘দুম’ আওয়াজটি আজও যেন কানে বাজে মৃগাঙ্কমোহনের!

এবার মাঠের বাঁদিকে তাকায় মৃগাঙ্কমোহন। চোখ পড়ে শেওড়াতলার দিকে। সেই ছোটবেলা থেকে গাছের গুঁড়িতে বসে মা-মাসিদের রূপসী পুজো করতে দেখেছে। তবে সেই আদ্যিকালের শেওড়া গাছটি এখন আর নেই। বদলে আছে নবীন একটি অশ্বত্থ গাছ। প্রচুর ডালপালা সহ বলিষ্ঠ কাণ্ডের গাছটি আকাশের দিকে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। কচি কলাপাতা রঙের অজস্র পাতা বৈশাখ রোদ ও বাতাসে কেমন ঝিলমিল করছে। পুরোনো -প্রাচীন শেওড়া গাছটিকে সম্পূর্ণরূপে পেটের ভিতর ঢুকিয়ে নিয়েছে বলবান অশ্বত্থ গাছটি। জীবজগতে ছোট প্রাণীকে বড় প্রাণীর আত্মসাৎ করার এটি একটি সাধারণ প্রাকৃতিক ঘটনা–!

(ক্রমশ)

ছবি- সূরজ মোহান্ত

Tags: উপন্যাসপূর্ণাঙ্গ উপন্যাসবাবলির-জন্য-রূপকথামিথিলেশ ভট্টাচার্য
Previous Post

মিলনকান্তি দত্ত | তৃতীয় সংখ্যা

Next Post

মনোজমোহন চক্রবর্তী | দ্বিতীয় সংখ্যা

Daruharidra

Daruharidra

Next Post
মনোজমোহন চক্রবর্তী | দ্বিতীয় সংখ্যা

মনোজমোহন চক্রবর্তী | দ্বিতীয় সংখ্যা

Leave a Reply Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

No Result
View All Result

RECENT POSTS

মেখলা পরা মেয়ে || শ্রীযুধাজিৎ || অন্তিম পর্ব

মেখলা পরা মেয়ে || শ্রীযুধাজিৎ || অন্তিম পর্ব

15/04/2022

সঞ্জয় চক্রবর্তী || অন্তিম পর্ব

09/04/2022
মেখলা পরা মেয়ে || শ্রীযুধাজিৎ || দ্বাবিংশতি পর্ব

মেখলা পরা মেয়ে || শ্রীযুধাজিৎ || দ্বাবিংশতি পর্ব

08/04/2022

সঞ্জয় চক্রবর্তী || নবম পর্ব

02/04/2022
মেখলা পরা মেয়ে || শ্রীযুধাজিৎ || একবিংশতি পর্ব

মেখলা পরা মেয়ে || শ্রীযুধাজিৎ || একবিংশতি পর্ব

01/04/2022

সঞ্জয় চক্রবর্তী || অষ্টম পর্ব

27/03/2022
মেখলা পরা মেয়ে || শ্রীযুধাজিৎ || বিংশতি পর্ব

মেখলা পরা মেয়ে || শ্রীযুধাজিৎ || বিংশতি পর্ব

25/03/2022
সঞ্জয় চক্রবর্তী || সপ্তম পর্ব

সঞ্জয় চক্রবর্তী || সপ্তম পর্ব

20/03/2022
মেখলা পরা মেয়ে || শ্রীযুধাজিৎ || উনবিংশতি পর্ব

মেখলা পরা মেয়ে || শ্রীযুধাজিৎ || উনবিংশতি পর্ব

18/03/2022
ষষ্ঠ পর্ব || সঞ্জয় চক্রবর্তী

ষষ্ঠ পর্ব || সঞ্জয় চক্রবর্তী

13/03/2022

RECENT VIDEOS

https://www.youtube.com/watch?v=77ZozI0rw7w
Daruharidra

Follow Us

আমাদের ঠিকানা

দারুহরিদ্রা
কুঞ্জেশ্বর লেন
(বরাকভ্যালি একাডেমির নিকটবর্তী)
নতুন ভকতপুর, চেংকুড়ি রোড
শিলচর, কাছাড়, আসাম
পিন-788005

ডাউনলোড করুন

সাবস্ক্রাইব

Your E-mail Address
Field is required!
Field is required!
Submit
  • আমাদের সম্পর্কে
  • লেখা পাঠানো
  • যোগাযোগ

Copyright © All rights reserved Daruharidra | Development by Prosenjit Nath

No Result
View All Result
  • ধান্যগৃহ
  • কবিতা
  • গল্প
  • গদ্য
  • প্রবন্ধ
  • উপন্যাস
  • সাক্ষাৎ পাতা
  • অনুবাদ পাতা
  • আর্কাইভ
  • আমাদের সম্পর্কে
    • লেখা পাঠানো
    • যোগাযোগ

Copyright © All rights reserved Daruharidra | Development by Prosenjit Nath