Daruharidra
  • ধান্যগৃহ
  • কবিতা
  • গল্প
  • গদ্য
  • প্রবন্ধ
  • উপন্যাস
Daruharidra
  • ধান্যগৃহ
  • কবিতা
  • গল্প
  • গদ্য
  • প্রবন্ধ
  • উপন্যাস
Daruharidra
No Result
View All Result
Home গদ্য

পল্লব ভট্টাচার্য | দ্বিতীয় সংখ্যা

আয়নামহল | ধারাবাহিক গদ্য

Daruharidra by Daruharidra
24/07/2020
in গদ্য
9
পল্লব ভট্টাচার্য | দ্বিতীয় সংখ্যা

ছবি- অপরূপা সিনহা

211
VIEWS

◾ মুঠোর বাতাস , বিড়ির ধোঁয়া

কবিরা পাগল হয় , না পাগলরা কবি , আজ অব্দি এটাই ঠিকঠাক বুঝে উঠতে পারি নি । তবে , কবি আর পাগলের এক জায়গায় খুব মিল । দুজনেই অপলক তাকিয়ে থাকে , দেখে । আপাত অর্থহীন , অসংলগ্ন ভাষায় এই দেখাটাকেই অনুবাদ করে যায় । লোকসমাজ সাধারণত এই অনুবাদ বুঝতে পারে না , তাই পাগল ও কবিকে কেউ বসার আসন দেয় না । যদি কেউ কবিকে বসতে ‘সাধের আসন’দেয় , তবে তাকেও আত্মহত্যা করে প্রমাণ করতে হয় , সে আগে মরে নি ।

তো , আমি যখন সুবলকে বসতে বলি , তখন অতশত জানতাম না । ছেঁড়া জামা প্যান্ট , লম্বা চুল আর উদভ্রান্ত চোখে , সে যখন চায়ের দোকানে বললো , আমারে এক কাপ চা খাওয়াবে ? তখন এড়িয়ে যাওয়া অসম্ভব ।

চায়ের অর্ডার দিয়ে বললাম ,বসো ।

চায়ে চুমুক দিয়ে, একটুক্ষণ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে , সে বললো ,তোমার হইবে । ছন্দ আছে । তারপর চিৎ হাতটা বাড়িয়ে , যেন প্রাপ্য , এমন ভাবে বললো ,বিড়ি ।

বিড়ি নেই । কী বিড়ি চাই ?

একটু মুচকি হেসে , সুবল বলে ,শিখা কি কোনও মেয়ের নাম ! নাকি বিড়ি ?

আহা পতঙ্গ , তার আগুনেই পুড়ে মরি ।

দোকান থেকে এক প্যাকেট শিখাবিড়ি কিনে দিয়ে বেরিয়ে আসছি , অরবিন্দবাবু সব লক্ষ্য করছিলেন , হাসতে হাসতে বললেন ,আপনেরে সুবল কবিয়ে পাইছে !

তারপর প্রায় প্রতিদিন , এক কাপ চা`র পর একটা শিখা বিড়ি ধরিয়ে , সুবল আমার ফুসফুস কবিতার তেতো ধোঁয়ায় ঢেকে দিতে থাকে ।

তখন ১৯৮৭ । স্বাধীন ত্রিপুরার বন্দুকে প্রতিদিন পাঁচ-দশজন মানুষ মরছে , আর রাজনৈতিক দলগুলো এখানে সেখানে শহীদবেদী বানিয়ে ১২ ঘন্টা , ২৪ ঘন্টার বনধ ডাকছে । সুবলের উদভ্রান্তি আরও বেড়েছে।

চা নয় , সে এখন ঘনঘন বিড়ি ধরায় , আর ধোঁয়া ছাড়ে । দেখা হয় , কিন্তু কথা হয় না ।

সেদিন ১২ ঘন্টা বনধ । শুনশান মফস্বল শহর । এক আধটা দোকানের একটা পাটও যদি খোলা পাই , সিগারেট কিনব । রাস্তার পাশে , কয়েকটা ইট কালো কাগজে মুড়ে কারা যেন শহীদ বেদী বানিয়ে রেখেছে ।গতকালই মানুষগুলো ছিল ,আজ শহীদ বেদী । সামনে কয়েকটা জবাফুল । শ্রদ্ধার্ঘ ।

সুবল খুব চিন্তিত চোখে বেদীর দিকে তাকিয়েছিল । হঠাৎ আমার দিকে তাকিয়ে , বললো , শহীদ বেদী । তারপর , আমার কাছে একটু এগিয়ে , কুকুর কামড়ে তোমার মরণে , রচিলাম বেদি শহীদ স্মরণে ; বলতে বলতে চলে যাচ্ছিল , হঠাৎ পেছন ফিরে , ডান হাতটা সামনে পেতে বললো ,বিড়ি ?

নেই , বলতেই হাতটা টেনে , শূন্য থেকে একমুঠো বাতাস এনে , আমার মুঠোয় দিয়ে , হনহন করে চলে গেল ।

তাকে আর দেখি নি । শুধু অই বাতাসটা এখনও আমার মুঠোয় রয়ে গেছে ।

◾ বে-গুন

তারাপীঠ। মহাশ্মশান। গা ছমছমে ভয়াবহতা কথা শুনেছি, তার কিছুই নেই প্রায়। কিছু নতুন পুরোনো গাছ। দুপুরের চড়া রোদেও ছায়া দেয়। আগুনের চুল্লীর বদলে ইলেকট্রিক চুল্লী হয়েছে। অজস্র দোকানপাট।এর মাঝেমাঝেই এমন কিছু মানুষ, যাদের ঠিক এই সমাজ গ্রহণও করে না, বর্জনও করে না, একপাশে সরিয়ে রেখেছে। এরা আছে, এইসব গাছের তলায়, আলো ও ছায়ায়।
তিন ইটের এক অস্থায়ী উনুনে, এলুমিনিয়ামের ডেকচিতে পাতাপুতা সহ ভাত ফুটছে। আঁচ দিচ্ছিল এক পঁয়ত্রিশ থেকে চল্লিশের কালো সুঠাম মহিলা৷ ভৈরবী। তার ভৈরব একটু দূরে দাঁড়িয়ে । সেখানে গর্ত খোঁড়া হচ্ছে এক বয়স্ক সাধুকে সমাধি দেওয়ার জন্য। কাছেই লাল শালু পরণে সেই সাধুর দেহ শোয়ানো।মৃত মুখটিতে ক্ষয়িষ্ণুতার ছাপ। শস্তা কয়েকটি ধূপকাঠি কেউ জ্বালিয়ে দিয়েছে, তার একটা বিদঘুটে গন্ধ ছড়াচ্ছে। খেয়ে বাঁচার জন্য একদিকে রান্না হচ্ছে,পাশেই সৎকারের জন্য গর্ত খোঁড়া হচ্ছে। অথচ কী নির্বিকার ওই মানুষগুলো। মৃত্যু এবং জীবন দুটোকে সমান জেনেই হয়তো এরা তেমন করে ঘর বানায় না।
এইসব ভাবতে ভাবতে ঘাটের কাছে চলে যাই।সেখানে কিছুটা আড়াল, বিশাল দুটো গাছের ছায়ায়, কয়েকজন বসে গাঁজার কল্কে সাজাচ্ছে।এরই এক কোণে; চেহারা এবং গড়নে মনে হয় বছর ত্রিশের বেশি বয়স হবে না, আসন করে বসে কী যেন করছে। রং শ্যামলা। মুখে কচি দাড়িগোঁফ। পরণে ময়লা একটা কালো প্যান্ট। আদুল গা। গায়ে ছাই। কাঁধের ওপর একটুকরো কালো কাপড়। মাথায়ও কালো কাপড় বাঁধা।
লক্ষ্য করে দেখি, বাতিল দুটো টিনের কৌটোর উপর, মাটি দিয়ে বানানো দুটো লম্বাটে আকার। খানিকটা লিঙ্গাকৃতি। সে তাতে জলের ছিটে আর পাতাপুতা দিচ্ছে বারেবারে। বিড়বিড় করছে কিছু।
আস্তে আস্তে পেছনদিকে একটু দূরে গিয়ে দাঁড়ালাম, তার কার্যকলাপ লক্ষ্য করার জন্য। জল-পাতা ছিটিয়ে দিচ্ছে আর বলছে, রেল কোয়ার্টারে গেলাম বেগুন বিক্রির জন্য৷ তাজা বেগুন, গাছ থেকে তুলে আনা। পাঁচ টাকা কেজি। মাত্র পাঁচ টাকা। কোয়ার্টারের বাবু তাও দিতে চায় না। যত বলি তাজা, খেয়ে দেখুন ভাজা, তত বলে কম হবে না। ঘটাং করে সিগনাল দিল, হুং…
অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এইসব শুনলাম, সে কিন্তু এর মধ্যেই জল-পাতা দিয়ে একটা ধূপকাঠি ধরিয়ে আরতিও করে নিল। কিন্তু মুখে ওই বেগুনের প্রলাপ।
পাগলের কাণ্ডকারখানা ভেবে, চলে যেতে গিয়েও থমকে দাঁড়ালাম। মনে হলো, পাশুপত ব্রতধারীদের কাজকর্ম নাকি উন্মাদবৎ। অবিতত্করণ মানে উন্মাদের আচরণ আর অবিদ্ভাষণ মানে অর্থহীন প্রলাপ এদের চর্যার অঙ্গ। এ কি তেমন কেউ? কৌতূহলে বোধহয় একপা এগিয়েছিলাম। সে ঘাড় কাত করে আমার দিকে তাকালো। এমন স্নিগ্ধ শান্ত চাউনি কোনও সাধারণ পাগলের হয় না। তারপরই একটু হেসে দু’বার ঘাড় নাড়লো।
মনে হল সে বলতে চাইছে, আমি তো সমাজ ছেড়ে শ্মশানে মশানে পাগল হয়ে আমার দরজা খুলতে চাইছি। তুমি কী করছ এখানে? যাও হে যাও…

◾ নিঝুম সন্ধ্যায়

সন্ধ্যাপাগলীকে আমি কোনওদিনই দেখিনি। তার বয়স কত,তাও জানি না। শুধু তার গান শুনেছি। এখনও যখন সন্ধ্যার আবছায়া ঘনিয়ে আসে, আস্তে আস্তে হারিয়ে যাওয়া সেই বিষণ্ণ সুর যেন শুনতে পাই।
তখন আগরতলা শহরে এত ভিড় নেই। বিশাল বিশাল দালানে ঘিঞ্জি নয় কোনও এলাকাই। খোদ মোটরস্ট্যান্ডের পেছনেই বিশাল ফাঁকা মাঠ। বিকেলের আগেই একদল ছেলেমেয়ে জুটে খেলতে যেতাম সেই মাঠে। গোল্লাছুট, টুকি, বুড়ি-গো-বুড়ি খেলতে খেলতে সারা মাঠ ছুটে বেড়াতাম। আতাগাছ, জামগাছ
সুদ্ধ আমরাই হয়ে যেতাম মাঠের রাজা। কিন্তু বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামার আগেই পুরো মাঠে আবছায়া। সব কেমন অচেনা হয়ে যায়। চেনা আতাফল গাছ, জামগাছ গুলো ভুতুড়ে হাত-পা ছড়াতে থাকে। খেলার ঝোঁকে অনেক সময় খেয়াল থাকে না, চারপাশ ঝাপসা কালো হয়ে গেছে। তখনই দূরে কোথাও শোনা যায়, সন্ধ্যাপাগলীর গলা: নিঝুম সন্ধ্যায়…

অন্ধকারে আমাদের ভয় হতে থাকে। সবাই বাড়ির দিকে ছুটতে থাকি। সবকিছু কেমন অচেনা লাগছে। অজানা ভয়ে বুক টিপটিপ করছে। নিঝুম সন্ধ্যায় পান্থপাখিরা বুঝিবা পথ ভুলে যায়… গাইতে গাইতে সন্ধ্যাপাগলী দূরে কোথাও চলে যাচ্ছে। তার গলার স্বর আস্তে আস্তে মিলিয়ে যাচ্ছে। মন কেমন করে ওঠে। যদি পথ ভুলে যাই, যদি আর ফিরতে না পারি––বাড়ি।
তখন আগরতলায় বেশিরভাগ বাড়িতেই বিদ্যুৎ নেই। টিমটিমে হ্যারিকেনের আলোয় ঘরের ভেতরটা রহস্যময়, বাঁশের বেড়ায় মা বা কারো ছায়া নড়ছে। ছুটতে ছুটতে, ওই ছায়া জমানো ঘরের ভেতর ঢুকেই মাসিমণির কোলে ঝাঁপিয়ে পড়তাম।
কী হয়েছে বাবু? বলতে বলতে মাসিমণি মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। তখনই আবার ভেসে আসে সেই গান, কুলায়ে যেতে যেতে কী যেন সংকেতে আমারে ডেকে নিতে চায়… নিঝুম সন্ধ্যা-য়…
মনে হচ্ছে, আরও কাছে চলে আসছে আমায় নিয়ে যেতে। ভয়ে কুঁকড়ে, জড়িয়ে ধরছি মাসিমণিকে। কী হয়েছে, কী হয়েছে? আঙুল তুলে দেখালাম, যেদিক থেকে ভেসে আসে সেই অদ্ভুত কান্না ধরা সুর।
কিছু আন্দাজ করে, মাসিমণি বললো, ও তো সন্ধ্যাপাগলী––গান গেয়ে চলে যায়।
আস্তে আস্তে বড়ো হয়েছি। সন্ধ্যাপাগলীকে কোনওদিনই দেখি নি। তার সত্যিকারের নামও জানি না। শুনেছি, কলেজে পড়তে পড়তে, মেয়েটি কোন এক অচেনায় পথ ভুলে চলে গিয়েছিল, আর বাড়ি ফিরতে পারে নি। এক পথ থেকে আরেক পথে তাই গানটি গাইতে গাইতে চলে যেতো।
আজকাল, ফাল্গুন-চৈত্রের সন্ধ্যায় , অচেনা-হতে-থাকা আগরতলায়, লোডশেডিংয়ের অন্ধকারে, রাস্তায় দাঁড়িয়ে কেন যেন মনে হয়, পথ ভুলে কোথায় চলে এসেছি।সবকিছু অচেনা। অন্ধকারে, বিশাল বিশাল ঘুপচি ফ্ল্যাটগুলোর দিকে তাকিয়ে ভাবি, আমি কি আর কোনও দিন ফিরতে পারবো, আমার চেনা বাড়িতে?
তখনই শুনতে পাই, সেই কোন দূর থেকে সন্ধ্যাপাগলী গাইতে গাইতে হারিয়ে যাচ্ছে, নিঝুম সন্ধ্যায়…

◾ মন চলো

মাঝে মাঝে পান সিগারেট খাওয়ার জন্য মহাকালী মিষ্টান্ন ভাণ্ডার থেকে বেরুলে, মাখনদার সঙ্গে দেখা হয়ে যেত। মাখনদা যে আমাদের দেখতো, তা নয়, আমরাই মাখনদাকে দেখতাম।
পরণে চটের বস্তা, তাও আবার গ্রীকো-রোমান স্টাইলে। মুখভর্তি কাঁচা পাকা গোঁফ দাড়ি। মাথাভর্তি এলোমেলো সাদা চুল। চোখদুটো উদাস কিন্তু উজ্জ্বল। হয়ত একজন আরেকজনকে বললাম,না রে দেরি হয়ে গেছে, বাড়ি যাই।
অমনি মাখনদা নিজের মনেই বলে উঠলেন,’ বাড়িত যে যাইবি, গিয়া কী কইবি? ‘
তখন তুমুল আড্ডা ছাড়া বেঁচে থাকার কোনও অর্থই ছিল না। আর সেই আড্ডাও বেশিরভাগ সময় কবিতা নিয়ে। সমীরণদা, ত্রিপুরাদর্পণ পত্রিকার সম্পাদক, শারদীয় সংখ্যায় কবিতা ছাপতেন, আর খুব নিচু ও নিশ্চিত স্বরে বলতেন,’ কবিতা, মোস্ট আনপ্রোডাক্টিভ ব্যাপার।’ তো, আমরা, কয়েকজন নানা বয়সের মানুষ, তখন সেই আন-প্রোডাক্টিভ ব্যাপারটি ছাড়া বাঁচার কথা ভাবতেই পারতাম না। এক অমোঘ টানে এসে জড়ো হতাম, জিবি বাজারের মহাকালী মিষ্টান্ন ভাণ্ডারে। সকাল গড়িয়ে দুপুর, কখনও কখনও প্রায় বিকেলও হয়ে যেত সেই আড্ডায়। ভুলে যেতাম বাড়িতে বাজার নিয়ে যাওয়ার কথা, কিংবা দুপুর গড়িয়ে যাওয়ার পরও ভুলে যেতাম, মা ভাতের থালা নিয়ে বসে আছেন।
কিন্তু যখনই মাখনদা বলে উঠতেন,’ বাড়িত যাইবি, গিয়া কী কইবি’––তখনই ভেতরে মোচড় মেরে উঠত।
ইদানীং বয়স হয়েছে। জানি, আন-প্রোডাক্টিভ কথাটার আরেকটা অর্থ মিথ্যা বা মায়া। শব্দ নিয়ে মিথ্যা বা মায়ার এক সংসার এখনও সাজাই। কবিতা নামে এই মায়ার সংসার সাজাতে সাজাতে প্রায়ই ভুলে যাই, স্ত্রী সন্তানের জন্য আমার কিছু করার আছে। আবার চাকরি, সংসার ছেলে মেয়ে মানুষ করতে করতে, প্রায়ই ভুলে যাই, এর বাইরে, নিজের জন্য সত্যিই কিছু করার ছিল।
মন উদাস হয়। ফুরিয়ে যাচ্ছে সময়। মাঝে মধ্যে টেপরেকর্ডারে গান শুনি, – ‘ মন চল নিজ নিকেতনে…।’
গান শুনতে শুনতে, একমুখ কাঁচাপাকা দাড়ি নিয়ে, আমি আজকাল প্রায়ই ভাবি, বাড়ি যাওয়ার সময় হয়ে আসছে।
তখনই ভেতর থেকে মাখনদা বলে ওঠে, ‘ বাড়িত যে যাইবি, গিয়া কী কইবি?’

◾ যক্ষ

পাশের বাড়ির বন্ধ ঘরটির দিকে তাকিয়ে ভাবতাম, কী রহস্য আছে এই ঘরের ভেতর? মাঝে মাঝে, নিঝুম দুপুরে বা রাত্রিতে এক অদ্ভুত গোঙ্গানি ভেসে আসত অই ঘর থেকে। কথাহীন কান্নার এই ভয়ংকর শব্দ শুনে, মায়ের দিকে তাকালে, মা বলতেন, যক্ষের কান্না। যক্ষ কী,এই নিঝুম দুপুরে বা রাতে কেন সে কাঁদে, কিছুই জানতাম না। তবু, সেই কান্না শুনে বুকের ভেতর‍টা কেমন করে উঠত।
একটু একটু করে বড় হয়েছি। তখন বছর দশেক বয়স। অই বাড়ির দিদা একদিন ডেকে বললেন, ভাই একটু সাহায্য করবি? বিছানাপত্তরগুলি রোদে দেবো।
প্রায় দুপুরে, দিদাকে সাহায্য করতে গিয়ে ; হঠাৎ যখন তিনি অই বন্ধ ঘরের দরজা খুলতে গেলেন, অজান্তেই ভয়ে দু-পা পিছিয়ে গিয়েছিলাম। দরজার ফাঁক দিয়ে দেখলাম, অন্ধকার চিরে একটুকরো আলো পড়ল একটা মানুষের ওপর। মুখ গুঁজে বসেছিল, বিছানায়। আলো পড়তেই, চোখ তুলে তাকালো। দেখি, একমাথা এলোমেলো চুল, মুখভর্তি দাড়ি, গোঁফ। চোখের তলায় গভীর কালি। অথচ জ্বলজ্বল করছে চোখ দুটো। একটুক্ষণ, তারপরই দু’হাত দিয়ে মুখ ঢেকে, সেই ভয়ংকর অসহায় গোঙ্গানি।
আয়–– বলে দিদা যখন ডাকলেন, সাহসে ভর করে সেই ঘরের ভেতরে গিয়ে দেখি, যক্ষ নয়, নেহাতই একজন মানুষ। হাঁটুর ভেতরে মুখ গুঁজে বসে আছে। ঘরের দেওয়ালে পেন্সিলে আঁকা অজস্র আঁকিবুঁকি। পানপাতার মতো অজস্র হার্ট চিহ্ন আর যোগচিহ্ন। এক দুই করে গুনতে শুরু করলাম , অজস্র। নানা আকারের।
স্কুলের ইউরিন্যালে এমন অনেক হার্ট দেখে, কিছুটা ইচঁড়ে পেকেছি ততদিনে। কিন্তু সেখানে হার্ট চিহ্নের দু’দিকে, রতন প্লাস সোমা বা বিভু প্লাস কারও নাম থাকে। এখানে কোনও নাম নেই, শুধু দুটো চিহ্ন।
এই চিহ্ন দুটো এখনও মাথার মধ্যে ঘোরে, আর মনে পড়ে এই বিকাশকাকুকে। সেই কবে ডাক্তারি পড়তে গিয়েছিল ইন্দোর। বছরখানেক পড়ার পর নাকি, সেই যে ছুটিতে বাড়ি এলো, আর ফিরে গেলো না। মেডিক্যাল কলেজের হোস্টেল ঘরের বদলে একটা বন্ধ ঘরে হাহাকার করা যক্ষ হয়ে কাটিয়ে দিল বাকি জীবনটা। আজকাল মাঝে মাঝে মনে হয়, কী হয়েছিল বিকাশকাকুর? প্রেমে প্রত্যাখাত হয়েছিল? কোনও মেয়েকে চেয়েও বলতে পারে নি? নাকি আরও গভীর কোনও ক্ষত?
অথচ কিছুই জানা হয় নি। আহা, অমন ভালো ছেলেটা, কী হয়ে গেল, এই আক্ষেপ ছাড়া কারও মুখে প্রেমট্রেম নিয়ে কোনও কানাঘুষোও শুনি নি তার সম্পর্কে।
শুধু সেদিনের দেখা সেই অজস্র হৃদয় আর যোগচিহ্নগুলো মনে পড়ে। আর মনে হয়, একটা হৃদয়, বড়ো একলা হৃদয়, বিকাশকাকুরই হয়তো, অই সর্বগ্রাসী যোগচিহ্নটি দিয়ে বোঝাতে চাইত, আমি যুক্ত হতে চাই। পারে নি। হয়তো একাকিত্বের অভিশাপ বহন করে নিয়ে এসছিল নিজেই। তাই বন্ধ ঘরের অন্ধকারে, তার ভাষাহীন হাহাকার আর নিজেকে মেলে ধরার আকুল চিহ্নগুলো আজও ভাবায়। হৃদয়ের ওপর অই যোগচিহ্নটি এঁকে বিকাশকাকু হয়তো বারবার বলতে চেয়েছে, এ হৃদয় মিলতে চায়। জানি না, কাকে চাইত বিকাশকাকুর হৃদয়। কাকে চায় চিরকালীন যক্ষের বিরহী হৃদয়? শুধু ভাষাহীন এক হাহাকার শুনতে পাই আজও। প্রত্যেকের ভেতর।

◾ হোথা

রোগা পাতলা শরীর। হাঁটেও শাঁইশাঁই করে। তার শরীর, তার হাঁটার ধরন, সব মিলিয়ে একটা মজার ব্যাপার হয়ে ওঠে। এর মধ্যে, তার শিষ্ট ভাষায় কথা বলার চেষ্টাও অনেকের কাছে বেশ হাস্যকর। ফলে, তাকে ডেকে, কথা বলে, অনেকেই বেশ মজা পায়।
জীবনে অনেক কষ্ট, দারিদ্র‍্য ভোগ করলেও ; আমার মেজোমাসির মজা করা হাসতে ও হাসাতে পারার এক অদ্ভুত গুণ ছিল। ছোট বড়ো সবারই সমবয়সী হয়ে যেতে পারতো সহজেই।
একদিন মাসির বাড়িতে বেড়াতে গেছি, সেখানেই প্রথম তাকে দেখি। হনহন করে হেঁটে আসছিল। গা ভেজা। কাঁধে ভেজা গামছা।
মাসি উঠোনে কিছু একটা করছিল। আমি পাশেই ছিলাম। হঠাৎই আমার দিকে ফিরে, ‘ একটা মজা দেখ’ বলেই, তাকে ডাকলেন, – পবন–
সে একটু থমকে দাঁড়িয়ে বললো,–’ আজ্ঞে’–
তুমি কোথা থেকে আসছ?
হোথার থেকে।– –পবন উত্তর দেয়।
মাসি হেসে, আমার দিকে একটু তাকিয়ে, আবার জিজ্ঞেস করেন, কোথায় যাচ্ছ?
হোথায় – –বলতে বলতে পবন দ্রুত পা চালায়।
মাসি বলল, কই যাও, কেমনে আইছ, জিজ্ঞেস করলে, তাকাবেও না।
যেতে যেতে শুধু বলতে থাকবে , শুদ্ধ ভাষা বলতে হয়। শুদ্ধ ভাষা বলতে হয়।
আজ, এত বছর পর, ভাষা যখন তার শুদ্ধতা- অশুদ্ধতা সবকিছু হারিয়ে এক অস্তিত্বহীন অস্তিত্বে পরিণত হয়েছে, তখন অই ‘হোথা’ শব্দটির ধাক্কায় গড়িয়ে যেতে যেতে মনে হয়, পবন ওই ‘হোথা’ জায়গাটিকে ঠিক চিনতে পেরেছিল। তাই সে হোথার থেকে হোথাতেই যায়।

জগদীশ চন্দ্রের গঙ্গাও জানে, সে কোথা হইতে আসিয়াছে, কোথায় যাইবে। কোত্থেকে এসেছি, আমরা জানি না। কোথায় যাবো, তাও না। আমাদের এই ‘ না-জানা’ টিকে হোথা বলে দাগিয়ে পবন হনহন করে হাঁটতে থাকে৷ অই তো।

◾ বুক জলের অংক

এ কে! আমার বয়সী প্রায়,অনেকটা আমারই মতো দেখতে।গালে নরম, এলোমেলো দাড়ি। আধময়লা প্যান্ট আর পাঞ্জাবি পরে একা একা হেঁটে বেড়ায়, অথবা বসে থাকে চণ্ডীবাড়ির বুড়ো বটগাছে হেলান দিয়ে। প্রায়ই দেখি।একদিন দুপুরে হঠাৎ দেখি, অমরসাগরের পাড়ে একটা ছোটখাটো জটলা। জনা পঁচিশেক লোক। দীঘির ঘাটলায়, পাড়ে দাঁড়িয়ে চিৎকার করছে, ‘যা–আরও যা।’
সেই ছেলেটা অমরসাগরের হাঁটুজলে। ওপর থেকে কেউ কেউ মাটির ঢেলা ছুঁড়ছে। সবাই চাইছে, ছেলেটা আরও গভীরে যাক। বুঝতে পারছি না, কেন, আর কী তার অপরাধ।
থমকে দাঁড়ালাম। সঙ্গে শ্যামলবাবু। আমার সিনিয়র সহকর্মী। স্থানীয় মানুষ।
বললাম, ‘এরা কি মানুষ? ছেলেটাকে এভাবে ঢিল ছুড়ছে।’
বললেন,’ খুব ভালো ছাত্র ছিল, জানেন।’
‘তাহলে এরা এমন করছে কেন?’
‘উপায় নেই। কয়েকটা ডুব দেওয়াতে পারলে, কদিন ঠাণ্ডা থাকবে। নইলে গরমে খুব ভায়োলেন্ট হয়ে ওঠে।’
পাড় থেকে তখনও সমানে ঢিল আর চেঁচানি, ডুব দে। ১০১টা ডুব দে।
‘কেউ কিন্তু ওর গায়ে ঢিল দিচ্ছে না, দেখছেন তো!’ শ্যামলবাবু বললেন।
তবু চারপাশে ঢিল আর চেঁচানির ঠেলায়, বেচারা বাধ্য হয়ে এক ডুব দেয়, তারপর বুকজলে চুপ দাঁড়িয়ে থাকে।
এক ডুব দেওয়ায় লোকের উৎসাহ বেড়ে যায়। তারা ক্রমাগত ঢিল দেয় আর চেঁচায়, ‘ এই পাগলা ডুব দে। ১০১ ডুব। ‘
কিছুক্ষণ পর, আবার এক ডুব দিয়ে, সে সোজা ঘাটে উঠে আসে। কয়েকজন আবার তাকে ঠেলে জলে ফেলতে চায়। ঝটকায় তাদের সরিয়ে, সে চেঁচিয়ে ওঠে, ‘কী হইল?’
কইলাম না ১০১টা ডুব দিতে।
সে নির্বিকারভাবে বলে, ‘দিচ্ছি তো। ‘
কই দিলি? –―মাতব্বর গোছের একজন বললো।
‘প্রথমে কয় ডুব দিছি? ‘– ―সে জিজ্ঞেস করে।
কেউ একজন বললো,’এক ডুব। ‘
‘তারপরে?’– ― আবার জিজ্ঞেস করে।
‘তারপরে ডুব দিলি কই? বুকজলে দাঁড়ায়ে রইলি।’
এবার সে বিজ্ঞের হাসি হেসে বললো, ‘ ডুব নাই, মানে শূন্য। তারপরে আবার ডুব দিছি তো, হইল নি, এক শূন্য এক। ‘ বলে সবাইকে ভ্যাবাচ্যাকা খাইয়ে, সে সোজা পাড়ে উঠে হাঁটতে শুরু করে।
শূন্যের মানে বুঝে যাওয়া সেই পাগলের কথা মনে হলে, আজ দেখি, আমিও বুক জলে দাঁড়িয়ে আছি।

Previous Post

অভিজিৎ চক্রবর্তী | দ্বিতীয় সংখ্যা

Next Post

মিলনকান্তি দত্ত | দ্বিতীয় সংখ্যা

Daruharidra

Daruharidra

Next Post
মিলনকান্তি দত্ত | দ্বিতীয় সংখ্যা

মিলনকান্তি দত্ত | দ্বিতীয় সংখ্যা

Comments 9

  1. তপন রায় says:
    7 months ago

    খুব ভালো লেগেছে।

    Reply
  2. Nobonita Barbhuiya says:
    7 months ago

    দারুণ

    Reply
  3. Rahul says:
    7 months ago

    Darun

    Reply
  4. সুশান্ত কর says:
    7 months ago

    দারুণ, পল্লবদা।

    Reply
  5. সঞ্জয়+চক্রবর্তী says:
    7 months ago

    সাধারণ কিছু ঘটনা,অথচ ব‍্যতিক্রমী আড়ালে কথাগুলি এক গভীর দর্শনের দিকে আমাদের নিয়ে যায়।কবির গদ‍্য এরকম‌ই হয়।তাঁর দেখার চোখ যে সাধারণ নয়।অনেকদিন পর পল্লব ভট্টাচার্যের গদ‍্য পড়ে খুব‌ই আনন্দিত।আপনাদের অভিনন্দন।

    Reply
  6. Tafi Mukherjee says:
    7 months ago

    অপরূপ সুন্দর ! অস্তিত্ব অনস্তিত্ব সব এক সূতোয় গাঁথা হয়ে যায়- শব্দ বুননের মায়া জাদুতে!

    Reply
  7. Tafi Mukherjee says:
    7 months ago

    অপরূপ!

    Reply
  8. Tafi Mukherjee says:
    7 months ago

    অপরূপ! অস্তিত্ব অনস্তিত্ব সব এক সূতোয় গাঁথা হয়ে যায়- শব্দ বুননের মায়া জাদুতে!

    Reply
  9. ashin says:
    7 months ago

    অসাধারণ

    Reply

Leave a Reply Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

No Result
View All Result

RECENT POSTS

সঞ্জয় চক্রবর্তী

সঞ্জয় চক্রবর্তী

08/02/2021
শংকরজ্যোতি দেব

শংকরজ্যোতি দেব

24/01/2021
ঠাকুরমার খাতা

ঠাকুরমার খাতা

16/01/2021
রবীন্দ্রনাথ ও বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী জনগোষ্ঠী : রাবীন্দ্রিক সম্পর্কের  একশো বছর | প্রথম পর্ব

রবীন্দ্রনাথ ও বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী জনগোষ্ঠী : রাবীন্দ্রিক সম্পর্কের একশো বছর | প্রথম পর্ব

08/01/2021
মনোজমোহন চক্রবর্তী | দ্বিতীয় সংখ্যা

মনোজমোহন চক্রবর্তী | দ্বিতীয় সংখ্যা

05/09/2020

পলিয়ার ওয়াহিদ | তৃতীয় সংখ্যা

05/09/2020
পার্থজিৎ চন্দ | তৃতীয় সংখ্যা

পার্থজিৎ চন্দ | তৃতীয় সংখ্যা

03/09/2020
বিশ্বজিৎ | তৃতীয় সংখ্যা

বিশ্বজিৎ | তৃতীয় সংখ্যা

03/09/2020
সঞ্জয় চক্রবর্তী | তৃতীয় সংখ্যা

সঞ্জয় চক্রবর্তী | তৃতীয় সংখ্যা

03/09/2020
রজার রবিনসন | তৃতীয় সংখ্যা

রজার রবিনসন | তৃতীয় সংখ্যা

03/09/2020

RECENT VIDEOS

https://www.youtube.com/watch?v=77ZozI0rw7w
Daruharidra

Follow Us

আমাদের ঠিকানা

দারুহরিদ্রা
কুঞ্জেশ্বর লেন
(বরাকভ্যালি একাডেমির নিকটবর্তী)
নতুন ভকতপুর, চেংকুড়ি রোড
শিলচর, কাছাড়, আসাম
পিন-788005

ডাউনলোড করুন

সাবস্ক্রাইব

Your E-mail Address
Field is required!
Submit
  • আমাদের সম্পর্কে
  • লেখা পাঠানো
  • যোগাযোগ

Copyright © All rights reserved Daruharidra | Development by Prosenjit Nath

No Result
View All Result
  • ধান্যগৃহ
  • কবিতা
  • গল্প
  • গদ্য
  • প্রবন্ধ
  • উপন্যাস
  • সাক্ষাৎ পাতা
  • অনুবাদ পাতা
  • আর্কাইভ
  • আমাদের সম্পর্কে
    • লেখা পাঠানো
    • যোগাযোগ

Copyright © All rights reserved Daruharidra | Development by Prosenjit Nath