◾শ্রীকৃষ্ণ ম্যানিফেস্টো
যুদ্ধক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে মানবজীবনকে দার্শনিক-দৃষ্টিতে দেখা বিশ্বসাহিত্যে শ্রীমদ্ভাগবতগীতার এটিই অনন্যতা। রাজনৈতিক সাম্যবাদ হচ্ছে, যে উপরে আছে, তাকে টেনে নামিয়ে নীচের সঙ্গে সমান করে দাও। গীতার সাম্যবাদ হচ্ছে,যে নীচে আছে, তাকে উপরে উঠিয়ে নাও।
“উদ্ধরেৎ আত্মনা আত্মানম্ ।।”
অষ্টাদশ শতকের শেষদিকে চার্লস্ উইলকিন্স সংস্কৃত থেকে ইংরেজিতে গীতার অনুবাদ করেন। বড়োলাট ওয়ারেন হেস্টিংস্ সেই অনুবাদটি লন্ডনে কোম্পানির অফিসে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। লন্ডন থেকে ১৭৮৫ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজিভাষায় গীতা প্রকাশিত হয়। কবি কোলরিজ তা পড়ে বলেছিলেন, মিল্টনের কাব্যের চেয়েও মহত্তরভাষায় এই গ্রন্থে পরমাত্মার মনন করা হয়েছে। ওয়ার্ডসোয়ার্থ,শেলি,ইয়েটস্,ম্যাথু আর্নল্ড, এলিয়েট প্রমুখ স্বনামসিদ্ধ কবি তাদের কাব্যে গীতার প্রভাব অস্বীকার করতে পারেননি। এমনকি, উনিশশতকের আমেরিকান কবি এমার্সন, হুইটম্যানরাও গীতাগ্রন্থের নিবিড়পাঠ করেছেন। ফরাসি ও জার্মানসাহিত্যে গীতার প্রভাব সুদুর্লভ নয়। বিশেষ করে হায়েনরিখ হাইনের কবিতায়। আবুল ফজল ও ফৈজি গীতার দুটি ফারসি অনুবাদ প্রকাশ করেন। সাজাহানপুত্র দারাশিকো বলেছিলেন, “গীতা স্বর্গীয় আনন্দের অফুরন্ত উৎস।” বাংলাকাব্যে শোনা গেছে দুঃখবাদী যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের কণ্ঠস্বর_”কে গাবে নূতন গীতা_ কে ঘুচাবে এই সুখ-সন্ন্যাস_ গেরুয়ার বিলাসিতা?” গীতা-অনুষঙ্গে বিশেষ উল্লেখ্য হয়ে আছে কবি যুগান্তর চক্রবর্তীর “স্মৃতিবিস্মৃতির চেয়ে কিছু বেশি” কাব্যের অন্তর্গত “অর্জুনবিষাদ” কবিতাটি। “শ্রীকৃষ্ণের প্রতি অর্জুন” কবিতায় যুগান্তর লিখেছেন—
“উত্তর তোমার সব জানা আছে,/
দিয়েছ উত্তর।/কিন্তু জিজ্ঞাসাই যার জীবন,/
অব্যক্ত হতে যারে /অব্যক্তে পৌঁছাতে
ফের ব্যক্ত হতে হয় বারে বারে/
সেই জানে কুরুক্ষেত্র,/তাই প্রশ্ন,তাই,
অতঃপর…”
অথবা শঙখ ঘোষের “ধুম লেগেছে হৃৎকমলে” কাব্যের “অন্ধবিলাপ” কবিতা। কী অসামান্য পঙক্তির সমাহার ঘটেছে এ
কবিতায় —
“অন্ধ আমি দেখতে পাই না,
আমিই তবু রাজ্যশিরে
এবং লোকে বলে এ দেশ
যে তিমিরে সেই তিমিরে”
“এখন আমার মনে পড়ে
বেদব্যাস যা বলেছিলেন
নিদেনকালে সমস্তদিক
নাশকচিহ্নে ছড়িয়ে যাবে”
“সমবেত লোকজনেরা
কোথায় কখন কী করছে তা
শোনাও আমায়,অন্ধ আমি,
শোনাও আমায় হে সঞ্জয়
শোনাও আমায় শোনাও আমায়
শেষের সেদিন হে সঞ্জয় !”
◾ বিবেকানন্দ এবং জীবনানন্দ
একজন সন্ন্যাসী। অপরজন কবি। একজন সন্ন্যাসে এনেছেন কবিতার ঊষাকুয়াশা। অপরজন কবিতায় এনেছেন বীতশোক নির্লিপ্তি। একজন লিখেছেন সন্ন্যাসীর গীতি। অপরজন লিখেছেন পাণ্ডুলিপির ধূসরতা। কঠ-উপনিষদ দু’জনেরই প্রিয়। দু’জনেরই প্রিয় ঔপনিষদিক চরিত্র নচিকেতা। সন্ন্যাসীর কাছে নচিকেতা আত্মশ্রদ্ধ অমৃতসন্ধিৎসু। কবির কাছে নচিকেতা জীবনজিজ্ঞাসামুখ ক্লান্ত প্রাণ এক। দু’জনই আনন্দ-অভিধাযুক্ত। একজন আনন্দতৃপ্ত। অপরজন অনন্দার অবরোহী। একজন বলেছেন,”মানুষই জীবন্ত কাব্য”। অপরজনের বিশ্বাস,কাব্যের সঙ্গে জীবনের সম্বন্ধ রয়েছে,কিন্তু প্রসিদ্ধ ও প্রকটভাবে নেই।
জীবনানন্দের গদ্যলেখায় বিবেকানন্দ-প্রসঙ্গ প্রতুল নয়। দু’একবার উল্লেখ আছে। কবি সত্যপ্রচারক বা তথাকথিত সংস্কারক নন,এই বিষয়ে “কবিতা ও কঙ্কাবতী” গদ্যে জীবনানন্দ বলেছেন,”বিবেকানন্দ ও কেশব- চন্দ্র আমেরিকা ও ইউরোপে যে বক্তৃতা দিয়েছিলেন তেমন সত্যপ্রচার নয়। আমার মনে কেমন একটা অস্বস্তিকর ধারণা জন্মেছে যে আমাদের দেশে আধুনিক কোনো কোনো সমালোচক কবিকে ছোটখাট বিবেকানন্দ, কিংবা ঠিক বলতে গেলে, পূর্ণাবয়ব শিবনাথ বাড়ুয্যে হবার উপদেশ দিচ্ছেন…।” বিবেকানন্দ সম্পর্কে উক্তিটি খুব শ্রদ্ধেয় নয়। তবে,দেশ-জাতির সুভাবক হিসেবে “যুক্তি বিজ্ঞান ও বাঙালী” প্রবন্ধে জীবনানন্দ বিবেকানন্দের প্রতি তার সম্যক শ্রদ্ধার প্রকাশ প্রচ্ছন্ন রাখেননি। স্বামীজীর দীর্ঘ উক্তি প্রায় এক স্তবক উল্লেখ করে জীবনানন্দ বলেছেন,”সত্যকথা। মনকে সতর্ক ও উন্নত না রাখলে সংস্কৃতি শিক্ষা জীবনের সবক্ষেত্রেই জাতীয়তাবাদের ফল খারাপ হতে পারে_বিবেকানন্দ যে অর্থে বলেছিলেন তা ছাড়া আরো নানা অর্থে।” “ঝরাপালক” প্রথমকাব্যে “বিবেকানন্দ” নামে দীর্ঘ ৬০ পঙক্তির একটি প্রশস্তিবাদী কবিতা লিখেছেন জীবনানন্দ। যদিও এ ধরনের কবিতা পরে আর লিখেননি।
” হে যুবক মুসাফের,
স্থবিরের বুকে ধ্বনিলে শঙখ জাগরণপর্বের।”