Daruharidra
  • ধান্যগৃহ
  • কবিতা
  • গল্প
  • গদ্য
  • প্রবন্ধ
  • উপন্যাস
Daruharidra
  • ধান্যগৃহ
  • কবিতা
  • গল্প
  • গদ্য
  • প্রবন্ধ
  • উপন্যাস
Daruharidra
No Result
View All Result
Home উপন্যাস

মিথিলেশ ভট্টাচার্য | দ্বিতীয় সংখ্যা

বাবলির জন্য রূপকথা| ধারাবাহিক | প্রথম পূর্ণাঙ্গ উপন্যাস | দ্বিতীয় কিস্তি

Daruharidra by Daruharidra
24/07/2020
in উপন্যাস
0
মিথিলেশ ভট্টাচার্য | দ্বিতীয় সংখ্যা
100
VIEWS

বোর্ডিং মাঠের শেষপ্রান্তে অর্থাৎ দক্ষিণদিকে দু’সারি টানা দোচালার বোর্ডিং হাউস।কত কত ঘটনার যে সাক্ষী ওই জীর্ণ ঘরগুলি।ফি বছর বর্ষার সময় বরাকের পাড় ওপচানো ঘোলা জলে ভেসে যেত নতুনপাড়া ও তার আশপাশ এলাকা।বাড়িঘরে কখনও এক হাঁটু কখনও বা কোমর ভাসানো বরাকের হিমশীতল জল। ঘরদোর ছেড়ে সাময়িকভাবে আশ্রয় নিতে হতো বোর্ডিং হাউসের কুঠুরিতে। কেরোসিন বা,সরষে তেলের টিন কেটে বানানো হতো চুলা।তাতে চেলা কাঠের আগুন জ্বেলে কড়াই বা ডেকচি বসিয়ে রান্না করত মা।সামান্য ডালভাতের আয়োজনকে মনে হতো অনেক।বোর্ডিং হাউজের বারান্দায় বা কুঠুরির মেঝেতে আসন পেতে বসে ডালভাত মাখা গরাস মুখে তুলতে গিয়ে কী যে রোমাঞ্চ বোধ হতো মৃগাঙ্কমোহনের।
মায়ের হাতের রান্নার সুস্বাদ স্মৃতি কোনোদিন বিস্মৃত হবে না মৃগাঙ্কমোহন।কোনো খাওয়া-দাওয়া বা রান্নার কথা মনে উঠলেই মন চলে যায় মায়ের কাছে।সামান্য লতাপাতা শাক-সব্জী দিয়ে অসামান্য ব্যঞ্জন তৈরি করত মা। বিশেষত মায়ের হাতের পোস্তবড়া ছিল তুলনারহিত।ওরকম হালকা লালচে রঙের ভাজা, মুচমুচে পোস্তবড়া আর জীবনে দ্বিতীয় কারও হাত দিয়ে তৈরি হতে দেখেনি সে।শুধু ওটিই না;আরও ছিল, পেঁয়াজ-রসুনহীন নিরামিষ মাংস, পাঁঠার মাথার ঘিলু আর মাংস দিয়ে তৈরি মসুরডাল! ছেলেবেলা ওইসব সুস্বাদ খাবার খেয়ে মৃগাঙ্কমোহন ও অন্য দু’ভাই মিলে জল্পনা করত বড় হলে পর মায়ের নামে একটি হোটেল খোলার—মনোরমা হোটেল! একটি দীর্ঘশ্বাস মোচন করে অতীতদিনের কথা ভাবে সে।

বোর্ডিং হাউসের মাঠ ছিল মৃগাঙ্কমোহনদের দিনভর খেলাধুলা আর দাপিয়ে বেড়ানোর জায়গা।মাঠের এখানে ওখানে শেয়ালকাঁটা, দ্রোণফুল আর কাঁটাডাটার ঝোপ আর সারা মাঠ জুড়ে লেংরা (চোরকাঁটা) ঘাসের জঙ্গল।ওসবকিছু অগ্রাহ্য করেই চলত মৃগাঙ্কমোহনদের খেলাধুলা,দাপানো।পৌষ সংক্রান্তির আগেরদিন মাঠের মধ্যিখানে নেরা (নাড়া) দিয়ে মেড়ামেড়ির ঘর বেঁধে রাত জেগে মাংস ভাত রান্না করে পিকনিক করার আনন্দ আর আমেজই ছিল আলাদা।পরদিন ভোর ভোর হি হি শীতে গরমজলে চান সেরে মেড়ামেড়ির ঘরে আগুন দিয়ে তাপ পোহানো আর কাঁচা মুলি বাঁশে গিট্ ফোটার দুম্ দুম্ আওয়াজ কী যে উল্লসিত করে তুলত তাদের!

বিহ্বল দৃষ্টিতে মাঠের দিকে চেয়ে থাকতে গিয়ে স্মৃতিকাতর মৃগাঙ্কমোহনের সহসাই মনে পড়ে ১৯৬০ ইংরাজির কথা।একদিন হঠাৎ করেই যেন গোটা দেশের আকাশ কালো হয়ে উঠল।বাতাসে শুধুই বিদ্বেষ বিষের গন্ধ।আসামের ‘বঙাল খেদা’র নিষ্ঠুর অস্ত্রাঘাত দেশের দক্ষিণতম প্রান্তকে শিহরিত করে দিয়েছিল সেদিন।রক্তের ছিটেয় ভরে উঠেছিল উপত্যকার শরীর।মহাবাহু ব্রহ্মপুত্রের পারে, গোরেশ্বরে, নরসংহারের নারকীয় তাণ্ডবের স্মৃতি এখনও মৃগাঙ্কমোহনকে কেমন বিবশ করে দেয়।যারা বেঁচেছিল সেসব সর্বস্বান্ত মানুষের ভিড়ে ভরে উঠছিল বোর্ডিং হাউসের ঘরদোর ও বারান্দা।

সব হারানো নারী পুরুষের এতসব তুমুল অশ্রুপাত ও হাহাকারের ভিতরে একদিন বিকালবেলা মৃগাঙ্কমোহন ও তার সঙ্গীদের চোখের সামনে উন্মোচিত হয়েছিল এক করুণ ও মর্মান্তিক দৃশ্য।
ছিন্নমূল মানুষের ওপচানো ভিড় থেকে হঠাৎ এক মধ্যবয়স্ক লোক তীব্র আর্তনাদ করে ছুটে গিয়েছিল মাঠের অন্যপ্রান্তে ইতস্তত ঘুরে বেড়ানো এক কৃশকায় ছেলের দিকে।ছেলেটি বিষন্ন চেহারা নিয়ে এদিক-ওদিক তাকিয়ে যেন কিছু খুঁজছিল।ওকে বুকের ভিতর জাপ্টে ধরে ওই লোকটির সেকী বুক ফাটানো চিৎকার করে কান্না। ছেলেটি যে তার হারানো মানিক।দাঙ্গার আগুন, নারকীয় অত্যাচার ও প্রচণ্ড গোলমালের মাঝখানে রাতের অন্ধকারে ছেলেটি ছিটকে গেছিল কোন্ অপরিচিত মানুষের ভিড়ে।

|| তৃতীয় অধ্যায় ||

মৃগাঙ্কমোহনের স্মৃতির অতলান্ত কুঠুরিতে অনেক গভীর দুঃখজনক ঘটনা জমে আছে, যার একটি সহসা স্তব্ধপ্রায় নিদাঘ দুপুরে পথ পাশের কলপারে দাঁড়িয়ে অবধারিত মনে পড়ল তার। সে এক মর্মান্তিক ঐতিহাসিক ঘটনা। পুরসভার বাঁকানো লোহার কল উঠে গেছে কবে তবু এই স্থানটি একই আছে। এখানে এসে দাঁড়াতেই মৃগাঙ্কমোহনের মনে পড়ে যায় অতীতের সেই ভয়ংকর গ্রীষ্ম -দুপুরের কথা।
সেদিন বেলা দুটো সওয়া দুটো নাগাদ মৃগাঙ্কমোহন তার নিজের ছোটভাই ও এক খুড়তুতো ভাইকে সঙ্গে নিয়ে বালতি হাতে জল নিতে এসে কলপারে দাঁড়িয়েছিল। তখনও কলে জল আসেনি। লোহার বাঁকানো পাইপে ঘড়ঘড়ে শব্দ হচ্ছিল। অর্থাৎ পুরসভার রিজার্ভার থেকে জল ছাড়া হয়েছে। গোটা শহর জুড়ে শিরা-উপশিরার মতো ছড়ানো পাইপের ভিতরে জল দৌড়াতে শুরু করেছে। ভিতরের বদ্ধ বাতাস জলের বেগে ঘড়ঘড়ে শব্দ করে বাইরে বেরুচ্ছে। আর এরকম সময়ে দক্ষিণদিক্ অর্থাৎ তারাপুরের দিক্ থেকে মৃগাঙ্কমোহনের শ্রবণইন্দ্রিয়কে চকিত করে পরপর কিছু দুম্ দুম্ শব্দ–!

দিক কাঁপানো ওই আচম্বিত শব্দাবলীকে প্রথমে ওরা কেউ শনাক্ত করতে পারেনি। শুধু চকিত, হতবাক হয়ে ভাবছিল পরপর শব্দগুলি কী এবং কেন! সেদিন ছিল ১৯৬১ ইংরাজির ১৯ শে মে। বরাক উপত্যকার মুখের ভাষা বাংলাকে রক্ষা করার দাবিতে শহর -শহরতলী-গ্রাম-গঞ্জ সব একত্রে উপুড় হয়ে জমেছিল তারাপুর রেলওয়ে ইস্টিশানে সত্যাগ্রহ আন্দোলনে। তাহলে ওখানে কী কিছু অঘটন ঘটল?
কিসের শব্দ রে-? খুড়তুতো ভাই সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল মৃগাঙ্কমোহনের দিকে।
বুঝতে পারছি না রে–।
শব্দটা তো বেশ ক’বার হল, না?
হ্যাঁরে– মৃগাঙ্কমোহন চিন্তিত গলায় বলছিল।
চল, গিয়ে দেখে আসি–খুড়তুতো ভাই বলে তাকে।
কিন্তু জল –?
এখনও তো আসেনি, আগে গিয়ে দেখে আসি, তারপর জল ভরবো’খন –।

তারপরই তিনভাই মিলে দ্রুত হাঁটতে শুরু করে দিয়েছিল তারাপুরের দিকে। কিন্তু অন্নপূর্ণা মন্দিরের সামনের রাস্তা থেকে আর এগোনো যাচ্ছিল না। অগণন কালো মাথার বিশাল ভিড় পথ জুড়ে দুর্ভেদ্য এক দেওয়াল তৈরি করেছিল সেখানে। ভিড়ের ভিতর থেকে আতঙ্কিত সুরে কেউ কেউ চিৎকার করে বলছিল, গুলি হয়েছে, গুলি–!
কে যে কাকে গুলি করছিল সেসময়
মৃগাঙ্কমোহন ও তার ভাইয়েরা বুঝতে পারেনি। ক্রমশঃ ঘটনাক্রম তাদের কাছে পরিষ্কার হয়েছিল। দীর্ঘ প্রচার ও প্রস্তুতির পর ওইদিন ছিল প্রথম প্রতিরোধের দিন। সত্যাগ্রহ। রেললাইনের ওপর বসেছিল পিকেটারদের দল। আর তাদের লক্ষ করেই পুলিশ প্রশাসন হঠাৎ গুলি ছুঁড়তে শুরু করেছিল।

তারপর বদলে গেল শান্ত, সুন্দর,ছিমছাম ছোট্ট শহর শিলচরের চেহারা। শোকময় উন্মাদপ্রায় শহর উত্তেজনায়,প্রতিবাদে প্রতিরোধে সেদিন ফুটতে শুরু করেছিল টগ্ বগ্ করে৷ প্রকৃত অর্থেই প্রতিজন বাসিন্দা বৃদ্ধ-প্রৌঢ়, যুবক-যুবতী, কিশোর-কিশোরী, মুখে প্রথম বোল্ ফোটা শিশুটিও প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠেছিল! কয়েকজন দুর্দমনীয় নবীনযুবকের অসমসাহসিক নেতৃত্বের পতাকাতলে সেদিন সামিল হয়েছিল আপামর উপত্যকাবাসী। কী যে স্বতঃস্ফূর্ত ছিল সেদিনের সকলের যোগদান যা ভাবতে বসলে মৃগাঙ্কমোহনের শরীর-মন আজও রোমাঞ্চিত হয়ে ওঠে!
ঘরে ঘরে অরন্ধন, নিষ্প্রদীপ, প্রত্যন্তগ্রাম-গঞ্জে আন্দোলনের বার্তা পৌঁছে দেবার জন্য দীর্ঘ পদযাত্রা,—প্রতিবাদের ভাষা এমন বাঙ্ময় হয়ে উঠতে দেখার অভিজ্ঞতা মৃগাঙ্কমোহনের জীবনে সেই প্রথম এবং সেই শেষ—!
কত কবিতা, ছড়া, গান, — লোক কবিদের দোতারা বাজিয়ে বাজিয়ে প্রতিবাদ আর প্রতিরোধের গান,—শরীরের রক্ত যেন ছলকে ছলকে উঠত।আবেগে, রোমাঞ্চে শরীর হত শিহরিত, কখনও চোখ দিয়ে গড়িয়ে নামত জল–!
এসবকিছু বানচাল করে দেবার জন্য প্রশাসনের কী দুরন্ত অপচেষ্টা, শহর শহরতলি জুড়ে একশ চুয়াল্লিশ ধারা জারি, কারফিউ, রাতের বেলা ফ্ল্যাগ মার্চ, সত্যাগ্রহীদের নির্বিচারে বন্দী বানানো এবং শেষমেশ ব্রিটিশদের সেই জঘন্যতম অস্ত্র প্রয়োগঃ ডিভাইড এণ্ড রোল পলিসি! হিন্দু-মুসলমানে দাঙ্গা বাঁধিয়ে দেওয়া, বাংলাভাষী মুসলমানদের দিয়ে বলানোঃ আমাগো অহম্যা লাগে—!

এখানে দাঁড়িয়ে অতীতদিনের কথাগুলো ভাবতে ভাবতে এপাড়ারই একজন বৃদ্ধ লোকের কথা মনে পড়ে। দেবতোষ সেন।রেলওয়ে ইষ্টিশানে গুলি হওয়ার খবর যিনি আতংকগ্রস্ত সুরে পাড়ার ঘরে ঘরে পৌঁছে দিয়েছিলেন।
দীর্ঘদেহি বয়োবৃদ্ধ সেন মশাই বউলঅলা কাঠের খড়ম পরে পাড়ার পিচ ঢালা রাস্তায় মাঝে মাঝেই চক্কর কাটতেন।খড়মের খটেখটে আওয়াজ এখনও যেন কানে বাজে মৃগাঙ্কমোহনের।ওর দিনের আড্ডাস্থল ছিল দুটি জায়গা।প্রথমটি দাশগুপ্তদের বাড়ি।দ্বিতীয়টি পাশের লোকনাথ ফার্মেসির চেম্বার।দুপুরবেলা ভাত খেয়ে সামান্য বিশ্রাম সেরে বিপত্নীক সেন মশাই প্রথমে চলে আসতেন লোকনাথ ফার্মেসিতে।সেসবদিনে দুপুরবেলা কলকাতা থেকে বিমানে আসত দৈনিক আনন্দবাজার, যুগান্তর, দৈনিক বসুমতী, হিন্দুস্থান ষ্ট্যাণ্ডার্ড পত্রিকা সব।
বেলা দুটো আড়াইটা নাগাদ হকার হরেন্দ্র সাইকেলের ক্যারিয়ারে পত্রিকা বোঝাই করে নিয়ে আসত। লোকনাথ ফার্মেসিতে আনন্দবাজার পত্রিকা রাখা হতো।ওখানা পড়ার উদগ্র বাসনা নিয়ে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে পাশের দেওয়াল সংলগ্ন হেলানবেঞ্চে পা তুলে বসে চাতক প্রতীক্ষায় থাকতেন দেবতোষ সেন।
শুধু উনিই না, মৃগাঙ্কমোহন ও তার ভাইয়েরাও অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করত আনন্দবাজার পত্রিকার জন্য। হকার হরেন্দ্রের হাত থেকে শিকারী চিলের ক্ষিপ্রতায় ছোঁ মেরে কাগজখানি নিতেন সেন মশাই। সকলের আগে কাগজখানা তাঁর পড়া চাই!
মৃগাঙ্কমোহন ও তার ভাইয়েরা সতৃষ্ণ চোখে তাকিয়ে থাকত কাগজের দিকে। তাদের বাড়ির কাগজ তবুও ওই কাগজে প্রথম চোখ বুলাতেন সেন মশাই!
উনি পাকিস্তানকে বলতেন পার্কিস্তান। কথাটা এখনও বেশ মনে আছে মৃগাঙ্কমোহনের।
দু’হাতে কাগজ মেলে ধরে পড়তে পড়তে কখনও সেন মশাই সশব্দ বায়ুত্যাগ করতেন। মৃগাঙ্কমোহন ও তার ভাইয়েরা হেসে কুটি কুটি হতো। এতসবেও ভ্রুক্ষেপহীন ছিলেন বৃদ্ধ দেবতোষ সেন।
পাড়া-বেপাড়ার সব খবর দেবতোষ সেনের কাছে কেমন করে যে আগেভাগে চলে আসত! তাইতো সকলে তাকে আড়ালে ‘গেজেট’ বলে ডাকত। আর নানা কারণে পাড়ার ছেলেমেয়েরা ওকে ভয়ও পেত।শুধু দু’জন ছাড়া। টুনুদা আর রানাদা।ওদের স্বাস্থ্যোজ্জ্বল তরুণ শরীরের চেহারাকে উনি উল্টে ভয় পেতেন।মাঝে মাঝে উনি বলতেনও ‘ওই দুটি গুণ্ডাকে আমি ভয় করি, কখন না জানি বাঘের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে আমার ওপর!’

দাশগুপ্তদের বাড়ির সামনের প্রশস্ত বারান্দায় সিমেন্ট বাঁধানো হেলান চেয়ার ছিল দেবতোষ সেনের বিশ্রাম্ভালাপের স্থান।সকাল-দুপুর-বিকাল এই তিনভাগের কোনোও একভাগে সেখানে বসে খোশগল্পে মগ্ন হতেন।তবে বেশিরভাগ দিন বিকালবেলাই। সোমত্ত সব নাতিনিরা বসত ওর দু’ পাশে।অনুদি আর মিনুদিই ছিল ওর বেশি অন্তরঙ্গ। বৃদ্ধবয়সে দু’পাশে দুই সুন্দরী সোমত্ত নাতনিকে নিয়ে বসে গল্প করাকে অনেকেই অন্যচোখে দেখত। বলতো বুড়ো ভামের কাণ্ড দ্যাখো!
অনেকে বলত গল্প করতে করতে কখনও নাকি সেন মশাই লোলচর্ম জরাগ্রস্ত হাতের সুখও মেটাতেন!
ওই বাড়ির একটি মেয়ে কিশোরী শুভ্রাকে পড়ানোর দায়িত্ব পেয়েছিল মৃগাঙ্কমোহন।সেসব দিনে প্রাইভেট টিউশনি করে সে তার পড়ার খরচ চালাত। সেই ক্লাস টেন-এ পড়ার সময় থেকে টিউশন ধরছিল মৃগাঙ্কমোহন।
কিশোরী শুভ্রা সব বোনেদের মধ্যে সবচে সুন্দরী। যেমন শরীরের উজ্জ্বল ফর্সা রঙ, তেমন চেহারা। মাথায় একরাশ ঘন কালো কুকড়ানো চুল ছিল ওর। শরীরের গড়ন চমৎকার।

রোজ সন্ধ্যাবেলা গিয়ে মৃগাঙ্কমোহন হাজির হতো ওদের বাড়িতে শুভ্রাকে পড়ানোর জন্য। ওদের শোবার ঘরে শুভ্রা আর মৃগাঙ্কমোহন মুখোমুখি টেবিলে বসত। ঘরটি খুব সুন্দর করে সাজানো। দামি দামি আসবাবে ঘরটি আকর্ষণীয় করে তুলছিল। ওর বাবা মা দু’জন, শুভ্রা নিজেও ছিল খুব শৌখিন।
একদিন শীতের সন্ধ্যায় পড়ানো শেষ করে মৃগাঙ্কমোহন যখন বেরোবে বলে উঠে দাঁড়িয়েছে তখন শুভ্রা ওকে বলল, দাঁড়াও মৃগাঙ্কদা, তোমাকে একটা সুন্দর জিনিস দেখাই– বলেই ঘরের বাতি নিভিয়ে দিয়ে বলল, দেখতো, দেয়ালঘড়িটা কেমন বালবের মতো জ্বলছে অন্ধকারে –! মৃগাঙ্কমোহন মুগ্ধ চোখে সেদিকপানে তাকাতেই কিশোরী শুভ্রা পিছন থেকে তাকে জাপ্টে ধরে বলছিল,কেমন, সুন্দর না!

মৃগাঙ্কমোহনের পিঠের ওপর শুভ্রার নরম তুলতুলে নবীন স্তনের চাপ সমস্ত শরীরে লহমায় যেন আগুনের তীব্র স্রোত বয়ে গেল।ঝিম্ ঝিম্ করে উঠেছিল তার গোটা শরীর— জীবনে প্রথমবার নারী শরীরের আস্বাদ তাকে যেন সেমুহূর্তে বিবশ-বিকল করে দিয়েছিল—!
ওই চকিত ঘটনা আজও তাকে কেমন বিহ্বল করে দেয়। জীবনে প্রথম প্রেমের পাঠ কী মৃগাঙ্কমোহনের ওরকমভাবেই শুরু হয়েছিল?
না! মৃগাঙ্কমোহনের ভিতর থেকে কেউ যেন বলে ওঠে।
বোর্ডিং মাঠের পূব দিকের প্রান্ত সীমায় বড়নালাটা যেখানে বাঁক খেয়ে দক্ষিণমুখী হয়েছে সেখানে গরীবগুর্বো লোকের সামান্য বসতভিটের ভাঙাচোরা চিহ্ন এখনও ছড়িয়ে আছে দেখতে পায় মৃগাঙ্কমোহন। স্থির চোখে ওদিকে তাকিয়ে ভাবে অঞ্জলি এখন জানি, কোথায় আছে!
অঞ্জলির বাবা-মা নিশ্চয়ই এতদিন বেঁচে নেই।ওর ভাইয়েরাও নিশ্চয় ছড়িয়ে আছে কোথাও না কোথাও। আর অঞ্জলি? লহমায় মনটা যে কোন সুদূরে দৌড়ে ছুটে যায়।
অঞ্জলির বাবা ছিল অভয়াচরণ পাঠশালার চৌকিদার। আর চৌকিদারের মেয়ে অঞ্জলি ছিল এক নবীনা কিশোরী। ফুটফুটে ফর্সা চেহারার বালক মৃগাঙ্কমোহন তখন দলবেঁধে যেত ঢাকাইপট্টির সরকারি পুকুরে চান করতে।অঞ্জলিও আসত সেখানে। জলে দাপাদাপি করে চান করতে করতে একদিন কামদেব-শরে সহসা বিদ্ধ মৃগাঙ্কমোহন সুডৌল,সুগোল উজ্জ্বল শ্যামবর্ণা সুশ্রী অঞ্জলির প্রতি আকৃষ্ট হয়ে মুহূর্তে মজে গেছিল! অঞ্জলিরও একই অবস্থা হয়েছিল। প্রথম প্রেমের কদমফুল ফুটেছিল দু’জনের মনে।মুগ্ধ চোখে একজন অন্যজনকে দেখছিল নির্নিমেষ। তারপর থেকে কখনও খেলার মাঠে দাঁড়িয়ে বেভুল মৃগাঙ্কমোহন তাকিয়ে থাকত অঞ্জলিদের মাটির ঘরের উঠানের দিকে।আর অঞ্জলি কাজ-অকাজের ছুতোয় বার বার ঘর-বার করত। বয়সের সন্ধিক্ষণ সেটা।দু’জনের শরীর-মনে নতুন যৌবনোদ্গম হচ্ছে। শরীরের ভিতরে আরেকটা শরীর জেগে উঠছে। কী এক অদম্য অবোধ যৌন আকর্ষণে যে বাঁধা পড়ে যাচ্ছিল দুটি মন–!

সংসার অভিজ্ঞ অঞ্জলির বাবা-মায়ের চোখে ধরা পড়ছিল মেয়ের চপলমতি চঞ্চলতার কথা।বাড়ির উঠানের পাশ দিয়ে মৃগাঙ্কমোহনের কখনও আনাগোনা বা কাছের খেলার মাঠের কিনারায় মান্দার গাছের নীচে দাঁড়িয়ে থেকে অঞ্জলিদের বাড়ির দিকে নির্নিমেষে তাকিয়ে থাকা এসব কিছুই সম্ভবত চোখে পড়ছিল ওদের। একদিন সহসা মৃগাঙ্কমোহনের কানে এসেছিল একটি কথা, যা তখন সঠিক বুঝতে পারেনি সে।অঞ্জলির বাবা ওর মাকে বলছিল, দুইটাই তো বকনা, চউখে চউখে রাখতে অইব!

অনেকদিন পর ‘বকনা’ শব্দের মানে,ওদের কথার মানে বুঝতে পেরেছিল মৃগাঙ্কমোহন। ‘বকনা’ হচ্ছে গাভীর স্ত্রী বা পুরুষ বাছুর।

আজ অঞ্জলি জানি কোথায় আছে! প্রান্তরের দিকে দৃষ্টি মেলে খানিক উদাস মনে ভাবে মৃগাঙ্কমোহন। বড়বড় গাছপালা আর দুরন্ত জঙ্গলের আড়ালে হারিয়ে গেছে ওদের সামান্য বসতভিটে। পুরুষ বা নারীর জীবনে কখন কীভাবে যে প্রেমের ফুল ফুটবে তা কেউ আগে থেকে বলতে পারে না। নিতান্ত গরীব ঘরের মাটির উঠোন বা ধনীর হর্ম্যতলেও দৃষ্টির আড়ালে ফুটতে পারে প্রথম প্রেমের আশ্চর্য কদমফুল–!
কখন কীভাবে যে অঞ্জলির আকর্ষণ থেকে বিচ্যুত হয়েছিল মৃগাঙ্কমোহন বা তারা দু’জনেই একে অপরের কাছ থেকে দূরে চলে গেছে সে সব বৃত্তান্ত এখন আর মনে পড়ে না, তবে এর বেশ কিছুদিন পর অঞ্জলিই যেন আবার নতুন রূপে চলে এসেছিল মৃগাঙ্কমোহনের বালকবয়সের দুরন্ত দিনগুলোকে প্রেমের শিহরিত অনুভবে আবেশময়,আনন্দময় অভিজ্ঞতায় ভরপুর করে দিতে—!
সরকারি বিদ্যালয়ের বিজ্ঞান শিক্ষক কান্ত চৌধুরীর কিশোরী কন্যা কমল,কমললতা।মৃগাঙ্কমোহনদের বাড়ির পিছনের পুকুরপাড়ে সীমানা ঘেঁষে ওদের টলটলে জলের বড়পুকুর, বাড়ি।সেসব দিনে পুকুরে ছিপ ফেলে মাছ ধরা ছিল মৃগাঙ্কমোহনের প্রবল নেশা।সকাল-বিকাল ছিপ হাতে কিশোর মৃগাঙ্কমোহন পুকুরপাড়ের এদিক-ওদিক ঘুরত আর সেসব সময়ে কখনও কমললতা চাল ধুতে বা অন্যকোনো কাজ করতে তাদের পুকুর-ঘাটে এসে দাঁড়াত।শ্যামলাবরণ সুশ্রী ছিপছিপে কিশোরী তার দুই ডাগর চোখে অপার কৌতূহল নিয়ে তাকাত গৌরবর্ণ মৃগাঙ্কমোহনের দিকে।বাড়ির পিছনে নির্জন পুকুর পাড়ে সকাল বিকাল বা দুপুরে প্রায়ই দেখা হতো দু’জনের।প্রথমে যা ছিল নিছক কৌতূহল ক্রমে তা বদলে যায় সুতীব্র আকর্ষণে। দু’জন দু’জনের দিকে নিঃশব্দে তাকিয়ে কত কত সময় যে কাটিয়ে দিত—!

দিনের পর দিন পুকুরপাড়ের আম-জাম-কাঁঠাল-সুপারি আর কাঠবাদাম গাছের ছায়ায় ছিপ হাতে মগ্ন থাকত ফুটফুটে গৌরবর্ণ কিশোর এক, চণ্ডীদাস মৃগাঙ্কমোহন যার নাম। শ্যামলাবরণ ছিপছিপে ফ্রকপরা কিশোরী রামী রজকিনী কমললতা আসত ঘাটে চাল ধুতে— একমরণে দু’জন মরতে বসেছিল সেদিন, কিন্তু হল না,— মাঝখানে এসে গেল ননীচোরা নওলকিশোর ঘনশ্যাম নামের আরেক কিশোর–!

তবে মৃগাঙ্কমোহনের জীবনে সত্যিকারের প্রেম এসছিল প্রায় বার্ধক্যে উপনীত হবার পর।রীতিমতো সম্বন্ধ করে ভুবন চা-বাগিচার বড়বাবু নিশিপদ’র বড় মেয়ে নীলিমার সঙ্গে বিয়ের গাঁটছড়া বেঁধেছিল সে।তারপর সুখ-দুঃখের দোলায় দুলতে দুলতে দু’জনের দাম্পত্য জীবনের দীর্ঘ সময় কেটে যাবার পর বদলির চাকুরিতে স্বল্পকালের এক অবিচ্ছিন্ন সময় প্রবাহে পরস্পরকে বাধাহীন অবস্থায় কাছে পেয়েছিল তারা, এখন ঘন রসের মতো গাঢ় আকাঙ্খায় তাদের মনে ধরা দিয়েছে ‘প্রেম’, ‘মুখোমুখি বসিবার’, সব আয়োজন পূর্ণপ্রায় আর তখনই সহসা যেন সব শূন্য হয়ে গেল, সব আলো গেল নিভে, নিকষকালো আঁধারে ছেয়ে গেল চারপাশের পৃথিবী, এক কালব্যাধি নীলিমাকে নিল কেড়ে…।
সেসব অভিজ্ঞতার কথা, চলে যাওয়া দিনের কথা শোক-তপ্ত, ভাঙা হৃদয় মৃগাঙ্কমোহন কিছু লিখে রেখেছে দিনলিপির গোপন খাতায়।

Previous Post

সুশান্ত কর | দ্বিতীয় সংখ্যা

Next Post

অঞ্জলি (নার্জারি) বসুমতারি | দ্বিতীয় সংখ্যা

Daruharidra

Daruharidra

Next Post
অঞ্জলি (নার্জারি) বসুমতারি | দ্বিতীয় সংখ্যা

অঞ্জলি (নার্জারি) বসুমতারি | দ্বিতীয় সংখ্যা

Leave a Reply Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

No Result
View All Result

RECENT POSTS

সঞ্জয় চক্রবর্তী

সঞ্জয় চক্রবর্তী

08/02/2021
শংকরজ্যোতি দেব

শংকরজ্যোতি দেব

24/01/2021
ঠাকুরমার খাতা

ঠাকুরমার খাতা

16/01/2021
রবীন্দ্রনাথ ও বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী জনগোষ্ঠী : রাবীন্দ্রিক সম্পর্কের  একশো বছর | প্রথম পর্ব

রবীন্দ্রনাথ ও বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী জনগোষ্ঠী : রাবীন্দ্রিক সম্পর্কের একশো বছর | প্রথম পর্ব

08/01/2021
মনোজমোহন চক্রবর্তী | দ্বিতীয় সংখ্যা

মনোজমোহন চক্রবর্তী | দ্বিতীয় সংখ্যা

05/09/2020

পলিয়ার ওয়াহিদ | তৃতীয় সংখ্যা

05/09/2020
পার্থজিৎ চন্দ | তৃতীয় সংখ্যা

পার্থজিৎ চন্দ | তৃতীয় সংখ্যা

03/09/2020
বিশ্বজিৎ | তৃতীয় সংখ্যা

বিশ্বজিৎ | তৃতীয় সংখ্যা

03/09/2020
সঞ্জয় চক্রবর্তী | তৃতীয় সংখ্যা

সঞ্জয় চক্রবর্তী | তৃতীয় সংখ্যা

03/09/2020
রজার রবিনসন | তৃতীয় সংখ্যা

রজার রবিনসন | তৃতীয় সংখ্যা

03/09/2020

RECENT VIDEOS

https://www.youtube.com/watch?v=77ZozI0rw7w
Daruharidra

Follow Us

আমাদের ঠিকানা

দারুহরিদ্রা
কুঞ্জেশ্বর লেন
(বরাকভ্যালি একাডেমির নিকটবর্তী)
নতুন ভকতপুর, চেংকুড়ি রোড
শিলচর, কাছাড়, আসাম
পিন-788005

ডাউনলোড করুন

সাবস্ক্রাইব

Your E-mail Address
Field is required!
Submit
  • আমাদের সম্পর্কে
  • লেখা পাঠানো
  • যোগাযোগ

Copyright © All rights reserved Daruharidra | Development by Prosenjit Nath

No Result
View All Result
  • ধান্যগৃহ
  • কবিতা
  • গল্প
  • গদ্য
  • প্রবন্ধ
  • উপন্যাস
  • সাক্ষাৎ পাতা
  • অনুবাদ পাতা
  • আর্কাইভ
  • আমাদের সম্পর্কে
    • লেখা পাঠানো
    • যোগাযোগ

Copyright © All rights reserved Daruharidra | Development by Prosenjit Nath