২২ আগস্ট বৃহস্পতিবার, রাত বারোটা
থানার সামনে বাইকটা দাঁড় করিয়ে প্রথম একটা বড়ো করে শ্বাস নিল অশোক। সেই শ্বাস নেয়াটা বাংলা অনুবাদে দাঁড়াবে – যাক, শেষ পর্যন্ত! স্ট্যান্ডটা টেনে সোজা করে নামিয়ে বাইক লক করে কথাটা সে বলেও ফেলল – যাক পৌঁছনো তো গেল শেষ পর্যন্ত! আসতে আসতে ভাবছিলাম শালার ইন্সিওরান্স পলিসিটা আপটুডেট আছে তো? কে কোন গলি থেকে দড়াম করে চালিয়ে দেবে, তারপর সারা রাত রাস্তায় বেওয়ারিশ পড়ে থাকতে হবে!
রাস্তা থেকে এক চিলতে জমি পেরিয়ে থানা। সেই জমিটুকুতে দু তিনটে পুলিশের জীপ পার্ক করা, একপাশে একটা দুমড়ে যাওয়া মারুতি গাড়ি, বোধহয় কোনো অ্যাকসিডেন্ট এর পর উদ্ধার করে নিয়ে আসা। থানার সামনের বারান্দায় পুলিশ গিজগিজ করছে, একটা দাঁড় করানো জীপের ভেতর থেকে ওয়াকিটকিতে স্ট্যাটিক জড়ানো কথাবার্তার শব্দ, আকাশে চাঁদ আধখানা, মাঝনদীতে একলা নৌকোর মতো নিজের খেয়ালে ভেসে যাচ্ছে।
বিপাশার চোখ সেকেন্ড দুয়েকের মধ্যে এই পুরো দৃশ্যটা জরিপ করে নিল। তার বুকের ভেতর এখনো আরতির ঢাক বাজছে, মাথার ভেতর দুই গরিলার দড়ি টানাটানি। ভগবান কি তার জন্যেই এই সব অসম্ভব ক্রাইসিস তৈরি করে রেখেছেন? অবশ্য ভগবান নেই, ভগবান থাকলে –
অশোক বলল – কতো পুলিশ লক্ষ করেছো? আজ রাতে হয়তো বড়ো ধরণের কোন অ্যাকশন হতে পারে। ওই হতভাগাটাকে নিয়ে ভালোয় ভালোয় ফিরতে পারলে বাঁচা যায়।
বিপাশা, তার যাবতীয় দুর্ভাবনা এবং টেনশনের মধ্যেও, অশোকের জন্যে সহানুভূতি বোধ করল। বেচারি। আজ এই রাতে যাবতীয় ঝুঁকি ঘাড়ে নিয়ে তার এখানে আসার কথা ছিল না। সেও বিপাশার মামাতো ভাইয়ের মতো এড়িয়ে যেতে পারত, ওরকমভাবেই ফোনে বলতে পারত – চিন্তা করিস না, এক রাত থানায় থাকলে কিছু হবে না, কাল সকালে খোঁজ নেয়া যাবে। রাতে রিস্ক নিয়ে কাজ নেই। তোদের পাড়ার শরিফুলকে রাস্তার মোড়ে স্ট্যাব করেছে, পুরো এরিয়াটা সন্ধে থেকে থমথমে হয়ে আছে। কিছু মনে করিস না, সুরজিতদা হ্যাজ ডান এ ভেরি ইরেসপন্সিবল থিং।
উপায়ান্তর না দেখে বিপাশা তারপর অশোককে ফোন করে। অশোকও রাজি না হলে, এবং সে জন্যে তাকে কোনো দোষও দেয়া যেত না, সে একা মেয়ে এই দুর্যোগের রাতে কতটুকু কি করতে পারত? টু হিজ এভারলাস্টিং ক্রেডিট, অশোক ফোন পেয়েই বলেছিল – কিচ্ছু ঘাবড়িও না, বিপাশা, আমি বাইকটা নিয়ে পাঁচ মিনিটের মধ্যে পৌঁছচ্ছি। এবং ঠিক পাঁচ মিনিটের মাথায় নীচে থেকে হর্ন দিয়ে জানান দিয়েছিল সে হাজির।
রাস্তায় আসতে আসতে অশোক বিপাশার কাছ থেকে পুরো ঘটনাটা জেনেছিল। বিপাশার জন্যে ওষুধ কিনতে বেরিয়েছিল সুরজিত, আধা ঘন্টার মধ্যে ফিরে আসার কথা ছিল। যখন পাক্কা দু ঘন্টা অপেক্ষা করার পরও সুরজিত ফিরল না, বিপাশা বন্ধুবান্ধব, হাসপাতাল, থানা সব জায়গায় ফোন করতে আরম্ভ করে। কোনো জায়গা থেকেই কোনো পজিটিভ সাড়া না পেয়ে বিপাশা যখন উৎকণ্ঠা ও আতংকের চরম সীমায়, তখন থানা থেকে ফোন আসে। ওমাথা থেকে এক কর্কশ পুরুষকণ্ঠ তাকে জানায় যে সুরজিতের চেহারার বর্ণনার সঙ্গে মিলে যাওয়া একজনকে ঘন্টাখানেক আগে রাস্তায় উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘোরাঘুরি করার জন্যে থানায় তুলে নিয়ে আসা হয়েছে। সে নামও বলেছে সুরজিত, কিন্তু তার কথাবার্তা এতো অসংলগ্ন যে নিশ্চিত হবার জন্যে পুলিশ চায় বিপাশা থানায় এসে আইডেন্টিফাই করুক।
থানার ভেতর সরগরম। মুহুর্মুহু ফোন বাজছে, ফোনে ইয়েস স্যার ইয়েস স্যার বলে নামিয়ে রাখার পরই উঁচু গলায় নির্দেশ যাচ্ছে থানার বাইরের ঘর থেকে ভেতরের দিকে, ইউনিফর্ম পরা সশস্ত্র পুলিশ ঢুকছে আর বেরোচ্ছে, বাইরে জীপের স্টার্ট নেবার শব্দ; অশোক নীচু গলায় বলল – সুরজিতটা শালা আর দিন পেল না!
বেশ কিছু সময় ওদের অপেক্ষা করতে হল। যে পুলিশ অফিসারটি ওদের খবর দিয়েছিলেন, তিনি অন্য কাজে ব্যস্ত ছিলেন।শস্তা প্লাস্টিকের চেয়ারে পাশাপাশি বসে থাকতে থাকতে দুজনে অলস চোখে থানার ভেতরের আসবাবপত্রের আনাচকানাচ দিয়ে দ্রুত ধাবমান আরশোলা, পাশের টেবিলে মোবাইলে কান লাগিয়ে বসে থাকা অফিসারটির বড়ো ঝোলা গোঁফ, ওই কোণে দাঁড়িয়ে খৈনি ডলতে থাকা কনস্টেবলের গালের জড়ুল, দেয়ালে মহাত্মা গান্ধীর ধূলিধূসর ফ্রেমে আটকানো ছবি, তার ওপর দিয়ে সরসর করে দৌড়ে যাওয়া বিশাল এক কালো মাকড়শা, থানার মেঝের ঠিক মাঝখানটায় সরু সরলরেখার মতো ফাটল এই সব দেখা শেষ করে এনেছে, তখন অশোকের মনে পড়ল। সে বিপাশার দিকে ফিরে বলল – তুমি রাতে কিছু খাও নি বোধহয়।
বিপাশা হাসল। তারপর বলল – তুমি আজ যে সাহায্য করলে অশোকদা, সারাজীবন তোমার ঋণী হয়ে থাকবো।
অশোক হাত দিয়ে মাছি তাড়ানোর ভঙ্গি করল।
দূর, বাদ দাও তো। সুরজিত আমার হাফপ্যান্ট পরার সময় থেকে বন্ধু, ওর জন্যে যমের দুয়ার পর্যন্ত হেঁটে যেতে রাজি আছি, এ তো কিছুই না।
বিপাশা আবার হাসল। জানি। আচ্ছা অশোকদা, তোমার পাড়ায় সব ঠিক আছে?
অশোক কাঁধ ঝাঁকাল। টাচ উড, আজ রাতে যদি আর কিছু না ঘটে। রাস্তার মোড়ে অবশ্য সি আর পি টহল দিচ্ছে। খেয়াল করেছো, থানায় আসতে আসতে কতোগুলো চেক পয়েন্টে আটকালো আমাদের? এক সময় মনে হচ্ছিল গুণ্ডার ছুরিতে যদি না ও মরি, সি আর পির লাঠির বাড়ি খাওয়া কেউ আটকাতে পারবে না।
বিপাশার মনে মনেও এই ভয়টা ছিল, যে জন্যে অশোকের কথাটা সে হেসে লঘু করে দিতে পারল না। সি আর পি গুলোর হাবভাব ছিল খুবই মারমুখী, যে কোন ছুতোয় লাঠির গুঁতো দেবার জন্যে যেন তৈরি হয়ে আছে। আর কিরকম বিশ্রী ভাবে তার দিকে তাকাচ্ছিল! জলে কুমির ডাঙায় বাঘ, কোথায় যে পা রাখি আমরা!
কী যে চলছে চারদিকে! কবে শেষ হবে এই পাগলামি?
বিপাশার এই প্রশ্নের ভেতর উত্তরটা আগেই জানার এমন একটা হতাশ্বাস শ্রান্তি ছিল, অশোক চুপ করে মহাত্মা গান্ধীর ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকল। পাগলামি তো বটেই, যে পাগলামি থামার নয়, এমন এক রোগ যা কিছুদিন আরোগ্যের ছদ্ম নিশ্চিতি দেবার পর শরীরের অন্য কোনো অংশে চাড়া দিয়ে ওঠে। তার সঙ্গে এটাও ঠিক যে বীজ যেই বপন করে থাকুক না কেন, এই ভাইরাসের বিস্তৃতিতে তাদের সবারই অবদান রয়েছে।
আজ সারারাতই এখানে বসে থাকতে হবে মনে হচ্ছে।
বলতে বলতে সাব ইন্সপেক্টরবাবু এসে গেলেন। ভারিক্কি চেহারার, মধ্যবয়েসী, উর্দি ঘামে জবজব করছে, কিন্তু মুখ দেখে বিপাশার মনে হলো ফোনে গলাটা যেমন রুক্ষ্ম শুনিয়েছিল, ভদ্রলোক আসলে হয়তো ততটা খারাপ না।
সাব ইন্সপেক্টর চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে একটা পেন্সিল বিপাশার দিকে উঁচিয়ে প্রশ্ন করলেন – আপনি বিপাশা রায়? ফোনে আপনার সাথেই কথা হয়েছিল?
বিপাশা ঘাড় নাড়ল। ইন্সপেক্টর সাহেব, সুরজিত ঠিক আছে তো? কোনো –
ইন্সপেক্টর এবার পেন্সিলটা অশোকের দিকে তাক করলেন। আপনি?
অশোক পরিচয় দেবার পর ভদ্রলোক কিছুক্ষণ পেন্সিলটা নিয়ে নাড়াচাড়া করলেন। তারপর একটা ময়লা রুমাল বের করে কপালের ঘাম মুছে বিপাশার দিকে তাকিয়ে বললেন – সুরজিতবাবুর, মানে আপনার স্বামীর কি কোনো সাইকিয়াট্রিক প্রবলেম আছে?
বিপাশার চোখে আশংকার ছায়া পড়ল।
কেন, একথা কেন বলছেন? কী হয়েছে সুরজিতের? আমি ওকে এক্ষুনি দেখতে চাই।
অশোক বলল – সুরজিত পারফেক্টলি নর্মাল, ইন্সপেক্টরবাবু। আজ বিকেলেও ওর সাথে ফোনে কথা হয়েছে।
ইন্সপেক্টর অশোকের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন। মাথার ওপরের পাখাটা কি আরেকটু জোরে ঘুরতে পারে না? বিপাশার কপালে স্বেদবিন্দু জমছিল। পেন্সিলটা টেবিলে নামিয়ে রেখে ভদ্রলোক বিপাশার দিকে ফিরে বললেন – কেন বলেছি, আপনার স্বামীর সাথে কথা বললেই বুঝতে পারবেন। তবে আপনাদের ভাগ্য ভালো পুলিশ ওকে দেখতে পেয়ে থানায় তুলে এনেছে। স্বামীকে নাহলে হয়তো জীবন্ত ফিরে পেতেন না। আজ রাতে এখন পর্যন্ত ওই এলাকায় তিনটে স্ট্যাবিং এর ইনসিডেন্ট রিপোর্টেড হয়েছে।
অশোক টের পেল বিপাশার হাত পা থরথর করে কাঁপছে। তার নিজেরও মাথার ভেতরটা কেমন গোলমাল হয়ে যাচ্ছিল। সুরজিত তার সবচেয়ে কাছের বন্ধু, কিন্তু শুধু তাই নয়, এমন বুদ্ধিমান, বিবেচক, বন্ধুবৎসল মানুষ সে তার জীবনে কম দেখেছে। এই দু তিন ঘন্টার ভেতর এমন কী হয়ে থাকতে পারে যে পুলিশের ওকে রাস্তা থেকে ধরে আনতে হয়, বা ভাবতে বাধ্য হতে হয় যে ওর মাথায় গোলমাল আছে? কী করেছে সুরজিত? কী হয়েছে সুরজিতের?
বিপাশা আকুল গলায় বলল – ওকে ছেড়ে দিন, ইন্সপেক্টর সাহেব। আমি ওকে বাড়ি নিয়ে যাবো। প্লিজ।
পেন্সিলটা আবার ইন্সপেক্টরের হাতে ফিরে গিয়েছিল। একজন পুলিশের পক্ষে মুখের ভাব যতোটা কোমল করা সম্ভব ততোটা করে তিনি পেন্সিলের মুখটা আস্তে আস্তে বাঁদিকে ঘুরিয়ে দিলেন। সেদিকে ফিরে বিপাশা দেখল থানার করিডরের মুখটায় সুরজিত দাঁড়িয়ে আছে। মুখচোখ শুকনো, চোখদুটো কেমন উদ্ভ্রান্ত।
চেয়ারটা ঠেলে সরিয়ে উঠে দাঁড়াল বিপাশা। সুরজিতের পেছনে দাঁড়িয়ে এক কনস্টেবল, সুরজিত প্রথমে বিপাশাদের দেখতে পায় নি, কনস্টেবল ভদ্রলোক হাতের ইশারায় দেখালেন। বিপাশা দেখল সুরজিতের মুখ নিমেষে আলো হয়ে উঠেছে। সে দ্রুত পায়ে ওদের দিকে এগিয়ে এল। বিপাশার সারা শরীর তখনো কাঁপছে যখন সুরজিত তার খুব কাছে এসে দাঁড়িয়ে তার চোখে চোখ রেখে হাসল।
অনেক কষ্ট দিলাম তোমাকে, তাই না?
বিপাশা টেরও পায়নি তার দুচোখে বৃষ্টি ধারা হয়ে নামছে। সুরজিত ইন্সপেক্টরের দিকে তাকিয়ে বলল – আমার স্ত্রী বিপাশা, আর ওই যে আমার বন্ধু অশোক। ইজ মাই আইডেন্টিটি এস্টাব্লিশড নাউ? আমরা কি বাড়ি যেতে পারি?
পেন্সিল টেবিলের ওপর গড়িয়ে দিয়ে ইন্সপেক্টর উঠে দাঁড়ালেন।
হ্যাঁ যান। এসকর্ট দিয়ে দিচ্ছি সঙ্গে, নইলে এ রাতে একলা ফিরতে পারবেন না। আর শুনুন, বি কেয়ারফুল, অ্যান্ড ট্রাই টু কীপ আউট অফ ট্রাবল। নিজের বাড়ির ঠিকানাও বলতে পারেন না, কীরকম মানুষ মশাই আপনি?
অশোক বলল – অনেক ধন্যবাদ আপনাকে, ইন্সপেক্টর সাহেব। তারপর সজোরে সুরজিতের পিঠে একটা চাপড় মারল।
শালা দেখালি বটে। মনে হচ্ছে যেন হামফ্রে বোগার্ট লরেন বাকাল এর কোনো ছবির লাস্ট সিন দেখছি।
সুরজিত হেসে উঠল। বিপাশাও। সুরজিত অশোকের কাঁধে হাত দিয়ে গভীর গলায় বলল – তোর মতো একজন বন্ধু পাওয়া যে কতোখানি ভাগ্যের সেটা সারাজীবনই বুঝছি, আজও নতুন করে বুঝলাম।
অশোক প্রতিবাদ করে কিছু বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই সুরজিত বিপাশার দিকে ফিরে চিন্তিত গলায় বলল – তুমি যে থানায় এলে, এতো রাতে টিটোকে কার কাছে রেখে এসেছো?
টিটো?
বিপাশার শরীরের সমস্ত বাঁধুনি আলগা হয়ে এল, তার পায়ের নীচে মাটি মাতালের মতো দুলছিল। ছেড়ে রাখা চেয়ারটায় কখন আবার বসে পড়েছে, সে নিজেই বুঝতে পারে নি।
টিটো?
২২ আগস্ট বৃহস্পতিবার, দুপুর দেড়টা
অশান্তি বেশ কদিন ধরেই চলছিল, এখানে ওখানে চোরাগোপ্তা মার, গলিঘুঁজির অন্ধকারে দু একটা স্ট্যাবিং, স্থানীয় সংবাদপত্রে সাম্প্রদায়িক আবেগের আগুনে ঘি ঢালা সম্পাদকীয়, পাড়ায় পাড়ায় রাতটহল, শহরে কোথাও যেতে হলে বিশেষ বিশেষ কিছু রাস্তা বাঁচিয়ে চলা, ফলে সবার মনে মনে একটা প্রস্তুতি ছিলই, তাই যখন দুপুরে খবর এল অজ্ঞাতনামা দুষ্কৃতিকারীরা শহরের একশো বছরের পুরনো কালীবাড়ির সামনে গরু মেরে ফেলে গিয়েছে, সুরজিতের অফিস দশ মিনিটের মধ্যে ফাঁকা হয়ে গেল।
একটা ইমেল কর্পোরেট অফিসে সেদিনই পাঠিয়ে দিতে হবে, তাই সুরজিত সবার সঙ্গে বেরোতে পারে নি। ব্যস্তসমস্ত হয়ে টাইপ করছিল, বীরেনদা ব্রিফকেস হাতে বেরিয়ে যাবার মুখে তার টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে বলল – চল শালা, আর কাজ দেখাতে হবে না। আর কাকে কাজ দেখাবি, বড়ো সাহেব নিজেই তো একটু আগে গাড়ি নিয়ে ভোঁকাট্টা হয়ে গেল।
সুরজিত হাসল। আরে না না বীরেনদা, তুমি এগোও, আমি আসছি। জাস্ট পাঁচ মিনিট।
দীপু বীরেনদার পেছনেই ছিল, বলল – কাকে বলছো, বীরেনদা। কর্তব্যে গাফিলতি আমাদের সুরজিতবাবুর চরিত্রে নেই। হি ইজ ফরএভার দ্য গুড বয়।
বীরেনদা অট্টহাস্য করে উঠল। আগুন যখন লাগে, তখন কাউকে ছাড়ে না। গুড বয়দেরও না।
দীপু বলল – তুমি কালাকে রবি ঠাকুরের গান শোনাচ্ছো। তারপর কীবোর্ডে চলমান সুরজিতের আঙ্গুলের ওপর হাতের চাপ দিয়ে বলল – একটা ভালো আডভাইস দিচ্ছি, শোন। বাড়ি ফেরার সময় চাল ডাল তেল আলু পেঁয়াজ কিনে নিয়ে যাস। সন্ধের ভেতর দাঙ্গা লেগে যাবে একদম গ্যারান্টি।
সুরজিত ঘাড় নাড়ল।
পাশের টেবিলের নোমল কম্পিউটার সুইচ অফ করে সুরজিতের দিকে তাকিয়ে বলল – তোর কতো দেরি হবে?
এই তো ইমেলটা পাঠাবো আর উঠবো। তুই বেরোচ্ছিস?
নোমল বলল – না ঠিক আছে, আমি ওয়েট করছি। আমি তো ওদিক দিয়েই যাচ্ছি, তোকে বাড়িতে ড্রপ করে যাবো।
ওরা লিফট থেকে বেরিয়ে অফিসের বাইরে পা রেখেছে, দেখল রাস্তায় স্কুটার, গাড়ি, বাস সব ছন্দহীন, ত্রস্ত ভঙ্গিতে বাড়িমুখো দৌড়চ্ছে। একটা অটো এরই মধ্যে মাইকে চ্যাঁচাতে চ্যাঁচাতে বলে গেল, মানে হাওয়ায় কেঁপে কেঁপে ভেসে যাওয়া শব্দপুঞ্জের ভেতর যতোটুকু সুরজিত বুঝতে পারল – বন্ধুগণ, আজ হিন্দু ধর্মের সমূহ বিপদ। এই অন্যায়ের বিহিত চাই। কাল থেকে শহরে অনির্দিষ্ট কালের জন্যে বন্ধ ডাকা হয়েছে। আগামীকাল বিশাল প্রতিবাদ মিছিলে আপনারা দলে দলে যোগদান করুন।
নোমলের বাইকের পেছনে বসে সুরজিত বলল – ইতিহাস থেকে আমরা কিছুই শিখি না। এরকম দশ বছর আগেও হয়েছে, আবার দশ বছর পরেও হবে। উই উইল কীপ রিপিটিং দ্য সেম মিস্টেকস।
নোমল ইতিমধ্যে বাইকে স্টার্ট দিয়েছিল। সুরজিতের কথা শুনে হেসে উঠল।
হাসলি কেন? ভুল বলেছি?
প্রথম লাল সিগনালটার সামনে বাইক থামিয়ে নোমল বলল – আমার একটা থিওরি আছে, শুনবি?
এ শহরে গাড়ির সংখ্যা গত ক’বছর ধরে বেড়েই চলেছে। ট্রাফিক জ্যাম, যা দশ বছর আগেও ভাবাই যেত না, এখন প্রায় নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। এখন যখন সব গাড়িই ঘরমুখো, সিগনালের সামনে দাঁড়িয়ে অধীর হর্ন, একজস্টের ধোঁয়া আর পোড়া তেলের পেট মোচড়ানো গন্ধ সুরজিতকে বিধ্বস্ত করে দেয়। নাকে রুমাল চাপা দিয়ে সুরজিত ঈষৎ বাঁকা গলায় বলল – তোর থিওরি!
নোমল তাদের অফিসের রেসিডেন্ট গীক, যতো রাজ্যের আজগুবি ইনফর্মেশন তার নখদর্পনে। এই গ্যালাক্সির কোন প্ল্যানেটারি সিস্টেম সৌরজগতের সবচেয়ে কাছে তার নাম থেকে শুরু করে নীল তিমি বছরে ক’বার ডিম পাড়ে এই সমস্ত অপ্রয়োজনীয় তথ্য যদি কারো জানার ইচ্ছে হয়, সোজা নোমলের কাছে চলে গেলেই হলো। ছেলেটার মাথায় সবসময় বিদঘুটে সমস্ত থিওরি কিলবিল করতে থাকে।
শুনতে না চাইলে বলবো না! লাল সিগনাল ততক্ষণে সবুজ।
আরে না না, বল। নোমলের অসূয়াহীন খ্যাপামি সুরজিত বেশ পছন্দই করে, সত্যি বলতে নোমলের পেছনে না লাগা যদি কেউ থাকে তাদের অফিসে, তবে সে সুরজিত।
আমার ধারণা পৃথিবীটা আসলে একটা খুব বড়ো স্কেলের কনসোল গেম।
শুনে প্রথমে সুরজিত হাসবে না কাঁদবে ঠিক করতে পারছিল না। বলে কি পাগলটা?
মানে আমরা জাস্ট দাবার বোড়ে? কেউ রিয়াল নই? পৃথিবী, বা সোলার সিস্টেম বা ইউনিভার্স আসলে একজিস্ট করে না?
ঠিক তাই। নোমল এতক্ষণে রাস্তা তুলনামূলক ফাঁকা পেয়ে স্পিড বাড়াল। ওগুলো হলো গেমের মধ্যেই গড়ে তোলা ব্যাকস্টোরির এক একটা অংশ। পৃথিবী আসলে একটা স্ট্র্যাটেজি গেম তো। ইউ নিড সাম কনটেক্সট ইন আ স্ট্র্যাটেজি গেম। এজ অফ এম্পায়ার্স খেলিস নি নাকি কখনো? এ শালা ফার্স্ট পার্সন শুটার নয়, যে নেমেই হাতে একটা মেশিন গান নিয়ে দুদ্দাড় করে চালিয়ে দিবি! এখানে জিততে গেলে বুদ্ধি খাটাতে হবে।
এতোটা আবোলতাবোল সুরজিতের পক্ষেও নেয়া সম্ভব হলো না।
যদি আমরা সিম্পলি দাবার বোড়েই হয়ে থাকি, তাহলে আমাদের বুদ্ধিবৃত্তি, আমাদের সেন্স অফ হোয়াট ইস র্যাশনাল – এসব কোত্থেকে এল?আমাদের যাবতীয় ডিসিশন তো সেই সেন্স থেকেই আসছে, না কি?
রাস্তার চারপাশের দোকানগুলো আস্তে আস্তে বন্ধ হতে আরম্ভ করেছে। পুলিশের একটা গাড়ি তাদের পাশ দিয়ে সাইরেন বাজিয়ে ছুটে গেল।
তুই কোনোদিন ভিডিও গেম খেলিস নি বোঝাই যাচ্ছে। ইন-গেম চরিত্রদের জন্যে এ আই বা আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্সের ব্যাপক ব্যবহার হয় আজকাল। যারা এই মাল্টিপ্লেয়ার গেমটা ডিজাইন করেছে, এটুকু টেকনিক্যাল নোহাউ যে তাদের থাকবে না, এরকম ভাবতে পারিস কী করে?
ছেলেটা এমনভাবে বলে, যে ফাজলামি করছে, না সিরিয়াস ধরা মুশকিল।
সুরজিত বলল – তোর থিওরিটা ইন্টারেস্টিং। কিন্তু এতো শতাব্দী ধরে এই একটাই গেম চলে আসছে এটা কতোদূর বিশ্বাসযোগ্য?
তিন আলি থেকে ডান দিকে টার্ন নিতে নিতে নোমল বলল – সময় আপেক্ষিক। এটা আমি না, মনীষী আইনস্টাইন বলে গিয়েছেন। তোর কাছে যেটা কয়েক মিলেনিয়াম, ওই গেমারদের কাছে সেটা কয়েক মিনিট মাত্র। সুতরাং চিন্তা নেই, এন্ডগেম এখনো অনেকটা দূর। আমরা কেউ ততোদিন থাকবো না।
সুরজিত হেসে উঠল। যাক একটা বড়ো চিন্তা দূর হলো। আচ্ছা সবজান্তাবাবু, বলুন তো যদি আমাদের সব কাজ লজিকাল হয়, সেই লজিক যে আর্টিফিশিয়াল সেটা প্রমাণ হবে কী করে? আই মীন আমাদের চয়েসগুলো যদি স্বজ্ঞানে, বিচার বিবেচনা করে করা হয়ে থাকে তাহলে সেই চয়েস যে অন্য কারো ইমপোজিশন সেটা কী করে জানা যাবে?
সুরজিতদের পাড়ার রাস্তার মোড়ে নোমল বাইক দাঁড় করিয়ে দিল। তারপর হেলমেটটা খুলে তার দিকে ফিরে বলল – সিম্পল। জানা যাবে এক্সেপশনস দিয়ে?
মানে?
নোমল একটা ঘনাদা মার্কা হাসি উপহার দিয়ে বলল – বুঝলি না? তুই বলছিস সব কাজ যদি আমরা লজিকালি করি তাহলে আমাদের দিয়ে কেউ এই কাজগুলি করাচ্ছে এটা প্রমাণ হবে কী করে? প্রমাণ হবে এক্সেপশনস দিয়ে। সেই কাজগুলি দিয়ে যেগুলো আমরা বিবেচনা করে করি না। এই ধর বড়োল্যান্ডের দাঙ্গা। বা এই ধরণের জাতিগত, সম্প্রদায়গত খুনোখুনি। এগুলো কী লজিকাল কাজ? প্রথম বা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ কি লজিকাল কাজ ছিল? এই জাতি বা সম্প্রদায়ের ভাগ, এই মিলিটারি, পুলিশ, নিউক্লিয়ার অস্ত্রশস্ত্র এসব কি কোনো কমপ্লিটলি লজিকাল ইউনিভার্সে সম্ভব? এসব আছে, থাকবে, কেননা মাল্টিপ্লেয়ার স্ট্র্যাটেজি গেমে মাঝেমাঝেই অ্যাকশন এর দরকার পড়ে। টু গো ওয়ান আপ অন ইয়োর কম্পিটিটরস। ক্লিয়ার?
সুরজিত বাইক থেকে নেমে পড়ল। সামনে তাকিয়ে দেখল মোড়ের মহাবীর গ্রসারি শপ খোলা আছে। চাল ডাল কিছু কিনে নিয়ে যেতে হবে।
নোমল বলল – একটা সিগারেট দে। অফিসগুলো নো স্মোকিং জোন করে দিয়ে যে কী প্রবলেম করেছে!
সিগারেট এগিয়ে দিয়ে সুরজিত বলল – সবই তো বললি। এখন এই মাল্টিপ্লেয়ার গেমের গেমারদের নাম বল।
হেলমেটটা বাইকের সীটে রেখে সিগারেটটা ধরাতে ধরাতে নোমল বলল – কুডন্ট ইউ গ্যেস? ঈশ্বর। আল্লা। গড। আরো আছে, আমি তাদের সবার নাম জানি না।
সুরজিত জোরে হেসে উঠল। উল্টোদিকের ফুটপাথে দুটো মধ্যবয়স্ক লোক তার দিকে সন্দেহের চোখে তাকাতে তাকাতে পাশের গলিটায় সুড়ুৎ করে ঢুকে গেল।এক মুখ ধোঁয়া ছেড়ে সুরজিত বলল – হুমম আই শুড হ্যাভ গেসড তুই ওই লাইনে খেলছিস। আমরা সব নিয়তির হাতের পুতুল।
ভেরি কমফর্টিং, তাই না। সিগারেটে জোরে জোরে টান দিচ্ছিল নোমল। বিশেষ করে হোয়েন ইউ আর ইন আ ক্রাইসিস। রেস্পনসিবিলিটি নেবার দায় থাকে না।
আধপোড়া সিগারেট পায়ে পিষে দিয়ে শূন্য চোখে আকাশের দিকে তাকাল সুরজিত। সূর্য কিছুটা পশ্চিমে হেলে পড়েছে, তবু তেজ একটুকু কমে নি। সামনের রাস্তা, দুপাশের বাড়িঘর রোদে স্বর্ণাভ সাদা। নিয়তি তাকে কমফর্ট দিচ্ছে কোথায়? এতোদিন পরেও –
না তোর স্ট্র্যাটেজি গেমের থিওরি আমার পোষাল না। আওয়ার চয়েসেস ডু ম্যাটার।
হেলমেটটা হাতে তুলে নিয়ে নোমল হাসল। ঠিক আছে, পোষাল না যখন, যাবার আগে তোকে আরেকটা থিওরি দিয়ে যাই।
আরেকটা? তোর মাথায় কটা থিওরি থাকে একসঙ্গে?
শোন না। নোমল মাথার ওপর দিয়ে হেলমেটটা গলাতে গলাতে সুরজিতকে হাত দিয়ে ভঙ্গি করল। তুই যে চয়েসের কথা বললি সেই কনটেক্সটেই বলা।
পাক্কা দশ মিনিট তারপর সুরজিতকে ওই রোদ মাথায় নিয়ে রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে নোমলের যে হিজিবিজবিজ শুনতে হলো সাজিয়ে গুছিয়ে নিলে সেটা এরকম দাঁড়ায়। আমাদের এই ব্রহ্মাণ্ডের সমান্তরাল নাকি আরো অনেক ব্রহ্মাণ্ড আছে, এই পৃথিবীর সমান্তরাল অসংখ্য পৃথিবী। অনেকগুলো আয়না পর পর সমান্তরাল দাঁড় করিয়ে সামনে দাঁড়ালে যেমন আমরা অসংখ্য আমাদের প্রতিফলিত ছবি দেখতে পাই, সেরকম। কিন্তু হুবহু সেরকম নয়। নোমলের ভাষ্য অনুযায়ী আমরা যেমন জীবনে প্রতি পদক্ষেপে চয়েসের মুখোমুখি হই, এবং অনেকগুলো বিকল্পের ভেতর একটা বেছে নিই্, যে সিদ্ধান্তগুলো আমাদের প্রত্যেকের জীবনকে সংজ্ঞা দেয়, অন্য পৃথিবীগুলোতেও তাই। পার্থক্যটা হলো প্রত্যেক সমান্তরাল পৃথিবীতে আমাদের সিদ্ধান্তগুলো পালটে পালটে যাচ্ছে, তাই আমরা এই সমান্তরাল সমস্ত পৃথিবীতে দেখতে হয়ত একইরকম থাকছি, কিন্তু আমাদের জীবন এই প্রত্যেকটা পৃথিবীতে আলাদা আলাদা রাস্তায় হাঁটছে।
সুরজিত দোকানের দিকে পা বাড়ানোর আগে নোমলের হেলমেটে একটা আদরের টোকা দিয়ে গেল।
তুই মাথার ডাক্তার দেখা, আজই। এখানে কোনো চয়েস নেই! এটা তোর নিয়তির নির্দেশ!
২২ আগস্ট বৃহস্পতিবার, বিকেল তিনটে
দোকান পর্যন্ত হেঁটে আসতে আসতে মহাবীর গ্রসারি শপ আধখানা ঝাঁপ ফেলে দিয়েছিল। অগত্যা কোমর বাঁকিয়ে, মাথা হেঁট করে ঢুকতে হলো সুরজিতকে। মালিক মহাবীর কাউন্টারের ওপাশে চৌকিটায় হেলান দিয়ে বসে একটা লাল রঙের বাঁধানো খাতায় কিছু হিসেব লিখছিল, তাকে দেখে ভুরু কুঁচকে বলল – আসেন সুরজিতদা। আপনি বড়ো লেট করেন দাদা! তারপর কাউন্টারের পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা কর্মীটিকে তাড়া লাগাল – এই রতন, জলদি কর। বাবুর কী লাগে চটপট ওজন করে দে।
সুরজিত তার দরকারের জিনিসগুলো রতনকে বুঝিয়ে দিয়ে মহাবীরকে বলল – কি বুঝছো, মহাবীরভাই?
মহাবীর লিখতে লিখতেই চোখ না তুলে বলল – বোঝাবুঝির কী আছে, সুরজিতদা। লুঙ্গিওলাদের পালটা মার দিতে হবে। কালীমাইকে যারা অপমান করার সাহস পায়, তাদের কালো হাত ভেঙে দিতে হবে।
সুরজিত বলল – কিন্তু তুমি তো জৈন, তাই না?
মহাবীর এবার চোখ তুলে একগাল হাসল। কি যে বলেন সুরজিতদা, জৈন বলে কী হিন্দু না? আমাদের সবাইকে একজোট হয়ে লড়াই করতে হবে, হয় এস্পার নয় ওস্পার।
রতন জিনিস সাজিয়ে দিয়েছিল। সুরজিত ব্যাগটা হাতে নিয়ে বাইরের দিকে পা বাড়াতে বাড়াতে বলল – আগে নিজের ভুঁড়ি কমাও, মহাবীর। নইলে লড়াই করবে কী করে?
মহাবীর মুখটা বাংলা পাঁচের মতো করে বলল- ঠাট্টা করছেন, করেন সুরজিতদা। আধখানা ঝাঁপের তলা দিয়ে তখন আরেকজন দোকানে ঢুকছিল। সেদিকে তাকিয়ে চোখ ছোট করে মহাবীর বলল – কিন্তু হুঁশিয়ার থাকবেন, আপনার বন্ধুই দেখবেন কোনদিন আপনার গলায় ছুরি বসিয়ে দিয়েছে।
সুরজিত দেখল শরিফুল। শরিফুল বলল – আরে সুরজিত যে। ভালোই হলো, একটু দাঁড়াও, তোমার সঙ্গে কথা আছে। তারপর মহাবীরের দিকে ফিরে বলল – মহাবীরভাই, পাঁচ কিলো আইজং দাও।
মহাবীর তার লেখালিখিতে ফিরে গিয়েছিল। চোখ না তুলেই বিরস গলায় বলল – দোকান বন্ধ।
ওরা দুজন বন্ধ দোকানের বাইরে দাঁড়িয়েছিল। শরিফুল হাসছিল, কিন্তু সুরজিতের ব্যাপারটা ঠিক হজম হয় নি।
আমি পাঁচ কেজি চাল নিয়েছি। আধাআধি তুমি নিয়ে নাও, আমার কুলিয়ে যাবে।
শরিফুল বলল – আরে না না, আমার যোগাড় আছে। এটা একটা এক্সট্রা প্রোটেকশনের মতো ছিল আর কি। আর মহাবীরকে তুমি মাইন্ড করো না, ধর্মের ব্যাপারে ওর সবসময়ই একটা ক্রুশেডিং আটিচুড আছে।
রাস্তা দিয়ে আরেকটা পুলিশের ভ্যান তাদের পেরিয়ে বড়বাজারের দিকে চলে গেল। যানবাহনের সংখ্যা ক্রমশ কমে আসছে।
সুরজিত বলল – তোমার পার্টি এ ব্যাপারে কিছু ভাবছে টাবছে?
শরিফুল হাসল – আমার পার্টি? তোমার নয়? তুমিও তো প্রতি মাসে ডোনেশন দাও, পার্টি পেপার সাবস্ক্রাইব করো।
সুরজিত বিব্রত ভঙ্গিতে হাসল। সে শরিফুলের পার্টিকে সমর্থন করে ঠিকই, কিন্তু ওই পর্যন্ত। তার বাইরে গিয়ে কিছু করার তার ইচ্ছেও নেই, সামর্থও। কিন্তু পার্টি যেহেতু এখানে ইলেকশনে কোন ক্যান্ডিডেট দিতে পারে না, সুরজিত নির্বাচনের দিন বই পড়ে আর গান শুনেই কাটিয়ে দেয়।
শরিফুল বলল – পার্টি এখানে ততোটা স্ট্রং না তুমি জানো। কিন্তু তাই বলে এই পরিস্থিতিতে বসে থাকা তো যায় না। আমরা কাল সকালে একটা শান্তি মিছিল বের করছি। মানুষের কাছে সম্প্রীতির মেসেজটা পৌঁছে দেয়া খুব জরুরি। তুমিও এসো।
সুরজিত এবার সত্যিই অস্বস্তিতে পড়ল। শান্তি মিছিলকে নৈতিক সমর্থন জানানো এক কথা, মিছিলে পা মেলানো আরেক। সক্রিয় প্রতিবাদ তার সিন নয়।আর এই চড়া রোদে?
সুরজিত বলল- আমি নীতিগত ভাবে তোমাদের পাশেই আছি, শরিফুল। কিন্তু মিছিলে যেতে পারবো কি না এখুনি বলতে পারছি না।
শরিফুল সুরজিতের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ। বিকেলের রোদ শরিফুলের মুখের ওপর, তার চশমার কাচে ঝিলিক দিয়ে উঠছে, সেদিকে বেশিক্ষণ তাকানো যায় না। সুরজিত চোখ ফিরিয়ে নিল।হাতে ধরা ব্যাগদুটো ক্রমশ যেন বেশি ভারী হয়ে উঠছে।
একটা শ্বাস ফেলে শরিফুল বলল – আমি হাফ এক্সপেক্ট করেছিলাম তুমি এটাই বলবে। একটা কথা বলি সুরজিত। শুধু বিশ্বাস যথেষ্ট নয়, ইউ হ্যাভ টু সামটাইমস অ্যাক্ট অন ইট। মার্ক্সও তাঁর ম্যানিফেস্টোতে এই কথাই বলে গিয়েছেন। যাই হোক তোমার নৈতিক সমর্থন পাচ্ছি, আজকের দিনে সেটাও কম নয়।
উল্টোদিকের দেয়ালে দু তিনটে পাড়ার উঠতি মস্তান আগামীকালের বন্ধের পোস্টার সাঁটছিল। শরিফুলের দিকে আঙুল দেখিয়ে তাদের ফিসফিস সুরজিতের ভালো লাগল না।
তুমি কিন্তু সাবধানে থেকো, শরিফুল। সুরজিত ইতিমধ্যে এক পা বাড়ানো শরিফুলকে ডেকে বলল। এ পাড়াটা তোমার জন্যে এখন ততোটা সেফ নয়।
শরিফুল মুখ ফিরিয়ে হাতের বুড়ো আঙুল উঁচিয়ে দেখাল।
আমার জন্যে ভেবো না, আমি ইনডেস্ট্রাক্টিবল।
২২ আগস্ট বৃহস্পতিবার, সন্ধে সাড়ে ছটা
সমস্ত শহর, ঝড়ের আগে যেমন হয়, থম ধরে আছে। কফির কাপ হাতে সুরজিত ব্যালকনি থেকে সরে এল। সন্ধে হয়ে এসেছে। সত্যি বলতে কি, সারাটা বিকেল জুড়েই আজ সন্ধে ঝুপ ঝুপ করে তুষারপাতের মতো নামছিল, ওয়ালেস স্টিভেনসের ওই কবিতায় যেমন আছে, যদিও শেষ বিকেলের আলোর ম্লান উজ্জ্বলতার রেশ সূর্য ডুবে যাবার পরেও মিলিয়ে যায় নি অনেকক্ষণ। আলো নয়, সুরজিত দেখছিল সেই আলোর ভেতর ঘনায়মান ছায়া; শহরের হৃদয়ের ওপর তুষারপতনের সেই অবিরল নৈঃশব্দ্য তার কানে তালা ধরিয়ে দিচ্ছিল।
খালি কফির কাপটা সিনকে রেখে সুরজিত খেয়াল করল বিপাশা অনেকক্ষণ হলো কোনো কথা বলে নি। গত ছ মাস ধরে এরকম প্রায়ই হয়। দুজনের কথাবার্তার মাঝখানে বিপাশা উঠে গিয়ে ভেতরের ঘরে আলো নিবিয়ে চুপচাপ শুয়ে থাকে। অথবা মাঝপথে কথা বন্ধ করে তার দিকে তাকিয়েই থাকে। অপলক সেই তাকানো তাকে জানায় বিপাশার সঙ্গে তার দূরত্ব এই মুহূর্তে কোটি আলোকবর্ষের, বিপাশা যেখানে স্বেচ্ছাবন্দী হয়ে আছে নিজস্ব সেই নরকে তার প্রবেশ নিষেধ। ইদানীং এই ব্যাপারটা কিছু কমেছে, সময় তার শুশ্রূষার কাজ চালিয়ে যেতে থাকে তো। কিন্তু তবু।
যা ভেবেছিল, তাই। বিপাশা শুয়ে আছে, ঘর আঁধার। সুরজিত আলো জ্বেলে দিয়ে চিন্তিতমুখে বলল – কি হয়েছে বিপাশা, শরীর খারাপ লাগছে?
আলোকিত সেই ঘর অনেকক্ষণ চুপ হয়ে থাকল। তারপর অস্ফুট গলায় বিপাশা বলল – আলোটা নিবিয়ে দাও প্লিজ। মাথাটা অসম্ভব ধরেছে।
ঠিক তখুনি আলো নেবালো না সুরজিত। তার মনে একটা সন্দেহ হয়েছিল, সে বিছানার পাশের ছোট কাঠের ক্যাবিনেটটা চেক করে দেখল। যা ভেবেছিল তাই। ডাক্তার বিপাশার জন্যে একটা ডিপ্রেশনের ওষুধ প্রেসক্রাইব করেছিল, সেটা ফুরিয়েছে।
আলো নিবিয়ে সুরজিত বলল –তুমি শুয়ে থাকো। আমি ফার্মেসি থেকে তোমার ওষুধটা নিয়ে আসছি।
বিপাশা উঠে বসল। সুরজিত দেখল তার চোখ লাল। কাঁদছিল? আবার?
বিপাশা বলল- শহরের এই অবস্থা, তোমাকে বেরোতে হবে না। এক রাত্তির ওষুধ না হলেও আমার চলে যাবে। কাল সকালে যা হয় দেখা যাবে।
কাল বন্ধ, কাল কিচ্ছু পাওয়া যাবে না। তুমি অনর্থক ভেবো না, আমি যাবো আর আসবো। অ্যান আওয়ার, অ্যাট দ্য মোস্ট।
বিপাশা আকুতির গলায় বলল – প্লিজ না সুরজিত, আমার ভয় করছে। হুট করে রাস্তায় কোনো হাঙ্গামা শুরু হয়ে গেলে –
সুরজিত হাসল, যদিও সেই হাসিতে তেতোর ভাগটাই ছিল বেশি।
আই হেট টু সে দিস, বিপাশা, কিন্তু এটা আমাদের, হিন্দুদের এরিয়া। এখানে আমাকে কেউ কিছু করবে না।
সুরজিত শার্টটা পাল্টাতে পাশের ঘরটায় গেল। এটা ছিল টিটোর পড়ার ও খেলার ঘর, এখানে তারা দুজনেই পারতপক্ষে ঢোকে না। কিন্তু তাদের মধ্যবিত্ত বসবাসে এতোখানি স্পেস চিরকাল ছেড়ে রাখাটা আয়ত্তের বাইরের লাক্সারি, তাই কিছু কিছু দৈনন্দিন দরকারের জিনিস সেখানে গুছিয়ে রাখতেই হয়।
টিটোর পড়ার টেবিলের ওপরে সাঁটা লায়োনেল মেসির পোস্টারটা আগের মতোই উজ্জ্বল। টেবিলের পাশে, দেয়ালের কোণে ক্রিকেট ব্যাটটা ঠিক সেরকম হেলান দিয়ে আছে। গত বছর পরীক্ষার পরপরই খুব হৈচৈ করে কেনা হয়েছিল। টিটো বড়ো হয়ে কী হবে – মেসি না যুবরাজ সিং – এই নিয়ে খুব দোটানায় ছিল। টেবিলে তার স্কুলের বই যত্ন করে গোছানো, এমনকি একটা পেপারওয়েটের নীচে ওর ক্লাস রুটিনটাও হারিয়ে যায় নি।
চোখটা করকর করছে। শক্ত হও, শক্ত হও, বিপাশার মতো নিজেকে ভেসে যেতে দিও না। সুরজিত হুড়মুড় করে নতুন শার্টটা গায়ে গলিয়ে নিল। পকেটে হাত দিয়ে দেখল টাকা যা আছে হয়ে যাবে। টিটোর ঘর থেকে বেরোবার আগে বন্ধ জানালাটার সামনে এসে দাঁড়াল সুরজিত। গত ছ মাস এই জানালাটা খোলা হয় না, কেননা জানালা খুললেই চোখে পড়বে নতুন সুপারমার্কেট যেটা টিটোদের খেলার মাঠের ওপর গড়ে উঠেছিল। যখন ছোট ছিল, সে হাত ধরে শিশু টিটোকে ওই মাঠে নিয়ে যেত, টিটো দৌড়ে বেড়াত, সে দোলনচাঁপা গাছটির নীচে কাঠের বেঞ্চিটায় বসে থাকত আর ফেরার সময় এক গুচ্ছ তার মাথার ওপর ঝরে পড়া দোলনচাঁপা ফুল কুড়িয়ে নিয়ে যেত বিপাশার জন্যে। একটু বড়ো হবার পর টিটো নিজেই স্কুল থেকে ফিরে বন্ধুদের সঙ্গে দৌড়ে চলে যেত মাঠে, আর বিপাশা এই জানালার সামনে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকত ছেলেকে চোখে চোখে রাখবে বলে। শরিফুলরা মাঠটা বাঁচানোর জন্যে ধর্নায় বসেছিল বেশ কিছু দিন, পুলিশ তারপর একদিন লাঠিচার্জ করে ওদের তুলে দেয়। প্রগতির হাত থেকে আমাদের বাঁচাবে কে?
শরিফুলদা আমাদেরও ধর্নায় যোগ দিতে বলেছিল, আমরা যাই নি।
সুরজিত টের পায় নি বিপাশা কখন দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। বিপাশা কি তার মনের কথা পড়তে পারে?
বন্ধ জানালার দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে থাকতে থাকতে বিপাশা আবার অস্ফুটস্বরে বলল – খেলার মাঠটা থাকলে আজ টিটোর –
এর উত্তরে সুরজিতের আর কী বলার বা করার ছিল, ধীরে ধীরে বিপাশার হাতটা নিজের হাতে তুলে নেয়া ছাড়া? কি হলে কি হতে পারত সেই চিত্রনাট্য তারা গত ছ মাসে অন্তত এক হাজার বার নিজের মনে লিখেছে, কাটাকুটি করেছে, আবার লিখেছে। বড়ো রাস্তার পাশে ঘুপচি জমিটা থেকে রাস্তার দিকে ছুটে যাওয়া ক্রিকেট বলটা ধরার জন্যে ধাবমান টিটো আর বিপরীত দিক থেকে দ্রুত এগিয়ে আসতে থাকা ট্রাকটাকে সে নিজের মনে কতোবার সেই বিশেষ মুহূর্তে ফ্রিজ করে দিয়েছে কিন্তু কোন অঙ্কেই শেষ অমোঘ উত্তরটা বদলানো যায় নি।
সুরজিত, বিপাশাকে নয়, যেন নিজেকেই আস্তে আস্তে বলল – ধর্নায় আমরা যোগ দিই নি ঠিক, কিন্তু দিলেই কী কিছু বদলাত? ধর্না কতোটুকু পাবলিক সাপোর্ট পেয়েছিল? এপাড়ার অনেকেই তো নতুন সুপারমার্কেটে শপিং করার সুযোগ পাবে এই খুশিতে নাচছিল। তাছাড়া এই শহরের মানুষদের জন্যে আরো অনেক বড়ো ইসু ছিল তখন – একটা বাঙালি ছেলে অসমিয়া এক ঘরের বৌকে ভাগিয়ে নিয়ে গিয়েছে সেটাই ছিল হেডলাইন নিউজ। সেটাও ছিল এইরকম এক উত্তেজক সময়। মারধর, খুনজখম, টিভি চ্যানেলে আলোচনা, নেতাদের বিবৃতি – আমাদের কী সময় ছিল তখন বাচ্চাদের খেলার মাঠ একটা কমে যাওয়ার মতো ট্রিভিয়াল ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামানোর?
বিপাশা চুপ করে ছিল। বন্ধ জানালায় নিবদ্ধ তার শূন্য চোখের তারায় সেই হারিয়ে যাওয়া মাঠ আর বল পায়ে ছুটতে থাকা টিটোকে প্রতিবিম্বিত দেখল সুরজিত।
বৃহস্পতিবার, ২২ আগস্ট, রাত আটটা
যাবার সময় তার বেশ গরমই লাগছিল, কপালে জমে উঠেছিল দু একটা স্বেদবিন্দু। বাতাস ছিল না একটুও, রিকশা চালু থাকলে সে না হেঁটে হয়ত একটা রিকশাই নিত। ফেরার সময় উলটো, একটা হিম হিম ভাব, রোমকূপ শিউরে উঠছে শৈত্যের ছোঁয়ায় যেন এটা আগস্ট নয়, শেষ ডিসেম্বর। আবহাওয়া কি আজকাল এতো দ্রুত পালটে যাচ্ছে? নাকি শীতবোধটা আসছে তার ভেতরের টেনশন থেকে? আকাশ মেঘহীন, এইমাত্র ঝাড়ু দিয়ে যাওয়া মেঝের মতো পরিষ্কার, এমনকি একটা তারাও নেই। এটাও অবাক হবার মতো। অমাবস্যার আগের দিন, তাই চাঁদ দেখা যাবে না এটা বোঝা যায়, কিন্তু তারারা সব কোথায় গেল? সুরজিতের কেমন মনে হল এক অদৃশ্য কুয়াশা চাঁদোয়ার মতো আকাশটাকে আবৃত করে রেখেছে। আর সেই কুয়াশার ফিনফিনে ডালপালা বেয়ে শীত নামছে তাদের শহরে। সুরজিত নিজের মনেই হেসে উঠল। একা থাকলেই তার কল্পনা নোমলের মতো নানা বিদঘুটে অ্যাঙ্গেলে দৌড়তে থাকে।
রাস্তা একেবারে জনহীন। এটা ততোটা অবাক না করলেও সুরজিত পায়ের গতি দ্রুততর করে। পাড়ার দোকানপাট সব বন্ধ থাকায় তাকে ফার্লং খানেক হেঁটে চব্বিশ ঘন্টা খোলা শহরের সবচেয়ে বড়ো ফার্মেসিটায় আসতে হয়েছে। ভাগ্যিস এটা খোলা ছিল, যদিও ওষুধের প্যাকেটটা দিতে দিতে ফার্মেসির মানুষটা তাকে বলেছিল –দাঁড়াবেন না কোথাও, ইমিডিয়েটলি বাড়ি চলে যান। আমরাও দোকান বন্ধ করে দিচ্ছি। রাতে নাকি আগুন লাগাবে। ভেতরে একটা টেবিলের ওপাশে বসে ক্যাশ মেলাতে থাকা মালিক হেঁকে বলেছিল – বন্ধ করো সুকুমার, বন্ধ করো। এত কথা কিসের? ওষুধ নিয়ে বেরোতে বেরোতে সুরজিত শুনতে পেয়েছিল কাউন্টারের কাঠের ফ্ল্যাপটা ঘটাং করে বন্ধ হলো।
এই নিঝুম পথ চেনা, দিনে কতোবার সে এ পথে আসাযাওয়া করে, অথচ আজ যেন হঠাৎ অচেনা হয়ে উঠেছে। তার বাসা আর কতদূর, পথ ফুরোয় না কেন? এই প্রথমবারের মতো সুরজিতের বুক একটুখানি ধুকপুক করে উঠল। মানুষ নেই বোঝা যায়, কিন্তু পুলিশ, নিদেনপক্ষে রাস্তার কুকুরও থাকবে না নাকি তাই বলে? সুপারমার্কেটের সামনে এতক্ষণে এসে যাবার কথা, কিন্তু রাস্তার দুপাশে কুয়াশার খাড়া দেয়াল উঠে গিয়েছে আকাশের সীমানা পর্যন্ত, সে এবং তার সামনের রাস্তা, চরাচরে আর কোথাও কিছু দেখার উপায় নেই। কুয়াশা, এই বর্ষণহীন গ্রীষ্মে? সে কী স্বপ্ন দেখছে? সুরজিত দৌড়তে আরম্ভ করল। এবং সভয়ে টের পেল এ কুয়াশা স্থবির নয়। দুপাশের দেয়াল ভেঙেচুরে তার সামনে রাস্তার ওপর গড়ে উঠছিল বিশাল ধূসর এক অর্ধস্বচ্ছ স্তম্ভ। অন্ধের মতো দৌড়তে দৌড়তে সুরজিত সেই স্তম্ভের ভেতর ঢুকে গেল।
শনিবার, ২৪ আগস্ট
দৈনিক সকালের আজকের সংখ্যা থেকেঃ
শহরে অনির্দিষ্টকালীন কারফিউ, পরিস্থিতি এখনো উত্তেজনাপূর্ণ, মৃত ১
শান্তির জন্য শহীদ, না উন্মাদের খেয়াল?
বিশেষ সংবাদদাতার প্রতিবেদন
২৩ আগস্ট।
আজ দুপুর দুটো থেকে জেলা প্রশাসন শহরে অনির্দিষ্ট কালের জন্য সান্ধ্য আইন ঘোষণা করেছে। গত দু তিন দিন ধরেই এখানে পরিস্থিতি উত্তেজনাপূর্ণ হয়ে ছিল। কাল স্থানীয় রাজনৈতিক কর্মী শরিফুল চৌধুরীর ওপর ছুরিকাঘাতের ঘটনার পর উদ্যোক্তারা আজকের প্রস্তাবিত শান্তি মিছিল মুলতুবি রাখেন। আজ ২৪ ঘন্টার বন্ধের আহ্বান অগ্রাহ্য করে কিছু এলাকায় দোকানপাট খোলা রাখার চেষ্টা করলে সকাল থেকেই দুই বিবাদমান সম্প্রদায়ের মধ্যে বিক্ষিপ্ত লুটতরাজ ও মারপিটের ঘটনা ঘটতে থাকে। দুপুরবেলা বন্ধ সমর্থকেরা মিছিল বের করলে পরিস্থিতি চরমে ওঠে। বন্ধ বিরোধীরা পালটা মিছিল বের করে। বড়োবাজারের সামনের খোলা চত্বরে যখন দুটো সশস্ত্র মিছিল মুখোমুখি, এবং এই শহর এক তুমুল রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের সম্ভাবনা থেকে মিনিটখানেকের দূরত্বে, তখন একটা আশ্চর্য ঘটনা ঘটে। সুরজিত রায় নামে এক ব্যক্তি একটা সাদা শার্ট মাথার ওপর দোলাতে দোলাতে দৌড়ে দুটো মিছিলের মাঝখানে এসে দাঁড়িয়ে পড়েন। হতচকিত দুটো মিছিলই কিছুক্ষণের জন্যে থমকে দাঁড়ায়। এই ক্ষণিকের বিরতি পুলিশ ও আধা সামরিক বাহিনীকে ঘটনাস্থলে সময়মতো পৌঁছতে সাহায্য করে। পুলিশ যখন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্যে লাঠিচার্জ করতে যাচ্ছে, সেই সময় অজ্ঞাতনামা আততায়ীর দ্বারা গুলিবিদ্ধ হয়ে শ্রীরায় রাস্তাতেই লুটিয়ে পড়েন। হাসপাতালে নিয়ে যাবার পর চিকিৎসকেরা তাঁকে মৃত বলে ঘোষণা করেন। পুলিশ জানিয়েছে শ্রীরায় গতকাল রাত থেকেই অপ্রকৃতিস্থের মতো আচরণ করছিলেন।
আমরা মৃতের স্ত্রী বিপাশা রায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু শ্রীমতী রায় আমাদের সঙ্গে কথা বলতে অস্বীকার করেন। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে মাত্র ছ মাস আগে তাঁদের একমাত্র সন্তান স্থানীয় স্কুলে ক্লাস ফাইভের ছাত্র টিটোর এক মর্মান্তিক পথ দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়। শ্রী রায়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু অশোক হালদার আমাদের প্রতিবেদককে জানান যে কাল রাত থেকেই সুরজিতবাবুর ভেতরে কিছু অসংলগ্নতা দেখা দিতে থাকে। রাস্তায় উদ্দেশ্যহীন ভাবে ঘুরে বেড়ানোর জন্যে পুলিশ তাকে কাল সন্ধ্যায় থানায় নিয়ে যায়। তিনি নাকি তাঁর নিজের বাড়ি চিনতে পারেন নি। অশোকবাবু বললেন – কাল রাতে যখন সুরজিত কিছুতেই বিশ্বাস করতে চাইল না যে টিটো মারা গিয়েছে, আর বাড়ি আসতে আসতে আমাকে জিজ্ঞেস করল রাস্তায় এতো পুলিশ কেন, তখনই বুঝেছিলাম ওর মাথায় একটা গণ্ডগোল হয়েছে। হয়ত রাস্তায় কোথাও পড়ে টড়ে গিয়েছিল। আমি আর বিপাশা দুজনেই ভেবেছিলাম বাড়িতে একদিন বিশ্রাম নিলে সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু আজ সকালে যখন বিপাশা ফোন করে বলল কাল সুরজিত সারা রাত ঘুমোয় নি, শুধু অস্থিরভাবে পায়চারি করেছে, আর বিপাশা ওকে বিশ্রামের কথা বললে উদ্ভ্রান্ত চোখে তাকিয়ে হাহাকারের মতো বলেছে – এমন কীভাবে হয়? এক মিনিটে পৃথিবী এমন বদলে যায় কী করে?, তখনই আমি ভেবে রেখেছিলাম বন্ধ কাটলে সুরজিতকে সাইকিয়াট্রিক চেক আপের জন্যে নিয়ে যাবো। কিন্তু হতভাগাটা, অশোকবাবু কাঁদতে কাঁদতে আমাদের বলেন, সেই সুযোগ আর আমাকে দিল না।
আগামীকাল থেকে সান্ধ্য আইন কিছুটা শিথিল হবার সম্ভাবনা আছে।
বৃহস্পতিবার, ২২শে আগস্ট, রাত আটটা এক
ক্রিং ক্রিং!
কুয়াশা কোথায়? সুরজিত দেখল স্ট্রিটল্যাম্পের উজ্জ্বল নরম আলোয় ধুয়ে যাচ্ছে পথ, মৃদু কথাবার্তার শব্দ, হাসি, ফুটপাথে পথচারীদের অলস আনাগোনা, আর সে রাস্তার ঠিক মাঝখানে জবুথবু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সে কী হাঁটতে হাঁটতে ঘুমিয়ে পড়েছিল?
ক্রিং ক্রিং!
সুরজিত পেছন ফিরে দেখল নোমল সাইকেলের ওপর বসে এক পা রাস্তায় রেখে তার দিকে তাকিয়ে হাসছে।
নোমল বলল – কি রে, ভর সন্ধেবেলা রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে নতুন কোনো উদ্ভট থিওরি ভাঁজছিলি নাকি? আর একটু হলে সাইকেলচাপা পড়তি। তাহলে আর মানসম্মান কিছুই থাকত না!
সুরজিত অবাক হয়ে বলল – উদ্ভট থিওরি? আমি?
নোমল সাইকেল থেকে নেমে পড়ল। সুরজিতের পেছনে একটা রিকশা টুংটাং বেল বাজাচ্ছে।
সাইডে আয়, মাঝখানে ওরকম উজবুকের মতো দাঁড়িয়ে থাকিস না। আর তোর থিওরি যদি উদ্ভট না হয় তাহলে আমিও ব্র্যাড পিট।
সুরজিত রাস্তা থেকে সরে এসে ফুটপাথে দাঁড়াল। নোমলের কী হলো, টেনে এসেছে নাকি এই সন্ধ্যারাতে?
নোমল আবার বলল – আজ দুপুরে ক্যান্টিনে বসে পৃথিবী নামক স্ট্র্যাটেজি গেম আর সমান্তরাল বিশ্বের ফান্ডাগুলো তো জম্পেশ দিয়েছিলে গুরু। তোর মাথায় আসেও মাইরি।
সুরজিতের এবার রাগ হয়ে গেল। কি আজেবাজে বকছিস, নোমল? ওই থিওরিগুলো তো তুই-ই নামিয়েছিলি! আর সেটা ক্যান্টিনে বসে নয়, তোর বাইকে চড়ে আজ দুপুরে বাড়ি ফেরার সময়।
সাইকেলের হ্যান্ডেলে দু হাত রেখে নোমল সুরজিতের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল। ওপরে আকাশে তারার মালা দীপাবলির আলোকসজ্জার মতো জ্বলছে নিভছে, সুরজিতের মনে হলো এরকম চমৎকার ঝলমলে আকাশ সে আগে দেখে নি। আর এই যে বাতাস তার শরীর জুড়িয়ে বয়ে যাচ্ছে – কি তাজা, কি মিষ্টি!
নোমল, গোটা গোটা করে, যেন শিশুকে বোঝাচ্ছে, বলল- এক, আমার বাইক নেই। দুই, দুপুরে খামোখা বাড়ি ফিরতে যাবো কেন?
নোমল তার লেগ পুল করছে না তো? সুরজিত সন্দিহান গলায় বলল – তোর বাইক নেই, তাহলে যে হোন্ডা রোজ চড়ে আসিস, সেটা কার? আর খামোখা বাড়ি ফেরা মানে? শহরে দাঙ্গার আশংকা কি হঠাৎ নেই হয়ে গেল না কি?
নোমল এবার সাইকেলটা দাঁড় করিয়ে সুরজিতের সামনে এসে দাঁড়াল। সুরজিত দেখল নোমলের চোখে তার জন্যে চিন্তার ছায়া। এটা তাকে অস্বস্তি দেয়।
সুরজিত তুই ড্রাগ ফাগ নিচ্ছিস না তো? আমার কোনো জন্মেই হোন্ডা কেন, কোনো মোটরবাইকই ছিল না, আজও নেই। এই শহরের অন্য প্রায় সবার মতো আমি সাইকেলে যাতায়াত করি। শরীর ভালো থাকে, বায়ুদূষণ হয় না। আর দাঙ্গা? পঞ্চাশ বছর আগে শেষ দাঙ্গা হয়েছে ভারতবর্ষে, ইতিহাস বইতে আছে বলে শব্দটা এখনো পুরোপুরি অবসোলিট হয়ে যায় নি।
সুরজিতের মাথার ভেতর সব গোলমাল হয়ে যাচ্ছিল। নোমলের চোখ দেখে মনে হয় না সে ঠাট্টা করছে, বা সুরজিতের লেগপুল করার চেষ্টা করছে। কিন্তু সে যা বলছে তা যদি সত্যি হয়, তাহলে –
নোমল কোমল গলায় বলল – চল তোকে বাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসি। বুঝতে পেরেছি দিনরাত ওই সব বিদঘুটে থিওরাইজিং তোর ব্রেইন সেলগুলোকে ওভারহিটেড করে দিচ্ছে। কাম ব্যাক টু হিয়ার অ্যান্ড নাউ, সুরজিত রায়!
সুরজিত কিছু বুঝে উঠতে পারছিল না। এটা ঠিক যে রাস্তা দিয়ে সে সাইকেলই যেতে দেখেছে এ পর্যন্ত, কোনো গাড়ি বা মোটরবাইক চোখে পড়ে নি। কিন্তু সে তো স্ট্রিট ভায়োলেন্স থেকে বাঁচার জন্যেও হতে পারে।
সে গলা যতোদূর সম্ভব শান্ত করে বলল – তা এই হিয়ার অ্যান্ড নাউটা একজ্যাক্টলি কী?
নোমলের চোখ ঝিকমিক করে উঠল।
আজ বৃহস্পতিবার, ২২শে আগস্ট, এখন রাত আটটা কুড়ি। আমরা দাঁড়িয়ে আছি পাড়ার শিশু উদ্যানের সামনে।
এতক্ষণে সুরজিতের খেয়াল হলো। তার ঠিক পেছনেই মানুষ-সমান দেয়াল দিয়ে ঘেরা খেলার মাঠ। মাঠের চারপাশে বড়ো বড়ো গাছ, ফুটপাথের ওপরে দাঁড়িয়ে দোলনচাঁপা গাছটিও চিনে নিতে পারল সুরজিত। গাছের নীচে বেঞ্চিতে দুই বৃদ্ধ বসে গল্প করছেন। গাছপালার ফাঁকে ফাঁকে লুকনো আলোকস্তম্ভ সারা মাঠ আলোকিত করে রেখেছে। সেই আলো যেখানে ছায়ায় মিশেছে সেই প্রদোষ-এলাকায় দু চার জোড়া প্রেমিক প্রেমিকাকেও যেন হাত ধরাধরি করে হেঁটে বেড়াতে দেখল সুরজিত।
তার সমস্ত শরীর অবশ হয়ে এল। সে কী সত্যি দেখছে এই খেলার মাঠ?
তাহলে সুপারমার্কেট? অস্ফুট গলায় বলল সুরজিত।
কোন সুপারমার্কেট?
এখানে যে সুপারমার্কেটটা ছিল?
এখানে কোনো সুপারমার্কেট ছিল না। নোমলের গলায় তার জন্যে দুশ্চিন্তার রেশটা এখন বেশ স্পষ্ট।
এখানে সুপারমার্কেট করার একটা চক্রান্ত চলছিল। আমরা সবাই মিলে আন্দোলন করে সেই চক্রান্ত ব্যর্থ করে দিয়েছি। নোমল সুরজিতের কাঁধে হাত রাখল। কেন, আমাদের সম্মিলিত ধর্নায় তো তুইও বসেছিলি, ভুলে গেলি?
সে, সুরজিত রায়, ধর্নায় বসেছিল? স্মৃতি তন্ন তন্ন করে ঘেঁটেও সুরজিত মনে করতে পারল না সে কোনদিন ধর্নায় বসেছিল, বা মিছিলে হেঁটেছিল। কিন্তু এই শিশু উদ্যান তো সত্যি, যেমন সত্যি তার সামনে দাঁড়ানো নোমল আর তার সাইকেল, তার পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া তরুণীটির মুখে রাস্তার বাতির আনন্দময় আলো, প্রাণজুড়নো এই স্নিগ্ধ, সতেজ বাতাস, আর মাথার ওপরে ওই ঝিকিমিকি তারায় ভরা আকাশ। তার নিজের ইন্দ্রিয় তাকে যা বলছে, কেবল স্মৃতির ওপর ভর করে সেটা সে অস্বীকার করবে কী করে?
ভবিষ্যৎ তার জন্যে কী লিখে রেখেছে জানা নেই, কিন্তু এই মুহূর্তে এটাই তার বর্তমান, স্মৃতি দিয়ে কী হবে? স্মৃতি তাকে কী দিয়েছে, দুঃখ ছাড়া? কাম ব্যাক টু হিয়ার অ্যান্ড নাউ, সুরজিত রায়।
সুরজিত বুক ভরে নিশ্বাস নিল।
চল, আমার বাড়িটা দেখিয়ে দিবি।
২২শে আগস্ট, বৃহস্পতিবার, রাত নটা
বাড়ির দরজা পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে নোমল বিদায় নিল।
খেয়ে দেয়ে টানা ঘুম দে। আর সায়েন্স ফিকশন অতো পড়িস না। তোর মাথাটা ওতেই গেছে।
সুরজিত হাসল। সামনে তার বাড়ির দরজা। তার স্মৃতির সেই বাক্স মার্কা মাল্টিস্টোরিড-এর বাক্স-বাসা নয়, সত্যি বলতে কি, মাল্টিস্টোরিড কিছুই নেই যতোদূর তার দুচোখ যায় ততোদূর পর্যন্ত। ছিমছাম ছোট এক আসাম-টাইপ বাড়ি, বাড়ির সামনে ছোট বাগানে অজস্র রঙিন ফুল, আর সেই বাড়ির লাল টালির চাল থেকে জ্যোৎস্না টুপটুপ করে ঝরে পড়ছে ছোট বারান্দাটিতে।
কড়া নেড়ে ছোট এক প্রতীক্ষা। বিপাশা দরজা খুলে দিল। বিপাশার মুখে হাসি, হাতের আঙুলে হলুদ দাগ। রান্না করছিল। সমস্ত শরীরে আনন্দ ছলকানো এই বিপাশাকে সে শেষ কবে দেখেছে?
বিপাশা বলল – এতো দেরী করলে যে?
আরো একজন ছিল, বিপাশার ঠিক পেছনেই। চোখ বড়ো বড়ো করে তার দিকে তাকিয়ে সেই আরেকজন বলল – জানো বাবা, আজ আমি দু গোল দিয়েছি। বন্ধুরা এখন আমাকে মেসি বলে ডাকে।
টিটোকে হাত বাড়িয়ে কাছে টেনে নিতে নিতে সুরজিত বিপাশার দিকে তাকিয়ে বলল – দেরী হয়েছে তো কী? ফিরে আসাটাই সব।
ছবি- সূরজ মোহান্ত