উত্তর-পূর্বের বাংলাভাষার কবিদের প্রতি আমার আন্তরিক শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসাই এই কবিতাগুলি রচনার উৎস।২০১৫ সালে গুয়াহাটির ভিকি পাবলিকেশনস থেকে একটি কবিতা সংকলন প্রকাশিত হয়েছিল।সেই সংকলনে সংকলিত কবিদের উদ্দেশেই আমার এই রচনা।বলাবাহুল্য,এর বাইরেও অনেক কবি রয়ে গেছেন,যাদের নিয়ে আমি লিখিনি।এই কবিতাগুলি আমি লিখিনি। লিখেছেন সেই কবিরাই।আমি শুধু বিনির্মাণের চেষ্টা করেছি।বলা যেতে পারে,ওনাদের কাব্যভুবনকে মাত্র একটি কবিতায় ধরার একটি দুরূহ এবং অক্ষম প্রয়াসের দুঃসাহস দেখিয়েছি।কবিরা আমাকে ক্ষমা করবেন।অন্তরের পরম শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসাই আমাকে তাড়িত করেছে।—সঞ্জয় চক্রবর্তী
◾শক্তিপদ ব্রহ্মচারী
বাঁধের উপর বসে রয়েছেন তিনি, একা
আঙুলে ধরা সিগারেট, বুকের বাঁদিকে হাত
রাখলেন। ভালোবাসা, বেদনার ঘর ওইটি
আর দৃষ্টি যায় দূরে, ওই দূরে
আকাশে দেশহীনতার নখে
আঁচড়ে লিখেছি আত্মপরিচয়
যাত্রায় ভুল ছিল কোথাও!
পথই ছিল পথের পরিচয়
হাওরের জল এসে জড়াল বাহুবন্ধনে
শব্দেরা জাগে অসুখের শিয়রে
নারীর আলোকে ধুয়েছি, মায়ের দুধে মুখ।
কবিতায় নিমগ্ন শরীর চুমু খেয়েছি শব্দের ঠোঁট
কুপিলম্ফে বুড়ি জাগে, গাঙের গর্ভিণী গন্ধে;
সহজ ছিল অনেক কিছুই সহজেরই ছন্দে।
ঈশানবাংলার বালক আমি,
মৃত্যুঞ্জয় আমার শরীর
দুহাতে কলজে ছিঁড়ে
মায়ের পায়ে ঢালি রুধির
বারবার ভালোবাসার নিকট হয়েছি কাঙাল
নষ্টবাড়ির ছাদে দুপুরের নির্জনে
অন্ধদের ডায়েরি থেকে চুরি করেছি প্রণয়কথা
প্রিয় নারী,বিনিদ্র রজনীতে অসুখের শিয়রে
দাঁড়িয়ে থেকে দিয়েছে শুশ্রূষা
মানুষ মরণশীল জেনেও বুকে রেখেছি হাত;
মতিচ্ছন্ন চাঁদের নীচে দাঁড়িয়ে বুঝেছি,
যেতে হবে এবার, ডাকে অনন্ত ভাসান।
◾অমিতাভ দেব চৌধুরী
গতজন্ম থেকে একটি সিজারিয়ান ভাষা
শিলঙের পাহাড়ি পথ বেয়ে বরাকভ্যালি এক্সপ্রেস চড়ে
নেমে এল কবির শহরে, শিলচরে, যেখানে একা নির্জনে
রাতের ময়লা আকাশে চাঁদের ফ্রেসকো আঁকে নিঃস্ব কবি,
অনেক গল্প আছে তোমার ঝুলিতে, অশ্রু মাখতে মাখতে
সেসব ক্রন্দনঅক্ষর আজ তোরঙ্গে বন্দি হয়ে চলে যাচ্ছে গতজন্মের দিকে
একটি পেনসিলরেখার পথ ধরে। সেসব রাত্রিকাহিনি, পরিকাহিনি,
মোমকাহিনি শুধু জানে পরবাসে আশ্রিত ছেঁড়াখোঁড়া এক একতারা।
এঁকেছি কতকিছু, সূর্যের বুকে জলধির কালো,
চন্দ্রের যতশত মোম স্নানঘরে
শরীর ভরে নিল কিশোরী আলো।
বৃক্ষেরা দেশান্তরিত। আমি চুপ করে বুকে রেখেছি শালগ্রাম শিলা।
দেশহারানোর ক্ষতে গানের স্নানে দিতে চেয়েছি অনন্ত শুশ্রূষা।
কিছুই থাকে না, সকল চন্দ্রতাপ মুখ হারায়,
হারায় অক্ষর, গিলে ফ্যালে সময়, হৃদয় একদিন জুড়ায়
তবু শব্দের কাছে নতজানু হয়েছি বারবার।
ছন্দকে ঘষে মেজে দেখেছি, রহস্যালোক বলে কিছু কি আছে!
নদীর পাড় ভাঙে, পরি নামে শহরে,বাঙালিরা চিরদিন
সীমান্ত পেরোয়, পা ব্যথায় জর্জর, তবু পেরোয় বনবাদাড়,মাঠ, জল।
শেষে, শরীরে জল মেখে অক্ষরেরা থাকে অমৃতময়
অক্ষর, আমার ক্রন্দনসন্তান, যে জলরূপ বেদনারই নাম,
ঝরে ঝরে আর যাবে একদিন বিসর্জনের ঘাট।
◾পল্লব ভট্টাচার্য
সুশীলা মরিল, উড়িল ধুলা, তামাকপাতা সরাইয়া
ধুলো মেখে রমণীরা ধায় ষাঁড় ও সূর্যাস্তের দিকে।
জোনাকি থেকে কতটা আলো ছিন্ন হলে অমাবস্যায়ও
আলোকিত হয় সভ্যতা, সে গণিতসূত্রে আমরাও নিয়মবিরুদ্ধ
চলাচল করি, দেখে নিই মুগ্ধতার ওপর পিঠে
কি লেখা আছে হলুদ পাখির গান?
জটিলতত্ত্বে বাণিজ্য অসহায়, বিনিময় প্রথায়
আলোর কাঁথা মুড়ে মস্তকেরা হাঁটাচলা করে
মৎসশিকারের পারদর্শিতার গুরুতত্ত্ব আমাদের অধিগত
জলের লাবণ্যের সঙ্গে করমর্দন হল না আর।
স্বচ্ছতার নিরিখে তোমার অবশ্যম্ভাবী আঁচল
ওড়ে, প্রাচীন সভ্যতার দিকে, বালকেরা মুড়ি খায়।
আমাদের ঝালতত্ত্বে বন্দুকেরা আনাগোনা করে
ডুব দেয় গভীরে, আগুন খায়, অগ্নি ছুঁড়ে।
মাস্টারের পাঠশালায় সামান্য তামাকপাতা পোড়ে;
তার সেই দহনের নৈঃশব্দের নীচে আমাদের
পোড়া কপাল, ছাইমথিত, জাগে অনিদ্রায়
আলো আসবে, আমরা সেই আলোকসম্ভাবনার দিকে
মুখ উঁচিয়ে বসে থাকি, প্রহর গড়ায়…
◾তপন রায়
এক বিধুর লন্ঠন দেখেছিল
ধোঁয়াওড়া গরম গরম ভাতের ওপরে
উড়ছে বেড়ালের রোম
পথ পড়ে রয়েছে, মানবেরা হেঁটে যায়
হাজরিকা দিদিমণি টাইপরাইটার ছেড়ে
এখন কীবোর্ডে আঙুল রাখেন।
এইসব দৃশ্যপট জলফড়িঙ-ও দেখে,
লিখে রাখে জলের দেয়ালে,
কীভাবে সহজ হাতটি রাখতে হয়
দুঃখী মানুষের কাঁধে
পাণ্ডুনাথ এখনও জলকেলি করেন
রজকিনির ঘাটে, জলের ভাষা বোঝা
সহজপাঠ নয় জেনেও পাপহরা স্নানেরা
জেগে থাকে ঘাটের কিনারে
ধূলির সারল্যের ভেতর
ভ্রমণশেষে জীর্ণ পত্রটি তখন
চিরবিশ্রাম গ্রহণ করে।
◾শিবাশিস চট্টোপাধ্যায়
আত্মহত্যার কাহিনি পাহাড়ের পাখিরা জানে
আমি ক্ষীণ ঘর-গেরস্থালি নিয়ে
পড়ে রয়েছি জলঘাসে।
অমলিন ভোরে আহ্লাদী বাতাস
এই প্রাচীন পৃথিবীতে চেয়েছিলাম।
কীটদষ্ট শিউলিরা হিম পাহাড়ের
দিকে সৎকার অবগাহনে গেছে।
যদি বলি ধূলিবিবরণ,সব আমারই।
মৃত্যু প্রতিবিম্বিত শেকড়ের মূলে।
পার্থিব করাত কাটছে যদিও যাপন,
রিমিকে সুরম্য দালানের লিরিক দিয়েই আমি
পাখিদের সঙ্গে যাব পাহাড় অরণ্যে।
◾অশোক দেব
জলবিষাদের বুকে গলুইভর অবসাদ নিয়ে,
এক বিষণ্ণ নৌকা জেগে রয়েছে।
প্রহরী,চাঁদের মালতীগন্ধ।
তোল,পাল তোল,
সূর্যাস্তের সাজ গ্রহণ করেছে
নদীর অববাহিকা।
যে অংশ অবন্দিত,
শুভদিনে মরশুমি ডাকবাক্সে রেখে আসি।
শুভ্রাদি ওই বর্ণের কাজল চোখে পরবে।
সেলফোন আর জরুরি নয়,
মেয়েরা চলে গেছে স্বপ্নের ভেতর।
পুকুরের কিনারায় বসে রয়েছে গান।
সাঁকোটি একা একা কেঁপে ওঠে।
একমুঠো তারা নিয়ে এস
উঠোনে বিছিয়ে রাখব।
এত অন্ধকার করে রেখেছ ঘরদুয়ার
তারার আলোয় বাঁচব।
◾প্রবুদ্ধসুন্দর কর
ডার্করুম ভেঙে দিয়েছি, সমস্ত রাতই এখন ডিজিট্যাল।
ধলাই নদীর তীরে আসন্ন সন্ধ্যায়
পুনর্জন্মের মত ফুটে রয়েছেন ডায়না পামার
জিওলছড়া ফরেস্টে ঘন বনানীর ভেতর দাঁড়িয়ে অরণ্যদেব,
দিলেন তীব্র নৈশশিষ, সেই ধ্বনি অনুসরণ করে মেয়েরা
মসৃণ হাসে, কবিতায় মিথ্যে বলতে নেই। মেয়েদের নেশাতুর
হাসির নাম রেখেছি প্রবুদ্ধসুন্দর।
চাবুক ও তূণভর্তি শ্লেষ,আমার বায়োডাটা লিখেছেন গুণী
আজন্মলালিত শোক,ধর্মপুরাণ,ধূমায়িত শব্দের এই জন্মান্ধনিয়তি
বয়ে নিয়ে বেড়াতে বেড়াতে দেখি, চৈত্রবাতাস
মাথা কুটে মরে গোমতী তীরে
অরণ্য শুশ্রূষা দিয়েছে, যখন আগুনে পুড়েছে হাত ।
সিগারেটে ফুঁ দিয়ে হারমোনিয়াম এবং বাংলা কবিতার
কাছে ভেজা চোখে হাঁটু গেড়ে বসি।
◾স্বর্ণালী বিশ্বাস ভট্টাচার্য
মন,দহন জানো,
ওষুধ খাও,প্রতিরাতে?
জলের সখি, বালিকা আমি,
লণ্ঠন জ্বালাই বুকের মাঠে।
বৃষ্টি নামে প্রতি রাতে
শব্দসকল ভিজে যায়।
বৃষ্টিশেষে তারা গুনি
যদি তোমায় দেখা যায়।
কতটুকু আসবো কাছে,বলতো এক্ষুনি
বাঁশির সঙ্গে তবলার সঙ্গত,ঠিক যতখানি?
শব্দ কুড়োই,মালা গাঁথি সহজ স্বভাবে
ছিড়ে ফেলি মালার যতন,তোমার অভাবে।
আমি ইভ,অ-কবিতা লিখি যদিও
কবিতার থেকে পারি না দূরে যেতে।
স্যানাটোরিয়ামে আপেলের বিকল্পে
কবিতার খাতা শিয়রের পাশে।
চন্দ্রাবলী মেঘ শিলং পাহাড় থেকে
উড়ে যায় বরাকপারের দিকে,
একটি বালিকা কারো অপেক্ষায় থাকে।
শব্দ পড়ে,শব্দ ঝরে,শব্দ পড়ে সারারাত
গুছিয়ে রেখো আমার শব্দ অদৃশ্য থেকে কোনো হাত।
◾অভিজিৎ চক্রবর্তী
এই পাহাড় ভৈয়ামের মায়াবিস্তারের ভেতর
আমি থাকি। অনন্ত আমার বন্ধু। মাঝেমধ্যে
সাইকেল চেপে আমরা দুজন নদীর কাছে
রেখে আসি আমাদের নিজস্ব চিরকূট।
আমি বৃষ্টি দেখি শ্রাবণে ; কীভাবে জল
আঁকে দখনার সবুজ, মেজির আগুনের
ভেতর পার্বণ আমার, উৎসবে পুনর্বার
মনস্তাপ ঝেড়ে ফ্যালে আসি
বরদৈচিলার ভেতর দেখেছি বৈশাখের ঝড়।
নখে হলুদ বাংলা কবিতাকে রন্ধনকক্ষ থেকে এনে
দাঁড় করাই এই ভূমে,
জিজ্ঞাসী, আমি বাংলাদেশি কি না
সে অবাক হয়ে থাকে, রাত্রির কালো বিন্দু বিন্দু ঝরে।
নদীর ভেতর পিঁড়ি পেতে বসে
আমি ও অনন্ত ভাত খাই।
অদূরে জেগে থাকে শিলং সাইকেল স্টোর্স।
চাকা ঘুরতে থাকে,আমরা ভাত খাই
ছবি- সূরজ মোহান্ত
অনেক আগের প্রকাশিত কবিতা। পড়েছি সেই সময়। অতুলনীয় কবিতা অবশ্যই। তবে আমার ব্যক্তিগত ভাবে মনে হয় এখন লিখলে একই কবি এদের কয়েকজনকে হয়তো অন্যভাবে ভাববেন। সঞ্জয় দা ফেসবুকে নেই, তাই তিনি হয়তো এই মন্তব্য দেখতে পাবেন না।
তথ্যে সামান্য ভুল আছে। কবিতাগুলো আসলে কবির নিজের মুখেই শোনা। স্মৃতি গণ্ডগোল করায় প্রকাশিত বলে মনে হয়েছে। এই সিরিজের অন্য কিছু কবিতা সম্ভবত প্রকাশিত হয়েছিল। এগুলো নতুন লেখা। স্মৃতিবিভ্রমের জন্য ক্ষমাপ্রার্থী।