Daruharidra
  • ধান্যগৃহ
  • কবিতা
  • গল্প
  • গদ্য
  • প্রবন্ধ
  • উপন্যাস
Daruharidra
  • ধান্যগৃহ
  • কবিতা
  • গল্প
  • গদ্য
  • প্রবন্ধ
  • উপন্যাস
Daruharidra
No Result
View All Result
Home অনুবাদ পাতা

বীরেন্দ্র কুমার ভট্টাচার্য

একটি জাপানি মেয়ে

Daruharidra by Daruharidra
09/03/2021
in অনুবাদ পাতা
0
বীরেন্দ্র কুমার ভট্টাচার্য

অলংকরণ - আশু চৌধুরী

347
VIEWS
মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ: সুশান্ত কর

 

      বহু বছরের পরে যেন সে ঘুম থেকে জেগে উঠল। ক্লান্তিতে সারা শরীর অবশ। বালিশ—   বালিশ নয়—কাঠ। আগস্ট মাসের নয় তারিখে ওর বিয়ে, কাকিমারা সব যোগাড়যন্ত্র করছে। বরের কনের ঘরে মিলে কুষ্ঠী দেখে বিয়ের দিন ঠিক করেছে। ওর বান্ধবী একজন ‘কিমনো’টা সেলাই করে দেবে। ওর পরনের জুতোজোড়া হবে লাল, অনেকে সেই দিনে বাজারে আসা বিদেশি জুতো পরতে ভালোবাসে। কিন্তু সে সেরকম জুতো পরতে পছন্দ করে না, কারণ বিদেশি জুতো ওর পছন্দ নয়। জাপানি জুতোই পরে। সেদিন সে  পাউডার, লিপস্টিক কিছুই মাখে না। জাপানি মেয়ের রং এমনিতেই ফর্সা, তাই নিয়ে ওর একটি গর্ববোধও আছে। আগে হলে মুখে এক রকম তেল আর সাদা পাউডার মাখতে হত, কিন্তু এখন ওর মন কৃত্রিমতা সহ্য করতে পারে না। অবশ্য কাকিমার ইচ্ছে অমান্য করতে না পেরে সে তার লম্বা চুলগুলো যাতে বিয়ের দিনে ভালো করে বাঁধতে পারে তাই এখন থেকেই কাঠের বালিশে শুয়ে সমান করছে। … তার বাইরে, বরের ঘরে ‘সান –সান- কু-ডে’র ভোজের আয়োজন হয়েছে। বিয়েতে বরের বাড়ির লোকেরা ঠিক করেছেন সাগর থেকে টুনা মাছ নিয়ে আসবেন ।

      নিচু জানালা দিয়ে সূর্যের লাল কিরণ এসে ওর নাকে মুখে ছড়িয়ে পড়েছে। … সে ভাবল তার জীবনেও রাত ফুরিয়ে ভোরের শুভাগমন হয়ে গেছে। … সুজুকি, ওর সুজুকি, শান্তিপ্রিয় মানুষ, নাগাসাকির কাবুকি থিয়েটারের মুখ্য অভিনেতা। সুজুকিকে দর্শকেরা ভালোবাসে— ভালোবাসবেই না কেন, সে যা সুন্দর অভিনয় করে! প্রথম যখন ‘যুদ্ধের থেকে ফিরে আসা সৈনিক’ নামের নাটকটিতে সৈনিকের অভিনয় করে, সে তখন অপূর্ব সৃষ্টি শক্তির পরিচয় দিয়েছিল। ‘বুসিডে’ বিশ্বাসী জাপানি সৈনিক ‘চা-না-উ’তে বসে হঠাৎ স্থির সংকল্প চিরদিনের জন্যে তলোয়ার ত্যাগ করা দৃশ্যে ওর সংলাপ কী সংক্ষিপ্ত অথচ কত গভীর অর্থপূর্ণ, –“ সামুরায় বিদায়।” বলা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে গ্যালারিতে বসে থাকা মানুষরা চিৎকার দিয়ে বলে উঠলেন, ‘সুন্দর!’। তারপরে মঞ্চে সুজুকি হেঁটে গিয়ে ‘টকনমা’র ভেতরে গিয়ে ঢুকল।  সেখানে অনেক চেরি ফুল পড়ে ছিল। তারই  একটি তুলে সে বলেছিল, “ চেরি ফুল অমর হউক।’ চেরি ফুল আর কে হবে? প্রত্যেক জাপানিই এক একটি চেরি ফুল। হারাকিরি করতে ভয় না পাওয়া জাপানি সৈনিকের জীবন চেরি ফুলের মতো একদিন সুন্দর হয়ে ফুটে উঠে আবার না চাইতেই ঝরে পড়ে মরে যায়। জাপানিকে আর চেরি ফুল হতে হবে না, —জাপানি বেঁচে থাকুক।

      সেই থিয়েটার হয়েছিল গেল বছরের নয় আগস্টে।

      নয় আগস্ট।

      একটি দীর্ঘশ্বাস ঝরে পড়ল ফুমিকো নরহরার নাক দিয়ে। নয় আগস্ট তার জীবনের একটি অসাধারণ দিন। সেই দিনে ওদের শহরে এটম বোমা পড়েছিল। বছর কয় আগেকার কথা।

 ***   ***

 

      আড়মোড়া ভেঙে সে উঠল। বিছানা গুছোলো। রাতে বিছানা করে শোয়া ছোট ছোট পিঁড়িগুলো গুটিয়ে স্টোর রুমে গিয়ে রেখে দিল। তার পরে স্নান করতে গেল। স্নানের ঘর রাজপথের কাছে ।সর্বজনীন স্নানের ঘর। সেখানে ঢুকে সে গরম জলের টাবে গা ডুবিয়ে নিয়ে কিছুক্ষণ পড়ে রইল। পাশের স্নানের ঘর থেকে কারো করুণ গান ভেসে আসছিল। সুরটি পুরোনো জাপানি সঙ্গীত ‘গাগাকু’র বলে মনে হচ্ছে, গলার স্বরটি অবশ্য চেনা বলে মনে হচ্ছে না। …

                 … হাজার চেরি ফুল ঝরে পড়ল

                  শুধু আমার আশার তরি ডুবল না…

গানটা ওর ভালো লাগল। এই ভোরে কেমন আশার বার্তা ছড়িয়ে দিল। চেরিফুল  ঝরল। কিন্তু আশা বেঁচে উঠল। এটম বোমাতে অনেক জাপানি মরল। কিন্তু জাপানির আশা মরেনি।

      ওর মুখে একটা হাসি ফুটল। কাছের দেওয়ালে সে একটা হাসি দেখতে পেল। কোনো শিল্পী এঁকে রেখেছেন মহাকাশ্যপের হাসি। সে পড়েনি, কিন্তু জেন ভিক্ষুর থেকে শুনেছে, এই হাসি ভারতের হাসি। একদিন বুদ্ধ ভিক্ষুদের সঙ্গে আলাপ করে বসে আছেন, এমন সময় ব্রহ্ম রাজা এসে তাঁকে একটি সোনার ফুল উপহার দিলেন, আর ধর্ম ভিক্ষা করলেন। বুদ্ধ ফুলটি নিলেন, চোখের সামনে তুলে ধরলেন আর তারপরে ধ্যানস্থ হলেন। তার পর মহাকাশ্যপ হাসলেন। সেই হাসি সাতাশ পুরুষ ধরে ভারতে ছিল, পরে চিনে এল। তার পরে জাপান এসে পৌঁছাল। এই হাসিটা ‘ওয়াবি’র সবাক নিস্তব্ধতার হাসি। … কিন্তু এ যেন ‘সাবি’র অথবা শান্তির অমর হাসিও নয়?

      ‘সাবি!’ ওর মনে আজ ‘সাবি’র দরকার।

      সে স্নান শেষ করে এসে বাক্সটি খুলে ওর নতুন ‘কিমনো’ একটা পরবার জন্যে বের করল। হঠাৎ  তার মনে পড়ল কাপড়ের স্তুপে পনেরো বছর বয়সে পরা পুরোনো ‘কিমনো’টা পড়ে আছে। ‘কিমনো’টি ওকে সেই মহাপ্রলয়ের দিনটির কথা মনে পড়িয়ে দিল। সেদিনও সে এই ‘কিমনো’টি পরেছিল।

      ওর মনে একটি ছোট ভূমিকম্প হল। তাড়াতাড়ি সে নতুন ‘কিমনো’টি পরে নিল। তার পরে সে জিনিসপত্র গুটিয়ে     গুছিয়ে সোজা গিয়ে ‘টকনমা’র তলাতে গিয়ে পৌঁছাল। ‘টকনমা’র বেদীতে কাকিমা একটি মেরি-গোল্ড ফুল রেখে গেছিলেন। ফুলটি হাসছিল।

      সে সোজা গিয়ে পরিচ্ছন্ন কোঠাটির বেদিতে মাথাটি রেখে পাগলির মতো চেঁচিয়ে উঠল, “মা! তুমি কই? বাবা! তুমি কই? তোমরা এসো। তোমরা আসো। আমার বিয়ে হচ্ছে, মা! সুজুকির সঙ্গে আমার বিয়ে হচ্ছে!”

      সে এবারে ফুলের দিকে তাকাল— ফুলটি আগের মতোই হাসছে। শোকে সামান্যও ম্লান না হওয়া হাসি…

      “অমিতাভ’। সে অস্ফুট স্বরে চেঁচিয়ে উঠল।

      সে দাঁড়াল।  বাইরের কোঠাতে গিয়ে সে জুতোজোড়া পরল, তারপরে চুল আঁচড়াল। সামান্য দাঁড়িয়ে সে আয়নাতে মুখখানা দেখল। নয় বছরের আগের ওর চেহারাটার কথা মনে পড়ল। তখন ওর ‘কিমনো’-র রং বেগুনি ছিল, মা-বাবা ওকে আদরে ঢেকে রেখেছিলেন আর দেশে যুদ্ধ চলছিল।

      যুদ্ধ!

      সে বেরিয়ে গেল রেস্তোরাতে। এক পাশে গিয়ে বসল। এক কাপ কফি আর এক টুকরো কেক চেয়ে নিল। অন্যমনস্কভাবে খেল, বেরিয়ে গেল। যেতে যেতে সাগরের পাড়ে গিয়ে পৌঁছাল। সে দাঁড়াল। আর দাঁড়াল ওর সাদা চকচকে মুখখানার বেড়ালছানার মতো চোখজোড়া। আর দাঁড়াল লম্বা ‘কিমনো’-র নীচের জুতোজোড়া। জায়গাটা সুন্দর। সেই জায়গা থেকে মাটি উঁচু হয়ে গিয়ে মিলেছে পাহাড়ের চূড়ায় আর সেখান থেকে আর দিক এদিকে নেমে মাটি গিয়ে মিলেছে গিয়ে সাগরে। …

      সাগর! বাতাসের ছোঁয়াতে ওর ‘কিমনো’টা উড়তে শুরু করল। মুখখানা ঠাণ্ডা বলে মনে হল। বুকের ভেতরে ঢুকে এল অনেকদিনের আগের সাগর, বাবা বেঁচে থাকা দিনের সাগর। সেই সাগর যে ওর থেকে আলাদা কোনো একটা অশরীরী বস্তু এই কথা তার কোনোদিনই সেরকম মনে হয়নি। কখনও বা জেলেদের কল-নৌকাতে উঠে সে মা-বাবার সঙ্গে গভীর সাগরের কল্লোল আর মাছের সন্ধানে গেছিল। কখনও বা অনেক মাঝি নৌকার মিছিল করে গিয়ে তিমি মাছ ধরে দেখেছিল। সেদিন ওর কী আনন্দ!… শুধুই কি তাই? সাগরের অগভীর জলে ভেসে ফেরা শ্যাওলা , বালির শামুক, জলের উপর উড়ে বেড়ানো পাখি, মাছ খেতে আসা হাঙর—কতকিছুর সঙ্গে যে ওর বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল! পোতাশ্রয়ে এসে ঢুকে পড়া জাহাজের ঢেউতে কেঁপে নৌকাগুলো যখন নড়ে উঠে, তখন সেই ঢেউতে সেও নাচে। ওর পায়ের অঙ্গী ভঙ্গী এত সুন্দর ছিল যে শহরের মেয়েরা এখনও ওকে প্রশ্ন করে, “ ফুমিকো, আজকাল আর তুই নাচতে আসিস না কেন?” কেন আসে না সে? কেন আসে না — সে কথা ওর সেই বুড়ো পাহাড় জানে।

      এই উরাকামি পাহাড়টি ওর জীবন সংগ্রামের সাক্ষী।

      সাগরের পাড়ে বেশিক্ষণ সে থাকতে পারেনি। পাহাড়ের নীচে দিয়ে সাগরের পাশের পথ ধরে সে জোরে পা চালিয়ে গেল ওর সেলাই কলের কাজের জায়গাতে। সেই সেলাই কলটিই ওকে আজ ন’বছর ধরে বেঁচে থাকবার উপায় দিয়েছে, কিন্তু সঙ্গে ওর থেকে কেড়ে নিয়ে গেছে সাগরে ঘুরে বেড়াবার আর নাচবার অবসরটুকু। মা-বাবা মারা যাবার পর থেকে ওর অবসর নেই হয়ে গেছে। দিনে রাতে বে-দিশার মতো সে সেলাই কল চালিয়ে গেছে।

      মা-বাবা মারা যাবার কথা মনে আনতেও ওর কষ্ট হয়, ভাবলেই ওর ভেতরটায় একটা শূন্যতা তৈরি হয়। অনাথ বলে কাকা-কাকিমা ওকে আদর তো করেন, কিন্তু তাঁদেরও ছেলে-মেয়ে দু’টি আছে। তাদের আদর করতে করতে ওর জন্যে আর অবশিষ্ট কিছু থাকে না। তার উপরে ওদের বাড়িতে ও শোয় মাত্র, বাকি সব কাজ বাইরেই করে। নিজের রোজগার সে নিজেই করে।

      সেলাই কলের ঘরঘর শব্দের মধ্যে ও জীবনের দুঃখ ভুলবার চেষ্টা করে; সঙ্গে মনে এই আশা লালন করে যে সুজুকির সঙ্গে বিয়ে হলে নিশ্চয় তার জীবন সুখের হবে। কেবল তাই নয়, সুজুকি ওকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বিয়ের পরে ওকে ‘কাবুকি’তে অভিনেত্রী হিসেবে ঢুকিয়ে দেবে আর নিজের কল-নৌকাতে চড়িয়ে ওকে গভীর সাগরে ঘুরিয়ে নিয়ে আসবে।

***   ***

      দিন দুপুরে দোকান থেকে ‘কিমনো’ চারটা সেলাই করে পাশের রেস্তোরাতে ভাত খেতে এল।ভেতরে আসতে না আসতে সে রান্নাঘরে কোলা ব্যাঙের ডাক শুনতে পেল। ওর মন ভালো হয়ে গেল। যুদ্ধের সময় থেকে সে কোলা ব্যাঙের মাংস খায়নি। খাবার টেবিলে বসেই সে শুরুতেই সেই কোলা ব্যাঙের মাংসের অর্ডার দিল।

      শুরুতে এক প্লেট মাছের ভাজা, তার পরে এক কাপ শ্যাওলার ঝোল, তারপরে কোলা ব্যাঙের এক বাটি সেদ্ধ মাংস এবং সব শেষে এক প্লেট ভাত খেয়ে সে যখন বিল মিটিয়ে দিতে এল, ততক্ষণে বেলা ঢলে পড়েছে। কাউন্টারের পিছনে একটি ট্যাঁরা চোখের গেইসার প্রতিমূর্তি যেন ওর সহজ সরল বেশ-ভূষার দিকে উপহাস করে তাকাচ্ছিল। সে গেইসাকে দুই চক্ষে দেখতে পারে না। ওদের জীবন কৃত্রিম এবং শুধুই পুরুষ মানুষের জন্যেই নিবেদিত । গেইসার জীবনে রূপের যা সওদা চলে, এর কোনোটাই ওর পছন্দ নয়।

      ভাতের দাম চার ইয়েন দিয়ে সে যখন পথে নেমে এল,  দেখল কাকিমা দৌড়ে দৌড়ে এদিকে আসছেন। কাকিমার মুখ বিষণ্ণ। চোখ দুটি এক অদৃশ্য আশঙ্কাতে কাঁপছে।

      “ফুমিকো!”

      “কাকিমা!”

      “ তুই দোকান বন্ধ করে আমার সঙ্গে আসতে পারবি?”

      “কেন, কাকিমা?”

      কাকিমা বললেন, “সাংঘাতিক কাণ্ড হয়েছে। আমি সমবায়ে কাজ করছিলাম, হঠাৎ একটা ফোন এল।”

      “ কী খবর পেলে?”

      “ বলছি, চল তো দেখি আগে; যেতে যেতে বলব।”

        ফুমিকোর বুক কেঁপে উঠল।

      সে দোকান বন্ধ করে কাকিমার পিছু নিল।

      কাকিমা মানুষটি এরকমই। তাঁকে দেখলে মনে হয় যেন জীবনের কোথাও আশার কোনো বার্তাই নেই। দুনিয়ার সব ছেলে মেয়েকে বিপদের খবর বিলিয়ে যাওয়াই যেন তাঁর পুরোনো অভ্যেস। তাঁর তদারকিতে যারাই থাকে তাদের বিপদ বেদনার বোধ বাড়ায় মাত্র।

      কাকিমা ওকে বাসে তুলে নিয়ে সোজা সাগর পারের নৌ-হাসপাতালে নিয়ে গেলেন। সে যন্ত্র-চালিতের মতো কাকিমাকে অনুসরণ করল।

      বাস এসে নৌ-হাসপাতালের সামনে দাঁড়ালে কাকিমা নেমে পড়লেন। ওকেও নামতে বললেন। সে নামল।

      হাসপাতালের উপর তলাতে যে ঘরের সামনে ফুমিকোর কাকিমা সকম্পিত পায়ে গিয়ে দাঁড়ালেন। সেখানে তখন ডাক্তার ঢুকে রোগীকে পরীক্ষা করছেন। কাকিমা নিঃশব্দে ফুমিকোর দিকে তাকালেন। আতঙ্কে কাকিমার চোখ বিহ্বল হয়ে উঠেছে। সে জিজ্ঞেস করল, “ কী হয়েছে কাকিমা, কে আছে এখানে?”

      কাকিমা জীবনে এই প্রথমবার ওর কাছে চেপে এলেন। ওর কাঁধে হাত রেখে বেশ করুণ স্বরে বললেন, “  ফুমিকো, সুজুকি আছে এখানে। সুজুকি!”

      “ কী হল সুজুকির?”  ফুমিকোর হৃদয় দুরু দুরু কাঁপতে শুরু করল। “আমি সমবায়েই ছিলাম, ম্যানেজার ডেকে নিয়ে গেলেন, বললেন ফোন আছে। সুজুকির বাবার ফোন। বাবা বললেন, পাঁচদিন আগে বুঝি ওরা ‘সি’ উপসাগরে মাছ ধরতে গেছিল। পাঁচটির মতো কল নৌকা ছিল। সব মিলিয়ে ওরা পঁচিশজনের মতো ছিল। ‘ডান-সান-কু-ডো’র ভোজের জন্যে টুনা মাছের সন্ধানে গেছিল।”

      “তারপর?” অধৈর্য হয়ে ফুমিকো জিজ্ঞেস করল।

      “ তারপর ওরা পরশু ঘুরে এল।”

      “ কাকিমা, আসলটা বলো। সুজুকি যদি ঘুরেই এল, তবে এত চিন্তা করবার কী আছে? হাসপাতালে আনল কেন?”

      “কাল থেকে ওর শরীরে কিছু অদ্ভুত লক্ষণ দেখা দিয়েছে। চুল ঝরছে, খিদে মরে গেছে আর সন্দেহ হচ্ছে যদি বা…” কাকিমা বলতে গিয়ে রয়ে গেলেন। তাঁর হাত পা থরথর করে কাঁপছিল।

      “ গেল মাসে আমেরিকানরা ‘বি’ দ্বীপে হাইড্রোজেন বোমা পরীক্ষা করেছিল। তার শক এসে ৮০ মাইল দূরে ‘সি’ উপসাগরে লেগেছে। এর তেজস্ক্রিয়  ছাই পড়েছে মাছের গায়ে, জেলের গায়ে। সবাইকেই ‘রেডিও একটিভ’ করেছে। সমস্ত জেলেদের শরীরের কোষে প্রভাব ফেলেছে। ডাক্তার বলে দিয়েছেন, এবারে আর রক্ষা নেই।”

      “ সু-জু-কি?”

      হাসপাতালের মেঝের উপরে ঢলে পড়ল সে, অসহায়ের মতো এবারে চীৎকার করে উঠল, “অমিতাভ! অমিতাভ!”

      তারপরে সেই মর্মস্পর্শী সুগভীর নিস্তব্ধতা হাসপাতালের চারদিক ভরিয়ে ফেলল।

 

*** ***

 

      একমুঠো তেজস্ক্রিয় ছাই।

      ছাই সুজুকির রক্ত প্রবাহে ব্যাঘাত ঘটিয়েছে, হাড়ে গিয়ে আঘাত করেছে। ওকে ছুঁতেও মানা। কথা বলতে মানা। সে এখন প্রায় যমের দুয়ারে দাঁড়িয়ে। সুজুকির সঙ্গী বাকি চব্বিশজন জেলেরও একই দশা, সবার শরীরে একই লক্ষণ দেখা দিয়েছে।

      চিলমিল করে ঘুম পাচ্ছিল সুজুকির। দূর থেকে বাঁকা অবনত নজরে ফুমিকো ওকে দেখছিল। হয়ত শেষবারের জন্যে দেখে নেওয়া। সুজুকির সুগঠিত শরীরের উপর একখানা পাতলা কাপড়। ম্লান সান্ধ্য আলোতে ওর মুখমণ্ডলে এক বিবর্ণ জ্যোতি দেখা যাচ্ছিল। ওর কোমল মিহি গাল দুটির থেকে লাল রং ছিটকে পড়ছিল। কপালের ছড়ানো সমতলে এক গভীর প্রশান্তির ছায়া। ঠোঁট দুটি শুকনো অথচ কাপড়ের মতো কোমল।

      সবই একই আছে। কিন্তু তবুও আর কিছুই নেই।

      ফুমিকোর থেকে ধীরে ধীরে দূরে সরে যাচ্ছে সুজুকি। কত দূরে সে বলতে পারবে না। এত কাছে এসেও মানুষ কেমন দূরে সরে যায়।

      ওর অশ্রু ঝরে পড়ল। হঠাৎ দেখল, সুজুকি ওর দিকে অপলক তাকিয়ে আছে। দেহ আর মনের সর্বশেষ শক্তি দিয়ে সে তাকে দেখছে। এই চাউনিতেই যেন তাকে শেষ করে দেবে।

      “ফুমিকো!” কথা বলবার সঙ্গে সঙ্গে সুজুকির চোখের জল  বেরিয়ে এল ।

      ফুমিকোর অশ্রু অঝোরে ঝরতে শুরু করল।

      অশ্রুর সঙ্গম। বিয়ের আগেই এল বিচ্ছেদ। কে জানে হয়ত এটিই অপ্রতিহত বিচ্ছেদের আগাম ঘোষণা।

      সুজুকির বাবা ওকে ঘরের বাইরে দূরে নিয়ে গেলেন। সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করলেন, “ধৈর্য ধর, তাকে আজ টোকিও ইউনিভার্সিটি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হবে। জাপানের সেরা হাসপাতাল।” কিন্তু কথা বলতে বলতেই মানুষটি ভেঙে পড়লেন।

      ডাক্তার ফুমিকোকে ডেকে নিয়ে গেলেন। ঘরে বসিয়ে বললেন, “যদি  বিজ্ঞান সুজুকিকে রক্ষা করতে পারে, তবে করা হবে। কী করবে ফুমিকো? জাপান পৃথিবীর কশাইখানাতে পরিণত হয়েছে। সেবারে পড়ল এটম বোমা। নাগাসাকির ৭০ হাজার মানুষ মরে শেষ হল, ৫০ হাজার আহত অসুস্থ হলেন। তারই মানসিক ঘা আজও শুকোয়নি। আবার এবারে হাইড্রোজেন বোমার পরীক্ষার কুফল ভোগ করতে হচ্ছে আমাদের মানুষকে।”

      এই আলাপে ভাগ নেবার অবস্থা ফুমিকোর ছিল না। ওর মনে আর তখন সান্ত্বনার কোনো জায়গা নেই। সেই শুধু নিজেকেই প্রশ্ন করল, “ আমি কীভাবে বেঁচে থাকব?” এটম বোমা মারল মা-বাবাকে, হাইড্রোজেন বোমা মারছে ভাবি বরকে। মেয়ে মানুষ বাঁচবে কী করে?

      ডাক্তার ওকে গভীরভাবে নিরীক্ষণ করে বিফল হয়ে শেষে সান্ত্বনার কোনো চেষ্টা না করে শুধু বললেন, “ফুমিকো, আমার জিহ্বা জড় হয়ে যাচ্ছে। তোমার মতোই আমিও নিঃসহায়। বড় বড় শক্তিগুলো তোমার আমার নামে এটম হাইড্রোজেন বোমা বানাচ্ছে। মারছে আবার আমাদেরই। কিন্তু এরা বুঝে না আমাদের যুদ্ধের দরকার নেই, দরকার শুধু শান্তির।”

      ফুমিকো দেওয়ালের দিকে মুখ ঘুরাল। দেখতে পেল মহাকাশ্যপ হাসছেন। ওর সমস্ত চেতনা সেই হাসিতে লেগে রইল।

হঠাৎ সে টের পেল পেছন থেকে কেউ ওর কিমনোতে ধরে টানছে।

কাকিমা যাবার জন্যে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছেন।

 *** ***

      বিকেলে যখন কাকিমার সঙ্গে সে বাড়িতে গিয়ে ঢুকল, তখন সুজুকির জীবনের সব আশা ছেড়ে এসেছে। সেই সঙ্গে তার নিজের সুখী ভবিষ্যতেরও। কাকিমা ওকে ‘নো’ নাটক দেখতে যাবার কথা বললে, ও গেল না। উপায় না পেয়ে কাকিমা বললেন,

      “চল, উরাকামি পাহাড়ে যাই।”

      “কেন?”

      “ চল তো দেখি।”

      আজ ন বছরে এরা উরাকামি পাহাড়ে যায়নি। কেউ কেউ পাহাড়টিকে জীবন দূত , কেউ বা আবার যম-দূতও বলে। ফুমিকোর জন্যে কিন্তু দুটিই সত্য। এই পাহাড়ের এই পারে থাকার জন্যে সে এটম বোমার থেকে বেঁচে গেছিল। আর সেই পারে ছিলেন বলে, ওর বাবা-মা মরে ছাই হয়ে গেলেন।

      উঁচু পথ ধরে উঠে যেতে যেতে কাকিমা বললেন,” আমার একটি ছবির কথা মনে পড়েছে।”

      “কার ছবি , কাকিমা?”

      “মিয়ামটরের ছবি। মনে আছে কি তোর? একটা মরা ডালের উপরে একটি পাখির গান গাইবার দৃশ্য?”

      “আছে।”

      “আমাদের জীবনগুলোও সেরকমই হয়েছে। জীবনের আশ্রয় যেন কেউ ভেঙে ফেলতে চাইছে। আমরা নতুন আশ্রয়ের এখনও সন্ধান পাইনি।”

      “কাকিমা!”

      “আগে ভাবতাম, জীবনটি রিকুউর আঁকা সেই ভোরের গোলাপ পাপড়ির মতো। এখন দেখছি, রোজই ভাঙা ডালেই গান গাইছি। মনে আছে কি তোর রিকুউর আঁকা সেই ছবিটির কথা?”

      ফুমিকো মন্ত্রমুগ্ধের মতো বলল, “আছে।”

      “ তোর কি মনে আছে, সেই মহাপ্রলয়ের দিনটির কথা? আমার গায়ে সেদিন জ্বর। তোর কাকা কাজে বেরিয়ে গেছেন। ছেলেটা আছে যুদ্ধে। তোর বোনটি তখন স্কুলে। তোর মা সকাল সকাল আমার শুশ্রূষাতে তোকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। তুই আমার কাছে বসে ফুল সাজাচ্ছিলি। মনে আছে তোর?”

      “আছে।” ফুমিকোর চোখ ছলছল করে উঠল। কিন্তু কাকিমা সেটি খেয়াল করেননি।

      কাকিমা বললেন, “সেদিন তুই আমাকে সয়াবিনের ঝোল বানিয়ে দিয়েছিলি। ডাক্তার ভাত আর কফি খেতে মানা করেছিল। তার পরে তুই আমাকে একটি জেনের কিচ্ছা বলেছিলি, মনে পড়ে?”

      “ না, মনে নেই, কাকিমা।” সত্যিই ওর মনে ছিল না।

      কাকিমা বললেন, “গল্পটি এই। দুজন ভিক্ষু ছিল। একদিন ভিক্ষে করে ফিরে আসবার সময় পথে একটি নদীতে ভাঙা সেতু পেল। সেতুর পাড়ে এক সুন্দরী মেয়ে ছিল। কাপড় ভিজবে বলে সে নদী পার হতে ভয় পাচ্ছিল। সেই দেখে একজন ওকে কাঁধে তুলে পার করে দিয়ে এগিয়ে চলে গেল। আরেকজন যে ছিল, সে তার এই অশোভন কাজ থেকে রাগে গোটা পথ ধরে বকাবকি করছিল। তাই না দেখে প্রথম জন বলল, ‘মেয়েটির কথা কি তুমি এখনও ভাবছ? আমি তো ওকে নদীর পাড়েই রেখে এসেছি।’ সেই গল্পটি বলবার সঙ্গে সঙ্গে তুই বলেছিলি, ‘কাকিমা অসুখের কথা বেশি বেশি ভেবো না।’ আমিও সেভাবেই কথাগুলো ভাবতে শুরু করেছি। সেই গল্প আমাকে বেশ মনের জোর দিল। ভেবে ভেবে জীবনকে ভারী করে লাভ কী? ভাবনাকে ছুঁড়ে ফেলাই ভালো।”

      ফুমিকো কিছুই বলল না। ওর ভেতরে তখন কেবল একটি হাসির বাইরে কিছুই ছিল না। সেই অনির্বাপিত হাসি হল বুদ্ধের হাসি, যে হাসি ওয়াবির মতো নির্বাক অথচ ভাষাময়। সে কীসের আভাস দিয়েছিল, বুঝা কঠিন। কাকিমার সান্ত্বনা-বাণী ওর মনের গভীরে প্রবেশ করতে পারল না।

      কাকিমা ওর নীরবতা দেখে মহাপ্রলয়ের দিনটির কথা বলে যেতে আর সাহস করলেন না।

      ধীরে ধীরে তাঁরা গিয়ে উরাকামির উপরে চড়ে ধীরে ধীরে অন্য পাড় দিয়ে নীচে নেমে গেল। সামান্য দূরে গিয়ে যেখানে সমতলে পৌঁছাল তখন ফুমিকো হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেল। কাকিমা জিজ্ঞেস করলেন, “ কী হল?”

      “ এখানে আমাদের বাড়ি ছিল। এর ঠিক পোয়া মাইল দূরে বাবাদের কাজের লোহার কারখানা। তার পাশেই মায়ের সমবায়টি। আমরা ভোরেই বৈদ্যুতিক হাঁড়িতে জল গরম করে চা করলাম। বাবা কিছুক্ষণ ভায়োলিন বাজালেন। মা –বাবা গ্লোভজোড়ার ফাটা জায়গা সেলাই করলেন; তারপরে আমরা বেরিয়ে গেলাম। সেই যে গেলাম, আর আমাদের দেখা হল না। ঠিক ১১টা ৫ মিনিটে শব্দটি হল।”

     “না, ১১টা ২ মিনিটে।” কাকিমা ঠিক করে দিলেন, “ পৃথিবী কাঁপতে শুরু করল। ছাই উড়ল। ঘণ্টা খানিক পরেও আমাদের দিকের মানুষজনের সাড়া শব্দ ছিলই না। তারপরে এম্বুলেন্স , মোটরসাইকেল আর প্লেন চলতে শুরু করল। ৭০ হাজার মরল, ৫০ হাজার আহত হল।”

      কাকিমার স্মৃতির দুয়ার হঠাৎ খুলে গেল। কিন্তু পর মুহূর্তে তিনি বুঝলেন যে তাঁর কথা ফুমিকোর মনে শোকের আগুনে ঘিই শুধু ঢালছে। সেই জন্যেই তিনি তাড়া দিয়ে বললেন, “চল, আর বেড়াতে হবে না।”

      দু’জনেই ফিরে এলেন। পাহাড়ের উপরে আবার কাকিমা বললেন, “ লোকে এই পাহাড়টিকে যাদু পাহাড় বলে। এই পাহাড়ই বুঝি আমাদের বাঁচাল।”

      ফুমিকো এবারেও কিছু বলল না। ওর মনে ‘সাবি’র বাইরে আর কিছুই প্রবেশ করল না। অমিতাভর হাসিতে সে আশ্রয় চাইছিল। সেই হাসিকে কেন্দ্র করে জীবন মৃত্যুর বিপরীত বাসনার দ্বন্দ্ব ওর মনের চারপাশে তখন ভাবের ঘূর্ণিবায়ুর সৃষ্টি করেছিল।

 *** ***

 

      সেই হাসিটা ওর মনে শক্ত হয়ে লেগে থাকবার জন্যে ফুমিকো মৃত্যুর সঙ্গে সংগ্রাম করতে তৈরি হল।

      কিন্তু সুজুকির মৃত্যুর সংবাদ সে মুহূর্তে মুহূর্তে আশা করেছিল। ওর পরীক্ষার ক্ষণ তখনই শুধু শুরু হবে।

      টোকিও থেকে খবর আসতে সাতদিন লাগল। সুজুকি রক্তপ্রবাহ বন্ধ হয়ে মারা গেল। সমস্ত চিকিৎসা অতলে গেল।

      তখন সন্ধ্যা হয় হয়। কাকিমা বাড়ি ছিলেন না। কাকারাও কোনো কাজে নাগাসাকির বাইরে ছিলেন।

      ফুমিকো নিঃশব্দে গিয়ে বাক্সটা খুলে বিয়ের জন্যে সেলাই করে রাখা কিমনোটি বের করে পরল। মাথাতে সামান্য তেল মাখল। পায়ের জুতোজোড়া পাল্টাল। তার পরে আয়না সামনে রেখে সে একবার নিজের রূপটা দেখল। চুল আঁচড়াল। ওর মনে হল যেন সেদিনই ওর বিয়ে। কাল-বিয়ে। যে বিয়ে বাস্তবে আর ঘটে না। ওর মনে হল যে তার যৌবন-মুখর দেহটি যেন ধীরে ধীরে জ্বলে পুড়ে শেষ হয়ে যাচ্ছে। পৃথিবী ধীরে ধীরে কাঁপছে। বেশিক্ষণ সে আয়নার সামনে থাকতে পারল না। ধীরে ধীরে ‘টকনমা’র বেদির পাশে বসে নীরবে কিছু ভাবল। কিন্তু সেখানেও অবশেষে দেখল, সেই শান্তির রহস্যময় হাসিটা। সাধারণ সুখ-দুঃখ ওর পাশে চাপতে পারে না। সে যেন একটি দেহহীন উড়ন্ত, অরূপ ইথারের কম্পন।

      সে উঠে এগিয়ে গেল। কিছুতে যেন তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল। নীরবে সামনের বাগিচাতে গিয়ে পৌঁছাল। বাগিচার থেকে একটি ‘ক্রিসেনথিমাম’ ফুল তুলে নিল। সঙ্গে সঙ্গে একটি গন্ধ বেরুল। ওর অন্তরে সাগরের আহ্বান এল।

      সাগর!

      সাগরের পাড়ে পাড়ে গিয়ে সে বালিতে নামল গিয়ে। ওর চোখের সামনে ভেসে উঠল সমুদ্রের প্রবল জোয়ার। জোয়ারের বুকে সে ক্রুর উল্লাসের হাসি দেখতে পেল। মনের ‘সাবি’, শান্তির ধরণী হারিয়ে গেল।  জীবন কিছু অবুঝ ভাবের কোলাহলের চাপে গতিহীন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

      জোয়ার এসে তার পা ছুঁল। তারপরে হাঁটু স্পর্শ করল। তারপরে ধীরে ধীরে ওকে গ্রাস করতে এগিয়ে এল।

      হঠাৎ সে শুনতে পেল, “নড়বি না, ফিরে আয়।”

      প্রথমবারে সে পা নাড়াল না।

      দ্বিতীয়বার সে আবার শুনল, “নড়বি না, ফিরে আয়।”

      সে এবারে ফিরে তাকাল।

      তৃতীয়বারে আবার ওর কানে পড়ল, “নড়বি না, ফিরে আয়।”

      সে এবার ফিরে তাকাল।

      চতুর্থবার আবার ওর কানে পড়ল, “মরবি না, ফিরে আয়।”

      সে ফিরে দৌড় দিল। প্রাণ হাতে নিয়ে দৌড় দিল। নেমে আসা অন্ধকারে সে কিছুই মানছিল না। মনও মানবার মতো অবস্থাতে ছিল না।দৌড়ে দৌড়ে এসে চোখে লম্বা কিছু একটা দেখে এবারে সে দাঁড়িয়ে গেল।

*** ***

 

      পরদিন যখন সে চোখ মেলল তখন তার চারপাশে বিরক্তিকর নিস্তব্ধতা।  কারো কোথাও সাড়া শব্দ নেই। সাগরের জোয়ারের উচ্ছ্বাস ওর বুকের ভেতরে আর বাইরে হারিয়ে গেল। মৃত্যুর কল্লোলের বুক থেকে সে জীবন-বন্ধ বাড়িতে ফিরে এল।

      সে উঠে দাঁড়াতে চাইল। কিন্তু শরীরটা অবশ বলে মনে হল। আছে কই সে — সেটাই অনুমান করা কষ্ট হল। ঘরটা অচেনা অচেনা লাগল। অনন্ত নিস্তব্ধতা।

      বিছানাতে এবারে কাত হয়ে দেখল, ছোট্ট  টেবিলে একটি চিঠি রাখা। এক হাতে কাগজটা তুলে নিয়ে সে পড়ল:

 

স্নেহের মেয়েটি,

         তুমি কে আমি জানি না। তুমি কেন আত্মহত্যা করতে চাইছিলে তাও আমি জানি না। আমি মাছ মেরে ফিরে আসবার সময় তোমাকে দেখে তিনবার চেঁচালাম। তুমি যাই হোক, দৌড়ে এলে। অচেতন অবস্থাতে তোমাকে নিয়ে এলাম।এখন তুমি আমার বাড়িতে থাকতে  পারবে। আমি ভোরবেলাই টুনা মাছ ধরতে বেরিয়ে এসেছি। থাকতে পারছি না বলে দুঃখিত, ক্ষমা করবে। যার কাজে মতি থাকে তার অন্য ভাবের দরকার পড়ে না। তুমি যেই হও আমার উপর সম্পূর্ণ নির্ভর করে চলতে পারবে। মরবার ভাবনা মনে আনবে না। জেলে হয়ে জন্মালে বুঝতে, সাগরে মাছ ধরতে সহজ, কিন্তু মাছ মারা কঠিন। মানুষ সহজে মরতে পারে। বেঁচে থাকাই কঠিন। আমার বড্ড দেরি হচ্ছে, আমি যাই। আজ সাগরে যেতে হবে।

                          ইতি                

একজন জেলে

 

          এই অচেনা মানুষটির অদ্ভুত ব্যবহার দেখে সে অবাক ও মুগ্ধ হল। যখন তার সমস্ত আশাই শেষ হয়ে এসেছিল, তখন তার জন্যে একমুঠো আশা নিয়ে এসে উপস্থিত হয়েছে একটি মানুষ : মানুষ সহজে মরতে পারে, কিন্তু  বেঁচে থাকাটাই কঠিন।

      কিছুক্ষণ চুপচাপ পড়ে থেকে সে উঠল, বাইরে বেরিয়ে গেল। বেরিয়ে গিয়ে রাজপথে পা দিতেই  মাইক একটার থেকে কিছু কথা ভেসে আসছে শুনে সে দাঁড়াল।

         “নাগাসাকির প্রসিদ্ধ অভিনেতা সুজুকির মৃত্যু হল। হাইড্রোজেন বোমার তেজস্ক্রিয় ছাই তাঁকে তেজস্ক্রিয় করে মারল। এই খবর পেয়ে তাঁর ভাবি পত্নী ফুমিকো নরহরা সাগরে গিয়ে আত্মহত্যা করেছেন বলে জনগণের সন্দেহ হয়েছে। উপায় নেই। বৃহৎ শক্তিগুলো যদি মারাত্মক বোমা বানানো বন্ধ না করে, তবে পৃথিবীতে মানুষের অবশেষটুকুও থাকবে না। পৃথিবীর বিবেক জাগাবার সময় হল। বিবেক না জাগলে মানুষের সভ্যতা সংস্কৃতি থাকবে না। আমাদের হয় এটম-হাইড্রোজেন বোমা ধ্বংস করতে হবে, নয় নিজেরা ধ্বংস হতে হবে।

         নাগরিকেরা মন স্থির করুন। পৃথিবী থেকে যুদ্ধ আর অস্ত্রকে নির্বাসিত করতে হবে। সেই সঙ্গে একটি অনুরোধ, ফুমিকো নরহরার সন্ধান যদি কেউ পান, আমাদের জানাবেন। কাকিমারা বড় উদ্বেগে আছেন। ফুমিকো নরহরা যদি কোথাও বেঁচে আছেন, তবে তাঁকে আমাদের সমবেত সমবেদনা জানাচ্ছি আর অনুরোধ করছি মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসুন।”

         ফুমিকোর পা থেমে গেল। খানিক্ষণের জন্যে। এবারে ওর চেঁচিয়ে উঠতে ইচ্ছে হল, “ আমি! আমি! ফুমিকো নরহরা! আমি বেঁচে আছি। বেঁচে থাকব!”

         রাজপথের বক্তার কাছে গিয়ে নিজেকে ধরা দেবার ইচ্ছে হল ওর। কিন্তু ইতিমধ্যে মাইক বহুদূর চলে গেছে। তার উপর জেলেটি এখনও ফিরে আসেনি।

      কাছের চায়ের দোকানের দেয়ালে ওর নজর গেল। দেয়াল থেকে বুদ্ধ হাসছেন।

      অবশেষে ওর মনে ঘুরে এল শান্তি।

*** ***

 

      আগের মতো এখনও হাসিটি ওকে পুরো কথা বলেনি। শুধু তার আভাস এখন স্পষ্ট হয়েছে। কম হলেও সেই আভাস ফুটে উঠেছে রাজপথের বক্তার মুখে। রাজপথে মানুষ জেগেছে। সে নতুন ভাষাতে কথা বলছে। মানুষ বুঝতে পারছে। হ্যাঁ, প্রলয়ঙ্কর বোমা ধ্বংস হতেই হবে, নয় নিজেদের ধ্বংস হতে হবে। কাকিমার মতো ওরা বলেনি, “ভেবে ভেবে জীবনকে ভারী করে লাভ কী? ভাবনাকে ছুঁড়ে ফেলাই ভালো।” কাকিমার মতে, মানুষ মরা ডালে বসে গান করা পাখি। ডাল যখন ভাঙবেই গান গেয়ে কী লাভ? অচেনা জেলেই তাঁর থেকে আশাবাদী, তার মতে বেঁচে থাকতে হলে সংগ্রাম করতেই হবে। গভীর জলে মাছ মারতেই হবে। কিন্তু সে নিজের জীবনের বাইরে অন্যের জীবনের কোনো সমাধান দিতে পারে না। সে বলছিল, “বেঁচে থাকো।” ফুমিকো নরহরা বেঁচে থাকবার পথ এবং সার্থকতা কোথায় –ভেবে বের করতে পারেনি। বের করে দিল রাজপথের বক্তাটি। মানুষ তাকে ভুলেনি। সুজুকিকে স্মরণ করছে। এরা মানুষ মারা বোমা চায় না, মৃত্যু চায় না, চায় জীবন।

      রাজপথের মানুষটি ওর অচেনা। কিন্তু সেই ফুমিকোকে প্রকৃত জীবনের সন্ধান দিয়েছে। মানুষ বেঁচে থাকতে চাইছে। মানুষ মানুষের কথা বলছে। মানুষ মানুষকে বলছে, বেঁচে থাকতে। সে বেঁচে থাকবে। সে মানুষের জন্যে বেঁচে থাকবে। মানুষ শান্তির জন্যে অনেক আশা নিয়ে অভিযানে নেমেছে। বোমাকে মানুষ অভিশাপ দিচ্ছে। মানুষ বলছে, শান্তি চাই।

          বাবা-মা-স্বামীকে হারাবার পরেও সে সব কিছু হারাল না। ‘ওয়াবি’র মধ্যে ফুটে উঠেছে আশার বাণী। মানুষের অন্তরে করুণার উদ্রেক হয়েছে।  জেলে মানুষটি আর সেই মাইকে কথা বলা লোকটি তারই সাক্ষী।

           ফুমিকো নরহরা ঠিক করল, সে বেঁচে থাকবে।

 

 

১৯৫৩  সন; কলং আজিও বয়
Tags: অনুবাদগল্পসুশান্ত কর
Previous Post

সঞ্জয় চক্রবর্তী

Next Post

আয়নামহল

Daruharidra

Daruharidra

Next Post
আয়নামহল | তৃতীয় সংখ্যা

আয়নামহল

Leave a Reply Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

No Result
View All Result

RECENT POSTS

মেখলা পরা মেয়ে || শ্রীযুধাজিৎ || অন্তিম পর্ব

মেখলা পরা মেয়ে || শ্রীযুধাজিৎ || অন্তিম পর্ব

15/04/2022

সঞ্জয় চক্রবর্তী || অন্তিম পর্ব

09/04/2022
মেখলা পরা মেয়ে || শ্রীযুধাজিৎ || দ্বাবিংশতি পর্ব

মেখলা পরা মেয়ে || শ্রীযুধাজিৎ || দ্বাবিংশতি পর্ব

08/04/2022

সঞ্জয় চক্রবর্তী || নবম পর্ব

02/04/2022
মেখলা পরা মেয়ে || শ্রীযুধাজিৎ || একবিংশতি পর্ব

মেখলা পরা মেয়ে || শ্রীযুধাজিৎ || একবিংশতি পর্ব

01/04/2022

সঞ্জয় চক্রবর্তী || অষ্টম পর্ব

27/03/2022
মেখলা পরা মেয়ে || শ্রীযুধাজিৎ || বিংশতি পর্ব

মেখলা পরা মেয়ে || শ্রীযুধাজিৎ || বিংশতি পর্ব

25/03/2022
সঞ্জয় চক্রবর্তী || সপ্তম পর্ব

সঞ্জয় চক্রবর্তী || সপ্তম পর্ব

20/03/2022
মেখলা পরা মেয়ে || শ্রীযুধাজিৎ || উনবিংশতি পর্ব

মেখলা পরা মেয়ে || শ্রীযুধাজিৎ || উনবিংশতি পর্ব

18/03/2022
ষষ্ঠ পর্ব || সঞ্জয় চক্রবর্তী

ষষ্ঠ পর্ব || সঞ্জয় চক্রবর্তী

13/03/2022

RECENT VIDEOS

https://www.youtube.com/watch?v=77ZozI0rw7w
Daruharidra

Follow Us

আমাদের ঠিকানা

দারুহরিদ্রা
কুঞ্জেশ্বর লেন
(বরাকভ্যালি একাডেমির নিকটবর্তী)
নতুন ভকতপুর, চেংকুড়ি রোড
শিলচর, কাছাড়, আসাম
পিন-788005

ডাউনলোড করুন

সাবস্ক্রাইব

Your E-mail Address
Field is required!
Field is required!
Submit
  • আমাদের সম্পর্কে
  • লেখা পাঠানো
  • যোগাযোগ

Copyright © All rights reserved Daruharidra | Development by Prosenjit Nath

No Result
View All Result
  • ধান্যগৃহ
  • কবিতা
  • গল্প
  • গদ্য
  • প্রবন্ধ
  • উপন্যাস
  • সাক্ষাৎ পাতা
  • অনুবাদ পাতা
  • আর্কাইভ
  • আমাদের সম্পর্কে
    • লেখা পাঠানো
    • যোগাযোগ

Copyright © All rights reserved Daruharidra | Development by Prosenjit Nath