পর্ব-২
টিআরটিসি। ত্রিপুরা সড়ক পরিবহণ নিগম। লাল আর ক্রিম কালারের লম্বা এই বাসগুলো দেখলেই আমার গা গুলিয়ে উঠত। দূরপাল্লার জার্নিতে বমির ভয়ে মা-র শরীরে মাথা গুঁজে ঘুমিয়ে পড়ার চেষ্টা করতাম। কীসের ঘুম? পাহাড়ি আঁকাবাঁকা রাস্তা শুরু হতেই শরীরের অস্থিরতা শুরু হয়ে যেত। একসময় পিত্ত বেরিয়ে আসত। জ্বালা জ্বালা করত গলা। সেদিন আর কোনো খাওয়াই গলা দিয়ে নীচে নামত না।
হালাহালিতে নেমে দেখি বেশ কয়েকজন রিকশাচালক সওয়ারির অপেক্ষায়। অদ্ভুত ব্যাপার, একটি রিকশারও হুড নেই! হুডখোলা রিকশা আগরতলা কোথাও দেখতে পাওয়া যায় না। বাবা দুটো রিকশা ডাকলেন। মালপত্রসমেত আমরা রিকশায় উঠলাম। গন্তব্য চল্লিশ ফুট। মানিক দেবের বাড়ি। ফাঁকা রাস্তা। প্রায় প্রতিটি বাড়ির সামনেই বড়ো বড়ো পুকুর। বেশ কিছুদূর যাওয়ার পর রাস্তার দুপাশে বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে রাইসরিষার খেত হলুদ হয়ে আছে। মুজিব ইরমের কবিতার মতো। “ড্যাফোডিলের খেতকে কেন রাইসর্ষে ভাবো।” একটা ছোট্ট পাকা সাঁকো পেরিয়ে রিকশা থামল। বড়ো রাস্তার পাশেই ডানদিকে একটি বাড়ি। এই হচ্ছে বাবার কাকা মানে আমাদের মানিক দাদুর বাড়ি। বয়সে বাবার ছোটোই হবেন। হালাহালি সিলেটি প্রধান এলাকা। কিন্তু মানিক দাদুর মা অর্থাৎ বড়মার কথায় খাঁটি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার টান। বাড়ির লোকজন এত আন্তরিক, কীভাবে যে এক সপ্তাহ কেটে গেল সে বাড়িতে টেরই পেলাম না। সব মফস্বলেই বোধহয় মানুষের এত মায়া।
সারাদিনে কমলপুর থেকে আগরতলাগামী আর আগরতলা থেকে কমলপুরের দিকে ৫/ ৬ টি টিআরটিসি বাস, আমবাসা ও কমলপুরের মধ্যে চলাচলকারী কয়েকটি জিপগাড়ি আর স্থানীয় রিকশা ছাড়া বাকি সময় রাস্তাঘাট নিরিবিলি। শুনসান। এই একসপ্তাহে পিরের থানে গেলাম। পিরকে পাওয়া গেল না। পিরকে নিয়ে বেশ কিছু অবিশ্বাস্য গল্প শোনালেন দিদা, মানে মানিক দাদুর স্ত্রী। আরেকদিন পাশের বাড়ির গোবিন্দ, প্রায় আমারই সমবয়সি, খিরাইয়ের খেত দেখাবে বলে আমাকে নিয়ে গেল। ব্যাটার মনে মনে যে অন্যের খেত থেকে খিরাই চুরির মতলব কে জানত! কয়েকটা খিরাই চুরির পরই মালিকের তারস্বরে চিৎকার। ঔ ধরো রে ধরো, খিরাই চুরি করিয়া নেরগি। প্রাণ হাতে করে ফিরে এলাম। ধরা পড়লে কী কেলেংকারিই না হত! হেডমাস্টারর পুয়া খিরাই চোর! আর কোনোদিন অবশ্য গোবিন্দর সঙ্গে কোত্থাও যাইনি।
এরমধ্যে বাবার সঙ্গে একদিন কমলপুর গেলাম বাবার বন্ধু অসুস্থ কানু মজুমদারকে দেখতে। কানু মজুমদার একসময় গোটা মহকুমায় মস্তান হিসেবে পরিচিত ছিলেন। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী সুখময় সেনগুপ্তের খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন বলে শুনেছি। পরে ধর্মে কর্মে মতি হয়। আমি নিজেও ছোটোবেলায় কানু জেঠু এসছে শুনলেই খাটের তলায় লুকিয়ে পড়তাম ভয়ে। দীর্ঘদেহী, স্বাস্থ্যবান, বাজখাঁই গলার মানুষটি আজ শয্যাশায়ী আর আমি বাবার সঙ্গে জেঠুকে দেখতে এসছি ভাবতেই মনে হল, আর ছোট্টটি নেই আমি। বেশ বড়ো হয়ে গেছি।
আরেকদিন বাবার সঙ্গে হালাহালি বাজারে গেলাম। মানিক দাদুদের বাসনের দোকানে বসলাম। বেশ বড়ো বাজার। বাজার থেকে ধলাই নদী খুবই কাছে। গোরুবাজারের পরই নদী। সপ্তাহে দুদিন বাজারবার। রবি ও বৃহস্পতি। দূর দূর গ্রাম থেকে ক্রেতা বিক্রেতারা আসে। চানকাপ, দেবীছড়া, বামনছড়া, মহাবীর চা বাগান, লুৎমা, পশ্চিম হালাহালি, অপরেস্কর, নাকাসিপাড়া, ফুরাইছড়া, এরার পার, আরও দূর দূর থেকে লোকজন আসে। যদিও তখনো ভরতি হইনি, একদিন স্কুলেও গেলাম। ক্লাস এইটের কয়েকটি ছেলেমেয়ে এগিয়ে এল। হেডমাস্টারের ছেলে। সবারই কৌতূহল। এর মধ্যে একটি মণিপুরি ফর্সা মেয়ে এসে আমাকে জিজ্ঞেস করল, তর নাম কী লো? মুহূর্তের জন্যে একটু ধাক্কা খেলাম। মেয়েটি আমার সহপাঠী মৃণালিনী সিনহা। মণিপুরিদের অনেকেই পদবি সিংহ না লিখে সিনহা লেখেন। আরেকটি ছেলে এগিয়ে এসে বলল, কত পাইছো সেভেনের অ্যানুয়ালে। অ্যাগ্রিগেট বলতেই বলল, ধুর, আমরার অভিজিৎ অনেক বেশি পাইছে। নিজেকে একটু অপ্রতিভ মনে হল বই-কি । সেই সহপাঠীর নাম বলাই।
অভিজিৎ সিংহ। হালাহালি স্কুলের ক্লাস এইটের ফার্স্ট বয়। আর আমি আগরতলার অভয়নগর উচ্চতর মাধ্যমিক স্কুলের ফার্স্ট বয়। অভিজিৎ হালাহালিতে নেই। সম্ভবত ডাক্তার দেখাতে আগরতলা গেছে। অভিজিতের বাবা আমাদের শিক্ষক। যোগেন্দ্র সিংহ। ইতিহাস পড়াতেন। সাদা ধুতি ও কলার দেওয়া পাঞ্জাবি পরতেন স্যার।
বাবার কাকা মানিক দেব বেশ সৌখিন। খেতে ও খাওয়াতে ভালোবাসতেন। এই একসপ্তাহ থাকাকালীন দুপুরে আমার কাজ ছিল, খাওয়া দাওয়ার পর মানিক দাদু বিছানায় শুয়ে পড়লে ঘুম না আসা পর্যন্ত দাদুকে উপন্যাস পড়ে শোনানো। কাজটি যে আমার মতো ক্লাস এইটের ছাত্রের কাছে খুব একটা সহজ ছিল তা নয়। যদিও আমি ক্লাস থ্রি থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে সুনীলের উপন্যাসে অভ্যস্ত। দাদুকে পড়ে শোনাতে শোনাতে নায়ক নায়িকার চুমু খাওয়া বা জড়িয়ে ধরার মুহূর্তে অনলাইন সেন্সর বোর্ডের কাঁচি চালিয়ে ঠিক সামলে নিতাম। শীতে কীর্তনের দলের মহড়া হত দাদুদের বাড়ির উঠানে। বাবরি চুল, দীর্ঘদেহী সূর্য সূত্রধর ছিলেন সেই দলের মুখ্য কীর্তনিয়া। শ্রীখোলবাদক। উনিশ কুড়ি বছরের দুটি মেয়েও গাইত নেচে নেচে ঘুরে ঘুরে। বাংলাদেশের বিভিন্ন লোকগানের সুরে ষোলো অক্ষর বত্রিশ নাম হরেকৃষ্ণ হরেকৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে গাইত সবাই। যেসব লোকগানের সুর ব্যবহৃত হত, সেগুলো ছিল সোনা বন্ধু তুই আমারে করলি রে দেওয়ানা/ মনে তো মানে না দিলে তো বোঝে না কিংবা যদি সুন্দর একখান মুখ পাইতাম, যদি মিষ্টি একখান মুখ পাইতাম, বাংলাদেশের পানের খিলি আমি তারে খাওয়াইতাম ইত্যাদি আরও অনেক গানের সুর। হিন্দি গানের সুরেও যে কীর্তনের মহড়া হত না তা নয়।
মানিক দাদুদের বাড়িতে এক সপ্তাহ থাকাকালীন তড়িঘড়ি আমাদের জন্যে মানিক দাদুর বন্ধু জুন্টু চৌধুরীদের বাড়িতে বাঁশের তরজার বেড়া, উপরে ছনের ছাউনি, একটি ঘর তোলা হল। পাশে লাগোয়া ছোট্ট একটি রান্নাঘর। হারাধন চৌধুরী জুন্টু নামেই বেশি পরিচিত। পুরোনো প্রভাবশালী ব্রাহ্মণ পরিবার হিসেবে গোটা মহকুমায় সবাই একডাকে চেনে এই চৌধুরী পরিবারকে। চৌধুরীরা চার ভাই। কালীপদ, হরিপদ, দুর্গাপদ, রাধিকাপদ। কালীপদ ও হরিপদ চৌধুরীর পাশাপাশি বাড়ি। কোনো বেড়া বা পাঁচিল নেই। একই উঠোন। দুর্গাপদ ও রাধিকাপদ একটু দূরে আলাদা আলাদা বাড়ি। কালীপদ সবার বড়ো। তিন মেয়ে তিন ছেলে। কথাসাহিত্যিক অরুণোদয় সাহার শ্বশুর হচ্ছেন কালীপদ। কালীপদ চৌধুরীকে আমি ও বোন বড়োবাবা ডাকতাম। আমরা হালাহালি যাওয়ার বেশ কয়েকমাস আগেই হরিপদ চৌধুরী প্রয়াত হয়েছেন। গোটা পরিবারই শোকাচ্ছন্ন। হরিপদ চৌধুরীর দুই ছেলে তিন মেয়ে। সবার বড়ো জুন্টুদা। ফিশারিতে চাকরি। ছোটো ছেলে মিন্টুদা পারিবারিক ব্যবসা সামলায়। তিন মেয়ে আভাদি, রেবাদি, ইভাদি। ইভাদি তখন আমার এক ক্লাস উপরে নাইনে পড়ত। রাধিকাপদ চৌধুরীর মেয়ে সত্তা ওরফে রিংকু আমার সহপাঠী।
লেখাটা টানছে ।
হুডখোলা রিকশা আগরতলা(র) …. ও রাধিকাপদ(র)…
চমৎকা ! বর্ণনায় এক জ্বলজ্বলে ছবি এঁকেছো।
ধারাবাহিকের ১মটি কোথায়?
এখানে পাবেন প্রথম পর্বটি
লিংকে ক্লিক করুন
https://daruharidra.com/2168/
চমৎকার
চল্লিশ ফুট জায়গার নাম ? দারুণ তো । পরবর্তী পর্বের অপেক্ষায় …..
ভালো লাগছে পড়তে। তৃতীয় পর্বে যাচ্ছি।