চার
বাবা বলে দিয়েছিলেন, স্কুলে গিয়ে সব স্যারদের প্রণাম করতে। একটু আড়ষ্ট লাগছিল। ছোটো বড়ো সব ক্লাসের ছাত্রছাত্রীরাই এসে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। হেডমাস্টারের ছেলে বলে কথা। রীতিমতো লজ্জাই লাগছিল। হালাহালি দ্বাদশ শ্রেণি বিদ্যালয় কোনো অংশেই রাজধানীর সম্ভ্রান্ত স্কুলগুলির চেয়ে কম কিছু নয়। গোটা মহকুমায় স্কুলের সুনাম রয়েছে। আমি হালাহালি স্কুলে ভরতি হওয়ার বছর কয়েক আগে বোর্ডে স্ট্যান্ড করেছিল এক মণিপুরি ছাত্রী। গুণমণি সিংহের মেয়ে স্বপ্না সিংহ। খুব সম্ভবত বোর্ডে নাইনথ হয়েছিল। প্রত্যেক বছরই কয়েকজন ফার্স্ট ডিভিশন পায় মাধ্যমিকে। ত্রিপুরা মধ্যশিক্ষা পর্ষদের মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় আগরতলার নেতাজি সুভাষ বিদ্যানিকেতন, শিশুবিহার স্কুল, উদয়পুর রমেশ স্কুলের পরীক্ষার্থীদের মধ্যে থেকেই বোর্ডে স্ট্যান্ড করত। কালেভদ্রে হয়ত মফস্বলের কোনো ছাত্র বা ছাত্রী ছিনিয়ে নিত রাজধানীর সেই মুকুট। সবচেয়ে বেশি স্ট্যান্ড করত নেতাজি স্কুল। সিক্স থেকে টেন, দুটি করে সেকশন। ইলেভেন ও টুয়েলভ একটি করে। সায়েন্স, কমার্স তখনো চালু হয়নি। শুধু আর্টস। ছেলেদের ইউনিফর্ম সাদা প্যান্ট আর আকাশি শার্ট। মেয়েদের গাঢ় নীল স্কার্ট আর শার্ট। অধিকাংশ ছাত্রছাত্রীরাই খালি পায়ে স্কুলে আসে। একটু দূরের ছাত্ররা বাইসাইকেল চালিয়ে আসে। আমাদেরও একটি বাইসাইকেল ছিল। বাবা সেটা নিয়ে এসছিলেন। ক্লাস এইট পর্যন্ত হাফ প্যান্ট। মেয়েদের নাইন থেকে শাড়ি। স্কুলের সময় ১১ টা থেকে চারটে কুড়ি।
ক্লাসের সহপাঠীদের অনেকের সঙ্গেই পরিচয় হল। মানবেন্দ্র। প্রশান্ত। মৃণাল। সজল। রমেন। প্রদীপ। অমলেন্দু। সঞ্জীব। কমলেশ। জয়দেব। কাজল। গকুল। গোপাল। বিদ্যুৎ। বিভাংশু। সত্তা। কবিতা। সন্ধ্যা। নির্মলা। বিজয়া। কৃষ্ণকুমার। প্রত্যুষ ওরফে চন্টু। মাধুরী। মীনা। কেউ একজন বলল, গকুল ও গোপাল, এই যমজ ভাইয়েরা দুজনেই গান গায়। দুজনেই বাঁশি বাজাতে পারে। শুনেই ভেতরটা কীরকম করে উঠল। ক্লাসের ছেলেরা এই দুই ভাইকে গকুলজি গোপালজি বলে ডাকে। কল্যাণজি আনন্দজির মতো। সজল বেশ মজার ছেলে। এমন সব অঙ্গভঙ্গি করে কথা বলে যে ওর দিকে তাকালেই হাসি পায়। কমলেশ নাকি ভালো আবৃত্তি ও নাটক করে। জয়শ্রী ভালো গান গায়। কে যেন বলল, জয়শ্রীদের বাড়িতে ওর মাও ভালো গান গায়। ওর মাসি শান্তি সিংহ আকাশবাণী আগরতলার আর্টিস্ট। অভিজিৎ তখনো আগরতলা থেকে ফেরেনি।
স্যারদের মধ্যে কয়েকজনের বাড়ি আগরতলায়। বায়ো সায়েন্সের রাজীব স্যার। সমীর স্যার। ইতিহাসের অমল স্যার। অমল স্যার অনেক আগে থেকেই আমাদের পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ। আমি অমল কাকুই ডাকতাম। খুব দূর থেকে সাইকেল চালিয়ে আসতেন প্রবোধ স্যার, সন্তোষ স্যার, অতীন্দ্র স্যার। প্রবোধ স্যার কমার্সের টিচার হলেও চমৎকার বাংলা পড়াতেন। সন্তোষ স্যার বাংলা পড়াতেন। আর অতীন্দ্র স্যার ইতিহাস। এঁরা তিনজনেই প্রায় দশ ১০/১২ কিলোমিটার সাইকেল চালিয়ে হারেরখলা ও মাণিকভাণ্ডার থেকে আসতেন। হরিপদ গোপ স্যারও প্রায় ৮/৯ কিলোমিটার সাইকেল চালিয়ে আসতেন। স্কুলে ও এলাকায় সবচেয়ে জনপ্রিয় গোপ স্যার। ব্যক্তিগত জীবনে কংগ্রেসি রাজনীতিতে সক্রিয় থাকলেও এলাকার সি পি আই এম সমর্থক কর্মী ও অভিভাবকদের কাছে খুবই প্রিয় ছিলেন ছাত্রদরদি মেধাবী শিক্ষক হিসেবে। বি এস সিতে ডিস্টিংশন ছিল গোপ স্যারের। গোপ স্যার ছাড়াও অঙ্ক ও ফিজিক্যাল সায়েন্স পড়াতেন পরিতোষ পাল। রাগী যুবক। আড়ালে সবাই ফিসফিস করত, পরিতোষ স্যার নাকি নকশাল রাজনীতি করেন। পরে পিউর সায়েন্সের টিচার অজিত সিংহ বদলি হয়ে এসছিলেন। খুব মাই ডিয়ার ছিলেন স্যার। হালাহালির স্থানীয় শিক্ষক বলতে যোগেন্দ্র স্যার। চিত্র সিংহ স্যার। সোহরাবউদ্দিন স্যার। স্যার খুব রসিক মানুষ ছিলেন। কিশোর সিংহ স্যার। রঞ্জিত স্যার। অধীর স্যার। মদন পাল স্যার। অধীর পাল স্যার। তারিণী স্যার বাংলা পড়াতেন। ভুলোমনের মানুষ ছিলেন তারিণী স্যার। অধীর ও সোহরাবউদ্দিন দুজনেরই রাজনৈতিক তৎপরতা ভিন্ন ভিন্ন হলেও দুজনের বন্ধুত্ব উদাহরণযোগ্য। কালাচাঁদ সিংহ স্যার। কালাচাঁদ স্যার ছিলেন আমাদের শারীর শিক্ষক। স্কুলে স্যারের রুমে খেলার আসর ম্যাগাজিনটি দেখে আশ্বস্ত হয়েছিলাম। পারুল দিদিমণি, একমাত্র শিক্ষিকা। পরে তপতী দত্তবিশ্বাস ও তপতী নাহাবিশ্বাস দিদিমণি বদলি হয়ে এলে শিক্ষিকা মোট তিনজন। তপতী নাহাবিশ্বাস রবীন্দ্রসংগীত গাইতেন। রবীন্দ্রনাথের প্রচুর গান তাঁর সংগ্রহে ছিল। পরে বদলি হয়ে এসেছিলেন ইতিহাসের স্যার মাজির আলি। সোহরাবউদ্দিন ও মাজির আলি স্যার ছিলেন মণিপুরি মুসলমান সম্প্রদায়ের। রাজীব ও সমীর স্যার দুজনেই বায়ো সায়েন্সের হলেও রাজীব স্যারের প্রাইভেট টিউশনে ছাত্রছাত্রী বেশি ছিল। শিক্ষকদের প্রাইভেট টিউশন নিয়ে তখন সরকারি বিধিনিষেধ ছিল না। সংস্কৃতের পণ্ডিত স্যারের বাড়ি সোনামুড়ার মেলাঘরে। সপরিবারে ভাড়া থাকতেন। সোনামুড়া থেকে এসছিলেন ইতিহাসের রতন দেবনাথ স্যার। খুব ভালো হাওয়াইন গিটার বাজাতেন। ব্যাডমিন্টনে রাজ্যের হয়ে খেলেছেন বেশ কয়েকবার। সোনামুড়াতে রতনস্যারদের একটি সিনেমাহল ছিল। কামিনী টকিজ। স্যারের গিটারে হিন্দি ফিল্মের গানের সুর শুনে হালাহালির উঠতি কয়েকজন যুবক হাওয়াইন গিটার কিনেও ফেলেছিল স্যারের কাছে গিটার শেখার জন্যে। শিক্ষকদের মধ্যে ধুতি পাঞ্জাবি পরতেন বাবা, যোগেন্দ্র স্যার, চিত্র স্যার, অতীন্দ্র স্যার, তারিণী স্যার আর পণ্ডিত স্যার।
সপ্তাখানেকের মধ্যে টের পেয়ে গেলাম আমার বাবা অর্থাৎ প্রধানশিক্ষকসহ কয়েকজন শিক্ষকের একটি করে কোডনেম আছে। এটা বোধহয় বাঙালি ছাত্রছাত্রীদের বৈশিষ্ট্য। কোন শিক্ষকের কী নাম ছাত্রছাত্রীদের মুখে মুখে ফিরত তা আমি লিখব না। তবে নামগুলো ছিল, জামাই অর্থাৎ বর। কটা । সিলেটিতে কটা মানে কাঠবিড়ালি। ত্রিপুরায় চলা বা চলই বলা হয় কাঠবিড়ালিকে। ইন্দুর। কদু মানে লাউ। ড্রাইভার। তখনো ধলাই নদীর কাছে যাইনি। দেখিনি তার উল্টো ধারা। স্কুল থেকে ফেরার পথে সহপাঠী মৃণাল ওরফে পঞ্চুদের বাড়ির কাছ থেকে লংতরাইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। সহপাঠী ও বন্ধু সঞ্জীব বলেছিল, লংতরাইয়ের চূড়ায় দাঁড়ালে কৈলাসহরের বাজার দেখা যায়। কৈলাসহর তৎকালীন উত্তর ত্রিপুরার মহকুমা। কৈলাসহর দিয়ে বয়ে গেছে মনু নদী। এর আগের নাম ছিল কৈলার গড়। একসময় ছাম্বুল নগর নামেও পরিচিত ছিল অধুনা কৈলাসহর। এখানেই ঊনকোটি তীর্থ। পাথরের পাহাড়ের গায়ে খোদাই করা ভাস্কর্য। এই ঊনকোটি নিয়ে পৌরাণিক গল্পও রয়েছে। সঞ্জীবের কথা শুনে আমি আরও আচ্ছন্ন হয়ে পড়তাম দূরের লংতরাই পাহাড়ের অস্পষ্ট নীলিমায়।
অভিজিৎ আগরতলা থেকে ফিরে এসছে। পরিচয় হল। ফর্সা, হাসিখুশি এক নিষ্পাপ লাজুক মুখ। আপাদমস্তক ধারালো। দেখেই বোঝা গেল, এই ছেলে মেধাবী না হয়ে যায় না। ক্লাসে ও বাইরে সঞ্জীবের সঙ্গেই বেশ বন্ধুত্ব গড়ে উঠল। সঞ্জীব দাস। বাবা খগেন্দ্র দাস হালাহালি বাজারের বেশ বড়ো ব্যবসায়ী। বাজারের পেছনেই বাড়ি। সঞ্জীবের দাদা অঞ্জন আমাদের দুই ক্লাস সিনিয়র। মেধাবী ছাত্র। খগেন্দ্র দাসের বিশাল মুদি দোকান। আমাদের পারিবারিক মাসের বাজার খগেন্দ্র দাসের দোকান থেকেই নেওয়া হত। খগেন্দ্র দাস বেশ কেতাদুরস্ত। আমাকে ডাকতেন প্রদ্যোৎ। অনেকেই আমাকে কেন যেন সঠিক নামে ডাকত না। কেউ প্রদ্যোৎ, কেউ প্রদ্যুম্ন, কেউ প্রবুদ্ধশঙ্কর। ক্লাস ইলেভেনে আগরতলার নেতাজি স্কুলের টিচার গোপালবাবু আমাকে ডাকতেন প্রভুবন্ধু।
আস্তে আস্তে সঞ্জীব আমার প্রিয় বন্ধুদের একজন হয়ে উঠল। ছুটির দিনে ঠা ঠা রোদে দুপুরে বেরিয়ে পড়তাম। প্রথম যেদিন দুপুরে সঞ্জীবকে ডেকে নেওয়ার জন্যে ওদের বাড়ি যাই, খগেন্দ্র দাস সঞ্জীবকে তো ছাড়লেনই না, উল্টে আমাকে বিকেল ৫ টা অব্দি বসিয়ে রাখলেন। রাগে ফেটে পড়ছিলাম ভেতরে ভেতরে। সিদ্ধান্ত নিলাম, ছক পাল্টাতে হবে। আমি পাল্টানোর আগেই সঞ্জীব পরদিন স্কুলে গিয়ে বলল, ছুটির দিনগুলোতে বাবা ঘুমিয়ে পড়লেই আমি দুপুরে বেরিয়ে আসব। মনে মনে বললাম, শাব্বাস, এই না হলে বন্ধু! ক্লাস সেভেন পর্যন্ত আমিও দুপুরে মা শুয়ে পড়লে টেবিল টেনে ছিটকিনি খুলে খেলতে বেরিয়ে পড়তাম। সেদিন সঞ্জীব আমাকে ওদের বাড়ির পাশেই একটি ইটের পাঁজায় সদ্য ডিম ফুটে বেরোনো কয়েকটি জালালি কবুতরের বাচ্চা দেখিয়েছিল। কদিন পরে ছানাগুলোকে আর পাইনি।
৫.
অবশেষে একদিন পঞ্চুদের বাড়ির লাগোয়া প্রাইমারি স্কুলের নীচের মাঠ পেরিয়ে ধলাই নদী। ওই পারে দেবীছড়া। ধলাই কমলপুর মহকুমার একমাত্র নদীপ্রবাহ। লংতরাই পাহাড়শ্রেণি থেকে ধলাই নদীর উৎপত্তি। উত্তরবাহিনী এই নদী আঠারোমুড়া ও লংতরাই পাহাড়শ্রেণির মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে কমলপুর সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশের কুলাউড়া উপজেলার মনুরমুখে মনুনদীতে মিশে শেষে কুশিয়ারায় গিয়ে পড়েছে। তেইশটি জলবিভাজিকাযুক্ত ধলাই অববাহিকার যে অংশটি ভারতে রয়েছে এর আয়তন ৬৭৮.১৩৬ বর্গ কিলোমিটার। ত্রিপুরার অধিকাংশ নদী বৃক্ষরূপী জলনির্গমন প্রণালী তৈরি করে, যার অর্থ প্রবাহিত নদীগুলোর যৌবন পর্যায়। নদী অববাহিকার উচ্চতা ১৬ মিটার থেকে ৪৯৮ মিটার পর্যন্ত। এখানে ধাপযুক্ত পাহাড়, ক্ষয়জাত পর্বত, সংকীর্ণ উপত্যকা অঞ্চল, তরঙ্গায়িত সমভূমি ও প্লাবনভূমি ইত্যাদি ভূমিরূপ দেখতে পাওয়া যায়। অববাহিকাটি মূলত ক্ষয়প্রাপ্ত বেলেপাথর, শেলপাথর, সিল্ট ও পলি দিয়ে গঠিত। ধলাইয়ের ছোট্ট মোহনা আমবাসা পেরিয়ে কুলাইবাজারের পূর্বদিকে যেখানে চান্দ্রাইছড়া ও ধনচন্দ্রছড়া একসঙ্গে মিলিত হয়েছে। এই চান্দ্রাইছড়ার উৎস লংতরাই পাহাড় আর ধনচন্দ্রছড়ার উৎস আঠারোমুড়া।
ক্রমশ…
অবাক করে দেওয়া স্মৃতি। পরের পর্বের অপেক্ষায় রইলাম।
চতুর্থ পর্বের অপেক্ষায় ছিলাম। দারুণ লাগছে।