পর্ব ৫
জানুয়ারি মাস। শীতের ধলাই নদীতে জল খুবই কম। পারাপারের জন্যে নদীর দুই পারে খুঁটি পুঁতে কাছি বাঁধা। মাঝি না থাকলেও লোকেরা নিজেরাই কাছি ধরে ধরে নৌকাকে এগিয়ে নিয়ে পারাপার করতে পারে। ভাবতাম, ওইপারে দেবীছড়া পেরিয়ে লংতরাইয়ের পাদদেশে পৌঁছতে কতক্ষণ সময় লাগতে পারে? আমি আর সঞ্জীব কি খুব সকাল সকাল একদিন রওয়ানা হয়ে লংতরাই দেখতে যাব? পাহাড়ের ঘন জঙ্গলে কি বাঘ আছে? অজগর? ভালুক?
জুন্টু চৌধুরীদের বাড়ির পাশেই বেশ কয়েকঘর মণিপুরি বসতি। পদ্মাবতী সিংহদের বাড়ি। দাদা শশীমোহন। আরও তিনভাই। সুখো, সুখেন, নগেন। পদ্মাবতীর মা সকালে ঢেঁকিতে চিড়া কুটে। লাল লাল চিড়া। ওদের বাড়ি থেকেই আমরা চিড়া কিনতাম। শশীমোহনের দর্জির দোকান হালাহালি বাজারে। পদ্মাবতী আমাদের এক ক্লাস উপরে। বাকি তিনভাই স্কুলে পড়ে। সবচেয়ে ছোটো নগেন তখন প্রাইমারিতে পড়ে। বেশ বিটলা ও ক্লাউন টাইপের। আমাদের ক্লাসে যেমন সজল দত্ত। এ ধরনের কমেডিয়ান ছেলেদের হালাহালিতে বাটপার বলে। আমি একটু অবাকই হয়েছিলাম কারণ ত্রিপুরায় বাটপার শব্দের আরেকটি অর্থ হচ্ছে টাউট। অসাধু। নগেনের মুখে অদ্ভুত অদ্ভুত ছড়া। আমাদের ঘরের পেছনের বাড়িতে মুন্দ সিংহ। মুন্দ খুব মৃদঙ্গ বাজায়। প্রায় রাতেই নেশা করে ঘরে ফেরে। ফিরে একটু হইচই করে খেয়ে শুয়ে পড়ে। মুন্দ সিংয়ের বৌ তম্বি পিঠে দোলনার মতো করে পাছড়া বেঁধে বাচ্চা শিশুটিকে ঝুলিয়ে ঘরের ও বাইরের কাজ করত। নগেনদের বাড়ির উঠোন পেরিয়ে ইরাবতীদের বাড়ি। ইরাবতী আমাদের সিনিয়র। আরেকটু এগিয়ে সহপাঠী মৃণালিনীদের ঘর। যখনই উঠোনের পর উঠোন পেরিয়ে ওইদিকে যেতাম, সহপাঠী মৃণালিনীর পড়ার সুর ভেসে আসত। ওদের উল্টোদিকেই আমার জুনিয়র রঞ্জিতদের ঘর। রঞ্জিতের চেহারায় দাদু দাদু ছাপ আছে বলে সবাই ওকে রঞ্জিত বুড়া ডাকত। ওকে দেখলে সবাই বলত, রঞ্জিত বুড়া রঞ্জিত বুড়া পে পে ঢং ঢং। ও কিন্তু রাগ করত না। উল্টে ও আমাদের সঙ্গে গলা মিলিয়ে বলত, পে পে ঢং ঢং। মৃণালিনীদের বাড়ির বাঁয়ে পরপর দুটো বাঙালি পরিবার। ডানদিকে কিছুটা পথ গিয়ে কুঞ্জমালাদের বাড়ি। সান্ত্বনাদের বাড়ি। সান্ত্বনার বাবা বৃন্দে সিংহকে নিয়ে একটি মজার কাহিনি আছে। ছোটোবেলায় স্কুলে পড়ার সময় ক্লাসে একদিন শিক্ষক বৃন্দে সিংহকে প্রশ্ন করেছিলেন, মুলা বানান করো। বৃন্দে উত্তর দিয়েছিল, মু লা। মুলা। সেদিন শিক্ষকের পিটুনি খেয়ে বৃন্দে সিংহ আর স্কুলের পথ মাড়ায়নি। দুজনেই আমার সহপাঠী। তারপর নমিতাদের বাড়ি। এর একটু দূরে কণা শব্দকরের বাড়ি। এই পদবি প্রথম শুনেছিলাম। শব্দকরদের ডোকলা বলা হয় আড়ালে। এরা বাঙালি সমাজে অন্ত্যজ শ্রেণির। ইভাদিদের উঠোনের পর বড়োবাবাদের উঠোন পেরিয়ে মণিপুরিদের ব্রাহ্মণ কৃষ্ণ শর্মাদের ঘর। বাড়িতে বিশাল মণ্ডপ। নিত্য ঠাকুর পূজা হয়। একটি ঢেঁকিঘরও আছে। শর্মাকে আমরা ঠাকুর বলে ডাকতাম। আর শর্মার বৌকে ঠাকুরাইন। দুই ছেলে। রাধাবিনোদ বাইরে আর্মিতে চাকুরি করত। রাধাকিশোর স্কুলে আমাদের সিনিয়র। তিন মেয়ে। কামিনী। লক্ষ্মী। সতী। লক্ষীদি অ্যাথলেটিকসে ন্যাশনাল প্লেয়ার। কামিনীদি খুব ভালো গান গাইত মণ্ডপের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে। সতী আমাদের জুনিয়র। কৃষ্ণ ঠাকুরদের ঢেঁকিতে লংকা, তেঁতুল বা বরই দিয়ে কাঁঠাল গাছের মুছি পিষে কত যে ভর্তা খেয়েছি। মণিপুরি প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই ঢেঁকি আছে।
জুন্টুদাদের বিশাল বাড়ি। বাড়ির সামনে শরিকি যৌথ পুকুর। একদিকে পাকা সিঁড়ি। অন্যদিকে কাঠের। তুমুল সাঁতার কাটতাম সেই পুকুরে। পুকুরের সামনে বেশ বড়ো বালোয়ারি স্কুল। সিমেন্ট বাঁধানো কয়েকটি বসার জায়গা। এই স্কুলের মাদার মহিলা বাড়ি বাড়ি ছোটো ক্লাসের বাচ্চাদের পড়াতেন। পুতুকে পড়ানোর জন্যে মহিলাকে রাখা হল। মহিলার নাম আজও জানি না। কুমুদবুড়ির মা বললে সবাই চিনত। তিনি কোনোদিনই নাকি আগরতলা দেখেননি। হালাহালিতেই প্রথম শুনি মণিপুরি ও বাঙালি শিশু কিশোরদের ছড়া কেটে কেটে পারস্পরিক খুনশুটি।
কোনো বাঙালি ছেলে মণিপুরি ছেলেকে খেপানোর জন্যে ছড়া কাটত—
মণিপুরি দাদি
চিড়া খাইয়া পাদি
চিড়া নাই ঘরো
শুটকি খাইয়া মরো।
মণিপুরি ছেলেটিও ছেড়ে কথা বলত না। সেও পাল্টা জবাব দিত—
বাঙ্গালি কাঙ্গালি
পুঁটিমাছের তেল
আনা তেলে ভাজা খায়
মণিপুরি পেল।
আনা তেলে মানে বিনা তেলে। আর পেল শব্দটির অর্থ শিশ্ন। এ ধরনের ছড়া আমরা পদ্মাবতীর ভাই নগেনের মুখে বেশি শুনতাম। যেমন—
ঘাটের উপর চিংড়ি পোনা
কানি বগায় খায়
তাই দেখে কুঞ্জবাবু
পল লইয়া যায়।
২৬ জানুয়ারি প্রজাতন্ত্র দিবসে আমাদের স্কুল থেকে শোভাযাত্রা বেরোয়। আগরতলাতে ২৩ জানুয়ারি একমাত্র নেতাজি স্কুল থেকেই বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা বেরোয় প্রত্যেক বছর। ওই একটি দিন শহরে প্রচুর ভিড় হয়। হালাহালি স্কুল থেকে প্রজাতন্ত্র দিবস উপলক্ষ্যে শোভাযাত্রায় গান্ধিজিকে দেখে চমকে উঠেছিলাম। এত জীবন্ত কী করে হয়? আমাদের উপরের ক্লাসের কৃপাময় দত্ত। বীণাদিকে নেতাজি সাজানো হয়েছিল। তবে নেতাজি ঘোড়ার উপরে নন। একটি দুই চাকার ঠেলাগাড়িতে। আর সেই ঠেলার দুটো হাতল ধরে ব্যালেন্স রেখে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছিল আমাদের সিনিয়র ষণ্ডামার্কা বিচিত্রদা। বীণাদি খুব ভালো আবৃত্তি করত বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়। আমি ভরতি হওয়ার পর থেকে বীণাদির প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠলাম। জানুয়ারি মাসের মধ্যেই গোটা স্কুল, এমনকি হালাহালিই আমার নিজের হয়ে উঠল। মাঝে মাঝে আগরতলায় ফেলে আসা বন্ধুদের জন্যে মন কেমন করত বই-কি। বাল্যবন্ধু অনুপমের সঙ্গে পোস্টকার্ড চালাচালি।
আস্তে আস্তে বাইসাইকেল শিখতে শুরু করলাম। হাফপ্যাডেল। প্রথমদিকে খুবই অসুবিধে হত। কয়েকমাস শুধু হাফপ্যাডেল। বাবা বলতেন, যে-কোনো যানবাহন চালাতে গেলে দূরে চোখ রাখতে হয়। এতে নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা বেড়ে যায়। একদিন সাহস করে ঠাকুর ঠাকুর বলে ফুলপ্যাডেল। সিটে বসে মনে হল, শৈশবে দেখা সার্কাসের সেই বিশাল উঁচু এক চাকার সাইকেলের সিটে যেন চেপে বসেছি। বুক দুরু দুরু। প্যাডেল পায়ে ঠেকে তো আবার কোথায় যেন হারিয়ে যায়। এই করে করে আরও সপ্তাহ দুয়েক লাগল। এরপর থেকে তো বাইসাইকেলের নেশা চেপে বসল। দিকবিদিকে সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়তাম। দূর থেকে কোনো টিচারকে আসতে দেখে সাইকেল থেকে নেমে গিয়ে যে সম্মান দেখানো, এটা আমি হালাহালিতেই শিখেছি। একে একে সরস্বতী পূজা, অ্যানুয়েল স্পোর্টস। প্রাইজ গিভিং, শিক্ষক- অভিভাবক দিবস হয়ে গেল। স্কুলও পুরোদমে। খেলার নেশা থাকলেও খুব ভালো খেলোয়াড় আমি ছিলাম না। কিন্তু নেশা ছিল তীব্র। কালাচাঁদ স্যার খেলার আসর নিয়মিত পড়তে দিতেন। পড়ার নেশা আমার তিন বছর বয়স থেকে। রোজ দুপুরে কিছু না কিছু না পড়লে আমার ঘুমই আসত না। বই পড়া নিয়ে জীবনে কম অপমানিত হইনি। সহপাঠী জয়শ্রীদের বাড়িতে আনন্দমেলা আসত প্রতি মাসে। তখন আনন্দমেলা ছোটো সাইজের। প্রতি মাসেই ওদের পড়া হয়ে গেলে নিয়ে আসতাম। যে ক’টি ডোমেস্টিক লাইব্রেরি আমার জীবনে পেয়েছি, কালীপদ চৌধুরীদের বাড়ির লাইব্রেরি সেগুলোর একটি। তিন মেয়ে ও তিন ছেলের সবাই পড়ুয়া। মেজো মেয়ে মঞ্জরী চৌধুরী ছিলেন বাংলার অধ্যাপিকা। ভাই শিশির চৌধুরী ও স্ত্রী স্বপ্না চৌধুরী তখন কুলাই হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলে। আমার দোস্তি ছিল সমীর চৌধুরীর সঙ্গে। গানের গলা ভালো ছিল সমীরদার। হঠাৎ এক সন্ধ্যায় বারান্দার চেয়ারে বসে হারমোনিয়াম কোলে নিয়ে পরপর গাইতে দেখলাম। ডেকে ডেকে কত / কথা ছিল যত। নয়ন সরসী কেন ভরেছে জলে। সবচেয়ে ছোটো ভাই স্বপন চৌধুরী তখন ইম্ফলে ডাক্তারি পড়ছিলেন। বার দুয়েক স্বপনদার সঙ্গে দেখা হয়েছিল। স্মার্ট যুবক। জিনস, টি শার্ট। হাতে গিটার। আমার জীবনে প্রথম জিনস পরা যুবক স্বপনদা। অনেক বছর ধরেই আমেরিকাতে আছেন এই স্বনামধন্য চিকিৎসক। প্রতিদিন সন্ধ্যায় বড়োবাবা আমাকে ও পুতুকে ডেকে নিতেন হরিবোল হরিবোল গাইবার জন্যে। এক হরিবোল বিভিন্ন সুরে প্রায় ৬/৭ মিনিট খেলিয়ে খেলিয়ে গাওয়া হত। আমাদের ভূমিকা ছিল দোহারের।
বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান এই ধলাই উপত্যকায়। উত্তরে চল্লিশ ফুট পেরিয়ে দুরাইছড়া শিববাড়ি। দুরাইছড়াতে একটি শিবমন্দির আছে। দুরাই শব্দটি এসছে হালামদের থেকে। হালামদের মধ্যে দৌরাই বা দেউরাই পদবি আছে। এই পদবি আসামে গিয়ে হয়ে গেছে দেউরি। এই পদবির অর্থ ধর্মপ্রচারক। এরা পূজা অর্চনার সঙ্গে জড়িত। দুরাই পেরিয়ে এয়ারপোর্ট। স্থানীয়দের মুখে মুখে এয়ারপোর্ট পাল্টে হয়ে গেছে এরারপার। একসময় এটি চালু আন্তঃরাজ্য বিমানবন্দর ছিল। কমলপুর ছাড়াও ত্রিপুরাতে খোয়াই, কৈলাসহর, বিলোনিয়াতে ছোটো এয়ারপোর্ট ছিল। ছোটো ছোটো বায়ুদূত বিমানই যাত্রী ও পণ্য পরিবহণ করত। দীর্ঘদিন কমলপুর এয়ারপোর্ট বন্ধ ছিল। ১৯৮৩ তে আগরতলা – কমলপুর বিমান পরিসেবা চালু হয়েছিল। অনেক ব্যবসায়ীরা সময় বাঁচাতে ফ্লাইটে যাওয়া আসা করতেন। বিমানভাড়া ছিল মাত্র ৩৯ টাকা। সঞ্জীবের বাবা খগেন্দ্র দাসও তখন ফ্লাইটে যাতায়াত করতেন। তখন ফ্লাইটে ধূমপান চালু ছিল।
হালাহালির পূর্বদিকে নদীর ওইপারে দেবীছড়া গ্রাম। বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরিদের বসতি। বাঙালি পরিবারও কিছু আছে। ২৫/ ২৬ কানি জায়গা নিয়ে দেবীছড়ায় হুনামতি সাধুবাবার আশ্রম। তাঁর দেহরক্ষার পর শিষ্য রাজা সাধু আশ্রম পরিচালনা করতেন। ১০০ বছর বেঁচেছিলেন এই রাজা সাধু। সাধুর দেহরক্ষার পর মেয়ে বনমালা সিংহ এই আশ্রমকে নিষ্ঠার সঙ্গে পরিচালনা করে আসছেন। দর্শনার্থীদের ভিড় লেগেই থাকে। এই আশ্রমে রাধাকৃষ্ণ ও শিবের বিগ্রহ। প্রচুর বনৌষধির গাছ আশ্রমে। এছাড়াও দেবীছড়ার ভূমিহীন কলোনিতে দেড়শো বছরের পুরোনো কাঙালদাস আশ্রম এখন ভগ্নপ্রায়। এই আশ্রমে রয়েছে রাধাকৃষ্ণ বিগ্রহ। এ ছাড়াও রয়েছে হনুমান আশ্রম। হনুমান আশ্রমের দেখভাল করেন গোপী সাধু। হনুমান আশ্রমে হনুমান ও রাধাকৃষ্ণের বিগ্রহ। হুনামতি, কাঙালদাস, গোপীসাধু বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি সম্প্রদায়ের। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে গোপী সাধু ছিলেন এক সশস্ত্র যোদ্ধা। রাজ্য ও রাজ্যের বাইরে দূরদূরান্ত থেকে দর্শনার্থীরা আসে। ত্রিপুরা সরকার ইচ্ছে করলে দেবীছড়ার এই তিনটি আশ্রমকে নিয়ে একটি লাভজনক পর্যটনক্ষেত্র গড়ে তুলতে পারত। ধলাই নদীর পূর্ব পারে দেবীছড়া চানকাপ হয়ে রাস্তা সিংহগড় কলোনি থেকে বেঁকে গেছে জামথুমের দিকে। ক্রমশ মেছুরিয়া, কচুছড়া, বলরাম, লালছড়ি, বাগমারা হয়ে আমবাসা গিয়ে মিলেছে।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনেক কিছুই পাল্টে যায়। মানুষের মুখে মুখে পাল্টে যায় শব্দ। শব্দের অর্থ। পাল্টে যায় ভাষা। অতীতের অনেক প্রমিত শব্দ আজ আমাদের কাছে তথাকথিত ইতর শব্দ হয়ে ওঠে। পাল্টে যায় স্থাননাম। নীল এই উপত্যকার অনেক জায়গার নামই পাল্টে গেছে সার্ভেয়ারদের মুখে মুখে। ধলাইয়ের পশ্চিম পারে চানকাপ নাম এসছে হালাম শব্দ চাংকাপ থেকে। হালাম শব্দ চাং মানে মৃত্যুফাঁদ। আর কাপ মানে লক্ষ্যবস্তুকে বিদ্ধ করা। এই কাপকে ককবরক ভাষায় বলে দুক। আটটি মজবুত বাঁশ বেঁকিয়ে ধনুক বানানো হত। সেটির ছিলায় টানটান করে জুড়ে দেওয়া হত একটি তীক্ষ্ণ বাঁশ। আর ধনুকের সঙ্গে বাঁধা একটি দড়ি দিয়ে ফাঁদ এমনভাবে পাতা থাকত যেটি জন্তু বা শত্রুর নজরেই আসত না। দড়িতে পা পড়তেই সেই তীক্ষ্ণ বাঁশটি গিয়ে শিকারকে বিদ্ধ করত। কুকি আক্রমণের সময় হালামরা এই অস্ত্র ব্যবহার করে আক্রমণ প্রতিহত করেছিল। এই চাংকাপ থেকেই চানকাপ। চানকাপে একটি হালাম বস্তি আছে।
চানকাপের পর লোকমুখে ফেরা জামথুম শব্দটিও হালাম জনগোষ্ঠীর। শব্দটি আসলে জানথুম। হালাম ভাষায় জান মানে রাত্রি আর থুম মানে তিন। তিন রাত্রির বিশ্রামস্থল। মেছুরিয়াও তাই। হালাম ভাষায় জায়গাটির নাম ছিল মাচেরওয়া। মাচের মানে লেবু। ওয়া মানে ছড়িয়ে পড়া স্রোতধারা। লেবুর জঙ্গলের টিলা থেকে ছড়িয়ে পড়া স্রোতধারা। কচুছড়া জায়গাটির আগে নাম মউইতুলুঙ। মউইতু অর্থ কচু। লুঙ মানে জায়গা। কচুছড়া একসময় ছিল ঠাকুরচান দেববর্মার তালুক। অনাবাদি জমি। নিজের জমিজমা বিক্রি করে বেশ কয়েকবার ঠাকুরচান কর দিয়েছেন রাজাকে। বলরাম জায়গাটির আগের নাম ছিল তাংবুল। এটি হালাম শব্দ। বলরাম পেরিয়ে লালছড়ির আগের নাম ছিল তুইসেনতে। হালাম শব্দ তুই মানে জল। সেনতে অর্থ লাল। ছড়ার লাল জল। বাগমারা আসলে বাঘমারা। এর আগের নাম কেইথাতপাড়া। যেখানে বাঘ মারা হয়।
৬
পশ্চিম হালাহালি বালোয়ারি স্কুলের সঙ্গে একটি আমলকী গাছ আছে। হরিণের মতো আমরাও ঋতুতে আমলকী খেতে যেতাম। এদিকেই আমাদের সহপাঠী বলাইয়ের বাড়ি। বলাইয়ের দাদা কানাই আমাদের এক ক্লাস উপরে। মেধাবী ছাত্র। কানাইদা স্কুলের প্রার্থনাসভা পরিচালনা করত। বাজারে ওদের দোকান। পশ্চিম হালাহালি বন্দের বাড়ি মণ্ডপ থেকে অপরেসকরের দিকে একটি রাস্তা চলে গেছে। আরেকটি রাস্তা নাকাসিপাড়া পানবোয়া হয়ে পাহাড়ি চড়াই উৎরাই পেরিয়ে খোয়াইয়ের আশারামবাড়ির দিকে গেছে। বিক্রম দেববর্মার ঠাকুরদা নাকা সিং দেববর্মার নাম থেকে এই গ্রামের নাম নাকাসিপাড়া। অপরেসকর নামটি কোনো মানুষের নাম থেকে আসেনি। আপ্রাংখর থেকে অপরেসকর। ককবরক ভাষায় আপ্রাং মানে বাইনমাছ। খর মানে বসতি বা বাস। অর্থাৎ যেখানে বাইনমাছ পাওয়া যায়। এরকম আরও কিছু জায়গার নাম ত্রিপুরাতে আছে। যেমন চিবুকখর। ককবরক ভাষায় চিবুক মানে সাপ। সাপের বাসা। তকবাকখর মানে বাদুড়ের বাসা। মায়ুংখর মানে হাতির বসতি।
একেবারে ঝরঝরে, রসসিক্ত , তথ্য সমৃদ্ধ লেখা ।
প্রতিটি পর্বই বেশ উপভোগ্য হচ্ছে ।
বাঃ । পরের পর্বের অপেক্ষায় রইলাম।
মনে করিয়ে দিলে, মণিপুরী দাদী আর বাঙ্গালী কাঙ্গালী। কিন্তু তিক্ততা ছিল না।
গদ্য এমনই উচিত। পড়তে পড়তে মনে হবে নিজেই লিখেছি।
আমার বহুদিনের ছেড়ে চলে যাওয়া, পড়ার অভ্যাস ফিরে এসেছে। ধন্যবাদ “প্রবুদ্ধসুন্দর” -কে।
বেশ interesting লাগলো কিছু আঞ্চলিক শব্দের ব্যবহার। 👌