Daruharidra
  • ধান্যগৃহ
  • কবিতা
  • গল্প
  • গদ্য
  • প্রবন্ধ
  • উপন্যাস
Daruharidra
  • ধান্যগৃহ
  • কবিতা
  • গল্প
  • গদ্য
  • প্রবন্ধ
  • উপন্যাস
Daruharidra
No Result
View All Result
Home গদ্য

প্রবুদ্ধসুন্দর কর || অষ্টম পর্ব

নীল উপত্যকার রাখাল

Daruharidra by Daruharidra
09/05/2021
in গদ্য
3
প্রবুদ্ধসুন্দর কর || অষ্টম পর্ব
350
VIEWS

৮

চালের শেডের পরের শেড বাংলাদেশি জামাকাপড়ের। খুবই সস্তায় প্যান্ট, শার্ট, জ্যাকেট, কোট। কয়েকটি দোকান পেরিয়ে নদীর দিকে ঢালুতে কয়েকটি ছোটো ছোটো একচালা ঘরে আবার সেই বাংলাদেশি কাপড়ের দোকান। এরপরে গোরুবাজার। কাঞ্চনবাড়ি, ফটিকরায়, ধুমাছড়া, কুলাই ও আরও অন্যান্য জায়গা থেকে ফাঁড়িপথে গোরুপাইকাররা গোরু হাঁটিয়ে নিয়ে আসত। ভিতরবাজারে ঝান্ডিমুন্ডার জুয়া চরকিজুয়া, তাসের জুয়ার অবাধ খেলা। এবার বাজারে ঢোকার প্রথম রাস্তার দিকে ফিরতি পথে হাতের বাঁদিকে দেবীছড়ার রসিকলাল রায়ের বেকারি। ছেলে রঞ্জিত আমাদের সঙ্গে পড়ত। খুব ভালো ফুটবল খেলত রঞ্জিত। রঞ্জিতের ঠোঁটের অবস্থা গোলকিপার সন্তোষের মতোই। রঞ্জিতের ভাই বিমল আমাদের স্কুলেরই ছাত্র। সামনে রাখাল মজুমদারের চায়ের দোকান শুধু বাজারবারেই খোলা হত। রবি ও বৃহস্পতি, এই দুটো বারই হালাহালির বাজারবার। সামনে দুর্গাশংকর দাসের কাপড়ের দোকান। দুর্গাশংকর ব্যাংকে চাকরি করতেন। গান করেন। খগেন্দ্র দাসের আত্মীয়। তখন সবে হালাহালিতে হিরো ম্যাজেস্টিক মোপেড। সঞ্জীব ও আমি একদিন সঞ্জীবের মেজকাকার মোপেড চালিয়েছিলাম। দুর্গাশংকর দাস সপরিবারে বড়োবাবাদের বাড়িতে ভাড়া থাকতেন। একদিন বিকেলে উঠোনে দুর্গাশংকর দাসের মোপেড দেখে লোভ সামলাতে পারলাম না। বসে স্টার্ট দিয়ে কৃষ্ণ শর্মাদের রাস্তায় এসে মেনরোডের দিকে। শুনতে পেলাম, পেছন থেকে পুতু বলছে, দাদা, কাঁপছে । মুহূর্তেই টাল সামলাতে না পেরে মোপেডসহ পড়ে গেলাম তিন ফুট নীচে বাঁপাশের শুকনো ধানজমিতে। নাক, মুখ, কপাল ও হাতের বেশ খানিকটা ছড়ে গেছিল। মোপেডও অল্পবিস্তর ক্ষতিগ্রস্ত। বাবা সারাইয়ের টাকা দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি নেননি। দুর্গাশংকর দাসের শালা অর্ধেন্দু এসে থাকত মাঝেমাঝে। আমাদের এক ক্লাস উপরে পড়ে। অর্ধেন্দুকে আমরা আধা ইন্দুর বলে ডাকতাম। দুর্গাশংকর দাসের দোকানের সামনে বারান্দায় গৌরবাবু সিংহের সেলাই মেশিন। গৌরবাবু আমাদের সহপাঠী মৃণালিনীর বাবা। এরপর নীরদ দেবের চায়ের দোকান। বিভু রায়ের জুতার দোকান। এরপরেই ছোটো একটি মিষ্টির দোকানের পর প্রতাপ দেবের মুদি দোকান। প্রতাপ দেবের বাড়ি মানিক দাদুদের বাড়ির কয়েকটা বাড়ি পরে। সামনে সুকেশ বিশ্বাসের পাঠ্য ও নোট বইয়ের দোকান। পরে সুকেশ বিশ্বাসের সঙ্গে বাবার আপন পিসির বিয়ে হয়েছিল। সুকেশ বিশ্বাস ফিশারিতে চাকরি করতেন। সুকেশ বিশ্বাসের সঙ্গে বাবার আপন পিসি শোভা দিদিভাইয়ের বিয়ে হয়েছিল। সেই সূত্রে বাবার পিসেমশাই। সুকেশ বিশ্বাসের দাদা সুভাষ বিশ্বাস প্রাইমারি টিচার। খুবই মজার মানুষ ও ভুলোমন। একদিন রাস্তায় বাবাকে পেয়ে সুভাষ বিশ্বাস জিজ্ঞেস করলেন, কেমুন আছইন? বাবা উত্তর দিলেন, একটা কথা আছে জানেন তো? মামার শালা পিসার ভাই / তার সঙ্গে সম্পর্ক নাই। দুজনেই একসঙ্গে হেসে উঠেছিলেন। সুকেশ দাদুভাইয়ের দোকানের পর গণেশ দেবনাথের দোকান। এরপর পুতুল শুক্লবৈদ্যের বিড়ি-সিগারেট, লজেন্স বিস্কুটের দোকান।

হালাহালি মেন রোডের কাছাকাছি এসে এবার বাজার বেঁকে গেছে বাঁদিকে। প্রথমেই নিবারণ ঘোষের কাপড়ের দোকান। নিবারণ ঘোষ গোপ স্যারের শ্বশুরমশাই। কাপড়ের ব্যবসা ছাড়াও নিবারণ ঘোষের ছাতা তৈরির ব্যবসা। চৌধুরীবাড়ির ডানহাতি রাস্তার পাশের ধানজমি পেরিয়ে নিবারণ ঘোষের বাড়ি। ধানকাটা হয়ে গেলে ওই শুকনো জমিতে ছাতার বাঁট তৈরির বাঁশগুলোকে পুড়িয়ে শুকোতে দেওয়া হত। বাঁশের বাঁটের ছাতা বেশ বড়ো হয়। নিবারণ ঘোষের মেজো মেয়ে নমিতার সঙ্গে মানিক দাদুর ছোটোবোন নমিতাদির সই পাতানো হয়েছিল। সমনামের মেয়েদের বা একই আদ্যাক্ষরের নামের ভিন্ন দু’টি পরিবারের দুটি মেয়ের ঋতুমতী হওয়ার আগে সই পাতানো উপলক্ষ্যে মাঘব্রত সিলেটের সামাজিক প্রথা। হালাহালিতে এসেই আমি প্রথম সই পাতানোর মাঘব্রত দেখি। উঠোনে আলপনা এঁকে আরও বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে সারা জীবনের জন্যে এই সই পাতানো। আত্মীয়তার মতোই এই সম্পর্ক। হালাহালি বাজারে কাপড়ের দোকানের বারান্দায় একজন দর্জি থাকবেই। নিবারণ ঘোষের দোকানের পর পদো পালের গ্রোসারি। এরপর পরপর দু’টি হোটেল। শৈলেন দেব ও কৃষ্ণ দেব পুরকায়স্থের। কৃষ্ণ দেব পুরকায়স্থ সহপাঠী বলাইয়ের বাবা। বলাইয়ের দাদা আমাদের এক ক্লাস সিনিয়র। কানাইদা স্কুলের মেধাবী ছাত্র। হোটেলের পর সুনীল দাসের কাপড়ের দোকান। সুনীল দাস সঞ্জীবদের নিকটাত্মীয়। পাশেই দীনবন্ধু দাসের ভুষিমালের দোকান। এরপর অজিত নাহার হার্ডওয়্যারের দোকান ও অমর সিংহের ভুষিমালের দোকান। পাশের ভিটায় কৃষ্ণ সিংহ নামে এক হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার ফিটফাট হয়ে বসে থাকতেন। মনতোষ সাহার স্টুডিয়ো। শিবু ও শম্ভুর রেডিয়ো সারাইয়ের দোকান। এই লাইনের শেষ ভিটাটি কীর্তি সিংহের শ্রীদুর্গা প্যাক্স। খুব রসিক ও আড্ডাবাজ ছিলেন কীর্তি সিংহ।

মেইন রোডের পশ্চিম দিকে বকুল পালের রেশন শপ। বকুল পাল মদন স্যারের ভাই। কাউন্টারে বসত বাচ্চুদা। মদন স্যারের দাদা চিনু পালের ছেলে। সহপাঠী মৃণাল ওরফে পঞ্চুর দাদা। পাশেই চিনু পালের চায়ের দোকান। পাশে আমাদের এক ক্লাস উপরে আশিসদের বাড়ির সরু রাস্তার পরই সুবিনয় মালাকারের সাইকেল সারাইয়ের দোকান। সুবিনয়দা সাইকেল ভাড়া খাটাত। ঘণ্টায় ২৫ পয়সা। এরপরই শ্যামাপদ আচার্যের হোমিওপ্যাথিক ওষুধের দোকান। পাশে বকুল পালের গ্রোসারিতে বকুল পাল ও বাচ্চুদা পালা করে বসতেন। এরপর নীলমণি সিংহের দাদা ভৃগুধর সিংহের টেইলারিং দোকান। এরপর সুবিনয় দেবের ফার্মেসি ও অনিল নাহার মুদি দোকান। অনিল নাহার দোকানের বারান্দায় সাইকেল সারাই করত একটি লোক। এরপরেই বসাক কাকুর মিষ্টির দোকান। পাশে নগেনের দাদা শশীমোহনদার এস এম টেইলার। এরপর একটি গলি খানিকটা গিয়ে দু-ভাগ হয়ে গেছে। একটি রাস্তা গেছে সোজা সহপাঠী সন্ধ্যাদের বাড়ি। আরেকটি বেঁকে গেছে সেই ক্যারাটের নগেনদাদের বাড়ি। গলির পরেই দেবীশংকর মিশ্রের কাপড়ের দোকান। মাড়োয়ারি এই পরিবারটি হালাহালি এসে সিলেটিই হয়ে গেছে । চার ছেলের মধ্যে ছোটোটি সঞ্জীবশংকর ওরফে বট্টি স্কুলে জুনিয়র হলেও বেশ বন্ধু হয়ে গেছিল। পাশেই টেইলারিং দোকানে বাবা, ছেলে একসঙ্গে কাজ করত। নন্দলাল সিংহ ও ছেলে সমর। এরপর জুন্টুদাদের দোকানভিটা। পাশে প্রসন্ন ডাক্তারের হোমিও চেম্বার।

এরপর বেশ ফাঁকা জায়গা। ক্লাবের দুর্গাপূজা হয় এখানে। মাঝেমাঝে মাদারিরা খেলা দেখায়। পাটের দড়ির শিকের মতো কিছু একটাতে ঢুকিয়ে জ্যান্ত মানুষ হাপিস করে দেওয়া। রাবারের টুকরো থেকে সাপ। হৃৎপিণ্ড উপড়ে আনা খেলা দেখার টানটান উত্তেজনার পাশাপাশি ভয়ও করত। একবার প্রণব মুখার্জি এসেছিলেন হালাহালিতে। এই ফাঁকা জায়গাটিতে ছোট্ট মঞ্চ করা হয়েছিল। প্রায় কুড়ি পঁচিশ মিনিট বক্তব্য রেখেছিলেন। শ্রোতার সংখ্যা সাকুল্যে কুড়ি। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী প্রয়াত সুখময় সেনগুপ্তও সেদিন উপস্থিত ছিলেন। একসময়ের প্রতাপশালী মুখ্যমন্ত্রীর পরনে সেদিন ছিল সাধারণ লুঙ্গি ও পাঞ্জাবি। সঙ্গে আরেকজন সুস্বাস্থ্যের অধিকারী যুবক, ঘাড় পর্যন্ত লম্বা চুল, পরনে লাইট কালারের বেলবটস। গায়ে বটল গ্রিন শার্ট। পুলিশের উর্দিতে যেমন দুই কাঁধে ধাতব স্টার বসানোর জন্য যেমন কাপড়ের টুকরো দিয়ে তৈরি শোল্ডার ফ্ল্যাপ থাকে ঠিক তেমন শার্ট। পায়ে হাই হিল। তেছরা চাহনি। দেখেই মনে হয় মস্তান। পরে শুনেছিলাম, লোকটির নাম মানিক চক্রবর্তী। বাড়ি সালেমা। বেশ ক’টি খুনের আসামি। ফাঁকা সভায় উপস্থিতদের মধ্যে গোপাল দত্ত ও নেপাল দত্ত, এই দুই পরিবারের বাড়ির কয়েকজন। হালাহালির পুরোনো কংগ্রেসি বাড়ি। সুখময় সেনগুপ্ত হালাহালি এলে ওদের বাড়িতে যেতেন। এই অংশটির পরেই একটি চায়ের দোকানের পাশে অখিল পালের চা-পাতার দোকান। অখিল পাল আমাদের সহপাঠী গীতার বাবা। পাশে বিজয় রায়ের ঘড়ি সারাইয়ের পরই নিরু সাহার মাইক সাউন্ড বক্স, রেকর্ড প্লেয়ার, লাইট ইত্যাদি ভাড়া দেওয়ার দোকান। আমাদের বেশ সিনিয়র দাদাদের আড্ডার ও গান শোনার জায়গা ছিল এই দোকান।

৮.

হালাহালির মতো শান্তিপূর্ণ জায়গা ত্রিপুরাতে কমই আছে। স্কুল ও স্কুলের রেজাল্ট নিয়ে অভিভাবকেরা বেশ সচেতন। বাবার আগে প্রধান শিক্ষক নিকুঞ্জ দত্ত খুবই শৃঙ্খলাপরায়ণ ছিলেন। সহকর্মী শিক্ষক, ছাত্র, অভিভাবকদের কাছে খুবই গ্রহণযোগ্য। এলাকার লোকেরা তাঁকে বড়দা বলেই ডাকত। আদর্শ শিক্ষক ও দক্ষ পরিচালক বলতে যা বোঝায় তিনি ছিলেন তাই। এলাকায় সুনাম কুড়িয়েছিলেন প্রধান শিক্ষক হিসেবে। স্বাভাবিকভাবেই বাবার দায়িত্ব আরও বেড়ে গেল। সন্ধে হলেই প্রতিটি বাড়িতে পড়ার শব্দ, সংগীতচর্চা। বাড়ি বাড়ি গিয়ে গান শেখাতেন কৃষ্ণকুমার সিংহ ও পূর্ণ সিংহ। কৃষ্ণকুমারের শিক্ষার্থীই তুলনামূলক বেশি ছিল। ভালো তবলাও বাজাতে পারতেন। পূর্ণ সিংহের ভীষণ তোতলামি। আশ্চর্যের ব্যাপার গান গাইবার বা শেখাবার সময় তিনি সাবলীল। তোতলামির সামান্য লক্ষণও নেই। দুজনের বাড়িই দেবীছড়া। গানের শিক্ষার্থীদের ছোটোখাটো অনুষ্ঠানে নজরুলগীতিই বেশি গাইতে শুনতাম।

ক্লাসের ব্যাকবেঞ্চারদের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব একটু বেশিই ছিল। গোটা এলাকায় এই একটিই দ্বাদশ শ্রেণি বিদ্যালয় আর দু’টি প্রাইমারি স্কুল। যেহেতু ভালো ভালো শিক্ষকেরা রয়েছেন, দূর দূর থেকে ছাত্রেরা পড়তে আসে। এরারপার, দুরাইছড়া, অপরেসকর, লুৎমা, শান্তিরবাজার, দেবীছড়া, চানকাপ, মহাবীর, বামনছড়া থেকে ছাত্রছাত্রীরা পায়ে হেঁটে ও সাইকেল চালিয়ে আসত। ক্লাসে একটি ছেলেকে দেখতাম সবসময় পেছনের দিকে একটি নির্দিষ্ট জায়গাতে বসত। একদিন আবিষ্কার করা গেল তার পেছনে বসার উদ্দেশ্য। সেই সহপাঠী কৃষ্ণকুমার সিংহ বেঞ্চের খোপে বইয়ের নীচে লুকিয়ে গল্পের বই পড়ে। ছেলেটিকে ভালো লেগে গেল। সামনের বেঞ্চে বসতাম আমি, অভিজিৎ, প্রশান্ত, সঞ্জীব, মানবেন্দ্র, পঞ্চু। আমাদের ক্লাস এইটে বিড়ি খেত জয়দেব। ছোটোখাটো গড়নের। ট্যারা। স্কুলে বিড়িখোর ছাত্রদের সিনিয়র জুনিয়র ছিল না। নেশাতে কোনো ভেদাভেদ নেই। উই আর ইন দ্য সেম বোট ব্রাদার। হালাহালি স্কুলে ক্লাস নাইন থেকেই মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের মাধ্যমিকে ফার্স্ট ডিভিশনের জন্যে প্রোজেক্ট করা হত। আমরা যখন এইটে পড়ি, টেনে অত্যন্ত মেধাবী শিক্ষার্থী দু’জন। সঞ্জীবের দাদা অঞ্জনদা আর অনীতা সিংহ। নাইনে বলাইয়ের দাদা কানাইদা, মেঘদূতদা আর রুমিদি। রুমিদি মানবেন্দ্রর মাসি। গোটা মহকুমায় হালাহালি ছাড়াও মাধ্যমিকের রেজাল্ট ভালো হত কুলাই স্কুলে, মানিক ভাণ্ডারের হরচন্দ্র স্কুলে। ফুলছড়ির বয়েজ স্কুল ও কমলপুর গার্লসে। গকুল বোনাজের ভাই গোপাল ছিল বাবার ন্যাওটা। গোপালের কণ্ঠেই আমি শচীনকর্তার  গানটি প্রথম শুনি, তুমি যে গিয়াছ বকুল বিছানো পথে। আজও গানটি শুনলে গোপালের মুখই ভেসে ওঠে। মহাবীর চা-বাগান থেকে গকুলজি গোপালজি ছাড়াও ছিল অকূল গোয়ালা। অনেক সহপাঠীই বয়সে আমার বড়ো। হালাহালি টুয়েলভ স্কুল কো এড তো বটেই। একেকটি শ্রেণির ছাত্রছাত্রীরা একই সেকশনে। এখানে এসে আমি খাড়া লজ্জা শব্দটির সঙ্গে পরিচিত হলাম। কাউকে সরাসরি লজ্জিত করাই খাড়া লজ্জা। অভিজিৎদের বাড়ি স্কুলের পেছনে। ওদের সাদা ও বাদামি রংয়ের পোষা কুকুরটি প্রায়ই স্কুলে চলে আসত। যোগেন্দ্র স্যার যখন ইতিহাস ক্লাস নিতে আসতেন, কুকুরটিও ক্লাসে এসে চুপচাপ বসে থাকত। মাঝেমাঝে অভিজিৎকে খুঁজতে এলে আমরা কুকুরটিকে চেয়ারে বসিয়ে সামনে পাঠ্যবই খুলে দিতাম।

হালাহালি স্কুলে ছোটো বড়ো ছাত্রছাত্রীদের, সত্যি হোক বা না হোক, জুটি বেঁধে দেওয়ার একটা ফিসফিসানি চল ছিল। আমাকেও জুড়ে দেওয়া হল কবিতা নামের এক সহপাঠীর সঙ্গে। এরপর থেকেই কিছু কিছু সহপাঠী ও সিনিয়র ছাত্র আওয়াজ দিত পিকে বলে। পি মানে প্রবুদ্ধ আর কে মানে কবিতা। ফলে, লজ্জায় মেয়েটির সঙ্গে আমার কথা বলা বন্ধ হয়ে গেল। তবে সহপাঠীদের কেউ কেউ খুবই গানপাগল। মাঝেমধ্যেই আসর বসত বন্ধুদের কারো কারো বাড়িতে। জলসার প্রধান উদ্যোক্তা সজল। গায়ক বলতে গকুল ও গোপাল বোনাজ। নজরুলগীতি ছাড়াও গকুল বাংলাদেশের গান বেশি গাইত। মনের বাগানে ফুটিল ফুল রে রসিক ভ্রমরা আইল না / ফুলের মধু খাইল না…। আরেকটি গান, মনে বড়ো আশা ছিল তোমাকে শোনাব গান / এতদিনে আশা হল পূর্ণ…। একটি নজরুলগীতি গকুল বাধ্যতামূলক গাইত, আমায় নহে গো ভালোবাসো তুমি / ভালোবাসো মোর গান/ বনের পাখিরে কে চিনে রাখে / গান হলে অবসান…। সজলদের বাড়িতে জলসা হলে ওর বোন ঝর্ণাও গাইত।

মহাবীর চা-বাগানে তখনো যাইনি। চৌধুরীবাড়ির পেছনে দণ্ডকলসের খেত। শীতকালে সাদা খইয়ের মতো ফুটে থাকে। পাশেই ঘাসে ঢাকা একটুকরো বর্গাকার জমিতে দুটো মঠ পূর্বপুরুষদের স্মৃতির উদ্দেশে। হালাহালিতে শ্মশান নেই। বড়ো জায়গাজমি নিয়ে যাদের বাড়ি, তারা বাড়ির সীমানা থেকে বেশ দূরে কাষ্ঠ করে। সিলেটিরা দাহকে কাষ্ঠ বলে। স্মৃতি হিসেবে বাঙালিরা সেই কাষ্ঠের জায়গাটিতে পূর্বপুরুষের নাম লেখা ছোটো মঠ নির্মাণ করে । মণিপুরি ও বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরিদের ধলাই নদীর পারেই দাহ করতে দেখেছি। দুই সম্প্রদায়েরই অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া ও শ্রাদ্ধের রীতি রেওয়াজ একই রকম। মৃদঙ্গ ও করতাল বাজিয়ে দেহতত্ত্ব বা ভাবতত্ত্বের গান গাইতে গাইতে শবানুগমন । সেই গানের ভাষা ছিল ব্রজবুলি ও বাংলা। দাহের আগে পিণ্ডদান। মণ্ডপের ব্রাহ্মণ উপস্থিত থাকতেন। ১৩ দিন শোকপালনের পর শ্রাদ্ধ। যথারীতি শ্রাদ্ধের আগের দিন আবারও পিণ্ডদান। মস্তক মুণ্ডন। ক্ষত্রিয় বলে দুই সম্প্রদায়েরই উপনয়ন সংস্কার আছে। উপনয়নের আগে বা পরে ব্রাহ্মণের কাছ থেকে দীক্ষা নেওয়া বাধ্যতামূলক। পুরুষ ও মহিলাদের দীক্ষা না থাকলে বিবাহের অধিকার নেই। বাঙালিদের শ্রাদ্ধবিধি এক মাস অশৌচ পালনের পর। ব্রাহ্মণ ও নাথ সম্প্রদায়ের এগারো দিনে। মণিপুরি মুসলমানদের কবরস্থান উত্তর হালাহালির যে রাস্তাটি ইটভাটা পেরিয়ে মহাবীর চা-বাগানের দিকে বেঁকে গেছে সেই রাস্তায় একটু এগিয়ে। আরেকটি কবরস্থান এরারপার এলাকায়।

একদিন বিকালে সপরিবারেই মহাবীর চা-বাগান দেখতে গেলাম। চৌধুরীবাড়ির পূর্বদিকে অনেকটা খেত পেরিয়ে এসে মহাবীরের কাঁচা রাস্তা। রাস্তা পর্যন্ত পুরো জমিটাই চৌধুরীদের। এই জমিতে সরিষা, বাঙ্গি, মুসুরি ডালের চাষ। পাশে পরেশ দেবের কুশিয়ার খেত। কুশিয়ার মানে আখ।  রাস্তায় উঠে বাঁয়ে খানিকটা এগিয়ে ধলাই নদীর উপর বাঁশের বেশ বড়ো সাঁকো। বর্ষায় ধলাই নদীর বান এই সাঁকো ভাসিয়ে নিয়ে যায়। তখন নৌকায় পারাপারই একমাত্র ভরসা। সাঁকো পেরিয়ে বাঁদিকে রাস্তা বামনছড়া হয়ে চুলুবাড়ির চলে গেছে। চুলুবাড়ি থেকে একজন বাদামবিক্রেতা আমাদের স্কুলে আসেন বাদাম নিয়ে। খানিকটা এগিয়ে বাগানের ম্যানেজারের বাংলো। মহাবীর চা-বাগানের পত্তন ১৯২৭ সাল নাগাদ। সিলেটের পাইলগাঁওয়ের ব্রজেন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী ও তাঁর ভাইদের শরিকি উদ্যোগ ছিল এই বাগান। পালগ্রামের অপভ্রংশ পাইলগাঁও। বাগানের নাম মহাবীর কেন তা জানা যায়নি। মহাবীর বাগানে ঢোকার মুখেই একটি ছোট্ট বাজার। দু-পাশে কিছু কোয়ার্টার। এরপর ম্যানেজারের সাজানো গোছানো বাংলো। তখনকার মফস্বলে হেডমাস্টার ও ডাক্তার বেশ সম্মাননীয় ব্যক্তি। গোটা বাংলোটাই আমাদের দেখানো হল। একটি ঘরের দেওয়ালে বিশাল এক বাঘছাল ও পাইথনের চামড়া। মেশিনঘরে নিয়ে গিয়ে দেখানো হল কীভাবে চায়ের পাতা শুকিয়ে প্রসেসিং হয়। ফেরার পথে চা-শ্রমিকদের সঙ্গে দেখা। এদের অনেকেই ভিনরাজ্যের। বংশপরম্পরায় এই বাগানে মজুর হয়ে রয়ে গেছে। এখান থেকে চা-বাগানের ফাঁড়িপথে লংতরাই নিশ্চয়ই বেশি দূরে নয়? একজনকে গকুল ও গোপালদের বাড়ির ঠিকানা জিগ্যেস করতে রাস্তা দেখিয়ে দিল। মুহূর্তেই মনে হল লংতরাই পাহাড়ে বাধা পেয়ে একটি গানের কলি প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে এসেছে, আমি যেন হায় ফেলে যাওয়া মালা কুলহারা নদীতটে…। গোপালের কণ্ঠে এই গানটি শুনলেই বুক হু হু করে উঠত।

                                                                            ক্রমশ…

Tags: গদ্যধারাবাহিক গদ্যপ্রবুদ্ধসুন্দর কর
Previous Post

অমিতাভ দেব চৌধুরী || প্রথম পর্ব

Next Post

অমিতাভ দেব চৌধুরী || দ্বিতীয় পর্ব

Daruharidra

Daruharidra

Next Post
অমিতাভ দেব চৌধুরী || দ্বিতীয় পর্ব

অমিতাভ দেব চৌধুরী || দ্বিতীয় পর্ব

Comments 3

  1. চঞ্চল চক্রবর্তী says:
    1 year ago

    অভিজিতের কুকুর এবং সই পাতানোর মাঘব্রত এবারের সম্পদ।

    Reply
  2. Prasanta Kumar Sinha says:
    1 year ago

    Tor ei lekha theke Halhali Bazar er tokhonkar (1981-1984) ekta chitro chukher samne bheshe uthlo. Tor memory take salam. Deshi mod bikri jara karto tader naam tui ki kare janli? 🤣🤣 Bulan aar Upen Singh er kothao thik tor mone aachhe 🤣🤣. Jhantu Choudhur der dukaner pashei Lakshi Kumar Singha r (Bidhyadhan dar Jamai Babu & Surajit Singhar kakku) gharir dukaner kotha likhte bhulage gechhis naki tokhon chhilona? E chhara Nishi Singha aar Inai Ali r tailor er dukaner ullekh nei. Egulu ki tokhon chhilona?

    Reply
  3. Purba Purkayastha (Rakshit) says:
    1 year ago

    সন্ধ্যে হলেই প্রতিটি বাড়িতেই পড়ার শব্দ, সঙ্গীতচর্চা। এটা একটা রেওয়াজ ছিল।
    বেশ ভালো লাগছে….. ‘পিকে’ 🥰😘😘Purba

    Reply

Leave a Reply Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

No Result
View All Result

RECENT POSTS

মেখলা পরা মেয়ে || শ্রীযুধাজিৎ || অন্তিম পর্ব

মেখলা পরা মেয়ে || শ্রীযুধাজিৎ || অন্তিম পর্ব

15/04/2022

সঞ্জয় চক্রবর্তী || অন্তিম পর্ব

09/04/2022
মেখলা পরা মেয়ে || শ্রীযুধাজিৎ || দ্বাবিংশতি পর্ব

মেখলা পরা মেয়ে || শ্রীযুধাজিৎ || দ্বাবিংশতি পর্ব

08/04/2022

সঞ্জয় চক্রবর্তী || নবম পর্ব

02/04/2022
মেখলা পরা মেয়ে || শ্রীযুধাজিৎ || একবিংশতি পর্ব

মেখলা পরা মেয়ে || শ্রীযুধাজিৎ || একবিংশতি পর্ব

01/04/2022

সঞ্জয় চক্রবর্তী || অষ্টম পর্ব

27/03/2022
মেখলা পরা মেয়ে || শ্রীযুধাজিৎ || বিংশতি পর্ব

মেখলা পরা মেয়ে || শ্রীযুধাজিৎ || বিংশতি পর্ব

25/03/2022
সঞ্জয় চক্রবর্তী || সপ্তম পর্ব

সঞ্জয় চক্রবর্তী || সপ্তম পর্ব

20/03/2022
মেখলা পরা মেয়ে || শ্রীযুধাজিৎ || উনবিংশতি পর্ব

মেখলা পরা মেয়ে || শ্রীযুধাজিৎ || উনবিংশতি পর্ব

18/03/2022
ষষ্ঠ পর্ব || সঞ্জয় চক্রবর্তী

ষষ্ঠ পর্ব || সঞ্জয় চক্রবর্তী

13/03/2022

RECENT VIDEOS

https://www.youtube.com/watch?v=77ZozI0rw7w
Daruharidra

Follow Us

আমাদের ঠিকানা

দারুহরিদ্রা
কুঞ্জেশ্বর লেন
(বরাকভ্যালি একাডেমির নিকটবর্তী)
নতুন ভকতপুর, চেংকুড়ি রোড
শিলচর, কাছাড়, আসাম
পিন-788005

ডাউনলোড করুন

সাবস্ক্রাইব

Your E-mail Address
Field is required!
Field is required!
Submit
  • আমাদের সম্পর্কে
  • লেখা পাঠানো
  • যোগাযোগ

Copyright © All rights reserved Daruharidra | Development by Prosenjit Nath

No Result
View All Result
  • ধান্যগৃহ
  • কবিতা
  • গল্প
  • গদ্য
  • প্রবন্ধ
  • উপন্যাস
  • সাক্ষাৎ পাতা
  • অনুবাদ পাতা
  • আর্কাইভ
  • আমাদের সম্পর্কে
    • লেখা পাঠানো
    • যোগাযোগ

Copyright © All rights reserved Daruharidra | Development by Prosenjit Nath