৯
ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে। বাবা হালাহালিতে জয়েন করার কয়েক মাসের মধ্যেই বাবার সতীর্থরা বাবার সঙ্গে দেখা করতে শুরু করল। আমার বাবা ছিলেন শ্রী অনুকূলচন্দ্র চক্রবর্তীর প্রতিষ্ঠিত সৎসঙ্গের সহপ্রতিঋত্বিক। ফলে, শৈশব থেকেই আমি ধর্মীয় অনুশাসনের মধ্য দিয়ে বড়ো হয়েছি। নিয়মিত ভোরে ও সন্ধ্যায় নির্দিষ্ট সময়ে প্রার্থনা, নামধ্যান, নিরামিষ খাওয়া, সৎসঙ্গ, নামসংকীর্তন ইত্যাকার আবহের মধ্যেই বেড়ে উঠেছি। আমার শৈশবের অনেকটা সময় কেটেছে আগরতলা আশ্রমে। সৎসঙ্গ মূলত সন্ত ঘরানার আধ্যাত্মিকতা। অনুকূলচন্দ্রের মা মনমোহিনী দেবী ছিলেন হুজুর মহারাজের দীক্ষিত। পরে এই ভাবধারায় অনুকূলচন্দ্র বৈদিক ঐতিহ্য ও বৈষ্ণব ভাবধারাকেও সংযোজিত করেন। অনুকূলচন্দ্রের জন্ম তৎকালীন পূর্ববঙ্গের পাবনার হেমায়েতপুরে। পরে চলে আসেন তৎকালীন বিহার তথা অধুনা ঝাড়খন্ডের দেওঘরে। শ্রী চৈতন্যদেবের মতোই নামসংকীর্তনকেন্দ্রিক সৎসঙ্গের ভাবধারা বৈষ্ণবীয় বাঙালি সমাজে জনপ্রিয় ও গ্রাহ্য হয়েছে। সৎসঙ্গ এমন একটি ভাবান্দোলন, যা পুরুষোত্তম শ্রীকৃষ্ণ, যিশুখ্রিস্ট, নবীজি হযরত মহম্মদ, চৈতন্যদেব, রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব প্রমুখ সবাইকেই সর্বশক্তিমানের অবতার জ্ঞান করে। এই ধর্মীয় ভাবান্দোলন অনুকূলচন্দ্রের মহাপ্রয়াণের পর আচার্য পরম্পরায় এগিয়ে চলেছে। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু ও তাঁর মা, দুজনেই ছিলেন অনুকূলচন্দ্রের দীক্ষিত। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনও দীক্ষা নিয়েছিলেন। দেওঘরের আশ্রমে অনুকূলচন্দ্রের সান্নিধ্যে কয়েকদিন থেকে ফিরে গিয়ে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর বিপ্রদাস উপন্যাসটি লেখেন। এই সৎসঙ্গের জন্যেই জীবনে অনেক ভালো মানুষ যেমন দেখেছি তেমনি কিছু খারাপ মানুষও দেখেছি। আমার পোশাকি নামটি রেখেছিলেন অনুকূলচন্দ্রের বড়ো ছেলে শ্রী অমরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। আর আমার বাবলু ডাকনামটি রেখেছিলেন আসামের রবীন দে। অসমিয়া। রবীন জেঠুও সৎসঙ্গের ঋত্বিক ছিলেন। নামধ্যান করে করে কিছু দিব্য, ব্যাখ্যাতীত ক্ষমতার অধিকারী তিনি হয়েছিলেন। নিজের আসন্ন মৃত্যু আগে থেকে টের পেয়ে তিনি তখন দেওঘর চলে যান। বেশ কয়েকমাস পর আশ্রম থেকে উড়িষ্যা যাওয়ার একটি ট্যুর স্থির করা হলে রবীন জেঠুকে এই শর্তে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়, পথে কোথাও যাতে রাত্রিবাস না হয়। কিন্তু এমনই নিয়তি যে তুমুল ঝড়বৃষ্টির কারণে সেই রাতে সবাইকেই ঘাটালে থেকে যেতে হয়। পরদিন উড়িষ্যার ভদ্রকে পথদুর্ঘটনায় রবীন জেঠু মারা যান।
ইংরেজি সাহিত্যের ইতিহাস পড়লে দেখা যায় অনেক কবিদের বাবারাই ছিলেন বিশপ বা আর্চ্বিশপ বা ক্লার্জিম্যান বা প্রিচার। আমিও বাবার বখে যাওয়া ছেলে। কুলাঙ্গার। অনুশাসনে ছিলাম বলেই হয়ত মাকে ঘুমে রেখে ছিটকিনি খুলে ভরদুপুরে বেরিয়ে পড়তে ভালো লাগত। আদাড়ে বাদাড়ে ঘুরে বেড়াতাম। বাবা ছিলেন আমার ফ্রেন্ড-ফিলোসফার-গাইড। আমাকে আজও জিগ্যেস করলে আমি বলব, বাবাই ছিলেন আমার শ্রেষ্ঠ বন্ধু। এতসব ধর্মীয় রীতিনীতির পরেও বাবা ছিলেন যথেষ্ট আধুনিক। জ্ঞানী। পরোপকারী। সৎ ও নির্ভীক। বিচক্ষণ। সংগীতপ্রিয়। রসিক ও মিশুকে। ঈশ্বরের প্রতি এক উৎসর্গীকৃত প্রাণ। আদর্শ শিক্ষক। দক্ষ প্রধান শিক্ষক। ছাত্রদরদি। আমি গর্বিত, বাবা কখনোই রাষ্ট্রপতি পুরস্কারের জন্যে আবেদনপত্র জমা দেননি। বাবার নখের যোগ্যতাও আমার নেই। সাধারণ জীবন যাপন করতেন। বলতেন, প্লেন লিভিং হাই থিংকিং। রণজিৎ দাশের কবিতায় বাবার মতোই আমারও পাওয়ার স্টেশন ছিলেন বাবা। আমাকে একমাত্র বাবাই নিয়ন্ত্রণ করতে পারতেন। কুলশাস্ত্র, অকাল্ট, থিওসফিক্যাল পড়াশোনা, সন্ত ও বৈষ্ণব ভাবধারা বিষয়ে তীব্র অনুসন্ধিৎসা ছিল বাবার। বাবার নখের যোগ্যও আমি নই। জীবনের অনেক মুহূর্তেই আমার মাথার উপর যে ঈশ্বরের হাত রয়েছে, অনুভব করি।
বাবার জন্ম ১৯৩৫ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সংলগ্ন ভাদুঘরে। পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি জটিল হয়ে পড়লে যৌথ পরিবারসহ ঠাকুরদা ভারতে চলে আসেন। ঠাকুরদা প্রফুল্লচন্দ্র ছিলেন যৌথ পরিবারটির বটগাছ। আগরতলার উমাকান্ত একাডেমি থেকে মেট্রিকুলেশনের পর বাবা ইন্টারমিডিয়েটে সায়েন্স নিয়ে ভরতি হন। পরীক্ষার আগে টাইফয়েড। এরপর আর্টস নিয়ে আই এ পাস করেই শিক্ষকতার চাকরিতে জয়েন করেন। তারপর সবই প্রাইভেটে। বি এ। বি টি। হিন্দিতে রাষ্ট্রভাষা রত্ন। মাঝখানে হিন্দি ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপকও ছিলেন। সংস্কৃত কলাপ ব্যাকরণে উপাধি। ইসলামিক হিস্ট্রিতে এম এ। অঙ্ক ও ইংরেজির তুখোড় শিক্ষক। বাবা বলতেন, ঈশ্বরের দরবারে সবই অবিদ্যা। আমার ধারণা, বাবা বংশশ্রেষ্ঠ। একবার ঠাকুরদার এক বন্ধু বাড়িতে এসে কিছু একটা বিষয় নিয়ে রেগে গিয়ে বাবাকে বলেছিলেন, তোমার বাবার মতো ভালো মানুষের ঘরে তুমি একটি কুষ্মাণ্ড। বাবা ভদ্রলোককে বসিয়ে রেখে দোকান থেকে মিষ্টি এনে খাইছিলেন যেহেতু তিনি ঠাকুরদার প্রশংসা করেছিলেন। বাবা আমাকে ঠাকুরদার আগে আরও পাঁচ পুরুষের নাম বলে গেছেন। কবি শঙ্খপল্লব আদিত্য আমাকে একদিন বলেছিলেন, বাবামুখী ছেলেদের বৈষয়িক উন্নতি কম হয়। হবে হয়ত। এতে আমার কোনো আফসোস নেই। আমার মায়ের জন্ম সিলেটের পঞ্চখণ্ড। চৈতন্য মহাপ্রভুর দাদার বাড়ি থেকে একটু দূরে। পঞ্চখণ্ড ছিল একটি বর্ধিষ্ণু গ্রাম। মায়ের বাবা মানে আমার দাদু ছিলেন ডিব্রুগড়ের পানিতোলা চা-বাগানের প্যাথোলজিস্ট । খুব পড়ুয়া ছিলেন দাদু। ভালো বক্তাও ছিলেন। দিদিমা একে একে আট মেয়ে ও দুই ছেলের জন্ম দিয়েছিলেন। মা সবার বড়ো। গুয়াহাটি ইউনিভার্সিটি থেকে ১৯৬৪ তে ইংরেজি ও সংস্কৃত সাহিত্যে গ্র্যাজুয়েশন করেছিলেন। বিয়ের আগে এন সি হিলসের হাফলং -এ সরকারি স্কুলে পড়াতেন। বিয়ের পর চাকরি ছেড়ে চলে আসেন ত্রিপুরাতে। ইন্টারভিউ বোর্ডে ত্রিপুরায় বসবাস নিয়ে সামান্য মিথ্যে বলে উঠতে পারেননি বলে মা-র চাকরি করা হয়ে উঠেনি। পরে পেয়েছিলেন ঠিকই। তবে প্রত্যন্ত এলাকায় বলে মা আর জয়েন করেননি।
আমার অষ্টম পূর্বপুরুষ রাধাবল্লভ রাঢ়বঙ্গ থেকে সপরিবারে চলে এসেছিলেন শ্রীহট্টের হবিগঞ্জের বানিয়া চং-এ। রাধাবল্লভ ছিলেন ব্রাহ্মণ পরিবারের ছেলে। সাবর্ণ গোত্র। সেখানে একটি তরফের ভূস্বামী ছিলেন তিনি। তখন তাঁর পদবি ছিল তরফদার। সেখানে কোনো এক ঘটনায় সামাজিকভাবে অপমানিত হয়ে রাধাবল্লভ রাগে ক্ষোভে রাতারাতি বানিয়া চং ছেড়ে সপরিবারে চলে আসেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া। এসে যার আশ্রয় গ্রহণ করেন সেই ভদ্রলোকের পদবি ছিল কর। আগের পদবি ত্যাগ করে রাধাবল্লভ সেই আশ্রয়দাতার কর পদবি গ্রহণ করেন। সেই থেকে বংশপরম্পরায় আমাদের পদবি কর। পরবর্তী সময়ে কাংসবণিকদের তামা কাঁসার ব্যবসা কীভাবে আমাদেরও জীবিকা হয়ে উঠেছিল সেটাই বিস্ময়ের। এখনো আমাদের গোত্র সাবর্ণ। এইসব তথ্য বাবা বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে জোগাড় করেছিলেন।
স্কুলে স্যারদের মধ্যে বাবার সতীর্থ ছিলেন রঞ্জিত সূত্রধর আর অমল দে। হালাহালি বাজারের হোমিও ডাক্তার শ্যামাপদ আচার্য। কীর্তন গাইতেন। শুরু হল সৎসঙ্গ। মাঝেমাঝে আমাকেও সঙ্গে করে নিয়ে যেতেন। বাবার সান্নিধ্য ছাড়তে ইচ্ছে করত না। হাঁটতে হাঁটতে পূর্ব পাকিস্তানের গল্প। আমাদের তৎকালীন যৌথ পরিবারের গল্প। ইংরেজি গ্রামার। ট্রান্সলেশন। বাংলা ব্যাকরণ। সন্ধ্যার পড়াশোনা ফেলে মাঝে মাঝে বাবার সঙ্গে এই বেরিয়ে যাওয়া নিয়ে মা খুব রেগে যেতেন। মা ছিলেন একটু কড়া মেজাজের। আমাদের ভালোই চাইতেন। মাঝেমাঝে মায়ের শাসন থেকে পালাতে ইচ্ছে করত। আমার দৈনিক পড়াশোনার সময়সীমা তিনঘণ্টা। এর বেশি পড়তে ভালো লাগত না। আর এতেই মায়ের যত রাগ। আমি কী করব? আমাকে হাতছানি দেয় লংতরাইয়ের রহস্যনীলিমা। ধলাই নদীর উল্টো স্রোত। অপরেসকরের টিলা। কমলপুরের বড়ো রাস্তা। বামনছড়া ও নাকফুলের চড়কের মাঠ। মহাবীর চা-বাগান। আগের ডাকসাইটে প্রধান শিক্ষক নিকুঞ্জবাবু যাওয়ার পর বাবার দায়িত্ব অনেকটাই বেড়ে যায়। স্থানীয় লোকজন ও ছাত্রছাত্রীদের অভিভাবকদের সঙ্গে সম্পর্ক এবং সৎসঙ্গকেন্দ্রিক তৎপরতা ইত্যাদির জন্যে বাবার জনসংযোগ আরও বেড়ে গিয়েছিল। সহকর্মী শিক্ষকদের ও ছাত্রদের কাছে বাবার গ্রহণযোগ্যতা বেড়ে যাওয়াতে বাবা খুব তাড়াতাড়িই জনপ্রিয় হয়ে উঠলেন।
১০
হালাহালির মতো মফস্বলে তখন পূজাপার্বণের মতো সামাজিক অনুষ্ঠানই একমাত্র বিনোদন। কালেভদ্রে দুয়েকটি নাটক ও জলসা। হালাহালিতে দেখা আমার প্রথম নাটক চক্রব্যুহ। আমাদের স্কুলের ক্যাম্পাস হলে। রাজনৈতিক নাটক। অভিনয় করেছিলেন পদ্মমোহন সিংহ। কল্পনাদি। বিজয়দা। নাটকের আলোকসম্পাতের দায়িত্বে দুলাল চ্যাটার্জি। লম্বা গড়নের। ফর্সা। দেখতে অনেকটা হিন্দি সিনেমার কিরণকুমারের মতো। হাবভাবও নায়কের মতো। মাঝেমাঝেই সাহেবি হ্যাট পরতেন। দুলালদাদের বাড়িতে মণ্ডপ ছিল। বাবা ব্রজধন চ্যাটার্জি বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরিদের পুরোহিত। ছোটোভাই জিতেন স্কুলে আমাদের সিনিয়র। দুলালদা আমাদের কাছে এক বিস্ময়। বৈজ্ঞানিক কারিগরিতে এক দুর্দান্ত প্রতিভা। পড়াশোনা খুব বেশি নয়। দুলালদার তৈরি প্রোজেক্টারে নির্বাক ডকুমেন্টারি দেখেছিলাম। কী নেই সেই হাতে তৈরি প্রোজেক্টারে! নারকেল তেলের খালি কৌটো থেকে শুরু করে লারেলাপ্পার প্লাস্টিকের চাকতি। পরীক্ষায় নকল করার একটি ছোট্ট ডিভাইসও নাকি তৈরি করে ফেলেছিল দুলালদা! নাকাসি পাড়ার ছড়ার জলের ফলসে টারবাইন বসিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে অনেকগুলো বালব জ্বালিয়ে দিয়েছিল। সেই জলবিদ্যুৎ দেখতে বিদ্যুৎ দপ্তর ও স্থানীয় লোকদের ভিড় হয়েছিল। এই কাজে দুলালদাকে সাহায্য করেছিলেন ডাক্তার প্রতাপ সিংহ। এরপর বাড়িতে বিভিন্ন সাধারণ উপাদান দিয়ে বাড়িতেই একটা আস্ত স্টিম ইঞ্জিন তৈরি করেছিলেন। পরে মহকুমার দুর্গা চৌমুহনিতে একটি ঝর্ণা থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্যে তৎকালীন চিফ ইঞ্জিনিয়ার চিত্তরঞ্জন চক্রবর্তী দুলালদাকে নিয়ে গেছিলেন। সেই প্রোজেক্ট সম্ভবত সফল হয়নি। দুলালদা, বাবুলদা, বিজয়দা, এই তিনজন খুব বন্ধু। আরেকবার বাজারের ব্যবসায়ী দুই ভাই শিবু ও শম্ভুর উদ্যোগে অর্কেস্ট্রা। মিউজিসিয়ানরা এসছিল আগরতলা থেকে। গোটা মাঘমাস জুড়ে বাঘনাচের একটি দল মধ্যরাতে গৃহস্থদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে গান গাইত। গানের তালে তালে বাঘের মুখোশ পরা ল্যাজওয়ালা, গায়ে ডোরাকাটা একটি ছেলে বাঘ সেজে নাচত। গান শেষ হলে গৃহস্থরা সাধ্যমতো টাকাপয়সা দিত দলটিকে। বাঘনাচের গানটির শুরুর অংশ এরকম–
তোমরা বাইরইয়া দেখো গো বাঘ আইসাছে
বাঘের গলায় মোহনমালা ঝিলমিল ঝিলমিল করে
তোমরা বাইরইয়া দেখো গো বাঘ আইসাছে
বাঘের মাথায় পাকনা চুল টগবগাইয়া চায়
বুড়া বুড়ি রাইখা বাঘে জোয়ান লইয়া যায়
তোমরা বাহির হইয়া দেখো গো বাঘ আইসাছে…
মধ্যরাতে ঘুম থেকে জেগে ওঠা বাচ্চারা একটু ভয় ও মজা পেত বই-কি। কৃষ্ণনগর ও দুরাইছড়ার দিকে বাঘনাচের কয়েকটি দল ছিল। মাঘ মাসের সংক্রান্তিতে বাঘের মূর্তি তৈরি করে পূজা দেওয়া হত। সিন্নি দেওয়া হত বাঘের নামে। কোনো কোনো অঞ্চলে একে বাঘাইয়ের সেবাও বলা হয়। পূজার পর সবাই মিলে পিকনিক করত।
খেলাধুলার পরিবেশ ও চর্চায় তখন হালাহালি গোটা কমলপুর মহকুমায় এগিয়ে। খেলার নেশা আমারও ছিল। তবে খুব ভালো খেলোয়াড় ছিলাম না। খেলার প্রতিভা আমার ছিল না। কিন্ত আগ্রহের জন্যে কালাচাঁদ স্যার খুব স্নেহ করতেন। শীতের সময় ক্রিকেটের সমস্ত সামগ্রী আমাদের হেফাজতে থাকত। সঞ্জীব ছিল ফাস্ট বোলার। বল করার ধরন খানিকটা ওয়েস্ট ইন্ডিজের ম্যালকম মার্শালের মতো। বল ফেস করতে বুক দুরুদুরু করত। ঠিক এরকম ভয়ংকর ফাস্ট বোলার ছিল শান্তিবাবু সিংহ। সহপাঠী অমলেন্দুর ভাই দীপ্তেন্দুও ছিল ফাস্ট বোলার। অনুপ পাল, মনোজ, প্রফুল্ল সিংহের ভাই কেংকালু ছিল স্পিন বোলার। কেংকালু উইকেটকিপারও ছিল। এছাড়া নিয়মিত খেলতে আসত আমাদের সিনিয়র কাজল সিংহ। রাধাকান্ত সিংহ। কীর্তি সিংহ। বন্ধুদের মধ্যে সুবল সিংহ, বিদ্যামণি সিংহ, প্রিয়তোষ। জুনিয়রদের মধ্যে বট্টি, সত্যসুন্দর, বিমলেন্দু।
নদীর পারে প্রাইমারি স্কুলের মাঠে ফুটবল খেলা হত। বড়োদের সেই খেলায় আমাদের ভূমিকা ছিল দর্শকের। ছোটোদের মধ্যে পঞ্চুকে ও গোলকিপার সন্তোষকে নেওয়া হত। সিনিয়রদের মধ্যে নিয়মিত খেলতেন কাজল সিংহ। প্রফুল্ল সিংহ। শান্তিবাবু সিংহ। সুব্রত সিংহ। টুটুল দাস, রাধাকান্ত সিংহ। রঞ্জিত রায়। সত্যবিকাশের দাদা সত্যবিজয়, যাকে সবাই বিজু ডাকত। বিজু খেলত ব্যাক পজিশনে। কালাচাঁদ স্যার মাঝেমাঝেই রেফারি থাকতেন। মাঝেমাঝে বাড়িতে এলে কাজল পালও খেলতে আসতেন। কাজল পাল ছিলেন উদয়পুরে রমেশ স্কুলের শারীর শিক্ষক। ধনঞ্জয় সিংহ নামে একজন দুর্ধর্ষ গোলকিপার কদাচিৎ খেলতে আসতেন। ধনঞ্জয়দা তখন আগরতলায় পড়তেন। সহপাঠী অমলেন্দু ও ভাই বিমলেন্দু সিংহও বেশ ভালো ফুটবলার ছিল। তাছাড়া খেলত সমীর দেব। শ্যামল মালাকার। রসিরউদ্দিন। কামালউদ্দিন। কৃষ্ণধন সিংহ। অমর সিংহ। মেঘদূতদা। কিশোর সিংহ। বট্টি। সমরজিৎ সিংহ ওরফে জম্পাই। হঠাৎ হঠাৎ সজল এসে খেলোয়াড়ের কায়দায় হাফপ্যান্টের ভেতর শার্ট গুঁজে খেলার জন্যে রেডি থাকত। ভালো খেলত না বলে স্বাভাবিকভাবেই বাইশ জন হয়ে গেলে ওকে আর নেওয়া হত না। আমরা যারা বড়োদের ফুটবলে চান্স পেতাম না, মাঝেমাঝে আমাদের স্কুলের মাঠে খেলতাম। নেশা এত বেশি ছিল যে বৃষ্টি ভিজেও খেলেছি। ভলিবল ও বাস্কেটবলও খেলেছি। ভলিবলে জিতেন চ্যাটার্জি ও মৃণালদা ছিল তুখোড় স্ম্যাশার। জিতেনদার খেলার স্মার্টনেস এখনো চোখে ভাসে। জিতেনদার স্ম্যাশ ফেরানো প্রতিপক্ষের জন্যে খুব একটা সহজ ছিল না। খুব ভালো ব্যাডমিন্টন খেলত মেঘদূতদা। মাঝেমাঝে সিরিয়াস কিছু ম্যাচ হত। কুলাই টিমের সঙ্গে একবার প্রাইমারি স্কুলের মাঠে ক্রিকেট ম্যাচ হয়েছিল। মাইকে সেদিনের খেলার রিলে করেছিলেন মদন স্যার। একবার ফুটবল টুর্নামেন্টও হয়েছিল প্রাইমারি স্কুলের মাঠে। সে কী টানটান উত্তেজনা। আগরতলা থেকে আমার আগের স্কুলের পিন্টু ও শচীনকে হায়ার করে আনা হয়েছিল। ফাইনালের দিন তো দুপক্ষের সমর্থকদের মধ্যে মারামারি হওয়ার উপক্রম। সে যাত্রা আমাদের স্কুল হেরে গেছিল। কমলপুরের সঙ্গে ভলিবল ম্যাচ হলে মায়াছড়ি থেকে জিতেনদাদের বয়সি কমল নামে একজন প্লেয়ার খেলতে আসত যার খেলা আমার খুব ভালো লাগত। ভলিবলেও রেফারি থাকতেন কালাচাঁদ স্যার।
আমাদের স্কুলের মতো এত বর্ণাঢ্য অ্যানুয়েল স্পোর্টস আমি আগরতলাতেও দেখিনি। তিনটে নতুন ইভেন্ট আমি হালাহালিতে এসেই দেখতে পেলাম। পোল ভল্ট। জ্যাভলিন থ্রো। স্লো বাইসাইকেল রেস। হালাহালি থেকে বেশ কিছু প্লেয়ার ন্যাশনাল মিট করেছিল। কৃষ্ণ ঠাকুরের মেয়ে লক্ষ্মী শর্মা। অ্যাথলেটিকসে ন্যাশনাল মিট হাই জাম্পে সেকেন্ড পজিশন। ক্যারাটে মাস্টার মৃণালদার ভাই বিজন সিংহ ছিল ভলিবল ও বাস্কেটবলে ন্যাশনাল প্লেয়ার। স্কুলে বিজন আমাদের এক ক্লাস জুনিয়র। অ্যাথলেটিকসে ন্যাশনাল লেভেলের রানার প্রণতি শুক্লবৈদ্য। আরেক বিজন সিংহ ছিল দেবীছড়ার। নর্থ ইস্ট লেভেলে দৌড়ে গোল্ড মেডালিস্ট। নদীতে স্নান করতে গিয়ে দেখা হয়ে গেলে চরে ব্যাকভল্ট করে দেখাত আমাকে। কাবাডিতেও হালাহালি স্কুল বেশ ভালো স্থান করে নিয়েছিল। ভদ্রা সিংহ, দীপক পাল, রাজকুমার সিংহ ছিল কাবাডির ন্যাশনাল প্লেয়ার।
ক্রমশ…
খুব ভাল লেগেছে …. জানিনা কেন এথানে টাইপ করতে খুব অসুবিধা হচ্ছে…
খুব ভাল লেগেছে …. জানিনা কেন এখানে টাইপ করতে খুব অসুবিধা হচ্ছে…
দারুন এগোচ্ছে। এত কিছু স্মৃতি এখনও মনে আছে, সাবলীল ভাবে লিখে যাচ্ছো, ভাল লাগছে, অবাকও হচ্ছি প্রবুদ্ধ! নামজপ কী এখনও করছো? জপের একটা মহত্ব নিশ্চয়ই আছে। আমার ছোট বোন এর পরিবারে সবাই অনুকুল ঠাকুরের শিষ্য। দেখেছি ওরাও করে। দে পদবী অসমীয়া দের মধ্যে আছে, জানতাম না। যাক লেখা এগিয়ে চলুক।শুভেচ্ছা…
বেশ। আবার দশমের অপেক্ষায় ।
খুব ভালো লাগ। প্রাণ খুলে লিখে যা।