Daruharidra
  • ধান্যগৃহ
  • কবিতা
  • গল্প
  • গদ্য
  • প্রবন্ধ
  • উপন্যাস
Daruharidra
  • ধান্যগৃহ
  • কবিতা
  • গল্প
  • গদ্য
  • প্রবন্ধ
  • উপন্যাস
Daruharidra
No Result
View All Result
Home গদ্য

প্রবুদ্ধসুন্দর কর || দশম পর্ব

নীল উপত্যকার রাখাল || পর্ব -দশ

Daruharidra by Daruharidra
16/05/2021
in গদ্য
7
প্রবুদ্ধসুন্দর কর || দশম পর্ব
329
VIEWS

১১

আমবাসা-কমলপুর রোডে নাকফুলের ছোট্ট ব্রিজ পেরিয়ে একটু এগোলেই হালাহালি দ্বাদশ শ্রেণি বিদ্যালয়। এর আগে পাবলিক হেলথ সেন্টার। আমরা যখন প্রথম যাই তখন ডাক্তার ছিলেন গৌরীশঙ্কর বাবু। তখনকার মফস্বলে ডাক্তার একজন ভি আই পি বই-কি। তিনি বেশিদিন ছিলেন না। এরপর আসেন ডাক্তার কিষান রায়। ছিপছিপে যুবক। কৈলাসহরে বাড়ি। দুঃসাহসী। ডিউটির পর পায়ে হেঁটেই এদিক সেদিক ঘুরে বেড়ান। কিষান রায়কে নিয়ে ফিসফিসানি ছিল তিনি নাকি নকশাল রাজনীতি করেন। সুধীর দাস তখন সি পি আই এমের তরুণ তুর্কি নেতা। একদিন হেলথ সেন্টারে কোনো একটা ব্যাপারে কিষান রায় ও সুধীর দাসের মধ্যে তর্কাতর্কি হতে হতে প্রায় হাতাহাতির উপক্রম। কিষান রায়ও গলা থেকে স্টেথো খুলে হাতে নিয়ে মারমুখী। লোকজন দৌড়ে এসে দুজনকেই নিরস্ত করে। কিষান রায়ের পর জয়েন করেছিলেন ডাক্তার লক্ষ্মী সিংহ।

হালাহালি স্কুলে ঢোকার ডানদিকে বড়ো একটি পুকুর। পুকুর পেরিয়ে ডানদিকে ভলিবল কোর্ট। আরেকটু এগিয়ে ডানদিকে বাস্কেটবল কোর্ট। কোর্টের ডানদিকে বেশ বড়ো খেলার মাঠ। বাঁয়ে একটি আমগাছের চারদিকে গোল করে বাঁধানো পাকা বেদি। আমগাছের বাঁয়ে ক্যাম্পাস হল। স্কুলের আলাদা কোনো পাঁচিল নেই। এমনভাবে তৈরি, ক্লাসের দেওয়ালগুলিই পাঁচিল। দুদিকেই প্রবেশপথ। বাঁয়ে লাইব্রেরি। ডানদিকে সামনের বারান্দায় প্রথমে অফিসরুম। এরপরে হেডমাস্টারের রুম। ডানদিক দিয়ে ঢুকলে বাঁহাতি সামনের বারান্দায় টিচার্স কমনরুম। ভেতরে বারান্দা দিয়ে ঘেরা। শেষ প্রান্তে ডানদিকে মেয়েদের টয়লেট। বাঁয়ে ছেলেদের টয়লেট। স্কুলের ভেতরে তিনদিকে বারান্দা ঘেরা ঘাসে ঢাকা মাঠ। পশ্চিমের বারান্দায় টিচাররা দাঁড়াতেন প্রেয়ার এসেম্বলির সময়। নীচে মাঠে ক্লাসের ক্রমানুসারে ছাত্রছাত্রীরা। প্রেয়ার কমান্ড দিত সিনিয়র কানাইদা। জাতীয় সংগীতের পর সংকল্পপাঠ। বাণীপাঠ হত।

স্কুলের পেছনে অভিজিৎদের বাড়ি ছাড়াও পাশাপাশি চিত্র স্যারের বাড়ি। পাশে ক্যারাটে মৃণালদাদের বাড়ি। স্কুলমাঠের পশ্চিম প্রান্তে কয়েকটি বাড়ি। বাড়িগুলির লাগোয়া রাস্তা পশ্চিম হালাহালির দিকে গেছে। স্কুলের পেছন দিকে একটি গলি দিয়ে খানিকটা গেলেই অপরেসকরের রাস্তা। সেই রাস্তার পাশেই সহপাঠী রমেনের বাড়ি। বাবার বন্ধু ঈশ্বর সিংহের বাড়ি। একসময় দুজনেই কল্যাণপুরে চাকরি করেছেন। কাছেই কালাচাঁদ স্যারের বাড়ি। স্কুলের লাগোয়া দক্ষিণ দিকে আরেকটি গলি। গলির ডানদিকে সিনিয়র অনীতাদিদের বাড়ি। বাঁয়ে সুশীলদাদের বাড়ি। সহপাঠী বিজয়াদের বাড়ি। বিজয়াদের এক ভাই বিজন। জন্ম থেকেই জড়বুদ্ধি। সারাদিন ঘোরাফেরা করত। সমবয়সি কাউকে পেলেই পেটে জোর চিমটি কেটে আর ছাড়তে চাইত না। বিজনকে আমরা বাঘা বলে খেপাতাম। বাঘা ডাকটি শুনলেই বিজনের রক্ত উঠে যেত মাথায়। যে-ই ডাকত তাকে তাড়া করত। আমি খুব ভয় পেতাম বিজনকে। একদিন বাঘা বলে আওয়াজ দিয়ে পালিয়ে গেছিলাম। পরের দিন আমাকে বাগে পেয়ে পেটে রামচিমটি। প্রাণ বেরিয়ে যাওয়ার জোগাড়। কিছুতেই ছাড়ছে না। আমি যন্ত্রণায় চিৎকার করে বলছি, ছাড় বাঘা ছাড়, আর কোনোদিন কইতাম না। ছাড় বাঘা ছাড়। চিমটির ডিগ্রি আরও বেড়ে গেল। বুঝলাম যে যন্ত্রণার চোটে কী ভুল আমি করে ফেলেছি! বিজন আমাকে বলছে, ঐ তো দেখি আবার কস। কাকুতি মিনতি করে শেষে ছাড়া পাওয়া গেল। বিজয়াদের বাড়ির পরেই জিতেনদা, দুলালদাদের বাড়ি ও মণ্ডপ। এই গলিটিও দক্ষিণে অপরেসকরের রাস্তায় গিয়ে পড়েছে।

অপরেসকর থেকে ও আরেকটু ভেতর থেকে আসত সহপাঠী গ্রহণ দেববর্মা, নিয়তি বর্মন, চন্দন, নৃপেশ, রবীন্দ্র। হঠাৎই একদিন এক বাজারবারে রবীন্দ্রকে দেখলাম রিকশায় বউ নিয়ে বাড়ির দিকে যাচ্ছে! আমাকে দেখেও না দেখার ভান করল। বাড়ি ফিরে বাবাকে জানালাম। বাবা বললেন, কালকে স্কুলে গিয়া তারে জিগাইবি, কী রে, রিকশায় যে তোর সঙ্গে মহিলারে দেখলাম, তোর মাসি নিকি? পরদিন স্কুলে গিয়ে সবাইকে বললাম। না হয় আমাদের চেয়ে বয়সে বড়ো, তা বলে ক্লাস এইটে পড়তেই বিয়ে! অবশ্য সেদিনের পর থেকে রবীন্দ্র আর স্কুলে আসেনি। আমাদের স্কুলে তিনজন গ্রুপ ডি। ভরত বেহারা। নেপাল। আর এক বিধবা মধ্যবয়স্ক মাসি। দাঁত ব্যথা হলে ভরতদা ব্যথা কমানোর মন্ত্রপূত তাবিজ দিত লোকজনকে। তখন শশী কাপুর অভিনীত একটি ছবির গান খুব মুখে মুখে ফিরত। ইস দুনিয়া মে কৌন সে ওয়ারে সবকে বিগড়ে কাম / ভরত কা ভাই লক্সমন, লক্সমন কা ভাই রাম। সহপাঠী সজল গানটির প্যারডি করেছিল, ভরত কা ভাই নেপাল, নেপাল কা বেহেন মাসি। স্কুলে অনেক প্রেমিক-প্রেমিকা জুটিও ছিল। ফলে, প্রেমপত্রের চিঠি চালাচালির চল থাকাটাই স্বাভাবিক। একটু নিভৃতে, শুনসান রাস্তায়, গলিতে এইসব চালাচালি হত। বইয়ের ভাঁজে করে, কখনো বা বিদ্যুৎগতিতে প্রকাশ্যে। নিভৃতি বলতে জুটিদের কিছুই ছিল না। এক পলকের দেখা, সাইকেল নিয়ে স্কুল ছুটির পর প্রেমিকার পাশাপাশি বা পেছন পেছন যাওয়া, এটুকুই। কেউ কেউ বেশ সাহস করে রাস্তায় দেখা করত। কথা বলত। গ্রুপ ডি নেপালদা একবার একটি ছাত্রের প্রেমের প্রথম চিঠি কোনো এক ছাত্রীকে দিতে গিয়ে ফেঁসে গেছিল। ওই মেয়েটির অভিভাবক ঘটনাটি বাবাকে জানালে বাবা নেপালদাকে শোকজ করেন। সেদিন রাতে আমাদের বাড়ি এসে নেপালদার সে কী কান্না! স্যার, ইটা না কইরা আপনে আমারে দুইটা চড় মারতেন! ইটা কিতা করলেন স্যার। অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে সাবধান করে নেপালদাকে বাড়ি পাঠানো হয়েছিল। হালাহালিতে আমাকে কোনো মেয়েই কখনো প্রেমের চিঠি দেয়নি। বাঁকা চোখে তাকায়ওনি। তবে বন্ধুদের কারো কারো চিঠি মাঝে মাঝে পড়াত। অজস্র ভুলে ভরা, পারফিউম ছিটানো সেইসব চিঠিতে মাঝেমাঝে কিছু ভালোবাসার ছড়াও থাকত।

কাস্মীরের K গো তুমি
ইন্ডিয়ার I
তার সাথে SS দিয়ে
তোমায় দিতে চাই।

এসব দেখে শুনে আমারও যে কোনো মেয়ের কাছ থেকে চিঠি পাওয়ার ইচ্ছে করত না, তা নয়। কিন্তু বাংলা বানানের যা ছিরি, ইচ্ছেটাই মরে যেত। খুবই ছোটো বয়সে মা যে আমাকে আদর্শলিপি থেকে বানান শিখিয়েছিলেন, তারপর থেকে আমার বাংলা বানান ভুল হয় না। আমাকে বরং আকর্ষণ বেশি করত উপরের বিভিন্ন ক্লাসের কয়েকজন ছাত্রী। এই ইচ্ছেটাকে দমিয়েই রাখতাম। তাছাড়া দেখতেও ছোটোখাটো। প্রেম নয়, মেয়েরা হয়ত স্নেহের চোখেই বেশি দেখত। হেডমাস্টারের ছেলে, কিছু হলে ছিছিক্কার হবে। বাবার সম্মানহানি হবে, এই ভয়টাও কাজ করত। হঠাৎই একদিন আবিষ্কার করলাম, আমার তলপেট ছোটো ছোটো হালকা রোমে ছেয়ে গেছে! প্রথমটায় একটু আঁতকে উঠলেও নিজেকে সামলে নিলাম। আমাকে তো আগে থেকে কেউ বলেনি, এরকম হতে পারে! কাউকে বলতেও পারছি না। বাবাকেও না। সঞ্জীবকেও না। চন্টুকেও না। সজলকে বললে হয়ত কিছু বলতে পারবে। এই বিস্ময় নিয়ে কয়েকদিন ঝিম মেরে রইলাম। ক্লাস থ্রি থেকে বড়োদের উপন্যাস পড়ি, তবু শারীরিক এই পরিবর্তন আমার কাছে যেন এক বিপন্ন বিস্ময়! এক অদ্ভুত ভয়মেশানো শিহরন।

১২.

হালাহালিতেই আমি প্রথম দূর থেকে ঝেঁপে বৃষ্টি আসতে দেখেছি। সঙ্গে শোঁ শোঁ আওয়াজ। হালাহালিতে বৃষ্টি ভালোই হত। গ্রীষ্মের ছুটিতে কখনোই গরমে খুব একটা কষ্ট পাইনি। গোটা ত্রিপুরাতেই তখন বৃষ্টিপাতের হার যথেষ্ট ভালো ছিল। বৃষ্টির পর লংতরাইয়ের রং পালটে অন্যরকম হয়ে যেত। এত স্পষ্ট হয়ে উঠত, মনে হতে পাহাড়টি খুব বেশি দূরে নয়। কখনো কখ‌নো বৃষ্টির পর রামধনু উঠত। কোনো কোনো বিকেলে বৃষ্টির মাঝখানেই হঠাৎ রোদ। আমরা ছোটোবেলায় বলতাম শিয়ালের বিয়া। এরকম মুহূর্তে নাকি শেয়ালের বিয়ে হয়।

বর্ষার ধলাই ভয়ংকর। ঘোলা জলের পাগলা স্রোত। সে সময় কমলপুর মহকুমায় মরাছড়ার ঝুলন্ত ব্রিজ ছাড়া ধলাই নদীর উপর আর কোনো ব্রিজ ছিল না। বন্যার স্রোত সমস্ত বাঁশের অস্থায়ী সাঁকো ভাসিয়ে নিয়ে যেত। তখন নদীর পূর্ব ও পশ্চিম পারের একমাত্র ভরসা নৌকা। হালাহালি-দেবীছড়া পারাপারের মাঝি তিনজন। সত্যেন্দ্র পাল। বামচা সিংহ। অতুল মালাকার। আর উত্তর হালাহালি ও মহাবীর চা-বাগানের পারাপারের মাঝি বেণু ও কানু দুই ভাই। নৌকা খুব বড়ো নয়। বর্ষার সময় ত্রিশ/ চল্লিশ জন যাত্রী নিয়ে স্রোতের উল্টো দিকে নৌকার অভিমুখ। মনে হত এই বুঝি নৌকাডুবি হবে। স্রোতের উল্টো দিকে অনেকটা দূরে মাঝিরা লক্ষ্য স্থির করলেও স্রোতের প্রবল টানে নৌকা গিয়ে ভিড়ত দেবীছড়ার নির্দিষ্ট ঘাট থেকে অনেকটা এগিয়ে। তখনো মহকুমায় কোনো নৌকাডুবির দুর্ঘটনা ছিল না বললেই চলে। পাহাড়ে বৃষ্টিপাতের উপরই নদীর ফুলে ওঠা নির্ভর করে। এমনও হয়, হালাহালির আবহাওয়া হয়ত মেঘলা নয় বা বৃষ্টি নেই। কিন্তু ধলাই ফুলে ফেঁপে উঠত। বর্ষায় জমা জল বেরিয়ে যাওয়ার জন্যে খেতের আল কেটে দেওয়া হত। ওই কাটা আলে বাঁশের তৈরি উপা পেতে রাখা হত মাছ ধরার জন্যে। ছোটো ছোটো মাছ একবার উপাতে ঢুকে পড়লে আর বেরুতে পারত না।

হঠাৎই একদিন সন্ধ্যায় মানিক দাদুদের বাড়ির পেছনে সেই ফরিজউদ্দিন পির সাইকেল চালিয়ে চৌধুরীবাড়িতে এসে হাজির। এসেই বড়মাকে বললেন, চলো গো মাঈ ঠাকুরঘরো চলো। পিরের কথা দিদা মানে মানিক দাদুর বউয়ের কাছ থেকে আগেই শুনেছিলাম। পিরের থানে মাঝেমাঝে গিয়ে দিদার ধূপকাঠি, মোমবাতি জ্বালানো, পিরকে এটা সেটা প্রশ্ন করা মানিকদাদুর পছন্দ ছিল না। একদিন বিকালে দিদা গেলে ফরিজউদ্দিন পির দিদাকে বললেন, তর জামাই যখন আমার অনো আওয়া ভালা পায় না, তে তুই আছ্ কেনে? বিবাহিত সিলেটি নারীরা নিজের স্বামীকে জামাই বলে। পিরের কথা শুনে দিদা তো অবাক। পির কী করে জানলেন দাদুর অপছন্দের কথা! লজ্জায় দিদা আর কথা বলতে পারেননি। ফরিজউদ্দিন পির দেখতে খুব একটা লম্বা নয়। ছিপছিপে গড়নের। মুখে দাড়ি। পরনে লাল ধুতি। খালি গা। দুই হাতে বালা। পলা ও কাচের চুড়ি। ঠাকুরঘরে আসন পেতে দিতে বললেন। ধূপকাঠি ও মোমবাতি জ্বালানো হল। দুই কাঁধ নাচিয়ে নাচিয়ে, দুই হাতের চেটো ঠুকে ঠুকে চুড়ির রিনরিন ধ্বনির তালে তালে পরপর দুটো কীর্তন গাইলেন। একটি কীর্তনের শুরুর লাইন, গুরুপদে মকরন্দে…। মকরন্দ শব্দটি বেশ লাগল। কিন্তু অর্থ তো জানি না। অনেক বছর পরে জেনেছি, মকরন্দ শব্দের অর্থ মধু। কীর্তনের পর মোম ও ধূপকাঠি হাতে বাড়ি প্রদক্ষিণ করে বললেন, রোজ সন্ধ্যায় হরিবোল গাইবায়। আমার ও পুতুর দায়িত্ব বেড়ে গেল। সন্ধ্যায় বড়োবাবার হরিবোলের পর বড়মার ঠাকুরঘরে আবার।

কমলপুর মহকুমায় ফরিজউদ্দিন পির ও অনন্ত সাধু, এই দুজনই রহস্যময় মানুষ। কী এমন আছে এঁদের ভেতর যে লোক ছুটে আসে। বামনছড়ায় অনন্ত সাধুর আশ্রম। আগরতলা থেকে রাজনৈতিক নেতারা ছুটে আসে অনন্ত সাধুর কাছে। রাধিকারঞ্জন গুপ্ত, সমীর বর্মণ, আরও অনেক রাজনৈতিক নেতা, ব্যবসায়ী, বিভিন্ন ধরনের মানুষের আনাগোনা। ফরিজউদ্দিন পির অনন্ত সাধুকে একদম সহ্য করতে পারত না। সাধুর নাম শুনলেই বলত, ইগু পেরত বা। তার খালি বড়োলোকর লগে কারবার। তুই ব্যাটা সাধু, টাকা দিয়া কিতা করতে রে? সিলেটিতে পেরত মানে প্রেতের অপভ্রংশ। তবে পির সম্পর্কে অনন্ত সাধুর বক্তব্য অবশ্য জানা যায়নি। আমি দু-বারই দেখেছি অনন্ত সাধুকে। চৌধুরীবাড়ির পেছনে কুশিয়ার খেতের মালিক পরেশ দেবের বউ আরতিদি আমাদের দূর সম্পর্কের আত্মীয়। বাবাকে কাকু ডাকতেন। একবার পরেশ দেবের বাড়িতে অনন্ত সাধু এসে একরাত ছিলেন। এসেই বললেন, হেডমাস্টররে খবর দেও আমি আইছি। বাবাকে খুব ভালোবাসতেন। সেদিন বাবার সঙ্গে আমিও গেছিলাম। গিয়ে দেখি, ধুতি পাঞ্জাবি পরা ছোটোখাটো খুবই সাধারণ এক বুড়ো মানুষ। খাটে বসে আছেন। বাবাকে ইশারা করে পাশে বসতে বললেন। বাবার সাথেসাথে আমিও প্রণাম করলাম। বাবাকেও দাদু বলেই সম্বোধন করতে শুনলাম। দু একটা কথা বলার পর বাবাকে বললেন, ঠাকুরর গান শোনাও। দুটো গান শোনার পর খানিকক্ষণ চোখ বুঁজে রইলেন। চোখ খুলে বাবাকে বললেন, আমার আশ্রম অটা তোমারে দিলাইমু। আমি মরি গেলে তুমি চালাইবায়। অনন্ত সাধুকে শেষ দেখি তাঁর আশ্রমে। বাসন্তীপূজার ভোগ খেতে গিয়ে।

ক্লাস এইটে হঠাৎই একদিন একটি কবিতা লিখে ফেলি। কাকে পড়ানো যায়? সন্তোষ স্যার ছিলেন আমাদের ক্লাসটিচার। সন্তোষ স্যার আমাদের বাংলা পড়াতেন। কালো মতো, চাষাড়ে চেহারা। কথায় কথায় বক্রোক্তি করতেন। কবিতাটি স্যারকেই পড়ালাম ক্লাস শেষ হওয়ার দু-তিন মিনিট আগে। পড়ে কিছুই বললেন না। বাবা সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে বললেন, তুই কবিতা লেখছস? মাথা নাড়লাম। সন্তোষবাবু কইলেন। আমি স্যারের প্রতিক্রিয়া শোনার জন্যে উদগ্রীব, স্যার কী কইল? বাবার চোখেমুখেও খুশির অভিব্যক্তি। সন্তোষবাবু কইলেন, স্যার প্রবুদ্ধের একটু যত্ন নিয়েন। সে একটু অন্যরকম। তার লেখার হাত আছে। ভবিষ্যতে লেখব সে। স্যারের প্রতিক্রিয়া শুনে আমার বুকের ছাতি যেন ফুলে উঠল। ক্লাস এইটে ইংরেজি পড়াতেন কালাচাঁদ স্যার। খেলার নেশার জন্যে স্যার আমাকে খুব স্নেহ করতেন। একবার মরাছড়া স্কুলের সঙ্গে বাস্কেটবল ম্যাচ। খুব ভালো বাস্কেটবল আমি খেলতাম না। সিলেকশনের শেষে স্যার বললেন, প্রবুদ্ধ তুমি আমরার টিম ম্যানেজার হইয়া যাইবায়। সেই প্রথম আমার ধলাই নদীর উপর ঝুলন্ত ব্রিজ পেরিয়ে মরাছড়া যাওয়া। এইটে আমাদের অঙ্ক করাতেন গোপ স্যার। স্যারের মুখে হালকা সুতোর মতো একটি হাসি লেগেই থাকত। বেত হাতে ক্লাসে ঢুকতেন। ভুল হলে আর রক্ষা নেই। ছাত্রছাত্রীদের কাছে সবচেয়ে প্রিয় ছিলেন হরিপদ গোপ। ভূগোল পড়াতেন চিত্র স্যার। পেটে রামচিমটি কাটতেন পড়া না পারলে বা ক্লাসে দুষ্টুমি করলে। কখন যে চিমটি কাটবেন স্যারের মুখ দেখে বোঝা যেত না। প্রাকৃতিক বিজ্ঞান পড়াতেন পরিতোষ স্যার। রাগি চেহারার। মারতেনও ছাত্রদের। জীবন বিজ্ঞান পড়াতেন আগরতলার সমীর স্যার। তখন হালাহালিতে একটা কথা খুব চাউর হয়েছিল, সমীর স্যার নাকি ত্রিপুরার সেরা দশজন ক্রিকেটারদের একজন। স্যারের শারীরিক গড়ন দেখে স্পোর্টসম্যান বলে মনে হত না। যদিও দুয়েকদিন আমাদের ব্যাট ধরার কায়দা ফায়দা শিখিয়েছিলেন। স্যারের শ্বাসকষ্টের সমস্যা ছিল। স্যারের মিমিক্রি করে দেখাত সহপাঠী কাঞ্চন ওরফে পিন্টু। পিন্টু খ্যাপাটে ধরনের ছেলে। সমীর স্যার কথা বলতেন টেনে টেনে হালকা মেয়েলি ভঙ্গিতে। ক্লাসে পিন্টুকে কিছু জিগ্যেস করলে পিন্টু স্যারের কায়দায়ই উত্তর দিত। এতেও ক্ষান্ত হত না, বাজারে গিয়ে স্যার যেসব দোকানদারের কাছে গিয়ে সবজি, মাছ, মাংসের দরদাম করতেন, পিন্টু সেখানেও হানা দিয়ে স্যারের পাশে দাঁড়িয়ে সেই কথা বলার স্টাইলে স্যারকে শুনিয়ে শুনিয়ে দর জিজ্ঞেস করত। অতীন্দ্র স্যার ইতিহাস পড়াতেন আমাদের। বেশ লম্বা। ধুতি, কলার দেওয়া পাঞ্জাবি। চোখে মোটা ডাঁটির চশমা। টেবিলে বসে পায়ের উপর পা তুলে পড়াতেন। অতীন্দ্র স্যার একবার রেগে গেলে দমাদ্দম মারতে শুরু করে দিতেন।

ক্রমশ…

Tags: গদ্যধারাবাহিক গদ্যপ্রবুদ্ধসুন্দর কর
Previous Post

প্রবুদ্ধসুন্দর কর || নবম পর্ব

Next Post

অমিতাভ দেব চৌধুরী || তৃতীয় পর্ব

Daruharidra

Daruharidra

Next Post
অমিতাভ দেব চৌধুরী || তৃতীয় পর্ব

অমিতাভ দেব চৌধুরী || তৃতীয় পর্ব

Comments 7

  1. Chirasree Debnath says:
    1 year ago

    ক্লাস এইটের কবিতাটা

    Reply
  2. T Mohanta says:
    1 year ago

    ক্লাস এইটের কবিতাটি সংগ্রহে আছে?

    Reply
  3. চঞ্চল চক্রবর্তী says:
    1 year ago

    এবারে অনেক গল্প। ভাল লাগছে , ভাল লাগছে।

    Reply
  4. Amitabha Dev Choudhury says:
    1 year ago

    প্রবুদ্ধ, সত্যিই জমে গেছে । ওই কবিতাটা কি মনে পড়ে ?

    Reply
  5. কমলিকা মজুমদার says:
    1 year ago

    আপনার মেমোরী কে সেলাম…কি করে এমন ছবির মতো মনে রাখলেন

    Reply
  6. সমীর মজুমদার says:
    1 year ago

    খুব ভালো লাগ, চালিয়ে যা।

    Reply
  7. বিকাশ সরকার says:
    11 months ago

    বীরপাড়া উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পড়বার সময়ে আমারও ইংরেজি শিক্ষক ছিলেন কালাচাঁদ স্যার। কালাচাঁদ দাস। তিনি কবিতাও লিখতেন। উত্তরবঙ্গের সেরা কবিদের নিয়ে একটি সংকলন প্রকাশ করেছিলেন তুষার বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই সংকলনেও তাঁর কবিতা স্থান পেয়েছিল। তিনি আবার এলাকার খুব নামী ফুটবলারও ছিলেন। প্রবুদ্ধর কালাচাঁদ আমার কালাচাঁদকে মনে করিয়ে দিলেন।

    Reply

Leave a Reply Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

No Result
View All Result

RECENT POSTS

মেখলা পরা মেয়ে || শ্রীযুধাজিৎ || অন্তিম পর্ব

মেখলা পরা মেয়ে || শ্রীযুধাজিৎ || অন্তিম পর্ব

15/04/2022

সঞ্জয় চক্রবর্তী || অন্তিম পর্ব

09/04/2022
মেখলা পরা মেয়ে || শ্রীযুধাজিৎ || দ্বাবিংশতি পর্ব

মেখলা পরা মেয়ে || শ্রীযুধাজিৎ || দ্বাবিংশতি পর্ব

08/04/2022

সঞ্জয় চক্রবর্তী || নবম পর্ব

02/04/2022
মেখলা পরা মেয়ে || শ্রীযুধাজিৎ || একবিংশতি পর্ব

মেখলা পরা মেয়ে || শ্রীযুধাজিৎ || একবিংশতি পর্ব

01/04/2022

সঞ্জয় চক্রবর্তী || অষ্টম পর্ব

27/03/2022
মেখলা পরা মেয়ে || শ্রীযুধাজিৎ || বিংশতি পর্ব

মেখলা পরা মেয়ে || শ্রীযুধাজিৎ || বিংশতি পর্ব

25/03/2022
সঞ্জয় চক্রবর্তী || সপ্তম পর্ব

সঞ্জয় চক্রবর্তী || সপ্তম পর্ব

20/03/2022
মেখলা পরা মেয়ে || শ্রীযুধাজিৎ || উনবিংশতি পর্ব

মেখলা পরা মেয়ে || শ্রীযুধাজিৎ || উনবিংশতি পর্ব

18/03/2022
ষষ্ঠ পর্ব || সঞ্জয় চক্রবর্তী

ষষ্ঠ পর্ব || সঞ্জয় চক্রবর্তী

13/03/2022

RECENT VIDEOS

https://www.youtube.com/watch?v=77ZozI0rw7w
Daruharidra

Follow Us

আমাদের ঠিকানা

দারুহরিদ্রা
কুঞ্জেশ্বর লেন
(বরাকভ্যালি একাডেমির নিকটবর্তী)
নতুন ভকতপুর, চেংকুড়ি রোড
শিলচর, কাছাড়, আসাম
পিন-788005

ডাউনলোড করুন

সাবস্ক্রাইব

Your E-mail Address
Field is required!
Field is required!
Submit
  • আমাদের সম্পর্কে
  • লেখা পাঠানো
  • যোগাযোগ

Copyright © All rights reserved Daruharidra | Development by Prosenjit Nath

No Result
View All Result
  • ধান্যগৃহ
  • কবিতা
  • গল্প
  • গদ্য
  • প্রবন্ধ
  • উপন্যাস
  • সাক্ষাৎ পাতা
  • অনুবাদ পাতা
  • আর্কাইভ
  • আমাদের সম্পর্কে
    • লেখা পাঠানো
    • যোগাযোগ

Copyright © All rights reserved Daruharidra | Development by Prosenjit Nath