Daruharidra
  • ধান্যগৃহ
  • কবিতা
  • গল্প
  • গদ্য
  • প্রবন্ধ
  • উপন্যাস
Daruharidra
  • ধান্যগৃহ
  • কবিতা
  • গল্প
  • গদ্য
  • প্রবন্ধ
  • উপন্যাস
Daruharidra
No Result
View All Result
Home গদ্য

প্রবুদ্ধসুন্দর কর || দ্বাদশ পর্ব

নীল উপত্যকার রাখাল || দ্বাদশ পর্ব

Daruharidra by Daruharidra
23/05/2021
in গদ্য
3
প্রবুদ্ধসুন্দর কর || দ্বাদশ পর্ব
361
VIEWS

১৪.

 

রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে এল। তবে, মর মানুগৈ মর মানুগরে কিদিয়া মারেরতা; সংলাপটি একটি স্মরণীয় পংক্তি হয়ে উঠল। বিশেষ করে বড়ো ক্লাসের ছাত্রদের মুখে মুখে ফিরত। সেদিন কে যে  চিৎকার করে এটি বলে উঠেছিল, জানা যায়নি। বিমল সিংহকে আমি প্রথম দেখি হালাহালি বাজারে। তখনও জানতাম না। হঠাৎই দেখি একজন রাশিয়ান যুবক, ফর্সা, গালে সোনালি দাড়ি, সঙ্গে প্রায় দশ বারোজন লোক, কোথাও যাচ্ছেন। এত সুন্দর পুরুষ খুবই কম চোখে পড়ে। পরে জেনেছি, সেই রাশিয়ানদের মতো দেখতে লোকটিই বিমল সিংহ। বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি। লেখালেখি করেন। দুঃসাহসী। নিজের সম্প্রদায় ছাড়াও অন্যান্য সম্প্রদায়ের কাছেও গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিত্ব। আরও অনেক গল্প শুনেছি তাঁর সম্পর্কে। অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয়। নিসর্গ প্রেমিক। বিমল সিংহের ভাই রকেট সিংহকেও দেখেছিলাম এক বন্ধুকে নিয়ে বাইক চালিয়ে স্কুলের সেই দেওয়াল পত্রিকা ও ছবির প্রদর্শনী দেখতে এসেছিলেন। রূপবান যুবক। বেশ লম্বা গড়নের। ফর্সা।

দুর্গাপূজা যে শুধু পুজোই নয়, সর্বজনীন উৎসবও, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এই পুজোর পর কেমন এক মনখারাপ নেমে আসে যা অন্য কোনো পুজোর পর হয় না। হয়ত হেমন্ত শুরু হয় বলে। মনে হয়, খেলা থেমে গেছে। কীরকম যেন এক হালকা হালকা শীত শীত। সন্ধ্যা নেমে এলে দূর ও কাছের আলোগুলি ম্রিয়মাণ লাগে। এ সময় কার্তিক মাস। লক্ষীপূজা হয়ে গেছে। অ্যানুয়াল পরীক্ষার আর দেরি নেই। কম্পিটিশন আমার ধাতে নেই। ক্লাসে প্লেস পেতে হবে, এ নিয়েও আমার কোনো মাথাব্যথা নেই। অভিজিৎকে আমি কখনোই প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবিনি। প্রশান্ত, মানবেন্দ্র, পঞ্চুকেও না। খুবই কমসময় পড়ি। তাও আবার কোনো কোনো দিন বাবার সঙ্গে বেরিয়ে যাই। এ নিয়ে মা-র গজগজ, বকাঝকা। রেগে গেলে মা আমাকে মরকেনেওরা ও বকাস বলে তেড়ে আসতেন। দুটোই সিলেটি গালাগাল। মরকেনেওরা মানে মৃত্যু যাকে তুলে নেয়। বকাস মানে বাচাল। আমার আগে মা এক মেয়ের জন্ম দিয়েছিলেন। ষষ্ঠীর নামকরণের পরদিন মেয়েসন্তানটি মারা যায়। সম্ভবত তাই আমাকে নিয়ে মায়ের এত সতর্কতা। পরে পুতুর জন্মের আগেও আরেকটি কন্যাসন্তান ভূমিষ্ঠ হয়েই মারা যায়। তাই পুতুকে বাবা একটু বেশিই ভালোবাসতেন। এই দুটি মৃত্যুর শোক সামলাতে মা-র বেশ সময় লেগেছিল। বাড়িতে থাকলে বোনের সঙ্গে খুনশুটি। বিকেলে খেলাশেষে সন্ধ্যার হরিবোলের পর সামান্য পড়াশোনা হয়ে গেলে চলে যাই আভাদিদের ঘরে। ভালো কিছু যদি খেতে পাই। ওদের সব ঘরে নিয়নের সাদা আলো। আমাদের ঘরে ডুমের হলুদ আলো। আলো চলে গেলে হ্যারিকেন। হ্যারিকেনের আলোয় যেদিন পড়তাম, সন্ধ্যার টিফিন ধোয়া চিঁড়া ও মিষ্টি থেকে কিছু চিঁড়া রেখে দিতাম চিমনিতে সেঁকে শুকনো করে খাওয়ার জন্যে। পরের দিন চিমনির হাল দেখে আবার মায়ের বকুনি। মা আমাকে বদতমিজ বলেও বকতেন। চিঁড়া শুকানোর ছোপ ছোপ চিমনি মেজে পরিষ্কার করে রাখতেন। এই কড়া ধাতের জন্যে সঞ্জীবও মাকে ভয় পেত।

কৃষ্ণ শর্মার মণ্ডপে আমি কোনো রাসলীলা দেখিনি। কার্তিক মাসের পূর্ণিমাতে বড়োলুৎমা মণ্ডপে কার্তিকরাস বা মহারাস হয়। এই রাসোৎসব সর্বজনীন। বড়োলুৎমার মহারাস ১২৬ বছর ধরে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। এই মণ্ডপটি মূলত বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরিদের। লুৎমার রাসের চেয়েও পুরোনো  বাংলাদেশের মাধবপুরের জোড়ামণ্ডপের রাস। এই জোড়ামণ্ডপ বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরিদের। মাধবপুরের রাস প্রায় ১৭৫ বছরের পুরোনো। মণিপুরিদের বেশ কয়েকটি রাসোৎসব রয়েছে। দিবারাস। আশ্বিন মাসের পূর্ণিমায় কুঞ্জরাস। নৃত্যরাস। বসন্ত ঋতুতে বসন্তরাস। ঝুলন পূর্ণিমায় ঝুলনরাস। শ্রীকৃষ্ণের গোষ্ঠলীলা ও বালক বয়সের খেলা নিয়ে উদুখলরাস। অবশ্য মণ্ডপ ছাড়াও যে-কোনো মণিপুরি গৃহস্থ বাড়িতে অস্থায়ী মণ্ডপ তৈরি করেও রাসলীলা হতে পারে। মণিপুরিরা রাসের মানত রাখে। মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হলে সেই রাস মণ্ডপে বা গৃহস্থের বাড়িতে অনুষ্ঠিত হয়। রাসলীলার গানের ভাষা ব্রজবুলি ও বাংলা। রাস অনুষ্ঠিত হওয়ার আগে প্রায় একমাস সময় নিয়ে রাসনৃত্যের প্রশিক্ষণ হয়। এই প্রশিক্ষককে বলা হয় রাসধারী। এ ছাড়াও দুজন মহিলা থাকেন যাদের সূত্রধারী বলা হয়। বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরিরা রাসধারীকে অজা বলেই সম্বোধন করে। অজা মানে মহাশয়। রাসের মৃদঙ্গ বাদককে বলে ডাকুলা। বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরিদের আরেকটি রাস আছে। একগোপীরাস। এই রাস সচরাচর অনুষ্ঠিত হয় না। এই রাসনৃত্যে একজনই গোপিনী আর একজন রাখাল। রাখাল বলতে শ্রীকৃষ্ণ। তবে এই রাসনৃত্যের সময় গোপিনীকেই শুধু মঞ্চে দেখা যায়। শ্রীকৃষ্ণের বেশে রাখাল থাকে পর্দার আড়ালে। দর্শকেরা শুধু সেই রাখালের নৃত্যরত পা দুটি দেখতে পায়। এই রাস বেশ ব্যয়সাপেক্ষ। কালেভদ্রে একগোপীরাস অনুষ্ঠিত হয়। লুৎমার মণ্ডপে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরিদের  কার্তিকরাস ও বসন্তরাসই হত। বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি ছেলেদের জীবনে একবার রাখালনাচ করা ও মেয়েদের একবার রাসে অংশগ্রহণ করা বাধ্যতামূলক।

কার্তিক মাসের পূর্ণিমাতে ১৭৭৯ সালে প্রথম রাসলীলা হয়েছিল মণিপুরে রাজর্ষি  ভাগ্যচন্দ্রের আমলে। স্বপ্নাদিষ্ট রাজা ভাগ্যচন্দ্র গোবিন্দজির মন্দির নির্মাণ করে বিগ্রহ স্থাপন করেন। শ্রীকৃষ্ণের এই গোবিন্দ নাম রেখেছিলেন দেবরাজ ইন্দ্র। গোবিন্দ শব্দের সংস্কৃত অর্থ গাঃ পশূন্ বিন্দতি ইতি গোবিন্দঃ। গবাদি পশুর যিনি আনন্দ বিধান করেন। গো অর্থাৎ গমন, বিন্দ মানে বিন্দু অর্থাৎ চলার কেন্দ্রবিন্দু যিনি।

গো শব্দের আরও অর্থ ইন্দ্রিয়,পৃথিবী, আলোক, সূর্য, জ্ঞান, বেদ, গমনশীলতা এই সবকিছুর যিনি নিয়ন্ত্রক, তিনি উৎস, তিনি গোবিন্দ। মূলত গো শব্দের যতগুলি অর্থ আছে সেই সবকিছুর যিনি আনন্দ বিধান করেন। জনশ্রুতি এরকম, রাজর্ষি ভাগ্যচন্দ্র স্বপ্নে দেখেন, মণিপুরের কায়না পাহাড়ে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ একটি কাঁঠালগাছ রূপে বেড়ে উঠছেন। সেই গাছ কেটে এনে এর কাঠ দিয়ে গোবিন্দজির বিগ্রহ তৈরি করে স্থাপন করা হয়। সেই মন্দিরেই রাজর্ষির চেষ্টায় মণিপুরে প্রথম রাসলীলা। গোপিনীদের সঙ্গে শ্রীকৃষ্ণের নৃত্যলীলাই রাস। মণিপুরের সেই প্রথম রাসে মহারানি নিজে বৃৃন্দার ভূমিকায় অংশ নিয়েছিলেন। রাজর্ষি  ভাগ্যচন্দ্র ছিলেন সেই প্রথম রাসের অন্যতম মৃদঙ্গ বাদক। রাজকুমারী বিম্বাবতী ছিলেন রাধার ভূমিকায়। বিম্বাবতী সারাজীবন কুমারীই থেকে যান। গোবিন্দজির সেবায়ই নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন। ত্রিপুরার মহারাজা দ্বিতীয় ছত্রধর মাণিক্য বিয়ে করেছিলেন রাজর্ষি ভাগ্যচন্দ্রের মেয়ে রাজকুমারী হরিশেশ্বরীকে। ত্রিপুরাতে প্রথম রাস অনুষ্ঠিত হয় ১৭৯৮ সালে পুরোনো আগরতলার পুরোনো হাবেলিতে। মহারানি হরিশেশ্বরীর উদ্যোগেই পুরোনো হাবেলিতে রাসলীলা হয়েছিল। পরে রাজবাড়ি আগরতলায় স্থানান্তরিত হলে রাধানগরের রাধামাধব মন্দিরে নিয়মিত রাসলীলা হত। এখনো সরকারি উদ্যোগে রাধানগর মন্দিরে সেই রাসোৎসব হয়।

শ্রীমদ্ভাগবতে রাসের প্রসঙ্গ আছে। রস আকারপ্রাপ্ত হলেই রাস। ভাগবতে রসোস্বৈসঃ মানে ভগবান রসস্বরূপ। এই রস মধুর রস। এই রাসকেই হরিবংশ পুরাণে হল্লীসক বলে উল্লেখ করা হয়েছে। শ্রীমদ্ভাগবত শ্রীকৃষ্ণকেন্দ্রিক। কোথাও রাধার উল্লেখ নেই। শুধু এক প্রধান গোপিনীর চরিত্র আছে। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ যমুনার তীরে গোপিনীদের সঙ্গে লীলা করতে করতে প্রধান গোপিনীকে নিয়ে উধাও হয়ে গেলে অন্য গোপিনীরা পরস্পরের সঙ্গে কামবিকারগ্রস্তের মতো উন্মত্ত আচরণ করতে থাকেন। পরে শ্রীকৃষ্ণ সেই প্রধান গোপিনীকে নিয়ে ফিরে এলে গোপিনীরা তাদের ঘিরে ঘূর্ণির মতো নৃত্য করতে থাকেন। গোপিনীদের ভাব দু-রকমের। তদীয়তাময়। মদীয়তাময়। তদীয়তাময় মানে আমি তোমার, যা অন্য গোপিনীদের ছিল। মদীয়তাময় মানে তুমি আমার যা রাধার ছিল। গোপিনী শব্দটি সংস্কৃত গুপ্ ধাতু থেকে। গুপ্ ধাতুর মানে গোপন করা অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণপ্রেমকে গোপনে রাখা।

অনয়ারাধিতো নূনং

ভগবান হরিরীশ্বরঃ

যন্নো বিহয়ে গোবিন্দঃ

প্রীতো যমনয়দ্রহর।।

(ভাগবত, ১০ম স্কন্ধ।)

বৈষ্ণব টীকাকারেরা এই শ্লোকে রাধানামের আভাস পান। এই অনয়ারাধিতো শব্দবন্ধে চৈতন্য মহাপ্রভুও রাধার উল্লেখ কল্পনা করেছিলেন। ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে মহাভাবময়ী রাধা কৃষ্ণের হ্লাদিনী শক্তিরূপে স্বতন্ত্র তত্ত্বমর্যাদা পান। ততদিনে বাংলার ভক্তিবাদে সহজিয়া ভাবের উত্থান ঘটে গেছে। ভক্তিবাদের প্রচার, প্রসার ও উত্থান মূলত দক্ষিণভারতে। তাই বলা হয়, “দ্রাবিড়ে উৎপন্না ভক্তি।” পরে উত্তর ভারতে ছড়িয়ে পড়ে। ভক্তিবাদের মূল স্থপতি রামানুজাচার্য। তবে মূল ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে রাধার উল্লেখ নেই। যে ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে রাধাকে মর্যাদা দেওয়া হয়েছে, তা কোনো এক অর্বাচীন বৈষ্ণব কবির।

সর্বজনীন বলে বড়োলুৎমার পাঁচদিনব্যাপী এই মহারাসে সকালে রাখালনাচ। সন্ধ্যায় রাস। দূরদূরান্ত থেকে মানুষ আসে। বাঙালি, মণিপুরি, বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি, ত্রিপুরী, ত্রিপুরী বৈষ্ণব, এ যেন ভক্তদের এক মহামেল। মণ্ডপের উল্টোদিকের মাঠে বেশ বড়ো মেলা বসে। সেবার আমি ও সঞ্জীব ঘুরে ঘুরে মেলাটাও দেখেছিলাম। মেলাতে কয়েক জায়গায় ঝান্ডিমুন্ডার জুয়ার আসরও দেখলাম। খুব কাছ থেকে দেখলাম, একটি লোক শতরঞ্চির উপর বসে ফেজ টুপির মতো বড়ো পাত্রে দুটো বড়ো বড়ো ছক্কা নিয়ে একটা পাত্র দিয়ে আরেকটি পাত্রকে ঢেকে দুহাতে কড়কড় শব্দ তুলে ঝাঁকিয়ে দান ছুড়ে মারছে। হেরে যাওয়া জুয়াড়িদের শতরঞ্চিতে বাজি রাখা টাকা দুহাতে টেনে নিচ্ছে। মণ্ডপে রাসনৃত্য চলাকালীন শ্রীকৃষ্ণ ও শ্রীরাধার প্রতি উৎসর্গীকৃত ভক্ত বৈষ্ণব মহিলা ও পুরুষদের দেখলাম কিছুক্ষণ পরপরই চোখের জল মুছছে। কেউ কেউ ধীর পায়ে গিয়ে শ্রীকৃষ্ণ ও শ্রীরাধার পায়ের কাছে টাকা রেখে আসছে। বৈষ্ণবেরা খুবই আবেগপ্রবণ। গলা কাঁপিয়ে কাঁপিয়ে পরিবেশিত রাসের গানকে আমার কেন যেন কান্নার মতো মনে হত। মনে হত বিলাপের ধ্বনি।

আমাদের সময় কর্মশিক্ষা ও এস এস এস পি বা বিদ্যালয় কৃত্যক সিলেবাসে বাধ্যতামূলক ছিল। ক্লাস এইটে এ বিষয়ে একটি বিতর্ক প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। বিষয় ছিল, কর্মশিক্ষা ও বিদ্যালয় কৃত্যক মাধ্যমিক সিলেবাসে বাধ্যতামূলক থাকাই উচিত। ক্লাসের বেশ কয়েকজন ছাত্রছাত্রীরা অংশ নিয়েছিলাম। আমি বিপক্ষে ছিলাম। কমলেশ ছিল আমার পরের বক্তা। আমার মূল বক্তব্য ছিল, এই দুটো বিষয়কে সিলেবাসে বাধ্যতামূলক রাখার প্রয়োজন নেই। কারণ যে শিক্ষার্থী কর্মশিক্ষা ও বিদ্যালয় কৃত্যক নিয়ে পরিশ্রমী, মনোযোগী ও দক্ষতাসম্পন্ন, সে হয়ত একশোতে পঁচাত্তর পায়। আর এই বিষয়ে ফাঁকিবাজ শিক্ষার্থীটি বিশেষ কিছু না করেই পেয়ে যাচ্ছে পঁয়ষট্টি বা সত্তর। আমাদের অনেক মনীষী ও স্মরণীয় ব্যক্তিদের ওয়র্ক এডুকেশন স্কুল পারফমেন্স সিলেবাসে ছিল না। বিদ্যাসাগর, স্বামী বিবেকানন্দ, রামমোহন রায়, গান্ধিজি, নেতাজি সুভাষচন্দ্র, ইন্দিরা গান্ধি প্রমুখ ব্যক্তিত্বেরা এই বিষয়গুলি ছাড়াই স্মরণীয় হয়েছেন। কমলেশ উঠেই নিজের বক্তব্য রেখে শেষে বলল, আমার আগের বক্তা যেসব ব্যক্তিত্বের নাম উল্লেখ করেছেন, তাঁদের দুর্ভাগ্য, যে, তাঁদের সময়ে কর্মশিক্ষা ও বিদ্যালয় কৃত্যক ছিল না। যদি থাকত তবে তাঁরা  সমাজে আরও অনেক অবদান রেখে যেতে পারতেন। মুহূর্তেই হাততালি ও হাসির রোলে স্কুলের ক্যাম্পাস হল ফেটে পড়ল। সেই ডিবেটে কমলেশই পেয়েছিল প্রথম পুরস্কার।

আরেকটি ঘটনা ঘটেছিল ক্লাস এইটে। সেদিন প্রায় সবাই চলে এসেছিল প্রেয়ারের অনেক আগে। সজলকে বললাম, চল তিন্নাথের কীর্তন গাই। শুরু হল, যন্ত্র যদি পড়ে থাকে লক্ষজনার মাঝে/ যন্ত্রীক বিহনে যন্ত্র কেমন করে বাজে। বেঞ্চে ঠুকে ঠুকে দুজন তালে তালে বাজাচ্ছিল। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই কীর্তন জমে গেল। ক্লাসের আরও অনেকেই দোহারের ভূমিকায়। কীর্তন তখন ঝুমুরের তুঙ্গে। যন্ত্র বাজিতে লাগিল/ যন্ত্রীক বিহনে যন্ত্র বাজিতে লাগিল। হঠাৎই চিত্র স্যারের দিকে নজর গেল। স্যার রেগে না মুচকি হাসছেন বোঝা গেল না। আমার ও সজলের মাথায় স্যারের চাঁটি। কার পেটে যেন চিমটিও কাটলেন। পরের দিন স্বাধীনতা দিবসের পতাকা উত্তোলন। সমবেত জাতীয় সংগীতের পর প্রধান শিক্ষকের সংক্ষিপ্ত ভাষণ। পরের বক্তা চিত্র স্যার। স্বাধীনতা দিবসের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বললেন, ভারতবর্ষ স্বাধীন। আমরাও স্বাধীন। স্বাধীনতা মানে ক্লাসে বসে কীর্তন করা নয়। সেদিন প্রেয়ার লাইনে আমি ও সজল মাথা তুলতে পারিনি।

শীতের ধলাই বাহ্যত স্থির। খুব কাছে না গেলে বা জলে না নামলে বোঝাই যায় না স্রোত উত্তরদিকে বয়ে চলেছে। দুই পাহাড়ের মাঝখানে এই উপত্যকায় শীত খুব বেশি। খেলা ছাড়াও কয়েকজন বন্ধু মিলে নদীতে টানানো কাছি ধরে ধরে নৌকাতে এপার ওপার করার মধ্যে এক আলাদা রোমাঞ্চ। শীতের সময় মাঝিদের দেখা পাওয়া যেত না। নদীর উর্বর পলির চরে কত ধরনের যে ফসলের খেত! প্রাইমারি স্কুলের মাঠের দিকটায় নদীর চরে বাদামের চাষই বেশি হত। শীতের সকালে রোদের অপেক্ষা। কখন রোদ উঠবে আর সেই রোদে শরীর গরম করা যাবে! চৌধুরীবাড়িতে ঘরের বাইরে গোরুর খাবার সেদ্ধ করার জন্যে উনুন ছিল। সেই আগুনেও শরীর খানিকটা সেঁকে নেওয়া যেত। গোরুর দেখভালের জন্যে বিজয় নামে একটি ছেলেও ছিল। আমি ও নগেন ওকে বিজয় তেলি বলে খেপাতাম। বিজয়ের মা আসত মাঝে মাঝে ছেলেকে দেখতে। মহিলা নাকি একবার পাগল হয়ে গেছিল। সন্ধ্যায় দুধ দুইতে আসত পিনু ঘোষ। উবু হয়ে বসে দুই ঊরু দিয়ে বালতি চেপে ধরে গাইয়ের বান টেনে টেনে দুধ দুইত। শুরু করার আগে বাছুরকে খানিকটা খাইয়ে আঙুলে ও গাইয়ের বানে তেল মেখে নিত। পিনু গোয়ালা বৈষ্ণব। গলায় তুলসির মালা। বৈষ্ণবেরা যারা মাছ খায়, রাতের বেলা মাছকে বলে জলবাইঙ্গন। বাইঙ্গন মানে বেগুন। মেন রোডের দুই পাশে ন্যাড়া খেত। ধানকাটা হয়ে গেছে। খুব তাড়াতাড়ি বেলা ফুরিয়ে আসে। সূর্যাস্তের সময় শুধু পশ্চিমে আঠারোমুড়ার দিকে তাকাই। লাল বাস্কেটবলের মতো সূর্য অস্ত গেলে সন্ধে নেমে আসে। শীতকালে হালাহালিতে সবজি বাজারে সব টাটকা সবজি। সে বছর টমেটোর ফলন এত বেশি হয়েছিল, দশ পয়সা বা পনেরো পয়সায় এক কিলো টমেটো পাওয়া যেত।

অ্যানুয়াল পরীক্ষার সময় ঘনিয়ে এল। এই কটা দিনই আমার যা পড়াশোনা। পরীক্ষা নিয়ে একটা ভয় কাজ করত। অভিজিৎ মেধাবী। স্টুডিয়াস। তবে মানবেন্দ্র যে দিনরাত একাকার করে দিচ্ছে সেটা জানি। মৃণালিনীদের উঠোন পেরিয়ে যখনই যাই, শুধু পড়ার শব্দ ভেসে আসে। হালাহালি স্কুলে যে পরীক্ষার সময় কেউ নকল করত না তা নয়। কয়েকজন শিক্ষক খুব নকল ধরতেন। এ ব্যাপারে বাবাও খুব কড়া। একেকটা পরীক্ষা হয়ে যেত আর কাউন্ট ডাউন। শেষ পরীক্ষা ভূগোল। শেষ পরীক্ষার দিন খুব আনন্দ। বেশ কিছুদিন বই নিয়ে আর বসতে হবে না। সাইকেলে ঘোরাঘুরি করা যাবে। অবশেষে রেজাল্ট। এইট থেকে নাইনে প্রমোশন হল। আমি ফার্স্ট। অভিজিৎ সেকেন্ড। মানবেন্দ্র থার্ড। অভিজিৎ বরাবরই সায়েন্স গ্রুপে আমার চেয়ে বেশি মার্কস পেত। বাকিগুলোতে আমি বেশি পেতাম।

 

১৫.

 

ক্লাস নাইন মানেই ফুলপ্যান্ট আর ছোটো ক্লাসের কাছে দাদা হওয়ার প্রথম ধাপ। মেয়েদের শাড়ি। কিন্তু ছেলেদের অধিকাংশই এতই ছোটোখাটো ছিলাম, হাফপ্যান্টই পরতাম। ছেলেদের ফুলপ্যান্ট পরা বাধ্যতামূলক না হলেও নাইনে মেয়েদের শাড়ি পরা ছিল বাধ্যতামূলক। কদাচিৎ কোনো মেয়ে স্কার্ট ও শার্ট পরে আসত। এইটে যেসব সহপাঠী ফিগারে বড়ো, পায়ে লোম বড়ো হয়ে গেছে, এরা সবাই সাদা ফুলপ্যান্টই পরে আসত। এইটের মতোই ছেলেরা মেয়েরা একই সেকশনে। ঐচ্ছিক বিষয় হিসেবে অভিজিৎ, প্রশান্ত, পঞ্চু বেছে নিল বায়োলজি। আমি নিলাম সংস্কৃত। মানবেন্দ্রকে বারণ করা সত্ত্বেও অ্যাডিশনাল অঙ্কই বেছে নিল। ছেলেদের মধ্যে এই পাঁচজনকেই মাধ্যমিকে ফার্স্ট ডিভিশনের জন্যে প্রোজেক্ট করা হল। মেয়েদের মধ্যে মৃণালিনী, জয়শ্রী, শ্যামা। গোপ স্যারের কাছে ফিজিক্যাল সায়েন্স ও অঙ্কের প্রাইভেট টিউশন নিতে শুরু করলাম। রাজীব স্যারের কাছে লাইফ সায়েন্স। দুজনেরই আট/ দশ জনের ব্যাচ। টিউশন ফি চল্লিশ টাকা। মেঘদূতদাদের বাড়িতে একটি ঘরে গোপ স্যার আমাদের পড়াতেন। সেই ব্যাচে জয়দেবও পড়ত। স্যার মাঝেমাঝে আমাদের টাস্ক দিয়ে বাজারে বসাক কাকুর দোকানে চা খেতে যেতেন।  সেই সুযোগে জয়দেব স্যারের ফেলে যাওয়া বিড়ির প্যাকেট থেকে বিড়ি চুরি করে বাইরে গিয়ে টেনে আসত। তবে টিউটোরিয়ালে স্যার আমাদের কখনোই মারেননি। স্কুলে আমার ও সঞ্জীবের পিঠেই স্যারের বেত বেশি পড়ত। একদিন বাবা রাউন্ড দেওয়ার সময় দেখে গেলেন স্যার আমাকে মারছেন। পিরিয়ড শেষ হওয়ার পর গোপ স্যার বাবাকে গিয়ে বললেন, আপনি কিছু মনে করছেন না তো স্যার। সেদিন বাবা বলেছিলেন, দেখেন গোপবাবু, আমার ছেলেরে মানুষ করতে গিয়া যদি মাইরাও ফালান, আমার কিন্তু কোনো অভিযোগ থাকত না।

 

ক্রমশ…

 

Tags: আত্মজৈবনিকগদ্যধারাবাহিকপ্রবুদ্ধসুন্দর কর
Previous Post

প্রবুদ্ধসুন্দর কর || একাদশ পর্ব

Next Post

অমিতাভ দেব চৌধুরী || চতুর্থ পর্ব

Daruharidra

Daruharidra

Next Post
অমিতাভ দেব চৌধুরী || চতুর্থ পর্ব

অমিতাভ দেব চৌধুরী || চতুর্থ পর্ব

Comments 3

  1. অশোক সিনহা says:
    1 year ago

    গো অনেকটা অয়ণ এর মতো। যে বস্তুর অয়ণ আছে সে গো। তাই গরু গো, গ্রহ তারা গো, ইংরেজী GO, একই শব্দ, শুধু তার অর্থ সংকুচিত হয়ে গেছে।
    দারুণ লাগছে।

    Reply
  2. চঞ্চল চক্রবর্তী says:
    1 year ago

    দশ এবং একাদশ এই দুই দারুণ পর্বের পর দ্বাদশে গতি মন্থর।

    Reply
  3. Amitabha Dev Choudhury says:
    1 year ago

    চমৎকার হচ্ছে হে । রাজকুমারী বিম্বাবতীর কথা পড়ে মনে হলো, ইনিই তো আমাদের মীরাবাঈ !

    Reply

Leave a Reply Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

No Result
View All Result

RECENT POSTS

মেখলা পরা মেয়ে || শ্রীযুধাজিৎ || অন্তিম পর্ব

মেখলা পরা মেয়ে || শ্রীযুধাজিৎ || অন্তিম পর্ব

15/04/2022

সঞ্জয় চক্রবর্তী || অন্তিম পর্ব

09/04/2022
মেখলা পরা মেয়ে || শ্রীযুধাজিৎ || দ্বাবিংশতি পর্ব

মেখলা পরা মেয়ে || শ্রীযুধাজিৎ || দ্বাবিংশতি পর্ব

08/04/2022

সঞ্জয় চক্রবর্তী || নবম পর্ব

02/04/2022
মেখলা পরা মেয়ে || শ্রীযুধাজিৎ || একবিংশতি পর্ব

মেখলা পরা মেয়ে || শ্রীযুধাজিৎ || একবিংশতি পর্ব

01/04/2022

সঞ্জয় চক্রবর্তী || অষ্টম পর্ব

27/03/2022
মেখলা পরা মেয়ে || শ্রীযুধাজিৎ || বিংশতি পর্ব

মেখলা পরা মেয়ে || শ্রীযুধাজিৎ || বিংশতি পর্ব

25/03/2022
সঞ্জয় চক্রবর্তী || সপ্তম পর্ব

সঞ্জয় চক্রবর্তী || সপ্তম পর্ব

20/03/2022
মেখলা পরা মেয়ে || শ্রীযুধাজিৎ || উনবিংশতি পর্ব

মেখলা পরা মেয়ে || শ্রীযুধাজিৎ || উনবিংশতি পর্ব

18/03/2022
ষষ্ঠ পর্ব || সঞ্জয় চক্রবর্তী

ষষ্ঠ পর্ব || সঞ্জয় চক্রবর্তী

13/03/2022

RECENT VIDEOS

https://www.youtube.com/watch?v=77ZozI0rw7w
Daruharidra

Follow Us

আমাদের ঠিকানা

দারুহরিদ্রা
কুঞ্জেশ্বর লেন
(বরাকভ্যালি একাডেমির নিকটবর্তী)
নতুন ভকতপুর, চেংকুড়ি রোড
শিলচর, কাছাড়, আসাম
পিন-788005

ডাউনলোড করুন

সাবস্ক্রাইব

Your E-mail Address
Field is required!
Field is required!
Submit
  • আমাদের সম্পর্কে
  • লেখা পাঠানো
  • যোগাযোগ

Copyright © All rights reserved Daruharidra | Development by Prosenjit Nath

No Result
View All Result
  • ধান্যগৃহ
  • কবিতা
  • গল্প
  • গদ্য
  • প্রবন্ধ
  • উপন্যাস
  • সাক্ষাৎ পাতা
  • অনুবাদ পাতা
  • আর্কাইভ
  • আমাদের সম্পর্কে
    • লেখা পাঠানো
    • যোগাযোগ

Copyright © All rights reserved Daruharidra | Development by Prosenjit Nath