দারুহরিদ্রা:- আপনি আরও বলুন, আমরা শুনি।
অমিতাভ:- বহুদিন আগে মেক্সিকান লেখক হুয়ান রুলফোর একটা উপন্যাস পড়েছিলাম। পেদ্রো পারামো। একজন মানুষ তার মা মারা যাওয়ার পর, তার বাবার খোঁজে কোমালা বলে একটি জায়গায় আসে। এসে দেখে সেটা এক মৃতদের শহর। যাদের সঙ্গে তার দেখা হচ্ছে তারা সবাই আসলে মৃত। আমার নিজেরও, জানো তো, পৃথিবীটা এখন ভরে উঠছে মৃত মানুষে। আত্মীয়-পরিজন, বন্ধু-বান্ধব, মাস্টারমশাই, সহকর্মী, ঘনিষ্ঠজন সবাই আস্তে আস্তে অন্যলোকে পাড়ি জমাচ্ছেন। দিনের বেলা অ্যান্টি ডিপ্রেস্যান্ট-এর প্রভাব কাজ করে। মোটামুটি স্বাভাবিক থাকি। কিন্তু রাতের বেলা, গভীর ঘুমে তলিয়ে না–গেলে স্বপ্নে সব মৃত মানুষেরা জীবন্ত হয়ে দেখা দেন। ঘুম ভেঙে গেলে মনে হয় এর চেয়ে স্বপ্নলোকই তো ভালো ছিল।

দ্যাখো, স্মৃতি কী সাংঘাতিক জিনিস! মৃত্যুলোক থেকেও মানুষকে ফিরিয়ে নিয়ে আসতে পারে। যা-হোক, পেদ্রো পারামো উপন্যাসটি স্প্যানিশ ভাষায় লেখা। গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের নাকি এই উপন্যাস পুরোটা মুখস্থ ছিল। এসব অবশ্য আমার চেয়ে অনেক বেশি জানে, কবি ও গল্পকার সুব্রতকুমার রায়। তার পুরো মার্কেজ পড়া। উপন্যাসটির সম্মানে, মৃতদের সম্মানে, চলো আমরা বরং একটু গান শুনি। এটি একটি স্প্যানিশ গান। কিউবার গান। গানটি কিন্তু মোটেই মৃতদের নিয়ে নয়। গুয়ান্তানামোর একটি মেয়েকে নিয়ে। এই গানের অনেকগুলি ভার্শান আছে। এদের মধ্যে কোন ভার্শানটি, ঠিক জানি না, কিউবার কবি হোসে মার্তি-র। আমরা গানটি শুনব জোওন বায়েজের গলায়। বায়েজ ছিলেন একদা বব ডিলানের প্রেমিকা। বব ডিলান নোবেল পাবার পর, জানো তো, শুভপ্রসাদ আর আমি, টংলার অভিজিৎ চক্রবর্তী আর আমি ফোনযোগে খুব হইচই করেছিলাম। কেন জানো? রবীন্দ্রনাথের পর সম্ভবত এই দ্বিতীয়বার কোনও গান-লিখিয়ে নোবেল পেলেন। আর গান, আমার মতে শ্রেষ্ঠ শিল্পমাধ্যম।
১৬. দারুহরিদ্রা:- বেশ! আপনার মা-বাবার কথা জানতে চাই।
অমিতাভ:- মার কথা পরে বলব। সে আমার জীবনে গল্পের মতো এক অধ্যায়। আর বাবার কথার সঙ্গে সঙ্গে আমার জ্যাঠা কাকাদের কথাও বলতে হবে। মা মারা যান আমার সাড়ে ছয় বছর বয়সে। তারপর থেকে আমরা তিন ভাই-বোনের কেউই বাবার কাছে বড় হইনি। আমি বড় হয়েছি আমার জ্যাঠা, কাকাদের কাছে। আমার পরের বোন মামাবাড়িতে। আর সব ছোটো বোন এক নিঃসন্তান পিসতুতো দিদির কাছে। তাই জ্যাঠা, কাকাদের কথা বলাটা আমার কৃত্যের মধ্যে পড়ে। এঁরা আমার জীবনের গার্ডিয়ান এঞ্জেল। এঁরা না থাকলে আমি আজ যা, যতটুকু, তার কিছুই হয়ে উঠতাম না। প্রথমে বাবার কথা বলে নিই।
বাবা অপূর্বকুমার আমাদের গোটা পরিবারকে ভারতীয়ত্ব দান করেছিলেন। লোকে যেমন চাকরি খুঁজতে তাদের রাজ্যের রাজধানীতে যায়, বাবা তেমনি সেই ১৯৪১ সালে সিলেট থেকে শিলং চলে আসেন। তাঁর এক সম্পর্কিত মেসো চারুচন্দ্র দত্ত ছিলেন শিলঙের উকিল। তাঁর আমন্ত্রণে বাবা শিলং আসেন। এসে ভারতীয় ডাকবিভাগে চাকরি পেয়ে যান। জানো তো, বাবার এই মেসোর স্ত্রী ছিলেন কিংবদন্তি ব্যক্তিত্ব কামিনীকুমার চন্দর বড় মেয়ে হিরণকুমারী দত্তর আপন জা।
বাবার বিবাহিত জীবন মাত্রই কয়েকটি বছরের ছিল। মা মারা যাওয়ার পর বাবা কেমন এতোলবেতোল হয়ে যান। শুনেছি, প্রথম দিকে শ্মশানে-মশানে গিয়ে বসে থাকতেন। পরে চাকরির সঙ্গে সঙ্গে ট্রেড ইউনিয়নে ভয়ংকরভাবে জড়িয়ে পড়েন। আমাদের সঙ্গে বছরে হয়ত একবার দেখা হত। কর্তব্য পালনে ত্রুটি করতেন না। ছেলে মেয়ে যে যেখানে বড় হচ্ছে সেখানে টাকা পাঠাতেন। বাবার সঙ্গে, স্বাভাবিক কারণে, আমাদের ভাইবোনের একধরনের দূরত্ব চলে আসে। আমাদের নিজেদের মধ্যেও ওই একই দূরত্ব বাসা বাঁধে। ১৯৭৫ সালে ইন্দিরা গান্ধির আমলে যে পি অ্যান্ড টি ধর্মঘট হয়, বাবা তার অন্যতম পাণ্ডা ছিলেন। শাস্তিস্বরূপ তাঁর চাকরিটি যায়। জনতা পার্টির সরকার গঠিত হলে অবশ্য তিনি পুনর্বহাল হন। তাঁর দুই প্রিয় নেতা ছিলেন জর্জ ফার্নান্ডেজ, মধু দণ্ডবতে। এঁদের নাম শুনতে শুনতে কান ঝালাপালা হয়ে যেত।
জীবিত বাবার প্রতি যত অভিমানই পোষণ করি না কেন, মৃত বাবার প্রতি আমাদের ভাই, বোন কারোরই কোনও অভিমান নেই। তিনি আমাদের আসামের চূড়ান্ত নাগরিকত্বের অভিজ্ঞান দিয়ে গেছেন। ১৯৫১-এর নাগরিকপঞ্জিতে এবং ১৯৫৩-এর ভোটার লিস্টে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় বাবার নাম আছে। তিনি তখন সেখানে কর্মরত। বাবা মারা যাওয়ার অনেক বছর পরে বাবার এই উপহারের কথা আমরা জানতে পেরেছি। ঠিক যেন এক গুপ্তধনের উত্তরাধিকার হাতে পাওয়ার মত।
জ্যাঠামশাই অনাদি দেব আমাদের সিলেট বাড়িতে প্রথম কমিনিউজম এনে ঢোকান এবং বাড়িটিকে এক মোটামুটি রাজনীতির আখড়ায় রূপান্তরিত করেন। ১৯৩৭ সালে সিলেট গোবিন্দপার্কে পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুর বিশাল সংবর্ধনা সভায় স্টুডেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে আমার জ্যাঠাই পণ্ডিতজিকে দেওয়া মানপত্র পাঠ করেন। ১৯৩৮ সালে সাদুল্লাহ মন্ত্রীসভা ভেঙে দিয়ে কংগ্রেস কোয়ালিশন সরকার গড়তে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু যখন শিলং অ্যাশলে হলে এসেছিলেন, তখন ছাত্রকর্মী হিসেবে জ্যাঠামশাইর ওপর ভার পড়েছিল তাঁর ছায়াসঙ্গী হবার। শুধু তাই নয়, শিলঙের অপেরাহলের এক ছাত্রসভায় সুভাষচন্দ্রের বক্তৃতার পর তাঁকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে ছাত্র ফেডারেশনের পক্ষ থেকে কথা বলার ভার পড়েছিল অনাদি দেবের ওপরই। তাঁর সম্পর্কে বিখ্যাত নট, নাট্যকার বিভাস চক্রবর্তী তাঁর স্মৃতিকথায় ( ‘সেই এগারোটা বছর’, ‘স্বকলমে’) লিখেছেন, ‘আমাদের বইয়ের জোগান আসত মর্ডান বুক ডিপো থেকে। জনশক্তি প্রেসের পাশেই ছিল সেই বইয়ের দোকান। দাদা আর আমি ওই দোকানে বসেই যে কত বই পড়েছি তার হিসেব নেই। দোকানের মালিকের পদবি ছিল শ্যাম, সর্বক্ষণের কর্মচারী ছিলেন অনাদিদা, অমিয় দেবের দাদা। এই সেদিনও ওঁর সঙ্গে দেখা হল শিলচরে।’ এই সেদিন মানে বহুযুগ আগে। বিভাস চক্রবর্তীরা, শুনেছি, সিলেটে আমাদের পরিবারের খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন। আমার কাকা অনন্ত দেব যতদিন জীবিত ছিলেন, বিভাস শিলচর এলে আমাদের একান্নবর্তী বাড়িতেই উঠতেন। আমি যখন ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিই, তখন বিভাসকাকু ‘রূপম’ -এর নাট্য প্রতিযোগিতার বিচারক হিসেবে আমাদের বাড়িতে ছিলেন। আমি প্রতিদিন পরীক্ষা দেবার আগে কপালে দইয়ের ফোঁটা-বিভূষিত হয়ে অন্যদের সঙ্গে সঙ্গে তাঁকেও প্রণাম করে যেতাম। মনে পড়ে।
জ্যাঠা ও কাকার সুবাদে আমাদের ছোটোবেলায় বাড়িতে যাঁরা আসতেন, তাঁদের বেশিরভাগই ছিলেন রাজনীতির মানুষ। এই যেমন, মহীতোষ পুরকায়স্থ, ভূপতি চক্রবর্তী, নুরুল হুদা। সবার নাম আজ আর মনে পড়ে না। তবে বীরেশ মিশ্র, আর কল্যাণী মিশ্র যেদিন আসতেন তাঁদের দুপুরে না খাইয়ে ছাড়া হত না। গল্প শুনেছি, বীরেশ মিশ্র নাকি সিলেটে আমাদের ধোপাদীঘিরপারের বাড়িতে থেকে পড়াশোনা করতেন। তিনি ছিলেন আমার জ্যাঠামশাইর গৃহশিক্ষক।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর শিক্ষাগত যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও কংগ্রেস সরকারের চাকরি নেবেন না বলে অনাদি দেব চাকরিই করলেন না। স্বাধীন ব্যবসা করতে গিয়ে জমাতে পারলেন না। সেই ব্যবসার ভার পড়ল আমার বড় কাকার ওপর। আমার দাদুর মৃত্যুর পর আমি বড় হয়েছি জ্যাঠামশাইর অভিভাবকত্বে। আমাকে অসম্ভব ভালোবাসতেন, আমাকে নিয়ে প্রচণ্ড টেনশনও ছিল তাঁর। গান গাইতেন। একা একা। ভীষণ সুরেলা গলায়। আজ মনে হয় আর কিছু না করে ভদ্রলোক যদি গানটাই করতেন, তাহলেও যশ- অর্থের কোনও অভাব হয়ত হত না তাঁর। তাঁর প্রিয়তম গান ছিল সম্ভবত শচীনকর্তার গাওয়া ‘তুমি যে গিয়াছ বকুল বিছানো পথে’। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে গাইতেন।
অনাদি দেবের কথা মনে হলে বা তাঁকে স্বপ্নে দেখলে বা তাঁর মত জীবনযুদ্ধে পরাজিতদের নিয়ে ভাবলে আজকাল আমার সার্বিয়ান কবি ভাস্কো পোপার একটি বিখ্যাত কবিতা মনে পড়ে।
Once upon a time there was a mistake
So silly so small
That no one would even have noticed it
It couldn’t bear
To see itself
to hear of itself
It invented all manner of things
Just to prove
that it didn’t really exist
It invented space
To put its proofs in
And time to keep its proofs
And the world to see its proofs
All it invented
Was not so silly
Nor so small
But was of course mistaken
Could it have been otherwise
গোপন কথাটি রবে না গোপনে
খুব ভালো