ক্লাস নাইনে তারিণী স্যার ক্লাসটিচার। বাংলা পড়াতেন। তখন আমাদের বাংলা দুই পেপার। মদন স্যার ইংরেজি। স্যার একটু মুখ বেঁকিয়ে ইংরেজি পড়াতেন। আমাদের হাসি পেলেও চেপে রাখতাম। ধরা পড়ে গেলে স্যার বলতেন, চলো ফিল্ডে চলো। একজন করিয়া আও। চ্যালেঞ্জ। গোপ স্যার অঙ্ক। রাজীব স্যার লাইফ সায়েন্স। ফিজিক্যাল সায়েন্স পরিতোষ স্যার। সোহরাবউদ্দিন স্যার ভুগোল। অমল স্যার বদলি হয়ে ডেপুটি ইনস্পেক্টর হয়ে সালেমা চলে গেছেন। বদলি হয়ে এসেছেন হিরন্ময় স্যার। কমলপুর থেকে পুলক স্যার। ইংরেজির সাবজেক্ট টিচার। আগরতলা থেকে তপতী নাহাবিশ্বাস। কমলপুর থেকে তপতী দত্তবিশ্বাস। স্থানীয় মাজির আলি স্যার নতুন চাকুরিতে পোস্টিং পেয়েছেন আমাদের স্কুলে। তপতী নাহাবিশ্বাস যেদিন জয়েন করেন, মদন স্যার প্রেয়ার অ্যাসেম্বলিতে পরিচয় করিয়ে দিতে গিয়ে বলেন, তোমাদের নতুন দিদিমণি খুব ভালো গান করেন। অনেক রবীন্দ্র সংগীত জানেন। তপতী দিদিমণির গায়ের রং কালো। তপতী দত্তবিশ্বাস ছিলেন উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ। এই দুই দিদিমণি ছাত্রছাত্রীদের কাছে আড়ালে কালা তপতী ও সাদা তপতী বলেই পরিচিত ছিলেন। পুলক স্যার দেখতে ছিলেন ছোটোখাটো। ধুতি ও কলার দেওয়া পাঞ্জাবি পরতেন। ইলেভেন-টুয়েলভে ইংরেজি পড়াতেন। স্যারদের পারস্পরিক সম্পর্ক যথেষ্ট ভালো। ভিন্ন সংগঠনের হলেও সোহরাবউদ্দিন স্যার চেষ্টা করে বন্ধু অধীর পালকে বদলি করিয়ে নিয়ে এসছেন আমাদের স্কুলে। তপতী নাহাবিশ্বাসের একটি গানের অনুষ্ঠান হয়েছিল ক্যাম্পাস হলে। প্রথমেই গেয়েছিলেন, কী গান শোনাব বলো ওগো সুচরিতা। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে সেই বিখ্যাত গান। দিদিমণির গলা একটু হাস্কি হলেও সুরে গাইতেন। নাইনে ওঠার সাথেসাথেই ভালো ছাত্রদের উপর স্যারেদের নজরদারি বেড়ে যেত। নীচের ক্লাসের কোন্ ছাত্র উপরের ক্লাসের কোন্ ছাত্রের সঙ্গে মিশছে তাও লক্ষ রাখা হত। নাইনে বেশ কিছু নতুন ছাত্র এসে আমাদের সঙ্গে ভরতি হল। চানকাপ থেকে সুধন দাস নামে একটি ছেলে আসে। কয়েকদিনের মধ্যেই আমরা আবিষ্কার করলাম, ফুলপ্যান্টের নীচে সুধন জাঙিয়ার বদলে গামছা পরে আসে। সে নিয়ে খুব হাসাহাসি হল। চুলুবাড়ি থেকে চিত্ত দাস ওরফে চানু স্কুলে নতুন এসেই আমাদের সঙ্গে বেশ মিশে গেল।
১৯৮১ থেকেই হালাহালিতে রাজেশ খান্না হেমামালিনী অভিনীত কুদরত ফিল্মের শচীন দেববর্মণের সুরারোপিত গানটি খুব জনপ্রিয়। মাইকে ভেসে আসত–
তুনে ও রঙ্গিলে ক্যায়সা জাদু কিয়া
পিয়া পিয়া বোলে মতবালা জিয়া
বাহোমেঁ ছুপাকে ইয়ে ক্যায়া কিয়া
ওরে পিয়া….
গানের সুরটি কোথায় যেন গিয়ে মর্মে লাগত। আরেকটু ছোটো থাকতে সরস্বতীপূজার দিন দূর থেকে মাইকে ভেসে আসা লতা মঙ্গেশকরের কণ্ঠে সেই গানটি ঠিক তেমনই উদাস করে দিত–
প্রিয়তম কী লিখি তোমায়
তুমি ছাড়া আর কোনো কিছু ভালো লাগে না আমার
কী লিখি তোমায়…
গানটির প্রথম অন্তরা কৃষ্ণচূড়ার বনে ছায়াঘন পথ/ আঁকাবাঁকা পায়ে/ আমার আঙিনা থেকে চলে গেছে তোমার মনে/ বসে আছি বাতায়নে/ তোমারই আশায় হয়ে যখন কী লিখি তোমায় অংশে ফিরে আসত তখন আমি আর আমাতে নেই। বয়সে তখন শিশুচিকিৎসক ডাক্তার বিকাশ রায়ের পেশেন্ট হলেও ক্লাস থ্রি থেকে লুকিয়ে উপন্যাস পড়ার ফলে শৈশবেই হয়ত অকালপক্ক এক প্রেমিক জেগে উঠেছিল আমার ভেতর। ক্লাস নাইনের অ্যানুয়েল স্পোর্টসের দিন সিক্সের এক ছাত্রী, সিক্সের তুলনায় দেখতে একটু বড়োসড়ো, এসে আমাকে ডেকে নিয়ে গিয়ে বলল, আজকা বিকালে প্রাইমারি ইস্কুলের মাঠে দেখা করবি। বুকটা ছাৎ করে উঠল। কীসের ইঙ্গিত! আত্মসম্মানেও লাগল। তিন ক্লাস উপরের সিনিয়রকে তুই করে বলা! বিকালে আর যাইনি। শুধু সঞ্জীবকে ঘটনাটা বললাম।
অবশেষে হালাহালির মানুষের জন্যে খুশির জোয়ার নিয়ে এল স্বপনপুরী। স্থানীয় কয়েকজন যুবক শেয়ারে এই সিনেমাহল তৈরি করেছিল। শেয়ার হোল্ডারদের মধ্যে সহপাঠী সত্যবিকাশের দাদা সত্যরঞ্জন বিশ্বাস, সঞ্জীবের মেজোকাকু রথীন্দ্র দাস, কাঁচাদা বলে একজন স্থানীয় যুবক এবং আরও কেউ কেউ। স্বপনপুরীর আগে কমলপুর মহকুমায় সিনেমাহল বলতে কুলাই, সালেমা আর কমলপুরে। উত্তর হালাহালির চা-বাগানের দিকে রাস্তার আগে ধানখেতেই বাঁশের বেড়ার লম্বা ঘর। মাটির মেঝেতে কাঠের বেঞ্চ দর্শকদের জন্যে। কাঠের তৈরি একটি ভি আই পি বক্স। পাশেই অপারেটর নিপুদার প্রোজেক্টর চালানোর খোপ। নিপুদা আগরতলা থেকে রিল নিয়ে আসত। ঘটা করে বিনা পয়সায় সবাইকে ম্যাটিনি শো দেখিয়ে উদ্বোধন হল। সেই শোয়ে আমন্ত্রিত ভি আই পি সস্ত্রীক বিডিও পল্লব দেববর্মা। পল্লব দেববর্মা তখন সবে বিয়ে করেছেন। সেই বিয়ে নিয়ে স্থানীয় মহিলা মহলে ফিসফিস। প্রথম ম্যাটিনি শোতে দেখানো হয়েছিল স্বয়ংসিদ্ধা। রঞ্জিত মল্লিক, মিঠু মুখোপাধ্যায়, অভিজিৎ সেন অভিনীত। হল উপচে পড়েছিল ভিড়ে। হলের ভেতরে সামনের দিকে মাটির মেঝেতে পলিথিন বিছানো থার্ড ক্লাস। শো শুরু হওয়ার আগে মাইকে হিন্দি সিনেমার গান বাজত। রোজ তিনটে শো। ম্যাটিনি। ইভনিং। নাইট। ৩ টা- ৬ টা- ৯ টা। দিনের বেলা রিকশায় মাইক বেঁধে সিনেমার অ্যানাউন্সমেন্ট। হিন্দি ছবির অ্যানাউন্সমেন্ট একটু আলাদা। আপনাদের প্রিয় প্রেক্ষাগৃহ স্বপনপুরীতে সম্পূর্ণ হিন্দি রঙিন ফাইটিং ফ্যান্টাস্টিক ছবি। বাংলা হলে সপরিবারে দেখার মতো সামাজিক বাংলা ছবি। স্বয়ংসিদ্ধার পর স্বপনপুরীতে রণধীর কাপুর অভিনীত পুঙ্গা পণ্ডিত। ছবির নামটি সবারই হাসির খোরাক হয়ে উঠেছিল। কারণ পুঙ্গা শব্দটি অশ্লীল শব্দ হিসেবেই চালু ছিল। সিনেমা শুরু হওয়ার আগে মাইকে হিন্দি ফিল্মের গান। ছুটির দিনে দুপুরে মাইকে গান শুরু হলেই পাগল পাগল লাগত। সিলসিলা ছবির গান বেশি বাজানো হত। পণ্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাশিয়ার সুরারোপিত সিলসিলা ছবির গানগুলো, রঙ্গ বরসে ছাড়া, শুনে কেমন যেন মনখারাপ হয়ে যেত। বিশেষ করে নীলা আসমাঁ শো গয়া গানটি। হালাহালিতে তখন প্রায় সবার মুখেই সিনেমার কাহিনি। উঠতি ছেলেদের স্টাইল বেড়ে গেল। বাড়িতে ফাঁকি দিয়ে অনেক সিনেমা দেখেছি। ধরা পড়ে মা-র হাতে মার খেয়েছি। বকুনিও। বাবা তারকনাথ সিনেমাটি দেখেছিলাম পাঁচবার। দোস্তানা দেখার পর হালাহালির প্রায় উঠতি সব ছেলেরাই অমিতাভ বচ্চনকে নকল করে মুখে চ্যুয়িংগাম রেখে বা না- রেখে চিবোতে চিবোতে কথা বলত। নগেন প্রায় সব সিনামাই থার্ডক্লাসে বসে দেখে এসে গল্প বলত। হেলেনের অভিনয় নকল করে দেখাত। একদিন আমি ও সঞ্জীব ম্যাটিনি শুরু হওয়ার কিছুক্ষণ পর বিনা টিকিটে চুপিসারে চোরের মতো হলে ঢুকে পড়েছিলাম। আমি রাজি ছিলাম না। সঞ্জীব অভয় দিয়ে বলেছিল, কোনো ভয় নাই। আমার মেজো কাকুও সিনেমা হলের মালিক। সেদিন হলের কেউ একজন আমাদের দেখে ফেলেছিল। কিছু বলেনি। তবে ঘটনা চাউর হয়ে গেছিল। হিট ছবি এলে মাঝেমাঝে টিকিট ব্ল্যাকও হত। হলের সামনে কয়েকটি পান-বিড়ি-সিগারেট ও চায়ের দোকানও ছিল।
বিকালবেলা হালাহালি বাজার থেকে চল্লিশ ফুট পর্যন্ত রাস্তাটি যেন উঠতি স্টাইলিস্ট যুবকদের র্যাম্প। বিকালে ফিটফাট হয়ে কয়েকটি গ্রুপ প্রায় রোজই বেরিয়ে পড়ত। একটি গ্রুপ টুটুল দাসের নেতৃত্বে চল্লিশ ফুট ঘুরে এসে বালোয়ারি স্কুলের পার্কে বসে সিগারেট খেত। আরেকটি তিনজনের গ্রুপে ছিল বিক্রম সিংহ, প্রদীপ বসাক, ভজন বণিক। আরেকটি দুজনের গ্রুপ ছিল আমাদের সিনিয়র সৌমেন দেব ও আশিস বণিকের। মাঝেমাঝে প্রেমিক-প্রেমিকাদের কাউকে কাউকে দেখা যেত। ওরা পাশাপাশি হাঁটত না। রাস্তার এক পাশে ছেলেটি ও আরেক পাশে মেয়েটি সমান্তরাল হয়ে হেঁটে যেত। শুধু চিঠি চালাচালির সময় এক আধ মিনিটের জন্যে কাছাকাছি আসা। আমাদেরও একটি গ্রুপ তৈরি হল। আমি, সঞ্জীব, পঞ্চু, সজল, রাজু। মদন স্যারের ভাগ্নে সুভাষ, প্রায়ই পায়জামা ও শার্ট পরা গোবেচারা ধরনের, কয়েকমাসের জন্যে গুয়াহাটি গেছিল। হঠাৎই একদিন দেখি টাইট জিনস আর লাভস্টোরি সিনেমায় কুমার গৌরবের ঘটিহাতা টাইট গেঞ্জি পরে সুভাষ স্পিডে স্মার্টলি হেঁটে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর আবার সেই একই স্পিডে ফিরে আসতেও দেখলাম। সন্ধ্যার আগে চৌধুরীবাড়ির পুকুরঘাটে ইভাদি, লক্ষীদি, সতী, নগেনসহ একটা আড্ডা হত। পাকা রাস্তা দিয়ে সবার যাতায়াতই চোখে পড়ত।
একদিন রঞ্জিত স্যার এক বিধবা মহিলাকে নিয়ে বাড়িতে এলেন বাবার সঙ্গে দেখা করতে। বাবাকে বললেন, এই মহিলা আপনের কাছে একটা জরুরি ব্যাপারে আইছেন। আমি যাই, বলে, স্যার চলে গেলেন। আমি ঘরেই ছিলাম। মহিলা বাবাকে বললেন, স্যার আমার ছেলেটার একটা চাকরির কথাবার্তা চলছে। একটা এইট পাস সার্টিফিকেট লাগে। বাবা বললেন,ছেলে কি আমরার স্কুলে পড়ত? মহিলা বললেন, না স্যার। বাবা বললেন, তাইলে আপনি কী কারণে আমার কাছে আইছেন? স্যার, ছেলের লাগি একটা এইট পাস সার্টিফিকেট লাগে। আপনে যদি আমার এই উপকারটা করইন। বাবা খুব শান্ত ভাবেই মহিলাকে বললেন, দেখেন, আমার পক্ষে এরকম সার্টিফিকেট দেওয়া সম্ভব না। আপনে এক কাজ করেন, যেসব স্কুল আগে আগুনে পোড়া গেছে, ওইসব স্কুলে চেষ্টা করেন। হঠাৎই মহিলা একতাড়া নোটের একটা বান্ডিল বের করে বাবার হাতে দিতে যাচ্ছিলেন। মুহূর্তেই বাবার রুদ্রমূর্তি! বাইর হন। এক্ষুনি ঘর থিকা বাইর হন। আপনার সাহস তো কম না। আমারে ঘুষ দিতে চান! মহিলা তো বাবার হাতে পায়ে ধরে সে কী কান্না! আমারে মাফ করি দেইন স্যার। বাবা তখন রাগে কাঁপছেন। আপনি রঞ্জিত বাবুর পরিচিত, নয়তো এই ধরনের কেসে আমি পুলিশ ডাকি। মহিলা আর দেরি না করে বেরিয়ে গেলেন।
বৃহস্পতিবার স্কুল খোলা বলে বিকালের বাজারবারে যাওয়া হয় না। সেই দুঃখ রবিবারের বাজারবারে পুষিয়ে নিই। তুলনায় রবিবারের বাজারই বেশি জমজমাট। কত ধরনের খেলা! কত ক্যানভাসার! সাপের খেলা। সাপ ও বেজির খেলা। সব খেলার উদ্দেশ্য একটাই। তাবিজ বিক্রি। মাদারির খেলা। একদিন দেখলাম একটা লোক ছোটোখাটো একটা অজগর সাপ নিয়ে বসে আছে। বেশ ভিড়। বলছে, কোনো দিলদার বাবু কি এখানে আছেন, আমার সাপকে মুরগি খাওয়ালে সব বিপদ কেটে যাবে। যা চাইবেন তা-ই পাবেন। কিছুক্ষণ পর দেখলাম একজন একটা সাদা মুরগি এনে খেলা দেখানোর লোকটির হাতে দিল। লোকটি অজগরটির সামনে মুরগিটিকে রেখে দিল। অজগরটি কুণ্ডলি থেকে নিজেকে বের করে আস্তে আস্তে মুরগিটির দিকে এগোচ্ছে। হিসহিস শব্দ। চোখের নিমেষে মুরগিটিকে মুখে পুরে সামান্য পাক খেয়ে গিলে ফেলল। সেই লোকটিও তাবিজ বিক্রি করে চলে গেল। আরেকদিন দেখলাম পুরুষের সেক্স বাড়ানোর নিতাই পিল। ক্যানভাসারের বুকে একটি দোতারা ঝোলানো। প্রথমেই সে গাইল, বিয়ের কথা ভাবতে ভাবতে পেকে গেল মাথার চুল/ কবে দয়াল ফুটবে বলো আমার বিয়ের ফুল। গান গাইবার সময় দেখলাম তার গলার শিরা উপশিরা নীল হয়ে ফুলে উঠছে। এরপর ক্যানভাসার নিতাই পিলের মাহাত্ম্য বর্ণনা শুরু করল। দাদারা ভাইয়েরা, এখানে অনেকেই আছেন যারা লজ্জায় মুখ ফুটে কইতে পারেন না। রাত্রে বউয়ের সঙ্গে ঘুমাইলে দুই তিন মিনিটে আউট হইয়া যায়। আপনে তো নাক ডাকাইয়া ঘুমান। বউয়ের কিন্তু ঘুম আসে না দাদাভাই। বড়ো বড়ো শ্বাস ফালায়। দাঁত দিয়া ঠোঁট কামড়ায়। রান দিয়া রান চাইপ্পা ধরে। একদিন দেখবেন বউ গেছে গা আরেক লোকের লগে। আপনে দাদাভাই তালু হাতাইবেন। হেইৎ দাদারা, ভাইয়েরা; এমন যাতে না হয় আপনের মরদানা যাতে বাড়ে, আপনাদের কথা চিন্তা কইরা আমার ওস্তাদের স্বপ্নে পাওয়া ওষুধ নিতাই পিল নিতাই পিল নিতাই পিল। নিতাই আমার নাম না ভাই। আমার ওস্তাদের নাম। দিনে ছয় রাত্রে বারো, লেমটন নিভাইয়া যার যেমনে পারো মারো। আগের দিনে রাজারা দাদাভাই কবুতররে পারদ খাওয়াইত। সেই কবুতরের পায়খানা পেচ্ছাপ বন্ধ হইয়া যাইত। সেই কবুতরের মাংসের রান্না খাইয়া রাজারা সারা রাইত সারা রাইত সারা রাইত। রাজারার চাইর পাঁচটা রানি থাকত নি কন? এক রানির পক্ষে সম্ভব হইত না দাদাভাই। হেই শক্তি আছে এই নিতাই পিলে। সংসার সুখের হইয়া যাইব গা দাদাভাই। নিতাই পিল নিতাই পিল নিতাই পিল। মুহূর্তেই নিতাই পিল উধাও। এছাড়াও দাঁতের মাজন, চর্মরোগের ওষুধ, মাথাব্যথার বাম নিয়েও ক্যানভাসাররা আসত।
১৬.
শীতকাল আমাদের কাছে আসে নাকি আমরা ঘুরে ঘুরে এক স্থির চিরশীতের কাছে যাই? সোহরাবউদ্দিন স্যারের ভূগোল ক্লাস শোনার পর এই প্রশ্ন জেগে ওঠে। এই যে শীতকাল একটু একটু করে তার কুয়াশা, উত্তরের হাওয়া গুটিয়ে চলে যাচ্ছে, যাচ্ছে, নাকি আমরা সরে সরে আসছি? ফাল্গুন মাস এলেই মন কেন এলোমেলো হয়ে যায়? পরিচিত, অপরিচিত সব নারীমুখ স্বপ্নে দেখি। সেইসব নারীরা স্বপ্নে আমাকে জাগিয়ে তোলে। উত্তেজিত হই। সে যে কী সুখ! ফিনকি দিয়ে বেরিয়ে আসে চটচটে আঠালো তরল। ঘুম ভেঙে যায়। ক্লান্ত লাগে। বাবাকে ডিঙিয়ে মশারির ভেতর থেকে বেরিয়ে আসি। এতটুকুও আওয়াজ না-করে দরজা খুলি। প্যান্ট ধুয়ে দিই। এরকম মাঝেমধ্যেই হয়। কেমন যেন এক অপরাধবোধ কাজ করে। কাউকেই বলতে পারি না। এই ঋতুতেই মনে হয়, কোনো নারী আমাকে ভালোবাসুক। শুনেছি, এই এলোমেলো অসহায়তাকে স্বপ্নদোষ বলে। ক্যানভাসারদের কাছ থেকে জেনেছি, স্বপ্নের ভেতর অনিচ্ছায় শরীর থেকে বেরিয়ে আসা এই তরলকে ধাতু বলে। এই হঠাৎ পরিবর্তন একা একা বইতে হয়। কাউকে বলা যায় না।
রং খেলার দিন এগিয়ে আসে। দোল। হোলি। স্কুল পরপর দুদিন বন্ধ। মহাবীর চা-বাগান থেকে যুবকের দল ফাগুয়া খেলতে খেলতে নদী পেরিয়ে বাজারের দিকে আসে। এই দলে পুরুষেরাই নারী সাজে। কারো কারো চোখে সানগ্লাস। কোনো কোনো যুবকের পরনে রঙিন শাড়ির ধুতি। রঙিন গেঞ্জি ও শার্ট। এদের ভিড়ে গকুলকে খুঁজি। গকুল নেই। গোপাল ও অকূলও নেই। ফাগুয়ার ঋতুতে যুবকেরা সাতদিন ধরে বাড়ি বাড়ি গিয়ে কাঠিনাচ করে পতরোসৌরা বা বিনাকারো গীতের অংশবিশেষ গায়–
লাঠিবন্ধন কাঠিবন্ধন আরও বন্ধন ভাই রে
চোখে মুখে লাগলে লাঠি মোরো দোষ নাই রে…
ফাগুয়ার মাসে যুবকদের কাঠিনাচের আরও কিছু গানও বাড়ি বাড়ি গেয়ে গেয়ে অর্থ সংগ্রহ করা হয়–
মেরে আঙ্গনো মে ইকদিন আজানা সাধু সঁইয়া
বরহা বরস কি উঠোতো উমরিয়া…
গান শুনে গৃহস্থেরা টাকাপয়সা দেয়। সেই সংগৃহীত অর্থ দিয়ে অষ্টম দিনে পিকনিক ও হই হুল্লোড় হয়। ফাগুয়ার এই গান ও কাঠিনাচ পনেরো দিন ধরেও চলতে থাকে।
দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এসে এরা বংশপরম্পরায় রয়ে গেছে এই মহাবীর চা-বাগানে। উড়িষ্যা, বিহার, ঝড়খন্ড, বর্ধমান, বীরভূম, পুরুলিয়া, মধ্যপ্রদেশ, তামিলনাড়ু থেকে চা-শ্রমিক হয়ে এসে এখানেই থেকে গেছে। বোনাজ, তাঁতি, কন্ডো, মহান্তি, নায়েক, তশা, টংলা, খয়রা, তেলি, অধিকারী, ডোম, ঘাশি পদবির লোকেরা এসেছিল উড়িষ্যার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে। মুন্ডারা ঝাড়খন্ড থেকে। বিহার থেকে এসেছিল কৈরি, পাশি, সোনার, লোহার, সতনামি, গঞ্জু পদবির লোকেরা। পাঞ্জাব থেকে লুধি। মধ্যপ্রদেশ থেকে গৌর পদবির লোকেরা। তামিলনাড়ু থেকে তেলেঙ্গারা। বর্ধমান, বীরভূম, পুরুলিয়া থেকে বাগচি, কুর্মি, রায়, কৃষ্ণগোয়ালা, ভূমিজ পদবির লোকেরা। বোনাজ পদবির শ্রমিকেরা ওড়িয়া ব্রাহ্মণ। পেটের দায়ে ভিনরাজ্য থেকে চা-বাগানে কাজ করতে এসেছে। এই কাজে থেকে সন্ধ্যাহ্নিক, আরও ব্রাহ্মণ্য রীতি, আচার সম্ভব নয় বলে উপনয়ন সংস্কারের পাট উঠে গেছে। সহপাঠী গোপাল ও গকুলের পূর্বপুরুষেরা হয়ত লগুনধারী ব্রাহ্মণ ছিলেন। বাগানের কথ্যভাষা ছিলোমিলো। ভিন্ন ভিন্ন জনজাতির ভাষা মিলেমিশে এই ছিলোমিলো। এরা বাংলাও ভালো বলতে পারে। কথায় সিলেটি টানটোন রয়েছে। ওড়িয়ারা ঘরে প্রভু জগন্নাথের বিগ্রহ রাখতে ভয় পেত। সারাদিনের পরিশ্রমের পর সন্ধ্যায় নেশা করে যদি কোনো অনাচার হয়ে যায়! তাই মহাবীর বাগানে আলাদা করে জগন্নাথের মন্দির তৈরি করা হয়েছিল। একসময় শ্রমিকদের কেউ কেউ বৈষ্ণব হয়ে গেছিল। বাগানের ম্যানেজার একবার ঘোষণা দিয়েছিলেন, কোনো শ্রমিক যদি বৈষ্ণব হয় তবে সে বাগানে থাকতে পারবে না। ম্যানেজারের ভয় ছিল, শ্রমিকেরা বৈষ্ণব হলে ধর্মকর্মে মতি হয়ে যদি কাজের ইচ্ছা হারিয়ে ফেলে? ফাগুয়ার হই হুল্লোড় ছাড়াও বাগানের শ্রমিকদের রয়েছে পৌষমাসের সংক্রান্তি। গ্রামপূজা। বর্ধমানীদের করম। চা-শ্রমিকদের. কাজের সময় আটঘণ্টা। রবিবার ছুটি। ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার জন্যে রয়েছে প্রাইমারি স্কুল। চিকিৎসার জন্যে বাগানের বেসরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্র। সৎকারের জন্যে রয়েছে বাগানের শ্মশানখলা। শ্রমিকদের মধ্যে যারা বৈষ্ণব, মৃত্যুর পর তাদের মাটি দেওয়া হয়। দৈর্ঘ্য ও প্রস্থে সাড়ে তিনহাত গর্ত করে কবর দেওয়াই মাটি দেওয়া। বাগানে ম্যানেজার না থাকলে ইনচার্জ থাকেন বড়োবাবু। কর্মচারীদের মধ্যে বড়ো কেরানি। ছোটো কেরানি শ্রমিকদের পাওনা গন্ডা দেখেন। এছাড়া আছে টিলাবাবু। সুপারভাইজার। আছে জমাদার। জমাদার টিলাসর্দার ও লাইনসর্দারের কাজের খোঁজখবর রাখেন।
লংতরাইয়ের দিকে মহাবীর চা-বাগান ধনচন্দ্রপাড়া পর্যন্ত বিস্তৃত। গকুল বলেছিল, বাগানের ফাঁড়িপথ ধরে গেলে লংতরাইয়ের পাদদেশ মাত্র দশ কিলোমিটার। গকুলকে একদিন জিজ্ঞেস করেছিলাম, বাগানের নাম মহাবীর কেন? লোকমুখে যেটুকু শোনা যায়, গকুল আমাকে তাই বলেছিল। অনেক আগে রাধাকান্ত ওড়িয়া বাংলাদেশ থেকে এসে এখানে বাড়িঘর করেন। তখন বড়োজোর ৫/৭ পরিবারের বসবাস। চারদিকে জঙ্গল। বাঘ, ভালুক, সাপ-খোপের ভয়। সেদিন কোত্থেকে এক হনুমান এসে সারাদিন বাগানেই ছিল। সেই হনুমানকেই রাধাকান্ত ও অন্যান্য শ্রমিকেরা মহাবীর হিসেবেই ভেবে নিয়েছিলেন। সেই থেকে মহাবীর চা-বাগান। বাগানের বিয়ে থা শাস্ত্রীয় নিয়মেই হয়। বাগানে তখন এক ঘোষাল পরিবার ছিল। বিয়ের পুরোহিত হিসেবে ঘোষালরাই সম্পন্ন করতেন। বামনছড়াতে ব্রাহ্মণ ভট পরিবার আছে। বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ধলাই উপত্যকার চা-শ্রমিকদের এক সম্মেলন হয়েছিল চুলুবাড়িতে। সেই সম্মেলনে লালমাটির ভাগবত সর্দার বিধান দেন যে ভট বা গাঙ্গুলিরাই বাগানের যুবক যুবতিদের বিয়ের পুরোহিত হবেন। শুধু বিয়েই নয়, জাতক-জাতিকার ব্রত, অন্নপ্রাশন, শ্রাদ্ধশান্তিতেও ব্রাহ্মণ আবশ্যক। এসব সামাজিক অনুষ্ঠান একটি মাটির তৈরি বেদিকে কেন্দ্র করেই হয়।
সারাদিন পরিশ্রমের পর চা-শ্রমিকের অধিকাংশ বাইরে থেকেই নেশা করে আসত। তারপর একটা সময়ে বাগানেই মদ তৈরি শুরু হল। সাতের দশকের শেষের দিকে শ্রমিকদের নেশা করা নিয়ে পারিবারিক অশান্তি এমন একটা পর্যায়ে গেল, গোপাল ও গকুল বাগানের আরও কয়েকজনকে নিয়ে হিন্দুস্তান বেদি সম্প্রদায় নামে মদবিরোধী অভিযান শুরু করে। গকুলদের উদ্যোগে শুরু হল নিরক্ষর যুবকদের জন্যে স্কুল। যাত্রাপালার মহড়া। এতে করে নেশাড়ু যুবক ও বয়স্কদের একাংশকে স্বাভাবিক জীবনে ফেরানো গেল। মহাবীর থেকে রীতা ও মিতা দুই বোন পড়তে আসত স্কুলে। রীতা ছিল আমাদের সহপাঠী। মিতা জুনিয়র। সৌমিত্র নামে আমাদের আরেক সহপাঠীও আসত বাগান থেকে। আসত বিজয় তেলেঙ্গা। স্কুলের পড়াশোনা তাড়াতাড়ি শেষ করে শুরু হত গকুল ও গোপালের বাঁশি ও গানের রিয়াজ। স্কুলে পড়াকালীন সময়েই এই দুই ভাই যাত্রাপালার নেপথ্য সংগীত পরিচালনা করত।
মাঝেমাঝে সেই ক্লাস সেভেনের মৃত্যুচেতনা চাগাড় দিয়ে ওঠে। বিছানায় শুয়েও ঘুম আসে না। একদিন মরে যেতে হবে! এত সৌন্দর্য, এত মায়া, সবকিছু ছেড়ে চলে যেতে হবে! পাহাড়ে জুমের আগুনের লালিমা থাকবে। আমি থাকব না। রাস পূর্ণিমা থেকে যাবে। আমি নেই! নদীর গতিপথ সরে যাবে। আমি দেখতে পাব না! শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার সেই অনঙ্গ অন্ধকার। বাবা বলতেন, মৃত্যুর পরও আমি থাকে। ধীরে ধীরে সেই আমি বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যায়। বুক হু হু করে ওঠে।
এবারের সম্পদ স্বপনপুরী এবং নিতাই পিল।
এতকিছু মনে রেখেছো কি করে , রাখাল ছেলে !