Daruharidra
  • ধান্যগৃহ
  • কবিতা
  • গল্প
  • গদ্য
  • প্রবন্ধ
  • উপন্যাস
Daruharidra
  • ধান্যগৃহ
  • কবিতা
  • গল্প
  • গদ্য
  • প্রবন্ধ
  • উপন্যাস
Daruharidra
No Result
View All Result
Home গদ্য

প্রবুদ্ধসুন্দর কর || চতুর্দশ পর্ব

নীল উপত্যকার রাখাল || চতুর্দশ পর্ব

Daruharidra by Daruharidra
30/05/2021
in গদ্য
3
প্রবুদ্ধসুন্দর কর || চতুর্দশ পর্ব
310
VIEWS

১৭.

ফাল্গুনে এত হাওয়া কোথা থেকে বয়? দক্ষিণ সমুদ্র থেকে? কখনো হু হু বাতাস নৌকার মতো সাইকেলকেও সামনের দিকে ঠেলে দেয়। আবার বিরুদ্ধ বাতাসে জোরে জোরে প্যাডেলে চাপ দিতে হয়।  বাবা সবসময় সাইকেল দিতে চান না। পরিচিত কারো থেকে সাইকেল চেয়ে নিই। হেডমাস্টারের ছেলে বলে এই স্নেহটুকু পাই। আমার বাউন্ডুলে স্বভাব সবাই জানে। একদিন ফুলছড়ি থেকে বাঁদিকের অচেনা রাস্তায় সাইকেল ঘুরিয়ে দিয়ে অনেকটা সামনে এগিয়ে আবিষ্কার করে ফেলি এক চা-বাগান। কীরকম যেন ধোঁয়া ধোঁয়া। চায়ের ঝোপের মাঝে মাঝে কিছু কিছু বড়ো গাছ। পাতা হলুদ হয়ে ঝরতে শুরু করেছে। বাগানের নাম রামদুর্লভপুর চা-বাগান। আসাম প্যাটার্নের বাড়ির মতো কয়েকটি কোয়ার্টার। এই বাগান নাকি মহাবীরের চেয়েও বড়ো। উত্তরে বাংলাদেশ সীমান্ত ও দক্ষিণে গারো টিলা পর্যন্ত এই চা-বাগানের সীমানা। মালিক বিহারের। কোথাও একটি কোকিল একা একা ডাকছে। সন্ধের আগে ফিরে আসতে হবে। বাতাসের উল্টোদিকে জোরে জোরে প্যাডেল চাপি।

দুদিন ছুটির পর স্কুলে গিয়েও রেহাই নেই। সহপাঠী ছেলে ও মেয়েদের কেউ কেউ লুকিয়ে ঠিক আবির এনেছে। খুব বাজে ধরনের রং খেলা হচ্ছে আঙুলে মিনা রং অর্থাৎ হিরাকষ নিয়ে পেছন থেকে হঠাৎই এসে জাপটে ধরে মুখের ভেতর ঢুকিয়ে দাঁতে ও মাড়িতে ঘসে দেওয়া। সেই রং মিলিয়ে যেতে এক সপ্তাহ বা দশ দিন লাগত। প্রতিটি বাঙালি পরিবারে মাটির ছোটো বেদি গড়ে দোলের দিন তাতে লাল-নীল-সবুজ আবির দিয়ে ধূপকাঠি, মোমবাতি দিয়ে রাধাকৃষ্ণের উদ্দেশ্যে পুজো দেওয়া হয়। কোনো কোনো বাড়িতে কীর্তনও হয়। লুৎমার মণ্ডপে এখন বসন্তরাস। সংস্কৃত মেধাবৃত্তির পরীক্ষা সামনে। পণ্ডিত স্যারের বাড়িতে মাঝেমাঝে পড়তে যাই। পণ্ডিত স্যারের পোশাকি নাম গৌরাঙ্গ। বাড়ি মেলাঘরে। সপরিবারে স্কুলের উল্টোদিকে গোপাল দত্তদের বাড়িতে ভাড়া থাকেন। কথায় কুমিল্লার টান। সংস্কৃত ছাড়াও স্কুলে বাংলা পড়ান। পণ্ডিত স্যারের বাড়িতে গিয়ে সংস্কৃত হেল্প টু দ্য স্টাডিজ করতে হয়। ট্রান্সলেশন করতে হয়। শব্দরূপ। ধাতুরূপ। লট। লঙ। লোট। গদ্য-পদ্য। কারক-বিভক্তি। উপসর্গ। প্রত্যনুধিঙনিকষান্তরান্তরেণযাবদ্ভি।

কমলপুর ফুলছড়ি বয়েজ হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলে সংস্কৃত মেধাবৃত্তি পরীক্ষার ভেন্যু। এর সপ্তাহখানেক আগে সালেমাতে ন্যাশনাল স্কলারশিপ পরীক্ষা দিয়ে এসেছি। পরীক্ষায় লিখতে গিয়েই বুঝেছি, এ আমার দ্বারা হবে না। গতবছর উপরের ক্লাসের কানাইদা জাতীয় মেধাবৃত্তি পেয়েছিল। বয়েজ স্কুলের সেন্টারে গিয়ে দেখি, আমাকে নিয়ে মোট পরীক্ষার্থী তিনজন। লুৎমা হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলের দুই ছাত্রী। পরীক্ষা দেওয়ার পর নিশ্চিত হতে পারছি না। পাবই, এটাও জোর দিয়ে বাবাকে বলতে পারছি না।

কমলপুরের কানু মজুমদার সপরিবারে হঠাৎই অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। কোনো চিকিৎসাতেই সেরে উঠছেন না। বাংলাদেশ থেকে এক ফকির এসে সুস্থ করে তুললেন গোটা পরিবারটিকে। সেই ফকিরকে নিয়ে আসা হল চৌধুরীবাড়িতে। জুন্টুদার ঘাড়ে একটা পুরোনো অসহ্য ব্যথা। প্রায়ই ফিরে ফিরে আসে। অনেক ডাক্তারই দেখানো হয়েছে। একদিন সকালে সেই ফকির এসে দু একটা কলাগাছের খোল দিয়ে কয়েকটা পাত্র তৈরি করে বাজার থেকে নতুন ব্লেড আনতে বললেন। জুন্টুদা স্নান করে এসে চেয়ারে বসলেন। ফকির জুন্টুদার ডানহাত টেনে নিয়ে বিড়বিড় করে কিছু বললেন। তারপর নতুন ব্লেড দিয়ে বাঁ হাতের কবজির নীচে একের পর এক ছোটো ছোটো পোচ দিতে শুরু করলেন। নীচে রাখা কলাগাছের খোলের পাত্রে টপ টপ করে রক্ত পড়ছে। ফকির সুর করে দুটো কলি বারবার গাইছেন, ঊনকোটি নালের বাহী মধ্যে নামো গো/ রহিতে না পারো তুমি মস্তকের ভিতর/ ঊনকোটি নালের বাহী মধ্যে নামো গো…। জুন্টুদার চোখেমুখে ব্যথার কোনো ছাপ নেই। টপ টপ করে ফোঁটা ফোঁটা কালো রক্ত জমা হচ্ছে পাত্রে। এভাবে আধঘণ্টা চলতে থাকার পর ফকির থামলেন। এর কয়েকদিন পরই ফকিরকে নিয়ে আসা হল সমীর স্যারের ভাড়াবাড়িতে। সমীর স্যারের প্রায়ই শ্বাসকষ্ট হয়। একইভাবে সুর করে গেয়ে গেয়ে ফকির সমীর স্যারেরও চিকিৎসা করলেন। হালাহালিতে হায়াৎ আলি নামে আরেকজন ছিলেন। মৌলবি। সবসময় ফিটফাট থাকতেন। সুদর্শন। হায়াৎ আলি নখদর্পণ জানতেন। একমাত্র তুলারাশির কিশোরেরাই এই নখদর্পণের মিডিয়াম হতে পারত। মিডিয়ামের বাঁ হাতের বুড়ো আঙুলের নখে অল্প সরিষার তেল মেখে হায়াৎ আলি নখদর্পণ করতেন। সেই তৈলাক্ত নখে ছবি ভেসে উঠত। নখের পর্দায় জ্বিন ডেকে আনতেন আলিসাহেব। হায়াৎ আলির সবচেয়ে ভালো মিডিয়াম ছিল বাবার বন্ধু শৈলেন স্যারের ছোটো ছেলে। তার নখে ছবি খুব সহজেই ভেসে উঠত। হায়াৎ আলি যে ছেলেকে মাঝেমধ্যে ডেকে নিতেন, শৈলেন স্যারের পছন্দ ছিল না। ভদ্র, বিনয়ী, হায়াৎ আলিকে মুখের উপর না করতে পারতেন না।

তারিণী স্যার ভুলো মনের মানুষ। সবসময়ই ধুতি আর ঘিয়া রঙের পাঞ্জাবি। স্যারকে নিয়ে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে একটি গল্প খুব চালু ছিল। কতটা সত্যি মিথ্যে তা জানা নেই। তারিণী স্যার নাকি একবার পায়খানায় পড়ে গিয়ে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলছিলেন, কোথায় স্বর্গ কোথায় নরক/ কে বলে তা বহুদূর… । এইটুকু বলতে বলতেই নাকি স্ত্রীকে ডেকে বলছিলেন, অ সুব্রতর মা, আমি পড়ি গেছি। আমারে তোলো। আমাদের বেতানোর জন্যে গোপ স্যার কোনো না কোনো ছুতো খুঁজতেন। ক্লাসে এসে হয়ত ব্ল্যাকবোর্ডে চক দিয়ে একটা বড়ো অ্যা স্কোয়ার এঁকে পাশাপাশি একটি ছোটো অ্যা স্কোয়ার আঁকলেন। এরপর জিগ্যেস করলেন, এই দুইটার পার্থক্য কী? সবাই চুপ। প্রত্যেকেই ভাবছে স্যার যখন লিখেছেন, নিশ্চয়ই কিছু একটা পার্থক্য থাকবে। কিছুক্ষণ পরই গণবেত্রাঘাত। রাজীব স্যার লাইফ সায়েন্স খুবই ভালো পড়াতেন। রাজীব স্যার ঢুকছিল শব্দটিকে সবসময় বলতেন ঢুকছল। পরিতোষ স্যারের রাগি ইমেজ ছাড়াও নকশাল রাজনীতির ফিসফিসানির জন্যেও ছাত্ররা স্যারকে ভয় পেত। একদিন এক অভাবনীয় কাণ্ড! টেনে ক্লাস করাতে গিয়ে স্যার বোধহয় কৃষ্ণকুমার দেববর্মাকে মারতে গেছিলেন। গাট্টাগোট্টা কৃষ্ণকুমার এর আগেই খপ করে স্যারের হাত ধরে ফেলেছিল। কৃষ্ণকুমার নাকাসি পাড়ার সি পি আই এম লিডার কুসুম দেববর্মা ও বিক্রম দেববর্মাদের বাড়ির ছেলে। পরে ঘটনাটি কীভাবে মিটমাট করা হয় তা অবশ্য আর কানে আসেনি।

চন্টুর কাছে থাকত হাঁড়ির খবর। কার সঙ্গে কার প্রেম, কে কাকে চিঠি দিয়েছে, ইত্যাদি। সঞ্জীবের ভেতর রহস্যময় কিছু একটা ছিল। বেশ কিছু মেয়েই সঞ্জীবকে চাইত। স্বভাবে লাজুক, মিতভাষী, সঞ্জীব এড়িয়েই যেত। পশ্চিম হালাহালির একটি ছেলেকে দেখে খুব ঈর্ষা হত। সুরজিৎ সিংহ ওরফে মান্তুন। হঠাৎ হঠাৎ তার সঙ্গে আমাদের বিভিন্ন জায়গায় দেখা হয়ে যেত। কখনো চা-বাগানের পথে। কখনো নাকফুলে। কখনো বা নদীর চরে। হাফ প্যান্ট পরা, কখনো গোল গলা গেঞ্জি। কখনো বা হাফ শার্ট। একমাথা কোঁকড়ানো চুল। মায়াবী দুটি চোখ। খুবই সুন্দর দেখতে। মান্তুনের স্কুল নেই। প্রাইভেট টিউটর নেই। সারাদিন প্রকৃতির সন্তানের মতো ঘুরে বেড়ায়। হাফ প্যান্টের দু-পকেট ভর্তি প্রেমপত্র। মান্তুন কতদূর পড়াশোনা করেছে তা আমরা কেউই জানি না। খুব সুন্দর হাতের লেখা। প্রেমিকাদের উদ্দেশ্যে লেখা চিঠিগুলি, প্রেমিকাদের দেওয়া চিঠি সে আমাদের পড়ে শোনাত। মান্তুনের লেখা সেইসব প্রেমের চিঠিগুলির অসাধারণ ভাষাজ্ঞান। কখনো কখনো প্রেমের সুখদুঃখের গল্প শোনাত। মান্তুনের মতো প্রেমিক হালাহালিতে আমার আর চোখে পড়েনি।

প্রতিটি চৈত্রমাসই একরকম। যতদূর চোখ যায় ঝাঁ ঝাঁ রোদ। একফোঁটা বৃষ্টি নেই। গরমে রাস্তার পিচ গলে জবজবে। মাঝেমাঝে লাল ধুতি পরা, খালি গায়ে লগুন, সন্ন্যাসীদের চোখে পড়ে। সারা শরীরে রুপোলি রং- মাখা জটাজুটধারী মহাদেব হেঁটে যাচ্ছে ভরদুপুরে। হাতে ত্রিশূল। পেছনে শাড়ি পরা ঘোমটা দেওয়া, মাথায় মুকুট পার্বতী। সঙ্গে ঢাকি। পার্বতী কোনো মেয়ে নয়। ছেলেকেই পার্বতী সাজানো হয়েছে। গৃহস্থের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ও বাজারে বাজারে গিয়ে সন্ন্যাসী হাঁক দেয়। একেকটি কথার পরেই ঢাক বেজে ওঠে। গৃহস্থেরা চাল ডাল সবজি টাকা পয়সা দেয়। দোকানদারেরাও সাধ্যমতো টাকাপয়সা দেয়। সারা চৈত্রমাস রোদে পুড়ে পুড়ে এই কৃচ্ছসাধন। হরগৌরীর বিয়ের গান। নানা ধরনের আচার। চৈত্রসংক্রান্তির দিন এই চড়ক তথা গাজনের মেলা। গাজন শব্দটি এসেছে গর্জন থেকে। শিব ও পার্বতীর বিয়েতে ভূত-প্রেতদের গর্জন। তবে চড়কের সঙ্গে শিবের মাহাত্ম্যের কোনো যোগাযোগ নেই। চড়ক মূলত সূর্য উৎসব। চক্রক শব্দটি ভেঙেই চড়ক। এই সংক্রান্তির দিনই দ্বাদশ রাশি পরিক্রমাশেষে সূর্যের অয়নযাত্রা শুরু হয়। এর আগে আমরা হারবিষু, মহাবিষুতে কিছু লোকাচার পালন করি। এই বিষু কথাটি বিষুব থেকে। হালাহালিতে দুটো জায়গায় চড়কের মেলা হয়। মহাবীর থেকে বামনছড়া যাওয়ার পথে চা-বাগানের মাঠে। আরেকটি নাকফুল থেকে লুৎমার দিকে বেঁকে যাওয়া রাস্তার বাঁদিকের শুকনো ধানখেতে। চড়কের গাছ আসলে সূর্যের অয়নযাত্রার কম্পাস ও পরিক্রমার প্রতীক। সন্ন্যাসীদের পিঠে বঁড়শি গেঁথে চড়কগাছে পাক খাওয়ানো, জ্বলন্ত অঙ্গার নিয়ে লোফালুফি, লোহার শিক দিয়ে জিভ ছিদ্র করা, ধারালো দা বা কাঁটাওয়ালা তক্তায় শুয়ে পড়া ইত্যাদি অভিচার ক্রিয়া একধরনের অবৈদিক কায়াসাধনা। শরীরকে কষ্ট দিয়ে পরমাত্মাকে জাগ্রত করার সাধনা।

হালাহালিতে এই গাজনের পাশাপাশি চলতে থাকে চা-বাগানের ওড়িয়া শ্রমিকদের দণ্ডযাত্রা। এটি মূলত উড়িষ্যার প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর  উৎসব। ওড়িয়া দণ্ডপুরাণ অনুসারে এই একমাসব্যাপী ক্রিয়াচার হয়। এই দণ্ডযাত্রা দু-ধরনের। ধূলিদণ্ড। পাণিদণ্ড। ধূলিদণ্ডযাত্রায় কৃচ্ছসাধন বেশি। চা-বাগানের বাইরে নির্জন জায়গায় জানিঘরে চারটি দণ্ড সারাবছর থাকে। এই দণ্ড মানে কোনো লাঠি নয়। পোড়ামাটির কল্কের মতো মাপের চারটি দণ্ড। ধূলিদণ্ডে তেরোজন লগুনধারী ভক্ত পুরো চৈত্রমাস গাছতলায় কাটায়। আতপ চালে সবজি দিয়ে সেদ্ধভাত খায়। প্রথম দিন স্নান করে জানিঘর থেকে দণ্ড বের করে আনা হয়। দেবী কালীর নবরূপ বর্ণনা করা হয়। প্রচুর লোকজন জড়ো হয়। কল্কের মতো সেই দণ্ডে ঘি ঢেলে কাপাসের সলতে রেখে আগুন জ্বালানো হয়। এরপর দণ্ডধারীরা ধূলিতে গড়াগড়ি খেতে খেতে জ্বলন্ত দণ্ড নিয়ে লোফালুফি করতে থাকে। দণ্ডের আগুন এতটুকুও নেভে না! স্নানশেষে মাকে স্থাপন করা হয়। এই দণ্ডযাত্রা যাত্রাপালার মতো কিছুদিন পরপরই একেক পাড়াতে হয়। ভক্তেরা বিভিন্ন সাজে খোলা জায়গায় মহাদেব ও পার্বতীর গুণগান, বাঁশ ও বাঁশির জন্মের কাহিনি, নূপুর-ঘুঙুর-শঙ্খ সিঁদুর-কলাগাছ-নৌকা ইত্যাদির জন্মকাহিনির বর্ণনা করে। হাঁড়িনাচ হয়। হাঁড়ি ও হাঁড়িয়ানি আসে। এরপর প্রভানাচ। প্রভানাচে কোনো গান নেই। শুধু ঢোল বাজে। সঙ্গে কাঁসর। ভক্তদের কেউ মহাদেব সাজে। কেউ চড়িয়া রাজা। কেউ বা নারদ সেজে পতরসরৌ বা বীণাকারো গায়। পালার একেকটি দৃশ্যকে বলে সোয়াং। শেষদিনে জানিঘরে মা কালীকে স্থাপন করা হয় ও দণ্ড রেখে আসা হয়। মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হলে বা করতে শ্রমিকদের কেউ কেউ দণ্ডযাত্রার মানতও রাখে। পাণিদণ্ড ততটা কৃচ্ছসাধনের নয়। বাড়িতে থেকেও করা যায়।

চৈত্রের এই রোদ্দুরে কি সত্যিই কাঠ ফাটে? কালবৈশাখী আসার আগে কেন ছিটেফোঁটাও বৃষ্টি হয় না? ছোটোবেলা একটি গান গাইতে গাইতে বাবা আমাকে ঘুম পাড়াতেন। কেমন এক করুণ সুর। এখনো গানটি মনে পড়লে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে–

আয় বৃষ্টি ঝেঁপে ধান দেব মেপে

আয় রিমঝিম বরষার গগনে রে

কাঠফাটা রৌদ্রের আগুনে

আয় বৃষ্টি ঝেঁপে আয়রে।

হায় বিধি বড়োই দারুণ

পোড়ামাটি কেঁদে মরে ফসল ফলে না

ক্ষুধার আগুন জ্বলে আহার মেলে না

কী দেব তোমারে নাই যে ধন খামারে

মোর কপালগুণে

কাঠফাটা রৌদ্রের আগুনে…

অনেক অনেক বছর আগের কথা। হালাহালিতে সেবার অনাবৃষ্টি। ধানজমি ফুটিফাটা। রোদের প্রখর তেজ। কোনো প্রার্থনা, কোনো হাহাকারই কাজ দিচ্ছে না। এক গভীর রাতে তিন মণ্ডপের তিন পুরোহিত নগ্ন হয়ে তিন ঘাটের জল বয়ে এনে সেই জল ঢেলে স্নান করে বৃষ্টির আবাহন করলেন। সেই রাতেই ঝমঝমিয়ে প্রবল বর্ষণ। হালাহালিতে মণিপুরি সমাজে কেউ কেউ আছেন যারা মন্ত্র পড়ে বৃষ্টির দিকপরিবর্তন করতে পারেন। ঝড়তুফান থামানোর জন্যে ছোটোবেলায় ঠাকুমাকে দেখতাম, কাঠের পিঁড়ি বাইরে উঠোনে ছুড়ে দিতে ও শঙ্খ বাজাতে। আমরা যখন হালাহালিতে ছিলাম তখনও তীব্র খরায় বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি নারীরা বৃষ্টির আবাহন করতেন। এই আবাহনই বরণ ডাহানির এলা অর্থাৎ বৃষ্টি আবাহনের গান–

ক্ষমূলে মাটি হুকেইল— লৈপাক পুঙৌ কইল।

সরালেলতে রাজারো— লৈপাক পুঙৌ কইল।।

বরন দে দৌরাজা— বরন দে দৌরাজা।

লৈপাকে মাখঙে মারা— খইমুয়ে জাঙাল দিল।।

চিংখং কালা কইল— মইরাঙে লেইবীর তিলে হমা।

বরন দে দৌরাজা— বরন দে দৌরাজা।।

চহা জুড়া বাধ উয়াল-পা— খুপা লামবেল ইল।

অসি লৌদি করিনো— খুনো পামফেল্ লৌনে।।

লেই নিংথৌ— নংনা হইবা মালে।

বরন দে দৌরাজা— বরন দে দৌরাজা।।

এই গানটি এত প্রাচীন, যে, এর আক্ষরিক অনুবাদ বা ভাবানুবাদ আজও সম্ভব হয়নি। শুধু এটুকু ধারণা করা যায়, এটি বৃষ্টির দেবতার উদ্দেশ্যে বৃষ্টির জন্যে আকুল প্রার্থনা। ১৫১৫ খ্রিস্টাব্দ বা কয়েক বছর পর গানটির প্রচলন শুরু হয়েছিল। ১৯৫৯ সালে প্রকাশিত এই গানটির একটি গ্রহণযোগ্য ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট উল্লেখ করেছিলেন ড. কালীপ্রসাদ সিংহ।

মণিপুরের নাম তখনো মণিপুর হয়নি। মৈরাং রাজার সঙ্গে খুমল রাজা বেশ কয়েকবারই যুদ্ধে হেরে গেছেন। শেষবারের মতো সমস্ত শক্তি নিয়ে খুমল রাজা যুদ্ধের ছক কষছেন। রাজার ছোটোভাই চমেই দাদাকে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ থেকে বিরত থাকার অনুরোধ জানালে খুমল রাজা চমেইকে লাথি মেরে রাজসভা থেকে বের করে দেন। অপমানে চমেই রাজ্য ছেড়ে জঙ্গলে চলে যান। চমেইকে অনুসরণ করে করে তার বেটি অর্থাৎ চাকরানিও জঙ্গলে চলে আসে। বারবার ফিরে যেতে বলা হলেও বেটি কিছুতেই রাজ্যে ফিরে যেতে রাজি নয়। কোনো উপায় না দেখে চমেই বেটিকে বিয়ে করে। তিনটি বছর তাদের জঙ্গলেই কেটে যায়। একটি সন্তানও হয়। ওদিকে খুমল রাজ্যে গত তিন বছর অনাবৃষ্টি ও দুর্ভিক্ষ। জ্যোতিষীরা খুমলরাজকে বললেন, চমেইকে অপমান করা হয়েছে বলে পাহাংপা দেবতা ক্রুদ্ধ। এই সরীসৃপ দেবতা পাহাংপার কোপেই খুমল রাজ্যে বৃষ্টি নেই। ফলে চারদিকে দুর্ভিক্ষ। জ্যোতিষীর কথা মেনে খুমল রাজা স্ত্রীপুত্রসহ চমেইকে জঙ্গল থেকে রাজ্যে ফিরিয়ে আনতেই ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি। রাজ্যে আবার কৃষিকাজ শুরু হল। প্রজারা লুসু বা পারণ দিয়ে মাছ ধরতে লাগল। এরপর থেকেই বরণ ডাহানির এলা শুরু হয়।

তৎকালীন কমলপুর ও কৈলাসহর মহকুমায় গ্রামের দিকে যেসব এলাকায় বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি সম্প্রদায়ের বসতি, সেইসব লোকালয়ে চৈত্রমাসের দাবদাহে ও খরায় বরণ ডাহানির এলা প্রথার প্রচলন ছিল। শুক্লপক্ষে পূর্ণিমার রাতে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি সম্প্রদায়ের বিবাহিতা নারীরা গভীর রাতে গোটা লোকালয় স্তব্ধ হয়ে গেলে কোনো এক নির্জন প্রান্তরে নগ্ন হয়ে বৃষ্টির দেবতার কাছে গান গেয়ে গেয়ে সমবেত প্রার্থনা জানাতেন। এরপর শুরু হত বৃষ্টির দেবতার উদ্দেশ্যে অশ্লীল গালিগালাজ। এই লোকাচার অঞ্চল বিশেষে একেক রকম। চৈত্রের খরায় বৃষ্টির জন্যে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরিদের আরও দুটো লোকবিশ্বাস আছে। কোনো গৃহস্থের ভাতের হাঁড়ি চুরি করলে তীব্র খরায় বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এছাড়াও কোনো গৃহস্থের ঢেঁকি অলক্ষ্যে সরিয়ে কোনো পুকুরে ফেলে দিলে বৃষ্টি নেমে আসে। আবার কালবৈশাখী ঝড়ের তাণ্ডব রুখতেও মহিলারা ঘরের পেছনে গিয়ে গালিগালাজ করতেন।

বৃষ্টি আবাহনের জন্যে গান মণিপুরিদেরও প্রথা। মণিপুরে এই আবাহনই নোংলাউ ঈশৈ। ত্রিপুরার গ্রামগুলিতে যেখানেই মণিপুরি বসতি আছে সেখানে নোং কৌবা বা বৃষ্টির জন্যে আকুল প্রার্থনার রেওয়াজ ছিল। মণিপুরে নোংলাউ ঈশৈ-র অনেক গানের মধ্যে যেমন একটি গান—

নোং ও চুরো

হনুবী হনুবা তাউথরো

লাংজিং মতোন

থুমহৎলো

পাৎশোয় নুরাবী তাউথরো

উনম পাখং খুঞ্জরো

গানটির বাংলা ভাবানুবাদ– এসো বৃষ্টি, বৃষ্টি এসো। বুড়োবুড়িরা যাক ভেসে যাক। ডুবে যাক লাংজিং পাহাড়চূড়া। নদী ও নালায় ভেসে যাক ওই গ্রামের যুবতিরা। তুলে নিক তাদের এ গ্রামের দুষ্টু যুবকেরা।” ত্রিপুরাতে এই নোং কৌবা মূলত গ্রামের যুবকেরাই করত। সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে এলে মণিপুরি যুবকেরা তাদের গামছা মাথায় বেঁধে নিয়ে নগ্ন হয়ে বৃষ্টি আবাহনের গান গেয়ে গেয়ে রাস্তায় হেঁটে যেত। সেই কৈশোরে আমার মনে হত, প্রচণ্ড গরমে, খরা ও অনাবৃষ্টিতে তামাম কৃষকদের হাহাকার ও আর্তি হয়ে বিলাপে বুক চাপড়াচ্ছেন আব্বাসউদ্দিন।

ক্রমশ….
Tags: আত্মজৈবনিকধারাবাহিক গদ্যপ্রবুদ্ধসুন্দর কর
Previous Post

রাজেশ শর্মা

Next Post

অমিতাভ দেব চৌধুরী || পঞ্চম পর্ব

Daruharidra

Daruharidra

Next Post
অমিতাভ দেব চৌধুরী || পঞ্চম পর্ব

অমিতাভ দেব চৌধুরী || পঞ্চম পর্ব

Comments 3

  1. চঞ্চল চক্রবর্তী says:
    1 year ago

    বেশ লেগেছে।

    Reply
  2. মনোজ পাইন says:
    1 year ago

    দারুণ। দারুণ লাগছে লেখাটি

    Reply
  3. Tapan Mohanta says:
    1 year ago

    অসমের ধুবড়ি জেলার রাজবংশী কৃষক সমাজে বৃষ্টি আবাহনের জন্য লৌকিক পুজোর নাম হুদুমদেও। অনাবৃষ্টির সময় কৃষক পত্নী ও বিধবারা গভীর রাতে নির্জন প্রান্তরে উলংগ হয়ে এই পুজো করেন। প্রাচীন কালে একটি প্যাঁচা ধরে খুঁটির সাথে বেঁধে চারদিকে নাচগান সহ এই পুজো করা হত। পরবর্তীকালে হুদুর (প্যাঁচার) পরিবর্তে সহোদর ভাইবোন না থাকা সন্তানের এক নিঃশ্বাসে কাটা কলা গাছ (হুদুম খুঁটি) প্রধান পূজারিণী পুজাস্থলীতে পুতার সাথে সাথে বৃষ্টি নামার লোকবিশ্বাস সমাজে প্রচলিত। যদি বৃষ্টি না নামে তবে তিন দিন অপেক্ষা করে হুদুমদেও পুজো করা হয়। পুরুষ বর্জিত বৃষ্টি আবাহনের এই হুদমদেও পুজো আজও রাজবংশী সমাজে প্রচলিত।

    Reply

Leave a Reply Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

No Result
View All Result

RECENT POSTS

মেখলা পরা মেয়ে || শ্রীযুধাজিৎ || অন্তিম পর্ব

মেখলা পরা মেয়ে || শ্রীযুধাজিৎ || অন্তিম পর্ব

15/04/2022

সঞ্জয় চক্রবর্তী || অন্তিম পর্ব

09/04/2022
মেখলা পরা মেয়ে || শ্রীযুধাজিৎ || দ্বাবিংশতি পর্ব

মেখলা পরা মেয়ে || শ্রীযুধাজিৎ || দ্বাবিংশতি পর্ব

08/04/2022

সঞ্জয় চক্রবর্তী || নবম পর্ব

02/04/2022
মেখলা পরা মেয়ে || শ্রীযুধাজিৎ || একবিংশতি পর্ব

মেখলা পরা মেয়ে || শ্রীযুধাজিৎ || একবিংশতি পর্ব

01/04/2022

সঞ্জয় চক্রবর্তী || অষ্টম পর্ব

27/03/2022
মেখলা পরা মেয়ে || শ্রীযুধাজিৎ || বিংশতি পর্ব

মেখলা পরা মেয়ে || শ্রীযুধাজিৎ || বিংশতি পর্ব

25/03/2022
সঞ্জয় চক্রবর্তী || সপ্তম পর্ব

সঞ্জয় চক্রবর্তী || সপ্তম পর্ব

20/03/2022
মেখলা পরা মেয়ে || শ্রীযুধাজিৎ || উনবিংশতি পর্ব

মেখলা পরা মেয়ে || শ্রীযুধাজিৎ || উনবিংশতি পর্ব

18/03/2022
ষষ্ঠ পর্ব || সঞ্জয় চক্রবর্তী

ষষ্ঠ পর্ব || সঞ্জয় চক্রবর্তী

13/03/2022

RECENT VIDEOS

https://www.youtube.com/watch?v=77ZozI0rw7w
Daruharidra

Follow Us

আমাদের ঠিকানা

দারুহরিদ্রা
কুঞ্জেশ্বর লেন
(বরাকভ্যালি একাডেমির নিকটবর্তী)
নতুন ভকতপুর, চেংকুড়ি রোড
শিলচর, কাছাড়, আসাম
পিন-788005

ডাউনলোড করুন

সাবস্ক্রাইব

Your E-mail Address
Field is required!
Field is required!
Submit
  • আমাদের সম্পর্কে
  • লেখা পাঠানো
  • যোগাযোগ

Copyright © All rights reserved Daruharidra | Development by Prosenjit Nath

No Result
View All Result
  • ধান্যগৃহ
  • কবিতা
  • গল্প
  • গদ্য
  • প্রবন্ধ
  • উপন্যাস
  • সাক্ষাৎ পাতা
  • অনুবাদ পাতা
  • আর্কাইভ
  • আমাদের সম্পর্কে
    • লেখা পাঠানো
    • যোগাযোগ

Copyright © All rights reserved Daruharidra | Development by Prosenjit Nath