দারুহরিদ্রা:- ব্যক্তিগত প্রসঙ্গে আপনি বারবার কবিতার কথা কেন টেনে আনছেন?
অমিতাভ:- ও এসে যায়। এমনিতেই। আসলে সচরাচর এরকম ইন্টারভিউ দিতে আমরা কেউই অভ্যস্ত নই। তোমরা যেহেতু সিরিয়াস, আমি তোমাদের সাজেস্ট করব, আমার প্রজন্মের উত্তর-পূর্বের প্রধান কবিদের ইন্টারভিউ নিতে।
১৭. দারুহরিদ্রা:- আপনার মতে এই প্রধান কবি কারা?
অমিতাভ :- দেবাশিস তরফদারদা তো একজন ছাদের মতো মানুষ। কিন্তু তিনি অসম্ভব নির্জনতাবিলাসী। তিনি ইন্টারভিউ দিতে রাজি হবেন বলে মনে হয় না। সব সময় নিজের শিল্পসম্ভোগ ও কারুবাসনার জগতে বাস করেন। বেশ কয়েকমাস আগে তাঁর সঙ্গে যখন ফোনে কথা হয়, তখন বলছিলেন তিনি প্রুস্ত-এর সাতখণ্ডে লিখিত হারানো সময়ের খোঁজে (À la recherche du temps perdu) পড়ছিলেন। তাও আবার ওরিজিনাল ফ্রেঞ্চে। ভাবা যায়? আমার জানা মতে অনেক পণ্ডিতও এই বইটা পড়েননি।
দেবাশিসদা অগ্রজ কবি। আমাদের ইমিডিয়েট পুর্বসূরীদের মধ্যে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার তপন মহন্তর কবিতা আমার ভালো লাগে। তাঁর কবিতায় রাজনীতির শাণিত অথচ গোপন টাচ থাকে। তারপর, আমার বিচারে, আমাদের সময়ের উত্তর-পূর্বের প্রধান বাঙালি কবিরা হলেন সঞ্জয় চক্রবর্তী, পার্থপ্রতিম মৈত্র (বহুদিন ধরে কলকাতা বাসী), পল্লব ভট্টাচার্য, তপন রায়, মিলনকান্তি দত্ত, স্বাতী ইন্দু, বিশ্বজিৎ দেব, প্রবুদ্ধসুন্দর কর, বিকাশ সরকার, অশোক দেব, স্বর্ণালী বিশ্বাস ভট্টাচার্য, সুব্রত কুমার রায়, সপ্তর্ষি বিশ্বাস, প্রদীপ মজুমদার। সঞ্জয়, পল্লব, তপন রায়, প্রবুদ্ধ, বিকাশ, অশোক, স্বর্ণালী, সপ্তর্ষি এরা সম্ভবত আমার চেয়ে বড় কবি। আমার মনে হয়, আমি অনেকটাই ওভাররেটেড। যতটুকু পাওয়ার তার চেয়ে বেশি পেয়ে বসে আছি। এদের মধ্যে মিলনকান্তি মহাপণ্ডিত। কবি ও সন্ন্যাসী। তিনি তাঁর মতো করে ইউরোসেন্ট্রিক যুক্তিবিধানকে অস্বীকার করতে পেরেছেন। হয়তো ইউরোসেন্ট্রিক র্যাশনালিজমের চেয়ে প্রাচ্যের মিস্টিসিজম ঢের আকর্ষণীয়। গ্রামের চণ্ডীমণ্ডপে বসে বিচার করার চেয়ে একা ঘরে দু-চারজনকে জুটিয়ে প্ল্যানচেট করাটা বা সেঅঁসে বসা মোটেও কম কিছু নয়। তাতে, আর কিছু না হোক, বিশ্ববিধানের প্রতি মনের একটা বিস্ময় প্রকাশ পায়। তো মিলনের কবিতা একরকম। আবার, এই যেমন সেদিন পল্লব ফোনে তার একটা কবিতা শোনালো। শুনতে শুনতে গায়ে কাঁটা দিল। তপনের ‘বিরাটনগর’ পড়ে আমার মনে পড়ছিল বুদ্ধদেব বসুর ‘মহাভারতের কথা‘র শেষদিকে ভবিষতের কোনও কল্পনার কবির কাছে করা বু.ব.-র সেই গভীর আমন্ত্রণের কথা। এতদিন পরে আমাদের তপন রায় যেন বু.ব.-র কল্পনার সেই কবিতাটি লিখে ফেলল।
বিরাটনগর
https://drive.google.com/file/d/1CkjKpOfNelxZsqhAJboVgiDOHWpTVEy_/view?usp=drivesdk
সৌজন্য : অনুবর্তন পত্রিকা
আমি নিজে আজ পর্যন্ত ওই রকম কোনও আশ্চর্য কবিতা লিখতে পারিনি। একই সঙ্গে আঞ্চলিক, একই সঙ্গে সর্বজনীন। প্রসঙ্গত তপনের প্রায় সদ্যপ্রকাশিত একটি বইয়ের নাম ‘ৰ’। সুব্রতও বহুদিন পরে কবিতায় ফিরে এসেছে এবং এই পর্বে অসম্ভব ভালো লিখছে। সুব্রতর আগের পর্বের কবিতা আমায় ততটা টানেনি। আর রইল দু-ভাই শংকরজ্যোতি, ভাস্করজ্যোতি আর অনীতা দাশ ট্যান্ডন। শংকর ডাক্তার-কবি। ইদানীং আমার hypochondria ডেভেলাপ করার পর এই কোভিডের বাড়াবাড়ির আগে পর্যন্ত আমি শংকরের চেম্বারের নিত্যযাত্রী ছিলাম। দারুণ সজ্জন মানুষ। খুব ভালো ডাক্তার। ভেবো না আবার আমি এই ছুতোয় শংকরের বিজ্ঞাপন করে বসছি। তবে ডাক্তারদের সম্পর্কে আমার বেশ একটু দুর্বলতা আছে। এই কোভিডের পিরিয়ডেই অনেক ডাক্তারকে টিভি স্ক্রিনে হাউহাউ করে কাঁদতে দেখেছি। কে বলে ডাক্তার মাত্রেই টাকার কসাই? এখন কত ডাক্তার যে ট্রমার ভেতর দিয়ে যাচ্ছেন তার কতটুকু জানি আমরা? শংকরের হাতে এক সহজাত কবিত্ব আছে আর অনীতা বিবাহসূত্রে শিলচরের হলেও আসলে তাঁর মাতৃভাষা পাঞ্জাবী, খানিকটা উর্দুও জানে। আমাদের উত্তরপূর্বের দুই জাঁদরেল বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরিভাষী কবি প্রয়াত ব্রজেন্দ্রকুমার সিংহ ও শ্রীযুক্ত সমরজিৎ সিংহের পর অনীতাই সম্ভবত ভীষণ শক্তিশালী অবাঙালি কবি যে বাংলায় এতো স্ট্যান্ডার্ড ও সূক্ষ্ম শিল্পনৈপুণ্যের স্বাক্ষর রাখতে পেরেছে।
আমাদের ঠিক পরের প্রজন্মের প্রধান কবিরা হল শিবাশিস চট্টোপাধ্যায়, টংলার অভিজিৎ চক্রবর্তী, ত্রিপুরার তমালশেখর দে ও ত্রিপুরার অভিজিৎ চক্রবর্তী। তমোজিৎ সাহারও একটা আন্ডারটোনে কথা বলার স্টাইল আছে। ও হ্যাঁ, শংকরজ্যোতির ভাই ভাস্করজ্যোতি এই পর্বের কবিদের মধ্যে পড়বে। আমাদের ঠিক পরের জেনারেশন। আমাদের জেনারেশনের শেলী দাস চৌধুরীর খুব বিশিষ্ট কাব্যভঙ্গী আছে। আজকাল সম্ভবত খুবই কম লিখছে। সৌমিত্র বৈশ্যের হাতে সুন্দর কবিতা ছিল। কিন্তু কবিতা সম্ভবত ও একটানা লেখেনি। গদ্য এবং কথাসাহিত্য ওকে বেশি করে আকর্ষণ করেছে। আরেকজন কবি হচ্ছে বিজয় ঘোষ। তার লীলাবতী সিরিজের অনেক কবিতাই মনোমুগ্ধকর। তারপর তোমাদের জেনারেশন। প্রজ্ঞা অন্বেষা, সুতপা চক্রবর্তী, রাজেশ শর্মা, হাবিব মানে আশু চৌধুরী, দেবপ্রতিম দেব। আরেকজনের কথা বলতেই হয়। অনেকেরই মাস্টারমশাই। অর্জুন। অর্জুন চৌধুরী। শিলচরের মত একটা প্রান্তে বসে ইংরেজিতে কবিতা লেখা, ইংরেজিতে অনুবাদ করা চাট্টিখানি কথা নয়। ভুলে যেও না অর্জুনের প্রথম বই ছেপেছিলেন পুরুষোত্তম লাল। তিনি কখনও যে কোনও বই প্রকাশ করতেন না। অর্জুন খানিকটা ল্যাটিন ও ফ্রেঞ্চ শিখেছিল বলে জানতাম। ও হ্যাঁ, ও সংস্কৃতটা অনেকটা জানে। আবার অর্জুনের ছাত্রদের কেউ কেউ ইংরেজিতে ভালো কবিতা লেখে। অনুবাদও করে। সপ্তর্ষি ভট্টাচার্যর মিষ্টি একটা অনুবাদের হাত আছে। সৌমিত্র রায় ভালো অনুবাদ করে। আমার কবিতাই অনুবাদ করেছে। আমার অনুজপ্রতিম অধ্যাপক জয়দীপ বিশ্বাস তুখোড় ইংরেজি জানে। এককালে সুজিৎ চৌধুরীর অনুবাদে হাত দিয়েছিল। আর একজনের কথা না বললেই নয়। শুভ, আমার বন্ধু রবীন্দ্রসঙ্গীত গায়ক শুভপ্রসাদ দারুণ অনুবাদক। এ যাবৎ আমার লেখার যত অনুবাদ সাহিত্য অকাদেমির ইন্ডিয়ান লিটারেচার জার্নালে বেরিয়েছে, সব শুভর করা। এর মধ্যে একটা গল্প ওদের সংকলনেও গেছে এবং সে-অনুবাদ হিন্দুর মত পত্রিকায় প্রশংসিতও হয়েছে। আরেকজনের কথা না বললে অন্যায় হবে। তিনি অশোক বার্মা। বার্মাদা সেই কবে থেকে সম্পূর্ণ নিজের গরজে বরাকের অনেক বাংলাভাষী ও অন্যান্য ভাষাভাষীর কবিতা হিন্দিতে তরজমা করে যাচ্ছেন। শক্তিদার কবিতা অনুবাদ করেছেন। আমার কবিতার একটা নির্বাচিত হিন্দি অনুবাদ সংকলন ছাপিয়েছেন। এই দ্যাখো, ফাঁকতালে আত্মপ্রচার করে নিচ্ছি। আর করছিই যখন, আরেকজনের কাছে ঋণস্বীকার করব। তাঁর নাম গঙ্গানন্দ ঝা। থাকেন চণ্ডীগড়ে। হিন্দি, ইংরেজি, বাংলা তিনটি ভাষাই ভালো জানেন। এককালে জিসি কলেজে পড়াতেন। আমার কাকা অনন্ত দেবের বন্ধু ছিলেন। কাকার মৃত্যুর পর থেকে আমার প্রায় বন্ধুই হয়ে গেছেন। আমার অনেক লেখা উনি নিজে থেকে অনুবাদ করে গর্ভনাল পত্রিকায় ছাপিয়েছেন। শুভপ্রসাদের প্রবন্ধেরও হিন্দি অনুবাদ করেছেন। আসলে আমাদের দরকার মণিপুরি, ডিমাসা, নাগা, খাসি, ককবরক, অসমীয়া, বড়ো এসব সাহিত্যের উন্নত মানের অনুবাদ। উন্নত মানের কথাটায় আমি আবার জোর দিচ্ছি। নিজে জানি, দেবাশিসদা সৌরভ কুমার চলিহার লেখা অনুবাদ করার সময় কিভাবে লেখকের সঙ্গে কথা বলতেন। কিভাবে তাঁর পাণ্ডুলিপি সৌরভকে বারবার দেখাতেন। দেবাশিসদা নাগা কবিতাও অনুবাদ করেছেন। অনুবাদক হিসেবে উদয়নদা, কবি উদয়ন ঘোষ খুব উল্লেখযোগ্য। খাসি কবিতার অনেক অনুবাদ আছে তাঁর। প্রবুদ্ধসুন্দর দক্ষিণী ও হিন্দি কবিতার দুর্দান্ত অনুবাদ করেছে। বলতে বলতে এত কথাই যখন বলে ফেললাম, তাহলে আর তিনজনের নাম আমাকে নিতেই হবে। সুজিৎ চৌধুরী, উষারঞ্জন ভট্টাচার্য আর কথাকার শ্যামল ভট্টাচার্য। তিনজনই তাঁদের অনুবাদ কর্মের জন্য সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত। আর শ্যামল যে কতগুলো ভারতীয় ভাষা জানে, তা আমার নিজেরই গুলিয়ে যায়। অভিজিৎ লাহিড়ী খুব দক্ষ অনুবাদক। ও প্রচুর পড়াশোনা করে, আর অনুবাদ করে। সুজিত দাস, সুশান্ত কর, বাসুদেব দাস, প্রসূণ বর্মণ (সম্পাদক হিসেবেও নামী), বাসব রায়, তাপস পাল সবাই, ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার অনেকেই ধারাবাহিকভাবে কিংবা একটানা অসমীয়া থেকে বাংলা অনুবাদ করার কাজে ব্যস্ত থাকেন। ও হ্যাঁ, সঞ্জয় চক্রবর্তীর অসমীয়া কবিতার বঙ্গানুবাদ বই হয়ে সেদিন বেরোলো একটা। আবার আমাদের অকালপ্রয়াত অভিধানকার জগন্নাথ চক্রবর্তীর একটা পা বরাক উপত্যকায় থাকলেও আরেকটা পা থাকত সেমখরের দেশে। এন সি হিলসে। তো এই হল উত্তর পূর্বের বাস্তবতা।
১৮. দারুহরিদ্রা:- এতো যে উত্তর-পূর্ব উত্তর-পূর্ব করলেন, উত্তর-পূর্বের বাংলাসাহিত্য বলতে আপনি ঠিক কী বোঝাচ্ছেন?
অমিতাভ:- শোনো, উত্তর-পূর্বের বাংলা সাহিত্যকে কোনও দাবি–আদায়ের প্ল্যাটফর্ম বলে আমি ভাবি না। নিজেদের বঞ্চিত ভেবে চাই-চাই করাটা ভিক্ষা করার মত। আমাদের দাঁড়াতে হবে সামর্থ্য নিয়ে, দুর্বলতা নিয়ে নয়। আমি যে-মুহূর্তে নিজেকে উত্তর-পূর্বের বাংলা সাহিত্যের একজন বলে মানছি, সেই মুহূর্ত থেকে নিজের স্বাতন্ত্র্য নিয়েও একধরনের সংলগ্নতার পথ ধরেই যাচ্ছি। তখন দেবেন্দ্র কুমার কিংবা অশোকবিজয় আর সোসো থাম পাশাপাশি উচ্চারণে আসছেন। নীলিমকুমার আর প্রবুদ্ধসুন্দরকে খুব একটা দূরের গ্রহের কবি বলে ভাবা যাচ্ছে না। এই আর কী! এই যে নিজের কথা বলতে বলতে নিজেদের কথায় চলে এলাম, এটাই হল উত্তর-পূর্ব। এখানে আমি এসে কোনও এক আমরা-য় ডুবে যায়। বিজিৎকুমার ভট্টাচার্য অনেক দশক ধরেই আমাদের নিজেদের সাহিত্যের পতাকা তাঁর একা হাতে ঊর্ধ্বে তুলে ধরে লড়াই করে চলেছেন। আমরা তাতে সামিল হয়েছি মাত্র। দেবাশিস তরফদারও উত্তর-পূর্বের বাংলা সাহিত্যের কথা বলেন। তাঁর দীর্ঘ কবিতা ‘দেববীথি’, উপন্যাস ‘শরাইঘাট’ ও ‘হাসিঘর’, কিশোর উপন্যাস ‘শিলং দূরে নয়’ এগুলোতে উত্তর-পূর্বের সাহিত্যের রূপরেখা ধরা আছে। উত্তর-পূর্বের বাংলা সাহিত্য বলতে আমি বুঝি আমাদের নিজস্ব ভূগোলচেতনা, আর প্রতিবেশচেতনা-আশ্রিত বাংলা সাহিত্যকে। আমাদের ভূগোল, দেখবে, সবসময় প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যের পাশাপাশি ইতিহাসকেও সঙ্গে নিয়ে নিয়ে চলছে আর আমাদের প্রতিবেশচেতনা? তুমি যদি আজ কোনও কারণে বরাক উপত্যকা বা শিলচরকে কল্পিত কোনও বৃহৎবঙ্গের অংশ করে দাও, দেখবে সেখানেও তোমার প্রতিবেশ তোমাকে পুরো বাঙালি হতে দিচ্ছে না। তোমার পাশে পাশে সবসময় ছায়ার মতোই রয়ে যাবে ডিমাসা, অসমীয়া, খাসিয়া, গারো, মিজো, নাগা, ত্রিপুরী, বড়ো, মাররা। আমাদের বেঁচে-থাকার সঙ্গে এঁরা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বেঁচে-থাকার সঙ্গে জড়িত যারা, তারা সাহিত্যের সঙ্গে জড়িত হবে না? এসব নিয়ে আমরা অনেকেই লিখেছি। এখনও কেউ কেউ লিখছেন। বলছেন। সবাই অবশ্য বলেন না।
আরেকটা কথা, উত্তরপূর্বাঞ্চল হল তুলনামূলক সাহিত্য পঠনের আদর্শ ক্লাসরুম। এখানে এর কান টানলে ওর মাথা এসে যায়। হিন্দুকে টানলে মুসলমান আসতে বাধ্য। তবে এখানে একটা কথা। বরাক উপত্যকার বাঙালি কখনও প্রবাসী বাঙালি ছিলেন না। দেশভাগের আগেও, স্মরণাতীত কাল থেকে বরাক ও ত্রিপুরা বাঙালির বাসভূমি। পশ্চিমবঙ্গে আমাদের অবস্থান নিয়ে নানা উদ্ভট ধারণা প্রচলিত আছে যে ধারণা নিয়ে দিলীপকান্তি লস্কর চমৎকার একটি ছোটো কবিতা লিখেছেন। আমরা যে আসলে প্রবাসী নই, পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিকে তা বোঝাতে গেলে ইতিহাস বই খুলে বসতে হয়। সে মহাঝামেলা। অথচ দেখো, নামকরা ইংরাজি-কলাম লিখিয়ে ও লেখক সুদীপ চক্রবর্তী (যাকে আমি চিনিই না, কখনও দেখিইনি) আমার একটি প্রবন্ধকে তাঁর ২০১৭ -এর বই ‘The Bengalis ‘এ দিব্যি যুক্তি মেনেই উদ্ধৃত করে ফেলেছেন। আমার দিল্লিবাসী বন্ধু ও সাংবাদিক ইউসুফ ও গুরগাঁওবাসী এক বান্ধবীর কাছ থেকে জেনে দারুণ মজা লেগেছিল।
আমরা যে প্রবাসী নই, আমাদের অস্তিত্ব যে ধারাবাহিকভাবে এই ভূমিসংলগ্ন— বহুবছর ধরে তা বোঝানোর দায়িত্ব নিজের থেকেই নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন অধ্যাপক অমলেন্দু ভট্টাচার্য। ডিমাসা রাজাদের সময়ের পদ্য ও গদ্যের স্মারকগুলি, পরবর্তী আমলের অনেক অনেক হারিয়ে যাওয়া পাণ্ডুলিপি পুনরুদ্ধার করে তিনি এটাই বোঝাতে চাইছেন যে বরাকের বাঙালি প্রবাসী বাঙালি নয়। অতি সম্প্রতি এই কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউ আসার আগে প্রকাশিত হল তাঁর সম্পাদিত সাম্প্রতিকতম সংকলন ‘বরাক উপত্যকার ভট্ট সঙ্গীত’।
সেই যে আমাদের ছোটোবেলায় রিকশায় রিকশায় মাইক বাজিয়ে কবিগান গেয়ে বিভিন্ন সংবাদ পরিবেশন করতেন গ্রামীণ কবিয়ালরা, বইটি সেসব কবিগানেরই এক নির্বাচিত সংকলন। অমলেন্দু ভট্টাচার্য দেখিয়েছেন যে ‘ভট্টসঙ্গীত’, আসলে, জনজীবনে সংবাদপত্র আসন গেড়ে বসার আগের যুগের সংবাদ পরিবেশনের একমাত্র মাধ্যম। বলতে পারি, গ্রামীণ সংবাদসাহিত্য। প্রসঙ্গত, বইটির পেছনের পাতায় আমাদের তিনজনের সম্পাদনায় প্রকাশিতব্য হিরণকুমারী দত্তর লেখা তাঁর বাবা কামিনীকুমার চন্দের জীবনী থেকে প্রাসঙ্গিক অংশের উদ্ধৃতি দেওয়া হয়েছে।
আচ্ছা অনেক কথা বলে ফেলেছি। ক্লান্ত লাগছে। তোমাদেরও টাইপ করতে করতে হাত ব্যথা হয়ে যাওয়ার কথা। একটা প্রসঙ্গ বলে নিয়ে আমরা পর পর দুটো গান শুনি চলো। প্রসঙ্গটা হল এই যে অমলেন্দু ভট্টাচার্য মধ্যযুগ বিশেষজ্ঞ— ভারতের মধ্যযুগকে কিন্তু ইউরোপের কায়দায় Dark Age বললে ভুল করবো আমরা। আমাদের মধ্যযুগ ছিল আলোর যুগ। সমন্বয়ের যুগ। দুটো অর্থে সমন্বয়। এক, ধর্মের সমন্বয় আর দুই, বিভিন্ন জাতের সমন্বয়। চৈতন্য দেবের হরিবোল শুধু ভক্তিআন্দোলনের নয়, ছিল সে যুগের প্রায় এক রাজনৈতিক স্লোগান। আবার দেখো, মধ্যযুগে সাহিত্য-পাঠকের (আসলে সাহিত্য শ্রোতার) মধ্যে এলিট, নন-এলিট ভেদাভেদ ছিল না। সবার জন্য একই সাহিত্য রচিত হত। যেহেতু পুথির মাস-প্রোডাকশন সম্ভব ছিল না এবং সেসময় প্রিন্টিং মিডিয়া আসেনি, তাই সুরের মাধ্যমে এই ওরাল সাহিত্যের ট্র্যাডিশনকে যৌথস্মৃতিতে গেঁথে দেওয়ার রেওয়াজ ছিল। তার মানে কী বুঝলাম? এক, আমরা যাকে ঐতিহ্য বলি তা একরকমের যৌথচৈতন্য। আর দুই, সারাটা মধ্যযুগ গান গাইতো। এমনকি অনুবাদও গীত হত। কৃত্তিবাসী রামায়ণ, কাশীদাসী মহাভারতও গীত হত। অমলেন্দু ভট্টাচার্য আমাকে একটা ইন্টারভিউতে খুব দারুণ একটা কথা বলেছিলেন, বড়াইল পাহাড় বরাক উপত্যকাকে বাইরের পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখায় এখানে মধ্যযুগের অনেক রীতিরেওয়াজ প্রায় অবিকৃত থেকে গেছে। আমার ছোটোবেলায় আমাকে বাধ্যতামূলকভাবে বৃহস্পতিবারে লক্ষ্মীর পাঁচালি, মাঝে মাঝেই শনিবারে শনির পাঁচালি পড়তে হত। বুঝতেই পারিনি কখন পয়ার ও অন্ত্যমিল রক্তের সঙ্গে মিশে গেছে। শক্তিপদ আর আমার মধ্যে মিল একটাই। তা হল এই যৌথস্মৃতির মিল। আমি বলি রক্তের পাঁচালির মিল। অমন দুর্ধর্ষ নাগরিক রণজিৎ দাশও যে তাঁর কবিতার শেষে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে অন্ত্যমিল নিয়ে আসেন– প্রশ্ন জাগে, তা কি তিনি এই বরাকে বড় হয়েছেন বলেই?
লেকচার খারাপ দিই না, কী বলো? চলো, এবার গান শুনি। প্রথম গানটি কবীরের একটি দোঁহা। দোঁহা হল Couplet, দ্বিপদী। আর দ্বিতীয় গানটি শুভলক্ষ্মীর গাওয়া ‘জগদোদ্ধারণ’ নামে একটি কৃতি। এটিও মধ্যযুগের দাক্ষিণাত্যের সাধক-সংজ্ঞীতজ্ঞ পুরন্দরদাস-এর রচনা। পুরন্দরদাসকে বলা হয় কর্ণাটিক মিউজিকের পিতামহ। একটু জ্ঞান দিই। তোমাদের কচি মাথা একটু চিবোই। কৃতির তিনটি অংশ থাকে। পল্লবী, অণুপল্লবী ও চরণম। হিন্দুস্থানি বন্দীশে যেমন থাকে স্থায়ী, অন্তরা, সঞ্চারী ও আভোগ। পারলে একবার থ্যাগরাজ ফেস্টিভ্যালে গিয়ে গান শুনে এসো। ‘জগদোদ্ধারণ’র মানে হচ্ছে: দ্যাখো দ্যাখো যশোদাকে, বেচারি বুঝতেই পারছেন না তিনি যাকে ছেলে হিসেবে পেয়েছেন, এত আদর করছেন, সেই ছেলেটি আসলে জগতের ত্রাতা। ওই ‘দেবতারে প্রিয় করি, প্রিয়েরে দেবতা’ আর কী !
জানো তো, আমার ক্ষতস্নান বইটি আমি উৎসর্গ করেছিলাম এই দুজনকে। আমার নিজের কবীর কুমার গন্ধর্বকে আর আমার মীরা সুব্বুলক্সমীকে। শোনো, বহুদিন ধরে গান শুনে আসছি তো। এই বলাগুলো গান শোনার অভিজ্ঞতা থেকে বলা। আমার কেমন যেন মনে হয় সুরের কাঠামোর সঙ্গে স্থাপত্যরীতির এক গোপন মিল আছে। ওয়েস্টার্ন ক্লাসিকাল মিউজিকের কিছুটা ধর্মীয়, কিছুটা সেকুলার। মনে হয়, এর সঙ্গে বিশাল গথিক আর্কিটেকচার-এর গোপন মিল রয়ে গেছে।
হিন্দুস্থানি ক্লাসিকাল বৈদিক সঙ্গীত ও ইসলামী সঙ্গীতের সমন্বয়ে সৃষ্ট। আমীর খুশরু খেয়াল-এর জন্মদাতা (বলা হয়)। এই সঙ্গীত সেকুলার হয়েও আধ্যাত্মিক। এর দীর্ঘ মীড়গুলির সঙ্গে আমি মসজিদের স্থাপত্যরীতির কোথাও খানিকটা মিল পাই। আর কর্ণাটিক মিউজিক একেবারেই হিন্দু সঙ্গীত। প্রচণ্ড ‘কাজ‘ বা মুড়কিবহুল এই গানের সঙ্গে দাক্ষিণাত্যের মন্দির গাত্রের সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম মূর্তির মিল খুঁজে পাওয়া সম্ভবত কঠিন নয়। আবার দেখো, পশ্চিমী ক্লাসিকাল সঙ্গীত পুরোটাই আর্ট, আর্টিফিশিয়াল। আমাদের ক্লাসিকাল অনেকটাই ন্যাচারাল। প্রকৃতির সঙ্গে সংযুক্ত। আমাদের রাগ রাগিণীগুলো ঋতুভিত্তিক। তাদের গাওয়ার আবার নির্দিষ্ট সময়টময়ও আছে। আমাদের গায়করা— তা তিনি হিন্দুই হোন আর মুসলমানই হোন, আধ্যাত্মিকতার স্পর্শ এড়িয়ে যেতে পারেন না। তাই হিন্দুস্থানি ক্লাসিকাল শুনলে আমার যে কোনও পুজোর অনুষঙ্গ মনে আসে। হিন্দুদের পুজোর পাঁচটি ভাগ আছে, জানো তো? প্রথমে আত্মশুদ্ধি বা আচমন (মুসলমানদেরও নামাজের আগে ওজু করতে হয়। সম্ভবত যে কোনও মসজিদসংলগ্ন জলাধার থাকা বাধ্যতামূলক)। দ্বিতীয় ধ্যান, যার পুজো করছি তার একটা রূপ মনে মনে কল্পনা করা। তারপর নিবেদন বা অঞ্জলি। যার চূড়ান্ত রূপ হল আত্মনিবেদন। তারপর আরতি (যা আসলে নিজের মধ্যে ইষ্টদেবতাকে খুঁজে পাওয়ার উল্লাস) আর বিসর্জন। খেয়ালেও এই পাঁচটি পর্ব আমি খুঁজে পাই। প্রথমে স্বর লাগানো মানে কি আচমন ? আলাপ সেই রাগের মূর্তি নির্মাণ, বন্দীশ হল নিবেদন, তান হল আরতি আর কণ্ঠসঙ্গীতের তারানা আর যন্ত্রসঙ্গীতের ঝালা হল সেই রাগকে আস্তে আস্তে ভেঙে ভেঙে একরকম এর বিসর্জন দেওয়া। যে কোনও রাগসঙ্গীত শোনার পর মনে যে রেশ থেকে যায় সেটা এক বিরহের রেশ। যেন এতক্ষণের এক উৎসবের আনন্দকে হারিয়ে ফেলার রেশ। আমায় ভুল বোঝো না। আমি কোনোভাবেই নব্যহিন্দুত্ববাদী নই। ধ্রুপদের চেয়ে খেয়াল-ঠুমরীতে আমি অনেক বেশি আসক্ত। এই পুজোর অনুষঙ্গটা স্রেফ একটা উপমা। গানের ওপর কোনও হিন্দুত্বারোপ নয়। ইসলামেও আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণের ব্যাপার আছে। আসলে, গানের মানুষ নই তো, তাই উল্টা পাল্টা কথা বলতে সাহসের অভাব হয় না।
পঠনে অসাধারণ মুগ্ধতা রেখে গেলাম । উত্তরপূর্বের সাহিত্য জগতের একটা সুস্পষ্ট মানচিত্র যেন এই কথোপকথনে ফুটে উঠল । আরো আরো জানার আগ্রহ রইল ।
ধন্যবাদ সহযোগে …
– পারমিতা –
ভক্ত সিং ঠকুরির কথাও বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে I হিন্দুস্থানি সঙ্গীত কর্ণাটক সঙ্গীত নিয়ে খুব গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন অমিতাভ দা I