বেলুনের বনে
বেলুনটা ফুটো না হলে হয়ত আমার জন্মই হতো না
~
বাড়ি জুড়ে দক্ষযজ্ঞ কাণ্ড বেঁধে গিয়েছিল।
পুকুরে জাল নামলো, পাশের বাজারে লোক পাঠানো হয়,
খোঁজ চলেছে সব আত্মীয়-বন্ধুর বাড়ি, রিকশা-মাইক
তৈরি–একটি হারানো বিজ্ঞপ্তি…
পুরোটাদিন আমি ঘরের বড়খাটের নীচে বসে
একা বাবা-মার হারানো বেলুন দিয়ে খেলছিলাম!
~
হাওয়ায় পাওয়া আপেল আমি
আদম গিলে ফেলেছিলাম
খেতে চাইনি তবু কেন
ভালোবেসে এমন করে
কাছে ডেকে নিলাম
হাওয়ায় পাওয়া আপেল আমি
আদম অনিচ্ছাতেও খেয়ে ফেলেছিলাম
হাওয়া তখন আপেল নিয়ে খেলছে
হাওয়ায় তখন সকল আপেল ভাসছে
হাওয়াই আপেল গাছে শোভা পাচ্ছে
হাওয়া ভীষণ আপেল নিয়ে নাচছে
হাওয়ায় সকল আপেল সাঁতার কাটছে
তাদের একটি ভাসতে দেখে নদীতে
ছুটছি একা সেই আপেলের গতিতে
লোলুপ আপেল খেয়ে অনেক পস্তাই
এখন আমি কী করবো আর, ধুৎ ছাই
হাওয়ায় পাওয়া আপেল আমি
কোন কুক্ষণে খেয়ে ফেলেছিলাম
অনন্তকাল সেই বোকামির
দিতে হচ্ছে কঠিন এ দাম
একবারও কি সেটা ভেবেছিলাম
হাওয়ায় পাওয়া আপেল আমি
আদম মুখে ধরে রাখতে গিয়েও
হাওয়ার ঘোরে কোন কুক্ষণে
এমন করে গিলে ফেলেছিলাম
কেমন করে নিষিদ্ধ ফল
আমি আদম খেয়ে ফেলেছিলাম
হাওয়ায় পাওয়া আপেল আমি
আদিম আদম গিলে ফেলেছিলাম
হাওয়ায় পাওয়া আপেল আমি
আদিম আদম খেয়ে ফেলেছিলাম
~
আমি বোধহয় এমনই এক সাদাকালো বেলুনের ভেতর জন্ম নিয়েছিলাম, উড়ে যেতে পারতাম, কীসের মায়ায় যে রয়ে গেলাম এখন আর মনে নেই। ভেসে যেতে পারতাম কিন্তু কোথায় পাবো সে মেঘহীন আকাশ! একবার পেছনে দৌঁড়ে পালাবো ভেবেছিলাম কিন্তু এ কোন মুক্তবেগ আমাকে মুক্তি দিয়েছিল অজানা এই জেলখানায় গভীরে। যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামির মত জীবনপাত করেছি গরাদের গারদে! অথচ, মুহুর্মুহু শিৎকারে ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে গতিময় আবেগে ছুটে যেতে চেয়েছিল সে, হয়ত ভেবেছে আর কতবার পালাবে, কত আর প্রতিযোগিতায় অংশ নেবে।
তার চেয়ে ভালো ছিন্নবিচ্ছিন্ন আহত-নিহত বাকি সব বেলুনের অবশিষ্টাংশ কুড়ানো শেষ করে এভাবে দিকচক্রবালের দিকে তাকিয়ে একা বসে থাকা
~
মায়ের নাক ও মুখের সঙ্গে বেলুনের মত
কী জানি একটা লাগিয়ে দিয়েছে, একবার জোরে
ফুলছে আবার ছেড়া ফুল হয়ে চুপসে যাচ্ছে
চোখদুটি খুলে বড় বড় করে তাকিয়ে রয়েছে
দু’ধারে অশ্রু, আমাদের দেখে চেয়েছিল কিছু
একটা বলতে–অস্ফুট স্বরে, বোঝাতে পারেনি
উল্টাপাল্টা খুব উঠা-নামা করছে বুকটা
একই সঙ্গে উঠছে-নামছে লাগানো বেলুন
আর অপলক সেদিকে তাকিয়ে রয়েছি সবাই
~
এভাবে নল লাগিয়ে দাও
পায়ুপথের ঠিক গভীরে
বাতাস দিতে থাক সজোরে
অন্যথায় কেমন করে
মুখে কালিমা মাখা ছেলেটা
উড়তে যাবে বেলুন হয়ে
~
আমি বেড়ে উঠছিলাম এমন কোন এক বেলুনের
ভেতরে, একাকী। ডালপালা গজানোর মতো গজিয়েছে
হাত-পায়ের আঙুল ও নখ, ফুটেছে চোখ, উঁচু হলো
নাক, ক্রমশ দৃশ্যমান একটি লিঙ্গ, ধীরে ধীরে
প্রকাশিত হয়েছে অকালে এমন রুগ্ন, লিকলিকে
দেহ, অসম্পূর্ণ থেকে যথাযথ হতে যেয়ে যেন
অকালে গিয়েছে ফেটে, সেওতো এক মহাবিস্ফোরণ!
~
প্রথমবার আমি শুধু প্রথম হয়েছিলাম
ঐ একবারই
এর পর থেকে আমি আর কখনও প্রথম হতে
পারিনি, দ্বিতীয় হয়েছি তৃতীয়, দশম হয়েছি পরাজিত
অথবা সান্ত্বনা পুরস্কার নিয়ে শান্তিতে বাসায় ফিরে গেছি
দৌড় প্রতিযোগিতায় আমি কখনও প্রথম হইনি
বেলুন ফাটানো, বিস্কুট খেলায়, জয় পাইনি সাপলুডুতে
কোন ক্লাসে আমি কোনদিন ফার্স্ট হইনি
প্রথম প্রেমিক হইনি একজন নারীর
প্রথমবার আমি শুধু প্রথম হয়েছিলাম
শুধু ঐ একবারই
~
ফোলানো বেলুন যেন হাওয়াই মিঠাই চুপসে যেতে
সময় নেয় না, শুরু হয় তখন বেঢপ ক্রন্দন!
জগতের সমস্ত বাচ্চাকাচ্চাদের শোরগোল
কানের নিকট লুটোপুটি খেলে, বেসুরো আদিম সুর
তোলে, কান্নাস্বরের কোন স্টাপ নোটেশান নেই বলে
সে চিরন্তন চিৎকারগুলো ধ্রুপদী! বড়রা সব
বানানো গল্পে সান্ত্বনা দিয়ে যায়, যেমন দিয়েছে
তাদেরকে কেউ, কয়েক পৃথিবী ধরে এটাই চলছে!
~
শততম মৃত্যুবার্ষিকীর কেক থেকে অশ্রুর আদলে
গলে পড়েছিল বরফরঙা ক্রিম আর প্রায় একইরূপ লালা
ঝরছিল পাথর হয়ে যাওয়া আগত অতিথি যত
শিশুদের; নিরানব্বইটি জলন্ত মোমবাতির বিপরীতে
কতটা বেলুন দিয়ে সাজানো হয়েছে মড়িঘর তাই
নিয়ে বাকবিতণ্ডা চলল পুরোটা বিকেল। সান্ধ্য শোরগোলের
পর ফুঁ ফুঁ করে মোমবাতি নিভিয়ে, বেলুন ফাটিয়ে, কেক
কাটার মুহূর্তে মৃতের জনৈক স্বজনের কান্না মাটি
করে দিয়েছিল সবকিছু
~
চুইংগাম ফোলাতে পারার
বীরত্ব
মুখটাকে আড়াল করে দেয়
~
এইসব বুদ্বুদ বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরেও থেকে যাবে
অনেককিছু। বাচ্চারা যেমন হঠাৎ কেমন ধুম করে
ফেটে যাওয়া বেলুনের অবশিষ্টাংশ কুড়িয়ে পুনরায়
নেমে পড়ে বেলুন ফোলানো খেলায়, তেমনই নবরূপে
টিকে থাকার উপকরণ কিছু রয়ে যাবে যত্রতত্র
এখানে-সেখানে, আকাশে-পাতালে, যত গোপন সিন্দুকে
মিশে রবে পঞ্চভূতে, কেউ সব খুঁজে পাবে আর কেউ
শুধু বাতাস ছাড়ার সঙ্গে চিরতরে অজান্তে হারাবে
~
এতসব এটার ভেতরে ঢুকে যায় কী ভাবে
সবকিছু এর ভেতরে জায়গা হয় কী করে
ভাঙা ব্রিজ, কালো টানেল, ফ্লাইওভার
জোড়া টাওয়ার বিশাল ভবনগুলো,
পিঁপড়ের মত অগণিত লোকজন
নিয়ে গাড়িঘোড়া হরদম ঢুকে পড়ে
নিমিষেই খেয়ে নেয় ক্রমশ শহুরে
হয়ে ওঠা সব গ্রাম,দেশ; মরানদী
পোড়াবন, ঘরহীন কীটপশুপাখি
ঘোলা আকাশ, আহত পাহাড়,সাগর
যত খোঁয়াড়, আস্তাবল, জেলখানা
বেলুনের গহ্বরে এতটা জায়গা!
কাওকে কিছু না বলে আমিও কেমন চুপটি
করে তাতে ঢুকে থাকতে চেয়েছিলাম গোপনে
~
কাঁটাতারে ঝুলছে রঙিন
ফ্রক পরা একটি বেলুন
যেন কোন বিদ্যুৎ তারে
বন্দি প্লাস্টিকের ঘুড়ি
নাটাইছেড়া হয়েও ওড়া
থেমে নেই, নাছোড়বান্দা
রক্তিম ক্ষতবিক্ষত
তাকে আরও উজ্জ্বল লাগে
~
অনুষ্ঠানে যারা শান্তির পায়রা ও বেলুন উড়িয়েছিল
তাদের শান্তির ঘুম নষ্ট হয়ে গেছে
যারা নষ্ট করেছে সে-সব
তাদের হাতেই আজ শান্তির বেলুন-পায়রা
তাও নষ্ট করতে ওত পেতে রয়েছে কেউ
ওদের চাওয়াও শান্তিতে পায়রা ও বেলুন ওড়ানো
~
থুতুর বেলুনে
রাঙিয়ে দিয়েছি
আহত আকাশ
ফেনিল বেলুনে
ভাসিয়ে দিয়েছি
ভাটির দু-পাশ
মেঘের বেলুন
ভিজিয়ে দিয়েছে
কবরের শব
রক্তবেলুন
ফাটলে তবে কি
হোলি উৎসব
~
প্রতিদিন একটি করে চিঠি
বেলুনে বেঁধে উড়িয়ে দিত আকাশে
মাঝে সাজে পেতো উত্তরও
মা-ছেলের এ চিঠি চালাচালি গল্প
অনেক পুরাতন
~
বেলুনে পানি ঢুকিয়ে বানাই
কালো-সবুজ আঙুর
রক্তিম তুঁতফল
সাজিয়ে রাখি শোকেসে
ধুলোমলিন বইপত্র
কাপপিরিচের ফাঁকে
বেলুনে পানি ঢুকিয়ে বানাই
ছোট-বড় মানুষ
ছড়িয়ে দিই যেখানে-সেখানে
ফুয়াদ হাসান। জন্ম, ২ নভেম্বর ১৯৭৯ সাল। ধূরুং, বিবিরহাট, ফটিকছড়ি, চট্টগ্রাম, বাংলাদেশ। সহকারী অধ্যাপক, পতেঙ্গা সিটি কর্পোরেশন মহিলা ডিগ্রি কলেজ, চট্টগ্রাম। প্রকাশিত গ্রন্থ - মানুষ মানুষ নয় হোমোসেপিয়ানস (২০০৪, বলাকা); রাফখাতার কাটাকুটি (২০১০, তেপান্তর); অ্যা জার্নি বাই অ্যাম্বুলেন্স (২০১৮, বাঙ্ময়); কাঁটাতারে কারাগারে (২০২১, বেহুলাবাংলা)।