১৯.
কালীপদ চৌধুরীর বড়ো মেয়ে বাসন্তী থাকতেন বিশালগড়ে। শিক্ষিকা। দুই ছেলে। ছোটো সুপ্রিয় আমারই বয়সি। একই ইয়ারের। সুপ্রিয় এলেই আমাদের প্ল্যানচেটের তোড়জোড় শুরু হয়ে যেত। সুপ্রিয়র মুখেই প্রথম শুনি সি পি আই এমের গৌতম দত্ত ও পরে কংগ্রেসের বিধায়ক পরিমল সাহা খুনের গল্প। শুনি, অফিসটিলা সি পি আই এমের বাজার আর বিশালগড় বাজার কংগ্রেসের। শিউরে উঠি। প্ল্যানচেট শুরু করার আগে পুরোনো ছবির ফ্রেম থেকে হুক খুলে কাচের স্কোয়ারটি আমরা আলগোছে বের করে নিতাম। সন্ধের পর একটি সাদা কাগজে অ্যা থেকে জেড, ছাব্বিশটি ইংরেজি আলফাবেট লিখে নীচের দুদিকে লিখতাম ইয়েস ও নো। আরেকটু নীচে মাঝখানে স্টার্ট। ঘরের সব আলো নিভিয়ে একটি ক্যান্ডেলস্টিক জ্বালানো হত। লেখা কাগজটি মেঝেতে পেতে এর উপর কাচের স্কোয়ারটি চেপে দিতাম। একটি বোতলের কর্ক থাকত স্টার্টিং পয়েন্টে। আত্মা এলে নাকি কর্কেই প্রথম ভর করে। সুপ্রিয়র চেহারায় এমন এক সাত্ত্বিক ভাব ছিল, মোমের আলোয় ধ্যানস্থ ওকে দেখলে মনে হত, আত্মা আমাদের কাছে না এসে যাবে কোথায়? ডানহাতের তর্জনী দিয়ে সুপ্রিয় কর্কটি হালকাভাবে ধরে রাখত আর বলে দিত, এখন আমরা রবীন্দ্রনাথ বা বিবেকানন্দকে ডাকছি। কিচ্ছুক্ষণ পরই কর্ক নড়ে উঠত। সে কী রুদ্ধশ্বাস অবস্থা আমাদের! আমাদের প্রশ্ন অনুযায়ী আত্মা মিডিয়ামের আঙুলে ভর করে কর্কটিকে নির্দিষ্ট আলফাবেট বা ইয়েস নোতে টেনে নিয়ে যেত। নাইনে পড়তেই আমরা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে মাধ্যমিকে আমাদের রেজাল্টের পার্সেন্টেসও একে একে জিজ্ঞেস করেছিলাম। সম্ভাব্য উত্তরও দিয়েছিলেন।
নগেনের দিদি পদ্মাবতী আমাকে বলেছিল, ঙা শব্দটি যে নিখুঁত উচ্চারণ করতে পারবে সে খুব তাড়াতাড়ি মণিপুরি ভাষা রপ্ত করতে পারবে। মণিপুরি এই ঙা শব্দের অর্থ মাছ। রমেন্দ্রকুমার আচার্য চৌধুরীর কবিতার ঙাপ্পি শব্দটি আছে। সুকুমার রায়ের ছড়াতেও। বার্মা তথা মায়ানমারের ঙাপ্পি একটি জনপ্রিয় খাদ্যাভ্যাস। ত্রিপুরাতে মগ জনগোষ্ঠীর লোকেরা বোয়ালমাছকে টুকরো টুকরো করে মাটির হাঁড়িতে রেখে মুখ বন্ধ করে মাটির নীচে গর্ত করে রেখে দেয়। দু-তিন মাস পর সেটিকে ছত্রাকায়িত অবস্থায় গর্ত থেকে তুলে এনে রান্না করা হয়। তীব্র কটু গন্ধ! যে-কোনো ভাষাই রপ্ত করতে গেলে চাই মাতৃভাষার উপর যথেষ্ট জ্ঞান আর সেই ভাষার প্রাথমিক ব্যাকরণবোধ। পুরুষ। বচন। ক্রিয়ার কাল। কারক, বিভক্তি ইত্যাদি। মণিপুরি ভাষার প্রতিটি শব্দের উচ্চারণ শুনে মনে হত যেন শব্দ ও বাক্যগুলো এক অদ্ভুত নাদ। নাভির ভেতর থেকে উঠে আসছে। অন্যদিকে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি ভাষা তুলনামূলকভাবে অনেক সহজ মনে হত। যথারীতি সিলেটি ছাপিয়েও এক অন্যধরনের টান। হালাহালিতে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি এলাকাসংলগ্ন বাঙালি ও মণিপুরিরা অনেকেই বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি ভাষা সহজেই বোঝেন ও বলতেও পারেন। গী শব্দটি যে মণিপুরি ভাষার ষষ্ঠী বিভক্তি, এটা বেশ ভালোই বুঝতে পেরে গেছিলাম। পরিচিত মণিপুরি বাড়িতে গেলে ভেতর থেকে কেউ হয়তো জিজ্ঞেস করত, কানান? হেডমাস্টারগী মাচা। নিরুদার ইলেক্ট্রিক্যাল ডেকোরেশনের দোকানটিতে তখন একটি রেকর্ড মাঝেমাঝে বাজত। পুরস্কারপ্রাপ্ত একটি মণিপুরি সিনেমার গান। ইমাগী নিঙধেম।
হালাহালিতে তখন রাম্বা হো সাম্বা হো পুরোদমে। খুব সম্ভবত আরমান সিনেমার গান। বিশেষ করে রাম্বা হো গানটির এই হো শব্দটির হো হো হো হো প্রতিধ্বনি ছিল উঠতি ছেলেদের ক্রেজ। হালাহালির স্টাইলিশ ছেলেরা তখন বেশ ভালো নাচিয়ে। সবুজ সংঘের পুজোয় ও স্কুলের সরস্বতী পূজায় শুধু নামমাত্রই আরতি প্রতিযোগিতা। একেকজন প্রতিভাবান ডিস্কো ডান্সারের উপস্থাপনা দেখতাম আমরা। তিনবেলা শো শুরু হওয়ার আগে সিলসিলার গান। আশা সিনেমার গান। সিসা হো ইয়া দিল হো। রাম্বা হো সাম্বা হো। ভেসে আসা এই গানগুলির সুরে সন্ধ্যার পড়াশোনায় মন কিছুতেই বসতে চায় না। নিরুদার দোকানে মাঝখানে আরেকটি বাংলা গান বেশ ফুল ভলিউমে শোনা যেত। বউদি গো ও বউদি গো। জুন্টুদাদের ঘরেও একটি নতুন রেকর্ড প্লেয়ার সদ্য সদ্য এসছে। একটি বাংলা গানের মনকাড়া একটি রেকর্ড। ও আমার শ্যামলা গাঁয়ের কাজলা মেয়ে। দেশপ্রেমী সিনেমার আরেকটি গানের রেকর্ড ছিল। তানে দিন তন্ডানা তন্ডানা তন্ডানা/ খাতুন খিদমতমে সালামে আপুন কা।
সে বছরই হালাহালিতে এলেন হরেকৃষ্ণ আচার্য। দক্ষিণ ত্রিপুরার উদয়পুর রমেশ স্কুলের বাংলার শিক্ষক। মনসামঙ্গলের কবি পণ্ডিত জানকীনাথের কবিকৃতি ও তাঁর পুথির উপর পি এইচ ডি করছেন। সাদা ধুতি, সাদা পাঞ্জাবি। একমুখ দাড়ি। কাঁধের ঝোলাব্যাগে খমক। বাউলগান করেন। খুবই মিশুকে। মানিকভাণ্ডার হরচন্দ্র স্কুলের শিক্ষক কাশীনাথ পালের বড়োছেলে কাজল পালের সহকর্মী। কাজলদা ছিলেন রমেশ স্কুলের শারীর শিক্ষক। খুব ভালো গোলকিপারও। শিক্ষক অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছ থেকেই পাণ্ডুলিপি সংগ্রহের অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন হরেকৃষ্ণবাবু। বাংলা এম এ পড়ার সময় থাকতেন হালিশহর শ্মশানে একটি সমাধি মন্দিরের পেছনে। হালাহালিতে এসে অনেকের সঙ্গেই পরিচয়। বাবার সঙ্গেও। এর আগে রমেশ স্কুলের ক্যান্টিন পরিচালক ব্রজলাল গোস্বামীর সূত্র ধরে বাংলাদেশের কুমিল্লা থেকেও ঘুরে এসেছেন পুথি সংগ্রহ করতে গিয়ে। সেবারে কাজলদার বাবার কাছেই পেয়ে গেলেন তেঁতুল কাঠের মলাটে হরিণের চামড়ায় মোড়া পণ্ডিত জানকীনাথের মনসামঙ্গল পুথি। এটি কাশীনাথবাবুদের পারিবারিক পবিত্র পুথি হিসেবেই শুধু গণ্য নয়, এই পুথিকে সাক্ষী রেখেই পারিবারিক হাতেখড়ি হয়। পুথির সঙ্গে একটি শ্লেটও আছে। অনেক বলে কয়ে পুথিটিকে তিনি উদয়পুরে নিয়ে এসে লিপি উদ্ধার করতে পারেননি। ধীরেন দত্ত তখন ঐতিহ্যবাহী রমেশ স্কুলের প্রধান শিক্ষক। সব শুনে ধীরেন দত্ত বললেন, পুথির লিপি যখন উদ্ধারই করতে পারলে না, যার পুথি তাকে ফেরত দিয়ে দেওয়াই ভালো। জেদ চেপে গেল হরেকৃষ্ণবাবুর। পনেরো দিন সময় চাইলেন। যেন এক চ্যালেঞ্জ। পনেরো দিনের মধ্যেই পণ্ডিত জানকীনাথের মনসামঙ্গল পুথির অনেকটাই উদ্ধার করে ফেললেন। কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে বোঝালেন যে কীভাবে কানা হরিদত্ত, বিপ্রদাস পিপলাই, বিজয়গুপ্ত প্রমুখের মনসামঙ্গল কাব্যের চেয়েও পণ্ডিত জানকীনাথের এই পুথি কাহিনি বিন্যাস, চরিত্রায়ণ, ভাষাশৈলী, ঔপন্যাসিক নিষ্ঠা ও কাব্যের প্রসাদগুণে শ্রেষ্ঠ। সর্বোপরি অনান্য কবিদের মনসামঙ্গল অলৌকিক। পণ্ডিত জানকীনাথের মনসামঙ্গলই একমাত্র লৌকিক মঙ্গলকাব্য। পণ্ডিত জানকীনাথ ছিলেন হবিগঞ্জের কৈল নাজিরপুরের সন্তান।
এরপর থেকেই শুরু হল পণ্ডিত জানকীনাথের আরও পুথি সংগ্রহের কাজ। হালাহালিতেও বন্ধুত্ব হল আরও কয়েকজনের সঙ্গে। কাজল আচার্য, সত্যবান বিশ্বাস, অনিল সূত্রধর। কাজল আচার্য হরেকৃষ্ণবাবুকে নিয়ে গেলেন সালেমাতে একজনের বাড়িতে যিনি নিজেকে পণ্ডিত জানকীনাথের দৌহিত্র বলে দাবি করতেন। ভদ্রলোকের দাবি যদিও ধোপে টেঁকেনি। হালাহালিতে অনিল সূত্রধরের সঙ্গে গিয়ে কৃষ্ণনগর গ্রাম থেকে পেয়ে গেলেন রামায়ণ ও পণ্ডিত জানকীনাথের পুথি। কৃষ্ণনগরেরই মাখন আচার্য ও মাখন দেবনাথের বাড়ি থেকে উদ্ধার হল আরও দুটি পুথি। এর মধ্যে একটি নারায়ণ দেবের মনসামঙ্গল। পুথির খোঁজে গেছিলেন বামনছড়া ওড়িয়া পণ্ডিতের আশ্রমে। বামনছড়ার এই আশ্রম ছিল মিশ্রবাবার। এই মিশ্রবাবা অনেক আগে ব্রিটিশ আমলে এসেছিলেন কটক থেকে। তখন এরকম অনেক বাগানেই জগন্নাথ মন্দির তৈরি করে দুয়েকজন ওড়িয়া ব্রাহ্মণ থাকতেন। ওড়িয়া শ্রমিকদের জন্ম, মৃত্যু, বিয়েতে রীতি, লোকাচার, পূজাবিধি সম্পন্ন করতেন। বামনছড়ার মিশ্রবাবা ছিলেন ব্রহ্মচারী। পরে ওড়িয়া ব্রাহ্মণরা মহাবীর চা-বাগানের শ্রমিকদের এইসব লোকাচার সম্পন্ন করার ভার বামনছড়ার ভট্টাচার্য তথা ভটেদের ও বাগানের ঘোষাল পরিবারের উপর দিয়ে উড়িষ্যায় ফিরে যান। এইরকম একজন ব্রাহ্মণ পুরোহিত ছিলেন বামনছড়ার ভগবান ভট। ব্রহ্মচারী ছিলেন। এরপর এই দায়িত্ব দেওয়া হয় অখিল ভটকে। অখিল ভটও ব্রহ্মচারী ছিলেন। মিশ্রবাবার আশ্রমের ভারও ছিল অখিল ভটের উপর। মিশ্রবাবার আশ্রমের জগন্নাথ মন্দিরকে কেন্দ্র করে তখন প্রতিবছর রথযাত্রা হত। যাই হোক, হরেকৃষ্ণবাবু এরপর কৈলাসহর যাওয়ার পথে করমছড়াতে হরিনাথ শর্মার বাড়িতে গিয়ে উদ্ধার করলেন আরেকটি পুথি। ছুটে গেছিলেন ধর্মনগরে কুলদাপ্রসাদ রায়ের বাড়িতে। সব মিলিয়ে পণ্ডিত জানকীনাথের সাড়ে নটি পুথি হরেকৃষ্ণবাবু উদ্ধার করতে পেরেছিলেন। পানিসাগরের অদূরে তিলথৈ ও বেতাংগি গ্রামেও গেছিলেন হরেকৃষ্ণবাবু। ওদিকটায়ও পণ্ডিত জানকীনাথের মনসামঙ্গলই প্রচলিত। জানকীনাথের বংশপরিচয় নিয়ে খুব একটা কিছু উদ্ধার করা যায়নি। তিলথৈ গ্রামে নাথসম্প্রদায়ের লোকেরা মূলত হবিগঞ্জ অঞ্চল থেকেই এসেছিলেন। পানিসাগর এলাকায় আবার বিশ্বম্ভর নাথের পদ্মপুরাণ জনপ্রিয়। যতদূর জানা যায়, এই বিশ্বম্ভর নাথ ছিলেন গায়েন ও দেবী বিষহরি তথা মনসার মাহাত্ম্যের ওঝানাচের পারদর্শী শিল্পী। বরাক উপত্যকার হাইলাকান্দি জেলার লালাতে বিশ্বম্ভর নাথের জন্ম। পরে তিনি পানিসাগরে চলে আসেন। তবে বিশ্বম্ভর নাথের এই পদ্মপুরাণ একটি আহরিত সংকলন।
মহাবীর চা-বাগানে প্রত্যেক বছর শ্রাবণ মাসে বর্ধমানি শ্রমিকেরা মনসাপূজা করতেন। তিথি নক্ষত্র দেখে একমাস আগে দেবী মনসার ঘট স্থাপন হত। নদী থেকে ঘটে জল আনতে গিয়ে বর্ধমানিরা গাইত–
মাকে আনতে যাব গ ধলাই নদীর পারে
পায়ে দিব লাল গামছা হাতে দিব ফুল গ
মাকে আনতে যাব…
ঘট স্থাপনের দিনই মূর্তির কাঠাম গড়ার কাজও শুরু হয়ে যেত। পুরো শ্রাবণ মাস জুড়ে প্রতিদিন পুথি থেকে গান। যন্ত্রানুষঙ্গ বলতে ছোটো ঢোল। করতাল। ঘণ্টা। বর্ধমানিদের এই পদ্মপুরাণও সেই বিষহরি ও চাঁদসদাগরেরই কাহিনি। পুথির হরফ বাংলা। পুজোর দিন নিমন্ত্রিত শ্রমিকরা আসতেন দূর দূর থেকে। যেহেতু এই পূজা বাগানেই হত, তা শুধু বর্ধমানিদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকত না। হয়ে উঠত সর্বজনীন মনসাপুজো। প্যান্ডেল করে ভক্তেরা চারপাশে গোল হয়ে বসতেন। পুথি থেকে সারাদিন গান ও খাওয়াদাওয়ার আয়োজন। আমিষ রান্নাই হত। পূজার রাতে জানি অর্থাৎ পূজারির উপর মনসার ভর হয়। পূজারি তখন সমবেত ভক্তদের বিভিন্ন সমস্যা, রোগব্যাধি নিয়ে প্রশ্নের উত্তর দেন। রাতে শুরু হয় কটরা খেলা। কটরা হচ্ছে কুশকে বেণীর মতো পাকিয়ে চাবুকের মতো করা হয়। সেই চাবুক হাতে নিয়ে একজন দু-পা ফাঁক করে দাঁড়িয়ে আরেকজনের শরীরে আঘাত করবে। এই কটরা নেওয়ার চাবকানির শব্দ এত জোরে হয়, উপস্থিত দর্শকদের রীতিমতো ভয় পাইয়ে দেয়। কিন্তু যাকে মারা হয় তার শরীরে কোনো দাগ বা আঘাত চোখেই পড়ে না। একে একধরনের দেবীর আশীর্বাদ বলেই ধরে নেওয়া হয়। পরের দিন দুপুরে প্রতিমা ভাসানে যাওয়ার পথে বিভিন্ন জায়গায় নারী পুরুষেরা কটরা নেয়। নদীর পারে ভাসানের আগে চলতে থেকে ঢোল, করতাল, ঘণ্টা বাজিয়ে দেবীর গান। দুই তান্ত্রিকের তন্ত্র-মন্ত্র ও বাণ মারার প্রতিযোগিতা ও একে অন্যের বাণ প্রতিরোধের খেলা। অগ্নিবাণ, বিরনিবাণ ইত্যাদি বেশ কিছু বাণ পরস্পরকে ছুড়ে মারার ও আটকানোর খেলা। বিরনি মানে বল্লা, যাকে বোলতা বলা হয়। একেকটি বাণ ছোড়া হয় আর তান্ত্রিকেরা মাটিতে পড়ে সাপের মতো কুণ্ডলি পাকিয়ে পাকিয়ে কাৎরাতে থাকে। কখনো তান্ত্রিকের মুখ দিয়ে উঠে আসে দলা দলা কাদা। বর্ধমানিদের এই পদ্মপুরাণ পুথির প্রণেতা জনৈক ওঝা। তাদের দাবি এত বিস্তারিত পদ্মপুরাণ বাঙালিদেরও নেই।
আমার কৈশোরে হালাহালিতে সেইসময় বেশ কিছু চরিত্র, হয়তো উল্লেখযোগ্য কিছু নন, হয়তো একদিন বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যাবেন, তাদের কথা না বললেই নয়। এরকম একজন মানুষ ত্রৈলোক্য দত্ত বা মাখন দত্ত বা তাখুম দত্ত। হবিগঞ্জের লাখাই-র জমিদার বাড়ির ছেলে। চলে এসেছিলেন ত্রিপুরার খোয়াইতে। নৃপেন চক্রবর্তীর সমবয়সি। খোয়াই থেকে মাখন দত্তকে সি পি আই এম পার্টির দায়িত্ব দিয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হয় কমলপুরে। এই তিনটে নামের মধ্যে মাখন দত্ত নামেই লোকজন তাকে বেশি চিনত। ককবরক ভাষায় তাখুম মানে পুরুষ হাঁস। মাখন দত্তের গলার আওয়াজ হাঁসের মতো ছিল বলে ককবরকভাষী লোকেদের কাছে তিনি কমলপুর মহকুমায় তাখুম দত্ত নামেই পরিচিত ছিলেন। বিয়ে থা করেননি। হবিগঞ্জে থাকাকালীন একবার প্রজাদের কাছে নোটিশ দেওয়া হয়েছিল, জমিদারের অনুপস্থিতিতে খাজনা যেন জমিদারের ছেলে মাখন দত্তের হেফাজতে জমা দেওয়া হয়। সে বছর আদায় করা খাজনার বহর দেখে তো জমিদারের চোখ ছানাবড়া। এত কম খাজনা! খোঁজ নিয়ে দেখা গেল, সব গরিব প্রজাদের খাজনা মাখন দত্ত মুকুব করে দিয়েছেন। আমরা যখন ছিলাম, মাখন দত্ত থাকতেন হালাহালি গোরুর বাজারে সি পি আই এম পার্টি অফিসে। সেই জায়গাটি ছিল চানকাপের যামিনী চৌধুরীর। বিরোধী রাজনীতির লোকেরাও মাখন দত্তকে ভালোমানুষ বলেই সমীহ করতেন। ১৯৭১ সালে বামনছড়াতে বারো দ্রোন খাসজমির সন্ধান পান মাখন দত্ত। দশ কানি জায়গার পরিমাপ এক দ্রোন। কানির পরিমাপ বিঘের চেয়ে বেশি। কুড়ি গন্ডাতে এক কানি। গন্ডার পরিমাপ আবার কাঠার চেয়ে একটু বেশি। ভূমিহীন কৃষকদের নিয়ে তাদের জন্যে সেই জমি দখল করে রাতারাতি ভূমিহীনদের ঘরবাড়ি তৈরির কাজে নেতৃত্ব দেন। তৎকালীন মহকুমাশাসক রঞ্জিত দিঘলের তৎপরতায় পুলিশবাহিনী বামনছড়াতে গিয়ে সেইসব রাতারাতি গজিয়ে ওঠা বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়। মাখন দত্তের নামে যথারীতি পুলিশ কেসও হয়। মাখন দত্তকে বিয়ে করানোর জন্যে নৃপেন চক্রবর্তী ও বীরেন দত্ত বেশ তোড়জোড় করেছিলেন। কিন্তু লাভ হয়নি।
হালাহালির বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি সম্প্রদায়ের সেম্বা সিংহের ছেলে বাবু সিংহ। সেম্বা সিংহের পরিবার সিলেট থেকে চলে এলেও বাবু সিলেটেই থেকে গিয়েছিল। পরে বাবুও চলে আসে হালাহালিতে। হারমোনিয়ম বাজিয়ে বাউলা গান গাইত বাবু। গান ও যাত্রাপালায় অভিনয়ের তীব্র নেশা ছিল বাবুর। হালাহালিতে এসেও যাত্রায় অভিনয় ও বিবেকের পার্ট করত। দেবীছড়ার সুগায়ক, গানের টিচার কৃষ্ণকুমার সিংহও যাত্রাপালায় বিবেকের অভিনয় করতেন। গোটা ত্রিপুরাতেই যাত্রা তখন এক অনিবার্য সামাজিক বিনোদন। একবার আমবাসাতে যাত্রাপালা বাংলার ডাকাত। বিশেষ কারণবশত দীর্ঘ মহড়ার পরও কৃষ্ণকুমারদার পক্ষে অভিনয় সম্ভব হচ্ছে না। পুরো টিমেরই মান ইজ্জতের প্রশ্ন। কে করবে বিবেকের অভিনয়? বাবুও সেই পালায় মন্ত্রীর চরিত্রে অভিনয় করছে। শেষ পর্যন্ত বাবু সিংহ রাজি। যাত্রাদলের মাথাব্যথা অনেকটাই কমে গেল। সেদিন আমবাসায় বাংলার ডাকাত পালার একটি দৃশ্যে ডাকাতদের দৌরাত্ম্যে মহারাজ দুশ্চিন্তায় ডুবে আছেন। মন্ত্রীর চরিত্রে বাবু মঞ্চে উঠেই তার বাংলা সংলাপ ভুলে গিয়ে মহারাজের উদ্দেশে বলল, কিয়ান ইসেহান থাং মহারাজ? কি চিন্তাহান খাল করিয়া বহিয়া আসতহান মহারাজ? আর মুহূর্তেই দর্শকদের মধ্যে তুমুল হাততালি ও শিস। অভিনয়ে সেই রাতে বাবু সিংহ অভিনয়ে এতটাই ডুবে গেছিল, যে, যাত্রাপালার বাংলা সংলাপ ভুলে গিয়ে নিজের মাতৃভাষা বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরিতেই সংলাপ বলে ওঠে। মুহূর্তটি এতই জীবন্ত হয়ে উঠেছিল, বাবুর এই ঘটনা এখনো মনে রেখেছে সেদিনের যাত্রাপালার দর্শক ও হালাহালির মানুষেরা। বাবু আর প্রভাত শীলের বেশ দোস্তি ছিল। আমাদের স্কুলের উল্টোদিকের দোকানে বসে মাঝেমাঝে দুজনে লুকিয়ে লুকিয়ে গাঁজা খেত।
চমৎকার
বউদি গো গান আমরাও গেয়েছি । মনে পড়ে গেল :
বউদি গো বউদি গো
দাদা তোমার কথায় ওঠে বসে
তোমার কথায় কাঁদে হাসে
বউদি গো ও ও ও বউদি গো ।
স্মৃতি সততই সুখের ।
কি ভালো লেখা। পড়তে পড়তে কৈশোরে যেন একাত্ম হয়ে যাচ্ছিলাম।
Planchette এ বিদ্যাসাগরকে মাধ্যমিক পরীক্ষার suggestion দিতে বাধ্য করা …. লা জবাব 🤣