২০.
শ্যামাপদকাকু, হালাহালি বাজারের হোমিও ডাক্তার, কীর্তন গাইলেও খুব বেশি কীর্তন সংগ্রহে ছিল না। বারবার দুটো কীর্তনই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে গাইতেন। বুক বেঁধে তুই আয় রে ছুটে করিস না রে ভাব না আর/ ভাবতে গেলে কূল পাবি না ভাবনা শুধু হবেই সার। আর আমার যে প্রিয় কীর্তনটি গাইতেন, বিশ্বনাথের রথ এল দুয়ারে/ তোরা জয় দে শাঁখ বাজা রে ধূপ দীপ জ্বালা রে/ বিশ্বনাথ দরশনে ডাক দিয়ে আয় জনে জনে…। এই কীর্তনটি একটু দীর্ঘ কিন্তু অসাধারণ বানীবিগ্রহ ও সুরের কারুকাজ! এই কীর্তনটির একটি পদ ছিল, ও তোরা আমায় নে রে আপন করে/ আমি এসেছি যে ও তোদের তরে…। এই অংশে এমন এক সুরের প্যাথোজ ছিল, চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ত। তখনই জেনে গেছিলাম, অশ্রু, স্বেদ, পুলক, কম্পন ইত্যাদি লক্ষণগুলো ভক্তির নয়; ভাবের। বাবা যে খুব ভালো কীর্তন গাইতেন তা নয়, তবে তাল, ঝুমুর, লয়জ্ঞান ইত্যাদি দোহার হিসেবে বাবার অসামান্য ছিল কীর্তনকেন্দ্রিক বংশের ছেলে হিসেবে। মাঝেমধ্যে গাইতেন। একটি চরণ আমার এখনও মনে পড়ে, নামামৃত রসধারে শুষ্ক তরু মুঞ্জরে…। সন্ধ্যার সৎসঙ্গকে আগে বলা হত অধিবেশন। মুকুন্দদাস, অতুলপ্রসাদ ও দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের কিছু গানকেও অধিবেশনে কীর্তন হিসেবে গাওয়া হত। যেমন মুকুন্দদাসের নাম নিয়ে ভাসানো তরী যেদিন ডুবে যাবে রে/ চন্দ্র সূর্য গ্রহ তারা, তারাও ডুবে যাবে রে…। অতুলপ্রসাদের প্রাণারাম, প্রাণারাম, প্রাণারাম/ কী যেন লুকোনো নামে মিষ্টি এত তব নাম…। অনেক বাঘা বাঘা গাইয়েদের কীর্তন আমি শৈশবে আগরতলায় শুনেছি। নলিনী দাসচৌধুরী গাইতেন, ডি এল রায়ের মৃত্যুশ্মশান মাঝেতে আজি এ কে যেন স্বরগ গীতি গায়/ মুছে গেছে তাই ভীষণ কালিমা দীপ্ত হইল বিশ্বময়…। নলিনী জেঠুর গায়কিতে এমন একটি তিজনবাঈয়ের পাণ্ডবানীর মতো দাপট ও শক্তি থাকত, কীর্তন শুরুর মুহূর্তের মধ্যেই সবাই নাচার জন্য উন্মত্ত হয়ে উঠত। উৎসবের সময় নগর পরিক্রমার কীর্তনে নলিনী জেঠুই গাইতেন। হাতে শুধু একটি কাঁসর। আরেক দাপুটে কীর্তন গায়ক ছিলেন বীরেন্দ্র দত্ত। আত্মীয়তার সম্পর্কে বাবার ভাই। বদন ভরিয়ে হরির নাম নিয়ে দু-বাহু তুলিয়ে নাচো রে কীর্তনটি বীরুকাকুর গায়কিতে উদ্দাম হয়ে উঠত। গাইতেন রাধে গোবিন্দ, রাধে গোবিন্দ, সদা আনন্দে বল রসনা/ ও তোর হরেকৃষ্ণ নাম গাও অবিরাম/ নামের গুণে পাবি পরমানন্দ… কীর্তনটি। বীরুকাকুর বাবা ব্রজেন্দ্র দত্ত ছিলেন বিখ্যাত যাত্রাশিল্পী। ঐতিহাসিক যাত্রাপালায় রানির ভূমিকায়ও অভিনয় করতেন। কীর্তন গাইয়েদের মধ্যে ছিলেন আগরতলার গোপাল চক্রবর্তী, নন্দন চক্রবর্তী, বিনোদ দেবনাথ, প্রভাত চক্রবর্তী, সুবল দে। তেলিয়ামুড়ার শশীভূষণ দাস ও হেমেন্দ্র রুদ্রপাল। গন্ডাছড়ার ক্ষিতীশ দাস। বিশ্বনাথের রথ এল রে দুয়ারে কীর্তনটির মতোই আরেকটি ভিন্ন বাণীবিগ্রহ ও সুরের কীর্তন গাইতেন গোপাল জেঠু। যুগ অবতার, আনন্দ পারাবার, সুন্দর রূপ মধুময়…। নন্দনকাকু ছিলেন তৎকালীন ডবল এম এ। ইংরেজি ও বাংলায়। অ্যালবার্টের হিস্ট্রি অফ ইংলিশ লিটারেচর বইটি কিনতে গিয়ে ভয়ে ফিরে এসেছিলেন। সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, ইংরেজি অনার্স পড়বেন না। সাহস করে পড়লেন। ভালো রেজাল্ট করে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স ও এম এ পাস করলেন। নন্দনকাকু গাইতেন, মোদেরে মানুষ করিতে আবার মানুষের বেশে এসেছ…। আরও একটি কীর্তন গাইতেন নন্দন চক্রবর্তী। যার মুখে ভাই হরিকথা নাই তার কাছে তুমি যেও না/ যাহারে হেরিলে পাশরিবে হরি তার পানে তুমি চেও না…।
এ রাজ্যের সৎসঙ্গ ভাবান্দোলনের অন্যতম উদগাতা ছিলেন শুভ্রাংশুশেখর মিশ্র। চৈতন্য মহাপ্রভুর বাবা জগন্নাথ মিশ্রের ভাই জ্ঞানবর মিশ্রের বংশধর। সপরিবারে শিলচর থেকে এসেছিলেন এ রাজ্যে। সৎ, দৃঢ় ব্যক্তিত্বসম্পন্ন, পরোপকারী, এই ধার্মিক মানুষটিকে সারা ত্রিপুরায় লোকজন মিশ্রদা নামেই চিনতেন। অসাধারণ গানের গলা। খুব ভালো কীর্তনও ভাইতেন। মা-র মুখে শুনেছি, হারমোনিয়ম টেনে যখন গাইতেন, মনবাগানে ফুটল কুসুম রূপের হাওয়ার উল্লাসে/ তাই তো ঘরের হলেম বাহির গান গেয়ে আর উচ্ছ্বাসে…সে এক স্বর্গীয় দৃশ্য। তাঁর গাওয়া বেশ কিছু কীর্তন মানুষ এখনো ভুলতে পারেনি। বিশেষ করে নামের অনল জ্বালো…। বিশ্বপিতার দরবারে নাই কোনো আর শঙ্কা রে…। তাঁর ঘনিষ্ঠ, বিশ্বস্ত, স্নেহধন্যদের মধ্যে একজন ছিলেন আমার বাবা। বাবাকে মিশ্রজেঠু বলতেন, বাঘের বাচ্চা। ১৯৭০ সালে অমরপুরের আগে জিপ দুর্ঘটনায় প্রয়াত হন শুভ্রাংশুশেখর মিশ্র। সেই গাড়িতে আমিও ছিলাম অক্ষত অবস্থায়। পুরো জিপগাড়ি উল্টে গিয়েছিল। আচার্যদেবের নির্দেশে গাড়ি চালানো নিষেধ ছিল তাঁর। অভিশপ্ত সেই দিনটিতে অমরপুরের আগে হঠাৎই কী ইচ্ছে জেগেছিল, ড্রাইভারকে সরিয়ে নিজেই স্টিয়ারিং হাতে বসলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই একটি বাঁকে এসে উল্টে গেল জিপ। আমার বয়স তখন দু-বছর। আজও চোখ বুঁজলেই ফেড রিলের মতো সেই দৃশ্য তাড়া করে। দীর্ঘদেহী, গৌরবর্ণ, সৌম্যদর্শন, সেই মানুষটিকে জিপ থেকে বের করা হচ্ছে। মাথা থেকে ফর্সা গাল বেয়ে নেমে আসছে লাল রক্তধারা। মা-র শাড়ি লাল হয়ে উঠেছিল সেই রক্তে ভিজে। বাবা আমাকে খুঁজেই যাচ্ছেন উল্টানো জিপের ভেতর। সবাই ভেবেছিল, আমি আর নেই। আমার সারা শরীর অক্ষত। পরদিনই মিশ্র জেঠুমারা যান। তাঁরই সন্তান সুদীপ্তশেখর মিশ্র। সুগায়ক। ছোটো ছেলে শুভেন্দুশেখর আমার ছোটোবেলার বন্ধু। সংগীতপ্রিয়। বাবার সংগীতানুরাগই এই দুই ভাইয়ের রক্তে। বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলনের অন্যতম শহিদ কমলা ভট্টাচার্য সুদীপ্তদার মাসি।
সেইসময় একদিন সালেমার রাখালতলিতে বাবার এক বন্ধু সালেমার রাখালতলির উপেন্দ্র দেবনাথের বাড়িতে দুপুরে খাওয়ার নিমন্ত্রণ। উপেন্দ্র দেবনাথ ছিলেন লোকসংগীত গায়ক ও গায়ক অমর পালের ছাত্র। উপেন্দ্রকাকু সম্ভবত ১৯৭৮-৭৯, এই একবছর সময় হালাহালি স্কুলে শিক্ষকতা করেছিলেন। তখন হালাহালিতে লোকগীতি শিল্পী ছিলেন শান্তি সিংহ। রেডিয়ো আর্টিস্ট। কমলপুরে ছিলেন শিল্পী অধর দেবনাথ ও প্রমোদ পাল। উপেন্দ্রকাকুর জন্ম সিলেটের মৌলভিবাজারের জগন্নাথপুর গ্রামে ১৯৩৪ সালে। সংগীতমুখর পরিবার। মা-বাবার কাছেই হাতেখড়ি। ঠাকুরদাও সুগায়ক ছিলেন। তখন মৌলভিবাজারে আরও দুই লোকসংগীত শিল্পী ছিলেন প্রহ্লাদ দাস ও ননীগোপাল বিশ্বাস। এদেশে চলে আসার পর চাকুরিজীবনের শুরুতেই উইদাউট পে হয়ে গান শিখতে কোলকাতা ছুটে যেতেন প্রবাদপ্রতিম শিল্পী অমর পাল ও নির্মলেন্দু চৌধুরীর কাছে। পাসপোর্ট করে গান শিখতে যেতেন আরেক প্রবাদপ্রতিম শিল্পী আবদুল আলীমের কাছে। চট্টগ্রামের আবদুল আলীম তখন ঢাকাতে থাকেন। আলীম সাহেবের একটি বিখ্যাত পল্লিগীতি ছিল–
বা-জান চল্ যাই চল্ মাঠে লাঙল বাইতে
গোরুর কান্ধে জোয়াল দিয়া ঠেলতে ঠেলতে ঠেলতে…
আলীম সাহেব আপ্লুত হয়ে উপেন্দ্রকাকুকে বলতেন, এই গানটি আমার চেয়েও তোমার কণ্ঠে সবচেয়ে ভালো শোনায়। অজস্র লোকগান উপেন্দ্রকাকু গেয়েছেন জীবনে। লালন সাঁইজি, রাধারমণ দত্ত, হাছন রাজা, ভাটিয়ালি, বাউল, পল্লিগীতি। হালাহালি থেকে সালেমা স্কুলে বদলি হয়ে এসে গঠন করেন একটি ধামাইল গান ও নাচের সংগঠন। এই দল নিয়ে চেন্নাইতেও অনুষ্ঠান করে এসছিলেন। উচ্চাঙ্গসঙ্গীতের তালিম নিয়েছিলেন আগরতলায় পণ্ডিত রবি নাগ ও রমেন দে-র কাছে। ডিব্রুগড়, কোলকাতা, শিলং, করিমগঞ্জ, অনেক জায়গাতেই তাঁর অনুষ্ঠান হয়েছিল। কোলকাতা যখন নির্মলেন্দু চৌধুরী ও অমর পালের গান শিখতে যেতেন, বেশিরভাগই রেলে যাতায়াত করতেন। একবার নিলামবাজার স্টেশনে রাত একটার ট্রেনের অপেক্ষা করছিলেন। ভাত খাওয়া হয়নি। প্ল্যাটফর্মে বসে গুনগুন করছিলেন। হঠাৎই এক কিশোর এসে কাকুকে বলল, আপনি তো গান করেন। চলুন, আমাদের কোয়ার্টারে। গান গাইবেন। তিনিও ইতস্ততঃ করছিলেন। ছেলেটি গিয়ে মাকে ডেকে নিয়ে এল। উপেন্দ্রকাকু গিয়ে দেখেন, এটি আসলে স্টেশন মাস্টারের কোয়ার্টার। সেদিন রাতে গান গাওয়ার পর সেখানেই খাওয়া দাওয়ার শেষে স্টেশন মাস্টার ভদ্রলোক কাকুকে ট্রেনে তুলে দেন। লামডিং পর্যন্ত বিনাভাড়ায় তাঁর আসার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন ভদ্রলোক। আজ পর্যন্ত কোনো সরকারি পুরস্কার উপেন্দ্র দেবনাথ পাননি।
তখন কমলপুর মহকুমায় রামায়ণ পালাগানের এক ও অদ্বিতীয় শিল্পী নবকিশোর সিংহ। বাড়ি লুৎমা। বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি সম্প্রদায়ের প্রতিভাবান এই পালাকীর্তনিয়ার জন্ম ১৯২২ সালে সিলেটের ভানুগাছ অঞ্চলের কালারাই বিল বা ডালুয়াতে। দশ বছর বয়সে ইন্ডিয়ায় চলে এসেছিলেন নবকিশোর। রামায়ণ পালার সাতকাণ্ডের মধ্যে নবকিশোর গাইতেন রামের বনবাস, সীতার বনবাস, তরণীসেনের যুদ্ধ, লক্ষণের শক্তিশেল, রামের সঙ্গে সুগ্রীবের মিলন, লব কুশের যুদ্ধ, পুত্রপরিচয়। আমার বন্ধু ও সহপাঠী কমলেশ, গৌতম হালদারের মেঘনাদবধ কাব্যের অভিনয় দেখে বলেছিল, নবকিশোর সিংহের প্রতিভার তুলনায় গৌতম হালদার রীতিমতো শিশু। আমার শৈশবে আগরতলা কুমারীটিলার ব্রজেন্দ্র দাসের স্ত্রী রেখা দাসের রামায়ণ গান শুনেছি। ব্রজেন্দ্র দাসের চেয়ে বেশ ছোটো বয়সে রেখা দাসের ছিল আগুনের মতো সৌন্দর্য। ব্রজেন্দ্র দাস প্রায় আমার ঠাকুরদার সমসাময়িক। দেখলে বোঝা যেত না। ঠাকুরদার সঙ্গে নাকি কীর্তন করতেন। হালাহালিতে এরও অনেক আগে ভিতর বাজারের শৈলেশ দেবের দুই মেয়েও নাকি রামায়ণ গাইতেন। পদাবলি কীর্তন গাইতেন পূর্ণমাসী সিংহ। শ্রীকৃষ্ণের অষ্টকালীন লীলার বারোপ্রহর জুড়ে এই পদাবলি শুরু হয় ভোর চারটে থেকে নিশান্ত দিয়ে। গৌরজাগানিয়া পদ। কৃষ্ণজাগানিয়া ও রাধাজাগানিয়া পদাবলি। এরপর গীত হয় শ্রীকৃষ্ণের বাল্যলীলা। এরপর শ্রীদাম, সুদামসহ গোষ্ঠলীলা। মধ্যাহ্ন লীলায় গাইতে হয় নৌকাবিলাস। সুবলমিলন। সূর্যপূজা। সূর্যপূজার ছলে গোপিনীদের গোবিন্দের সঙ্গে মিলন। এরপরই ফিরাগোষ্ঠের কীর্তন। তবে মা বা বাবার শ্রাদ্ধ উপলক্ষ্যে যদি কেউ পদাবলি কীর্তনের আয়োজন করেন, সেই অনুষ্ঠানে সংকল্পিত কীর্তন হিসেবে গোপাল আরতি, রাধা আরতি, গৌর আরতি, তুলসি আরতি ও জয়দেব আরতি গাইতেই হবে। এরপর নামমাহাত্ম্য। অভিসারের আগে রূপানুরাগ গাওয়া হয়। এরপর আক্ষেপ অনুরাগ। এরপর প্রেম প্রতি অনুরাগ। বংশী অনুরাগের পর অভিসার। কুঞ্জ অভিসারের পর মিলন গাওয়া হয়। মিলনের পরিবর্তে কখনো রাস দিয়েও সমাপ্ত হয়। পূর্ণমাসী সিংহের গুরু ছিলেন নাকফুলের ঠৎবা সিংহ। ঠৎবা সিংহের জন্ম সিলেটের ভানুগাছ অঞ্চলের ঘোড়ামারা। পূর্ণমাসী সিংহের পর এই পরম্পরা ধরে রেখেছেন লুৎমার ব্রজরানি সিংহ। ব্রজরানির গুরুও ঠৎবা সিংহ। পদাবলি কীর্তন ও রামায়ণ পালা, দুটি পরিবেশনাই ব্রজরানি করেন। ইদানীং পদাবলির আদি ব্রজবুলি ও বাংলা পদগুলি বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি ভাষায় অনুবাদ করে গাইছেন ব্রজরানি।
ত্রিপুরাতে ১৯৮০- র দাঙ্গার পর পানিসাগর, তিলথৈ, মাছমারা, কুমারঘাট, কমলপুর মহকুমা, তেলিয়ামুড়া, কল্যাণপুর, খোয়াই জুড়ে আমরা বাঙালি রাজনৈতিক দলটি খুব সক্রিয় হয়ে ওঠে। যদিও তাদের দাবি, অবাঙালি কোনো জনগোষ্ঠীর প্রতি তাদের কোনো রাগ বা দ্বেষ নেই। ছোটোবেলায় আগরতলার মহারানি তুলসীবতী বালিকা বিদ্যালয়ের লাগোয়া দেয়ালগুলিতে দেয়াল লিখন চোখে পড়ত, আসামের বাঙালি যদি বিদেশি হয়, অবাঙালি তবে বাংলা ছাড়ো। তিলথৈ-র প্রসন্ন নাথ এই দলের অন্যতম নেতা ছিলেন। প্রসন্ন নাথ একসময় ছিলেন অবিভক্ত তিলথৈ-র প্রধান। ভুবন বিজয় মজুমদার ছিলেন আমরা বাঙালি-র শীর্ষ নেতৃত্বের একজন। নির্বাচনও লড়তেন। কমলপুর মহকুমায় শান্তির বাজার, দেবীছড়া, কমলপুরে আমরা বাঙালি খুব সক্রিয় ছিল। একবার নেতাজির জন্মদিনে দেবীছড়ার এক আমরা বাঙালি-র ক্যাডার যুবককে, প্রায়ই রসিক রায়ের বেকারিতে আড্ডা দিত, নওজোয়ান নওজোয়ান নওজোয়ান গানটি গাইতে শুনেছিলাম। সেই যুবক তখন এক্সটার্নাল পরীক্ষার্থী হিসেবে প্রত্যেক বছরই মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়ে বলে বেড়াত এবারে সে ফার্স্ট ডিভিশন পাবেই। পরে রেজাল্ট বেরোলে দেখা যেত সে যথারীতি ফেল। আরেকটি গান গাইতে শোনা যেত –
বাংলা আমার দেশ, বাংলা আমার দেশ
বাংলাকে ভালোবাসি, বাংলার বুকে কাঁদি, বাংলার বুকে হাসি
বাংলাকে ভালোবাসি…
রঙ্গলাল দাস, সত্যেন্দ্র পাল, নন্দলাল অধিকারী, যতীন্দ্র দেবনাথ ছিল আমরা বাঙালি দলের সক্রিয় কর্মী। দেবীছড়ার সুশীল মালাকারও ঝুঁকে পড়েছিল ওই রাজনৈতিক আন্দোলনের দিকে। হালাহালিতে বাজারবারে মাঝেমাঝে বলাইদের হোটেলের সামনে আনন্দমার্গী সন্ন্যাসীরা খোলা কৃপাণ ও মড়ার খুলি হাতে কৌশিকী নৃত্য করত। কৌশিকী দুর্গার আরেক নাম। কোশ পরিবর্তন করে অসুর বধ করেছিলেন বলে এই কৌশিকী নাম। সন্ন্যাসীদের পরনে থাকত সাদা লুঙ্গির মতো ও গেরুয়া পোশাক। মাথায় গেরুয়া পাগড়ি। আমরা বাঙালি রাজনৈতিক দল আসলে আনন্দমার্গের রাজনৈতিক মঞ্চ। আনন্দমার্গের প্রতিষ্ঠাতা প্রভাতরঞ্জন সরকার। ১৯২১ সালের বুদ্ধপূর্ণিমায় আনন্দমার্গের আচার্য প্রভাত সরকার তথা আনন্দমূর্তিজির জন্ম বিহারের জামালপুরে। তাঁর আধ্যাত্মিক দর্শনটিই প্রাউট নামে পরিচিত। প্রাউট মানে উপযোগ তত্ত্ব। ভারতবর্ষীয় আধ্যাত্মিকতা নির্ভর প্রগতিশীল ধনতন্ত্রের বিস্তার চেয়েছিলে প্রভাত সরকার। এই আধ্যাত্মিকতা মূলত তন্ত্রসাধনার। ব্রহ্মচর্যের পরবর্তী স্তর অবধূত ও অবধূতিকা। খুব সম্ভবত আনন্দমার্গই একমাত্র ধর্মীয় সম্প্রদায় যেখানে সন্ন্যাসিনীদেরও দীক্ষাদানের অধিকার দেওয়া হয়েছে। আমরা বাঙালি নামটি তিনি আহরণ করেছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের কবিতা থেকে। প্রভাতরঞ্জনের মতে শরীর-মন-আত্মা নিয়ে মানুষের ত্রিভেদী অস্তিত্ব। পেশায় যদিও ভারতীয় রেলের সামান্য কর্মচারী ছিলেন, ভাষাজ্ঞান ও অগাধ পাণ্ডিত্য প্রভাত সরকারের। বেশ কয়েকটি বিদেশি ভাষা তিনি জানতেন। আনন্দমার্গীয় তন্ত্রসাধনার নির্জন ও রহস্যময় এই মানুষটির স্বপ্ন ছিল, ১৮৭২ সালের ২, ৪৮, ২৩১ বর্গমাইল বাঙালিস্তানের আধ্যাত্মিক ও সাংস্কৃতিক পুনরুদ্ধার ও একদা শ্রীভূমির মানচিত্রের দিকনির্দেশক। নেতাজি সুভাষ সম্পর্কে তাঁর মামা। নেতাজির আদর্শে আস্থা রাখতেন। বল্লালসেনীয় যুগের কৌলীন্যপ্রথার সংস্কার চেয়েছিলেন নবাব হুসেন শাহ। বল্লালসেনীয় কৌলীন্য প্রথায় পরিবারের বড়ো মেয়েটিকে বিয়ে দেওয়া হত ব্রাহ্মণের সঙ্গে। এই প্রথা সাতপুরুষ পর্যন্ত যদি কেউ রক্ষা না করতে পারে তবে সে ভগ্নকুলীন হিসেবে ব্রাত্য হবে। এতে দেখা যেত কোনো বয়স্ক ব্রাহ্মণের হয়তো এত স্ত্রী যে সেই স্বামীটি নিজেও তার স্ত্রীসংখ্যা মনে রাখতে পারতেন না। স্বামীর মৃত্যুর পর অকাল বৈধব্য থেকে আস্তে আস্তে জন্ম নিল সামাজিক যৌন ব্যভিচার যার ফল হুসেন শাহের সময় প্রকট হয়ে উঠল। নবাব তখন কৌলীন্য প্রথার সংস্কার জরুরি বলে মনে করলেন। নবাব এই দায়িত্ব দিয়েছিলেন নেতাজির পূর্বপুরুষ গোপীনাথ বসু তথা পুরন্দর খাঁকে। পুরন্দর খাঁ তখন কায়স্থ বা বৈদ্য বংশের ছেলেদের উচুঁ জাতির মেয়েকে বিয়ে করার মাধ্যমে সংস্কার সাধন করেন। এতে বৈদ্য ও কায়স্থেরা সামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবে অনেকটাই অগ্রসর হন। যদিও বল্লালসেনীয় ব্রাহ্মণ্য সমাজ এই সংস্কার মেনে নেয়নি। নবাব হুসেন শাহকে অনেক মধ্যযুগীয় ব্রাহ্মণ কবিরাই শ্রীকৃষ্ণের অবতার বলে উল্লেখ করেছেন। হিন্দু জাতি ও সংস্কৃতিকে হুসেন শাহ কখনোই আক্রমণ করেননি। বরং দেখা গেছে, তাঁর উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী ও অমাত্যবর্গের অনেকেই ছিলেন হিন্দু। যদিও কৃষ্ণদাস কবিরাজ ও গোবিন্দদাস হুসেন শাহকে ম্লেচ্ছ বা ভক্তিধর্মদ্রোহী বলেই চিহ্নিত করে গেছেন। দক্ষিণ ভারতে শঙ্করাচার্যের আবির্ভাবের আগে বর্ণ বলতে জাতি নয়, সংস্কৃতিকেই বোঝাত। গুণ ও কর্মের মধ্য দিয়ে ব্রাহ্মণত্ব লাভের সুযোগ সবারই ছিল। সেই বৈদিক রীতি অনুসারেই আনন্দমূর্তি প্রভাত সরকারও সদ্বিপ্র গঠন আন্দোলন চেয়েছিলেন। প্রভাতরঞ্জনের উল্লেখযোগ্য বইগুলো বাংলা ও বাঙালি। বর্ণবিচিত্রা। সভ্যতার আদিবিন্দু রাঢ়। বর্ণবিজ্ঞান। প্রভাতরঞ্জনের ব্যাকরণবিজ্ঞান। কণিকায় প্রাউট। পাঁচ হাজারেরও বেশি গান লিখে সুর করে গেছেন। এই গান প্রভাত সংগীত নামে পরিচিত। প্রাউট দর্শন তখন আমেরিকার বিশ্ববিদ্যায়তনিক স্তরে পাঠ্য ছিল। সি পি আই এমের সঙ্গে আনন্দমার্গ ও আমরা বাঙালি-র সম্পর্ক ছিল সাপে নেউলে। নৃপেন চক্রবর্তী মুখ্যমন্ত্রী থাকার সময় থেকেই। ১৯৮২ সালে কোলকাতার বিজন সেতুতে ১৭ জন আনন্দমার্গী সন্ন্যাসীদের জ্যান্ত পুড়িয়ে মারার ঘটনাও আমরা তখন শুনেছিলাম। এই মামলার আজও নিষ্পত্তি হয়নি।
একটা ব্যাপার আমাকে খুব ভাবিয়ে তুলত তখন। সহপাঠী পঞ্চলক্ষী দেববর্মাকে কেন বাংলাভাষায় পাঠ্যবই পড়তে হয়? অমলেন্দু সিংহ কেন মণিপুরি ভাষায় পাঠ্যবই পড়তে পারে না? রমেন বা ব্রজেনের পাঠ্যবই কেন বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি ভাষায় নেই? শৈশবে মামাবাড়ি গেলে আমার কোকিল মাসি ও দীপামাসিকে দেখতাম অসমিয়া ভাষার টেস্টপেপার প্র্যাকটিস করছে। এটা কেন? কেন প্রত্যেক ভাষিক জনগোষ্ঠী তাদের নিজেদের ভাষায় পড়াশোনা করতে পারে না? সালোকসংশ্লেষের কি ককবরক পরিভাষা নেই? মণিপুরি ভাষায় ত্বরণ ও মন্দন কী হবে? বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরিতে ডারউইনের যোগ্যতমের উদ্বর্তন শব্দবন্ধের সমার্থই বা কী হতে পারে? নিজের ভাষা জানার পরও অন্য ভাষায় শিক্ষাকে আয়ত্ত করার জন্যে এরা যে কতটা প্রশংসনীয় তা আমরা ভাবি না। আরেকটু বড়ো হয়ে বুঝেছিলাম, ভাষার মাৎস্যন্যায়। ভাষার এই মাৎস্যন্যায়ে বাংলাভাষা একইসঙ্গে রাঘব বোয়াল ও চুনোপুঁটি।
অসাধারণ লেখাটি