কুহক
তোমার ছোট ছোট উষ্ণ ব্যবহারগুলি সোনালি জালের মতো চারপাশে ঝুলে থাকে। আমি সেই জাল, সেই অপার্থিব জাল ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখি। যেন অন্ধ পাঠিকা ছুঁয়ে ছুঁয়ে আন্দাজ করছে বহুশ্রুত গল্প, গল্পের নায়ককে। আমি তোমার চোখ স্পর্শ করি। মনে মনে ধরে নিই, এ হয়তো তোমার চোখ। গাঢ় কুয়াশার মতো। হাতড়ে হাতড়ে ছুঁই তোমার প্রস্ফুটিত নাক, কী গরম তোমার নিঃশ্বাস! নিশ্চয়ই অনেক দূরত্ব পেরিয়ে আসছে! যে দূরত্ব বা দূরত্ব যেখানে শেষ- সেখানে যে অন্য জগৎ, আরেক পৃথিবী, তার সম্বন্ধে আমার কিছুমাত্র ধারণা নেই। কিছুটা তৃণাঞ্চল পার করে তোমার ঠোঁট! আমি অনেকক্ষণ তোমার নিঃস্পন্দ ঠোঁটদুটো ছুঁয়ে থাকি। কী যেন মনে হয় আমার। কেন যেন নিজেকে রোদ সরে যাওয়া লাল ইটের গাঁথুনির মতো লাগে। পাশেই একটা গোল সাদা থামের শুরু। যেন এই ইটের গাঁথুনি ও তার সংলগ্ন থামে হাত রেখে তরুণ গাছের মতো কেউ অন্য একটি তরুণ গাছের মতো কারও জন্য অপেক্ষা করে। উদগ্রীব হয়ে সময়ে চোখ রাখে। মুখ ঘুরিয়ে দ্যাখে দূরে দূরে শহরের উপছে ওঠা ফেনা! আবছা যানবাহনের শব্দ! এই যানবাহনে চড়ে কেউ হয়তো কারও কাছে যাচ্ছে! তোমার নিঃস্পন্দ ঠোঁট ছুঁয়ে আমার এইসবই মনে হয়। আমার আঙুল সরাতে ইচ্ছে করে না। এই ঠোঁটই তোমার পরিচয়। তোমার ছোট ছোট উষ্ণ ব্যহারগুলি, কথা বা হাসি এই ঠোঁটের সীমানা পেরিয়েই তো আমার জলহাওয়ায় মিশে যেত! আমি তোমার ঠোঁট ছুঁয়ে যতক্ষণ পারি দাঁড়িয়ে থাকি। তোমার গরম নিঃশ্বাস পড়ে পড়ে আমার চারদিকে বাষ্প জমে যায়
একসময় কোনো কণ্ঠস্বর বলে ওঠে- ‘সময় হয়েছে, আর নয়’। কার কণ্ঠস্বর? আমি পাথুরে মূর্তির মতো তোমাকে মনে মনে এই প্রশ্ন করি। পাথুরে মূর্তির থেকে যেমন কোনো উত্তর আসে না, তুমিও তেমনই নিরুত্তর থাক। আমি গন্ধ পাই পুরোনো আসবাবের। পুরনো পর্দা, কার্পেটের বা এসবের ওপর এঁকেবেঁকে সর্পিল হয়ে বা উঁচু-নিচু মাঠের মতো বোবা পুরনো এক রোদের। আমি গন্ধ পাই বুক ঢিবঢিব করছে যে মহীয়সী আকাশের – তার! আমি গন্ধ পাই মোটা খসখসে কোট পরে অদূরে দাঁড়িয়ে যে বহির্জগৎ শুভ-অশুভ চিন্তা করছে – তার। আমি গন্ধ পাই আড়ালে যারা চিৎকৃত ইঁদুরের মতো ছোটাছুটি করছে – তাদের। আমি আবার, আবারও সেই লাল ইটের গাঁথুনির কাছে ফিরে যাই, সেই থামের কাছে – যেখানে তরুণ গাছ আরো একটি তরুণ গাছের জন্য সমূহ সামলে অপেক্ষা করে। দূরে দূরে শহরের ফেনা, একটি সমুচ্চ বাড়ির মাথা, তার পাশে ঝুলন্ত তারের ওপর বসে থাকা একটি কালো পাখি। লেজ দেখে যাকে শনাক্ত করা যায়। তোমার ছোট ছোট উষ্ণ ব্যবহার, কাচের চুড়ি টুকরো হয়ে যাবার মতো কথা বা হাসি বা আরো কিছু – যা আমি বুঝতে পারিনি, সেসব শেষ বিকেলের মতো নীল হয়ে আসে। কণ্ঠস্বর আর কিছু না বললেও আমি বুঝি, বুঝতে পারি সে আমার আশেপাশেই কোথাও রয়েছে। তারও কটু উর্দির গন্ধ আমি পাই। তবুও আরো একবার তোমার কপাল, চোখ নাক ঠোঁটের ভাস্কর্য ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখি। এই কি শেষবার? নাকি আবারও সুযোগ হবে? আবারও তোমার শীতল পাথুরে স্তনের কাছে প্রশ্ন করি, কোনোদিন উত্তর পাব না জেনেও প্রশ্ন করি। তখনই টের পাই স্পষ্ট সোনালি জাল – তার বিষম, অগুন্তি গিঁটগুলো
সৈনিক
জানালার বাইরে আজ ভীষণ মন বিষণ্ণ করা বৃষ্টি পড়ছিল। অদ্ভুত সেই নীরবতার ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে তবে আমার সীমানা, নীচ থেকে কয়েকধাপ ওপরের দিকে উঠে যাওয়া সিঁড়ি এবং আমার ছোট বড় চাকায় ঘোরানো অস্তিত্ব। ঈষদুষ্ণ চিন্তার ওপরে খুলির ছাদ, তারও কয়েকহাত ওপরে আরেকটি অসাড় ছাদ। পায়ের নীচে যে মেঝে, তারও নীচে আরেকটা মেঝে। তারও নীচে গলিত দ্রাবক। আমাকে ঘিরে হাওয়ায় ফেঁপে ওঠা ধূসর গাউনের মতো বৃষ্টি হচ্ছিল। এই গাউনের বাইরে যে বাকি জগৎ, সেখানে হয়তো বৃষ্টি ছিল না। সোনালি আলপনার মতো রোদ কি অসম্ভব? জামাকাপড়েরা বাইরে এসে তারে তারে ঝুলেছিল ফাঁসি দেওয়া নরম মানুষের মতো। কয়েকটা পাখি উড়ে এসে বসেছিল অতিকায় মাটিতে। মাটিতে যৌনকেশের মতো রোদে পোড়া ঘাস, কঠোর দাঁতের দাগ। অসম্ভব কি? তোমার গলার ভাঁজে, বুকের ভাঁজে মূল্যবান পাথরের মতো ঘাম – অসম্ভব কি? অদৃশ্য থেকে ভুলতে চাওয়া রহস্যময় চুলের গন্ধ-তাও কি অসম্ভব? কড়াইয়ে অনেকেরই হাত কাঁপে, নিয়ন্ত্রণের বাইরে গিয়ে একা একাই নিজের মতো কেঁপে ওঠে, কোনো নিকট কারণ ছাড়াই। তার সাক্ষী সেই সময়ে আকাশের লক্ষ্যে উঠে যাওয়া তেল-ফোড়নের ঝাঁঝ, তৈলাক্ত দেওয়াল আর নির্জন মুখের একটি রুগ্ন বেড়াল। তোমাকে ঘিরে কোনো বৃষ্টি নেই, বরং সেখানে একটা খাঁটি দিনের উদার আলিঙ্গন, তবুও তোমার পিঠ ভেজে, তুমি বোঝো ভিজে যায়
শহরে কত বিপদ থাকে, অত্যাশ্চর্যও থাকে – নিজের ভেতরে এইসব ভাব না তখন? চোখ পড়ে না পাশাপাশি থাকা দুটো অসমান মাপের স্যান্ডেল আর বেডকভারের সঙ্গে গুটিয়ে রাখা শায়া আর গেঞ্জির দিকে? বাসনের তাক থেকে নোংরা অভিসন্ধির কোনো ইবলিশ হেসে ওঠে কি তখন? অবচেতনায় একটি হরিণ আর মানুষের সঙ্গম কি উঁকি দেয়? আমার ছোট বড় চাকার ওপরে হাঁটা বা বয়ে যাওয়া অস্তিত্ব দূরের ছাই ছাই জংগলের পেট চিরে চলে যাওয়া নদীর মতো জগতে, হিসেবে থাকে। তার আগে থাকে শ’য়ে শ’য়ে গণপরিবহণ, মুখোশ বা মুখোশ নামানো যাত্রী, উৎক্ষিপ্ত বোমার মতো সব কার্যালয় বা ঝিঁঝিঁ ডাকা বন। ব্যবস্থার সূক্ষ্ম জাল – যা চোখেই পড়ে না, আর চামড়ায় বেঁধানো হুক। আমার চারপাশে হাওয়ায় ফেঁপে ওঠা গাউনের মতো বৃষ্টি পড়ছিল। ঠিক তার কেন্দ্রবিন্দুতে আমি। খুব নিরাপদ দূরত্বে আমার সীমানা, যেমন বলেছি তেমন নীচ থেকে ওপরের দিকে উঠে যাওয়া কয়েকধাপ সিঁড়ি, একটু বারান্দা হয়তো- বা। তারপরেই দরজা খুললে আমি। আমার হাত-পা, অজস্র ডালপালা, বিসদৃশ সব সম্ভাবনা। দিনান্তে যেসব তোমাকে কুড়ে কুড়ে খায় বা তোমাকে ধরা দিতে হয় তাদের মুঠির মধ্যে। নক্ষত্রের পটভূমিকায় চাঁদ পালাতে থাকে, তার পেছনে পেছনে আসুরিক ধাবমান মেঘ বা মেঘেরা। তুমি হয়তো অপলক চোখে দ্যাখো। দ্যাখো যে তোমার শরীরে চুপিসারে কীভাবে প্রবেশ করছে অন্য এক বলহীন সৈনিকের শরীর
কুমির
একটা সাদা, গুঁড়ো গুঁড়ো আলো তাঁবুর মতো ছড়িয়ে আছে আমাদের ওপরে। আমাদের ভাঙা দূর্গের মতো দেহাবয়ব। কোথাও কোনো ফাটলে হঠাৎ বুনোপাতার কিছু বিস্ফোরণ হয়তো আছে, তবুও কীরকম নিরুত্তাপ, ক্রিয়াহীন আমাদের অসমান দেহাবয়ব। উচ্ছসিত শিশুর মতো পাতলা রাত দৌড়ে যায় ঘন রাতের দিকে। মানুষের জীবন চুইংগামের মতো আটকে থাকে এক অবিচলতার গায়ে। স্বাভাবিক রক্তচাপের মতো সর্পিল সব রাস্তাগুলো আমাদের এবং আমাদের আরো অধিককে ঘিরে আছে। আজ কোনো অভিনব ঘটনা ঘটেনি কোথাও। যে খোসায় আমাদের দেহ-মাংস মোড়া, সে খোসার ওপর ভনভন করে অগোছালো, নিষ্প্রভ একটা দিন। নিয়মিত বিরতিতে বাথরুম দিয়ে আবদ্ধ অসীম জল বেরিয়ে যায়, প্রাকৃত জলের মতো তারও হয়তো কোনো গন্তব্য আছে। আর কী? আর কী কিছু? তোমার ভাবনার পাশেই তো দলছুট কাঠের মতো সমান্তরাল হয়ে ভেসে আছে আমার ভাবনা। তুমি যেখানে যেখানে যাও, নিঃশব্দে আমিও কি অনুসরণ করি না তোমাকে? আমার সলজ্জ লিঙ্গ মাথা হেঁট করে থাকে না কি ব্যর্থ কর্মীর মতো? অভিনব কোনোকিছু, কোনো ঘটনা ঘটছে না কোথাও। মানুষের খুচরো শব্দ বিষণ্ণ টিপটিপে বৃষ্টির মতন
অজান্তে ছুঁয়ে দেখি নিজের মুখের ঘাস। গালের খাদ কী শক্ত বিষম আগছায় ছেয়ে গেছে। এ নিয়ে তোমার এখন কোনো বক্তব্য নেই। আমি বুঝি তোমার ভেতরে কালো হয়ে আছে আকাশ, যেরকম শহরের উপকণ্ঠে নির্মীয়মান বাড়ির মাথায় দেখা যায়। সেই আকাশ থেকে হাতে নিশান নিয়ে কখনো ঘোড়সওয়ারের মতো ঝড় আসে। দুর্ঘটনার মতো বিদ্যুত পড়ে। সেদিন জরায়ুর দিকে ফেলে রাখা সব নালি, সব শিরা উশখুশ করে ওঠে। যেন তারা কয়লার খনি থেকে এইমাত্র উঠে এল সমান করে ছাটা কোলাহলে। অদৃশ্যে থাকা গরম ঊরু আর তার ঘামের মধ্যে। এসময় আমার কী করা উচিত? বন্দরে অতিকায় একটা জাহাজ ভেড়ানো? অথবা কাল্পনিক সিঁড়ি দিয়ে বায়ুসেবকের মতো নেমে আসা? তোমাকে স্বপ্নের মতো হাতে নিরাভরণ করা? আমি দেখলাম তুমি উঠে নিজের নিয়ন্ত্রিত আগুনের কাছে গেলে। চায়নাবেলের মতো কিছু ক্ষুদ্র, সুন্দর শব্দ হল। তোমার পিঠের শিরদাঁড়া বরাবর যে উল্কি, সেটা শূন্যে মাথা উঠিয়ে তোমাকে লক্ষ করে হাঁ করল। দিনের সৎকারে এখন তুমিই প্রথম মুখাগ্নি করবে। তারপর হয়তো আমি। তারপর হয়তো আমাদের অভ্যাস, আসবাব আর পোশাকআশাকেরা। তারপর একটি ঘরের দুটো খাঁচায় পোষা দুটো প্রাচীন, নিরক্ত কুমির
ম্যুরাল
আমাদের সৌভাগ্য আজ তাড়াতাড়ি রান্না হয়ে যাবার মতন। অন্যান্য দিনের তুলনায় একটু জোরে ঘোরা সিলিং ফ্যানের হাওয়ার মতন। ঠা ঠা করা রোদ সরিয়ে হঠাৎ আইভরি গ্রে রঙের একটা মেঘলা পর্দা চারপাশে নেমে আসার মতন। জলের ঝাপটা দিয়ে পোড়া পোড়া থমথমে মুখ ধুয়ে ফেলার মতো। জলের আস্তর পড়া মুখ তুলে বেসিনের ওপরে বয়স্কা এক আয়নায় তাকানোর মতো। কী একটা সুন্দর শুক্তো শুক্তো পদের গন্ধ ঘরগুলোর প্রাণ দিয়ে সুতো টেনে নিয়ে একসাথে আটকে রেখেছে। এও আমাদের সৌভাগ্য, তবে বিশীর্ণ একটা গাছের পাতার চাপ চাপ ছায়া পড়া। আমাদের একটি হারানো ভাতের থালা আজ অত্যাশ্চর্য ভাবে খুঁজে পাওয়া গেছে, এও আমাদের সৌভাগ্যের উড়তে থাকা একটি প্রান্ত। তোমার নিজেকে পরিশ্রুত আর হালকা লাগছে। অনেকদিন পরে আমারও পেটে চনমন করছে খিদে। নাভির ভেতরের দিকে মাংসাশী প্রকাণ্ড ফুলের মতো পাপড়ি ছড়িয়ে হাঁ করে আছে তারা। আমি মনে করি এও সৌভাগ্য। ভ্যান গগ যেমন হলুদ দিয়ে কৃষিজমির ছবি আঁকতেন, এই দিনের মধ্যে তেমনই হলুদ। কখনো কখনো ছোট ছোট আল, হাতে তৈরি আটপৌরে বেড়া- যেগুলো কঠিন নয়, বরং হঠাৎই ফুরিয়ে যায় – তেমন। দূরে দূরে ঘর। তার পেছনে স্বল্প মেঘ কিন্তু সীমানা ছোঁয়া নীলের সুবিশাল পটভূমিকা। এই যে আমি মেরুদণ্ডে অলীক ছুরিবিদ্ধ হয়ে পড়ে আছি অথচ তুমি তা ঠান্ডা, প্রশান্ত মনে স্বীকার করে নিয়েছ – এও তো সৌভাগ্য! তবে আমাদের হয়তো নয়, শুধুই আমার
গির্জার ঘণ্টার মতো কোথাও কোনো শব্দ হয়। হয়তো আমরাই শুধু শুনি। তুমি একটা বিশাল মথের মতো বিছানায় শুয়ে পড়। তোমার চারদিকে ছড়ানো থাকে তোমার কালো আবছা পাখা। বহুদিন পর তুমি সময় পাচ্ছ বিছানায় গড়িয়ে নেবার। বিছানার সৈকতে অদৃশ্য সমুদ্রের ঢেউ যেসব ঝিনুক শৈবাল রেখে যায় – সেসব কুড়িয়ে নাড়িয়ে দেখার। বাতাস কখনো তুলনামূলকভাবে হিম হয়ে ট্রেসপাসারের মতো ঘরে ঢোকে বা তঞ্চকের মতো। অনেক আসবাবের ঢাকনা তাতে কেমন জীবন্ত হয়ে ওঠে। আমার মনে হয় গির্জার ঘণ্টার মতো শব্দটি শুধু আমরা নই, সবাই-ই শুনতে পায়। হয়তো সেটা প্রত্যেকের জন্য, প্রতিটি সংসারের জন্য আলাদা আলাদা করে বাজে। আমি ভাবি, তোমার থেকে আমার দূরত্ব তো বেশি নয়। কয়েকটা সংকীর্ণ বাঁক মাত্র! চাইলে তুমি অনায়াসে সেগুলো পেরিয়ে এসে আমার মেরুদণ্ড থেকে খচ করে এই চকচকে নকশা কাটা ছুরিটা উপড়ে নিতে পার। আমার ভেতরে মাথা ঢুকিয়ে মোটা, সেনাকম্বলের মতো ভাষায় জিজ্ঞেস করতে পার কী আমার ইচ্ছে। আমি কি এভাবেই মরদেহ হয়ে পড়ে থাকতে চাই কিনা? নাকি আমার জীবনে ফিরে আসার সত্যিই কোনো ঐকান্তিক ইচ্ছে আছে। পারতে, এসব সহজেই পারতে। কিন্তু কী কারণে যেন তোমার মধ্যে আজ তোমার সেই অবয়ব নেই, সেই পদশব্দ নেই। সময়কে যেন পেছনে ফেলে আরো, আরো বেশি দ্রুতবেগে ঘুরে যাচ্ছে পাখা। জানালার বাইরে বৃষ্টি নামার আগের খাকি পোশাকের অনুচর। হয়তো এও আমাদের পুরনো, বাতিল কোনো সৌভাগ্যর মতন
ময়ূর
কাছে এসে দেখলাম তোমার মুখের বয়েস হয়েছে। বিষণ্ণ ধুলো যেমন নির্বিচারে রাস্তার দু’পাশে উদগ্রীব পাতায় পাতায় জমে থাকে, তেমনই ধুলোর আস্তর বুঝি-বা তোমার মুখেও। হিমবাহ নেমেছে তোমার চোখের উৎপত্তি থেকে গাল বেয়ে চিবুকের দিকে। বাঘের আঁচড়ের মতো তাতে অসংখ্য ভাঁজ, কুঞ্চন। কী কারণে যেন তুমি পায়ের কাছাকাছি কোনো একটা অঞ্চলে তাকিয়ে আছ। আমি তোমার দৃষ্টি অনুসরণ করে দেখলাম সেটি একটি মরু অঞ্চল। বালিয়াড়ির পর বালিয়াড়ি। কখনো-সখনো কেয়াগাছ। ফেটে যাওয়া সূর্যের কী ভয়াবহ সুন্দর রক্ত বালির অনন্ত চাদরে ছিটকে পড়েছে। তুমি যে আমার উপস্থিতি টের পেলে, তা আমি বুঝতে পেলাম আঁচলের কুণ্ঠা দেখে। তোমার স্তনের অন্ধকার থেকে যেসব বিছের মতো প্রাণিরা বেরিয়ে এসেছিল, তাদের চকিতে সরে পড়া দেখে। তোমার মুখ দেখে আমার ফাঁকা বাড়ির দেয়ালে আটকে থাকা শুভ্র তুলোর কথা মনে পড়ল। মনে পড়ল প্রায় নির্জীব এক বইমেলার মাঠ। কবিতা পাঠ আছে বলতে বলতে যে শ্যামশ্রী চেহারাটি টেবিল ও চেয়ারের ফাঁক থেকে ভারী শাড়ির খসখস তুলে মুখোমুখি হেঁটে নয়, পাশে সরতে সরতে দৃশ্যমান বক্তব্যের পেছনে আরেকটি প্রচ্ছন্ন বক্তব্য রেখে বেরিয়ে গেল – সেই শ্যামশ্রী চেহারাটির কথা মনে পড়ল
কী গরম না? বলতে বলতে আমি একটা টুল টেনে তোমার ঝুলে পড়া, বাঘের আঁচড় কাটা মুখের সামনে বসলাম। সত্যিই তখন বলার মতো গরম হয়তো বাতাসের মধ্যে ছিল না। হয়তো এমন-ই একটা নির্ভার এবং ক্ষতিকর নয় কথা দিয়েই সব সম্পর্কের যাত্রা শুরু হয় – তাই বললাম। হৃদয়কে বিমুগ্ধ করে ঝলসে দেবার মতো, চোখদুটোকে কাচের ফলার মতো চকচকে করে তোলার মতো হয়তো আরো অনেক কথা বা বাক্য আছে, কিন্তু আমার গরমের কথাটাই মনে এসেছিল। কিছুই বলছ না দেখে আমি আঙুল দিয়ে তোমার একটি বলিরেখা ছুঁলাম। রাগ হল এই ভেবে যে, সময় নামক জন্তুটি কী ভীষণ নির্মম, পাশবিক। নিয়মের নামে হয়তো ওটা প্রকৃত বলাৎকার-ই করে। নিক্ষিপ্ত বীর্যকে নিপুণভাবে ঢাকা দিয়ে চলে যায়। পরে সেই বীর্য থেকে লতাপাতা বিষাক্ত সব শেকড় বেরোতে থাকে। বুকের মধ্যে মোম ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে নিভে যেতে থাকে। ঘোরের মধ্যে চুপ করে বসে থাকা প্রজাপতি হঠাৎ গা থেকে উড়ে, বেরিয়ে যায়। আমি তোমার বলিরেখায় আঙুল রেখে এইসব ভাবি। একাকী ময়ূর হয়ে একটা নদীর হাতায় ঘুরে বেড়াতে থাকি। আমার মস্তিস্ক কম, পাহাড়ের মাথায় মাথায় অবতীর্ণ নক্ষত্র কম – হয়তো সে কারণেই সুদূর বুঝতে পারি না আমি। জলের অজ্ঞাত দেশে মাছের রহস্য বুঝতে পারি না। শুধু বুঝি তোমার সংসারে আমি কাজ করি, কাজ করে খাই
আমাকে কখনো কখনো তুমি তোমার হীরে-মরকতের শরীর সামলে রাখতে দাও
অমিতরূপ চক্রবর্তী। জন্ম কোচবিহার জেলায়৷ বড় হয়ে ওঠা আলিপুরদুয়ার জেলার হ্যামিল্টনগঞ্জে৷ কলেজে পড়াকালীন লেখালেখির প্রতি আগ্রহ জন্মায় এবং লেখার হাতেখড়ি৷ স্থানীয় ছোট পত্রপত্রিকায় প্রথম লেখা প্রকাশ৷ এরপর লেখায় দীর্ঘ সময়ের ছেদ পড়ে৷ আবার গত তিনবছর ধরে লেখায় ফেরা৷ কাব্যগ্রন্থ 'কিছুক্ষণ থাকা অথবা অনন্তকাল' ২০২০ কলকাতা বইমেলায় 'শুধু বিঘে দুই' থেকে প্রকাশিত৷ মূলত কবিতা লিখতে পছন্দ করেন৷ একটু আধটু গদ্যচর্চাও হয়৷