২৩.দারুহরিদ্রা:- শিলচর আসার পর নিশ্চয় আপনাকে বাংলা মাধ্যমের স্কুলেই ভরতি হতে হয়েছিল?
অমিতাভ:- হ্যাঁ, প্রথমে নাজিরপট্টি মডেল প্রাইমারি স্কুল। সেখান থেকে পাবলিক হাইস্কুল। আমার বন্ধুভাগ্য ও শিক্ষকভাগ্য চিরকালই ভালো। পাবলিক স্কুলে শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলাম তিনজনকে। যারা শিলচরের সাহিত্য-সংস্কৃতির জগতকে শাসন করতেন। কবি বিমল চৌধুরী ছিলেন ‘অতন্দ্র‘ পত্রিকার অন্যতম প্রধান সম্পাদক। মনে রেখো, ‘অতন্দ্র‘ ছিল একটি কাব্য আন্দোলনেরও নাম। রণজিৎদা (দাশ) প্রায়ই বলেন, বাংলাভাষায় কাব্য আন্দোলনের সংখ্যা এমনিতেই খুব কম। তার মধ্যে, আমাদের কী ভাগ্য, গত শতকের ষাটের দশকের একটি প্রধান কাব্যআন্দোলন ঘটেছিল এই শিলচর শহরেই। আর আমার মাস্টারমশাই বিমল চৌধুরী ছিলেন সেই আন্দোলনের অন্যতম কর্ণধার। আমার আরও সৌভাগ্য এই যে, স্বয়ং শঙ্খ ঘোষের কাছে ছন্দের ক্লাস করলেও আমি এম এ টেমে পাশ করে এসে হাতেকলমে ছন্দের তালিম নিয়েছিলাম এই বিমল স্যারের কাছে। আমাদের আরেকজন মাস্টারমশাই ছিলেন গল্পকার শ্যামলেন্দু চক্রবর্তী। তিনি ছিলেন ‘অনিশ‘ পত্রিকার সম্পাদক। ‘অনিশ‘ ছিল তপোধীরদাদের ‘শতক্রতু‘ পত্রিকার একমাত্র অগ্রদূত। আর ছিলেন প্রসূন স্যার। প্রসূনকান্তি দেব শিলচরের সাংস্কৃতিক মহলে সর্বত্রউচ্চারিত একটি নাম। তিনি আমার গানের মাস্টারমশাই শিবেন্দ্র চক্রবর্তীর কাছে গান শিখেছেন। অর্থাৎ মাস্টারমশাই হলেও তিনি আমার গুরুভাই। প্রসূন স্যারের ছিল স্কুলের ভিতরে আরেকটি স্কুল। গানের স্কুল। সে স্কুল হত প্রতি শনিবার ছুটির পর। এই স্কুলটি নিয়ে একটি কিশোর উপন্যাস লিখেছি আমি। তোমরাও তা পড়েছ। প্রাণের হাট। আরেকটি উপন্যাস লেখার কাজ চলছে আমার ওই স্কুলজীবন নিয়েই। একটু রহস্য উপন্যাসের ধাঁচে। লেখা তেমন এগোচ্ছে না। যাই হোক, এর মধ্যে শেষ করে ফেলতে হবে।
২৪.দারুহরিদ্রা:- ‘প্রাণের হাট‘ আমরা পড়েছি। উপন্যাসের ভেতরে যে নাটক করার কথা আছে তা কি সত্যি হয়েছিল?
অমিতাভ:- না, এরকম কোনও নাটক হয়নি। এর বেশিরভাগটাই কল্পনা। চরিত্রগুলি কেবল বাস্তব থেকে নেওয়া। আমি তো সত্যিকারের নামও ব্যবহার করেছি। আমার সৌভাগ্য যে অরূপ বৈশ্যর মতো সহপাঠী পেয়েছিলাম। অরূপ বৈশ্য, তোমরা নিশ্চয়ই জানো, বামপন্থী তাত্ত্বিক। একবছর হল তার একটি তত্ত্বের বই বেরিয়েছে Cambridge Scholars Publishing থেকে। চাট্টিখানি কথা নয়! আমি অরূপকে নিয়ে গভীর গর্ব অনুভব করি। আন্তর্জালে বাংলা লেখা ও বই পড়া এই দুটি জিনিসের সঙ্গে উত্তর-পূর্বের লেখক, পাঠকদের মূলত যে-ব্যক্তিটি পরিচয় করিয়ে দেয় সেই সুশান্ত করও পাবলিক স্কুলেরই ছাত্র। আমার দু-বছরের জুনিয়র। আমাদের একজন সহপাঠী ছিল হিতেশ দাস। তার অকালপ্রয়াণ ঘটেছিল ব্লাড ক্যান্সারে। সেই প্রথম ক্যান্সারের সঙ্গে পরিচয়। আর এই উপত্যকার সর্বজনপরিচিত গল্পকার হিমাশিস ভট্টাচার্যও আমার সহপাঠী।
আমার মা-র মৃত্যুর আঘাত ছেড়ে কথা বলেনি। মা আমাকে ভর্তি করিয়েছিল কনভেন্ট স্কুলে। প্রাইমারি স্কুলে ইংরেজি পড়ানো হত না। হাইস্কুলে এসে দেখা গেল আমি ইংরেজি বেমালুম ভুলে গেছি। মানে, আমাকে রীতিমতো আবার এ বি সি ডি থেকে সবকিছু শুরু করতে হল। সেই যে বলে না, কোনও কোনও রোগে একটা না একটা অঙ্গ নিয়ে চলে যায়? আমার মা-র মৃত্যু আমার স্মৃতিভাণ্ডার নামক অঙ্গটিকে হয়ত খানিকটা দুর্বল করে দিয়েছিল। আমরা স্কুলে যেতাম পায়ে হেঁটে। হাওয়াই চপ্পল পরে। কাঁধে কোনও ব্যাগ থাকত না। বইপত্র ঝিক করে বাঁ-হাতে নিয়ে ডান-হাতে ছাতা ধরে হাঁটতাম।
২৫.দারুহরিদ্রা:- বারোমাসই কি বৃষ্টি পড়ত?
অমিতাভ:- ধ্যাৎ মেয়ে, বারোমাস বৃষ্টি কেন পড়বে? রোদ থেকেও তো মাথা বাঁচাতে হত! তবে শীতকালে ছাতা লাগত না, এটা নিশ্চিত। শীতকালে অবশ্য বইয়ের বোঝাও থাকত না ।
২৬.দারুহরিদ্রা:- কেন?
অমিতাভ:- আমাদের বার্ষিক পরীক্ষা হয়ে যেত ডিসেম্বরেই। শীতকালটা ছিল আমাদের দারুণ মজার সময়। জাটিঙ্গার ঝুড়ি ঝুড়ি কমলা, রেডিয়োতে পাঁচদিনের ক্রিকেট ম্যাচের ধারাবিবরণী আর প্রতিবছর অনুষ্ঠিত হওয়া স্কুল টুর্নামেন্ট। ওদিকে গান্ধীমেলা। এখানে ওখানে হিন্দি সিনেমার চোরা ডাক। সিনেমার উত্তেজক পোস্টার। সব মিলিয়ে শীতকাল ছিল জমজমাট। অবশ্য বাড়িতে জমজমাট গরমকালও পেয়েছি।।আমাদের ছিল আম গাছ, জাম গাছ, কাঁঠাল গাছ। বাড়ির পেছনে। পাকা কালো জাম গাছ থেকে পড়ে গাছতলাটা বেগুনি রঙের করে দিত। কুড়িয়ে খেতে খেতে জামা মুখ সবকিছুর রং পাল্টে যেত। পাকা কাঁঠালের গন্ধ ছিল মাতাল করা। আম-দুধ বা কাঁঠাল-দুধ ছিল গরমকালের নিত্যদিনের ডিজার্ট। আরেকটা আকর্ষণ ছিল গরমকালের। গ্রীষ্মের সময়ই আসতেন আমার ছোটোকাকা অমিয় দেব। যতদিন দাদু ও ঠাম্মা জীবিত ছিলেন, তিনি নিয়ম করে প্রতিবছর শিলচর এসেছেন। থাকতেন দিনদশেক। সঙ্গে নিয়ে আসতেন বই। দাদুর জন্য। আমাদের জন্য। আর দাদুর বই মানে তো আমারও বই। দাদু ঠাম্মাকে আমারই তো পড়ে শোনাতে হত। এভাবেই পড়া হয়ে গিয়েছিল কৃত্তিবাসী রামায়ণ আর কাশীদাসী মহাভারত। রামায়ণের প্রায় সবটাই বুঝতাম কিন্তু রাবণ রাজা প্রায়ই ‘বলে ধরে লয়ে তারে করিল শৃঙ্গার’ — এর মানে কিছুতেই বুঝতাম না। কেউ বোঝাতেনও না। এভাবেই পড়া হয়েছিল বসুমতীর সচিত্র বঙ্কিম রচনাবলী, আদ্যন্ত নিউজপ্রিন্টে ছাপা; ত্রৈলোক্য রচনাসম্ভার যার মধ্যে ‘কঙ্কাবতী‘ ছিল না, কিন্তু ‘লুল্লু‘ থেকে ‘ডমরুচরিত‘ সবকিছুই ছিল, ছিল সেই আশ্চর্য মন্ত্রটিও যা আমার এখনও মনে আছে: ‘জিলেট জিলেকি সিলেমেল কিলেকিট কিলেকিশ’।
‘ও পি–ও পিপি–ও প্রফুল্ল–ও পোড়ারমুখী’ ‘দেবী চৌধুরাণী’র এই শুরুটা বিস্ময়কর লাগত। কাকা যে সব বই আনতেন সেগুলোর একটা লিস্ট দিই: উপেন্দ্রকিশোরের ছোটোদের জন্য লেখা রামায়ণ ও মহাভারত,’ টুনটুনির বই’, সুকুমার রায়ের ‘আবোলতাবোল’, ‘খাইখাই’, ‘পাগলাদাশু’, ‘হযবরল’; দক্ষিণারঞ্জনের ‘ঠাকুরমার ঝুলি’, ‘ঠাকুরদাদার ঝুলি’; অবনীন্দ্রনাথের ‘ক্ষীরের পুতুল’, ‘নালক’, ‘শকুন্তলা’, ‘বুড়ো আংলা’, বুদ্ধদেব বসুর ‘ছোটোদের শ্রেষ্ঠ গল্প’, ‘হ্যামেলিনের বাঁশিওলা’, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘চাঁদের পাহাড়’ (এখনও মনে আছে ডিয়েগো আলভারেজের সেই প্রশ্ন : ‘ইয়্যাং ম্যান, তোমার বয়স কত হবে?’), ‘মরণের ডঙ্কা বাজে’, ‘হীরামাণিক জ্বলে’, ‘তালনবমী’, ‘মিশমিদের কবচ’; শিবরাম চক্রবর্তীর ‘বাড়ি থেকে পালিয়ে’, ‘হর্ষবর্ধন আর গোবর্ধন’, চার্লস ও মেরী ল্যাম্ব-এর ‘টেলস ফ্রম শেকসপীয়র’। মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘হরবোলা’। এইসব। সত্যজিতের বই পেতাম পুরস্কার হিসেবে। ‘প্রফেসার শংকুর কাণ্ডকারখানা’ আর ফেলুদা। আমাদের বিমল স্যার ছিলেন স্কুল লাইব্রেরিয়ান।
ইরানের ফিল্ম ডিরেক্টর মজিদ মজিদির ‘চিলড্রেন অব হেভেন’ ছবির একটি দৃশ্য
তিনি পড়িয়েছিলেন ‘ফ্যান্টাস্টিক’ পত্রিকা, দেব সাহিত্য কুটীরের অনুবাদ গ্রন্থমালা সিরিজের নানা বই। গৌহাটি থেকে মামা প্রতিবছর আনন্দমেলার শারদীয়া সংখ্যা পাঠাতেন। তাতে অবধারিত ভাবে শংকু কাহিনী থাকত। প্রতিবেশী চক্রবর্তী কাকার ঘরে শারদীয়া দেশ আসত। তাতে ছাপা হত ফেলু কাহিনী। এছাড়া স্বপনকুমার তো ছিলেনই। বিশ্বচক্র সিরিজ। কালনাগিনী সিরিজ। এইসব। আর বড়দের বই তো ছিলই। তাতে শরৎচন্দ্র থেকে আশুতোষ, বিমল, শংকর, আরো কত কে! নবকল্লোল, উল্টোরথ এসব লুকিয়ে পড়ার মজাটাই ছিল আলাদা। বর্ষাটাও জমজমাট ছিল। আমাদের পাশের পাশের বাড়িতে প্রতিবছর শ্রাবণ সংক্রান্তিতে মনসা পূজা হত। বর্ষা এলেই ওদের বাড়িতে মনসামঙ্গল পাঠ শুরু হয়ে যেত। সে আসরে ছোটদের প্রবেশাধিকার অবারিত ছিল। শরৎকাল এলে তো ঝলমলে রোদ্দুর আর পেঁজা তুলো মেঘ। বাড়িতে পুজো। পুরোহিত জ্যাঠার আগমন সঙ্গে আগমন সাধুর। সাধু মানে আমাদের দা কামলা। সে যে কোত্থেকে আসত ভুলে গেছি। থাকত আমাদের এক ব্রাহ্মণ প্রতিবেশীর বাড়িতে। গলা ছিল অসম্ভব সুরেলা। ওর গলাতেই আমি একটি গান শুনি। যা আর কারও গলায় কখনও শুনিনি। গানটা হল গৌরাঙ্গের রূপ বর্ণনা। সুরটা অবিকল ‘আমি কোথায় পাবো তারে, আমার মনের মানুষ যে রে’র মতো
সদা যার শান্তমতি, ঊর্ধ্বরতি
বরণ কাঁচা সোনা
রসিক ভঙ্গিতে যায় চেনা
ও রসিক ভঙ্গিতে যায় চেনা
মন থাকে ঘুমের ঘোরে
নয়নে রূপ নেহারে
ভঙ্গিতে ধরা পড়ে
আত্মসুখ জানে না
ও মন সরল হইয়া,
স্বভাব লইয়া
সেই দেশে চলো না
ও তোমার কাম নদীতে চর পড়েছে
প্রেম নদীতে জল আঁটে না।
হ্যাঁ মনে পড়ল, এই শ্রাবণ মাসেই একটা কাণ্ড ঘটেছিল। আমি তখন ক্লাস নাইনে পড়ি। আমাদের ইংরেজির পাঠ্যতালিকায় ছিল জিবি হ্যারিসনের গদ্যানুবাদে শেকসপীয়রের ম্যাকবেথ। মনে আছে আমাদের বাড়ির সামনের বারান্দায় চেয়ারে বসে আমার জ্যাঠা আমাকে পাঠটা পড়ে বুঝিয়ে দিচ্ছেন। আমি ওঁর চেয়ারের পেছনে দাঁড়িয়ে আছি। সেই বিখ্যাত ড্যাগার সিন — ম্যাকবেথ তাঁর কল্পনায় দেখছেন একটি রক্তে রঞ্জিত ছুরি ও তার বাঁট। আমি শুনতে শুনতে হ্যালুসিনেট করলাম। বিশ্বাস করো, চোখের সামনে দেখতে পেলাম একটি ছুরি। তার থেকে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত ঝরে পড়েছে। আমি অজ্ঞান হয়ে দড়াম করে পড়ে গেলাম। কপালের ডানদিকটা ফুলে একটা মার্বেলের সাইজের হয়ে গেল। আসলে উদ্দাম স্বপনকুমার পড়তাম তো! কল্পনার সাম্রাজ্য ভরে ছিল ছুরিতে, রিভলভারে, খুনে, রক্তে। আর কিছুদিন আগেই গেছে মনসা পূজা। বলির বাজনা বাজাতে বাজাতে রক্ত দেখে মাথা ঘুরিয়ে পড়ে গিয়ে বুঝতে পেরেছি আমার আসলে হিমোফোবিয়া আছে। যাকে বলে রক্ত ভীতি। মানে, আমি বুঝিনি, অভিভাবকরা বুঝেছেন। কল্পনায় ওই ছুরির রক্তপাত দেখে অমনটা হয়েছিল। তারপর যেটা হল সেটা আরও বিচিত্র। জ্ঞান ফিরলে আমার উদ্বিগ্ন ও আলাভোলা বাবা (তাঁর তখন সেই আন্দোলনের জেরে কিছুদিনের জন্য চাকরি চলে গেছে) ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আমার কাছ থেকে জানতে চাইলেন আমি হস্তমৈথুন করি কিনা। ব্যস, ওই এক ধাক্কায় বড় হয়ে গেলাম।
বাবাও বোধহয় মা–হারা ছেলের মা হলেন সেই প্রথম।
পোলিশ ফিল্ম ডিরেক্টর রোমান পোলানস্কির ছবি ‘ম্যাকবেথ’
২৭.দারুহরিদ্রা:- তারপর?
অমিতাভ:- তারপর আর কি? ম্যাট্রিক পাশ করে চলে গেলাম বাবার কাছে। শিলং। ততদিনে তিনি পুনর্বহাল হয়েছেন। বাবা থাকতেন বড়বাজার পোস্ট-অফিস কোয়ার্টারে। জ্যাঠা আর আমি সেখানে গিয়ে উঠলাম। ভর্তি হয়ে গেলাম সেন্ট এডমান্ডস কলেজে। প্রিন্সিপাল ছিলেন আইরিশম্যান। ব্রাদার শ্যাননের কথা আমি অন্যত্র লিখেছি। অসাধারণ ব্যক্তিত্ব। বাবা বড়বাজার থেকে বদলি হলেন লাইমোখরা পোস্ট-অফিসে। গত শতকের আশির দশক শুরু হবে হবে তখন। উত্তর-পূর্বের সর্বত্র অশান্তি। সবারই জাতিসত্তা উগ্র হয়ে উঠেছে। আর সে উগ্রতার বন্দুক বাঙালির দিকে তাক করা। কী কুক্ষণে যে পার্টিশান হয়েছিল! এই লং-পার্টিশানের দায় বাঙালিকে নতুন করে আবার বহন করতে হল। আমাকে সরাসরি শুনতে হল ‘ড্খার’। ‘হোয়াই ডোঞ্চ ইউ গো টু বাংলাদেশ?‘ আমাদের পোস্টাপিসের সামনে একরাতে প্রবল হইচই বাঁধল। জনতা মশাল হাতে অস্ত্রশস্ত্র হাতে হিংস্র মিটিং করল মধ্যরাত্রি থেকে শেষরাত অবধি। বাবা জ্যাঠা আর আমি না খেয়ে না ঘুমিয়ে সারারাত ত্রাসে কাঁপলাম। হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষা দেবার আগেই জ্যাঠা ঠিক করলেন আমাকে পরবর্তী পড়াশোনার জন্য শিলং ছেড়ে বেরিয়ে পড়তে হবে। বাঙালির স্বপ্নের রাজধানী কলকাতায়। হায়ার সেকেন্ডারি মানে প্রি-ইউনিভার্সিটি পরীক্ষা দিলাম রক্ত আমাশা নিয়ে। সিক রুম থেকে। প্রতিটি পরীক্ষার দিন ব্রাদার শ্যানন এসে আমাকে দেখে যেতেন। আমার পিঠে আদরের চাপড় দিয়ে, ‘জলি বয়’ বলে, হেসে, আমাকে উৎসাহ জোগাতেন। দু-বছরের শিলং বাস শেষে পাড়ি দিলাম কলকাতায়।

আমি কিন্তু শিলঙের পাহাড়িয়াদের পক্ষে। খাসিয়া, জয়ন্তীয়া, গারো এদের বাঙালিভীতি পুরোপুরি অমূলক তা বলতে পারি না। সত্যজিৎ রায়ের ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা‘ সিনেমাটি মনে পড়ে? আমার অসম্ভব প্রিয় সিনেমা। এই সেদিনও দশ বা এগারো নম্বর বারের মত দেখলাম। এখনও সমান ভালো লাগল। মনে পড়ে এই সিনেমাটি প্রথম শিলচর দূরদর্শনে লেট নাইট মুভিতে দেখে দেবাশিস তরফদারদা আর আমি দুজনেই প্রাণের টানে ছুটে গিয়েছিলাম বিমল স্যারের বাড়িতে। তাঁকে ধন্যবাদ জানাতে। কারণ বিমল স্যারই প্রথম আমাদের কাছে এই ছবিটির উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছিলেন। ভাবো! কোন যুগের শিলচর শহরে বসে একজন স্কুলের মাস্টারমশাই এই ছবিটি দেখছেন ঠিকঠাক এপ্রিশিয়েটও করেছেন। অন্যদেরও ছবিটির কথা বলতে ভুলছেন না। এঁরাই ছিলেন প্রকৃত প্রস্তাবে গুণী মানুষ। আমরা নির্গুণ। অত কিছু পেয়েও মানুষ হয়ে উঠতে পারিনি। সে যাই হোক, ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা‘র শেষে সত্যজিৎ কিন্তু ‘বহিরাগত’দের হারিয়ে দিলেন। জিতিয়ে দিলেন স্থানীয় এক পাহাড়ি বালককেই। তার গানকে। কাঞ্চনজঙ্ঘাকে। আমার কাছে ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা‘ সত্যজিতের শ্রেষ্ঠ ছবি। ‘পথের পাঁচালী‘, ‘চারুলতা‘রও উপরে। আসলে আদত শিলঙি তো! তাই বোধহয় সিনেমায়ও পাহাড়ই টানে।
‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’-র শেষদিকের দৃশ্য