২৮.দারুহরিদ্রা:- আপনি আপনার জীবনের হেমন্তে এসে আপনার জীবনের গ্রীষ্ম-বর্ষা-বসন্তের দিকে তাকালে কেমন অনুভূতি হয়? আর রেস্তোরাঁয় আমাদের এই আড্ডা বেশ কিছু সপ্তাহ, বেশ কিছু পর্ব পেরিয়ে এসেছে। তার সাথে সাথে পাঠকদের উদগ্রীব সাড়াও আমরা পাচ্ছি। পাঠকদের সঙ্গে এবার আমরা আরও উদগ্রীব…
অমিতাভ:- এরপর তো আমি কলকাতায় চলে যাই। পড়তে। দু-বছর ছিলাম আমার কাকা অমিয় দেবের বাড়িতে। কাকার বাড়িতে আমি মূলত তিনটে জিনিস শিখি। ১. রুচিবোধ। রুচিবোধ বলতে আমি সবকিছুই বোঝাচ্ছি। পোশাকের রং থেকে শুরু করে, কোন খাবারের সঙ্গে কোন খাবার চলে তা, এমনকি ঘর সাজানো — সব, সবকিছু। ২. মূল্যবোধ। শেষপর্যন্ত একটা লোকের কাছে তার ব্যক্তিগত জীবন যে সবচেয়ে পবিত্র, এমনকি সে জীবনের সবরকমের উৎকেন্দ্রিকতা, দোনামনা, আনন্দ, হতাশা, বিশ্বাস, নান্দনিক আভিজাত্য, সবকিছু নিয়েই — এই শিক্ষাও আমার হয় কাকার বাড়িতেই। ৩. জীববৈচিত্র্যের মতো যে শিল্পবৈচিত্র্যও সমান আকর্ষক এবং এই বৈচিত্র্যকে গ্রহণ করতে গেলে যে শুধুমাত্র একটা খোলা মনের প্রয়োজন — এটাও আমি শিখি সেখানে। ফলে যেটা হয়, আমি অ্যাভারেজ বাঙালির মতো ‘বনাম’-এর চেয়ে অনেক বেশি বিশ্বাসী ‘এবং’-এ। আমার কাছে কখনই সত্যজিৎ ‘বনাম’ ঋত্বিক নয়, সত্যজিৎ ‘এবং’ ঋত্বিক। কিংবা এই উত্তর-পূর্বের ক্ষেত্রে দেবাশিস ‘বনাম’ দেবীপ্রসাদ নয়, দেবাশিস ‘এবং’ দেবীপ্রসাদ। তাঁদের শিল্পকর্মে নিহিত সব পার্থক্যকে মেনে নিয়েও।
আমাদের মাস্টারমশাই এবং অধ্যাপিকাদের মধ্যে যাদের স্মৃতি আজও অম্লান, তাঁদের নাম এক নিঃশ্বাসে বলছি। দেবব্রত মুখোপাধ্যায়, মালিনী ভট্টাচার্য, যশোধরা বাগচী, কিটি দত্ত, রণজয় কার্লেকার, রমাপ্রসাদ দে, অশোক ঘোষ। এঁদের মধ্যে দেবব্রত মানে ডিএম স্যার আমাদের পড়াতেন রেস্টোরেশন পিরিয়ডের সাহিত্য। মারাত্মক উইটি আমাদের এই স্যার রেস্টোরেশন রেপার্টিও দারুণ কব্জা করেছিলেন। একদিনের একটা গল্প বলি। স্যার পড়াতে পড়াতে কী একটা মজার কথা বলেছেন, আমরা সবাই হেসে উঠেছি। আমাদের মধ্যে ইন্দ্রনীল ছিল দেখতে যেমন লম্বা, সব ব্যাপারেই তেমনি প্রলম্বনপ্রবণ। আমরা হেসেছি, হাসি থামিয়ে দিয়েছি। ইন্দ্রনীলের হাসি আর থামতে চাইছে না। ডিএম স্যার খানিকক্ষণ দেখে মন্তব্য করলেন, ‘ইট সিমস দ্যাট ইন্দ্রনীল ইজ ওয়ার্স (worse) দ্যান মোনালিসা।’ মানে মোনালিসা তো সারাক্ষণ হাসছেন-ই। ইন্দ্রনীলের অবস্থা তার চেয়েও খারাপ। স্যারের এই কথায় সারা ক্লাসে হাসির মহোৎসব শুরু হল। মালিনীদি পড়াতেন ওয়ার্ডসওয়ার্থ। অসম্ভব ভালো পড়াতেন। সরাসারি আমাদের দিকে না–তাকিয়ে ঘাড়টা একটু তুলে ওপরের দিকে তাকিয়ে একটানা বলে যেতেন। আমরা বলতাম, মালিনীদি ওয়ার্ডসওয়ার্থের সঙ্গে কথা বলছেন। এই মালিনীদি পরবর্তী জীবনে যাদবপুর কনস্টিট্যুয়েন্সি থেকে সিপিএম প্রার্থী হয়ে খোদ মমতা বানার্জীকেই হারিয়ে দিয়েছিলেন। যশোধরাদির স্বামী অমিয় কুমার বাগচী নামকরা অর্থনীতিবিদ। প্রসঙ্গত, অমিয় বাগচী একবার শিলচর এসেছিলেন। তখন আমার স্ত্রীর কাকু, অমিয় কুমার বাগচীদের সহপাঠী জ্ঞানব্রত ভট্টাচার্য আমার বাড়িতে বেড়াতে এসেছেন। অমিয় বাগচী সেই সুবাদে একবেলা আমাদের বাড়িতে এসে থেকে গিয়েছিলেন। যশোধরাদি এমনিতে ভীষণ রাশভারী ছিলেন। কিন্তু ভেতর ভেতর ছিলেন স্নেহপ্রবণ। আমার স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষের টিউটোরিয়াল পড়েছিল তাঁর কাছে। একদিন তাঁর ঘরে গিয়ে বসেছি আমরা তিনজন, আমার দুই সহপাঠিনী ও আমি। যশোধরাদি আমাকে একটু দেখলেন। নিজের ঘড়ি দেখলেন। তখন বিকেল। হঠাৎ বলে উঠলেন, ‘তোমাকে ভীষণ শুকনো দেখাচ্ছে অমিতাভ। যাও কিছু একটা খেয়ে এসো।’ যশোধরাদিও একবার শিলচর এসছিলেন। আমি তখন শিলচরে নেই, তিনি নাকি আমার খোঁজ করেছিলেন। জেনে যুগপৎ পুলকিত ও গর্বিত হয়েছিলাম।
তখন সদ্য সদ্য যাদবপুরে ভর্তি হয়েছি। একদিন সহপাঠী তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগের নীলরতন দাস এসে বলল, ‘অ্যাই অমিতাভ দেখবি আয়, একটা ঘরে গিয়েই “রমা, প্রসাদ দে” বললে প্রসাদ দিয়ে দিচ্ছে। গিয়ে দেখি, নীলরতন আমাদের স্যার রমাপ্রসাদ দের কথা বলছে। অসম্ভব ভালো ইংরেজি বলতেন। একেবারে বাগাড়ম্বর না করে স্পষ্ট উচ্চারণে সরল ও সুন্দর ইংরেজি। অশোক ঘোষ স্যার পড়াতেন ফিলোলজি, ব্রিটিশ অ্যাকসেন্টে ইংরেজি বলতেন। শুনেছিলাম, তিনি ল্যাটিনও জানতেন। কিটি দত্ত ছিলেন স্বনামধন্য অম্লান দত্তের স্কটিশ স্ত্রী। পড়াতেন মার্লোর ফাউস্টাস। এই টেক্সটির কিটি দত্ত সম্পাদিত একটি সংস্করণ ছিল। অসাধারণ তার ইন্ট্রোডাকশন। আমাদের এলিজাবেথান পিরিয়ডের গান শোনানোর জন্য নিজের বাড়ি থেকে সেই আদ্যিকালের পুরোনো বিদেশি রেকর্ড প্লেয়ার ও রেকর্ড ক্লাসে নিয়ে এসেছিলেন। ট্যাক্সি ভাড়া করে। এসব কখনও ভোলা যায় না।
আমি কখনও তেমন মেধাবীটেধাবী ছিলাম না (মেধাবিনী আসলে আমার ইমিডিয়েট ছোটো বোন, ও হায়ার সেকেন্ডারিতে আসাম থেকে সিক্সথ হয়েছিল), তবু কিভাবে এবং কেন জানি না এম এ তে আমার ভাইভা ভোচি পরীক্ষা বেশ ভালো হয়ে যায়। সতীদি, যাকে আমি জাতিস্মরের ইংরেজি জিজ্ঞেস করে একদিন একটু বিরক্তিভাজন হয়েছিলাম, তিনি ভাইভা পরীক্ষার শেষে বিভাগীয় প্রধানের ঘরেই আমাকে বললেন, ‘অল ইন্ডিয়া রেডিও দিল্লি থেকে ফ্রেশ ছেলেমেয়েদের চাইছে অমিতাভ। আমি লিখে দিই? তোমার চাকরি হয়ে যাবে।’ আমি কী যে বদখেয়ালে সেদিন হাতের লক্ষ্মীকে সরিয়ে দিয়েছিলাম জানি না; তবে এখন বুঝি দিল্লি চলে গেলে তো পরবর্তী জীবনে যে আমার স্ত্রী হবে, তার সঙ্গে আমার দেখা হত না। একেই কি তবে বলে বিধির নির্বন্ধ? এই যে এখন কাজে অকাজে মাঝেমধ্যে দিল্লি যাই, কলকাতা যাই, বুঝি আমার ভেতরে মহানগরের আকর্ষণ আজও প্রবল। ছোট শহরের নামী মানুষ হওয়ার চেয়ে, মহানগরের অজ্ঞাতপরিচয় লোক হয়ে বেঁচে থাকতে আমার বেশি ভালো লাগে। রেস্তোরাঁ জীবন, সূর্যাস্তের পানশালা (এই নামে আমার একটা গল্পও আছে) এগুলো এখনও আমাকে ভীষণ টানে। এলিয়টের কবিতা-ভূগোল থেকে এ জীবনে আমার সম্ভবত আর কোনদিন মুক্তি হবে না।
রণজয় কার্লেকার ছিলেন ভীষণ ছাত্রবৎসল। আমার স্নাতক প্রথম বর্ষের টিউটোরিয়াল তাঁর সঙ্গে পড়েছিল। রণজয়দার দাদা ভারতবিখ্যাত সাংবাদিক — হিরণ্ময় কার্লেকার। এ কথা অনেক পরে জেনেছি। হিরণ্ময় কার্লেকারের স্ত্রী সমাজতাত্ত্বিক, অধ্যাপক-লেখিকা মালবিকা কার্লেকার। আমাদের কামিনীকুমার চন্দের পৌত্রী। রণজয় অকালপ্রয়াত হন। আমরা তখন সম্ভবত স্নাতক দ্বিতীয়বর্ষে পড়ি। হঠাৎ একদিন শুনলাম, রণজয়দা মারা গেছেন। আমরা কয়েকজন একছুট্টে তাঁর বাড়ি গেলাম। বাড়ি ছিল ট্রায়েঙ্গুলার পার্কের পেছনে। আমরা বিক্ষিপ্ত মন নিয়ে পার্কের ভেতরটায় বসে আছি। হঠাৎ দেখলাম একটা গাড়ি থেকে নেমে এলেন সে সময়ের কলকাতা শহরের দীর্ঘতম ব্যক্তিত্ব, বিশপ লেফ্রয় রোডের সেই সার্থকনামা চিত্রপরিচালক। নেমেই সটান ঢুকে গেলেন বাড়িতে। তিনি সম্ভবত ওই বাড়ির আত্মীয় ছিলেন। রণজয়দার মৃত্যুতে বেশ আঘাত পেয়েছিলাম মনে পড়ে। বন্ধুর মতো ব্যবহার ছিল তাঁর। যাই হোক সন্ধ্যের পর তাঁর মরদেহ নিয়ে শোকমিছিল বের হব–হব করছে। আমরা অনুগমন করব। রণজয় বামপন্থী ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের দাদারা ‘ভুলিনি, ভুলব না’ ইত্যাদি শ্লোগান দিয়ে কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল ধরলেন। গানটা ইতিমধ্যে শেখা হয়ে গিয়েছিল, গলা মেলালাম। কিন্তু কোথায় যেন কী একটা কেটে যাচ্ছে, জোড়া লাগছে না — এরকম মনে হচ্ছিল। একটু পরে বাড়ির মেয়েরা বেরিয়ে এলেন। তাঁরা একসঙ্গে গান ধরলেন ‘সমুখে শান্তিপারাবার — ভাসাও তরণী হে কর্ণধার।’ নিমেষে সবকিছু জোড়া লেগে গেল। মনে হল এতক্ষণে এই মৃত্যু তার প্রাপ্য সম্মান পাচ্ছে। চোখ ছাপিয়ে জল এসেছিল, ওই গান শুনতে শুনতে। সেন্স অব পারস্পেকটিভ কাকে বলে ওই ঘটনা আমাকে হাত ধরে বুঝিয়ে দিয়েছিল। এই মন্তব্যের জন্য আমি আমার বামপন্থী বন্ধুদের কাছে ক্ষমা চাই। কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল আমার নিজের অত্যন্ত প্রিয় এবং এর সুরটি একটি অত্যাশ্চর্য সুর। এই সুর নিয়ে টংলার অভিজিৎ চক্রবর্তীর সঙ্গে অন্তত এক সন্ধ্যে আমার দীর্ঘ আড্ডা হয়েছে। পুরো সুরটার মধ্যে একটা ঢেউয়ের চলন আমরা দু-জনেই খুঁজে পেয়েছি। যেন এক বিপুল মানবসমুদ্রের ঢেউ। বিশেষ করে উর্দুতে পাকিস্তানি কমিউনিস্টদের গাওয়া কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল আমাদের দু-জনকেই আলোড়িত করেছিল। কিন্ত যে দিনের কথা বলছিলাম সেই দিনে ওই গানটি বোধহয় ততটা সুপ্রযুক্ত হয়নি।
ইংরেজি বিভাগের ছাত্র হলেও, আমাদের দু-তিনজনের মন কিন্তু পড়ে থাকত তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগে। আমার খুব ঘনিষ্ঠ এক বন্ধু ওই বিভাগেরই ছাত্র ছিল। ওটাও সাহিত্যেরই বিভাগ, একই জিনিস পড়ানো হয়, কিন্তু অন্যভাবে। যেমন, ওদের বিভাগে রোমান্টিসিজম মানেই ওয়ার্ডসওয়ার্থ আর কীটস নয়। জার্মান, ফরাসিদের ছাড়া ওদের পড়ানো সম্পূর্ণ হয় না। সব পড়ানোই শেষমেশ দেশের মাটিতে চলে আসে। যে ছাত্রটি বাংলা জানে না, তাকেও অনুবাদে রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ পড়তে হয়। আমাদেরও বাংলা পড়তে হত। তবে তার পড়া তো আলাদা পড়া। পাস কোর্সের বাংলা। পড়াতেন শঙ্খ ঘোষ এবং পিনাকেশ সরকার। অর্থাৎ সবকিছুর পরে তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগের পা যেন সবসময় দেশের মাটিতে থাকত, আর আমাদের বিভাগের পা থাকত মাটির অল্প একটু ওপরে। আরও একটা কারণ ছিল অবশ্য ওই বিভাগের এতটা চুম্বকশক্তির। আমাদের দু-বছরের সিনিয়র তিনজন অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ওই বিভাগেই পড়ত। অভিজিৎদা, অরিন্দমদা, শিবাজীদা। এঁদের মধ্যে শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম প্রায় সবারই পরিচিত। শিবাজীদা অসামান্য পণ্ডিত, পণ্ডিত অভিজিৎদাও আর অরিন্দমদা তো বহুকাল হল বিদেশে। শিবাজীদা কিন্তু তার কবিত্ব ও পাণ্ডিত্যের সঙ্গে সঙ্গে অভিনয়েও সমান পটু। ঋতুপর্ণের ছবি যারা দেখেছেন তাঁরা অবশ্যই তাঁর অভিনয়ের কথা জানেন। অরিন্দমদা দারুণ কবিতা লিখত। প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত তাঁর ‘অলিন্দ’ পত্রিকায় চেয়ে নিয়ে অরিন্দমদার কবিতা ছাপিয়েছিলেন। একটি কবিতা আমার এখনও মনে পড়ে:
নারী, তুমি প্রসবব্যথার কথা
কবিকে বলো না কখনও।
সে প্রথম অন্তঃস্থিত রক্তবিন্দু দিয়ে,
কবিতায় তোমাকে এঁকেছে।
আর অভিজিৎদা ছিল দুর্দান্ত উইটি। পণ্ডিত এবং মজার মানুষ। আমার সঙ্গে সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল অভিজিৎদার-ই। পাঁচ-ছশো পৃষ্ঠার কোনও বই দুতিনদিনের মধ্যে পড়ে শেষ করে ফেলা অভিজিৎদার কাছে কোনও ব্যাপারই ছিল না। ক্লাসে যখন স্যার ম্যাডাম থাকতেন না, অভিজিৎদা তার পাকা হাতের লেখায় ব্ল্যাকবোর্ডে অদ্ভুত অদ্ভুত সব জিনিস লিখে রাখত। একদিন লিখেছিল কাফকা আর ম্যাক্স ব্রডের কল্পিত সংলাপ। আরেকদিন লিখেছিল জীবনানন্দ ও বুদ্ধদেব বসুর কল্পিত আলাপচারিতা। তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগে প্রতিবছর পয়লা এপ্রিল মাস্টারমশাইদের নিয়ে ‘এপ্রিল লিস্ট‘ বের হত। এক বছর অভিজিৎদা প্রণবেন্দু স্যারকে নিয়ে ছড়া লিখেছিল:
মেরি অ্যান, দড়ি আন
চামচিকে বাঁধবো।
কবিতার রেসিপিতে
মোগলাই রাঁধবো।
মেরি অ্যান ছিলেন প্রণবেন্দু স্যারের বিদেশিনী স্ত্রী।
আমাদের বিভাগেও উইলিয়াম ব্লেক পড়ানো হত। ওদের বিভাগেও। সম্ভবত মানব স্যারই পড়াতেন, কিন্তু সেই পড়ানো রবীন্দ্রনাথের ‘শিশু’ বাদ দিয়ে কখনও সম্পূর্ণ হত না। ব্লেক, কোলরিজ, কীটস আমার অসম্ভব প্রিয়। এঁদের মধ্যে ব্লেক আমি পুরোটা পড়েছি। কিন্তু ওদের বিভাগে ব্লেকের প্রসঙ্গে নাম চলে আসত আঁতোয়ান দি সাতেক্সুপেরির লিটল প্রিন্সের। সে নাম ক্লাসরুম থেকে দোতলার সিঁড়ি বেয়ে চলে আসত নীচের লবিতে আমাদের আড্ডায়। আর আমরা কেউ কেউ জোগাড় করে তৎক্ষণাৎ পড়েও ফেলতাম সে বই। এভাবেই পড়া হয়ে গিয়েছিল অনেককিছু। একটা উদাহরণ: এই যেমন সুব্রত চক্রবর্তীর ‘বালক জানে না’। বইটির কোনও কোনও কবিতা এখনও আমার পুরো মুখস্থ। শিলচর শহরে একমাত্র সৌমিত্র বৈশ্য ছাড়া আর কারও মুখে আমি কবি সুব্রত চক্রবর্তীর নাম কখনও শুনিনি। যেমন, নরেশ গুহর কবিতার আবৃত্তি শুনেছি একমাত্র আমাদের বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীভাষী কবি ব্রজেন্দ্রকুমার সিংহের মুখে। লিটল প্রিন্সের উৎসর্গপত্রটি অনুপম, ভুবনবিখ্যাত। তোমরাও এই ফাঁকে পড়ে নিতে পার।
আমাদের সময়ের কলকাতা মানে সারারাত জেগে লাইন দিয়ে শম্ভু মিত্রের ‘চার অধ্যায়’ দেখা, আমাদের সময়ের কলকাতা মানে আমার মতো এক গেঁয়ো ভূতের এককথায় প্রথম বছরের ‘সংস্কৃতি ৮০’তে কৃষ্ণা চট্টোপাধ্যায়ের গান শোনা। এখনও মনে পড়ে, কৃষ্ণা চট্টোপাধ্যায়কে নিমন্ত্রণ করতে গিয়েছিলাম নবারুণ আর আমি। কী যুগ ছিল সেটা ভেবে দেখো, আমাদের মতো দুই নেহাৎ ‘বালক’-এর একবারের অনুরোধে কৃষ্ণা এককথায় বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে গান গাইতে রাজি হয়েছিলেন। এসে অসামান্য গানও গেয়েছিলেন। সবাইকে জানিয়ে তোমাদের কানে কানে এই সুযোগে একটা কথা বলে নিই: কৃষ্ণা চট্টোপাধ্যায় অতুলপ্রসাদী না গাইলে, এই কোথাকার কোন অমিতাভ দেব চৌধুরী কখনও কবি হত না। ওই অতি দীর্ঘ মীড়ের কাজ আমি বাঙালির শ্রেষ্ঠ গান রবীন্দ্রসঙ্গীতেও খুব কমই খুঁজে পেয়েছি। শুনেছিলাম আবু সয়ীদ আইয়ুব নাকি একবার বলেছিলেন একমাত্র রবীন্দ্রসঙ্গীতই ‘পড়া’ যায়, অতুলপ্রসাদের গান ‘পড়া’র যোগ্য নয়। তাঁর প্রতি আভূমিপ্রণত হয়ে, অত্যন্ত কুণ্ঠার সঙ্গে বলি, গান তো শেষপর্যন্ত ‘পড়া’র জিনিস নয়!
আমাদের সময়ের কলকাতা মানে দলবেঁধে লন্ডনের কোনও এক থিয়েটারের দলের অভিনীত শেকসপীয়রের নাটক দেখা। হাবিব তানভিরের নাটক দেখা। রাত জেগে লাইন দিয়ে গোদারের রেট্রোস্পেক্টিভ দেখা। পরবর্তী জীবনে অবশ্য গোদার সাহেবকে আমি আর নিতে পারিনি। কিন্তু তাতে সম্ভবত সেই সময়ের উত্তেজনা মলিন হয়ে যায় না। আমাদের সময়ের কলকাতা মানে দলবেঁধে ‘হরেরামা হরেকৃষ্ণ’ সিনেমাও দেখতে যাওয়া। আবার আমাদের সময়ের কলকাতা মানে অনেক কষ্ট করে টিকিট জোগাড় করে পার্ক সার্কাস চত্বরে ডিজি গিলেসপির জ্যাজসঙ্গীত শোনা। আমাদের সময়ের কলকাতা মানে সারারাত লাইন দিয়ে, বৃষ্টিতে ভিজে একবেলার জন্য ওরিজিনাল অগুস্ত রোদ্যাঁ দেখা। সেই দেখার প্রস্তুতি হিসেবে খানিকটা বইপত্র নেড়েচেড়েও যাওয়া। তোমরা কি জান কবি রাইনের মারিয়া রিলকে রোদ্যাঁর ব্যক্তিগত সচিবের কাজ করেছিলেন অল্প কিছুদিনের জন্য? রোদ্যাঁর বয়স তখন ৬১ আর রিলকে ২৬ বছরের টাটকা যুবক। দু-জনের মধ্যে মনান্তর ও মনের অনুরাগে গড়ে উঠেছিল আশ্চর্য এক সম্পর্ক। রোদ্যাঁর হুকুমে রিলকে একদিন নাকি টানা ন-ঘণ্টা মিনাসাহ্বি দুজদ্য দি প্লত চিড়িয়াখানায় গিয়ে বসেছিলেন। সেই অন্তর্দশনের ফল জগতবিখ্যাত ‘প্যান্থার’ কবিতা। প্রসঙ্গত তিনটে প্রাণীকে নিয়ে তিনটে ভাষায় লেখা কবিতা আমার মাথায় পর পর চলে আসে। উইলিয়াম ব্লেকের ‘টাইগার’, রিলকের ‘প্যান্থার’, আর আমাদের কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্তর ‘উটপাখি’।
আমাদের সময়ে কলকাতা মানে শীত-বসন্তের সন্ধিক্ষণে বইমেলায় গিয়ে হারিয়ে যাওয়া। শীতের সারারাত, একমাত্র সঙ্গী সবেধন নীলমণি ভরা পাঁইট সমেত ডোভার লেন মিউজিক কনফারেন্সে গিয়ে বুঁদ হয়ে থাকা। আমাদের সময়ের কলকাতা মানে আইস স্কেটিং রিঙ্কের সংলগ্ন হলে সত্যজিতের রেট্রোস্পেকটিভ দেখা। আমাদের সময়ের কলকাতা মানে দেশি-বিদেশি অসংখ্য অসংখ্য অসংখ্য সিনেমা দেখা। এদের মধ্যে বেশিরভাগ সিনেমাই দেখা হয়ে যেত ক্যাম্পাসে। যাদবপুর ইউনিভার্সিটির ফিল্ম সোসাইটির ব্যবস্থাপনায়। কেন জানি না যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের খুব প্রিয় ছিল বার্গম্যান আর কুরোসাওয়ার ছবি। বারবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে এই দু-জনের সঙ্গে দেখা হয়ে যেত।