২৩.
যেন টি এন ভি উগ্রপন্থীদের মতো লংতরাই ও আঠারোমুড়া পাহাড় থেকে পায়ে হেঁটে, থ্রি নট থ্রি রাইফেল হাতে শীতকাল নেমে আসে ধলাই উপত্যকায়। হেমন্তের মনখারাপ, কুয়াশা, আসন্ন পরীক্ষার ভাল্লাগে না, শীতের সকালে উঠে তিনদিন রাজীব স্যারের বাড়ি, মাঝেমাঝে ঐচ্ছিক সংস্কৃতের জন্যে পণ্ডিত স্যারের বাড়ি; সব মিলিয়ে ক্লাস নাইনের এই শীতকাল কেমন যেন পারুল দিদিমণির সপ্তাহে তিনদিন লাস্ট পিরিয়ডের বাংলা ক্লাসের মতো রসকষহীন। উপত্যকায় এমনিতেও শীতের প্রকোপ বেশি। পড়ার ফাঁকে ফাঁকে গিয়ে আভাদিদের গোরুর খাবার তৈরির বাইরের উনুনে আগুন পোহাই। বিজয় কাজ ছেড়ে চলে গেছে। তার জায়গায় মহাবীর থেকে নিপু নামে এক ছোটোখাটো সাঁওতাল ছেলে এসেছে। সুন্দর দুটি চোখ। আমাকে দাদাবাবু ডাকে। একদিন একটি লোক প্যাডেল-চালানো দা ধারানোর একটি মেশিন নিয়ে দা ধারাতে এসেছে। কাঠের তৈরি সেই মেশিনে বসে দুই পা দিয়ে প্যাডেল চালিয়ে সামনের ঘুরন্ত পাথরের চাকতিতে দা, ছুরি শানায়। লোহা ও পাথরের ঘর্ষণে ছিটকে ছিটকে আগুনের ফুলকি বেরোচ্ছে। নিপু তো হাঁ। একবার আমার মুখের দিকে আরেকবার দা-ধারানির দিকে। নিপু আমাকে জিজ্ঞেস করল, ব্যাটাটা কই থাকি আইছে দাদাবাবু? বললাম, আগরতলা। নিপু চোখ বড়ো বড়ো করে বলল, আগরতলা থাকি ইটা চালাইয়া আইছে? নিপুর নিষ্পাপ মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম।
ফাইনাল পরীক্ষা শুরু হয়ে গেছে। পরীক্ষা নিয়ে একটা ভয় আমার কাজ করত বই-কি। একটি সাবজেক্টকেই একটু সমঝে চলতাম। লাইফ সায়েন্স। অভয়নগর স্কুলে ক্লাস সেভেনে হাফ ইয়ারলি পরীক্ষায় জীবন বিজ্ঞানে ফেল করেছিলাম। একশোতে সাতাশ। ভয়ে বাড়িতে খাতাও দেখাতে পারছি না। একদিন বাবার জেরার মুখে ভেঙে পড়লাম। বাবা খুব একটা বকেননি। বরং লাইফ সায়েন্সের প্রতি নজর দিলেন। অ্যানুয়েলে লাইফ সায়েন্সে ভালো রেজাল্টই হয়েছিল। মাঝেমধ্যেই পরীক্ষার স্বপ্ন দেখতাম। সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। তেমন কিছুই লিখে উঠতে পারছি না। আরেকটি দুঃস্বপ্ন ছিল অভয়নগর লাল স্কুলে প্রাইমারিতে পড়ার সময়। আমাদের স্যার শাহেনশাহ হারাধন চক্রবর্তীকে নিয়ে। আমাদের বাংলা পড়াতেন। বোধজং বয়েজ স্কুলে পড়ানোর সময় ছাত্রেরা হারাধানবাবুর শাহেনশাহ নামটি রেখেছিল। তখন অমিতাভ বচ্চন অভিনীত শাহেনশাহ ছবিটি রিলিজ করেছিল। ছাত্রছাত্রীদের ত্রাস ছিলেন হারাধন স্যার। কবিতা লিখতেন। যাত্রা ও নাটকে অভিনয়ও করতেন। ভালো বক্তাও ছিলেন। পরবর্তী সময়ে ফেডারেশনের শিক্ষক নেতা ছিলেন। একবার আগরতলা টাউনহলে একটি নাটকে রাজার চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন রিহার্সাল ছাড়াই। কোনো কারণে স্যার হয়তো রাজ্যের বাইরে ছিলেন। নাটকের স্ক্রিপ্ট ও পার্ট স্যারকে আগেই পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ক্ষমতা চলে যাওয়ার পর একদিন স্যারের সঙ্গে হঠাৎ দেখা। প্রণাম করলাম। জিজ্ঞেস করলেন, কী করি? বললাম, স্যার, মান্দাইবাজার এইচ এস স্কুলে শিক্ষকতা করি। শুনে বললেন, চিন্তা কোরো না। এরপর ক্ষমতায় এলে তোমাকে বদলি করে নিয়ে আসব মান্দাই থেকে। স্যারের স্বপ্ন যদিওবা সত্যি হয়নি আর। একদিন স্বপ্ন দেখেছিলাম, হারাধন স্যার আমাদের ক্লাস ফোরের সবাইকে লাইন করে দাঁড় করিয়ে একের পর এক ছাত্রদের গুলি করছেন। তখন হালাহালিতে আমরা দোয়াত থেকে কলমে সুলেখা কালি ঢেলে লিখতাম। পরীক্ষায় একটানা এতক্ষণ লিখে আমার আঙুল কলমের কালিতে চুপসে যেত। ছাত্রদের পরস্পরের ইউনিফর্মে কলমের কালি ছেটানোর একটা চল ছিল হালাহালিতে। মাঝেমাঝে শিক্ষকদের সাদা পাঞ্জাবিতেও। এর শিকার হতেন পণ্ডিত স্যার, অতীন্দ্র স্যার, চিত্র স্যার। যোগেন্দ্র স্যার ও বাবার পাঞ্জাবিতে অবশ্য কখনোই কালির ছিটা চোখে পড়েনি।
মধ্যডিসেম্বর থেকে মধ্যজানুয়ারি পর্যন্ত পৌষমাস। পরীক্ষার রেজাল্ট বেরিয়ে গেছে। অভিজিৎ ফার্স্ট। সেকেন্ড আমি। থার্ড প্রশান্ত ও মানবেন্দ্র। আমার কোনো হেলদোল নেই। অভিজিৎদের কুকুর বাঘার মুখও কেমন হাসি হাসি। হয়তো অভিজিৎ ফার্স্ট হওয়াতে বাঘাও খুশি। বাঘা যোগেন্দ্র স্যারের ক্লাসে এসে বসে থাকে। টিচার্স কমনরুমে বসে থাকে। মাঝেমাঝে টেনের ক্লাসে অভিজিৎকে খুঁজতে আসে। উঠতে বসতে মা আমাকে গালাগাল করছেন। থার্ড ডিভিশন পাইবি মেট্রিকে। এক কান দিয়ে শুনে আরেক কান দিয়ে বের করে দিই। টেনের ক্লাসও শুরু হয়ে গেছে। পয়লা পৌষ থেকে সংক্রান্তি হয়ে মাসপয়লা পর্যন্ত গকুল ও গোপালদের আনন্দের মাস। পৌষের প্রথম দিন থেকে সারা মাস জুড়ে মহাবীর চা-বাগানে ভোরে ও সন্ধ্যায় নগর কীর্তন। ষোলো নাম বত্রিশ অক্ষর। সর্বজনীন এই নগর কীর্তনে ওড়িয়া, সাঁওতাল, মুন্ডা, বর্ধমানি, গোয়ালা, তেলেঙ্গা সব মিলেমিশে একাকার। হারমোনিয়ম, ঢোল, কাঁসর, করতাল সহযোগে মহাবীর যেন নদীয়া। আগে থেকেই গণকের কাছে রাধাকৃষ্ণ ও পঞ্চতত্ত্বের মূর্তি গড়ার বায়না দেওয়া হয়েছে। গণক মানে আচার্য পদবির ব্রাহ্মণ। আচার্যেরা আগে দেবদেবীর মূর্তি গড়তেন। ভাগ্যগণনা, গ্রহপূজা ইত্যাদি করতেন বলেই তাদের গণক বলা হত। পঞ্চতত্ত্বের মাটির মূর্তি বলতে গৌর, নিতাই, গদাধর, শ্রীবাস, অদ্বৈত আচার্যের মূর্তি। কৃষ্ণদাস কবিরাজের চৈতন্য চরিতামৃত গ্রন্থের আদিপর্বে পঞ্চতত্ত্বের বর্ণনা রয়েছে। বঙ্গদেশে এই পাঁচজন বৈষ্ণবীয় ভাবধারার প্রাতঃস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব। পঞ্চতত্ত্ব বলতে গৌর বা চৈতন্য মহাপ্রভুর ভক্ততত্ত্ব। নবদ্বীপে মহাপ্রভুর ভক্তলীলা। রাধাপ্রেমের মাধুর্য। নিতাই বা নিত্যানন্দ প্রভুর আনন্দতত্ত্ব। গদাধরের শক্তিতত্ত্ব। শ্রীবাসের সাধারণ ভক্ততত্ত্ব। অদ্বৈতের ভক্তের স্বরূপতত্ত্ব। নিত্যানন্দের আসল নাম ছিল কুবের ওঝা। রাঢ়ী ব্রাহ্মণ। অদ্বৈত মহাপ্রভুর আসল নাম কমলাক্ষ ভট্টাচার্য। অদ্বৈত ছিলেন চৈতন্যদেবের মা শচী দেবীর গুরু। তাঁর পূর্বপুরুষ নরসিংহ নড়িয়াল ছিলেন বৃহত্তর সিলেটের লাউড়ের মুসলমান রাজার আলাউদ্দিন ফিরোজ শাহের মন্ত্রী যিনি সেই রাজাকে সরিয়ে হিন্দু রাজা গণেশকে সিংহাসনে বসান। গণেশের রাজত্বে উজির ছিলেন নরসিংহ। গণেশের পরামর্শদাতাও। বলা হয়, চৈতন্য মহাপ্রভুকে অবতার রূপে প্রতিষ্ঠা করেন অদ্বৈত। অদ্বৈতের আহ্বানেই গৌরাঙ্গ মহাপ্রভু অবতীর্ণ হন। এইজন্যেই এই পাঁচ বিগ্রহকে পঞ্চতত্ত্ব বলা হয়। সারামাস জুড়ে দু-বেলা কীর্তনের পর সংক্রান্তির সন্ধ্যায় বাগানের সবাই গিয়ে মূর্তি নিয়ে আসে গণকের বাড়ি থেকে। ব্রাহ্মণ নয়, সেই মূর্তিগুলো গ্রামপূজার থানে প্রতিষ্ঠা করেন বৈষ্ণব। ওইদিন সবারই নিরামিষ খাওয়াদাওয়া। সারা রাত জাগরণ। রাতে সবাই গুড়, চিঁড়া, মুড়ি খেয়ে লবণ মেশানো লাল চা খায়। সেই একই রাতে বাগানের মহিলাদেরও টুসু পরব। টুসু মূর্তিও গড়তে দেওয়া হয়। লক্ষ্মীঠাকুরের মতো সেই টুসু মূর্তি। পুসুঙ্গা গাছের ফুল দিয়ে কোজাগরী টুসুপূজা হয়। সেই পূজা কোনো পুরুষ নয়, মহিলাই পূজারিণী থাকেন। টুসুপূজায় পুরুষের থাকার চল নেই। সংক্রান্তির শীতের রাতে আগুন জ্বালিয়ে মেয়েরা ঘিরে বসে আগুন পোহায়। সারারাত টুসুগানের তরজা। ভোর চারটেয় টুসুকে নিয়ে আসা হয় গৌরনিতাইয়ের বিগ্রহের কাছে। গৌরনিতাইয়ের সঙ্গে টুসুর মালাবদল হয়। বৈষ্ণব গৌরনিতাইয়ের মালা পরিয়ে দেন টুসুর গলায় আর পূজারিণী টুসুর মালা পরিয়ে দেন গৌরনিতাইয়ের গলায়। ভোর-ভোরই কীর্তন গাইতে গাইতে ধলাই নদীতে টুসুকে বিসর্জন দেওয়া হয়। এরপর কিছু পূজার রীতি রেওয়াজ। ছেলেরা কেউ কাউকে ধর্মভাই বলে সম্পর্ক পাতায়। মেয়ের পাতায় সই। পরস্পরকে ধর্মভাই বলে মেনে নেওয়া ছেলেরা, সই পাতানো মেয়েরা নদীতে নেমে মালাবদল করে। তবে মালাবদলের সময় তাদের নাভি যেন জলের নীচে থাকে। শীতের নদীতে যেহেতু জল কম, নাভি জলের নীচে রাখার জন্যে বসে বসেই মালাবদল হয়। নদীতে স্নানশেষে ফিরে গিয়ে সবাই রাধাকৃষ্ণ ও পঞ্চতত্ত্বের বিগ্রহকে প্রণাম করে। যারা এই বিগ্রহ বাড়ি নিয়ে যাওয়ার জন্যে রাজি হয়, তাদের বাড়িতে বিগ্রহ পৌঁছে দেওয়া হয়। ঘরে ফিরে ধোয়া পোশাক পরে মাটি দিয়ে তৈরি প্রত্যেক সম্প্রদায়ের ইষ্টকে ঘরের ভেতর গোপনে প্রতিষ্ঠা করা হয়। মাসপয়লার একসপ্তাহ আগে থেকেই রোজ প্রতিটি বাড়িতে গোবর দিয়ে উঠোন লেপে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা হয়। উঠোনে রাধাকৃষ্ণের ছবি সাজিয়ে রুটি উৎসর্গ করা হয়। সারাদিন বাড়িতে বাড়িতে শুধু তৈরি হয় রুটি। দুপুরে কীর্তনের দল ষোলো নাম বত্রিশ অক্ষর তারকব্রহ্ম নাম গাইতে গাইতে বাড়ি বাড়ি যায়। প্রতিটি বাড়িতেই ফল, তিল্লাই, বাতাসা, কদমা সাজিয়ে দেওয়া হয় উঠোনে রাখা রাধাকৃষ্ণের ছবির সামনে। কীর্তন গাইতে গাইতে সেই প্রসাদ থেকে কিছুটা তুলে নিয়ে হরির লুট ছুড়ে দেয় ভক্তদের কেউ। সেই লুটের প্রসাদ ধরতে গিয়ে রীতিমতো হুটোপাটি। কীর্তনশেষে গ্রামপূজার থানে সেই সংগৃহীত প্রসাদ ভাগ করে দেওয়া হয় সবাইকে।
হালাহালি থেকে কমলপুরগামী রাস্তায় স্বপনপুরী সিনেমাহল পেরিয়ে একটু গিয়েই বাঁদিকে পশ্চিমে একটি ঘাসে ঢাকা মাটির রাস্তা চলে গেছে বন্দের বাড়ির দিকে। সিলেটিতে ধানজমির শুকনো প্রান্তরকে বন্দ বলে। শিলচর থেকে কুম্ভীরগ্রাম যাওয়ার পথে যেমন উধারবন্দ। ময়নারবন্দ। লেবুরবন্দ। হাইলাকান্দি যাওয়ার পথে ধোয়ারবন্দ। বন্দের বাড়ির রাস্তায় নেমে গেলেই পশ্চিমে আঠারোমুড়া পাহাড় দেখা যায়। বন্দের বাড়ি যাওয়ার আগে একটি ছড়ার উপর সাঁকো। বন্দের বাড়িতে দেবনাথ সম্প্রদায়ের লোকজনই বেশি। কয়েকঘর দাস। বন্দের বাড়ির পেছনে কাইমাছড়া। কাইমাছড়ার পেছনে আঠারোমুড়া পাহাড়। কাইমাছড়া নামটি এসেছে কাইমাই থেকে। ময়ূরভঞ্জের মুন্ডাদের অনেক পরিবার এখানে বাস করে। মুন্ডা শব্দ কাইমাই মানে ঠাট্টা করা। এদিকে খোয়াই মহকুমার চেবরির দিকে ফাঁড়িপথ চলে গেছে। উত্তরে কৃষ্ণনগর গ্রাম। কৃষ্ণনগরের ৭০ শতাংশই সূত্রধর সম্প্রদায়ের লোকজন। কিছু পাল ও কিছু দাস। বন্দের বাড়ির দক্ষিণে একের পর এক খোলা ধানজমি পেরিয়ে পশ্চিম হালাহালি হয়ে আমাদের স্কুলে যাওয়া যায়। আভাদিদের বাড়িতে কাজ করত মীরা নামের এক খেপি। মীরার দিদি বিয়ের পরদিন বরের সঙ্গে সকালে রওয়ানা হয়ে বন্দের বাড়ির রাস্তা ধরে পায়ে হেঁটে খোয়াই শ্বশুরবাড়িতে নাকি দুপুরের পর পৌঁছেছিল। গ্রামদেশে গরিবদের বিয়ে যেমন হয়।
ক্লাস টেনে পণ্ডিত স্যার ক্লাসটিচার। বাংলা ফার্স্ট পেপার পড়াতেন। সেকেন্ড পেপার, প্রবোধ স্যার। ইংরেজি, হিরণ্ময় স্যার। অঙ্ক, গোপ স্যার ও পরিতোষ স্যার। লাইফ সায়েন্স, রাজীব স্যার। ইতিহাস, যোগেন্দ্র স্যার ও অতীন্দ্র স্যার। ভূগোল, প্রবোধ স্যার ও চিত্র স্যার। পারুল দিদিমণি, সপ্তাহে বাংলা ব্যাকরণ তিনদিন। রতন দেবনাথ প্রথম চাকরিতে জয়েন করলেন আমাদের স্কুলে। সোনামুড়া বাড়ি। ধনী পরিবারের ছেলে। রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম এ করেছেন। দেখতে বেশ হ্যান্ডসাম। হাওয়াইন গিটার বাজান। ব্যাডমিন্টনে ন্যাশনাল প্লেয়ার। স্কুলে অনেক ছাত্রীদেরই রাধাভাব দেখা গেল। স্কুলে মেয়েদের উপস্থিতির হারও বেড়ে গেল। গিটার বাজানোর কারণে স্কুলের অনেক ছাত্রেরাই তখন স্যারের ফ্যান। সোনামুড়াতে রতন স্যারদের একটি সিনেমা হল আছে। কামিনী টকিজ। সোনামুড়ায় তাদের বাড়িটি ছিল মুসলমান কোনো ব্যক্তির। স্যারেদের পূর্ব পাকিস্তানের কুমিল্লার বাড়িটি সেই মুসলমান ভদ্রলোকের সঙ্গে এক্সচেঞ্জ করে চলে এসেছিলেন সপরিবারে। রতন স্যারের একটাই দুঃখ, কোলকাতার এক ধর্মীয় সম্প্রদায়ের সাধু মাঝেমাঝেই সোনামুড়া এসে রতন স্যারের দাদার বাড়ি থাকেন। স্যারের দাদা সাধুটির শিষ্য। সাধু এলেই সোনামুড়ার ভক্তমণ্ডলী ছুটে আসেন। কীর্তনাদি হয়। সেই সাধু এলেই নাকি স্যারের দাদার কাছ থেকে প্রচুর টাকাপয়সা নিয়ে যান। লোকজনের মুখে মৌলবি হায়াৎ আলির নখদর্পণের গল্প শুনে রতন স্যার একদিন গেলেন আলিসাহেবের কাছে। সব শুনে টুনে নখদর্পণের দিনক্ষণ নির্ধারিত হল পরের রবিবার চল্লিশ ফুটির মানিক দাদুর বাড়িতে। যথারীতি দুরাই শিববাড়ির শৈলেন স্যারের ছোটো ছেলেরও ডাক পড়ল। সুদর্শন হায়াৎ আলি প্রথমে আমাকে বসালেন। তখনো শৈলেন স্যারের ছেলে এসে পৌঁছোয়নি। সরিষার তেল নিয়ে মন্ত্র পড়ে আমার বাঁ-হাতের বুড়ো আঙুলের নখে সেই মন্ত্রপূত তেল মাখিয়ে দিলেন। বললেন, মনে মনে জ্বিনরে ডাকো আওয়ার লাগি। জ্বিনরে দাদু ডাকবায়। আমিও মনে মনে জ্বিনকে ডাকছিলাম। পাঁচ ছয় মিনিট পরপরই হায়াৎ আলি বলছিলেন, কিচ্ছু দেখা যায় নি রে বা? আধঘণ্টা কেটে গেল। জ্বিনের পাত্তাই নেই। ততক্ষণে শৈলেন স্যারের ছেলে চলে এসেছে। তুলা রাশির জাতকেরাই নাখি নখদর্পণের সবচেয়ে ভালো মিডিয়াম। আমার তো সিংহ রাশি। শৈলেন স্যারের ছেলেকে বসানোর মিনিট তিনেকের মধ্যেই জ্বিন তার নখে চলে এল। হায়াৎ আলির দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে বলল, আই গেছে। হায়াৎ আলি বললেন, জ্বিনরে কও, সোনামুড়ার মাস্টার রতন দেবনাথর বাড়িত কলিকাতা থেকি এক সাধু আয়। অগুরে আনতো কও। তিন-চার মিনিট পর শৈলেন স্যারের ছেলে বলল, আনছে। আলিসাহেব জিজ্ঞেস করল, কী লাখান দেখতে? শৈলেন স্যারের ছেলে বলল, ধুতি-পাঞ্জাবি পরা। ফর্সা। দাড়ি আছে গালো। মাথাত চুল আছে। রতন স্যারের মুখে বিশ্বাস ও আনন্দের হাসি ফুটে উঠল। হায়াৎ আলি শৈলেন স্যারের ছেলেকে বলল, দাদুরে কও সাধুরে ভালা করিয়া খেছিতো। মিনিট দুয়েক পর হায়াৎ আলি আবার জিজ্ঞেস করল, কিতা রে বা? শৈলেন স্যারের ছেলে বলল, খেছের। আলিসাহেব বললেন, দাদুরে কও সাধু অগুরে কইতো সোনামুড়াত যেমন আর না যায়। নখদর্পণের পর হায়াৎ আলি রতন স্যারকে আশ্বস্ত করে বলল, স্যার চিন্তা করিয়েন না। যে মাইর খাইছে, আর সোনামুড়া যাইতো নায়। এরপর সেই সাধু আর রতন স্যারদের সোনামুড়ার বাড়িতে গিয়েছিল কিনা জানা যায়নি।
দুরন্ত ।
প্রথম থেকে ….. ছাত্রদের গুলি করছেন পর্যন্ত অনবদ্য