Daruharidra
  • ধান্যগৃহ
  • কবিতা
  • গল্প
  • গদ্য
  • প্রবন্ধ
  • উপন্যাস
Daruharidra
  • ধান্যগৃহ
  • কবিতা
  • গল্প
  • গদ্য
  • প্রবন্ধ
  • উপন্যাস
Daruharidra
No Result
View All Result
Home উপন্যাস

মেখলা পরা মেয়ে || শ্রীযুধাজিৎ || দ্বিতীয় পর্ব

সংগ্রাহক : সুশান্ত কর

Daruharidra by Daruharidra
09/07/2021
in উপন্যাস
1
মেখলা পরা মেয়ে || শ্রীযুধাজিৎ || দ্বিতীয় পর্ব
131
VIEWS

পাঠপ্রস্তুতি : শেষাংশ 

 

গল্পটি অনেকটা এরকম। গুয়াহাটির সন্দীকৈ গার্লস কলেজের মেয়েদের হোস্টেলে শুরু। গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র একটি অসমিয়া ছাত্রী শিবানী। যে খুব ভালো বাংলা বলে। শাড়ি পরে। মেখলা পরতে অস্বীকার করে। এবং তাঁর গ্রামের আবাল্য বন্ধু কলকাতার কোনও এক কলেজের অধ্যাপক শুভ্রেন্দুর সঙ্গে প্রেম সম্পর্কে জড়িয়ে আছে। ঘটনা শুরু ১৯৬০-এর জুন মাসের কোনও এক সময়। চারদিকে ভাষা নিয়ে উত্তেজনা। মার দাঙ্গা আগুনের আঁচ কলেজে বিশ্ববিদ্যালয়ে হোস্টেলেও এসে পৌঁছেছে। সহপাঠিনীদের মধ্যেও অসমিয়া বাঙালি বিভাজন শুরু হয়েছে। বাঙালি মেয়েরা হোস্টেল ছেড়ে যাচ্ছে বা যেতে চাইছে। শিবানী তাদের আশ্বস্ত করছে। তার বাঙালি প্রীতি অসমিয়া বন্ধু এমন কি শিক্ষক শিক্ষিকারও প্রশ্নে বিদ্ধ হচ্ছে। ৪ জুলাইর ঘটনার পরে শিবানী চিন্তিত হয়ে পড়ল গ্রামের বাড়িতে শুভ্রেন্দুর মা বাবাকে নিয়ে। কানাই কাকতি রয়েছে। যে শিবানীকে প্রেম যেচে ব্যর্থ হয়েছিল। সুশিক্ষিত এবং সফল প্রেমিক শুভ্রেন্দুর প্রতি ঈর্ষাও ওর কম নেই। সে না এই সময় দুষ্কৃতিদের নেতৃত্ব দিয়ে শুভ্রেন্দুর বাবা মায়ের কোনও ক্ষতি না করে বসে। সে ঠিক করল নিজের মা-বাবাকে চিঠি লিখে জানাবে। হোস্টেলের তৃতীয় শ্রেণির কর্মী সুরতিয়াকে দিয়ে একখানা খাম আনতে দিল। সে খামের সঙ্গে শুভ্রেন্দুর একখানা চিঠিও নিয়ে এল। শুভ্রেন্দু কিছুদিন জ্বরে ভুগে দিন পনেরোর ছুটি নিয়ে বাড়ি ফিরছে জানাল। এই সংবাদ ওকে আনন্দ দেবার বদলে শঙ্কিত করে তুলল। সে বাড়ি যাবার সিদ্ধান্ত নিল। কানাইর হাত থেকে শুভ্রেন্দুকে রক্ষা করতে হবে। এইখান থেকেই গোটা উপন্যাস জুড়ে টানটান উত্তেজনা। আর শিবানীর চলচঞ্চল যাত্রা শুরু হল। বাড়ি থেকে কেউ নিয়ে না এলে হোস্টেল থেকে কোনও ছাত্রীকে যেতে দেওয়া হয় না। সে সুরতিয়াকে ধরে রাতের অন্ধকারে একা বেরিয়ে যায়। ট্রেনে চেপে বাড়ি যাত্রা করে আক্রান্ত হয়। ধর্ষিতা হতে হতে রক্ষা পায়। বাড়ি পৌঁছেই অসুস্থ শুভ্রেন্দুর পরিচর্যার দায়িত্ব গ্রহণ করবার পাশাপাশি খবর নিতে শুরু করে কানাই কাকতির অভিসন্ধি কী? দিনের এক মুহূর্ত তার বিশ্রাম নেবার উপায় নেই। ছলনা করে সে কানাইর থেকে একটি বন্দুক আদায় করে। এবং নদীতে একটি ভেলা সাজিয়ে রাখতে তাকে উদ্বুদ্ধ করে। পরিকল্পনাটা এই যে শুভ্রেন্দুকে হত্যা করে কানাই শিবানী যাবে গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে। কিন্তু হয় উল্টো। কানাইকে ফাঁকি দিয়ে দুই বাড়িকে রাজি করিয়ে শিবানী শুভ্রেন্দুর প্রাণ বাঁচাতে পালায় গ্রাম ছেড়ে। কানাইর তৈরি ভেলাতে চেপে। তার আগে দুজনে সংক্ষিপ্ত বিয়েটাও সেরে নেয়। এই ভেলার ভাসানে পাঠকের মনে পড়বে লক্ষ্মীন্দরকে নিয়ে বেহুলার ভাসানের কথা। লেখক সেই গল্প মনে করিয়েও দিয়েছেন। এর পরের গল্পটা আমাদের বলে দেয়া ঠিক হবে না। আমরা কেবল বলতে চাই যে শিবানী বঙ্কিমের নায়িকা চরিত্রগুলোর আদলে তৈরি। সদা চঞ্চল, কর্মতৎপর, কর্তব্যে কঠোর, প্রতিজ্ঞাতে দৃঢ়। এর বিপরীতে শুভ্রেন্দু যেন প্রকৃতির পাশে পুরুষ। নির্বিকার, নিষ্ক্রিয়। অনেকটাই শরৎ-উপন্যাসের নায়কদের মতো। এর পক্ষে অবশ্য একটি যুক্তি তৈরি ছিল। পুরো গল্পভাগেই শুভ্রেন্দু জ্বরে কাতর। সেই অবস্থাতেই সে ভেলাতেও ভাসমান হয়। কিন্তু এই জ্বরের বাহানাতে শুভ্রেন্দুর বৈপরীত্যটা চাপা থাকে না। গুয়াহাটির ঘাটে যখন এরা গুণ্ডাদের দ্বারা ঘেরাও হল, শিবানী হুঙ্কার দিয়ে বলছিল তারা ভেলা থেকে নামবে না। তার হাতে বন্দুক ছিল। শুভ্রেন্দু এই প্রথম তাকে ধমক দিয়ে বলে, “কি ছেলে মানুষী করছ শিবানী, নির্মম নিয়তির হাত থেকে আমাদের পরিত্রাণ নেই।” শিবানীর রাজি না হয়ে উপায় রইল না। এই নিয়তি নির্ভরতা যেন শুভ্রেন্দুর একার নয়। ‘উচ্চশিক্ষা,সংস্কৃতি’র গৌরবে গরীয়ান বাঙালি মধ্যবিত্ত মাত্রের। এদের নিয়ে বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায়ের ‘আবার তার বৈপ্লবিক যুগ’-এ ফিরে যাবার স্বপ্ন পূরণ হয় না। এতেই ইতিহাসের মতই করুণ বিচ্ছেদে শেষের দিকে এগোয় উপন্যাস।

শুধু শিবানীই নয়, এর পরের বিপদ থেকে শুভ্রেন্দুকে রক্ষা করে দুষ্কৃতি বরদাকান্তের বোন বিনীতা আর মা। তার থেকে বিদায় নেবার মুহূর্তে শুভ্রেন্দু প্রায় কান্নাভেজা গলাতে বলে,“মনুষ্যত্ব আবার তোমাদের মনের পুষ্পক রথে চেপেই ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার মানুষগুলোর মনে মনে সঞ্জীবিত হোক বোন!” সে জন্যেই সম্প্রতি নিজের প্রকাশিত গবেষণা গ্রন্থ ‘১৯৬০ চনর ভাষা আন্দোলন’ বইতে যখন উপন্যাসটি নিয়ে একটি অধ্যায় রচনা করেন অধ্যাপক দেবব্রত শর্মা ও দয়া সাগর কলিতা—তাঁরা এর শিরোনাম দেন এরকম ‘অসমীয়া- বাঙালী সংঘাতর দলিল। তথাপিও উড়ন্ত মানবতার পতাকা অমলিন। ৪‘

তার মানে এই নয় যে গল্পভাগে কোনও গোল নেই। একটি বাণিজ্যিক চলচ্চিত্র পত্রিকা ‘রূপাঞ্জলি’তে প্রকাশিত হয় উপন্যাসটি। ফলে বঙ্কিম অনুরাগের বিপরীতে গিয়ে লেখককে সম্ভবত তার পাঠকের রুচির প্রতিও খেয়াল রাখতে হয়েছে। শিবানীর কলেজ ছেড়ে গ্রামে যাবার মূল প্রেরণা না হয় ছিল শুভ্রেন্দুকে রক্ষা করা। তাই বলে পুরো গল্পটাই ঘুরবে এক ত্রিকোণ প্রেমকে ঘিরে? যেন গ্রামে আর কোনও মানুষ নেই। আর কোনও মানুষের সমস্যা তার সমস্যা হয়ে রইল না, যে কিনা কলেজে ছিল সমস্ত আতঙ্কিত বাঙালি সহপাঠিনীদের নির্ভরতা। যে কিনা রেলে আসতে আসতেও আক্রান্ত সহযাত্রীদের বেদনার শরিক হয়। এই যে আর মানুষের অনুপস্থিতি তাতেই মনে হয় ‘সাহিত্য সাধক’ শ্রীযুধাজিৎ — যার লেখার ঘরে জুতো পায়ে প্রবেশ নিষেধ — তাঁর সমকালীন কথা সাহিত্যে বিশেষ দখল ছিল না। কানাইর ঈর্ষা উগ্রজাতীয়তাবাদকে একটা সুযোগ হিসেবে নিয়ে যেন কেবল শুভ্রেন্দুকে হত্যা করলেই শান্ত হয়ে যায়। সে জন্যেই সে শিবানীকে নিয়ে নিজের গ্রাম ছেড়ে যেতেও রাজি হয়ে যায়। অগত্যা,শুভ্রেন্দুর মা-বাবার নিরাপত্তা নিয়ে শিবানী বিশেষ চিন্তিত হবার সুযোগই পেল না এবং নিল না। যে মেয়ে আক্রান্ত রেলে চেপে বাড়ি ফিরল ধর্ষিতা হতে হতে — তার থেকে কিনা পথের বিপদ নিয়ে কেউ বিশেষ জানতেও চাইল না, এমন কি শুভ্রেন্দুও না। এবং সর্বোপরি মাঝে মধ্যে বিহুর প্রসঙ্গ বাদ দিলে শিবানী কেবল চরিত্র হিসেবেই বাঙালি কন্যাবৎ নয়, তার নামটাও বাঙালি। এমন অসমিয়া নাম হয় না, যেমন হয় না মিনিবালা, রুণীবালা ইত্যাদি। কানাইর নামটিও কৃষ্ণ হলে মানাত বেশ।   

ষাটের ভাষা-দাঙ্গার প্রেক্ষাপট নিয়ে বাংলা উপন্যাস এ যাবত এই একখানাই লেখা হয়েছে। কিন্তু অসমিয়াতে এমন একাধিক উপন্যাস রয়েছে। ‘মেখলা পরা মেয়ে’ উপন্যাসের আগেই হিতেশ ডেকা লিখেছিলেন ‘মাটিকার’। এর উল্লেখ শ্রীযুধাজিতের রচনাতে রয়েছে। কিন্তু এরও প্রেক্ষাপট ছিল না ভাষা দাঙ্গা। সে ছিল ১৯৫০-এর হিন্দু মুসলমান সংঘাত। ভাষা দাঙ্গা নিয়ে তাঁর উপন্যাস ‘ইতিহাসে সঁকিয়ায়’। একটি উগ্রজাতীয়তাবাদী রসদে ভরপুর রচনা। দেবব্রত শর্মারা যখন এটি নিয়ে আলোচনা করেন, শিরোনাম দেন এরকম, ‘হিতেশ ডেকার উপন্যাসত শত্রুত পরিণত বাঙালী-মিঞা-জনজাতি! সাহিত্যই গঢ়িবও পারে, ভাঙিবও পারে’ ৫’ সুখপাঠ্য ভালো উপন্যাস ‘সাঁথর’ লিখেছিলেন বীরেন্দ্র কুমার ভট্টাচার্য,‘দেবী’ লিখেছিলেন নীরদ চৌধুরী। ‘স্বপ্ন হৃদয় নদী’ লিখেছিলেন রাম গগৈ। অরূপা পটঙ্গীয়া কলিতার ‘ফেলানি’র শুরু সেই ভাষা দাঙ্গার দিনগুলোতে শেষ ভাটি অসমের বডো সন্ত্রাসবাদের প্রেক্ষাপটে। এঁরা প্রত্যেকেই অসমিয়া সাহিত্যের দিকপাল। সেভাবে এই আন্দোলনটি নিয়ে বাংলার তো নয়ই, অসম তথা পূর্বোত্তরের কেউ এই অব্দি বাংলা ভাষাতে উপন্যাস লিখে উঠেননি। হয়ত উঠবেন। আরও দুই একটি উপন্যাসে হয়ত প্রসঙ্গ ক্রমে বিষয়টি এসেছে। যেমন সাম্প্রতিক উপন্যাস ইমাদ উদ্দিন বুলবুলের ‘সুরমা নদীর চোখে’র জল। কিন্তু উপন্যাসের মূল প্রেক্ষাপট দেশভাগ ও স্বাধীনতা। ‘মেখলা পরা মেয়ে’ উপন্যাসটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব তাই কোনও কালেই ফুরিয়ে যাবার নয়। সেই কালেই বসে লেখা এখন অব্দি একক বাংলা উপন্যাস। এটা জেনেই পাঠক পড়তে বসবেন এবং উপভোগ করবেন এই আশাতে আমরা রইলাম।

সুশান্ত কর

তিনসুকিয়া

২৬ জুন, ২০২১

   

                           

গ্রন্থসূত্র ꠩

১) আসামে ‘বঙ্গাল খেদা’ অভিযান ও পশ্চিম বঙ্গের কথা—১৯৬০; আসামে ভাষা আন্দোলনও বাঙালি প্রসঙ্গ ১৯৪৭-১৯৬১;  বিশ্বাস, সুকুমার; পারুল প্রকাশনী প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা ৯; প্রথম সংস্করণ, পুনর্মুদ্রণ ২০১৯; পৃ:১৪৯।

২) প্রাগুক্ত; পৃ:১৬৬।

৩) প্রাগুক্ত; পৃ:১৬৩।

৪) শর্মা, দেবব্রত ও কলিতা, দয়াসাগর; ১৯৬০ চনর ভাষা আন্দোলন; একলব্য এবং অসম জাতীয় প্রকাশক, জাতীয়ভবন,  যোরহাট ০১; নভেম্বর, ২০২০; পৃ: ৫২৭।

৫) প্রাগুক্ত; পৃ: ৫১২।

 

মেখলা পরা মেয়ে

 

 

আমার লেখার ঘর। একটা মেহগনি কাঠের টেবল। তাতে চন্দন কাঠের দোয়াতদান, টেবল ল্যাম্প। একপাশে কটা ভাষা ও শব্দকোষ। চারদিকের আলমারিতে ঠাসা বই। এর মধ্যে রবীন্দ্র-রচনাবলী, শরৎ-গ্রন্থাবলী, এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা, ঋষি বঙ্কিমের গ্রন্থসমূহের সেট সহজেই চোখে পড়ে কেউ এ ঘরে এলে।

ঘরটা খুব বড়ও নয়, খুব ছােটও নয়। ডিষ্টেম্পার করা দেয়াল। মেঝে মােজেক-এ আবৃত। এ ঘরে জুতাের প্রবেশ নিষেধ। কেননা এ ঘরেই চলে আমার সাধনা — সাহিত্য সাধনা। দেয়ালে টাঙ্গানো কয়েকজন প্রাতঃস্মরণীয় ও বিশিষ্ট ভারতসন্তানের ছবি। তারা হ’লেন শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ-সারদামণি, স্বামী বিবেকানন্দ, গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ, নিজ হস্তাক্ষরে বাংলায়—“মাে, ক, গান্ধী” সহি সহ মহাত্মা গান্ধী, নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু এবং বর্তমান ভারতের মুখ্য নেতা নেহরু। এছাড়া আরও একটি চিত্র আছে, তা হ’ল বিদ্যার অধিষ্ঠাত্রী দেবী বীণাপাণির। সুতরাং এ ঘরে যে জুতো পরে ঢােকা উচিত নয় আশা করি এ কথা শ্রদ্ধানত চিত্তে আমার সঙ্গে আপনারাও স্বীকার করবেন।

এক দিকের দেয়ালে টাঙ্গানো আছে আরও দুটি জিনিস। তার একটি হ’ল পরাধীনতার আমলে বিদেশী সাম্রাজ্যবাদীদের অংকিত নানা দেশীয় রাজ্য কণ্টকিত একটি মানচিত্র। আর ঠিক তার পাশেই স্বাধীনতাত্তোর ভারতের পাক-অংশ বিযুক্ত মানচিত্র। আর যে জিনিসগুলাে ছিল একটা উডেন শেলফ-এর ওপর পর পর স্তুপাকৃতি হয়ে তা হ’ল উনিশ শ’ ষাট সালের জুন মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে সুরু করে জমানাে বেশ কিছু খবরের কাগজ — আনন্দবাজার, যুগান্তর, অমৃতবাজার, ষ্টেটসম্যান, হিন্দুস্থান ষ্ট্যাণ্ডার্ড, লােকসেবক, স্বাধীনতা, জনসেবক, আসাম ট্রিবিউন, নতুন অসমীয়া প্রভৃতি। কাগজগুলাের বুকে ছােট বড় নানা হরফে লেখা আসামের ভারতীয় নাগরিক বাংলা ভাষাভাষী নরনারীর ওপর অমানুষিক অত্যাচারের নানা সংবাদ। হতে পারে সবই মর্মান্তিক সত্যি — নইলে কিছুটা হয়ত মিথ্যা, নয়ত বা সত্যে যা ঘটেছে তার চেয়েও সংবাদ হ’য়ে বেরিয়েছে অনেক কম।

একদৃষ্টে আমি অনেকক্ষণ চেয়ে ছিলাম সেই কাগজগুলাের দিকে। পলক পড়ল না চোখে। তারাগুলাে জলে ভরে গেল। চােখের মণিটা স্থির, অচঞ্চল। এক সময় চোখের ভেতরটা আর্দ্র হ’ল। পাতা পড়ল এবার। সঙ্গে সঙ্গে খুলতে পারলাম না চোখ। অনেকক্ষণ মুদিত নয়নে বসে রইলাম। কেমন যেন তন্দ্রাতুর হ’লাম — আর মুদিত চোখের পাতার ওপর ভেসে উঠল দেশীয় রাজ্যে খণ্ডবিখণ্ড বৃটিশ ভারতের মানচিত্র। দেখতে পেলাম সেই মানচিত্রের ওপর দিয়ে লক্ষ লক্ষ দেশবাসীর জাগরণ। সমগ্র জাতটার হৃদয়ে কেন স্বাধীনতা অর্জনের আন্দোলনের ঢেউ একের পর এক এসে আঘাত করতে লাগল। অবশেষে এলাে উনিশ শ’ বিয়াল্লিশ সাল — মুক্তিকামী মানুষগুলাের মুখে বজ্রনির্ঘোষে ঘােষিত হ’ল সেই ঐতিহাসিক কথা — ইংরেজ, ভারত ছাড়। বৃটিশ সিংহ পলায়নপর হতে বাধ্য হল—সে দাবী শুনে। সরকারী ভবন শীর্ষ হতে নামানো হল ইউনিয়ান জ্যাক। ভারত মাতার বুকের ওপর দিয়ে দেশের নওজোয়ানরা অশােকচক্র লাঞ্ছিত তে–রঙা ঝাণ্ডা উড়িয়ে ব্যান্ড ও বিউগল বাজাতে বাজাতে কুচকাওয়াজ ক’রে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে ধ্বনি দিয়ে উঠছে তারা:

— বন্দে মাতরম্। স্বাধীন ভারত জিন্দাবাদ। জয়হিন্দ্!

কিন্তু, কিন্তু ওকি! হা ওই তো বিশাল দৈত্য-সদৃশ এক দেহ — হাতে তার শাণিত ছুরিকা। বিকট শব্দে অট্টহাসি হেসে উঠল দৈত্যটা। পরক্ষণেই সে ভারত মানচিত্রে দেশীয় রাজ্যগুলির এখানে, ওখানে সেখানে, রক্তবীজের মত বহু মূর্তি ধারণ করে হাতের সেই শাণিত ছুরি চালাবার ভঙ্গী করতে লাগল। সেই ভঙ্গীর সঙ্গে সঙ্গে বিরাট চেহারার দেহটার বিরাট মুখগহ্বর হতে অট্টহাসি বেরিয়ে আসতে থাকে গমকে গমকে। ভারতের ভবিষ্যৎ ভেবে শিউরে উঠলাম আমি।

তবে হঠাৎ তার সে হাসি হ’ল স্তব্ধ। কিন্তু কেন ? বিকটদর্শন বহুরূপী দৈত্যটা অকস্মাৎ কার ভয়ে থরথর কাঁপতে লাগল? ওর ভীত সন্ত্রস্ত দৃষ্টিকে অনুসরণ করে যাঁকে আমি দেখতে পেলাম—তিনি ভারতের প্রথম ও শেষ সহকারী প্রধানমন্ত্রী, ‘আয়রণ ম্যান’ সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল। হাতে তাঁর যেন এক মােহিনী যাদুদণ্ড। সেই যাদুদণ্ডের ইঙ্গিতে বিকট দর্শন দৈত্যটার সবকটি প্রতিরূপ— হাতের শাণিত ছুরি ফেলে দিয়ে দে ছুট দে ছুট। অবশেষে সে গিয়ে মিলিয়ে গেল ভারতসাগরের লবণাক্ত নীলাকাশের ছায়া পড়া নীল জলে।

বিস্ময়ে আনন্দে আমার চোখের তারা নেচে উঠল। দৃষ্টি গিয়ে পড়ল চৌদ্দটি ‘ক’ শ্রেণীর রাজ্য অধ্যুষিত নব ভারতের নতুন মানচিত্রের ওপর। মন আমার নিশ্চয়তায় হ’ল আপ্লুত।

হঠাৎ লেলিহান অগ্নি শিখায় উত্তর-ভারতের প্রত্যন্ত প্রদেশের আকাশ হ’ল রক্তিম। ভয়ার্ত নারী-পুরুষের ভীত করুণ আর্তনাদে আকাশবাতাস মথিত হয়ে উঠল। আবার এসেছে সেই দৈত্যটা। এই বার বছরে তার দেহ যেন বেশ পুরুষ্টু হয়েছে। চোখে মুখে যেন এসেছে আরও ভয়াল কুটিল ভাব। দেহের রক্ত যেন ওর নৃত্য করতে শুরু করেছে তাথৈ তাথৈ থৈ। আসামের প্রায় সর্বত্র সুরু হ’ল জহ্লাদবৃত্তি!

ভয়ার্ত, হৃতসর্বস্ব মানুষের আকুল আবেদন কি গিয়ে পৌঁছালাে দিল্লীর মসনদে? কি করে পৌঁছাবে, দিল্লী যে দুরস্ত্,—দিল্লী বহু দূর। কিন্তু বিজ্ঞান ত’ পরস্পরের কাছে এনে দিয়েছে গােটা দুনিয়াকে। তাই দিল্লী দূরে থেকেও দূর নয়। তার-বেতারটেলিফোন, সর্বোপরি সংবাদপত্র স্ব স্ব ধর্ম-মত দূরের মানুষদের আনন্দ-বেদনা-দীর্ঘশ্বাস-আর্তনাদ নিকট করে আনে। তবু যেন বিস্তর টালবাহানার পর প্রধানমন্ত্রী, জাতির জনকের ভাষায় যে— “জওহর সত্যিই একটি জওহর” নেতা নেহরু ছুটলাে সেই প্রত্যন্ত প্রদেশে।

সারা ভারত উন্মুখ হয়ে রইল—তাদের জাতীয় নেতার সিদ্ধান্ত শুনতে। বিশেষ করে হৃতসর্বস্ব, লাঞ্ছিত, নিগৃহীত, ধর্ষিত—ভারতীয় নাগরিক বাঙ্গালীরা তাঁর আশ্বাসের ললিতবাণী শুনবার আশায় যখন রুদ্ধশ্বাসে পল অনুপল গুণছে তখন নেহরু যা বলল তা যে দুষ্কৃতকারীদের তােষণেরই নামান্তর। দাঙ্গায় নিহত বাঙ্গালীদের জন্য নয়—পুলিশের গুলিতে নিহত রঞ্জিৎ বড়পূজারীর জন্য সমবেদনা জানালো নেহরুর সে বাণী। সংবাদপত্রগুলাের ওপর নেহরু চাপালাে অতিরঞ্জনের অপবাদ।

আমার মনের মাঝে নেহরুর মন্তব্য সম্পর্কে, তাঁর আচরণ সম্পর্কে ভাবনার আলােড়ন শুরু হল। কিছুতেই সায় দিতে পারলাম না তাঁর সিদ্ধান্তে। তাই সামনের সুদৃশ্য দোয়াতদানের দিকে ডান হাতটা এগিয়ে গেল, তুলে নিল লেখনী। কলমের নিব ডুবিয়ে দিল মসীতে মনের মাঝে একটা প্রত্যয় যেন দৃঢ়তা সহকারে অস্ফুটে বলে উঠল Pen is mighter than sword.

সত্যি কি ? হয়তো সত্যি। সত্যের আলােকে যেন দেখলাম মেখলা পরা মেয়ে আসামের ঘটনার ওপর নেহরুর মন্তব্যটা মিথ্যা দিয়ে সত্যকে চাপা দেবার সামিল। তাই আমার কলম টেবলের ওপর পড়ে থাকা প্যাড কাগজের বুকে কাটল আঁচড়–রূপ পেল আখর — নেহরু, তুমি ভুল করলে!

বঙ্গ-আসাম সীমান্ত সন্নিহিত এক মহকুমা শহর। সারি সারি অস্থায়ী তাঁবু পড়েছে পশ্চিম বঙ্গ সরকারের ত্রাণ বিভাগের। অদূরেই জংশন স্টেশন। আসাম থেকে আসা ট্রেনের কামরায় কালকে সব কিছু থাকা আজকের সহায় সম্বলহীন ভীতবিহ্বল নব-উদ্বাস্তু নরনারীর ভীড়। ভারতেরই কোন রাজ্য থেকে কুকুর বিড়ালের মত তাড়া খাওয়া ভারতীয় মানুষগুলাে এসে আশ্রয় নিচ্ছে তাঁবুতে তাঁবুতে। মুখে চোখে ওদের সব হারানাের ছাপ। রিক্ততার প্রতিচ্ছবি যেন ওরা। বিভিন্ন সেবা প্রতিষ্ঠানের লােকেরা শিশুদের দিচ্ছে দুধ, একবস্ত্রে চলে আসাদের দিচ্ছে বস্ত্র আর সম্মিলিত হেঁসেলে রাঁধা খিচুড়ি বিলােচ্ছে সবার মাঝে।

সবেমাত্র এক ট্রেন যাত্রী এসে পৌঁছেছে এই অস্থায়ী শিবিরে তাদের ভেতর থেকে একটি মেয়েকে সবারই চোখে পড়ে — চোখ জোড়া টানা টানা। মাথায় তেলহীন রুক্ষ একমাথা চুল। মুখে অদ্ভুত লালিত্য। স্বর্ণ চাঁপার মত গায়ের রং। পরনে অসমীয়া মেয়েদের জাতীয় পােশাক —ছিন্ন, ময়লা মেখলা। চাদরটা বুঝি হারিয়ে গেছে ওর। দৃষ্টিতে ভাবলেশহীন অভিব্যক্তি। চোখের কোলে বহু বিনিদ্র রজনী জাগরণের ক্লান্তিচিহ্ন। মুখের রেখায় রেখায় একটা নিস্পৃহ নিরাসক্ত ভাব। কিন্তু তার সে মুখ কমে ক্রমে সঙ্কল্প-কঠিন হয়ে উঠল। ঠোঁটদুটো সে পরস্পর জোরে চেপে ধরল। তারপর ডান হাতটা সামনের দিকে টান করে ধরল রিভলবারের ট্রিগার টিপবার ভঙ্গীতে। পরক্ষণেই মুক্তাপাঁতি দাঁত চিকমিকিয়ে চীৎকার করে বলে উঠল ।

— ঠাস, ঠাস, ঠাস। — বেঙ্গলি মারিম, অসমীয়া মারিম!

চলবে…

 

নোট : বানান অবিকৃত 
Tags: উত্তর-পূর্বধারাবাহিক উপন্যাসভাষা আন্দোলনমেখলা পরা মেয়েযুধাজিৎসুশান্ত কর
Previous Post

প্রবুদ্ধসুন্দর কর || ত্রয়োবিংশতি পর্ব

Next Post

প্রবুদ্ধসুন্দর কর || চতুর্বিংশতি পর্ব

Daruharidra

Daruharidra

Next Post
প্রবুদ্ধসুন্দর কর || চতুর্বিংশতি পর্ব

প্রবুদ্ধসুন্দর কর || চতুর্বিংশতি পর্ব

Comments 1

  1. Dhananjoy Chakraborty says:
    12 months ago

    পড়লাম…চলুক

    Reply

Leave a Reply Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

No Result
View All Result

RECENT POSTS

মেখলা পরা মেয়ে || শ্রীযুধাজিৎ || অন্তিম পর্ব

মেখলা পরা মেয়ে || শ্রীযুধাজিৎ || অন্তিম পর্ব

15/04/2022

সঞ্জয় চক্রবর্তী || অন্তিম পর্ব

09/04/2022
মেখলা পরা মেয়ে || শ্রীযুধাজিৎ || দ্বাবিংশতি পর্ব

মেখলা পরা মেয়ে || শ্রীযুধাজিৎ || দ্বাবিংশতি পর্ব

08/04/2022

সঞ্জয় চক্রবর্তী || নবম পর্ব

02/04/2022
মেখলা পরা মেয়ে || শ্রীযুধাজিৎ || একবিংশতি পর্ব

মেখলা পরা মেয়ে || শ্রীযুধাজিৎ || একবিংশতি পর্ব

01/04/2022

সঞ্জয় চক্রবর্তী || অষ্টম পর্ব

27/03/2022
মেখলা পরা মেয়ে || শ্রীযুধাজিৎ || বিংশতি পর্ব

মেখলা পরা মেয়ে || শ্রীযুধাজিৎ || বিংশতি পর্ব

25/03/2022
সঞ্জয় চক্রবর্তী || সপ্তম পর্ব

সঞ্জয় চক্রবর্তী || সপ্তম পর্ব

20/03/2022
মেখলা পরা মেয়ে || শ্রীযুধাজিৎ || উনবিংশতি পর্ব

মেখলা পরা মেয়ে || শ্রীযুধাজিৎ || উনবিংশতি পর্ব

18/03/2022
ষষ্ঠ পর্ব || সঞ্জয় চক্রবর্তী

ষষ্ঠ পর্ব || সঞ্জয় চক্রবর্তী

13/03/2022

RECENT VIDEOS

https://www.youtube.com/watch?v=77ZozI0rw7w
Daruharidra

Follow Us

আমাদের ঠিকানা

দারুহরিদ্রা
কুঞ্জেশ্বর লেন
(বরাকভ্যালি একাডেমির নিকটবর্তী)
নতুন ভকতপুর, চেংকুড়ি রোড
শিলচর, কাছাড়, আসাম
পিন-788005

ডাউনলোড করুন

সাবস্ক্রাইব

Your E-mail Address
Field is required!
Field is required!
Submit
  • আমাদের সম্পর্কে
  • লেখা পাঠানো
  • যোগাযোগ

Copyright © All rights reserved Daruharidra | Development by Prosenjit Nath

No Result
View All Result
  • ধান্যগৃহ
  • কবিতা
  • গল্প
  • গদ্য
  • প্রবন্ধ
  • উপন্যাস
  • সাক্ষাৎ পাতা
  • অনুবাদ পাতা
  • আর্কাইভ
  • আমাদের সম্পর্কে
    • লেখা পাঠানো
    • যোগাযোগ

Copyright © All rights reserved Daruharidra | Development by Prosenjit Nath