Daruharidra
  • ধান্যগৃহ
  • কবিতা
  • গল্প
  • গদ্য
  • প্রবন্ধ
  • উপন্যাস
Daruharidra
  • ধান্যগৃহ
  • কবিতা
  • গল্প
  • গদ্য
  • প্রবন্ধ
  • উপন্যাস
Daruharidra
No Result
View All Result
Home সাক্ষাৎ পাতা

শিবাশিস চট্টোপাধ্যায় || দ্বিতীয় পর্ব

গদাধরের বাউদিয়া || ধারাবাহিক

Daruharidra by Daruharidra
12/07/2021
in সাক্ষাৎ পাতা
9
শিবাশিস চট্টোপাধ্যায় || দ্বিতীয় পর্ব
275
VIEWS

 

দারুহরিদ্রা :- নিশ্চয় শুনবো। আপনি বলুন!

শিবাশিস :- আচ্ছা, তবে বলেই ফেলি। আমরা যে হাইস্কুলে পড়েছি (পি সি ইন্সটিটিউশন) তার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন রাজা বাহাদুর প্রতাপ চন্দ্র বড়ুয়া। তাঁর নিজের নামেই স্কুল। ১৯৭৪ সালে সেই স্কুলের হীরক জয়ন্তী উপলক্ষে প্রকাশিত স্মরণিকায় ঠাকুরদা অর্থাৎ দাদুর এক টুকরো লেখা বের হয়। ইংরেজিতে। সেখান থেকে তাঁর জীবন সম্পর্কে অনেক তথ্য পাওয়া যায়। তাছাড়া পরিবার সূত্রেও অনেক কথাই তো জানা। আসল কথায় আসি। এই যা, দাদুর আসল নামটাই তো এখনও বলা হয়নি। ঘটনা হল, দাদু সাধারণ্যে পরিচিত ছিলেন ‘মুন্সিবাবু’ বলে। কারণ তিনি রাজ এস্টেটের মুন্সিপদে বহাল ছিলেন প্রায় আজীবন। তবে শিক্ষিত সমাজে সারা জীবন ‘বাবু পূর্ণচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়’ নামেই পরিচিত ছিলেন। পরিচিত ছিলেন বলছি কারণ সেটা তাঁর আসল নাম বা যাকে বলে পিতৃদত্ত নাম ছিল না। তাঁর পিতৃদত্ত নাম ছিল বাবু প্রমথনাথ চট্টোপাধ্যায় এবং পি সি ইন্সটিটিউশন স্কুলের ভর্তি রেজিস্টারেও ওই নামই পাওয়া যায়।

 

প্রসন্ন চট্টোপাধ্যায় (মধ্যে), বাঁদিকে ঠাকুর্দা পূর্ণচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

প্রমথনাথ কবে কী পরিস্থিতিতে পূর্ণচন্দ্র হলেন সে এক ইতিহাস। এ কাহিনী যে খুবই কৌতূহলোদ্দীপকও তাতেও কোনও সন্দেহ নেই। দাদু ছিলেন সে যুগের আই এ পাশ। মোটামুটি ইংরেজিও জানতেন। গৌরীপুরের রাজা বাহাদুর প্রতাপ চন্দ্র বড়ুয়ার দ্বারা ইং ১৮৯৯ সনে স্থাপিত প্রতাপ চন্দ্র ইনস্টিটিউশনের প্রথম ব্যাচ। গৌরীপুরে প্রথমে একটি এম.ই স্কুল স্থাপন করা হয় ও কয়েক বছরের মধ্যে সেটিকেই হাইস্কুলে উন্নীত করা হয়। প্রথম হেড মাস্টার ছিলেন বাবু যোগেন্দ্র চন্দ্র দত্ত। নিম্ন অসমের বিভিন্ন জেলা থেকে ছাত্ররা সেকালে এখানে পড়তে আসত। সে যুগেও ছাত্রদের থাকার হস্টেল ছিল এখানে। থাকা ফ্রি, তবে খাওয়ার জন্য বোর্ডারদের সামান্য টাকা দিতে হত। এম.ই লেভেল পর্যন্ত শিক্ষাও ফ্রি ছিল। বুথ সাহেব তখন উচ্চশিক্ষা দপ্তরের প্রধান। রাজা বাহাদুর চাইলেও এই বুথ সাহেবের আপত্তিতে হাইস্কুল শিক্ষাকে ফ্রি করা যায়নি। খুব সামান্য দক্ষিণা ছাত্রদের দিতে হত ফী-বাবদ। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনেই ছিল গোটা শিক্ষা ব্যবস্থা। বহু বিখ্যাত মানুষ এই স্কুলে পড়েছেন। কবি অমিয় চক্রবর্তী থেকে প্রমথেশ বড়ুয়া, অম্বিকাগিরি রায়চৌধুরী, রেবতী মোহন দত্ত চৌধুরী (শীলভদ্র) পর্যন্ত। শীলভদ্রকেই সম্ভবত বলা যেতে পারে লাস্ট অফ দ্যা মোহিকান্স।

এরপর শুধু শূন্য। যাই হোক, সেই সকল মহারথীদের কথায় পরে আসছি। প্রায় ছাত্রাবস্থা থেকেই দাদু দেশের স্বদেশি আন্দোলনের সাথে জড়িয়ে পড়েছিলেন। পি সি ইন্সটিটিউশন থেকেই কোনও রকম বিনা প্রস্তুতিতে ১৯০৫ সনে ম্যাট্রিক পরীক্ষায়ও বসেন ও আশানুরূপ ফলই লাভ করেন, অর্থাৎ ফেল করেন। পরে ধুবড়ির জেলা স্কুলে ভর্তি হন ও সেখান থেকে ভাল নম্বর নিয়েই ম্যাট্রিক পাশ করেন। এর পরপরই তিনি দেশের মুক্তি সংগ্রামে গভীর ভাবে জড়িয়ে পড়েন। কলকাতায় ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের ২২ তম ( ডিসেম্বর, ১৯০৬) অধিবেশনেও যোগ দেন। সে সময় সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী, ফিরোজ শাহ মেহেতা, গোপালকৃষ্ণ গোখলে, মদনমোহন মালব্যরা ছিলেন মডারেট, অপর পক্ষে লালা লাজপত রায়, বাল গঙ্গাধর তিলক, বিপিনচন্দ্র পাল, অরবিন্দ ঘোষেরা ছিলেন যাকে বলে চরমপন্থী। ব্রিটিশের প্রজা হিসেবে অনুনয়-বিনয়ের রাজনীতি চরমপন্থীদের না-পসন্দ হওয়ায় কংগ্রেস ওল্ড পার্টি ও নিউ পাৰ্টিতে বিভক্ত হয়ে যায়। সে ইতিহাস আমাদের স্মৃতিতে ধূসর হয়ে গেছে এখন।

দাদু এই চরমপন্থী নিউ পার্টির ভলান্টিয়ার হয়ে যান। সে সময় অনেকের মতোই ভিতরে ভিতরে তিনিও হয়ে উঠেছিলেন অরবিন্দ ঘোষের (ঋষি অরবিন্দ) একান্ত অনুগামী। বিশেষত ১৯০৮-০৯-এর আলীপুর বোমা মামলার কিছুকাল আগে থেকে। দোর্দণ্ডপ্রতাপ বীচক্রফট সাহেবের এজলাসে মামলা চলছে। অরবিন্দ ঘোষ ছাড়াও উল্লাসকর দত্ত, রবীন্দ্র কুমার ঘোষ, হেমচন্দ্র কানুনগো সহ কোর্টে অনেক বিপ্লবীদের বিচার চলছে। মুরারীপুকুরের বাগানবাড়িতে বোমা নির্মাণের কারখানার অস্তিত্ব ধরা পড়ার পরবর্তী ঘটনাক্রমে তখন চারিদিকে গরম হাওয়া। সন্দেহ করা হয়, দাদু অনুশীলন সমিতির সহিংস কর্মকাণ্ডেও গোপনে জড়িয়ে পড়েছিলেন, অন্তত বেশ কিছুদিন। আলীপুর বোমা মামলায় ব্রিটিশ পুলিশ শ্রীঅরবিন্দ ও তাঁর সঙ্গীদের অ্যারেস্ট করলে বন্দিদের মুক্তির জন্য বিক্ষোভ আদি সংগঠিত করার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন দাদু ও তাঁর সহযোদ্ধারা। কোর্টের বাইরে দাদু ও তাঁর বন্ধুদ্বয় প্রভাস দেব, শচীন মুখার্জি ও সাথে অনেকেই বিক্ষোভে ফেটে পড়েন। দাদু ও দাদুর বন্ধুদ্বয়কে গ্রেপ্তার করে বিপিনচন্দ্র পালের সাথে একসঙ্গে জেলে পুরে দেয়া হয়। বিপিনচন্দ্র ব্রিটিশের প্রস্তাব অনুযায়ী অরবিন্দ ঘোষের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে অস্বীকার করে গ্রেপ্তার হন। দাদু ও তাঁর দুই বন্ধুর ১৪ দিনের জেল হয় প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ড সাহেবের বিচারে। সেই কিংসফোর্ড যাকে হত্যার উদ্দেশ্যে বোমা নিক্ষেপ করেছিলেন ক্ষুদিরাম। অন্য গাড়িতে থাকায় কিংসফোর্ড বেঁচে যায় যদিও দুর্ভাগ্যবশত ব্যারিস্টার কেনেডি সাহেবের স্ত্রী ও কন্যা মারা যায়। সে যাই হোক, ১৪ দিন পরে দাদু, বিভাস দেব ও শচীন মুখার্জি মুক্তিলাভ করলে বিডন স্কোয়ারে তাঁদের সংবর্ধনার আয়োজন করা হয়। সংবর্ধনা স্থলে পুলিশ লাঠি চার্জ করে সব লণ্ডভণ্ড করে দেয়।

 

পি সি ইন্সটিটিউশনের হীরক জয়ন্তী (৭৫ বছর পূর্তি) স্মরণিকায় প্রথম প্রকাশিত। পরে প্ল্যাটিনাম জুবিলি স্মৃতিগ্রন্থেও সংকলিত হয়। পৃষ্ঠা- ১৭২
পি সি ইন্সটিটিউশনের হীরক জয়ন্তী (৭৫ বছর পূর্তি) স্মরণিকায় প্রথম প্রকাশিত। পরে প্ল্যাটিনাম জুবিলি স্মৃতিগ্রন্থেও সংকলিত হয়। পৃষ্ঠা- ১৭৩

 

দাদু ব্রিটিশ ভারতে দু-দুবার জেল খেটেছেন। অন্যায়ের প্রতিবাদে একাধিক ব্রিটিশ সাহেবকে এমনকি শারীরিক ভাবে প্রহার ও অন্য প্রকার হেনস্থা করার দু:সাহসও তিনি একাধিকবার করেছিলেন। তিনি দীর্ঘদেহী, সুঠাম শরীর, যাকে বলে পেটানো চেহারা — তেমন ছিলেন। স্বভাবে ছিলেন কিছুটা একগুঁয়ে, জেদি ও যাকে বলে কোপনস্বভাব। অকুতোভয় প্রকৃতির মানুষ, ফলে যা হয়, কুছ পরোয়া নেই গোছের চালচলন। সাহেব পেটাচ্ছেন, কখনও আবার পুলিশ পিটিয়ে ফেরার হয়ে যাচ্ছেন। একবার কলকাতায় থাকাকালীন এক ব্রিটিশ সাহেবের ওপর চড়াও হন ও তাঁকে শারীরিক নিগ্রহ করেন। সাহেবও ছাড়বার পাত্র নন। একজন কালা আদমি, নেটিভ, Nigger-এর এত সাহস? পরদিন প্রমথনাথের নামে অ্যারেস্ট ওয়ারেন্ট বের হল। দাদু তার আগেই গা ঢাকা দেন ও অতি চতুরতার সঙ্গে ব্রিটিশ পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে আসামে, গৌরীপুরে পালিয়ে আসেন। মজার ব্যাপার, গৌরীপুরে এসে তিনি আর প্রমথনাথ থাকলেন না। নাম পাল্টে হয়ে গেলেন পূর্ণচন্দ্র। এর পরের কাহিনী আর তেমন জানা যায় না। প্রপিতামহ প্রসন্নের একান্ত ইচ্ছায় তাঁকে রাজ-এস্টেটে চাকরি নিতে হয়। ফলে পরবর্তীকালে তাঁর জীবন অন্য খাতে বয়ে যায়। তবে দেশ স্বাধীন হবার পর ‘স্বাধীনতা সংগ্রামী পেনশন’ নিতে তিনি অস্বীকার করেন। অনেক জোরাজুরি করেও তাঁকে রাজি করানো যায়নি। দীর্ঘদিন তিনি কলকাতায় ছিলেন ও দেশের কাজে অন্যত্রও ঘুরে বেড়িয়েছেন। কলকাতায় নিজের দিদির (বৈমাত্রেয়) বিয়ে হয়েছিল। তাছাড়া দেশের বাড়ির অনেকেই তখন কলকাতাবাসী। জানোই তো, যশোর থেকে কলকাতার দূরত্ব সামান্যই। ফলে আজও আমাদের আত্মীয়দের সিংহভাগই কলকাতায়। সে যাই হোক, পূর্ণচন্দ্র নামেই তিনি গৌরীপুর রাজ এস্টেটে ‘মুন্সি’ বা হেড ক্লার্ক পদে বাকি জীবন পার করেন। তবে গৌরীপুরে থেকেও তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামীদের যেভাবে পারেন সাহায্য করেছেন।

১৯৩৭ সালের দিকে নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বোস গৌরীপুরে আসেন। তখনও তিনি নেতাজী হননি। গৌরীপুরে আমাদের বাড়িতেই তাঁর রাত্রিবাসের ব্যবস্থা হয়। গৌরীপুরের সুশীল ভট্টাচার্য (দাদুর মামাতো ভাই, ডাকনাম মাখন) ‘মণিমালা’ করতেন। ‘মণিমালা’ ছিল, যতোদূর শুনেছি, একধরনের দেহচর্চা বা সামরিক অনুশীলনের অনুষ্ঠান। ব্রতচারীও হতে পারে। সেই সুশীল ভট্টাচার্য বা মাখনই গৌরীপুর রেলস্টেশন থেকে নেতাজীকে এসকর্ট করে শহরের প্রাণকেন্দ্রে নিয়ে আসেন। সুভাষকে বাড়িতে আশ্রয় দেয়া তখন অত্যন্ত রিস্কি ব্যাপার। রাজ এস্টেট তো আর স্বাধীন নয়। ব্রিটিশের প্রবল কর্তৃত্ব ছিল-ই। গৌরীপুর মাটিয়াবাগ প্যালেসের কাছে একজন ও প্রভাত চন্দ্র সঙ্গীত বিদ্যাপীঠের কাছে আরেকজন ব্রিটিশ অফিসার সবসময়ের জন্য থাকতেন। আর ছিলেন হ্যারিস সাহেব নামে একজন পাট ব্যবসায়ী, যিনি একজন স্থানীয় মহিলাকে বিয়ে করে গৌরীপুর ৪ নং ওয়ার্ডে থাকতেন। তাঁর কন্যা (মালতী বড়ুয়া) সাথেই পরে বিয়ে হয় মেজো কুমার লালজির ( প্রকৃতীশ চন্দ্র বড়ুয়া, চলচ্চিত্রাভিনেতা প্রমথেশ বড়ুয়ার ভাই)। গৌরীপুর নিয়ে বলতে গেলে কথা ফুরোতে চায় না। মূল প্রসঙ্গে আসা যাক। সুভাষকে আশ্রয় দেয়া ঝুঁকিপূর্ণ হলেও দাদু এসবের কোনও তোয়াক্কা করেননি কোনোদিন। গৌরীপুর মহামায়া ময়দানের উত্তরদিকের গোলপোস্টের কাছে মঞ্চ বাঁধা হয়। মঞ্চের পাটাতন বানানো হয় পি সি ইন্সটিটিউশন স্কুলের কাঠের প্ল্যাটফর্ম দিয়ে। আমাদের বাড়িতে একটা কাঠের উঁচু টেবিল ছিল। সেই টেবিল মঞ্চে নিয়ে যাওয়া হয় ও সেই টেবিলের ওপর দাঁড়িয়েই সেদিন স্থানীয় জনতার উদ্দেশে উদাত্ত ভাষণ দেন সুভাষ। সভা পরিচালনা করেন পি সি ইন্সটিটিউশনের হেড মাস্টার জিতেন রায়।

এবারে আমাদের ঠাকুরমার (থান্না) কথাও একটু বলি। থান্না প্রসঙ্গেও নেতাজী ও আরেক বিখ্যাত মানুষ শরৎ চন্দ্র পণ্ডিতের (দাদাঠাকুর) কথা আসবে। আগেই বলেছি নেতাজী আমাদের বাড়িতে এক রাত্রি ছিলেন। তো কথা হল, তখনকার দিনে বাড়ির মেয়ে-বউদের তো পরপুরুষের সামনে যাওয়া একপ্রকার নিষিদ্ধই ছিল। এদিকে এতো বড় মানুষ বাড়িতেই আছেন, অথচ সামনে যেতে পারছেন না। রান্নাবান্না করে পাঠাতে হচ্ছে অন্যের হাত দিয়ে। বাড়িতে তখন আষাঢ়ু নামে এক সর্বক্ষণের পরিচারক ছিল। সেই পরিচারকের হাত দিয়েই নেতাজীর জন্য চা-জলখাবার ও দুপুর-রাতের খাবার পাঠাতে হচ্ছিল। থান্নার হঠাৎ ইচ্ছে হল নেতাজীকে একবার চাক্ষুষ দেখার। জানলার ফুটোই ভরসা। তো সন্ধের পরে চুপিচুপি জানলার ফাঁক দিয়ে নেতাজীকে দেখার বাসনা পূরণ হল আবছা লণ্ঠনের আলোয়। ঘরে দু-তিনজন স্থানীয় লোক ও সাথে আমার দাদুও ছিলেন। নেতাজী খাটে বসে আছেন। থান্না নেতাজীর গলা শুনতে পেলেন। নেতাজী আক্ষেপ করে বলছেন — “সত্যি সত্যি ঘুমোলে তবু জাগানো যায়, কিন্তু যে জাতি জেগে ঘুমোয় তাকে জাগানো খুব কঠিন”। নেতাজী সম্পর্কে আরেকটি ঘটনাও আবার মনে পড়ে গেল। সবই শোনা কথা, যদিও। নেতাজীকে নিয়ে গৌরীপুর মহামায়া ফিল্ডে যে মিটিং হয়েছিল, সেখানে একজন স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি প্রথমে ভাষণ দেন। ভদ্রলোকের নাম কেশব দাশগুপ্ত। খুব শিক্ষিত ছিলেন না। বিশুদ্ধ ঢাকাইয়া ভাষায় বক্তৃতা শেষ করার আগে তিনি জনতার উদ্দেশ্যে দুই হাত আকাশে তুলে উদাত্ত স্বরে চিৎকার করে উঠলেন —” বাইরা রে বাইরা, বল স্বাধীনতা আমরা চাই, চাই, চাই-ই-ই”। ভদ্রলোকের অঙ্গভঙ্গি দেখে ও ঢাকাইয়া ভাষার এ হেন আহ্বানে মঞ্চেই নাকি হেসে ফেলেন নেতাজী। আরও অনেক কাহিনী আছে, সবটা বলা হয়ত সঙ্গত হবে না। শুনেছি, তখনকার নামকরা কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট বাড়ির পেছনের পুকুরপাড়ে লুকিয়ে ছিলেন, পাছে না নেতাজীর কাছে যেতে হয়। নেতাজীর অমর্যাদা তো নতুন কিছু ছিল না। যাই হোক, সে যাত্রায় গৌরীপুরে একটি কমিটিও গঠন হয় বলে শুনেছি। সভার শেষে নেতাজী ধুবড়ি শহরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন ও সেখানে পৌঁছে পূর্বপরিচিত কল্যাণী দত্তর বাসায় ওঠেন।

 

৩.দারুহারিদ্রা :-  গায়ে কাঁটা দেওয়ার মতো আপনার দাদুর জীবন! এতো এতো ঐতিহাসিক চরিত্র! ঘটনা … নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুকে আপনার থান্নার চাক্ষুষ দেখার মুহূর্তটি! … আপনি একজায়গায় শরৎচন্দ্র পণ্ডিতের কথা তুলেছেন,  তাঁর কথা এবার একটু বিশদে বলুন!  

শিবাশিস :- দ্যাখো, থান্নার নামটা উল্লেখ করতেও ভুলে গেছি। তাঁর পিতৃদত্ত নাম ছিল মনোরমা দেবী (মনু)। বহুকাল আগে গত হলেও তাঁর নামে ডানলপের (বৃহত্তর কলকাতা) বিক্রম সুপার মার্কেটে একটি লেদার গুডসের দোকান এখনও রমরমিয়ে চলছে। মাগ্গিগণ্ডার বাজারে ছেলেদের ভবিষ্যৎ চিন্তা করে দোকানটা নিয়েছিলেন আমাদের জেঠু, মণিলাল চট্টোপাধ্যায়। সম্ভবত গত শতকের সেই ৭০-এর দশকে। আমার জ্যাঠতুতো দুই দাদা (প্রবীর চট্টোপাধ্যায় ও কল্যাণ চট্টোপাধ্যায়) বহুবছর ধরে অক্লান্ত পরিশ্রমে সে দোকানটি ধরে রেখেছেন। সে যাই হোক, থান্নার ওই একটাই স্মৃতি এখনও বেঁচে আছে। আর আমি তো থান্নাকে দেখিইনি কোনোদিন। তবে তাঁর স্মৃতির সেই দোকানটা দেখেছি।

থান্না ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার রঘুনাথগঞ্জের মেয়ে। শুনেছি বাবা দৈবী গাঙ্গুলী ছিলেন সেকালের নামডাকওলা উকিল। উকিল হিসেবেও ছিল তুমুল পসার। চারদিকে তখন উকিলের সংখ্যাও তো কম। দূর-দূরান্ত থেকে লোক এসে মামলা লড়ার জন্য ধরে নিয়ে যায়। এরকম অবস্থা। কাশ্মীরের মহারাজার হয়েও তিনি নাকি মামলা লড়েছিলেন। মামলায় জয়লাভ করে উপহার হিসেবে বহু মূল্যবান কাশ্মীরি শাল ও প্রচুর উপঢৌকনও লাভ করেছিলেন বলে শুনেছি।

শরৎচন্দ্র পণ্ডিত, যিনি ‘দাদাঠাকুর’ নামেই একদা প্রায় কিংবদন্তি হয়ে উঠেছিলেন বঙ্গ সমাজে ; তাঁর স্থাপিত ‘পণ্ডিত প্রেস’ থেকে ছাপা হয়ে বেরুত ‘জঙ্গীপুর সংবাদ’, ‘বিদূষক’ পত্রিকা, ‘বোতল পুরাণ’ আদি। তিনিই একাধারে প্রকাশক, সম্পাদক, প্রুফ রিডার, লেখক। প্রচার ও পায়ে হেঁটে এ রাস্তা ও রাস্তা ঘুরে বিক্রির দায়িত্বও তিনি নিজের কাঁধেই নিয়েছিলেন। দাদাঠাকুর ছিলেন দৈবী গাঙ্গুলীর একেবারে যেন ঘরের ছেলের মতোই। অনেকেই একথা জানেন নিজস্ব প্রেস (পণ্ডিত প্রেস) খোলার আগে কতো স্ট্রাগল তাঁকে করতে হয়েছিল। তবে প্রতিষ্ঠা বলতে যা বোঝায়, মানে অর্থনৈতিক দিক দিয়ে, তার ধার তিনি ধারেননি কোনোদিন। বীরভূমের ধরমপুর গ্রাম থেকে মুর্শিদাবাদের দহরপুরে চলে আসেন তাঁরা। শৈশবেই অনাথ হন। রঘুনাথগঞ্জে থাকতেন তাঁর কাকা রসিকলালের বাড়িতে, যিনি অকৃত্রিম ভালবাসা দিয়ে তাঁকে মানুষ করেন। রঘুনাথগঞ্জে থাকার সময়ই দৈবী গাঙ্গুলীদের সাথে তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি হয় ও পরে এই গাঙ্গুলীবাড়িতেও তিনি আপনজনের মতো বেশ কিছুদিন ছিলেন। ফলে গড়ে উঠেছিল এক ধরনের আত্মীয়তা, বা হয়ত তার চেয়েও বেশি কিছু। তখনও তিনি বিদূষক হিসেবে, প্রকাশক-সম্পাদক-সংবাদসেবী হিসেবে, বিদ্রুপাত্মক কবি, গীতিকার ও গায়ক হিসেবে খ্যাতিমান হননি। ‘জঙ্গীপুর সংবাদ’, ‘বিদূষক’ আদি পত্রিকা তখনও আলোর মুখ দেখেনি। পরে তাঁকে দেখা যাবে অন্য ভূমিকায়। সমাজকে তীব্র কটাক্ষ করে, শ্লেষ ও বিদ্রুপ হেনে বোতল আকৃতির ‘বোতল পুরাণ’ লিখে, কষ্টার্জিত পয়সায় ছাপিয়ে, প্রায় সামান্য লাভে বা বিনা লাভে কলকাতার রাস্তায় রাস্তায় ফেরি করে বেড়াচ্ছেন।

আমাদের সৌভাগ্য, এরকম মহিরুহ–সদৃশ ব্যক্তিত্ব অনেকবার আমাদের প্রপিতামহের দক্ষিণ শালমারার কোয়ার্টারে ও পরে গৌরীপুরের বাসাবাড়িতেও এসেছেন। দু-চারদিন করে থেকেছেন প্রত্যেকবার, তাস খেলেছেন, রঙ্গ-তামাশা করেছেন। আসার একটা আপাত উদ্দেশ্য ছিল আর সেটা হল আমাদের থান্নাকে রঘুনাথগঞ্জে, বাপের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া, বা কখনও বাপের বাড়ি থেকে গৌরীপুরের শ্বশুরালয়ে পৌঁছে দেয়া। প্রথমবার নাকি এক অদ্ভুত সাজে এসেছিলেন, সঙ্গে ছিল বাবার এক মামা। হাঁটুর ওপর ময়লা ধুতি, গলায় তেল চিটচিটে গামছা জড়ানো। গাঙ্গুলীবাড়ির চাকরের বেশে, থান্নার ভাই সেই মামাকে ধমকাতে ধমকাতে এসেছিলেন যাতে সত্য পরিচয় সবার সামনে কোনোভাবেই তিনি প্রকাশ না করেন। দু-বিঘে সাত কাঠা জমির ওপর বাড়ি — বাড়ির দুটো মহল। তিনি যখন বহির্মহলে ঢুকছেন মামার ইয়া বড় পোটলা কাঁধে করে, তখন থান্না তাঁকে অন্দর মহলের দরজায় দাঁড়িয়ে লক্ষ করছেন ও চিনতে একটুও ভুল করছেন না। দাদাঠাকুরের এহেন ছদ্মবেশ দেখে থান্না আঁচলে মুখ লুকিয়ে হাসতে থাকেন ও  সেই মামাও সকলের সামনে প্রকাশ করে ফেলেন তাঁর আসল পরিচয়। পরিচয় ফাঁস হলে পরে, শুনেছি, আচ্ছা করে বকেছিলেন সেই মামাকে।

দাদাঠাকুর ছিলেন থান্নার অতি আদরের পণ্ডিতদা। দাদাঠাকুরও শুনেছি বোনটিকে অত্যধিক স্নেহ করতেন। যেমন আদরের ছোটবোনেরা হয়। দাদাঠাকুর ২৭ এপ্রিল, ১৯৬৮ সনে মরদেহ ত্যাগ করেন। তাঁর জীবদ্দশাতেই, ইং ১৯৬২ সনে সম্ভবত, ‘দাদাঠাকুর’ নামে তাঁর জীবন আধারিত একটি সিনেমা নির্মিত হয়। পরিচালক ছিলেন সুধীর মুখার্জি। দশম জাতীয় চলচ্চিত্র উৎসবে পুরস্কৃতও হয়েছিল সে ছবি। নাম ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন সেকালের আরেক কিংবদন্তি, অভিনেতা ছবি বিশ্বাস। কী বলব, দুর্দান্ত অভিনয় যাকে বলে। দুর্ভাগ্যবশত, ছবিটি রিলিজ করার আগেই ছবি বিশ্বাস এক দুর্ঘটনায় মারা যান।

ছবিটি বিভিন্ন সিনেমা হল ঘুরতে ঘুরতে একদিন গৌরীপুর জয়শ্রী সিনেমা হলেও এল। পরে যেটা, আমাদের আমলে, নাম পাল্টে উর্বি সিনেমাহল হয়েছিল। এই সিনেমা তখন দলেবলে, পরিবার পরিজনসহ, সকলেই দেখে আসছে। আমাদের বাড়ি থেকেও অনেকেই দেখতে গিয়েছে সে ছবি। কিন্তু, শত অনুরোধেও থান্না যেতে চাইলেন না কিছুতেই। বারে বারেই এক কথা — “পণ্ডিতদার সঙ্গে কত তাস খেলেছি, কত দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেছে … সিনেমা আর কী দেখব?”

দাদাঠাকুর ধরাধাম থেকে বিদায় নেবার তিন কি চার বছর আগে কলকাতার বরাহনগরে ইং ১৯৬৩-৬৪ সন নাগাদ থান্না পাড়ি জমান পরপারে। থান্নার, শুনেছি, দিনের অধিকাংশ সময়ই কাটত ঠাকুরঘরে। সারাদিন ধ্যানজপ। শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের একনিষ্ঠ ভক্ত, মৃত্যুর পর তাঁর ইচ্ছানুসারেই তাঁর লৌকিক শরীরের দাহকার্যও হয় কাশীপুর মহাশ্মশানে। দাদু মারা যান ৯১ বছর বয়সে, ইং ১৯৭৬ সনে, গৌরীপুরে।

Tags: উত্তর-পূর্বগদাধরের বাউদিয়াশিবাশিস চট্টোপাধ্যায়
Previous Post

প্রবুদ্ধসুন্দর কর || চতুর্বিংশতি পর্ব

Next Post

অমিতাভ দেব চৌধুরী || একাদশ পর্ব

Daruharidra

Daruharidra

Next Post
অমিতাভ দেব চৌধুরী || একাদশ পর্ব

অমিতাভ দেব চৌধুরী || একাদশ পর্ব

Comments 9

  1. Amitabh Ranjan Kanu says:
    12 months ago

    Flawless. Please, continue. It’s not only a personal account, but also an account of the past. You are recreating a gone past.

    Reply
    • Sibasish Chatterjee says:
      12 months ago

      Thank you, Amitabh, for your encouraging words. I’m putting all my efforts to these write ups these days. Most of the time I live in the past… kind of innate nature and you’re aware of that. I’ll try my best to make it a worthy read. Once again, thanks.

      Reply
  2. Susmita Chakraborty says:
    12 months ago

    Excellent. Enriched to learn so many things ….and need to know many more.

    Reply
    • Sibasish Chatterjee says:
      11 months ago

      Thanks a lot, Susmita Chakraborty.

      Reply
  3. রবীন বসু says:
    12 months ago

    সুন্দর সাবলীল স্মৃতি কথন। অনেক কিছু জানলাম। অভিনন্দন জানাই 🙏

    Reply
    • Sibasish Chatterjee says:
      11 months ago

      আপনাকে অনেক ধন্যবাদ, রবীনবাবু।

      Reply
  4. সুশান্ত কর says:
    12 months ago

    বেশ ভালো লাগছে। সামাজিক ইতিহাসও উঠে আসছে। পড়বার আগ্রহ বেড়ে গেল ‌।

    Reply
    • Sibasish Chatterjee says:
      11 months ago

      অনেক ধন্যবাদ, সুশান্তবাবু

      Reply
  5. Kapotakshi Brahmachary Chakraborty says:
    10 months ago

    পড়ছি এক এক পর্ব, মুগ্ধতায় ভরে যাচ্ছে মন। দারুহরিদ্রা কে ধন্যবাদ এই অপরিসীম মূল্যবান লেখাগুলো পাঠকের সামনে তুলে ধরার জন্য.৷ আপনাকেও অনেক অনেক শুভেচ্ছা . , 😊

    Reply

Leave a Reply Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

No Result
View All Result

RECENT POSTS

মেখলা পরা মেয়ে || শ্রীযুধাজিৎ || অন্তিম পর্ব

মেখলা পরা মেয়ে || শ্রীযুধাজিৎ || অন্তিম পর্ব

15/04/2022

সঞ্জয় চক্রবর্তী || অন্তিম পর্ব

09/04/2022
মেখলা পরা মেয়ে || শ্রীযুধাজিৎ || দ্বাবিংশতি পর্ব

মেখলা পরা মেয়ে || শ্রীযুধাজিৎ || দ্বাবিংশতি পর্ব

08/04/2022

সঞ্জয় চক্রবর্তী || নবম পর্ব

02/04/2022
মেখলা পরা মেয়ে || শ্রীযুধাজিৎ || একবিংশতি পর্ব

মেখলা পরা মেয়ে || শ্রীযুধাজিৎ || একবিংশতি পর্ব

01/04/2022

সঞ্জয় চক্রবর্তী || অষ্টম পর্ব

27/03/2022
মেখলা পরা মেয়ে || শ্রীযুধাজিৎ || বিংশতি পর্ব

মেখলা পরা মেয়ে || শ্রীযুধাজিৎ || বিংশতি পর্ব

25/03/2022
সঞ্জয় চক্রবর্তী || সপ্তম পর্ব

সঞ্জয় চক্রবর্তী || সপ্তম পর্ব

20/03/2022
মেখলা পরা মেয়ে || শ্রীযুধাজিৎ || উনবিংশতি পর্ব

মেখলা পরা মেয়ে || শ্রীযুধাজিৎ || উনবিংশতি পর্ব

18/03/2022
ষষ্ঠ পর্ব || সঞ্জয় চক্রবর্তী

ষষ্ঠ পর্ব || সঞ্জয় চক্রবর্তী

13/03/2022

RECENT VIDEOS

https://www.youtube.com/watch?v=77ZozI0rw7w
Daruharidra

Follow Us

আমাদের ঠিকানা

দারুহরিদ্রা
কুঞ্জেশ্বর লেন
(বরাকভ্যালি একাডেমির নিকটবর্তী)
নতুন ভকতপুর, চেংকুড়ি রোড
শিলচর, কাছাড়, আসাম
পিন-788005

ডাউনলোড করুন

সাবস্ক্রাইব

Your E-mail Address
Field is required!
Field is required!
Submit
  • আমাদের সম্পর্কে
  • লেখা পাঠানো
  • যোগাযোগ

Copyright © All rights reserved Daruharidra | Development by Prosenjit Nath

No Result
View All Result
  • ধান্যগৃহ
  • কবিতা
  • গল্প
  • গদ্য
  • প্রবন্ধ
  • উপন্যাস
  • সাক্ষাৎ পাতা
  • অনুবাদ পাতা
  • আর্কাইভ
  • আমাদের সম্পর্কে
    • লেখা পাঠানো
    • যোগাযোগ

Copyright © All rights reserved Daruharidra | Development by Prosenjit Nath