২৪.
বাবার প্রাইভেট ইসলামিক হিস্ট্রি পরীক্ষার প্রস্তুতি জোরকদমে। স্কুল থেকে এসে হাত-পা ধুয়ে চা টিফিন খেয়েই পড়তে বসে যান। মাঝে মাঝে হাত-পা ধুতে ধুতে আমাকে বলতেন, বাবা কইতেন মুসলমানদের কাছ থিকা আমরার বেশ কিছু শিখনের আছে। এর মধ্যে একটা হইল অজু। এই যে নমাজের আগে মুসলমানেরা অজু করে, এতে শরীল শীতল হয়। মনোযোগ বাড়ে। পড়াশোনা করার আগে সবসময় হাত-পা ধুইয়া বইবি। ঠাকুরদা বা ঠাকুরমার কথা বলতে বাবা কখনোই আমাকে তোর ঠাকুরদা বা তোর ঠাকুরমা, এরকম বলতেন না। আর প্রায়ই বনমালী করের গল্প করতেন। এই বনমালী কর বাবার দাদু। বাবার ঠাকুরদা জগবন্ধু করেরা তিন ভাই। বনমালী, জগবন্ধু, বৃন্দাবন। বাবা এই বনমালী করের কাছেই ছোটোবেলায় লালিত পালিত হয়েছেন। রাতে ঘুমাতেনও তাঁর সঙ্গে। বনমালী ছিলেন দার্শনিক গোছের মানুষ। আফিমের নেশা ছিল। তখন আগরতলায় অনেক মুদি দোকানেও আফিম পাওয়া যেত। পূর্ব পাকিস্তান থেকে আগরতলার উজান অভয়নগরে এসে থিতু হয়েছিল এই একান্নবর্তী পরিবার। পরে যৌথতা ভেঙে যাওয়ার সময় বাবা ঠাকুরদাকে বলেছিলেন, আপনের সামান্য কিছু যা-ই আছে, সব কাকারার মধ্যে ভাগ কইরা দেন। আপনে শুধু আমার সঙ্গে থাকেন। গোটা যৌথ পরিবারটির বটগাছ ছিলেন ঠাকুরদা। আর অ্যাডমিন ছিলেন বৃন্দাবন করের বড়ো ছেলে শচীন্দ্র। অস্তিত্বের প্রশ্নে এই কায়স্থ পরিবারে কীভাবে কাংস্যকার বৃত্তি ঢুকে পড়েছিল, তা জানা যায়নি। ভৈরব বাজারে আমাদের পারিবারিক তামা-কাঁসার বাসনপত্রের একটি দোকান ছিল। এদেশে আসার পর তখনকার আগরতলায় কাঁসারিপট্টিতেও ছোট্ট একটি দোকান নিয়ে ঠাকুরদা সেই ব্যবসা সামলাতেন। ঠাকুরদার মৃত্যুর পর শিক্ষকতার চাকরির পাশাপাশি বাবা এই দোকানটি আর ধরে রাখতে পারেননি। বিক্রি করে দেওয়া হয়েছিল। বাবা প্রথম চাকরি পেয়ে বিলোনিয়া চলে যাওয়ার আগে বনমালী করের আফিমের জন্যে মাসিক বাঁধা দোকান ঠিক করে দিয়েছিলেন। বাবা সৎসঙ্গের দীক্ষা নেওয়ার পর বনমালী করকে প্রণাম করে জানাতেই তিনি বলেছিলেন, ভাই কও তো দেখি তোমার গুরুদেবের কথা শুনি। শোনার পর বেশ কিছু সময় চুপ করে ছিলেন। তাঁর চোখেমুখে নাকি ফুটে উঠেছিল আনন্দের অভিব্যক্তি। বাবাকে বলেছিলেন, ভাই, তুমি সদগুরু পাইছো।
সন্ধ্যায় বাবা আর আমি একসঙ্গেই পড়তে বসতাম। বাবা শব্দ করেই পড়তেন। আমিও তাই। রাত দশটা সাড়ে দশটা পর্যন্ত বাবার পড়াশোনা চলত। ভোরের প্রার্থনার পর সকাল ন-টা পর্যন্ত আবার। বাবার সঙ্গে রঞ্জিত স্যারও পরীক্ষার্থী। রঞ্জিত সূত্রধর বলতে গেলে বাবার নিত্য সহচর। কোলকাতা সূর্য সেন স্ট্রিটের সত্যদার কোচিং থেকে নোটস আসে। প্রাইভেট মাস্টার্সে তখন সত্যদার খুব নামডাক। বাবার কাছে শুনেছি, গত দু-বছর কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে প্রাইভেট ইসলামিক হিস্ট্রিতে এম এ পরীক্ষায় ত্রিপুরাতে পাসের হার শূন্য। বাবার পড়া শুনতে শুনতে অনেক নোটস-ই আমার মুখস্থ হয়ে গেছিল। টেনের ইতিহাসের কিছু কিছু নোটসে বাবার নোটস থেকে ক্রিটিকদের কোটেশন টুকে নিতাম। বাবার সশব্দে নোটস শুনতে শুনতে এটা বুঝতে পেরেছিলাম, যে-কোনো ক্ষমতার নেপথ্যে অন্তর্ঘাতই নিয়তি। ইসলামিক শাসনের একটি করুণ মৃত্যু আমি আজও ভুলতে পারি না। জনৈক সুলতান হাবানা নামের এক নারীর মুখে আঙুর পুরে দিয়েছিলেন। সেই আঙুর গলায় আটকে সেই নারী শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা যান। মনে হত, মানুষের মৃত্যুর কার্যকারণ এক অসহায় দৃশ্য মাত্র। যেহেতু কালীপদ ও হরিপদ চৌধুরীর বাড়ির মাঝখানে কোনো বেড়া বা পাঁচিল ছিল না, লাগোয়া মণিপুরি বসতির অনেকেই জুন্টুদাদের বাড়ির উঠোন ও রাস্তা শর্টকাট হিসেবে ব্যবহার করত। সকাল সন্ধ্যায় বাবার সশব্দে পড়াশোনা শুনে মণিপুরি ছাত্রছাত্রীরা খুব অবাকই হত। নগেন তো অবাক হয়ে আমাকে একদিন বলেই ফেলল, স্যার এত কিতা পড়ে বে? বাবার পরীক্ষা শুনে নগেনের আর হাসি থামতে চায় না।
একদিন সাবরুটিনের ক্লাসে হঠাৎই রতন স্যার আমাদের ক্লাস টেনে এসে হাজির। স্যারের মুখে সবসময় একটি সরু মিষ্টি হাসি লেগেই থাকত। মান বাংলায় কথা বলতেন। তবুও কথায় কুমিল্লার টান। সিলেট, কুমিল্লা, নোয়াখালির টান সহজে যেতে চায় না। যতই লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করা হোক না কেন গোপাল ভাঁড়ের গল্পের সেই সড়া অন্ধা অছি-র সেই ল্যাং খাওয়া উড়ের পরিচয়ের মতো তা বেরিয়ে পড়বেই। স্যার প্রথমেই আমাদের জিজ্ঞেস করলেন, বলো, বিপ্লব মানে কী? গোটা ক্লাস চুপ। এত জানা, এত শোনা, শব্দের অর্থ বলতে পারছি না কেউ? বাজারবারে হালাহালি বাজারে আর এস পি-র অহীন্দ্র ভট চোঙ ফুঁকে ফুঁকে এত বিপ্লব বিপ্লব বলে চিৎকার করেন, সি পি আই এমের নেতারা বিপ্লব, সমাজতন্ত্র, কায়েমি স্বার্থ, বুর্জোয়া, ধনিক শ্রেণি বলে বলে এত ভাষণ দেয় হালাহালিতে, সেই বিপ্লব শব্দের অর্থ বলতে পারছি না! স্যার তখনো থেমে আছেন। ক্লাস টেনের মানসম্মানের ব্যাপার। সবাই জানে, এই ব্যাচ মাধ্যমিকে ভালো রেজাল্ট করবে। চোখের সামনে সহপাঠী রিংকুর জামাইবাবু কমলপুরের ভট্টাচার্য পাড়ার বিপ্লব ভটের মুখ ভেসে উঠল। বিয়ের পর কয়েকমাস আগেই ইভাদিদের বাড়ি এসেছিলেন। ইভাদি রিংকুর জ্যাঠতুতো দিদি। বিপ্লব ভট আমাদের নিয়ে গিয়ে সন্ধ্যায় স্বপনপুরীতে কাঠের বক্সে সিনেমা দেখিয়েছিলেন। সাহস জড়ো করে উঠে দাঁড়ালাম। বললাম, স্যার বিপ্লব মানে আন্দোলন। স্যার মুচকি হেসে বললেন, হয়নি। হয়নি! আস্তে আস্তে সারা ক্লাসে চোখ ঘোরাতে ঘোরাতে স্যার বললেন, বিপ্লব মানে পরিবর্তন। সবাই থ। আমার মনে হল, বেশ বড়োসড়ো ঝাঁকানি দিয়ে গেল কেউ। স্কুল ছুটির পরও পরিবর্তন শব্দটিই মাথায় ঘুরছে। এই যে আমাদের পাঠ্যবই পাল্টে যাচ্ছে, এই যে গৌরীশংকর স্যার ও অমল স্যার বদলি হয়ে আগরতলা চলে গেলেন, এই যে আমরা নাইন থেকে টেনে, এই যে পঞ্চুর গলার স্বর কেমন যেন পাল্টে যাচ্ছে; সবই কি বিপ্লব? অহীন্দ্র ভট তাহলে কোন্ বিপ্লবের কথা বলেন? এম এল এ রুদ্রেশ্বর দাস তাহলে কী চান? সবই তো পাল্টে যায়। এই প্রশ্নে কয়েকদিন বেশ ঘোরের মধ্যে কেটে গেল।
হালাহালিতে আমি পানের বরজ বা পানের বর দেখিনি। প্রথম পানের বর আমি দেখি, দুরাইছড়া শিববাড়ি পেরিয়ে বাবার বন্ধু শৈলেন স্যারের পাড়ায়। বেশ অবাকই হয়েছিলাম। অন্য সব গাছ, লতাপাতাই প্রকৃতিতে উন্মুক্ত। কিন্তু পানের চারাগুলোকে বাঁশের বেড়া দিয়ে চারপাশ ও উপর থেকে হালকা ছনের ছাউনি দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে! ধলাই উপত্যকায় এই পানচাষি ও বিক্রেতা বারুজীবীরা এসেছিলেন সিলেট ও হবিগঞ্জ থেকে। কিছু পরিবার সিলেটের মৌলভিবাজার থেকেও এসেছিল। এদের বেশিরভাগই থাকেন কমলপুর মহকুমার কান্দিগ্রাম, ভুবনছড়া ও নোয়াগাঁও এলাকায়। বারুজীবীদের সবাই কায়স্থদের পদবিই ব্যবহার করেন। শুধু কমলপুর মহকুমাতেই নয়, সিলেট ও হবিগঞ্জ লাগোয়া ধর্মনগর, কৈলাসহর, খোয়াইতেও এই সম্প্রদায়ের লোকেরা এসে বসতি ও পারিবারিক পানচাষ ও ব্যবসা শুরু করেছিলেন। ত্রিপুরার কুমারঘাটও পানের জন্য বিখ্যাত। তবে কুমারঘাটের বারুজীবীরা অনেকেই এসেছিলেন চট্টগ্রামের মহেশখালি থেকে। মহেশখালি দ্বীপটিও তৎকালীন পূর্ববঙ্গে পান চাষের জন্যে বিখ্যাত ছিল। কুমারঘাটের বারুজীবীরা নতুন বরজে পান চাষ শুরু করার আগে ও দুর্গাপূজার নবমীতিথি শুরু হওয়ার আগে দেবী বসুমতীর উদ্দেশ্যে পুজো দেন। শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত গ্রন্থে বারুজীবীদের প্রসঙ্গে অচ্যুতচরণ লিখেছিলেন, বারূজীগণ বর প্রস্তুত করতঃ পাণের ব্যবসায় করে বলিয়া বরজ বা বারূই নামে কথিত হয়। বারূজীগণ নবশায়ক শ্রেণীর অন্তর্গত। ইহাদের মধ্যে ভদ্র, মিত্র, দত্ত, নন্দী, দেব, ইত্যাদি উপাধির প্রচল দৃষ্টে কেহ কেহ কায়স্থ হইতেই ইহাদের উদ্ভব অনুমান করেন। শিক্ষিত বারূজীগণ মধ্যে (পশ্চিমবঙ্গে) বৈশ্য বারূজীসভা প্রতিষ্ঠিত হওয়ায়, ইহাদিগকে বৈশ্য বর্ণ বলা অযৌক্তিক হয় নাই। শ্রীহট্টে বারূজীগণ কায়স্থ বলিয়া পরিচয় দিতেই অধিক আগ্রহান্বিত। এইরূপে কায়স্থ বলিয়া আত্মগোপন করায় ১৮৯১ খৃষ্টাব্দে সমগ্র আসাম প্রদেশে বারূজী সংজ্ঞায় ৪৪২৯ ব্যক্তিকে মাত্র পাওয়া গিয়াছিল। ১৯০১ অব্দে ইহাদের সংখ্যা শ্রীহট্ট জিলায় ১৬৩৪৬ জন ; (তন্মধ্যে পুং ৮৩৩৮ এবং স্ত্রী ৮০৮৮ জন।)। অভিধানে নবশায়ক শ্রেণি বলতে নবশাক বা নবশাখ। সদগোপ, মালাকার, তেলি, তাঁতি, ময়রা, বারুই, কুম্ভকার, কর্মকার, নাপিত; এই নয়টি শ্রেণি। এই নবশায়ক শ্রেণির সহায়তায় পরশুরাম একুশ বার ক্ষত্রিয় নিধন করে পৃথিবীকে নিঃক্ষত্রিয় করেছিলেন। পরাশর সংহিতাতে এই নবশায়ক শ্রেণির স্পষ্টীকরণ আছে। মুকুন্দরামের চণ্ডীমঙ্গলেও এই বারুই সম্প্রদায়ের উল্লেখ রয়েছে। বারুই নিবসে পুরে/ বরজ নির্মাণ করে…। নগরপত্তনের সময় কালকেতু এই বারুজীবী সম্প্রদায়কেও স্থান দিয়েছিলেন।
পান ও সুপারি বাঙালির সমাজ জীবনের বিভিন্ন মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানে সুদূর অতীত থেকেই জড়িয়ে রয়েছে। বাঙালির বিয়ের অন্যতম অঙ্গ পানখিলি অনুষ্ঠানেও বিয়ের গানে পান, সুপারি ও চুন, সর্তা বা জাঁপির জন্মবৃত্তান্ত গীত হয়। পান মূলত ভারতবর্ষের ঔষধি গুণসম্পন্ন একটি কৃষিব্যবস্থা। সুপারি সম্ভবত ভারতের বাইরে থেকেই আসত। ভাষার ইতিবৃত্ত গ্রন্থে সুকুমার সেন পশ্চিম ভারতে সুর্পারক বা শূর্পারক বন্দরের কথা উল্লেখ করেছেন যে বন্দর হয়ে সুপারি ভারতে আমদানি হত। সেই থেকেও সুপারি শব্দটি আসতে পারে। এই সুপারিই উড়িষ্যায় সুপুরি। সিলেটি বিয়ের গানে লঙ্কায় আছিল গুয়া আনে হনুমান, এরকম চরণও পাওয়া যায়। পশ্চিমবঙ্গেও বারুজীবীরা কায়স্থদের অনেক পদবিই ব্যবহার করেন। অনেকে আবার পদবি সরাসরি বারুই লেখেন। কুলশাস্ত্র নিয়ে বাবার বরাবরই জানার ঝোঁক ছিল। বাবার কাছ থেকে যতটুকু শুনেছি, বিপ্র পিতা ও বৈশ্য মাতার মিলনে করণ সম্প্রদায়। করণ ও বৈশ্যের মিলনে তাম্বুলী বা তামুলি। করণ ও তামুলি মিশে বারুজীবী বা বারুই। পশ্চিমবঙ্গে তামুলিদের মধ্যে অনেকেই সেন, পিড়ি, পাল, ঘোষ ইত্যাদি পদবিও ব্যবহার করেন। কায়স্থদের সঙ্গে বারুইদের বিবাহ স্বীকৃত ছিল না। হালাহালি ও লাগোয়া এলাকায় বেশ কিছু বারুই পরিবার পারিবারিক অন্য পেশাই বেছে নিয়েছিল। কমলপুরের নোয়াগাঁও এলাকার বারুজীবীরাও তাই। কান্দিগ্রাম, ভুবনছড়া, দুরাই শিববাড়ি ছাড়াও কাটালুৎমা, আভাঙ্গা, শান্তিরবাজার, কাইমাছড়া এলাকাগুলিতে পানচাষের বরজ আছে। দুর্গাপূজার অষ্টমীতে বংশপরম্পরায় এই পানচাষিরা বরজ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে রাখেন। নবমী তিথি স্পর্শের আগেই বরজের ভেতর ফলমূল দিয়ে ভোগ দেওয়া হয়। এরপর বরজের দরজা বন্ধ করে চাষিরা চলে আসেন। দশমীর পর বরজের দরজা খুলে পানপাতা পেড়ে এনে বাজারে বিক্রি করে সেই টাকায় পরিবারের সবাই মিষ্টিমুখ করেন। ভাবি, এজন্যেই কি চণ্ডী গ্রন্থে দুর্গার আরেক নাম পর্ণশবরী? শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত গ্রন্থে বারুজীবীদের সম্পর্কে লিখতে গিয়ে অচ্যুতচরণ পান শব্দের বানান লিখেছেন পাণ। চর্যাপদে ও প্রাচীন বাংলায় মূর্ধন্য ণ লেখার ঝোঁক লক্ষ করা যায়। সংস্কৃত পর্ণ থেকে প্রাকৃত পণ্ণ হয়ে পাণ হয়ে এই পান।
একদিন অঙ্কের ক্লাসে পরিতোষ স্যার আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, দুটি সমকোণী ত্রিভুজ কী কী শর্তে সর্বসম? উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, এক. সাধারণ বাহু সমান। দুই. ত্রিভুজ দুটির অতিভুজ সমান। স্যার বললেন, আর? বললাম, আর কিছু না। স্যার একটু রেগে গিয়ে বললেন, ত্রিভুজ দুইটার কোণ নব্বই ডিগ্রি। আমি বললাম, স্যার, সমকোণী ত্রিভুজ মানেই তো কোণ নব্বই ডিগ্রি! স্যারের চোখমুখ কঠিন হয়ে উঠল। বললেন, দাঁড়াইয়া থাক্। খুব অপমান লাগছিল। বিনা দোষে শাস্তি। ঘণ্টা পড়ার পাঁচ মিনিট আগে স্যারকে বললাম, বাইরে যাই স্যার। বেরিয়ে সোজা বাবার রুমে। বাবাকে গিয়ে ঘটনা বললাম। শুনে বাবা বললেন, ইউ আর রাইট। যা ক্লাসে যা। ক্লাসে আর গেলাম না জেদ করেই। বাবা ছিলেন অঙ্ক আর ইংরেজির তুখোড় টিচার। প্রমোশনের আগে বাড়িতে ও ছাত্রছাত্রীদের বাড়ি গিয়ে প্রাইভেট পড়াতেন। বেশিরভাগই এই সাবজেক্টই পড়তে আসত। কত কম্পার্টমেন্টাল ও এক্সটারনাল পরীক্ষার্থী মেয়েদের বিয়ে আটকে থাকত শুধু অঙ্ক আর ইংরেজিতে পাস করার জন্যে। বাবা তাদের অবলীলায় বিয়ের পিঁড়িতে বসিয়েছেন। বাবা ছিলেন আমারও মুশকিল আসান দয়াল মানিক পির। পরিতোষ স্যার একদিন ক্লাসে চুম্বকের চ্যাপ্টার পড়াচ্ছিলেন। পড়ানো শেষ করে স্যার বললেন, ক্লিয়ার? কারো কোনো প্রশ্ন? পাগলা কাজল চট করে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, স্যার, এমন কোনো আছে নি যেটা মানুষরেও টানিয়া লইয়া যায়? কাজলের কথায় হালকা তোতলামি ছিল। কেউ হাসতেও পারছি না। স্যার বললেন, আছে। আছে! কাজল উত্তেজনায় টানটান। আমরা সব ঘাড় ঘুরিয়ে কাজলকে দেখছিলাম। স্যার বেশ কোমলভাবে বললেন, মানুষের ভালোবাসাই তো চুম্বক। ভালোবাসাই তো মানুষকে কাছে টানে। এই প্রথম স্যারকে একজন প্রেমিক বলে মনে হচ্ছিল। সজল যে বিটলা এটা পরিতোষ স্যার বেশ বুঝতে পেরে গেছিলেন। প্রতিদিনই ক্লাসের শেষ দু-তিন মিনিট সজলকে দাঁড় করিয়ে সজলের বিটলামি উপভোগ করতেন। আমরাও সজলের কথায় হেসে গড়িয়ে পড়তাম। একদিন অঙ্কের অবজেক্টিভ টাইপ কিছু একটা প্রশ্নের উত্তর দিতে না পারায় সজল স্যারের হাতে মার খেয়ে স্যারকে সাহস করে বলেই ফেলল, রোজ ক্লাসের শেষে আমার সঙ্গে আর ফাইজলামি কইরেন না। সজলের কথা শুনে স্যারও খুব গম্ভীর। ক-দিন পরেই সাবরুটিনের ক্লাসে স্যার আমাদের এস এস এস পি ক্লাস নিতে এলেন। এই ক্লাসে গান, আবৃত্তি, কমিক, কিছু না কিছু ছাত্রদের করতেই হত। সেদিন সজলের পালা। স্যার সজলকে গাইতে বললেন। এতটুকু দেরি না করেই সজল গান ধরল, একে একে মিলিয়ে গেল শূন্য পূরণ হল না/ গুরু তোমার পাঠশালাতে অঙ্ক শেখা হল না…। স্যার বেরিয়ে যাওয়ার পর সবাই হাসিতে ফেটে পড়ল।
ক্রমশ…
রম্যরচনার অনবদ্য উদাহরণ ….নির্মল আনন্দ ছড়ানো প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত
বাহ্