আমার দাদু পূর্ণচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ছিলেন ছয় ছেলেমেয়ের বাপ, ফলে যা হয়, স্বাভাবিকভাবেই আর্থিক দিক থেকে বিপর্যস্ত। যা বেতন পেতেন তাতে কুলতো না। সংসারের এই দুর্বিষহ হাল, আর্থিক অনটন বাবাদের তিন ভাই তিন বোনের মাথায় খুব ছোট থেকেই বেশ করে ঢুকে গিয়েছিল। দাদু তাঁর তিন ছেলের নাম রেখেছিলেন মিলিয়ে — মণি, চুনি ও পান্না। তখনকার দিনে কত রকমের যে নামের বাহার ছিল। সবার নামের সঙ্গেই আবার একটা করে ‘লাল’, অর্থাৎ গিয়ে দাঁড়াল — মণিলাল, চুনিলাল ও পান্নালাল। চন্দ্র, ভূষণ, নাথ এধরনের মধ্যনামে বাঙালিয়ানা খুঁজে পাওয়া যায়, কিন্তু ‘লাল’ বাঙালিদের মধ্যে কম। আবার বাঙালিদের মধ্যনাম প্রথম, মুখ্য নামটির সঙ্গে জুড়ে যায়। লালযুক্ত নাম কানে এলে হিন্দিভাষী, দেহাতি মনে হওয়া স্বাভাবিক। লাল, লালা, লাল্লা (শিশু অর্থে) এখনও আকছার পাওয়া যায় উত্তর ভারতে। শরৎচন্দ্র ‘দেবদাস’ উপন্যাসে ‘চুনিলাল’ চরিত্র সৃষ্টি করেছিলেন, ভাগ্যিস! বাঙালিদের মধ্যে পান্নালাল কয়েকজনকে তবু পেয়েছি — তাঁদের মধ্যে একজন তো বিখ্যাত পান্নালাল ভট্টাচার্য যাঁর শ্যামা সঙ্গীত আমরা পুরোনো গ্রামোফোনে ডিস্ক রেকর্ড চালিয়ে গোল হয়ে শুনতাম ছোটবেলায়। বাবাদের তিন বোন যথাক্রমে ঊষা, উমা ও ইলা। বড়পিসি ঊষাকে চোখের দেখাও দেখিনি এ জীবনে। আমার জন্মের অনেক বছর আগেই গৌরীপুরে, বাপের বাড়িতে চতুর্থ সন্তানজন্মের প্রায় এক মাসের মাথায় তিনি মারা যান। বাবাদের ছ’ভাইবোনের মধ্যে একমাত্র আমার কাকু পান্নাই এখনও বেঁচে আছেন। আমার ছোটপিসি ইলা, গল্পকার তুষার পুরকায়স্থর শাশুড়িও, বিবাহিত জীবনের অধিকাংশ সময় পার করেন পাণ্ডুর রেল কোয়ার্টারে। শেষ জীবনে কখনও মালিগাঁও চারআলির বিশাল হাউজিং-এর মেয়ের ফ্ল্যাটে, কখনও ছেলের ভাড়াবাড়ি, আনন্দনগরে। মারা যাওয়ার প্রায় দু’বছর মতো আগে একদিন দেখা করতে গিয়েছি। তো আমাকে উদ্দেশ্য করে হঠাৎই সেদিন বলে উঠলেন — তুই তো লিখিস-টিখিস। আমাদের বাড়ির কাহিনী, বংশের কাহিনী লিখবি না? এই পিসির মুখেই আমাদের বংশলতা ও আনুষঙ্গিক বহু বিষয়ে অনেক কথা আমি শুনেছি। ছোটকাকুর মুখেও শুনেছি, যার কিছুটা সরাসরি, বাকিটা ফোনে। সে যাই হোক, আমার ছোটকাকু পান্নালাল চট্টোপাধ্যায়ের পরিচয়টা একটু দিই। তিনি দীর্ঘকাল ধরে শিলচর টিচার্স ট্রেনিং কলেজের অধ্যাপক ছিলেন। চাকরি জীবনের শেষ প্রান্তে পৌঁছে অধ্যক্ষও হন ও অধ্যক্ষপদে থেকেই অবসর গ্রহণ করেন। বলতে গেলে প্রায় গোটা জীবনটাই সপরিবারে পার করেছেন শিলচর শহরে। নিজস্ব বাড়ি করেছিলেন শিলচরের মেহেরপুরে। সে বাড়িতে জীবনে একবারই আমার যাওয়া হয়েছে। এম এ পড়ার সময় পরিচিতা একজনের বিবাহের কন্যাযাত্রী হয়ে শিলচর যাই। পল্টনবাজার থেকে নেটওয়ার্ক ট্র্যাভেলসের লাক্সারি বাসে চড়ে, শিলং হয়ে, রাস্তায় কুখ্যাত কয়লাগাড়ির যানজটে প্রায় সারারাত আটকে থেকে পরদিন সকালে পৌঁছে যাই স্বপ্নের মতো।
এখন অবশ্য কাকুর সে বাড়ি আর নেই। শিলচরের পাট চুকিয়ে কাকু এখন থাকেন কলকাতার নিঃশ্বাসের কাছে, গড়িয়ায়।

আমার বাবা চুনি ছিলেন ভাইদের মধ্যে মেজো। স্বভাবের দিক দিয়ে ছিলেন অত্যন্ত শান্ত প্রকৃতির। কিন্তু ভিতরে ছিল একটা সদাসক্রিয় বাউল মন। যে সংসার তিনি পেতেছিলেন আমার মায়ের সঙ্গে, সেটাকে বাউলের সংসার বলাই ভালো। বাউলরা সংসার-জীবনের মাঠে স্বচ্ছন্দ হয় না মোটেই, অনিচ্ছাকৃত ‘ফাউল’ করে কখনও ‘হলুদ কার্ড’ দ্যাখে, কখনও বা আবার ‘লাল কার্ড’ দেখে আউট হয়ে যায়। বাবার জীবনটাও ছিল অবিকল তাই। ভাগ্যাকাশে হলুদ-লাল কার্ডের ঝিকিমিকি ছিল, তাতে অবশ্য দমে যাবার পাত্র তিনি ছিলেন না। সারাজীবন ধরে সরকারি-বেসরকারি নানা চাকরি করেছেন। সিপিডব্লিউডি (CPWD) বিভাগে ছিলেন বহুদিন, তারপর কি মতিগতি হল, ছেড়ে দিয়ে একেবারে ঝাড়া হাত-পা। অতঃপর অন্য কোথাও কাজ খুঁজে নিলেন। প্রথমে ঢুকেছিলেন পুলিশে এবং সেটা মাত্র ১৫ বছর বয়সে ম্যাট্রিক পাশ করার পরপরই। দাদু খেপে যাওয়াতে সে চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে রংপুর কারমাইকেল কলেজে (অধুনা বাংলাদেশ) ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হন। বাবা সেখানে থাকতেন রংপুর রামকৃষ্ণ মিশনে। সঙ্গে গৌরীপুরের অভিন্নহৃদয় বন্ধু হিতেন্দ্র নারায়ণ রায় (হিটু)। পরে বিএসসি পড়ার তাগিদে আরেক হরিহর-আত্মা বন্ধু রেবতীমোহন দত্তচৌধুরীও চলে আসে রংপুরে। বাবাকে যদিও বিএসসি সম্পূর্ণ করার বাসনা স্থগিত রাখতে হয়। এই রেবতীমোহনই পরবর্তী জীবনে প্রখ্যাত অসমিয়া সাহিত্যিক শীলভদ্র, ‘মধুপুর বহুদূর’ ছোটগল্প সংকলনের জন্য যিনি সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার পেয়েছিলেন ১৯৯৪ সনে। ২০০১ সনে লাভ করেন অসম উপত্যকা সাহিত্য পুরস্কারও। শীলভদ্রের ‘মধুপুর বহুদূর’ সংকলনের গল্পগুলির পরিকল্পনা অনেকটা হার্ডির ‘ওয়েসেক্স টেলস’ এর মতো। বলা হয়, কাল্পনিক ওয়েসেক্সের পেছনে ছিল দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিম ইংল্যান্ডের ডরসেট, সমারসেট, হ্যাম্পশায়ার আদি অঞ্চল। মধুপুরের ক্ষেত্রে শুধু নামটাই কাল্পনিক; এ নামের পেছনে প্রকৃতপক্ষে ছিল লেখকের আবাল্যের গৌরীপুর। আর ‘মধুপুর বহুদূর’-গ্রন্থের টাইটেল স্টোরিটিও কিন্তু মোটেও বানানো নয় — সেটা আসলে লেখকের জীবনেরই গল্প বা তাঁর আত্মজীবনীরই অংশবিশেষ। যাই হোক, বাবা, রেবতীমোহন ও হিতেন রায় — তিনজনই ছিলেন গৌরীপুর পি সি ইন্সটিটিউশনের তুখোড় ছাত্র। বাবার স্কুল জীবনের প্রিয় বন্ধুদের মধ্যে রেবতীমোহন, হিতেন রায় ছাড়াও আরেকজন ছিলেন শ্যামা ঘোষ। এই তিনজনকে খুব কাছ থেকে দেখেছি। বাবার এই তিন বন্ধুই সারাজীবন উচ্চপদে চাকরি করেছেন।

শ্যামা ঘোষ ছিলেন লম্বা ও স্বাস্থ্যবান। ভীষণ রগুড়ে মানুষ। বাড়ির সীমানার মধ্যে প্রবেশ করা মাত্র দূর থেকে ‘ডার্লিং,ডার্লিং’ হাঁক শোনা যেত। খ্যাপানোর ছলে ওই নামে ডাকতেন আমার মা-কে। বাবা মুচকি মুচকি হাসতেন। বন্ধুদের মধ্যে একমাত্র বাবাই ছিলেন জীবনভরের আউলিয়া। টাকা-পয়সা ছিল না, সম্বল ও সঞ্চয়ও নেই। মা গজগজ করতেন দুঃচিন্তায় আর বাবার তখন একটাই রেডিমেড উত্তর থাকত মুখে —” শোনো, মাদাম দ্যফার্জ, পাখি আর দরবেশ সঞ্চয় করে না”। ডিকেন্সের ‘এ টেল অব টু সিটিজ’ উপন্যাসের নায়িকার নাম মাদাম দ্যফার্জ। মা-কে, রসিকতা করে কখনও কখনও বাবা ওই নামে ডাকতেন। টাকার অভাবে কোনও কাজ আটকে গেলে বলতেন — “চিন্তা ক’রো না, টাকা ভূতে জোগাবে”। এখন ভাবি, বাবা কি সত্যিই পাখি ছিল, নাকি সাধু-দরবেশ! টাকার জন্য কখনও যে তাঁকে খুব বেগ পেতে হয়েছে এমনও নয়। সময় মতো সেই ভূত ঠিক টাকা জুগিয়ে গেছে, যেন ভূতই ছিল বাবার গৌরী সেন।

বন্ধু রেবতী মোহন দত্ত চৌধুরী লেখালিখির জগতে খ্যাতির শীর্ষে উঠে গেলেও গৌরীপুরে এলে বাড়িতে দেখা করতে আসতেন। চিঠিপত্রে তেমন বিশেষ যোগাযোগ ছিল না। যখন আসতেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডা হত। আমরা ছোটবেলায় এরকম বন্ধুমিলনের সাক্ষী ছিলাম একাধিকবার। লেখক হিসেবে রেবতীমোহনের উত্থানের পেছনে প্রথিতযশা অসমিয়া সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও পত্রিকা-সম্পাদক হোমেন বরগোহাঁইয়ের প্রভূত অবদান ছিল, যেটি রেবতীমোহন তাঁর একাধিক লেখায় স্বীকার করে গেছেন। সম্পাদকের আসল কাজটা কি সেটা হোমেন বরগোহাঁই তাঁর কাজের মাধ্যমে দেখিয়ে গেছেন।
প্রসঙ্গে ফেরা যাক। ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেই বাবা আবারও একটি চাকরি জুটিয়ে ফেললেন। সেটা ১৯৪২ সন। বাবার তখন বয়স প্রায় ১৮ ছুঁই ছুঁই। সিপিডব্লিউডি বিভাগে (CPWD) তাঁর প্রথম পোস্টিং হয় রূপসীতে। রূপসী এরোড্রোমের রানওয়ে, জঙ্গলের মধ্যে যুদ্ধবিমান লুকিয়ে রাখার পকেট ইত্যাদি নির্মাণের কাজ চলছে। কাজ যখন প্রায় শেষের দিকে, একদিন সন্ধেবেলা নির্জন কোয়ার্টারে বসে আপনমনে বাবা গলা ছেড়ে গান গাইছেন—
“ভুলানা না, ইয়াদ করো না করো
সতানা না, ইয়াদ করো না করো
আজকে ইয়াদ সে কহে দো কল কল
কসম তুমহারি আজ স্যো ভুল
যানা না না, ইয়াদ করো না করো
বিরহ কি রতিয়া, কটে নাহি মো সে
ছোটা সা দিল মেরা, মিলা হ্যায় তো সে
সতানা না, ইয়াদ করো না করো
ভুলানা না, ইয়াদ করো না করো
সামনের রাস্তা দিয়ে তখন সান্ধ্যভ্রমণে বেরিয়েছিলেন পাঞ্জাবি ‘বড়া সাহিব’ — বাবার অফিসের বস্ (Boss)। জঙ্গলাকীর্ণ আসাম মুলুকের এই নিভৃতভূমে কে গাইছে এমন গান! তিনি ভিতরে ঢুকে পড়লেন। তাঁকে দেখে বাবা তখন তটস্থ প্রায়, প্রমাদ গুনছেন মনে মনে। সাহেব হঠাৎ বিছানার পাশে বসে পড়লেন, বললেন — ফিন গাও, বেটা। ডরো মত। বাবা আবার গাইতে শুরু করলেন — ভুলানা না, সতানা না… বড় সাহেবের চোখে তখন অঝোর ধারায় জল। একটার পর একটা গান গেয়ে গেলেন বাবা, বিশেষ করে তাঁর প্রিয় গানগুলি, এমনকি বাংলা গানও, যেমন — চাঁদে রে ধরিতে আকাশে বাঁধিনু বাসা, কুছ খানে দে রাজা, কুছ পিনে দে রাজা, ভুলি কেমনে, আজো যেমনে, বেদনা সনে রহিল আঁকা ইত্যাদি।
ব্যস, বাবার টেম্পোরারি চাকরি পাকা হয়ে গেল। শুধু তাই নয়, বাবার প্রমোশন হয়ে নতুন পোস্টিং হল লখ্নৌতে। লখ্নৌতে বাবা বেশ ক’বছর ছিলেন। গান ভালোবেসে গানের শহরে ঘুরে বেড়াতেন জলসায় জলসায়। আখতারি বাঈয়ের (বেগম আখতার) গজল-ঠুমরি তাঁর খুব প্রিয় ছিল। বিশেষ করে সেই গানগুলো — ইয়াদ পিয়া কি আয়ে, এ্যায় মোহাব্বত তেরে অঞ্জাম পে রোনা আয়া, কোয়েলিয়া মত কর পুকার… আরও কতো গান। ওস্তাদ বড়ে গোলাম আলি খাঁ সাহেব মঞ্চে উঠেই নাকি শুরু করতেন “হরি ওম তৎসৎ”। এসব বাবার মুখেই শোনা। যেদিন জলসার টিকিট জুটত না, প্যান্ডেলের বাইরে, চাদর মুড়ি দিয়ে, শীতে জবুথবু বসে থাকতেন বাবা। বহু মানুষ এভাবেই নাকি মণ্ডপের বাইরে বুঁদ হয়ে বসে থাকত সঙ্গীতের নেশায়। এভাবে কতো রাত যে কাবার হয়ে যেত।
এমনই গানপাগল ছিলেন আমাদের বাবা।
সারাজীবন ধরে কখনও রূপসী, কখনও লখ্নৌ, কখনও দিল্লি-কানপুর — ঘুরে বেরিয়েছেন চাকরিসূত্রে। বিয়ের আগে কিছুদিনের জন্য থিতু হন কলকাতায়। বাবা আগের সব চাকরি ছেড়ে তখন ইণ্ডিয়া ওয়েইং স্কেলস আ্যন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানির (India Weighing Scales & Engineering Company Ltd) করেসপন্ডেন্স ক্লার্ক। পোস্টিং হাওড়ায়। তখনই বাবা নিজের বিয়েটা সেরে ফেলেন। বিয়ের পরে প্রথমে বরাহনগর, পরে মধ্যমগ্রামে থাকতেন। মধ্যমগ্রাম থেকে কলকাতা-হাওড়া লোকাল ট্রেনে ডেলি প্যাসেঞ্জারি করে চাকরি বাঁচিয়ে রাখতেন। তখনও পর্যন্ত তিনি গ্র্যাজুয়েট নন। তাই চাকরির ফাঁকে ফাঁকে, বিশেষত লোকাল ট্রেনে আসা-যাওয়ার পথে তিনি পড়াশোনা করতেন। এভাবেই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাবা বি এ পাশ করেন ১৯৬৩ সনে। প্রথম তিন সন্তানের জন্মের পর ১৯৬৪ সন নাগাদ আবার পাড়ি জমান — যাকে বলে সটান ‘ব্যাক টু ম্যাথিউজিলা’— দাদুর কাছে, গৌরীপুরে। দাদু দীর্ঘজীবী ছিলেন — বুড়ো হলেও বেশ শক্তপোক্ত। যাকে বলে, পরিবারের মাথা, প্যাট্রিয়ার্ক। ছেলেরা সব ভয়ে তটস্থ থাকত। আমাদের জেঠু মণিলাল চট্টোপাধ্যায়ও চাকরি করতেন সিপিডব্লিউডি-তে। ভারত-ভূটান সংযোগী কাঁচা রাস্তাগুলোর পিচঢালাইয়ের কাজে তাঁকে একেকবারে দীর্ঘদিন ধরে বাইরে থাকতে হত। তিনি বাইরে থাকলেও জেঠিমা ও তাঁর ছয় ছেলে এক মেয়ে প্রথম প্রথম গৌরীপুরের বাড়িতেই থাকত। পরে তাঁরা কলকাতায় বরাহনগরের ষষ্ঠীতলায় বাড়ি ভাড়া করে চলে যায়। তবে জেঠু মাঝে মাঝেই গৌরীপুরে আসতেন। চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের পর যখন আসতেন বহুদিন ধরে থাকতেন। যাই হোক, বাবা তখন হাওড়ায় চাকরি করেন। বিয়ে করেছেন খিদিরপুরের মেয়ে, আমার মা-কে। আমার বড়দার জন্ম হয়েছে সবে। ঠিক তখনই দাদু অনেকটা এরকম বয়ানে চিঠি লেখেন বাবাকে:
“বৃদ্ধ হইয়াছি। বিশাল বাটিতে আমি আর ভাইয়া, সম্পূর্ণ একা। শরীর ও মন খুব ভাল যাইতেছে না। ভয় হয়, এমতাবস্থায় মরিলে পুত্রের হাতের জল না পাইয়া হয়তো আমাকে পুত নরকেই যাইতে হইবে। চাকরি ছাড়িয়া গৌরীপুরের বাটিতে বাস করাই পুত্র হিসাবে তোমার আশু কর্তব্য বলিয়া জানিও । এখানে ৺নারায়ণের ইচ্ছায় গ্রাসাচ্ছাদনের নিমিত্ত ঠিক কিছু না কিছু ঠিক জুটিয়া যাইবে।”
ব্যস, বাবা হাতে স্বর্গ পেলেন যেন। কিছুদিনের মধ্যে প্রথমে একাই ফিরে এলেন গৌরীপুরে। মধ্যমগ্রামের ভাড়াবাড়িতে তখন মা ও তাঁর প্রথম সন্তান সম্পূর্ণ একা। এটা ১৯৬০ সনের কথা। একটু দূরের মামাবাড়িতে তখন সবার মনে দুশ্চিন্তা — জামাই ফিরে আসবে তো? এদিকে ইন্ডিয়া ওয়েইং স্কেল কোম্পানি চিঠির পর চিঠি পাঠিয়ে যাচ্ছে। আসলে, দাদু ধুবড়িতে জমি কিনে বাড়ি তৈরিতে হাত দিয়েছিলেন। কিন্তু বয়সের বাধায় ও কাজের চাপে হয়ত চাইছিলেন অন্তত এক ছেলে কাছে থাকুক। তাহলে দাঁড়াল এই যে বাবা আপাতত গৌরীপুরে একটা কাজ পেলেন আর সেটা হল গৃহ নির্মাণের দেখাশোনা। কিন্তু কিছুদিন পর, কী মাথায় চাপল, আবার কলকাতায় ফিরে পূর্বের চাকরিতে বহাল হলেন। কিন্তু ১৯৬৪ সনে তিনি সপরিবারে পাকাপাকি ভাবে কলকাতা ত্যাগ করলেন। যাকে বলে, ফাইনাল এক্সিট। কোম্পানি থেকে অনেক চিঠি, রিমাইন্ডার, ওয়ার্নিং এল। বাবা আর কর্ণপাত করলেন না। বাবার তরফে সেসব চিঠির কোনও রিপ্লাইও গেল না কলকাতায়। ফলে কলকাতার চাকরি গোল্লায় গেল।
আসলে, ব্যাপার হল, কোনও চাকরিতেই বেশিদিন টিঁকে থাকার মতো মানুষ বাবা তিনি ছিলেন না। ছুতো খুঁজতেন সবসময় কী করে পায়ের বেড়ি ভেঙে পালানো যায়। স্বভাবটাই যে তেমন ছিল। টাকা-পয়সা, চাকরি, বাড়ি-গাড়ির কোনও মোহ কোনোদিন গ্রাস করতে পারেনি বাবাকে। বাউলপনা স্বভাবদোষে তাঁকে ভুগতেও হয়েছে আজীবন, পুড়তে হয়েছে ধিকি ধিকি। তাঁর তিল তিল করে পুড়ে শেষ হয়ে যাওয়ার সাক্ষী ছিলাম আমরা পাঁচ ভাইবোন আর আমার মা।
গৌরীপুরে ফিরে এসে সে বছরই শহর থেকে চার কিঃমিঃ দূরের নবগঠিত আশারিকান্দি হাইস্কুলে শিক্ষক পদে যোগ দেন ও পরের বছরই সে স্কুলের হেডমাস্টার হয়ে যান। সদ্য গজিয়ে ওঠা স্কুল — না আছে ভালো বিল্ডিং, না আর কিছু। বেতনও প্রায় না থাকার মতোই। ফলে প্রাইভেটে ছাত্র পড়িয়েই দিন গুজরান করতে হচ্ছিল। কিছুদিনের মধ্যেই বাবা ধুবড়ি জেলার সমবায় আন্দোলনের সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে পড়েন। সমবায় আন্দোলনে তাঁর প্রভূত অবদানের কথা আজকের চরম অবনতির দিনে অনেকেই স্মরণ করেন। বউ-ছেলেপিলের সংসারে সেভাবে না জড়ালেও, শেষমেশ সেই বাউল বাঁধা পড়েছিল আরও অনেক বড় বিশ্ব-সংসারে।
বাড়িতে বাবার মন টিঁকত না একদম; যদিও বাড়িতেই দিনরাত প্রাইভেটে ছাত্র পড়াতে হত তাঁকে। অনেকগুলো পেটের ভাতের ব্যবস্থা তো করতে হবে। শেষের দিকে আর পারতেন না। ছাত্রদের কিছু একটা টাস্ক দিয়ে বেরিয়ে যেতেন। তখন পরিস্থিতি সামাল দিতে মাঠে নেমে বাবার ছাত্রদের পড়াতে বসত আমার দুই দাদা। বড়দা বাবলু (দেবাশিস চট্টোপাধ্যায়, শিক্ষক) তখন কলেজে পড়ে মাত্র, বাবার ছাত্রদের পড়াতে বসে যেত সকাল থেকে।
আমার মেজদা বাপ্পা ( স্নেহাশিস চট্টোপাধ্যায়, বর্তমানে আইওসিএল বঙ্গাইগাঁও রিফাইনারিতে কর্মরত) তখন নিজেই ক্লাশ নাইন, অথচ সেও অংক করাতে লেগে যেত ক্লাশ টেনের ছাত্রদের। এরকম করেই চলছিল বেশ কয়েক বছর। আমি ও আমার ছোটবোন মৌ — আমরা দু-জন হরলিক্স-মল্টোভা না খেয়েও গায়েগতরে বেশ বেড়ে উঠছি আস্তে আস্তে। দাদারা ধুবড়ি বিএন কলেজে পড়ে। আসা-যাওয়ার ভাড়া কনসেশন দিয়ে ৫০+৫০=১ টাকা। ভাড়ার টাকাটা কোনোভাবে চেয়েচিন্তে জুটে গেলেও টিফিনের জন্য এক্সট্রা পয়সা জুটত না ওদের। সকালে তেল-নুন-লঙ্কা চটকে রেশনের আতপ চালের দুটো ভাত মুখে দিয়েই ওরা ছুটত। তারপর সারাদিন আর কিছু পেটে পড়ত না। ফলে কিছু না খেয়েই মুখ শুকিয়ে প্র্যাকটিক্যাল ক্লাশ করে ফিরতে ফিরতে সন্ধে গড়িয়ে যেত। মেজদা একদম রোগাপটকা, দাদার চেহারা একটু ভারিক্কি গোছের, বরাবর। দাদাকে অতো বোঝা যেত না, তবে মেজদার শুকনো মুখটা মাঝে মাঝে এখনও আমার মনে পড়ে। এই যা, বাবার প্রাইভেট পড়ানোর কথা পাড়তে গিয়ে আবার কতো কথা চলে এল। যা বলছিলাম, আমার ছোটবোন মৌ, কত আর বয়স, ইংরেজি গ্রামার দেখিয়ে দিত বুড়ো বুড়ো ছাত্রদের। আমি অবশ্য ওসবের ধারেকাছেই ঘেষতাম না। পড়াশোনায় আমি চিরদিন এ প্লাস বি হোলস্কয়ার। খালি ভাবতাম, কে যে আবিষ্কার করেছে এই পড়াশোনাটা! হাতের কাছে পেলে একদিন দিতাম আচ্ছা করে। পড়াশোনা আমার একদমই ভাল লাগত না। নিজেরই বিদ্যে নেই, আবার ছাত্র পড়ানো — নৈব নৈব চ। আপনি শুতে ঠাঁই নেই, শঙ্করাকে ডাকে। এ জীবনে যেটুকু বিদ্যে লাভ হয়েছে, সে ওই ছোটবোন মৌ দিনরাত আমার পেছনে লেগে থাকত বলে। আমার শুধু একটাই কাজ ছিল — সারাদিন মায়ের পিছন পিছন ঘোরা আর কেবলই ঘ্যানঘ্যান করা। ছোট থেকেই ভুগতাম — ওই যাকে চাইল্ডহুড অ্যাজমা বলে, ওই রোগে। যাক, পরে ফাঁক পেলে সে অধ্যায়েও ঢোকা যাবে। মৃত্যু থেকে জীবনের রাজপথে কী করে ফিরে আসে মানুষ — সে কাহিনী। তো যেটা বলছিলাম, বাবা ছাত্রদের অথৈ সমুদ্রে ফেলে রেখে বেরিয়ে যেতেন। তবে যাবেন আর কোথায়, বড়জোর শম্ভু কুড়ির চায়ের দোকান, তা নাহলে চাউলপট্টিতে বন্ধু শচীন দত্তর দোকান। বরাবরই শচীন দত্ত ছিলেন গৌরীপুর চকবাজার সমিতির প্রেসিডেন্ট। প্রেসিডেন্ট হলেও, লম্বা, সুঠাম, বলিষ্ঠ শরীরের অধিকারী হলেও, শচীন দত্তর চালের দোকানও কিন্তু একেবারেই চলত না। তথৈবচ অবস্থা, যাকে বলে। এখানকার স্থানীয় ভাষায় বললে বলতে হয় দোকানের অবস্থা ‘স্যাঙস্যাঙা’। বাবার হাত যেদিন শূন্য — আবার ঘরেও একফোঁটা চাল নেই, বাবা আমার বা আমার দাদাদের হাত দিয়ে শচীনবাবুর কাছে চিরকুট পাঠাতেন। হাতে চিরকুট ধরিয়ে দিয়ে বলতেন — শচীনবাবুর হাতে দিবি, মুখে কিছু বলতে হবে না। চিরকুটে লেখা থাকত — “শচীনবাবু, ঘরে চাউল নাই। দয়া করিয়া ২৫ কেজি চাউল বাকি করিয়া দিবেন”। তা, আমরা শচীনবাবুর হাতে লজ্জা লজ্জা মুখ করে সে চিরকুটখানা তুলে দিতাম। শচীন দত্ত মুখে কিছু বলতেন না, তবে তাঁর চোখেও কেমন একটা অসহায়তার ভাব ফুটে উঠত। ‘আয়’ — বলেই চাউলপট্টির গলিঘুঁজির ভিতরে লম্বা লম্বা পা ফেলে হাঁটা দিতেন। আমার তো ছোট ছোট পা — পেরে উঠি না। তারপর হয়ত ভেতরে এক মহাজনের দোকানে ঢুকে পড়তেন। মহাজন, গোলগাল চেহারা, উদোম উর্ধাঙ্গ, ভুড়িসমেত বসে আছেন। বুকের কাঁচাপাকা লোমে হাত বোলাতে বোলাতে কথা বলছেন। শচীন দত্ত দাঁড়িয়ে। একটু পরেই দেখতাম হাসি হাসি মুখ — ব্যাগভর্তি চাল নিয়ে শচীন দত্ত বেরিয়ে আসছেন। মনে আছে, সে চালের ব্যাগ টেনে টেনে প্রায় ১৫০ মিটার দূরে স্থিত আমাদের বাড়িতে বয়ে আনতেও খুব কষ্ট হত। লক্ষ করতাম, শত কষ্টেও বাবা ভয়ঙ্কর রকমের শান্ত ও নির্লিপ্ত। মানুষের ভিতরের উথালপাথাল সবসময় বাইরে থেকে বোঝা যায় না।
ত্রিনেশ দাশগুপ্ত ছিলেন পি সি ইন্সিটিউশনের হেডমাস্টার। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনী– প্রচণ্ড মেধাবী, গণিত শাস্ত্র গুলে খাওয়া মানুষ। ধুতি-পাঞ্জাবি পরতেন। তাঁর পায়ে কোনোদিন চটিজুতো দেখিনি। খালি পায়েই স্কুলে যেতেন, বাজারহাট করতেন। স্কুল তাঁর আমলে প্রাদেশিকৃত হয়নি, মানে বেতন ছিল না বললেই চলে। জমিদারিও নেই, জমিদারও নেই, ফলে ছাত্রদের যৎসামান্য মাসিক ফী-ই দিয়েই মেটাতে হত শিক্ষকদের মাসোহারা। রিটায়ারমেন্টের পর, যেহেতু পেনশনও নেই, সংসারের বেহাল দশা সামাল দিতে বাজারে ঢোকার মুখে নর্দমার ওপর কাঠের প্ল্যাঙ্কিং করা সারি সারি দোকানের একটি ভাড়া নিয়ে তিনি হোমিও চর্চা আরম্ভ করলেন। এদিকে তাঁর বাড়িতেও অনেকগুলো পেট, মানসিক অসুস্থ স্ত্রী। দু-বেলাই নিয়ম করে তিনি হোমিও বাক্স নিয়ে তাঁর সেই অন্ধকার ঘুপচি চেম্বারে বসতেন। কোনও কোনও দিন হয়ত একটি পেশেন্টেরও দেখা নেই। তবু তীর্থের কাকের মতো বসে থাকতেন। ভাঙা টেবিলে একটা মোটা বই, চোখে পাওয়ারি চশমা, চশমার ফাঁক দিয়ে পড়ছেন।
বাবা ছাত্রদের অংক ও ইংরেজি দুটোই পড়াতেন। শিক্ষক হিসেবে খুবই রেয়ার কম্বিনেশন। কদাচিৎ হলেও এরকম হয়েছে, আমার মেজদা খুব কঠিন কোনও অংক কিছুতেই সলভ্ করতে পারছে না। বাবাকে দিয়েছে, তো বাবাও সে অংকের কূলকিনারা খুঁজে পাচ্ছেন না। শেষে হয়ত আমার মেজদাকে বলতেন — যা, তিনাদার কাছে যা। তিনাদা মানে ত্রিনেশ দাশগুপ্ত। ত্রিনেশ দাশগুপ্ত বই থেকে চোখ তুলে অংকটায় চোখ বোলালেন একবার, তারপর খচখচ করে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই সলভ্ করে দিলেন। মুখে মৃদু মৃদু হাসি। সেই ত্রিনেশ মাস্টার অভাবে পড়ে মাঝে-মধ্যে বাবার কাছে টাকা ধার চাইতে আসতেন। একদিন এসে বললেন — চুনি, বিশটা টাকা হবে? খুব বিপদ, বুঝলি?
সেদিন বাবার হাতে পাঁচটা টাকাও নেই। বাবা সেকথা বিনয়পূর্বক জানাতেই ত্রিনেশ মাস্টার চলে যেতে উদ্যত হলেন। মুখ দিয়ে শুধু বের হল — বেশ। আজ মনে হয় ছেলেমেয়েগুলোকে অনাহারেই থাকতে হবে। এ কথা শোনামাত্র বাবার বুকে যেন বজ্রাঘাত হল, বললেন, তিনাদা, আপনি একটু এখানটায় বসুন তো, আমি দেখছি। তিনাদাকে চেয়ার ছেড়ে দিয়ে বাবা বেরিয়ে গেলেন বাজারের দিকে। বাজারের কারও কাছ থেকে ২০ টাকা ধার করে এনে ধার দিলেন তিনাদাকে। ত্রিনেশ মাস্টারের চোখের কোণে কি সেদিন চিকচিক করেছিল গদাধরের বালিধোয়া জল। জানি না, সত্যিই জানি না।
বাঃ! চমৎকার লেখা।
অনেক ধন্যবাদ
I have read all the serial writing of my brother Sibasish Chattopadhyay about our family history. While I was reading the 3rd episode of ‘Gadadharer baudia’ sitting in my office….my eyes filled with tears…my colleagues asked me ‘what happened ?’ I told them ‘nothing’ !!!!!
লিখতে লিখতে নিজেও কেঁদেছি, মেজদা।
স্মৃতি সততই মধুর। তোমাদের পরিবারের তিন প্রজন্মের চালচিত্রের বিবরণ পড়ে আমাদের মত বাস্তুহারা নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের জীবন যুদ্ধের ইতিহাসটাও চোখের সামনে ভেসে উঠছে। এখানেই লেখকের কৃতিত্ব।