৩৩.দারুহরিদ্রা :- আপনার আর কোনও বন্ধুর কথা মনে পড়ছে না?
অমিতাভ :- হ্যাঁ অবশ্যই। কয়েকজন ছিল এই নেশাবৃত্তের বাইরে। যেমন তৃণাঞ্জন চক্রবর্তী। অভিজিৎ কুন্ডু। কৌশিক গুহ। এরা তিনজনই আমার দু’ব্যাচ জুনিয়র। অভিজিৎ অর্থনীতির ছাত্র ছিল। ফটো তোলার অদ্ভুত স্বতঃস্ফূর্ত হাত ছিল তার। এখন দিল্লিতে অর্থনীতি পড়ায়। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় অর্থনীতি- রাজনীতি-সমাজতত্ত্ব নিয়ে প্রবন্ধ লেখে। অতি সম্প্রতি আনন্দবাজারে প্রকাশিত একটি প্রবন্ধের শেষ করেছিল আমার কবিতার এক উদ্ধৃতি দিয়ে। কৌশিক গুহ ছিল তুলনামূলক সাহিত্যের ছাত্র। রুশভাষা জানা আমার এই পণ্ডিত বন্ধুটি পাগলের মতো বই পড়ে। প্যাপিরাসের জীবনীগ্রন্থমালা সিরিজে তলস্তয় নিয়ে বই লিখে শঙ্খ ঘোষের উচ্ছ্বাসভরা ফোন পেয়েছিল। সে কথা আজও আমাদের ঘনিষ্ঠ বন্ধুমহলে গল্প হয়ে ঘোরে। তৃণাঞ্জন প্রায় কোনও নেশাই করত না। ও আর ওর দাদা নীলাঞ্জন দু-জনেই ফ্রেঞ্চ শিখেছিল। নীলাঞ্জন অবশ্য যাদবপুরের ছাত্র ছিল না। তৃণাঞ্জন কোনও কোনও রবিবারে আমার হস্টেলে চলে আসত। কেন জানো? হস্টেলের ক্যান্টিনে বেশিরভাগ রবিবারে বোঁদে বানানো হত। তৃণাঞ্জন আসত বোঁদে খেতে। নীৎসের ‘দাস স্পোক জরথুস্ত্র‘ বইটির দুরন্ত বঙ্গানুবাদ শুরু করেছিল সে। তৃণাঞ্জন ফ্রেঞ্চ পড়ায় কলকাতার আলিয়ঁসে। ও বিয়ে করেছে যশোধরা রায় চৌধুরীকে যার কবিতা তোমরা সবাই পড়েছ। প্রবুদ্ধটা ফাজিল। তৃণাঞ্জনের সূত্র ধরে ও যশোধরার সাক্ষাতে আমাকে যশোধরার ভাসুরঠাকুর বলে ডাকত। তৃণাঞ্জনের বাড়িতে আমি এত স্নেহ পেয়েছি যে বলবার নয়। তৃণাঞ্জন, পার্থ বন্দোপাধ্যায় আর পার্থর বন্ধু ভবানীপুরের সৌমিত্র সরকার — এদের বাড়িতে আমি প্রায় বাড়ির ছেলে হয়ে গিয়েছিলাম। সৌমিত্রর করা একটা ডকু-ফিচার আমার একটি কবিতার উদ্ধৃতি দিয়ে শুরু হয়েছিল। ছবিটি জাতীয়স্তরের একটি পুরস্কারও পেয়েছিল। আমার দুর্ভাগ্য, কলকাতা ছেড়ে আসায় সে ছবি আমার আজও দেখা হয়নি। যশোধরা যেবার শিলচর এল, আমার বাড়িতে একবেলার জন্য এসেছিল। নীলাঞ্জন একবার আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ে এক্সটারনাল হিসেবে পরীক্ষা নিতে এসেছিল। তখন একবেলা আমার বাড়িতে এসে দেখা করে গেছে। আরেকজনের কথা একটু বলি, অর্থনীতি বিভাগের ছাত্র। পার্থ চৌধুরীদা। আক্ষরিক অর্থেই প্রতিভাবান অংকবিদ। হস্টেলে আমার ঘরে অংকের বই নিয়ে চলে আসত। আমি ওর পড়া নিতাম। ভারী ভারী অংকের ডাক ওর সামনে ধরলে নিমেষে মনে মনে অংকটা কষে ফেলত। তারপর আমাকে বলত ‘দেখ তো আনসার মিলেছে কিনা?’ আনসার সবসময়ই নির্ভুল হত। পার্থদার জীবনে একমাত্র শখ ছিল: একটা বাড়ি বানাবে। তার সামনের লনে জোৎস্না রাতে চেয়ার টেবিলে বসে চাঁদের আলোয় অংক করবে। বলত, নোবেল কমিটি গণিতে মিছিমিছি পুরস্কারটা দিল না। বলত ‘নাহলে আমি অংকে নোবেল পেতামই রে!’ পার্থদার কথা মনে রেখেই আমি গণিত নিয়ে একটা সনেট লিখেছিলাম।
আর এই সনেটটা পড়ে আমার বন্ধু অমিতেশ সরকার যে পাঠ-প্রতিক্রিয়া পাঠিয়েছিল তাও তোমাদের এই ফাঁকে জানাই।
অমিতেশ সরকার যাদবপুর বাংলা বিভাগের অধ্যাপক পিনাকেশ সরকারের ছোট ভাই। রবীন্দ্রসঙ্গীত নিয়ে ওর তুখোড় কিছু বিশ্লেষণ আছে। শঙ্খ ঘোষের প্রশংসাধন্য ‘প্রাণের গানের ভাষা’ ওর লেখা অপূর্ব বই। অমিতেশ ছাড়া কে আর জানাতো বলো ‘নদী আপন বেগে পাগলপারা’ গানটি আসলে তো নদীর নয়, স্তব্ধ চাঁপার তরুর গান? এই গান তো অত দ্রুতলয়ে গাওয়া যেতে পারে না! অর্থ ঠিক রাখতে হলে এটাকে তো অনেক ঢিমে লয়ে গাইতে হবে। অবশ্য অমিতেশের মতো রবীন্দ্রগানের আর একজন নিপুণ পর্যটক আমাদের শুভপ্রসাদ নন্দী মজুমদারও। শুভর ডাকে অমিতেশ একবার উনিশে মে শিলচর এসে গেছে। গানও গেয়েছে। আমার থেকে প্রায় দশবছরের বড় হলেও অমিতেশকে আমি দাদা বলি না। প্রবুদ্ধই আমাদের মধ্যে যোগাযোগের সেতু। আর ভাবো, প্রবুদ্ধ, অমিতেশ কতটুকু ভালোবাসে আমায় যে ২০১১ সালে যাদবপুর–এর বাংলা বিভাগে রিফ্রেশার্স কোর্সে আমার নেওয়া ক্লাসে দু-জনেই স্রেফ শ্রোতা হিসেবে উপস্থিত থেকে আমাকে উৎসাহ জুগিয়েছিল।
৩৪.দারুহরিদ্রা :- যাদবপুর পর্বের পর এবারে আমরা জানতে চাইছি উত্তর-পূর্বের সাহিত্য বা লেখকবন্ধুদের সাথে যোগাযোগের সূত্রপাত কিভাবে হয়েছিল আপনার ?
অমিতাভ :- শিলচরের ছিল কমলা বুকস্টল। শিলং-এর চপলা। দুটোই বইয়ের দোকান, কিন্তু বিদ্যাদেবীর নামে নয়। ধনের দেবীর নামে। ওই চপলা বুক স্টলে আমি প্রথম পরিচিত হই উত্তর-পূর্বের লেখালেখির সঙ্গে। মনোতোষ চক্রবর্তীর বই ‘মেঘ কারো বাড়ি গাড়ি নয়’ ওখান থেকেই আমি কিনে আনি। তার মৌতাতে মজে যাই। প্রায় একইসময়ে চপলা থেকেই সাহিত্যের একটি কৃশকায় সংখ্যা আমার হস্তগত হয়। তাতে বীরেন্দ্রনাথ রক্ষিতের একটি দীর্ঘ গদ্যকবিতা পড়ে, এবং তার বেশিরভাগটা বুঝতে না পেরে আমার মাথা খারাপ হয়ে যায়। কবিতার প্রথম লাইনটি আজও মনে আছে, ‘বিভার রোডের কফিহাউসে দেখা হবে ঠিক পাঁচটায়’। গৌহাটি আমার মামা বাড়ি। শিলংও তাই। কলকাতায় যেতে–আসতে গৌহাটি ছুঁতেই হত। মামার বাড়িতেই উঠতাম। মামা বিভাস চন্দ্র দাস পুরকায়স্থ তখন পাণ্ডু কলেজের রসায়নের অধ্যাপক ছিলেন। তাঁর ভাড়া বাড়ির অল্প একটু পেছনে থাকতেন বীরেন্দ্রনাথ রক্ষিত। আর তাঁর পরবর্তী কালের নিজস্ব বাড়ির অনেককালের ভাড়াটে ‘একা এবং কয়েকজন’ পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক উদয়ন বিশ্বাস। মামার মালিগাঁও হিলসাইড কলোনির ভাড়া বাড়ি আর আদাবাড়ির নিজস্ব বাড়ির মাঝামাঝি মালিগাঁও চারিআলিতে থাকতেন গল্পপত্র ‘পূর্বদেশ’ পত্রিকার সম্পাদক অখিল দত্ত। এই সূত্রেই বীরেন্দ্রনাথ রক্ষিত, উদয়ন বিশ্বাস, অখিলদার সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়। উদয়নদারা সন্ধেবেলায় বসত মালিগাঁও চারিআলির একটা মিষ্টির দোকানে। উদয়ন বিশ্বাস, শ্যামল বিশ্বাস, দেবীপ্রসাদ সিংহ। ওখানে মাঝেমধ্যে আসতেন নাট্যকার প্রদ্যোত চক্রবর্তীও। আমার অকালপক্কতা সীমাহীন। আমি ওই বয়সেই দাদাদের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে পরম তৃপ্তিলাভ করতাম। পরবর্তীতে তাঁদের কোনও কোনও পানের আসরেও আমি সম্মানিত অতিথির আসনটি অধিকার করে বসি। একবার একজন দাদা ফন্দি করেছিলেন আমাকে একটু বেশি খাইয়ে আউট করে ছেড়ে দেওয়ার। আমি ব্যাপারটা আগে থেকেই বুঝে যাই এবং বিভিন্ন ছুতোয় গেলাসের মদ সঙ্গে নিয়ে তা দিয়ে মাটির উর্বরাশক্তি (?) কিঞ্চিৎ বাড়িয়ে মদ না–খেয়েই নেশা হওয়ার অভিনয় করি। পানের নয়, মিষ্টির দোকানের ওই আড্ডার সবচেয়ে আকর্ষক মানুষটি ছিলেন দেবীপ্রসাদ সিংহ। দুর্দান্ত গল্পকার। বস্তুত মুসলমান জীবন বাদ দিয়ে যে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার কথাসাহিত্য তৈরি হতে পারে না তা দেবীপ্রসাদই হাতে কলমে প্রমাণ করে গেছেন। দেবীপ্রসাদ আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব। কিন্ত তিনি কখনই বক্তা নন। সবসময়ই শ্রোতা। ভীষণ লাজুক, ভীষণ সজ্জন এই মানুষটি ইংরেজিতেও দারুণ লেখেন। এবং তিনি সিনেমার পোকা। আমি যতদিন ‘সাময়িক প্রসঙ্গ’-এর রবিবারের সাহিত্যবিভাগের সম্পাদনা করেছি, সিনেমা নিয়ে কোনও লেখা লেখাতে হলে প্রথমেই হাত পাততাম দেবীদার কাছে। দেবীদাদের একটি ফিল্ম সোসাইটিও ছিল। ওই মালিগাঁও চত্বরেই কোথাও তাঁদের সোসাইটি আয়োজিত কয়েকটি ফিল্ম শো দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার ছাত্রবয়সে। আশির দশকের একটা ছোট্ট ঘটনা বলি, তখনও বিদেশি বিতাড়ন আন্দোলন চলছে। আমার সেবার শীতের সময় বাড়ির জন্য হঠাৎ-মন-কেমন করায় ট্রেনে করে ফিরছিলাম। ট্রেন সম্ভবত লেট ছিল। বঙ্গাইগাঁও পেরিয়ে গৌহাটি ঢোকার মুখে মাঝে কোন একটা জায়গায় উন্মুক্ত প্রান্তরে আমাদের ট্রেনের দিকে ছুটে এসেছিল অজস্র মশাল। সেই গভীর রাতে যদি ট্রেনে আক্রমণ হত আমাদের বাঁচার কোনও কারণ থাকত না। হঠাৎ বুঝতে পারি ট্রেনের গতি প্রচণ্ড বেড়ে গেছে। মশাল হাতের অদৃশ্য মুখগুলি অনেক পেছনে চলে যাচ্ছে।
ছাত্রাবস্থায় সবারই একটা রোমান্টিক মন থাকে। সেই মন সম্ভব-অসম্ভবের সীমানাকে কল্পনা দিয়ে অতিক্রম করতে চায়। আমিও কল্পনা করতাম আমার ভূমির এই পলিটিকস অব আইডেন্টিটির দু-টো মুখ আমি অতিক্রম করব নিজের জীবন দিয়ে। যে দুই সাম্প্রদায়িকতা আমাদের কুরে কুরে খাচ্ছে, সেটাকে অতিক্রম করব, অন্তত নিজের জীবনে। একজন অসমিয়া মুসলিম মেয়েকে বিয়ে করার মাধ্যমে।
৩৫.দারুহরিদ্রা :- করলেন না কেন?
অমিতাভ :- সাহস হল না। তাছাড়া মেয়ে তো আর বই নয় বা মদ নয়! বইয়েরও যদি প্রাণ থাকত, তাহলে হয়ত দেখা যেত সব বই সব পাঠককে দিয়ে নিজেকে পড়িয়ে নিতে চাইছে না। মদেরও যদি প্রাণ থাকত, দেখা যেত সব মদ সবার ঠোঁটের সামনে নিজেকে মেলে ধরছে না। আশা করি আমি কী বলতে চাইলাম তোমরা বুঝতে পেরেছ।
৩৬.দারুহরিদ্রা :- আপনার সাথে ওখানেই কলকাতার সম্পর্ক শেষ?
অমিতাভ :- না না তা কী করে হয়? আমরা যারা উত্তর-পূর্বের বাঙালি, আমাদের তো দুইবাংলার প্রতি টান সব সময়ই সজাগ থাকে! আমি এরপর চাকরি পেয়ে যাই উধারবন্দ হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলে। প্রথমদিকে কিছুদিন শিলচর আর ই সি তেও ক্লাস নিয়েছিলাম। তখনও রিজিওনাল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ এন আই টি হয়নি। আমি একইসঙ্গে পিএইচ.ডির কাজ শুরু করি। আমার গাইড ছিলেন প্রখ্যাত অনুবাদক মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। আমার কাজের বিষয় ছিল বিংশ শতাব্দীর ইংরেজি ও আমেরিকান সায়েন্স ফিকশন। এই যেমন, রে ব্র্যাডবেরি, ফিলিপ কে. ডিক, উরসুলা কে. লেগুইন, জে জি ব্যালার্ড — এঁদের নিয়ে। তখনও ইন্টারনেটের যুগ আসেনি। এটা ১৯৮৯ সালের কথা। প্রায়ই কলকাতা যেতে হত। শিলচরে থেকে প্রয়োজনীয় বইপত্র পাওয়া অসম্ভব ছিল। চাকরি করতে করতে রিসার্চ করার এই এক হ্যাপা। দু-বার অবশ্য আমি হায়দরাবাদের আমেরিকান স্টাডিজ রিসার্চ সেন্টারের গ্রান্ট পেয়েছিলাম। হায়দরাবাদে গবেষকদের দেখতেন গোয়ানিজ (তাই তো?) পণ্ডিত আইজাক সিক্যুয়েরা। প্রথমবার যখন যাই, তাঁর ঘরে দ্বিতীয় দিনই আমার ডাক পড়ে। জানতে চান কার কাছে কী নিয়ে গবেষণা করছি। আমার কাছে থেকে উত্তর জেনে যা বলেছিলেন, এখনও স্পষ্ট মনে আছে। ‘দেন ইউ নিড নো গাইডেন্স ফ্রম মি’। তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগের মাস্টারমশাইরা নাকি, তাঁর মতে, অসাধারণ। আইজাক সিক্যুয়েরা স্যার খুব ভালো গান গাইতেন। একটা ডিনারপার্টি গানে গানে জমিয়ে দিয়েছিলেন।

মানব স্যারের কাছে বছরে দু-বার তো যেতে হতই। প্রতিবারই তাঁর বাড়িতে একদিন নেমন্তন্ন করে খাওয়াতেন। একবার গিয়ে দেখি সেখানে বিরাজ করছেন আমাদের সুজিৎদা। স্বয়ং সুজিৎ চৌধুরী। মানব স্যারের জীবনের শুরুর দিকের একটা খণ্ড, তোমরা জানো, কেটেছিল করিমগঞ্জ শহরে। এবং সুজিৎদার দাদা বিজিৎ চৌধুরী ছিলেন মানব স্যারের সহপাঠী। সেই সূত্রে এঁরা প্রায় একই পরিবারের সদস্যের মতো ছিলেন। সায়েন্স ফিকশন নিয়ে গবেষণা করার সূত্রে আমি ওই সময় খুব ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে এসেছিলাম সিদ্ধার্থ ঘোষেরও। সিদ্ধার্থ ঘোষ ‘এক্ষণ’ পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সুপুরুষ এই মানুষটি, যতদূর জানি, সত্তরের দশকে তাত্ত্বিক রাজনৈতিক কর্মী ছিলেন। তাঁর লেখা দু’টি বিখ্যাত বই হল ‘বাঙালির ফোটোগ্রাফি চর্চা’ আর ‘কলের শহর কলকাতা’। দুটোরই প্রকাশক আনন্দ পাবলিশার্স। ‘এক্ষণ’ এ সিদ্ধার্থদার সায়েন্স ফিকশন নিয়ে একটি প্রবন্ধ পড়ে আমি সোজা তাঁর অফিসে যাই। আমাদের মধ্যে একটি হার্দ্য সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সিদ্ধার্থ আমাকে গবেষণার কাজে সবরকমের সাহায্য করবেন বলে প্রতিশ্রুতি দেন। এবং আমাকে তাঁর যাদবপুরের বাড়িতে যেতে অনুরোধ করেন।

পরেরদিন শিলচরের ফ্লাইট ধরব। সকালেই সব কাজ শেষ হয়ে গেছে আমার। দিনটা ছিল ছুটির দিন। যাদবপুর কফিহাউসে গিয়ে বসে আছি, হঠাৎ মনে হল, আরে, সিদ্ধার্থদার বাড়ি তো এই চত্বরেই! এখন গেলে কেমন হয়? বন্ধুদের ডেকে ডেকে জিজ্ঞেস করলাম, সবাই সিদ্ধার্থ ঘোষকে নামে-মানুষে চেনে। কিন্তু কেউই তাঁর বাড়ির ঠিকানা জানে না। কফি খেতে খেতে জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছি। হঠাৎ দেখি হিন্দুস্থান সুইটস-এর সামনে ডাক পিওন। নিমেষে দোতলার সিঁড়ি তরতরিয়ে নেমে এলাম। দ্রুত রাস্তা পার হয়ে পিওনকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আচ্ছা, সিদ্ধার্থ ঘোষ যার আরেকটা নাম অমিতাভ ঘোষ, তিনি এখানেই কোথাও থাকেন না?’। পিওন আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ, আমার সঙ্গে আসুন, আপনি তাঁর বাড়ি খুঁজছেন তো? ব্যস, আমার হয়ে গেল। সেদিন সিদ্ধার্থদা আমাকে লেম-এর একটা বই উপহার দিয়েছিলেন। অদ্রীশ বর্ধন আর অনীশ দেবের ফোন নং দিয়ে তাঁদের কাছ থেকে সাহায্য চাইতে বলেছিলেন।
বেরিয়ে অদ্রীশ বর্ধনকে ফোন করলাম। আহঃ! আমার সেই স্বপ্নের নাম! ছোটোবেলায় ‘আশ্চর্য’ আর ‘ফ্যান্টাসটিক’–এ যার লেখা পড়তে গিয়ে ওই অদ্ভুত নামটির প্রতি প্রবল আকর্ষণ অনুভব করতাম। কিন্তু অদ্রীশ আমাকে এককথায় নিরাশ করলেন। সেই রবীন্দ্রনাথের প্ল্যানচেটের গল্পের মতো। ‘আমি মরে গিয়ে যা জেনেছি, তোমরা বেঁচে থেকে তাই জেনে নিতে চাও?’ — সেরকমই আর কী! অদ্রীশ বললেন, ‘ভাই, আমি এত বছর কষ্ট করে যেসব বইপত্র জমিয়েছি, আপনি কোনও কষ্ট না করেই তা পেয়ে যেতে চান? আমি আপনাকে দোবো না।’ অনীশ দেব, যিনি ঘটনাচক্রে এ বছরই প্রয়াত হয়েছেন, তিনি আবার ঠিক উল্টো আচরণ করলেন। আমাকে সোজা তাঁর বাড়িতে নেমন্তন্ন করলেন। ইত্যাদি ইত্যাদি।
ওই একইসময়ে আমার গল্প লেখার হাতেখড়ি হয়। জীবনের প্রথম গল্পটি লিখে দুরুদুরু বক্ষে সোজা চলে যাই ‘প্রতিক্ষণ’ অফিসে। দেবেশ রায় তখন প্রতিক্ষণের অঘোষিত কর্ণধার। ওই সময় আমি যা পাঠিয়েছি দেবেশ তাই প্রতিক্ষণে ছাপিয়েছেন। খুব বেশি লিখতাম না তখন। তবে একাধিক গল্প ও একটি দীর্ঘ কবিতা ছাপা হয়েছিল মনে পড়ে। এখন ভাবলে কিরকম রোমাঞ্চ হয়, দেবেশ রায় আমার একটি লেখারও কোথাও কোনও হাত ছোঁয়াননি। শুধু বানান সংশোধন করে দিয়েছিলেন।
আমি তখন উধারবন্দে চাকরি পেয়ে গেছি। দেবেশ এলেন ‘দিশারী’র আমন্ত্রণে, শিলচরে এক আলোচনা সভার আলোচক হয়ে। সন্ধেয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। শিলচর ডিস্ট্রিক্ট লাইব্রেরিতে। কলকাতায়ই পরিচয় হয়ে গিয়েছিল, আমাকে পেয়ে ডেকে নিয়েছিলেন তাঁর পাশের সিটটিতে। অনেকক্ষণ কথা বলেছিলেন, যেমন জেনে গিয়েছিলাম, এক একটি উপন্যাস মাথায় পুরো এসে যাবার পর দেবেশ যখন লিখতে বসতেন, তখন লেখা চলাকালীন সময়ে তিনি কোনও বই পড়তেন না। শুধু গান শুনতেন।

পরের বার গ্রীষ্মের বন্ধে কলকাতা গিয়ে সিদ্ধার্থদার সঙ্গে দেখা করলাম। সিদ্ধার্থদার কাছে সেবার আমার এই অতি সাধারণ জীবনের সবচেয়ে বড়, সবচেয়ে অসাধারণ খবরটি মজুত ছিল। বললেন, ‘মাণিকদাকে আপনার কথা বলেছিলাম, মাণিকদা রাজি হয়েছেন। আপনি মাণিকদার বাড়ি গিয়ে তাঁর লাইব্রেরি ব্যবহার করতে পারেন, অনেক সায়েন্স ফিকশনের বই পাবেন সেখানে।’ বুঝতেই পারছ মাণিকদা মানে সত্যজিৎ রায়।
৩৭.দারুহরিদ্রা :- তারপর?
অমিতাভ :- তারপর আর কী… তোমরা কি ভেবেছ আমি সেখানে গিয়েছিলাম? কোনও কোনও ক্ষেত্রে নেমন্তন্ন-পাওয়াটা খেতে-যাওয়ার চেয়েও বড় হয়ে ওঠে। নেমন্তন্ন পেলেই পেট ভরে যায়। খাবার আর ইচ্ছে থাকে না। আমারও ঠিক তাই হয়েছিল। আরও একটা কথা জানিয়ে রাখি, আমার পিএইচ. ডি করা হয়ে ওঠেনি। অবসর নেওয়ার পরে, ভাবছি, পিএইচ.ডি টা করে নিলে কেমন হয়? জানো তো, কাগজেপত্রে আমি এখনও যাদবপুরেরই আওতাধীন। মানে, অন্য কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতে গেলে আমার প্রথমেই যাদবপুরের সম্মতি আদায় করে নিতে হবে।
বৃত্তের বাইরেও কতো বৃত্তান্ত… সেই, শীতের দুপুরে jadavpur স্টেশন থেকে পাঁচপোতা গ্রাম। টাটকা গুড় থেকে… CHIVAS REGAL