প্রশ্নটা শুনে শিবানীর কপালে চিন্তার কুঞ্চন রেখা পড়ল। কেননা সে জানে তার সঙ্গে শান্তি কখনও অসমীয়া ভাষায় কথা বলে না। তা ছাড়া এখানকার সব অসমীয়া মেয়েই চমৎকার বাংলা বলতে পারে আঞ্চলিক টানসহ। মনে মনে বুঝল নেতাদের উস্কানি কি ভাবে সাধারণ মানুষের মনে ক্রিয়া করছে। মুখে হাসি টেনে বলল:
—শান্তি, এ বিচার নেতারাই করুন ভাই, আমরা সাধারণ মানুষ; আমাদের ওসবে জড়িয়ে না পড়াই ভাল। তা ছাড়া রাজ্যের সরকারী ভাষা কি হবে না হবে— মুখ্যমন্ত্রী চালিহার সঙ্গে সকল পার্টির এম, এল, এ, এম, এল সি-রা বসেই ঠিক করতে পারেন। কেননা যা কিছু বিল…..
শান্তি শিবানীকে কথা শেষ করতে না দিয়েই উত্তেজিত ভাবে বলে:
—কিন্তু তুমি জান না শিবানীদি, বেঙ্গলী লােক অসমত অসমীয়া ভাষা যাতে না হয় সে জন্য আন্দোলন করিছে।
শিবানী একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসে বলে:
—আন্দোলন ত’ করবেই ভাই, এ দেশে যে গণতান্ত্রিক শাসন। এখানে সবারই সব দাবী জানাবার অধিকার আছে। তা ছাড়া একটা শিশুও চিৎকার করে তার দাবী জানায় মায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে আর যে ভাষায় কথা বলা লক্ষ লক্ষ অসমীয়া লােক থাকে এখানে তারা তাদের দাবী জানাবে না কেন।
—দাবী জানাক, জানালে এই যে এই রকম উচিত শিক্ষা পাবে বলে জ্ঞানদা দাশ হাতের কাগজের একটা খবর দেখিয়ে দেয় শিবানীকে। শিবানী চোখ বুলাতে যায়, এমন সময় সুরতিয়া তার চা ও টোষ্ট সহ প্রবেশ করে। শিবানীর সামনে ধূমায়িত চা ও টোষ্টের প্লেট রেখে ও প্রস্থানােদ্যতা হলে আর একজন মেয়ে বলে:
—আমার একটা চা এনে দাও ত’ সুরতিয়া ?
—এখন লারবাে দিদিমণি— ঘর, বারাণ্ডা সব ঝাড় দিতে বাকী আছে।
—আহা, শিবানী দি ডাকলে ত’ বেশ সুড়ুৎ করে চলে আস?
—দেখ দিদিমণি, হামাকে ঘাটাবেনি বলে দিচ্ছি। কিসে আর কিসে— শিবানী দিদিমণির মত হােবে, তারপর বলো।
—আঃ সুরতিয়া, তাের কাজে যাত? এই যে রেখা, এই চাটা নাও তুমি ভাই।
রেখা কোন রকম সৌজন্য প্রকাশ না ক’রে চায়ের কাপটা টেনে নিয়ে তাতে ঠোঁট লাগায়। সুরতিয়া প্রস্থান করে। শিবানী টোষ্ট ধতে কাটতে কাটতে খবরের কাগজে চোখ বুলায়— সংবাদটায় দেখা যায় পঁচিশ তিরিশ জন লােকের এক জনতা বাঙ্গালী মণিহারী দোকানের মালিককে বাংলায় লেখা সাইন বোর্ড অপসারিত করতে বলে ব্যর্থ হয়ে তাকে তাড়া করে। ভীতসন্ত্রস্ত লােকটি পাশের এক বাড়ীতে আশ্রয় নিলে সে বাড়ীর উদ্দেশ্যে দুর্বৃত্তরা ঢিল ছুঁড়তে থাকে। এছাড়া আরও ছ’জন লােককেও জনতা নিগৃহীত করে। শিবানী সংবাদটা পড়ে শেষ করতে না করতেই সুরতিয়া আর এক কাপ চা নিয়ে ঘরে ঢুকে শিবানীর সামনে টেবিলে রেখে মুখ ঝামটা দিয়ে রেখাকে বলল:
—চা ত পিয়ে লিচ্ছ, রেখা দিদিমণি, ক্যান্টিনে তুমহার নামে লিখিয়ে দিয়েছি, হাঁ।
কথাটা বলেই মুখভঙ্গী করে সুরতিয়া চলে গেল। মেয়েরা তার সে ভঙ্গী দেখে জলতরঙ্গের মত হেসে উঠল। সুরতিয়ার বরাদ্দ এরূপ ব্যবহার মাঝে মধ্যে ওদের সইতে হয়। কেননা, সুপারিণ্টেণ্ডেন্ট ললিতা বরা— সুরতিয়ার রিপোের্টকে বেশ গুরুত্ব দেয়।
—কি শিবানী দি’, পড়লে ত। কাল বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ইউনিয়নের সভায় রিজোলিউশন পাশ করা হয়েছে— বেঙ্গলী ভাষার বিরুদ্ধে অসমীয়া ছাত্রছাত্রীদের সর্বস্য পণ করে আন্দোলন করতে হবে।
—কাজটা খুব ভাল হবে না ভাই। আসামে যে সকল বাংলা ভাষী লােকেরা বাস করছে তারাও ত’ অসমীয়াই।
—একথা ভুল, আসামের নেতা বরদলুই বলেছিলেন Assam for Assamese.
—কিন্তু জাতির জনক মহাত্মা গান্ধী তার প্রতিবাদ করেছিলেন। আর সাবধান-বাণীতে বলেছিলেন— এরকম মনােভাব হ’লে ভাষার প্রশ্নে ভারত আবার ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যাবে।
—আমরা আদার ব্যাপারী, জাহাজের খবর নেব কেন— আসামের ভাল-মন্দই শুধু ভাবতে পারি আমরা— সমগ্র ভারত নিয়ে ভাববে দিল্লীর নেতারা।
বিজ্ঞের মত বলে জ্ঞানদা।
বড় ঘড়িটায় ঢং ঢং করে সাতটা বাজতেই মেয়েরা উঠে পড়ে যে যার ঘরের দিকে চলে গেল দ্রুত পায়ে। কেননা ভাের সাতটা পর্যন্ত রিডিং রুমে কাগজ পড়তে পারে, তারপর পড়ার বই নিয়ে বসবার কড়া হুকুম আছে সুপারিণ্টেণ্ডেণ্ট ললিতা বরার।
ওরা চলে গেলে হঠাৎ শিবানীর দৃষ্টি পড়ল বাংলাভাষী অদ্ভুত মেধাবতী মেয়ে সহপাঠিনী ষােড়শী মধুছন্দার ওপর। ওর চোখ-দুটো তখন জল-ছল-ছল। শিবানীর দিকে চেয়ে বলল:
—শিবানী দি, কি হবে ?
—ভয় কি ছন্দা, আমি ত আছি। ওরা অমন বলেই থাকে। এটা কি মগের মুল্লুক নাকি, যা খুশী তাই করলেই হ’ল?
কথা শেষ করে শিবানী নিজের শাড়ির আঁচল দিয়ে মধুছন্দার চোখ মুছিয়ে দিয়ে আবার বলল:
—অত ভেঙ্গে পড়তে নেই, মনকে শক্ত কর। ভয় পেলেই ভয়।
*** **** ***
কলেজে গিয়েও শিবানী দেখল ক্লাশের মেয়েদের কিছু সংখ্যকের মধ্যে রাজ্য ভাষা সংক্রান্ত প্রশ্ন নিয়ে উত্তেজিত আলােচনা চলছে। আবার কোন কোন অসমীয়া ছাত্রী তাদের বাংলা ভাষী বন্ধুদের প্রবােধ দিচ্ছে, অভয় দিচ্ছে। কিন্তু সে আশ্বাসে আশ্বস্ত হতে পারে না আসামবাসী বাংলাভাষী মেয়েরা। ভেবে পায় না কি সে কারণ যার জন্য রাতারাতি পাল্টে যাচ্ছে তাদের অসমীয়া ভাষী সহ-পাঠিনীদের মনােভাব। কোথায় গলদ, কোথায় ত্রুটি তাদের, কি অপরাধ ওদের— শুধুমাত্র বাংলার সংস্কৃতি ও ভাষায় ওরা আস্থাশীল বলেই কি ওরা অপরাধী হয়ে গেল। এই কি ন্যায়, এই কি নীতি, এই কি বিচার?
অধ্যাপক ক্লাশে আসতে মেয়েদের কলগুঞ্জন শান্ত হল। রোলকল সেরে সুরু করলেন তিনি লেকচার। মেয়েরা শুনতে লাগল সমনযােগে। কিন্তু কোন কোন মেয়ে অধ্যাপকের উপস্থিতিকে উপেক্ষা করেও সাম্প্রতিক ভাষা সমস্যা নিয়ে আলাপ আলােচনা অনুচ্চ স্বরে চালিয়েই যেতে লাগল।
এক সময় ক্লাশের মেয়েরা দোরের দিকে চেয়ে দেখল পাঁচ ছ’জন অচেনা মেয়ে ক্লাশ রুমের সামনে এসে জটলা করছে। তাদের মধ্যে একজন অধ্যাপকের উদ্দেশ্যে শুধায়:
—মে উই কাম ইন স্যার?
প্রশ্ন করে উত্তরের অপেক্ষায় না দাঁড়িয়েই মেয়েরা দলবদ্ধভাবে ক্লাশে ঢুকে পড়ল। অধ্যাপক তাদের এ আচরণে কিছুটা বিব্রতবােধ করলেও কোন রকম আপত্তি জানালেন না। মেয়েরা ভেতরে এলে তাদের একজন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সমিতির ও আসাম ভাষা সংরক্ষণ উপসমিতির সহযােগী সম্পাদিকাকে পরিচয় করিয়ে দেয় মেয়েদের সঙ্গে। এরপর সহযােগী সম্পাদিকা উত্তেজিত কণ্ঠে যা বলল তাতে প্রকাশ পেল যে কাছাড়বাসী বাঙ্গালীদের চক্রান্তে এবং বাঙ্গালী ঘেঁষা চালিহা মন্ত্রীসভার ক্লীবতায় আসাম রাজ্যে অসমীয়া ভাষাকে রাজ্যভাষা করা যাচ্ছে না। এজন্য কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অসমীয়া ছাত্র-ছাত্রীদের বিরাট দায়িত্ব রয়েছে। তাই আজ বিকালে গুয়াহাটী বিশ্ববিদ্যালয় লনে একটি ছাত্র সভা আহ্বান করা হয়েছে। এই সভায় প্রত্যেক অসমীয়া ছাত্রছাত্রীর যােগদান করা ও ভাষার প্রশ্নটিতে ছাত্র সম্প্রদায়ের ইতিকর্তব্য স্থির করায় সক্রিয় অংশ গ্রহণ করা বাঞ্ছনীয়। তাই সহ-সম্পাদিকা আশা প্রকাশ করলে যে তৃতীয় বার্ষিক শ্রেণীর প্রত্যেক অসমীয়া ছাত্রীই যেন বিকাল চারটেয় বিশ্ববিদ্যালয় লনে আজকের মহতী ছাত্র জনসভায় সমবেত হয়। এছাড়া সম্পাদিকা আরও আবেদন জানালে যে এতদিন অসমীয়া মেয়েরা বাঙ্গালী সংস্কৃতির প্রতি আকৃষ্ট হয়ে প্রায়ই শাড়ি পরে এসেছে কিন্তু এখন থেকে প্রত্যেক অসমীয়া মেয়েকেই শাড়ি ছেড়ে মেখলা-চাদর পরতে হবে। কেননা মেখলা-চাদরই আসামের জাতীয় পােষাক; এ কথাটা যেন অসমীয়া ছাত্রীরা সর্বদা মেয়েদের স্মরণ রাখে।
কথা শেষ করে সঙ্গিনীদের নিয়ে চলে গেল বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সমিতির সহ-সম্পাদিকা। মেয়েরা অধ্যাপকের উপস্থিতিতেই ছাত্র সমিতির ফতােয়া সম্পর্কে আলােচনায় লেগে গেল দেখে অধ্যাপক— ‘ওয়েল, ওয়েল’ বলে তাদের তাঁর লেকচারের দিকে আকৃষ্ট করতে চেষ্টা পেলেন। কিন্তু সে চেষ্টা ফলবতী হল না। ক্লাস মনিটর জুলেখা খাতুন সহসা উত্তেজিতভাবে বেঞ্চ ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল:
অসমীয়া ভাষার প্রশ্নে অসমীয়া ছাত্রছাত্রীসমাজের মন বিক্ষিপ্ত— সুতরাং আজকের মত ক্লাশ না নিলে ছাত্রীরা খুশী হবে, স্যার।
জুলেখার কথা শুনে একটুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে রইলেন সিভিক্স-এর অধ্যাপক জয়ন্ত সান্যাল। মনে মনে আহতও হলেন। নিজেকে অপমানিত মনে করলেন এবং পরক্ষণেই এ্যাটেণ্ডান্স বুক ও বইগুলি গুছিয়ে নিয়ে দ্রুত পায়ে ক্লাশ থেকে নিষ্ক্রান্ত হ’লেন। কিন্তু তিনি ক্লাশের দরজা পেরুতে না পেরুতেই অসমীয়া মেয়েদের অনেকেই বাঙ্গালী বলে তার প্রতি উপেক্ষার সমবেত হাসি হেসে উঠল। কেউ কেউ ডেস্কের ওপর বই পিটাতেও লাগলাে। আর পরক্ষণেই যার যার সামনের বইখাতাগুলাে হাতে তুলে নিয়ে হৈ হৈ করতে করতে বেরিয়ে পড়ল ক্লাশ থেকে।
ওরা বেরিয়ে গেলে দেখা গেল ওদের সঙ্গে যারা যায় নি— তাদের মধ্যে শিবানী এবং আর দু’জন অসমীয়া মেয়ে এবং মধুছন্দা ও আরও ক’জন বাংলা ভাষী মেয়ে অধোবদনে বসে। সবারই মুখ থমথমে। শিবানী অপাঙ্গে চেয়ে চেয়ে দেখে ওদের মুখ। মনে মনে ওর নিজেকে বড় অপরাধী মনে হয়। একই দেশের মানুষ, একই আলাে বাতাসে বেড়ে ওঠা মানুষ— তারা কিভাবে যে পরস্পর শত্রু হয়ে পড়ে। আশ্চর্য !
পলিটিক্স–রাজনৈতিক নেতাদের পারস্পরিক দ্বন্দ্বে জনসাধারণকে উত্তেজিত করে বাজিমাৎ করবার কি কুটিল চক্রান্ত। ও ভেবে স্থির করে ওর প্রাথমিক কর্তব্য হ’ল ওদের সাহস দেওয়া, সহানুভূতি জানানাে। শিবানী ওর জায়গা ছেড়ে উঠে এগিয়ে যায় মধুছন্দার কাছে। পাশে দাঁড়িয়ে ওর পিঠে সান্ত্বনার হাত রাখতেই সে ‘শিবানী দি’ বলে সােচ্ছ্বাস কান্নায় দু’হাতে মুখ ঢাকে।
—দেখ ছেলেমানুষী। কি হয়েছে যে অমন ভেঙ্গে পড়ছ তুমি? কৃত্রিম হাসি হেসে বলে শিবানী।
—ওরা যে পথে ঘাটে আমাদের টিটকিরি দিচ্ছে শিবানী দি।
নোট-১: বিশেষ চিহ্নিত শব্দগুলো লেখক বা অন্য কেউ হাতে লিখে রেখেছিলেন, ছাপা বইতে ছিল না। বইটিতে ছাপা শব্দটি ছিল 'শান্তি'। নোট-২: বানান অবিকৃত