বাবা তখন আশারিকান্দি হাইস্কুলের হেড মাস্টার। ‘আষাঢ়েকান্দি’ থেকেই সম্ভবত ‘আশারিকান্দি’ নামের উৎপত্তি। আশারিকান্দির পাশাপাশি আরেকটি গ্রাম আছে, নাম মাধাইখালি। স্কুলের অবস্থান দুই গ্রামের সীমানায়। ভারত-বাংলা সীমানায় যেমন হয়, হয়েছে অনেক সময়— রান্নাঘর পড়েছে ভারতে, তো ঠাকুরঘর বাংলাদেশে— সেরকম আর কি। পাশাপাশি গলা জড়াজড়ি করে যেন শুয়ে রয়েছে দুই ভগ্নী গ্রাম।
গৌরীপুর শহর থেকে উত্তর-পূর্ব কোণ ধরে এগোলেই হাইওয়ের ধারে, ডানদিকে ঘুরে প্রায় এক কিঃমিঃ-এর মধ্যেই এই গ্রাম। একেবারেই কোনও দুর্গম স্থান নয়। এখন বর্ধিষ্ণু গ্রাম বলা হলেও, সেকালে ছিল, যাকে বলে, একদম অজ পাড়াগাঁ।
বর্ষায় প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে দুর্গত মানুষের কান্না, দু-দিক থেকে ধেয়ে আসা দুই নদী, পার্শ্ববর্তী বিপুল লাউখাওয়া বিলের সংযোগে দু-কূলপ্লাবী জলকল্লোলে ভেসে যায়। আষাঢ়েকান্দি বা আশারিকান্দি গ্রামের নাম মাহাত্ম্য এতেই বেশ বোঝা যায়। গ্রামটি গদাধর নদের তীরবর্তী নিচু এলাকায়, তাছাড়া, আরও পূর্বে, অনতিদূরেই অবিরল বয়ে চলেছে বিশালবপু ব্রহ্মপুত্র। বর্ষাকালে গ্রামগুলি যখন জলে ডুবে যায়, স্কুলচত্বরে, নয়ত ৩১ নং জাতীয় সড়কে আশ্রয় নেয় শ’য়ে শ’য়ে বন্যাদুর্গত মানুষ। স্কুল দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ থাকে সে সময়। আর প্রতি বছর বন্যার সঙ্গে নিয়ম করে আসে দুর্ভিক্ষ। কারণ অতিবৃষ্টিতে ফসল নষ্ট হয়ে যায় ঘরে তোলার আগেই। বাঁশ আর টালির ছাতের ঘর ভেসে যায় জলের তোড়ে। ঘরের মানুষও ভাসে— বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, শিশু। গবাদি পশুগুলোর যে কী হাল হয় তা সহজেই অনুমেয়।
এই চিত্র শুধু আশারিকান্দিরই নয়, শহরকে চতুর্দিক থেকে বেষ্টন করে থাকা অন্য গ্রামগুলিতেও ছোটখাটো দুর্ভিক্ষ লেগেই থাকে প্রতি বছর। গৌরীপুরের রাস্তায় রাস্তায়, মহামায়া ময়দানের নাটমন্দিরে, স্কুলবাড়িতে তখন নিরন্ন মানুষের নিরবচ্ছিন্ন স্রোত বয়ে যায়। ট্রাকে ট্রাকে রিলিফের চাল আসে, কিন্তু তা অপ্রতুল, মোটেও যথেষ্ট নয়। আর দুর্নীতি তো চিরকাল রয়েছেই। অনেকের জন্যই এদেশে বর্ষাঋতু প্রকৃতপক্ষে ইনকামের সিজন। সেই ট্রাডিশন সমানে চলেছে, আজও।
এই দুর্ভিক্ষ শুনেছি দুর্বিষহ রূপ ধারণ করেছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়। তখন সীমান্তের ওপারের হাজার হাজার লোক এসে এপারে আশ্রয় নিয়েছিল। এদিকে খাবারের তেমন বন্দোবস্ত নেই। যুদ্ধ একসময় থেমে গেছে, তবে দুর্ভিক্ষ থামেনি। কারণ প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঠেকানো তো খুব সহজ কথা নয়। ফলে হত কী, বাড়ি বাড়ি ঘুরে ভিক্ষা করতে বেরোত নিরন্ন মানুষ। স্বচক্ষে দেখেছি, ভিক্ষার চাল নয়, দুটো ফ্যানই শুধু চাইত মানুষ। দুর্মূল্যের বাজারে চাল ভিক্ষা চাইতে গেলে বিফল, ব্যর্থ মনোরথ হবার ঝুঁকি আছে। ফ্যান তো ফ্যালনা, অতএব নিরাপদ— নিঃসঙ্কোচে যার-তার কাছে হাত পাতা যায়। তখন, বিশেষ করে, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, কোলে শিশুসহ মেয়ে-বউরা যখন-তখন এবাড়ি-ওবাড়ি ঢুকে পড়ত। যেসব বাড়িতে টিনের গেট বা লোহার গেট, সেসব বাড়িতে তালা পড়ে যেত সকাল সকাল, পাছে কিছু দিতে হয়! চারিদিক থেকে কেবলই ‘ফ্যান দ্যাও, ফ্যান দ্যাও’ আর্তচিৎকার। ৭৬-এর মন্বন্তর তো দেখিনি, তবে ঘুরেফিরে আসা বাৎসরিক এই গণ-অনাহারের পরব দেখেছি।
একটি অনাহারক্লিষ্ট মুখ এখনও মনে আছে আমার। চোখ বুজলে এখনও স্পষ্ট দেখতে পাই, কেননা সে ছবি আমাকে হন্ট করে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। এক উশকো-খুশকো চুল, নিষ্প্রাণ, বিবর্ণ মুখের অভুক্ত, অপুষ্ট মা, কোলে ততোধিক অনাহারক্লিষ্ট, অপুষ্ট শিশু। কবিতা লেখাই যায়— নগরে এক উন্মাদিনী— এই নামে। নিজের পেটের খিদে আর সেটা ছাপিয়ে পেটেরটার খিদে যে কী জিনিস, হায়! তখনও হাটে-বাজারে, অন্যত্রও, জনপ্রিয় হিন্দি গান “চুরা লিয়া হ্যায় তুমনে যো দিলকো”— ফুল ভল্যুমে বাজছে। কী আশ্চর্য, চারিদিকে দুটো ভাতের জন্য এত হাহাকার দেখেও মানুষের প্রেম পায়। কিন্তু একটা অলৌকিক ব্যাপার ঘটে গেল এর মধ্যেই। চরম উদাসীন সমাজে দায়বদ্ধ শিল্পকলা অলৌকিক বইকি। সেই একই গানের সুরে কথা বসিয়েই গান বাঁধলেন গৌরীপুরের এক জনপ্রিয় গায়ক স্বপন সরকার (মনাই): ফ্যান দাও, ফ্যান দাও। অনেক বছর সবার মুখে মুখে ফিরেছে সে গান। সে যাই হোক, অল্প সংখ্যক লোকের মধ্যে হলেও এই সামাজিক বিভীষিকার সদর্থক প্রভাব কিন্তু পড়েছিল। আমাদের অভাবী সংসারেও এই দমবন্ধ পরিবেশের প্রভাব না পড়ে থাকেনি। আমার বয়স তখন একেবারেই কম। কিন্তু দূরের স্মৃতি আমার বরাবরই খুব প্রখর আর সেজন্যই মনে করে লিখতে পারছি। দেখতাম এরকম ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিতে বাবা কিছুতেই ছাত্র পড়ানোয় মনোযোগ দিতে পারছেন না। উদ্বেগে পায়চারি করে চলেছেন সারাদিন। সুরাহার কোনও উপায় খুঁজে পাচ্ছেন না। হয়ত এরকম পরিস্থিতি লক্ষ করেই কয়েক বছরের মধ্যে তিনি সমবায় আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। গ্রামে গ্রামে গড়ে তোলেন সুলভ মূল্যের ‘গৌরীপুর প্রাথমিক গ্রাহক ভাণ্ডার সমিতি’র শেয়ার হোল্ডার। এমনকি কাছাকাছি পর্বতজোয়ারের পাহাড়তলির গ্রামগুলির ঘরে ঘরে ঘুরে বেড়ালেন এই কাজে। বাবার বুকের ভিতরে মানুষের জন্য একপাহাড় কষ্ট ছিল, মমতা ছিল, কিন্তু মানুষটার কোনও প্রকাশ ছিল না। তাছাড়া একা কীই বা করবেন? আমাদের ঘরেও তো প্রায় সবসময়ই চাল বাড়ন্ত। দাদু সকাল থেকে ইজি চেয়ারে বসে থাকতেন অন্দর মহলের বারান্দায়। ভাবখানা যেন, পাহারা দিচ্ছেন, যাতে দয়াপরবশ হয়ে কেউ ঘরের চাল ঘুরপথে বাইরে চালান করতে না পারে। মানসিক উদ্বেগেই করতেন এমন, দাদুর আসলে এতে কোনও দোষ ছিল না। অভাব মানুষকে স্বার্থপর হতে বাধ্য করে।
ঠিক সেরকম একটা সময়েই দেখেছি আমার মায়ের লড়াই। মায়ের কথা এযাবৎ তো বলিনি। সে যাই হোক, দাদুর তীক্ষ্ণ চোখকে ফাঁকি দিয়ে চুপি চুপি ঘুণ-ধরা বাঁশের চ্যাগাড়ের ফাঁকা দিয়ে ডুমুর গাছের পেছনে লুকিয়ে থাকা দু-তিনটি পরিবারকে মা নিয়মিত খাবার জোগাতেন। আমরাও মাকে একাজে সাহায্য করতাম। কাকপক্ষীতেও টের পেত না। হ্যাঁ, খাবার মানে প্রায় ওই ভাতের ফ্যানই, আর কি? এমনকি বাবাও জানতে পারেননি প্রথম দিকে। তা হল কী, একদিন মা ধরা পড়ে গেলেন। কারণ ঘরের চালের হিসেবে টান পড়ছে। টান পড়ছে, কারণ মা ফ্যানের সঙ্গে গোপনে বেশ কিছুটা ভাতও মিশিয়ে দিচ্ছিলেন। শুধু ফ্যান কি দেয়া যায়?
দাদু ঘটনাটা ধরতে পেরে কিছুক্ষণ গুম মেরে বসে রইলেন, শেষে শুধু বললেন— “এর’ম করে না, বৌমা, সারামাস আমরা খাব কী? তোমারও তো ছেলেপিলে আছে!”
দাদু তো যৌবনে বিপ্লবী ছিলেন, তারপরে হলেন সংসারী। শেষকালে অনন্যোপায় হয়ে উঠেছিলেন অতি মাত্রায় হিসেবি। মায়ের এ হেন কীর্তির কথা জেনেও বাবা প্রথমে মুখে কিছুই বললেন না। পরে, রাতের দিকে, মা তখন কাঁদছিলেন, মা-র মাথায় ডান হাতটা আলতো রেখে বললেন— “মায়া তো আমারও হয়, কিন্তু এভাবে তুমি ক’জনকে বাঁচাবে?”
মা-র উত্তরটা আজও মনে আছে আমার— “যে ক’জনকে পারি বাঁচাব। আমি মুখে একটা দানাও তুলতে পারছি না। খেতে বসলেই শুধু ওই শুকনো মুখগুলো মনে পড়ে আমার।”
আমার মায়ের মধ্যে মনোকষ্টে কিছু গিলতে না পারার ব্যাপারটা এর পরে আরও অনেক ব্যাপারে লক্ষ করেছি। না, নিজের জন্য নয়, অভুক্ত মানুষের জন্য, পাঁচ শ’ মাইল দূরের হঠাৎ চাকরি চলে যাওয়া বাবার জন্য, মা ও ভাইবোনদের জন্য, এক বস্ত্রে বরিশাল থেকে তাড়া খেয়ে মধ্যমগ্রামে পালিয়ে আসা মেজোজ্যাঠা, আত্মীয়-কুটুম্ব, পরিচিতজনদের জন্য। যেদিন ঘরে মাছ আসত, ভাত খেতে বসে মাছের পেটি হাতে নিয়ে মা স্থির দৃষ্টিতে বসে থাকতেন, খেতে পারতেন না। বাবা, মা, ভাইবোন, মধ্যমগ্রামের সবাই পেট ভরে আজ খেয়েছে তো! মাঝে মাঝে শুধু ‘বাবা, বাবা’ করে কেঁদে উঠতেন।
মধ্যমগ্রামের মাতামহ মথুরেশ ভট্টাচার্য বিআইএসএন কোম্পানিতে মোটা মাইনের চাকরি করতেন। বরিশালের দেশের বাড়িতে (পোরগোলা) শুধু এক ভাই থেকে গিয়েছিলেন, যিনি জমিজমা দেখতেন, চাষবাস করে খেতেন। বাকিরা অধিকাংশই কলকাতা বা কলকাতার শহরতলিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিলেন। তাঁরা সকলেই চাকরি করতেন এই ঘটিদেশে। যাই হোক, ১৯৬৮ সন নাগাদ সম্ভবত সেই ব্রিটিশ নেভিগেশন কোম্পানি হঠাৎ দেশত্যাগ করায় মাতামহের চাকরি চলে যায়। তারপরও জমানো টাকায় কায়ক্লেশে সংসার চলে যাচ্ছিল কোনোরকম। কিন্তু পূর্ববঙ্গ থেকে বিতাড়িতদের সাথে মাতামহের মেজোদাদা ও তাঁর পরিবার, অন্য স্বজনেরা একে একে দেশ ছেড়ে চলে আসতে শুরু করেছে তখন। ফলে সংসারের অবস্থা ক্রমে ঘোরালো হয়ে ওঠে। দুঃসময়ে কাকে দূরে ঠেলবেন তিনি? আমি আমার মায়ের সেই দেশহারা, বাস্তুহারা মেজো জ্যাঠাকে দেখেছি দু-বেলা মাথা নিচু করে ভাত খেতে আসছেন, খাওয়া হলে মাথা নিচু করে আবার কোথায় যেন চলে যাচ্ছেন। একটিবারের জন্যও মাথা তুলতেন না, কোনও কথাও বলতেন না। অন্যের গলগ্রহ হয়ে জীবন ধারণ করা যে কী অপমানের সে অবস্থায় যে না পড়েছে সে কোনোদিনই জানতে পারে না। তা সেই মেজোজ্যাঠার কোথাও মাথা গোঁজার ঠাঁই ছিল কিনা কিংবা রাতে তিনি কোথায় থাকতেন, সে সব আর জানা হয়নি। দেশভাগের পর, এমনকি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়েও, পুরো যশোর রোড উদ্বাস্তুর ভিড়ে নাকি উপচে উঠেছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে তারা সব মধ্যমগ্রাম, সদিলাপুর, নিউ ব্যারাকপুর আদি অঞ্চলে নিজস্ব কলোনি বানিয়ে মোটামুটি একটা স্থিতি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিল। কিন্তু মায়ের মেজো জ্যাঠা সম্পূর্ণ একা একা কোথায় থাকতেন? কেননা, এরই মধ্যে তাঁর স্ত্রী বিয়োগ হয়েছে, তাছাড়া দুই মেয়েও বাংলাদেশেই থাকে— শ্বশুড়বাড়িতে। বাকি তথ্য ঠিক জানি না। তবে জানার অদম্য কৌতূহল ছিল আমার, বিশেষ করে, তিনি কোথায় রাত্রিবাস করেন, এই বিষয়টা; কিন্তু গলগ্রহ মানুষটার মুখে তো একদমই রা ফুটত না। জানব কী করে? হয়ত স্টেশন চত্বরই ছিল তাঁর রাতের বিছানা, বা সেই যশোর রোডের ধারের কোনও গাছতলাই ছিল তাঁর অন্তিমের আস্তানা। তবে মাতামহ অনেক চেষ্টা করেছিলেন তাঁকে বাড়িতেই রাখার জন্য। কিন্তু তিনি কিছুতেই রাজি হননি।
এরকম এক ধরনের টেলিস্কোপিক স্মৃতি আছে আমার। যখনই মানসপটে দৃশ্যগুলো ভেসে ওঠে, মনে পড়ে যায় আমেরিকার বিট জেনারেশনের বাউল কবি অ্যালেন গিন্সবার্গের ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’, (September On Jessore Road) কবিতাটির কথা। কতবার যে পড়েছি একসময়–
Millions of babies watching the skies
Bellies swollen, with big round eyes
On Jessore Road— long bamboo huts
No place to shit but sand channel ruts
পার্টিশনের কুফলে যশোর রোডের ধারে আশ্রয় নেয়া সারি সারি উদ্বাস্তু জনজীবনের কথা ছবির মতো কী প্রাণবন্ত করেই না লিখেছিলেন গিন্সবার্গ। কবিতাটি পড়বার সময় বারবারই একটা জায়গায় এসে বরাবর থম মেরে যেতাম, এখনও যাই—
On Jessore road Mother wept at my knees
Bengali tongue cried mister Please
দিনের পর দিন ভাল করে না খেতে পেয়ে পেট ফুলে ওঠা বাচ্চাগুলো, তাদের মায়েদের আকূল কান্না, শূন্য হয়ে যাওয়া বুকের আর্তি— একটু খাবার, এক চিলতে মাথা গোঁজার ঠাঁই… ছবিগুলো মনের পর্দাজুড়ে কাঁপতে থাকে আর কেবলই এক মূক বেদনায় আমার কবুতরের মতো হেঁপো রুগীর বুকটা টনটন করে ওঠে।
আশারিকান্দিতে মূলত বাঙালি মৎস্যজীবী সম্প্রদায়ের বাস। মাছধরা ও চাষবাস— দুটোই প্রায় একই সঙ্গে চলে। অধিকাংশই মানুষই নিতান্ত গরীব। এক-দুই ঘর এদেশীয় রাজবংশী পরিবারও আছেন, যাঁরা এককালে হয়ত প্রভূত ভূ-সম্পত্তির মালিক ছিলেন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে জমি হারাতে হারাতে তাঁদের কারুর কারুর তখন তথৈবচ অবস্থা। কেউ কম বেতনের পুলিশের হাবিলদারের চাকরি জুটিয়ে নিচ্ছে তো কেউ বিনা বেতনের স্কুল শিক্ষকতা। এমন একজনকে জানতাম, নাম পরবানন রায়। পেশায় ছিলেন বিনা বেতনের শিক্ষক। সংসার কী করে চলত কে জানে?
আশারিকান্দি পার হয়েই চরাঞ্চল শুরু— একের পর এক ধুলোবালিময় গ্রাম— গেরামারি, ঝালের আলগা, ঘ্যাগের আলগা, এরকম অদ্ভূত নামের সব গ্রাম। আরেকটু এগোলেই টলমল জল, ব্রহ্মপুত্র। আশারিকান্দি পেরিয়ে খানিকটা ভেতরে এগোলেই একের পর এক বাঙালি মুসলমান গ্রাম, মসজিদ, মাদ্রাসা। এঁরা অবশ্য বাঙালি পরিচয় ত্যাগ করে বা গোপন করে নিজেদের ন-অসমিয়া বলে, অর্থাৎ কিনা নতুন অসমিয়া। এতে অবশ্য আপত্তির কিছু নেই। জীবন ধারণ আর টিকে থাকাই যখন মুখ্য, সেক্ষেত্রে, বেঁচে থাকার শর্তে, এটাকে একটা সহজ সমাধান হিসেবে ধরে নেয়াই যায়।
এযাবৎ মাত্র দু-একবার গিয়েছি চরের ওদিকটায়, এক বন্ধুর সঙ্গে। মনের ইচ্ছে, চর থেকে ব্রহ্মপুত্র দেখব, চরের জীবন দেখব। ওদিকে খানিকটা যাওয়ার পরই লক্ষ করলাম বন্ধুর মুখ শুকিয়ে গেছে, গলা কেমন ফ্যাসফ্যাসে। জিজ্ঞাসা করলাম— “কী হয়েছে রে?” বন্ধুর উত্তরটা ছিল খুবই আমোদজনক, ও বলল, আচ্ছা, এখানে দেখছি সব পাকিস্তানি রে। আমাদের মেরে এই চরের ধূ ধূ বালিতে যদি পুঁতে দেয়! কী হবে! বন্ধুকে শান্ত করলাম। হেসে হেসে বললাম— “সত্যিই খুব লস হয়ে যাবে রে, ব্রহ্মপুত্র দেখার সাধ আর পূরণ হবে না। তবে লাভও আছে একটা।” দীর্ঘকাল এই বন্ধু মেডিকেল রিপ্রসেন্টেটিভ পেশায় ছিলেন। সবে সেই পেশা ছেড়ে বেরিয়ে এসে তিনি পারিবারিক রেশনের দোকান সামলাচ্ছেন, সাথে অন্য টুকিটাকি ব্যবসা। প্রচণ্ড শ্রুতিধর। গৌরীপুর অঞ্চলের ইতিহাসের খুঁটিনাটি বলতে গেলে তাঁর নাকের ডগায়। ইচ্ছে করেই এই বন্ধুর নাম এখানে আমি নিচ্ছি না। তবে পরে, প্রসঙ্গান্তরে, তাঁর নাম আমাকে নিতেই হবে। তো কথা হল, লাভের কথা শোনামাত্র বন্ধু মুখ তুলে সরাসরি আমার চোখের দিকে তাকালো— “কী লাভ?” বললাম— “বর্ষায় ব্রহ্মপুত্র ভয়াল রূপে ধেয়ে আসবে, বয়ে যাবে আমাদের পচে ওঠা শবদেহের ওপর দিয়ে। তখন না হয় ব্রহ্মপুত্রের জলেই হবে এই আকিঞ্চন জীবনের শেষ ভাসান। ভয় কি?” বন্ধু বোকার মতো আমার দিকে তাকিয়ে আছে দেখলাম। ওকে আশ্বস্ত করে আবার বললাম— “ভয় নেই। মুসলমানরাও তো আমাদেরই মতো মানুষ। আর পাকিস্তানি কেন বলছিস? পাকিস্তান তো এই সেদিনের গল্প। এঁদের পূর্বপুরুষ তো বাঙালিই, আসলে। হ্যাঁ, সে দেশে ২৪ বছরের পাকিস্তানি শাসন ছিল বটে, কিন্তু তাতে আবহমান বাংলার সব কিছু কি ধুয়েমুছে সাফ হয়ে গেছে? স্বাধীন বাংলাদেশের উত্থান কি অন্য কথা বলে না?”
অসাধারণ
Pronam neben sir, eto sundor pronjol vasaya apnar lekhoni উপস্থাপন করার জন্য আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ। মনে হচ্ছে যেন শ্রীকান্ত র গন্ধ পাচ্ছি।
আমাদের শৈশব…..তৎকালীন গ্রাম্য জীবন….৭১ এর দুর্ভিক্ষ…… আমাদের পারিবারিক ঘটনা প্রবাহ…. এতো চমৎকার ভাবে তুলে ধরেছিস্…… অতুলনীয় !!
Nice