সে বার চরের বালিতে দাঁড়িয়ে ব্রহ্মপুত্র দেখার সাধ আর পূরণ হয়নি। সে আরেক গল্প, তবে ডাক শুনেছি নদীর, প্রায় দেড় ক্রোশ দূর থেকে। নদ-নদী ডাকে মানুষকে, পাহাড় ডাকে, জলাভূমি ডাকে, পশু-পাখি— পাখপাখালি… সব।
মানুষ এক জীবনে কতো রকমের ডাক শুনতে পায়? জীবনের মিহি, আলতো ডাক ধীরে ধীরে উচ্চগ্রামে উঠতে থাকে, উচ্চৈঃস্বরে ডাকতে থাকে, চিক্কুর পাড়ে, চিৎকার করে। সেই কবে ছোটবেলায় শুনেছি ডাহুকের ডাক। ভুলতে কি পেরেছি! ‘পরানের গহীন ভিতরে’ কান পাতলে এখনও কি শুনতে পাই না? বাড়ির পেছনের ডোবায়, ভরদুপুরে, প্রথম দেখা সেই একলা ডাহুক, কচুরিপানার ফাঁকে… গোপন জলের গা ঘেঁসে। ভাসা ভাসা নয়, স্পষ্টই তো মনে পড়ে। ডোবার ওপারে ছিল একটা এবড়ো-খেবড়ো মাঠ, বহুদূর বিস্তৃত। লোকে বলত ‘সাধুর বাগান’। স্থানীয় ভাষায় এমন নির্জন ভূমিখণ্ডকেই তো বলে ‘নিধুয়া পাথার’। আমার এদেশীয় বন্ধু চাটু থেকে থেকেই প্রস্তাব দিত— ‘চল, চল নিধুয়া পাথারত যাং।’
তো সেই ‘নিধুয়া পাথার’ ছিল আসলে উঁচু-নিচু, অসমান ভূমি— মধ্যে মধ্যে হাওড়, বড় বড় গর্ত, ঝোপ-ঝাড়ে পরিপূর্ণ। পুরো এলাকাটি সর্পসংকুল আর সন্ধে নামতে না নামতেই কোটর থেকে বেরিয়ে আসত বিশালাকৃতির সব শেয়াল। সন্ধেবেলা সমস্বরে ডেকে উঠত তারা, তারপর প্রহরে প্রহরে ডাকত, রাতের অন্ধকার ভেদ করে। আর ছিল কালপেঁচাদের একটানা কুক কুক কুক। সেই কবে থেকে নগরের উপকণ্ঠে, ক্রমক্ষীয়মান জঙ্গলে, বিপন্ন গাছের ডালে, হাইওয়ের ধারে, কালভার্টের নীচ থেকে বিপন্ন পশুপাখিরা ডাকছে। আমরা কি প্রকৃত শুনি, শুনতে পাই! ওরা কিন্তু শোনে… ওদের অবিমিশ্র, আদিম বাসভূমিতে মানুষের অপরিণামদর্শী পদধ্বনি শুনতে পায়।
সাধুর বাগানের সেই হাওড়, জলাভূমি, পাগারগুলো ভরাট ক’রে ধীরে ধীরে বসতি গড়ে উঠছিল আমার জন্মের বহু আগে থেকেই। আর যারা বসতি গড়ছিল তাঁদের অধিকাংশই ছিল পূর্ববঙ্গের বাস্তুচ্যুত মানুষ। তাঁর মধ্যে ব্রহ্মপুত্রের দক্ষিণ পারের নদীভাঙা পরিবারও ছিল কয়েকটি। একের পর এক ঝুপড়ি, কারুর কারুর হয়ত টিনে ছাওয়া মাটির ঘর। সেখানেরই এক মলিন কুটির থেকে সন্ধেবেলা ভেসে আসত কোটরগত চোখ, গাল-তোবড়ানো বিজয় মাস্টারের গান— ‘বাদল বাউল বাজায় বাজায় বাজায় রে।’ বিজয় মাস্টার ছিলেন একরকম অকালবৃদ্ধই— শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে অপুষ্টি। এক ঝলক দেখলেই বোঝা যেত দু-বেলা তাঁর পেটভরা খাবার জোটে না। তবে মুখে হাসিটি ছিল লাগা। আর ছিল গান— যাকে বলে উদাত্ত, পাগলপারা। পূর্ব বাংলার কোনও এক উচ্ছন্ন জনপদে পূর্ব জীবনে গানের শিক্ষক ছিলেন তিনি— কিন্তু কাঁটাতারের এপারে, এদেশে এসে তাঁর হাতে আর কোনও কাজ ছিল না। বলতেন—
‘আমাগো মাজা ভাইঙ্গা গেসে— কিছু আর করনের নাই। একলাই গান করি, একলাই হুনি।’
আমরা পুরোনো বাঙালিরা, অসমিয়ারা, রাজবংশীরা, বিহারী, মারোয়াড়িরা অধিকাংশই থাকি সাধুর বাগানের দক্ষিণ ও উত্তর-পশ্চিমে। দক্ষিণের আমলা পট্টিতে বরাবরই জমিদারের আমলাদের বাস। সেখানকারই এক প্রায় ভূতে-পাওয়া, পলেস্তারা-খসা, দো-মহলা বাড়িতে আমরা থাকতাম। ডান দিকের বাসাবাড়িটি একদা ছিল জমিদারের বড় ডাক্তার গিরীন চক্রবর্তীর। পরে সে বাড়িটি জমিদারপুত্রত্রয় অমল-অজয়-অজিত বড়ুয়াদের হস্তগত হয়। কিন্তু জমি-বাড়ির হাত বদল হলেই বা কী? সে বাড়ির পেছনের প্রায় আধা বিঘা জমির আম-জাম-কাঁঠালের বন নাকি তখনও ছড়ি হাতে সর্বক্ষণ পাহারা দিয়ে চলছিলেন প্রায় তিন দশক পূর্বে মৃত গিরীন চক্কত্তির মা। শুনে ভয় তো লাগতেই, তবে আমার কোমল মনে প্রশ্নও জাগত— বড়লোকদের ভূ-সম্পত্তির মোহ কী মরলেও যায় না? বাঁ দিকে থাকতেন ছোট ডাক্তার উপেন খাঁ, যাঁর প্রকৃত পদবি ছিল ভাদুড়ী। ‘খাঁ’-উপাধি নবাবি সূত্রে পাওয়া আর সেকথা বেশ বুক ফুলিয়েই জাহির করতেন খাঁ সাহেব। তিনি ছিলেন রীতিমতো সংসারী মানুষ— ভালো পসারও করেছিলেন ডাক্তারি পেশায়। বিয়ে করেছিলেন সাহিত্যিক সতীনাথ ভাদুড়ীর ভাগ্নীকে। যাই হোক, সাধুর বাগানের পশ্চিম থেকে উত্তরে ধনুকের মতো বাঁকা ‘বড়ুয়া পট্টি’ নামের যে ইট বিছানো দীর্ঘ শুনশান রাস্তাটি এখনও বিদ্যমান, জমিদার-বংশের আত্মীয় সম্ভ্রান্ত বড়ুয়াদের বাস ছিল সে রাস্তায়।
দেখতাম প্রতি বছর একটু একটু করে সাধুর বাগান ভরাট হচ্ছে। ভিতরে ভিতরে নতুন নতুন পাড়া গজিয়ে উঠছে, কত নতুন নতুন পথ-উপপথ। স্থানীয় অধিবাসীদের মনের কোণে কোথায় যেন এ নিয়ে মেঘও জমতে শুরু করেছে। তবে তখনও, তেমন আঁধার করে আসেনি চারিদিক। সাধের দেশ যাদের হাতছাড়া হয়ে যায়, শুধু এক আক্ষেপ আর হা-হুতাশ ছাড়া তাদের আর কীই বা থাকে জীবনে, শেষ অবধি! একের পর এক দুর্ভাগ্য ছাড়া আর কোনোকিছুই তাঁদের সঙ্গে দেয় না। বজ্র, শুনেছি, এক জায়গায় দু’বার পড়ে না। জীবনের জটিল-কুটিল অভিজ্ঞতা এরকম কত ভুল ভাঙিয়ে দিয়ে গেছে।
সাধুর বাগানের উত্তর-পূর্বের দিকটার পুরোনো নাম ছিল তেলেনি বিল বা স্থানীয় উচ্চারণে তেইলানি বিল। সে বিল দু’চোখ ভরে দেখবার সৌভাগ্য আমাদেরও হয়নি। কালে কালে কবে সেই তেইলানি বিলও বিক্রি হয়ে গেছে। খাল ভরাট করে সেখানেও গড়ে উঠেছে কলোনি। পূর্ববঙ্গীয়, দেশবিভাগের শিকার অগণন মানুষের বাস তখন সেখানে। তেইলানি বিলই নাম পাল্টে ক্রমে জনাকীর্ণ এক এলাকার জন্ম দেয়, পরে নতুন করে যার নামকরণ হয় সুভাষপল্লী।
প্রথম প্রথম সাধুর বাগানের দিকটায় একা একা যেতে বুক দুরুদুরু করত আমাদের। গায়ে কাঁটা দিত। কেমন একটা গা ছমছমে পরিবেশ— তাছাড়া নতুন বাসিন্দা যাঁরা বসতি করেছে, তাঁদের বয়স্কদের, বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের চোখেমুখে ফুটে থাকত একটা চাপা কষ্ট, হা-হুতাশ, আটকে থাকা কান্না। আর, একটা বেশ বদনামি শ্যাওড়া গাছও ছিল ডোবার বাঁদিকে। প্রতিবেশী উপেন খাঁ ডাক্তারের বাড়ির ঠিক পেছনটাতে। ছোটবেলায় যদিও বা কখনও দলেবলে ওদিকটায় গেছি, সেই শ্যাওড়া গাছটার দিকে কিন্তু ভুলেও তাকাইনি, না তাকানোর পিছনে একটা জুতসই কারণ ছিল। ছোটবেলা মানেই তো নানারকমের ভয়— আর সবচে’ বেশি ভয় তো অন্ধকারকেই। রাতের অন্ধকার একরকম, কিন্তু দিনের বেলার অন্ধকার? তখনও তো জানবার বয়সই হয়নি জীবনের অন্ধকার দিকগুলো আরও কত হাড়হিম-করা, নিশ্ছিদ্র। তবে শুধু ছোটরা নয়, বড়দের ভীতিও খুব কম ছিল না। কারণ ওই গাছে কোন এক আধো-অন্ধকার ভোরে ঝুলে ছিল খোকন নামের স্থানীয় এক যুবকের জিভ-বের-করা লাশ। দূর থেকে দেখেছি সে দৃশ্য— কাছে যাওয়া হয়নি কারণ যেতে দেয়নি কেউ। কচি মনের ভিতরে এদিকে তখন ঝড় উঠেছে। জীবনে সেটাই তো প্রথম মৃত্যু দেখা, তাও আবার অপঘাতে মৃত্যু।
খেলাচ্ছলে বড়দের ফিসফাস আলোচনায় কান পেতে শোনার চেষ্টা করছি এবং শুনেও ফেলেছি কিছু কিছু— খোকনের কেসটা নাকি আত্মহত্যার ছিল না মোটেও— মার্ডার। ‘মার্ডার’ শব্দটার সাথেও সেই আমার প্রথম পরিচয়। প্রকাশ্যে কেউই কিছু বলেনি অবশ্য। সবই ফিসফিস শোনা, রাত্রির কানে ভৌতিক কথাবার্তার মতো। গভীর রাতে একটা আর্ত চিৎকার নাকি পাড়ার অনেকেই শুনেছিল, সে চিৎকার নাকি ব্যবসায়ী জহরলালের কাঠগুদামের পেছন দিক থেকে ক্রমে সাধুর বাগানের দিকে সরে যেতে থাকে এবং সরতে সরতে শ্যাওড়া গাছের ঠিক নীচে এসে দপ ক’রে নিভে যায়। সাধুর বাগানের এক বৃহদংশের মালিকানা নিয়ে নাকি বিবাদ ছিল বিমাতার সঙ্গে আর তারই চরম পরিণতি হয়ে এক সকালে দাঁড়িয়ে ছিল জিভ-বের-করা শ্যাওড়া গাছ। ফিসফাস এইসব কথাবার্তা— সত্য নাকি গালগল্প— তা আর যাচাই করা হয়নি।
সেই ডোবার দক্ষিণ কোণে ছিল এক বাঁশের বেড়ায় মাটি-লেপা বাড়ি, উপরে সস্তার লাল টালি বিছানো। সেই বাড়িরই এক মেয়ে, সম্ভবত বড় মেয়ে, নাম ছিল বেজি। মাথার গন্ডগোল নিয়েই সে জন্মেছিল, না দেশভাগজনিত নির্যাতনের ফলে মাথা বিগড়েছিল, হয়ত সেটা কেউ জানলেও কোনোদিন প্রকাশ করেনি। সবার মুখে মুখে তার নাম হয়ে গিয়েছিল ‘বেজি পাগলি’। বেজি পাগলি নেচে নেচে ঘুরে বেড়াত খানাখন্দময় সাধুর বাগানের আনাচে-কানাচে, নয়ত লোকের বাড়ির পেছনের চ্যাগাড়বিহীন, উদোম জংলা কচু, শেয়ালকাঁটা বিছানো বনবাদাড়ে। নাচত আর হাসত— এক অনাবিল, অনর্গল হাসি। কখনও কখনও আবার হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে অপলক চেয়ে থাকত আমাদের দিকে, কখনও বা হাতছানি দিয়ে ডাকত। কিন্তু বেজি পাগলিকেও তো আমরা ভীষণ ভয় পেতাম। তাই একদমই কাছে যেতাম না। মানুষ মাত্রই অজানাকে ভয় পায় আর তখন তো আমরা শিশু। তবে বেজি পাগলিকে আমি ভুলতে পারিনি। ভোলা কি যায়? পাগল-পাগলি ছাড়া যে ছোটবেলাই হয় না। তারপর কত পাগলই না দেখলাম জীবনে। এক পাগল, সে পড়াশোনা জানত, বন্ধ দোকানের সিঁড়িতে বসে সোচ্চারে ইংরেজি পেপার পড়ত গড়গড় করে। মাঝে মাঝে পড়া থামিয়ে নাক ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে গন্ধ শুঁকত আর সারা মুখে এক অদ্ভুত হাসি ছড়িয়ে দিয়ে বলে উঠত— ‘ক্যারা বান মাংস রান্ধসে’ (কে যেন মাংস রেঁধেছে)। এ বয়সে পৌঁছে এখন ভাবি, সেই পাগল কি মাংস খেতে চাইত? উত্তর হয় না, উত্তর হয় না সবকিছুর। এই পাগলকেও ভুলতে পারিনি, যেমন ভুলতে পারিনি দূর থেকে দেখা খোকনের লাশ।
মানুষ মরে গেলেও ভূতেরা তো সহজে মরে না। মিথ হয়ে বেঁচে থাকে অনেক অনেক কাল। মৃত্যুর অনেক বছর বাদেও খোকনের ভূতকে শ্যাওড়া গাছে লটকে থাকতে নাকি দেখত কেউ কেউ। ঠিক তেমনই জিভ বের করা। বেকনের ‘অব ডেথ’- রচনাটির আরম্ভের বাক্যটি ছিল এরকম— ‘Men fear death as children fear to go in the dark’, গল্প, মিথ আদির কারণে বড় ও ছোটদের যথাক্রমে মৃত্যুভয় ও অন্ধকার ভীতি দুটোই ক্রমে বেড়ে যায়। মৃত্যুও একধরনের অন্ধকারই তো, যা খোকনের মতোই হয়ত প্রতিনিয়ত ঝুলে থাকে মানব মনের আলো-আঁধারিতে। তাই ভয় পাওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু না। এই ভয় প্রসঙ্গে আরেকটি ঘটনার কথা মনে পড়ে যাচ্ছে, যেটাও প্রায় মিথে রূপান্তরিত হয়ে টিকে ছিল বহুদিন। আজ হয়ত কারুর কারুর দূরাগত স্মৃতিতেই শুধু বেঁচে আছে সে কাহিনী।
ছোট ডাক্তার উপেন খাঁর কথা তো আগেই বলেছি। গায়ে গায়ে লাগালাগি বাড়ি আমাদের। তাঁর বাবা জগৎ খাঁ ছিলেন প্রবল দুঃসাহসী। খোঁচা আর ফাঁসিজাল দিয়ে খালবিলে মাছ ধরার প্রবল নেশা ছিল তাঁর। এক হাতে জ্বলন্ত হ্যাজাক, অন্য হাতে খোঁচা আর সুপুষ্ট কাঁধে ফাঁসিজাল নিয়ে রাত ক’রে মাছ ধরতে যেতেন নির্জন, নিস্তরঙ্গ লাউখাওয়া বিলে। বিশাল বিলের পাশে দীর্ঘ, উঁচু মাটির বাঁধ, বাঁধের ওপরে খানাখন্দে ভরা রাস্তা, যা গৌরীপুর শহরকে বাইপাস করে গিয়ে মিশেছে মাটিয়াবাগ প্যালেসের কাছে, ৩১ নং জাতীয় সড়কে। জগৎ খাঁর নিজস্ব নৌকো ছিল, যা দিনরাত বাঁধা থাকত বিলপারের এক শ্যাওলা-পড়া ঘাটে। দামি ভেন্না কাঠের নৌকো, তবে চুরি যাওয়ার তেমন ভয় ছিল না। লোকসংখ্যাও কম। তাছাড়া লাউখাওয়ার রাস্তায় এমনিতেই মানুষজন বিশেষ থাকে না, ঘরবাড়িও নেই। জনহীন, ফাঁকা একটা পথ— দিনের বেলাতেই কেমন যেন অন্ধকার অন্ধকার। ফলে, বিশেষ করে জ্যোৎস্নালোকিত রাত্রে, তার ঘোর তমসাচ্ছন্ন রূপের ভিতরে যে গভীর কোনও ছলনা লুকিয়ে থাকবে; এটা অবাক হওয়ার মতো কোনও বিষয়ই নয়। ইতিহাসে লেখা নেই, তবে জনশ্রুতি আছে, বাংলার সুবেদার মীরজুমলার সেনারাও নাকি আসাম আক্রমণকালে লাউখাওয়া বিলের পার ধরে হেঁটে যাওয়ার সময় এই অপার রাত্রিময়ীর ছলনার শিকার হয়ে দলে দলে জলে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। তখন হাতে জ্বলন্ত মশাল নিয়ে নাকি তাদের পথ দেখিয়েছিলেন গৌরীপুররাজের কোনও ঊর্ধ্বতন পুরুষ। এবং এ হেন অপ্রার্থিত সাহায্যের জন্যই মোগল বাদশাহ পরবর্তীতে এই বিজিত ভূমির কানুনগো বানিয়ে দেন তাঁকে। এরকম অনেক কিংবদন্তীই প্রচলিত আছে এ অঞ্চলে, যা বাতাসে কান পাতলে এখনও শোনা যায়। এমনই কোনও এক জোৎস্না-বিহ্বল রাতে, উপেন খাঁ ডাক্তারের বাবা জগৎ খাঁ লাউখাওয়ার উঁচু বাঁধের ওপর উঠে এলেন গামবুটে গটগট ধ্বনি তুলে। তাঁর পকেট ঘড়িতে তখন রাত্রি প্রায় বারোটা। রাস্তার ওপারে সারি সারি শিমূল গাছ, ফাঁক দিয়ে যেন চাঁদের আলোর এক উন্মনা হাট বসেছে। ডান হাতে সেদিন হ্যাজাক ছিল না, মাত্র একটা বাঁশের চটায় কাপড় পেঁচানো মশাল— মশালের আলোয় স্পষ্ট চোখে পড়ল, এক প্রায় অষ্টাদশবর্ষীয়া ললনা উল্টো মুখ করে বসে রয়েছে ওপারের খর্বাকৃতির এক শিমূল গাছের নিচু ডালে।
‘এতো রাতে, এই নির্জন বিলের পারে খোলা চুলে কোন বাড়ির মেয়েগো, তুমি? মাথায় একখণ্ড কাপড় পর্যন্ত নেই। কী সাংঘাতিক! একি ভীষণ দুঃসাহস তোমার! মুখ ফেরাও তো দেখি, কোন ঘরের মেয়ে তুমি?’
দু-দুবার করে বলার পর মুখ ফেরাল সেই মেয়ে… অন্ধকারের মুখ কি দেখা যায়!
‘মুখ দেখতে পারছি না কেন? ও বুঝেছি, দু’হাত দিয়ে মুখ ঢেকে রেখেছ নিশ্চয়ই! কী ভেবেছ, চিনে ফেলব? আচ্ছা চালাক মেয়ে তো!’
এবারে প্রত্যুত্তর করল সেই অন্ধকার, খাঁটি রাজবংশী উচ্চারণে:
‘তুই খুব দেওয়ানি হছিস, না? মরা মাইনষোকো ঘোঙটা দিবার কইস? বিলের মাছ ধরি খাইস, আরো মুখত বড় বড় কতা? যা যা বাড়িত যা, তোর জীবন মাত্তর সাত দিন, এই কয়া দিলং!’
ডাকাতের মতো সাহসী লোকটা বেলুনের মতো চুপসে গেলেন। শরীরের সব তেজ যেন নিমেষে উধাও হয়ে গেল। নিঃস্পন্দ দাঁড়িয়ে রইলেন কিছুক্ষণ, ভিজে বেড়ালের মতো! সত্যি সত্যিই তাঁর পরনের পায়জামা ভিজে গেল, ভয়ে। অতঃপর দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে দৌড়তে দৌড়তে ফিরে এলেন বাড়ি। কোনোদিকে আর ফিরে তাকানোর অবকাশ ছিল না। স্ত্রী ছাড়া আর কাউকেই ঘটনার কথা কিছু জানতেও দিলেন না। গুড়জল খেয়ে সটান শুয়ে পড়লেন বিছানায়। কিন্তু সে রাতেই ধুম জ্বর উঠল তাঁর। আর সেই জ্বরে ভুগেই ঠিক সাত দিনের মাথায় স্ত্রী-পুত্রকন্যাদের অকূলে ভাসিয়ে তিনি পাড়ি জমালেন ওপারে। খাঁ সাহেবের মনে ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের শেকড় তত গভীর ছিল না, হয়ত। আজীবন বংশধারায় প্রাপ্ত নবাবি টাইটেল বহন করেছেন সগর্বে। তাছাড়া, জাতে ব্রাহ্মণ হয়েও মাছ মেরে খেতেন, উপযুক্ত দাম পেলে বেচতেনও। কিন্তু মনের ভিতরে পুরুষতন্ত্রের অহমিকা ছিল পুরো মাত্রায়। অশরীরী দুরন্ত এক নারীর তীব্র বাক্যবাণে তাঁর মনের পুরুষতন্ত্র মরেছিল কিনা, মরণকালে অন্তত ঝরে গিয়েছিল কিনা, সে প্রশ্নের উত্তর একমাত্র মৃত জগৎ খাঁ-ই দিতে পারতেন। কিন্তু যাবার বেলায় তিনি কিছু বলে যাননি। হয়ত মহাকালের গায়েই শুধুমাত্র লেখা আছে সে ইতিহাস।
যত পড়ি কেমন ঘোর লেগে থাকে। ধারাবাহিকে কমেন্ট করি না। শুধু পড়ি। এখানে মন্তব্য না করে থাকা গেল না। বই হলে চাই।
আপনি পড়ে মন্তব্য করেছেন আমি আপ্লুত। নিজেকে পুরস্কৃত মনে হচ্ছে। অনেক ধন্যবাদ ও ভালবাসা।
সুন্দর বর্ণনা। বেশ লাগছে।
Outstanding. আগে প্রথম ও দ্বিতীয় পর্ব পড়েছিলাম। আজ ভালো করে তৃতীয় থেকে ষষ্ঠ পর্ব পড়লাম।Brother, I am just falling short of words to express my gratitude to you for bringing in front of me the bye gone days of Gauripur so vividly. In most of the scenes, it was a walk-through of my own past life …. I could relate so easily to my childhood & boyhood days…. বেশির ভাগ নিজ চোখে দেখা, কিছু বড়োদের মুখে শোনা… সব আবার নতুন করে চোখের সামনে ভেসে উঠলো…. বাংলাদেশের যুদ্ধের সময়ের সেই কামানের আওয়াজ, বাড়ির উঠোনে গর্ত করে bunker বানানো, ভেন্টিলেটরের কাঁচে কাগজ স্যাটানো যাতে আলো বাইরে না যায়.. আর সর্বোপরি refugee মানুষের দু্র্দশা… ভাবলে এখনো চোখে জল আনে। আমাদের দাজু পাঠশালায় রিফুজী কি জিনিস অবাক শিশুর চোখে দেখতাম …ঐবার বিজয়া সম্মেলনীতে হরি সভায় মনাইদার গাওয়া ” গভীর রাতে শুনতে পাবে…..কান্না, …. একটু ভাতের ফ্যান দেননা ” ….তোমার মতো আমারও কচি মনে গভীর দাগ কেটেছিল। তোমাদের আর উপেন খাঁর বাড়ি, পেছনের জংগল, বেজী পাগলীর হাসি, ত্রিনেশ দাসগুপ্ত স্যার, শচীন দত্তের দোকান সব আবার হুবহু জীবন্ত হয়ে উঠেছে তোমার অতি সুন্দর বর্ননায়। As if you have given expression in language of my own thoughts… and that shows how big you are as a social writer.. Bravo.. Hat’s off. Keep on writing about our own Gauripur… more about our childhood characters ..big and small, even like” Bulbul chanachurwala” , “Bokabhai”etc. Also write about astrology practised by your father Chuni Chatterjee & Jyatha Moni Chatterjee.. They were famous for it and I remember so many clients of the duo in our family and relatives at that time. I have sent your writings to all my relatives thru whatsApp and they are responding to it positively.
I WILL SURELY BE WAITING FOR YOUR NEXT RELEASE. 💖💖💖