লোকালয় পশ্চিম হালাহালিও একসময় ছিল ঘন জঙ্গল। সাপখোপ ও জন্তু জানোয়ারদের বিচরণক্ষেত্র। মাঝেমাঝে রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের দেখা পাওয়া যেত। সিলেটের মাধবপুর থেকে এসে ব্রজ সিংহের বাবা মণীন্দ্র সিংহ দুই ভাই বাগীন্দ্র ও বাবুকে নিয়ে জঙ্গল কেটে বসতি গড়ে তোলেন। একই সময়ে ভানুগাছ থেকে আসেন মদনচাঁদ সিংহ। কানাই সিংহ, ধনবাবু সিংহ ও সর্দার বাবি সিংহ। বাবি সিংহ তখন গ্রামের মুরুব্বি ছিলেন বলে সবাই তাকে সর্দার বলত। তখন হালাহালির তালুকদার ছিলেন নবকিশোর সিংহ। তখন মানুষের লোভ লালসাও ছিল কম। আশ্রয়ের জন্যে যতটুকু দরকার, এর বেশি জায়গা ভোগদখলের কোনো অভিসন্ধি ছিল না। এরপর একে একে হুনা সিংহ, মাইপাক ও রাজবাবুর বাবা রমানন্দ সিংহ সিলেট থেকে চলে আসেন এই লোকালয়ে। এর পরে আসেন যামিনী সিংহের বাবা মারিবা ও কাকা খুতুকবা সিংহ। পশ্চিম হালাহালিতে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরিদের মণ্ডপটি স্বাধীনতারও আগের। মণ্ডপ প্রতিষ্ঠার পর ব্রজধন শর্মার বাবা বাবু শর্মাকে পুরোহিত হিসেবে নিয়ে আসা হয়েছিল সিলেট থেকে। ব্রজধনের স্ত্রীই বসুমতী ঠাকুরাইন। খইতুংবুড়া ছাড়াও পশ্চিম হালাহালিতে মেইপা হিসেবে মাইপাক সিংহেরও নামডাক ছিল। নৈমিত্তিক অসুস্থতা, নজর লাগা ইত্যাদির জন্যে লোকজন মাইপাকের কাছে আসত। কিন্তু উত্তর হালাহালির ইপুনাথের পর ডাকসাইটে মেইপা ছিলেন খইতুং। অনেক মন্ত্রগুপ্তি জানতেন খইতুং। বিশেষ করে শরীরের হাত-পা ভাঙা যেসব রোগীদের ডাক্তারের কাছে গিয়েও সুরাহা হত না সেইসব হাড় বনাজি ওষুধ দিয়ে অনায়াসেই জুড়ে দিতেন খইতুং। তন্ত্রমন্ত্র, ঝাড়ফুঁক, চালানবিদ্যায় পারদর্শী খইতুংবুড়ার কাছে দূরদূরান্ত থেকে লোকজন আসত। আমবাসা-কমলপুর রোডে হালাহালি স্কুল পেরিয়ে বাজারের দিকে একটু গেলেই আমাদের একক্লাস উপরের কমল গুপ্ত ও কন্ট্রাক্টর চিত্ত দেবের বাড়ির মাঝখানের রাস্তা চলে গেছে পশ্চিম হালাহালির দিকে। তখন এই রাস্তার দুপাশে ধানজমি। বাঁদিকে একটি পাকা নালা দিয়ে ধলাই নদী থেকে পাম্প সেটের মাধ্যমে সেচের জলের ব্যবস্থা। রাস্তাটি সোজা গিয়ে বাঁদিকে বেঁকে গেছে অপরেসকরের দিকে। তখন বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি অধ্যুষিত গ্রামটিতে একঘরই বাঙালি পরিবার। সহপাঠী বলাইদের বাড়ি। একঘর উপজাতি বাড়ি। আমাদের সিনিয়র ধীরেন্দ্র দেববর্মাদের বাড়ি। টি এন ভি উগ্রপন্থীদের আক্রমণ থেকে পরিবারকে বাঁচাতে পশ্চিম হালাহালিতে এসে বাড়ি করেছিলেন ধীরেন্দ্রর বাবা জ্যোতিমোহন দেববর্মা। স্কুল থেকে আমরা অনেক সময় খেতের আলপথ ধরেও বাড়ি ফিরতাম। উত্তরে একটু গেলেই পাশাপাশি দুটি বড়ো পুকুর। পুকুরপাড়ে সুপারিগাছের সারি। একটি পুকুর ছিল কুঞ্জবাবু সিংহের। আরেকটি খেলেন্দ্র সিংহের।
হালাহালি প্রাইমারি হেলথ সেন্টারের গা ঘেঁষে চওড়া মাটির রাস্তা পশ্চিমে চলে গেছে অপরেসকরের দিকে। দুদিকেই বাড়িঘর। আবার কিছুটা ফাঁকা। অনেকটা এগিয়ে গেলে সেরিকালচার অফিস। অনেক পুরোনো রেশমগুটি চাষের খেত। এই রাস্তা চলে গেছে অপরেসকর জে বি স্কুলের দিকে। এরপর পাহাড়ি ফাঁড়িপথ বেয়ে খোয়াই মহকুমায় যাওয়া যায়। ১৯৫২ সালে মাইগ্রেশন কার্ড করে পূর্ব পাকিস্তান থেকে ত্রিশটি পরিবার অপরেসকরে এসেছিল। এরও আগে ছ-সাতটি বাঙালি পরিবার আগে থেকেই ছিল। স্বাধীনতার পর ভারত সরকার ত্রাণ ও পুনর্বাসন দপ্তরের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তান থেকে রিফিউজিদের ভারতে স্থায়ী বসত ও এককালীন অর্থসাহায্যের বন্দোবস্ত করত। এই এককালীন অর্থসাহায্যকে বলা হত ডোল। মহকুমা স্তরের আধিকারিকদের কাছে রিফিউজিদের তথ্য নথিভুক্ত করতে হত। কবে কোন্ সময় বর্ডার পেরিয়ে রিফিউজিরা ভারতে এসেছেন, পরিবারের সদস্যসংখ্যা ইত্যাদি তথ্য লিখে রাখা হত। ত্রিপুরা ও পশ্চিমবঙ্গেই এই ত্রাণ ও পুনর্বাসন দপ্তর সক্রিয় ছিল বেশি। তখন অপরেসকর ও পানবোয়া একই গাঁওসভা। প্রথম বামফ্রন্ট সরকারের আমলে অপরেসকরের বাঙালি বসতির একটি অংশ এ ডি সি তথা স্বশাসিত জিলা পরিষদের আওতায় নিয়ে আসা হয়। বাঙালি বসতিকে এডিসি-র আওতায় নিয়ে আসার বিরুদ্ধে পরবর্তী সময় মামলাও হয়েছিল।
২৭.
হঠাৎই একদিন শোনা গেল কৃষ্ণ ঠাকুরের বড়ো মেয়ে কামিনীদির বিয়ে। বর মানিকভাণ্ডারের ছেলে। মনটা একটু খারাপ হয়ে গেল। মণ্ডপে এখন সন্ধ্যার পর মাঙ্গাং বাজিয়ে কে গাইবে
হা গোবিন্দ প্রাণনাথ
একবার মোরে দয়া করো
হা গোবিন্দ প্রাণনাথ।।
কুঞ্জে কুঞ্জে বিলাসিনী
চরণসেবা অভিলাষী
হা গোবিন্দ প্রাণনাথ ||
বামে লয়ে রাই কিশোরী
যুগল মূর্তি দেখা দাওহে
হা গোবিন্দ প্রাণনাথ…
মণিপুরিদের বিয়েতে পাত্রপাত্রীর কোষ্ঠীবিচার চূড়ান্ত হয়ে গেলে শুভদিন দেখে আনুষ্ঠানিকভাবে বিয়ের ও অন্যান্য লোকাচারের দিনক্ষণ ঠিক হয়। এই অনুষ্ঠানকে মাঙ্গনকাবা বলে, বাঙালিদের যা মঙ্গলাচরণ। মাঙ্গন মানে বারান্দা। কাবা মানে ওঠা। কৃষ্ণ ঠাকুরের বাড়িতেও পাত্রপক্ষের পাঁচ-সাত জন মিষ্টি ও ফলমূল নিয়ে এসেছে। মেয়ের পক্ষ থেকেও গ্রামের পুরোহিত, আত্মীয় পরিজন ও কিছু গণ্যমান্য লোককে নিমন্ত্রণ করা হয়েছে। আজই বিয়ে ও অন্যান্য লোকাচারের দিনক্ষণ ও আনুষঙ্গিক কথাবার্তা পাকা হবে। ৯ সংখ্যাটিকে মণিপুরিদের অনেকেই অশুভ ভেবে এড়িয়ে যান। কোথাও বেড়াতে গেলে নবম দিনে বাড়িতে ফেরাকে অশুভই ধরে নেওয়া হয়। এতে অমঙ্গল ঘটে। যেহেতু মণিপুরিদের সাতটি আদি গোষ্ঠী তাই ৭ সংখ্যাটিকে বরং অনেকেই শুভ মনে করেন। মাঙ্গনকাবার দিন ছোটো একটি ঘট বসিয়ে তুলার বর্তি বা তুলোর সলতের প্রদীপ ও ধূপ জ্বালিয়ে ব্রাহ্মণ মন্ত্র উচ্চারণ করেন। প্রথমেই উপস্থিত সকলকে লেইচন্দন দিয়ে অভ্যর্থনা করা হল। লেই মানে ফুল। কলাপাতার গোল চাকতি কেটে তাতে পানসুপারি সাজিয়ে পানা তাংখ্রা ও ফলমূল সাজিয়ে হেইরা তাংখ্রা ঘটের সামনে রাখা হয়। মণিপুরিতে হেই মানে ফল। এই লেইচন্দন ও তাংখ্রা সাজানোরও কিছু নিয়ম আছে। মাঙ্গনকাবার পরের অনুষ্ঠান হেইজিপত। এই দিনটির জন্য কৃষ্ণ ঠাকুরের বাড়ি থেকে গোটা গ্রামে নিমন্ত্রণ বা বার্তন গেল। বার্তন মানে অর্ধচন্দ্রাকারে কাটা কলাপাতার এক টুকরো, পানসুপারি ও ফুল কলাপাতার গোল চাকতিতে সাজিয়ে রেখে এই নিমন্ত্রণ। সন্ধ্যার আগে বাড়ি বাড়ি গিয়ে তুলসী গাছের তলায় রেখে নিমন্ত্রণ করতে হয়। বরের বাড়ি থেকে পাঁচ-সাত জন মিষ্টি ও ফলমূল নিয়ে কনের বাড়িতে অনুষ্ঠান করতে এসেছেন। এই অনুষ্ঠানের জন্য একটি লাইপত নিয়ে যেতে হয়। লাই মানে দেবতা, পত মানে জিনিস। লাইপত নেওয়া হয় বাঁশবেত দিয়ে তৈরি ঢাকনাওয়ালা একটি সুন্দর পাত্র বা ফিঙ্গারুকের মধ্যে। একজন সধবা যার প্রথম পুত্র সন্তান হয়েছে তিনি এটি মাথায় করে নিয়ে এলেন। এই মহিলার পরনের লেইফানেক অবশ্যই বুকের উপর থাকতে হয়। গায়ে থাকতে হয় সাদা মণিপুরি ওড়না। ফিঙ্গারুকের মধ্যে কলাপাতার লাতন বা অগ্রভাগ বিছিয়ে তাতে গুড় মাখানো খই, নারকেল, চামপ্রা নামে এক ধরনের লেবু, চং থকপা লাফই অর্থাৎ এককাঁদির মধ্যে ছয় বা দশ বা চোদ্দোটি কলা, সাদা আখ, এক প্রকার গাছের ডাল লাঙথ্রেই মতোন তিলের নাড়ু, চিড়ার নাড়ু ও অন্যান্য আস্ত ফল, পানসুপারি, ধূপকাঠি, মোমবাতি অর্থাৎ য়ুমলাই পূজার যাবতীয় সামগ্রী দেওয়া হল। কনের বাড়িতে প্রবেশের পথে লাইপত মাথায় মহিলা থাকেন সবার আগে। এরপরই পানসুপারির ফিঙ্গারুক মাথায় মহিলা। পেছনে মিষ্টির ফিঙ্গারুক বহনকারী মহিলা। বরের বাড়ি থেকে আসা লাইপত ও বাকি দুটি ফিঙ্গারুক কনের বাড়ির সেই একই শুভ লক্ষণের য়াইফাবা মহিলারাই একে একে গ্রহণ করেন যারা সধবা এবং যাদের পুত্রসন্তান হয়েছে। শুধুমাত্র লাইপত য়ুমলাই বা আদি গৃহদেবতার সামনে নামিয়ে রাখা হয়। এরপর লেইচন্দন দিয়ে সব আমন্ত্রিতদের স্বাগত জানানোর পর মিষ্টি বিতরণের পর্ব। এই পর্বে কনের দিকের একজন মান্য ব্যক্তি কৃষ্ণ ঠাকুরের কাছে জানতে চাইলেন, আজ আপনার বাড়িতে কেন এই আয়োজন? কৃষ্ণ ঠাকুর বললেন, আমার বড়ো মেয়ে কামিনীর সঙ্গে মানিকভাণ্ডার নিবাসী রামগোপাল শর্মার ছেলে রামকুমার শর্মার বিয়ের কথা পাকা হয়েছে। তাদের মঙ্গল কামনায় এই সামান্য আয়োজন। ছেলের বাবার কাছেও কৃষ্ণ ঠাকুরের কথাগুলোর সত্যতা জানতে চাওয়া হল। বয়স্ক এবং উপস্থিত সবার উদ্দেশ্যে রামগোপাল শর্মা সত্যতা স্বীকার করে ছেলে মেয়ে দুজনের মঙ্গল কামনায় বিধাতা ও উপস্থিত সবার কাছে আশীর্বাদ প্রার্থনা করলেন। হেইজিপতের পর বরের বাড়ির সবাই চলে গেলে লাইপতের পূজার সামগ্রী দিয়ে য়ুমলাইয়ের পূজা শুরু হল। লোকাচার অনুসারে সন্ধের পর ছেলেমেয়েরা অনেকেই এল লিকন সানাবা বা পাশা খেলতে।
লুহোংবা বা বিয়ের দিন কামিনীদির উপোস। মণিপুরি লু শব্দটির অর্থ শরীর। হোংবা মানে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাওয়া। সন্ধ্যায় বর এল। লোকাচার অনুসারে মানিকভাণ্ডার থেকে হালাহালি, এই পাঁচ কিলোমিটার পথ আসতে গিয়ে পথে তিনবার বিশ্রাম নিতে হয়েছে। কাছাকাছি এসে শেষ যেখানে বিশ্রাম করেছে, কামিনীদির ভাই রাধাকিশোর সেখানে গিয়ে হবু বরকে সূর্যাস্তের আগে লেইচন্দন, পানা তাংখ্রা ও সাদা ফুলের মালা পরিয়ে বার্তন বা আমন্ত্রণ করে এসেছে। কনের বাড়িতে সংকীর্তনের রাগা শেষ হলেই বর প্রবেশ করতে পারবে। বরের আগে আগে প্রথমেই লেইচন্দন বহনকারী ধুতি পাঞ্জাবি পরা কপালে তিলক কাটা ছোট্ট একটি ছেলে। একে একে লাইপত পানাকোয়া, ফিরুক নুংশা, মিতম ঙা বহনকারী। এর ঠিক পরেই বর ও বরযাত্রীরা। লেইচন্দন ও পানা তাংখ্রা দিয়ে বর কনের বাড়ির গুরুজনদের প্রণাম করবে। সঙ্গে নিয়ে আসা লাইপতের পূজার উপকরণ দিয়ে য়ুমলাই বা আদি গৃহদেবতার পূজা হবে। ফিরুক নুংশাতে অর্থাৎ সাদা রুমাল দিয়ে ঢাকা একটি ছোট্ট বেতের টুকরির মধ্যে বরের বাড়ি থেকে আনা চাল, হলুদ, আদা, দক্ষিণার টাকা। বিয়ের পরে তৃতীয় দিনে বরের বাড়ি থেকে লাইপত বহনকারীসহ তিনজন সধবা মহিলা এসে ফিরুক নুংশার বাঁধন খুলবে। তখন যদি দেখা যায় সেই চালের মধ্যে মাকড়সা রয়েছে, সবাই ধরে নেন নতুন দম্পতির অনেক বাচ্চাকাচ্চা হবে। আর যদি চালে ছোটো কাচপ্পি পোকা থাকে তো ধরে নেওয়া এই জুটির খুব মিল হবে। মিতম ঙা-র জন্যে দুইটি জ্যান্ত লাটি মাছ রাখা হয়। বিয়ের সময় নাকি দুটি জ্যান্ত লাটি মাছের নড়াচড়া দেখে দাম্পত্য জীবনের ভবিষ্যৎ অনুমান করা হয়। বরের সঙ্গে রয়েছেন সহচর বরের জামাইবাবু সম্পর্কের একজন জামাই সেনাবা। বরের বাড়ি থেকে বয়ে আনা সামগ্রী নেওয়া হল কনের বাড়ি পক্ষ থেকে। গেটে দাঁড়িয়ে থাকার সময়ই বরের খং হামবা বা পা ধোয়ার আয়োজন। খং মানে পা। হামবা মানে ধোয়া। একটি কলসিতে জল ও পিঁড়ি পাতা। পা ধুইয়ে দেওয়ার জন্যে কনের ছোটোভাই গোছের ছেলেটিকে বখসিস দিতে হয়। কনের বাড়ির মূল উঠানে প্রবেশের সময় প্রথমে তিনটি দেউটি জ্বালিয়ে কনের বাড়ির লোকজন বর ও বরযাত্রীদের অভ্যর্থনা করলেন। কনের বাড়ির মেয়েরা মজা করে ফুল ছিটিয়ে ছিটিয়ে বরকে ব্যতিব্যস্ত করার চেষ্টা করে যাচ্ছে আর সহচর জামাই সেনাবা ছাতা দিয়ে বরকে ফুলের টোকা থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করছে। কামিনীদির মা-সহ তিনজন মহিলা বরণডালা দিয়ে বরকে বরণ করলেন। বরযাত্রীরা কুঞ্জের সামনে তাদের নির্দিষ্ট জায়গায় গিয়ে বসলেন। কিন্তু বরের মা-সহ কয়েকজন মহিলা বসলেন বরযাত্রীদের মুখোমুখি উলটো দিকে। একটু পরেই জামাই সেনাবা বরকে সংকীর্তন প্রণাম করিয়ে লেইচন্দন ও পানা তাংখ্রা দিয়ে কনের বাড়ির গুরুজনদের প্রণাম করাল। একই রকমে কামিনীদিদের ঘরের ভিতরে গিয়ে মহিলা গুরুজনদেরও প্রণাম করিয়ে বরকে নিয়ে বেরিয়ে এলেন জামাই সেনাবা। এরপর কুজাবা বা বরের বাড়ি থেকে নিয়ে আসা কনের সাজের পোশাক কনের হাতে তুলে দেওয়া হল। লেইফানেক, সাদা ওড়না, শায়া, ব্লাউজ। সাধ্যমতো সোনার গয়না। প্রসাধন সামগ্রী। মণিপুরি মহিলারা কুজাবার এই কাপড় ও গয়না আমৃত্যু আগলে রাখেন। কাউকে দান বা বিক্রি করলে অমঙ্গল ঘটে বলেই মনে করা হয়। বিয়ের জন্যে কনেকে পরানো হয় পলয় বা পৎলয়। রাসলীলায় গোপীদের অলংকৃত গাউনের মতো। খোলা চুলে গোলাকার লাল সোনালি চাকতি লেইতেরেং। এই পলয় ও লেইতেরেং বরের বাড়ি থেকেই নিয়ে আসা হয়েছে। এদিকে বারান্দায় কনের মায়ের মতো বয়স্ক তিনজন মহিলা মিলে বরের মায়ের মতো বয়স্ক তিনজন মহিলাকে নিয়ে পানা সেংগা লানাবা সম্পন্ন করেছে। এটি মূলত কনের বাড়ির পক্ষ থেকে পান সুপারি প্রদান। প্রণাম ও প্রতিপ্রণাম। এরপর জামাই ফান ফামবা। বরের সহচর জামাই সেনাবা কুঞ্জে বরের আসনে বরকে নিয়ে গিয়ে বসিয়ে দিলেন। আসনে বসার আগে বর তিনবার হাতজোড় করে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করলেন। তখন সংকীর্তনও চলছিল। বাঙালিদের মতো মণিপুরিদের বিয়েতে ঘড়ির কাঁটা ধরে লগ্ন নিয়ে তাড়াহুড়ো নেই। যেখানে সংকীর্তন চলতে থাকে সেখানে পুরো সময়টাকেই শুভ বলে ধরে নেওয়া হয়। কামিনীদিকে কুঞ্জে নিয়ে এলেন মৌ কনাবী বা কনথকপী। মৌ মানে বৌ। কনাবা হল আগলে রাখা। কনের সামনে ছোট্ট একটি মেয়ে মাথায় ফিদা বা আসন নিয়ে বেরিয়ে এল। কৃষ্ণ ঠাকুরের কন্যাদান শেষ হওয়ার পরই সাতপাক। কন্যাদানের দানসামগ্রী বরের মায়ের কোলে রাখা হয়ে গেছে। কনেকে একা একা মৃদঙ্গ ও গানের লয়ে ঘুরে ঘুরে বরকে প্রত্যেকবার প্রদক্ষিণের পর বরের মাথায় ফুল দিতে হয়। কনের সামনে থেকে পালার ঈশেই শাকপা বা প্রধান গায়ক নেচে গেয়ে কনেকে তালে তালে এগিয়ে যেতে সাহায্য করছেন। কুঞ্জের এই তাল লয়ের জন্য বিয়ের আগে অনেক তালকানা মণিপুরি মেয়েদেরই একটা ভয় কাজ করে। শেষ পাকে দুটি ফুলের মালা বরকে পরানোর পর বরের বাঁ পাশে কনেকে বসানো হলে বর একটি মালা খুলে কনেকে পরিয়ে দিলেন। তিনজন ব্রাহ্মণ মন্ত্রপাঠ করে আশীর্বাদ করে ফিজি কিবা বা দুজনের কাপড়ের প্রান্ত নিয়ে গিঁট দিলেন। বরকনেকে কুঞ্জ থেকে ঘরে নিয়ে বসানো হল। সেখানে বেশ হই হুল্লোড়, ঠাট্টা ইয়ার্কির মধ্য দিয়ে পানাকোয়া ও খয়দুম লানাবা পর্ব। বর ও কনে একে অপরকে নাড়ু, মিষ্টি, পানসুপারি খাইয়ে দিচ্ছে। খয়দুম মানে নাড়ু। এরপর বরকনেকে দুই পক্ষের তিনজন করে মোট ছ-জন মহিলা পানা তাংখ্রাসহ আশীর্বাদ করলেন। শেষে পুরোহিত ফিজি লকথকপা বা বরকনের কাপড়ের গিঁট খুলে দিলেন। কুঞ্জে তখনো সংকীর্তন চলছে। দু-পক্ষ থেকেই সংকীর্তনের গায়ক বাদকদের ফিরই দেওয়া হল। জামাই সেনাবা বরকে নিয়ে এসে সংকীর্তন প্রণাম করিয়ে নেওয়ার সাথে সাথে সংকীর্তন ও বিয়ে শেষ হল।
ইসলামিক হিস্ট্রি এম এ পরীক্ষা হয়ে গেছে। আগরতলা সেন্টার। বাবা আর রঞ্জিৎ স্যার পরীক্ষার ক-দিন আমাদের আগরতলা বাড়িতেই ছিলেন। দুজনে মিলেই রান্নাবান্না করেছেন। বাবা খুব ভালো রান্না করেন। তুলনায় মায়ের রান্না তত ভালো নয়। বাড়িতে কাউকে খাওয়ার নেমন্তন্ন করলে বাবাই রাঁধতেন। প্রশংসা কুড়োতেন মা। রান্নার ব্যাপারে বাবা বলতেন, রান্না করতে হয় শান্ত মন নিয়ে। আন্দাজজ্ঞান থাকতে হয়। এর উপরই রান্নার স্বাদ নির্ভর করে। বাবা খুব ভালো সাজেশন মেকারও ছিলেন। ইসলামিক হিস্ট্রি এম এ-র সাজেশন এমনভাবে তৈরি করেছিলেন, প্রতিটি পেপারের আগের দিন রঞ্জিৎ স্যারকে বলতেন, কাল প্রথম এই প্রশ্নের উত্তর লিখব। তারপর দ্বিতীয় এই প্রশ্নটি। এভাবে সবগুলো প্রশ্ন আগে থেকেই বলে রাখতেন। রঞ্জিৎ স্যারও পরদিন হলে গিয়ে অবাক। আগে থেকে ছকে রাখা হুবহু সেই প্রশ্নগুলিই পরীক্ষায় এসেছে! শেষের দিকে একটি পরীক্ষার আগে বাবা খুবই অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরীক্ষার দিন সকালে মাথা তুলতেই পারছেন না। স্যারকে বললেন, রঞ্জিৎবাবু আপনি পরীক্ষা দিতে যান। আমি আবার সামনের বছর বসব। স্যারও খুব বিমর্ষ হয়ে পড়েছিলেন। সেদিন সকালে আস্তে আস্তে বাবা উঠে দাঁড়ালেন। রিকশায় স্যারের গায়ে শরীর এলিয়ে দিয়ে সেন্টারে পৌঁছোলেন। একটি প্রশ্নের উত্তর লেখার পরেই বাবার ভেতরের সেই অশ্ব যেন জেগে উঠল। পরপর লিখে ফেললেন সব ক-টি উত্তর।
সামার ভ্যাকেশন। অল্প কিছুদিনের জন্যে আগরতলা গেছিলাম। বাড়িতে তখনো ইলেকট্রিক কানেকশন আসেনি। জগৎপুর তখন বদ্ধ গ্রাম। আমাদের বাড়ির দক্ষিণেই প্রায় এককানি জায়গা নিয়ে যামিনী দেবনাথদের ধানখেত। এরপরে বাঁশবাগান। তখনো ঘনবসতি গড়ে ওঠেনি। হ্যারিকেনের আলোয় পড়াশোনা। কে বলবে রাজধানীতে থাকি? তখনো আগরতলা খুবই গ্রামীণ। উজান অভয়নগর থেকে রিকশা করে নয়তো জিবি বাজার থেকে টাউন বাসে করে শহরে যেতে হত। অনেক শহরতলিই তখন রীতিমতো গ্রাম। আমাদের জগৎপুরে তখন অনেক বাঁশবাগান। বিভিন্ন পূজার সময় আশেপাশের ক্লাবগুলো প্যান্ডেল তৈরির জন্যে বাঁশ কেটে নিয়ে যেত। এই বাঁশ কাটা নিয়ে হুজ্জতিও হত। আমাদের বাড়ির পাশের টিলাগুলিতে অদ্ভুত ধরনের চ্যাপ্টা ছোটো ছোটো পাথর পাওয়া যেত। পাথরের ফাঁপা অংশ ভাঙলে দেখা যেত গন্ধক রংয়ের গুঁড়ো। হালাহালিতে ফেরার সময় পাশের বাড়ির হেমেন্দ্রকাকুর মেয়ে মীরাদিকেও মা সঙ্গে করে নিয়ে এলেন।
ক্রমশ…
নৃতত্ত্ব is the scientific study of humanity, concerned with human behavior, human biology, cultures and societies, in both the present and past, including past human species. Social anthropology studies patterns of behaviour, while cultural anthropology studies cultural meaning, including norms and values…. হুম