রেডিও বন্ধ ক’রে শিবানী সেটা ট্রাঙ্কের ভেতর চালান করে দিল। তারপর শােনা ঘটনাগুলাে মনের মাঝে নাড়াচাড়া করতে লাগল। ভাবতে লাগল ও যে সরকারী বিবরণে যা বলা হয়েছে ততটাই কতনা ভয়াবহ। বাস্তবে না জানি আরও কি ভয়াবহ বর্বর ও জঘন্ন অত্যাচার চলেছে তাদের ওপর যারা এই ভারতের নাগরিক। দুর্মনায়মান শিবানী মনে মনে একটা কথা ভেবে আশ্বস্ত হ’ল যে শুভ্রেন্দু এখন কলকাতায়। সে এখানে থাকলে দুশ্চিন্তায় দুর্ভাবনায় শিবানী কিছুতেই এই হােষ্টেলে পড়ে থাকতে পারত না। কিন্তু জ্যাঠামণি, জেঠিমা, তাদের প্রতিও ত’ তার একটা কর্তব্য আছে। হ্যাঁ আছে বই কি। কালই মাকে চিঠি লিখবে ও— যেন তারা প্রাণ থাকতে ওদের কোন ক্ষতি হতে না দেয়। হ্যাঁ, আর একজনকেও চিঠিতে অনুরােধ জানাবে ওদের ওপর নজর রাখতে— যে হ’ল কানাই কাকতি। ধীমতী শিবানী বােঝে কানাই কাকতির যেটুকু দুর্বল আছে ওর ওপর তাতে তার অনুরােধ সে উপেক্ষা করতে পারবে না। ও অঞ্চলে যারা হাঙ্গামা করতে পারে তাদের দলে যে বিশিষ্ট আসনে কানাই কাকতি থাকবে সে বিষয়ে শিবানীর কোন সন্দেহ নেই।
হ্যাঁ, কাল সকালেই খাম কিনে এনে চিঠি দিতে হবে। রাতের আহারে হাত নেড়েচেড়ে এসে একরূপ অভুক্ত অবস্থায়ই চিন্তান্বিতা শিবানী বিছানা নিল। কিন্তু বিছানা নিল বটে চোখের পাতায় ঘুম এলাে না। প্রেসনােটে যে ঘটনায় চুম্বক ও জানতে পেরেছে— তার সূত্র ধরে শিবানীর মনের মাঝে যেন বীভৎস, বর্বর আক্রমণগুলাে চলচ্চিত্রের ছবির মত থেকে থেকে স্পষ্ট হয়ে ভেসে উঠতে লাগল।
একসময় ও অশান্ত মন নিয়েও ঘুমিয়ে পড়ল, কিন্তু ঘুমের মাঝে সেইসব দৃশ্য স্বপ্ন হয়ে ওর মনকে করল আচ্ছন্ন। পেল একদল অসমীয়া দুর্বৃত্ত পাশব প্রবৃত্তিতে উল্লসিত হয়ে ইণ্ডিয়ান রিফাইনারীর এক বাঙ্গালী বড়বাবুর বাড়ী আক্রমণ করছে। কয়েক মুহূর্তে সারা বাড়ীতে যেন গুণ্ডাদের প্রেতনৃত্য শুরু হয়ে গেল। ওরা অন্দরে ঢুকে ভদ্রলােকের ভয়ব্যাকুলা স্ত্রীকে ঘৃণিত প্রয়াসে নিষ্ঠুর আকর্ষণে ধরে এনে একের পর এক তার ওপর চালাতে লাগল অকথ্য অত্যাচার, যাকে সভ্য মানুষের ভাষায় বলে পাশবিক আচরণ। স্বামীর সাক্ষাতে স্ত্রীর ওপর বর্বর অমানুষিক অত্যাচার! দুর্বৃত্তরা বলিষ্ঠ হাতে ধরে আছে ভদ্রলােকের একটি বাহু। তিনি শরীরের সকল শক্তিতে চেষ্টা করছেন ওদের হাত থেকে মুক্তি পেতে। মনে মনে সঙ্কল্প নিচ্ছেন যে করেই হ’ক পিশাচদের প্রতিনিবৃত্ত করতে হবে। শেষ পর্য্যন্ত বাম হাতের বাহুমূল ছিঁড়ে হুমড়ি খেয়ে পড়লেন গিয়ে স্ত্রীর বুকে পাশব প্রবৃত্তি চরিতার্থ করতে নিরত বিকট দর্শন লােকটির ওপর। পাশ থেকে আর এক দুর্বৃত্ত হাতের মােটা ভাণ্ডাটা সজোরে মারল বাঙ্গালী ভদ্রলােকের মাথায়। ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটলাে। বুক ফাটা আর্তনাদ করে গড়াগড়ি দিতে লাগলেন ভদ্রলােক। ভদ্রমহিলাও তখন সংজ্ঞাহীনা। সে কি বীভৎস দৃশ্য।
আঁ…আঁ…আঁ…..
স্বপ্নের মধ্যেই ভয়ার্ত চীৎকার করে বিছানায় উঠে বসল শিবানী। সে শব্দ নিস্তব্ধ রাত্রির নির্জনতা খানখান করে ছড়িয়ে পড়ল দিক হতে দিগন্তে। পাশের ঘরের একটি মেয়ে কামরা থেকে বেরিয়ে এসে শিবানীর কপাটে করাঘাত করতে লাগল:
— এই শিবানী, কি হল ?
—ও কিছু নয়— স্বপ্ন দেখছিলাম। তুই শুয়ে পড়
বলল শিবানী। মেয়েটির পায়ের চপ্পলের শব্দ দূরে মিলিয়ে গেলে শিবানী বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ল। এগিয়ে গিয়ে সুইচে হাত রাখল। আলােয় ভরে গেল ঘর। বুক, গলা, ঘাড়, সারা গায়ে ওর বিন্দু বিন্দু ঘাম। এগিয়ে গেল কুঁজোর দিকে। পর পর দু’গ্লাস জল ঢক ঢক করে ঢেলে দিল গলায়। নাক দিয়ে গরম নিশ্বাস পড়ছে ঘনঘন। আবার এসে দেহভার এলিয়ে দিল বিছানায়।
চিন্তা আর চিন্তা। এ চিন্তার হাত থেকে মুক্তি পেতে চায় শিবানী। মনটাকে নিয়ে যায় এই হােষ্টেলের কামরা থেকে, আসাম থেকে— সেই পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী, এশিয়ার অন্যতম বৃহত্তর সহর কলকাতায়। তারপর সতর্কে এগিয়ে গিয়ে আড়ি পাতে শুভ্রেন্দুর হােটেলের কামরায়। ঠিক যা ভেবেছিল, পাঠ পাগল শুভ্রেন্দু রাত জেগে টেবিল ল্যাম্পটার আলােকছত্রের নীচে বসে একমনে লিখে যাচ্ছে। কি লিখছে এত মনােযােগ দিয়ে? পাশে স্তূপাকৃতি নােটখাতা। বুঝেছে শিবানী, যে থিসিসটা ও সাবমিট করবে ডক্টরেট-এর জন্য সেটার সাধনায় ও এখন মগ্ন। ওর ঐ ধ্যানগম্ভীর মূর্ত্তি ওদের বাড়ীতে গিয়ে ওর পড়ার ঘরে আড়ি পেতে কতবার দেখেছে শিবানী। কতদিন মনে মনে ভেবেছে মানুষটা পারিপার্শিক ভুলে কি করে যে এতটা তন্ময় হয়ে যায়!
আবার ঘুম নামে শিবানীর চোখে। আবার ওর চেতনা ও চিন্তা নিঃসাড় হয়ে আসে। কিন্তু সে নিদ্রা প্রগাঢ় নয়— সে নিদ্রাও চিন্তাকীর্ণই বলা চলে। চিন্তা আবার রূপ পায় স্বপ্নে।
সে স্বপ্ন ভ্রাতৃনিধন যজ্ঞের কোলাহল মুখর। মার মার শব্দে যারা এগিয়ে এসে ঢুকলে আসামে চার পুরুষের বাসিন্দা জ্যেঠামণিদের বাড়ীতে তার নেতৃত্ব করছে যে শুভেন্দুর প্রতি বরাবরই দূর্বাক কানাই কাকতি! প্রচণ্ড উল্লাসে সে তার সশস্ত্র দলবল সহ প্রতিটি ঘরে কাকে খুঁজে ফিরছে? জ্যেঠামণিকে দেখেও দেখল— ভয়ার্ত জেঠিমাও ওদের মনোেযােগ আকর্ষণ করল না। তারপর যে এগিয়ে যাচ্ছে ওরা শুভ্রেন্দুরই ঘরে! সারা গায়ে কঁটা দিয়ে ওঠে শিবানীর! যে ঘরে বিবূধ শুভ্রেন্দু বিদ্যার সাধনা চলে— সেই ঘর কলঙ্কিত হচ্ছে আজ কুটিল প্রয়াসপুষ্ট ভ্রাতৃঘাতি সংগ্রামে লিপ্ত জহ্লাদদের পদ-স্পর্শে! হ্যাঁ, ঐ ত’ দুর্নীত কানাই এগিয়ে গিয়ে সারল্যের প্রতিমূর্ত্তি শুভ্রেন্দুর মুখোমুখি দাঁড়ালাে এক দুর্নিবার সংকল্প নিয়ে। শিবানী শিউরে উঠল কানাইয়ের হাতের শানিত ছুরিকা দেখে। ঘুমের ঘােরেও ঘন ঘন নিশ্বাস পড়তে লাগল ওর। বুকটায় এক প্রচণ্ড অব্যক্ত যন্ত্রণা উথালি পিথালি করতে লাগল। স্বপ্নঘােরেই মধ্যরাত্রির বিবিক্ত বিছানায় ছটফট করতে লাগল ও। তারপর বুকফাটা ভয়ার্ত্ত চীৎকার করে উঠল শিবানী শুভ্রেন্দুর ধড় ছাড়া মাথাটা অন্ধকারের বুকে ভেসে বেড়াতে দেখে।
—আঃ আঃ আঃ
আবার আর্তনাদ করে ওঠায় শিবানীর ঘুম ভেঙ্গে গেল। সঙ্গে সঙ্গে প্রবল উত্তেজনায় উঠে বসল সে। হাতের পিঠ দিয়ে চোখ ঘসল চোখের পাতা আন্দোলিত করে চাইল এদিকে ওদিকে— সত্যি নয়ত। ওর যেন তবু ঘাের কাটতে চায় না। মনে হচ্ছে শুভ্রেন্দুর ধড় ছাড়া মাথাটা যেন এখনও এই নির্জন ঘরের মধ্যেই ভেসে বেড়াচ্ছে।
বিছানা ছেড়ে নেমে পড়ল বিধুনিত শিবানী। সুইচ টিপে আলো জ্বাললো। কুঁজোর কাছে গিয়ে মাথার তালুতে জল ঠাসল। কি বিশ্রী স্বপ্ন। তবু এ স্বপ্ন আজ অনেক হতভাগ্য বাঙ্গালী যুবকের জীবনেই সত্য হয়েছে। যদি সত্যিই শুভ্রেন্দুকে ওরা… প্রচণ্ড ভয়ে শিউরে ওঠে ওর সারা দেহ-মুখ দিয়ে একটা ব্যথা করুণ ভয়ার্ত্ত আর্ত্তনাদ বেরােয়।
আগুন জ্বলেছে সমগ্ৰ আসাম উপত্যকায়—আগুন জ্বলছে আজ শিবানীর মনেও। কেমন এক অস্থিরতায় ঘরময় পায়চারি করে ফেরে ও। কখনও দাঁত দিয়ে নীচের ঠোঁট দংশন করে। কখনও মাথার দু’পাশের দপদপ করা রগদুটো টিপে ধরে হাতের আঙ্গুল দিয়ে। কখনও চেয়ারটায় গিয়ে বসে টেবিলের ওপর কনুই রেখে হাতের তালুতে চিন্তা-ভার মাথা রাখে। কখনও ডাক ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করে ওর। উৎকণ্ঠা ভরা একটা অব্যক্ত যন্ত্রণা যেন ওর পেটের ভেতর থেকে পাকিয়ে পাকিয়ে স্প্রিং-এর মত উঠে গলা অবধি এসে আটকে যায় বারবার।
ঘরটায় প্রচণ্ড গুমােট। দম যেন আটকে আসে ওর। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দরজার ছিটকিনি খুলে মানসিক যন্ত্রণাকাতর ও বাইরে বেরিয়ে আসে। ফুলবাগান থেকে আসা বাসিত হাওয়া বুকভরে টেনে নিতে নিতে শিবানী ক’বার সতর্ক পায়ে পায়চারি করে বারান্দার এ মাথা থেকে ও মাথা।
এক সময় চেয়ে দেখে পূবের আকাশে উষার আভাস। দু’একটা নিদ্রাজাগা পাখি তখন নীড় ছেড়ে অসীম আকাশে উড়ে যায় আলস্যের আড় ভেঙ্গে। কণ্ঠে তাদের খুসীর কাকলি। কিন্তু আসামের এক শ্রেণীর অধিবাসী বাঙ্গালী আজ জয়ে বিবর্ণ। তাদের মুখে ঐ রকম খুসীর কাকলি কি আর কোন দিন শােনা যাবে? ভাবতে ভাবতে পায়চারি করে— পায়চারি করতে করতে ভাবে শিবানী। ভাবে আর ভাবে।
নোট : বানান অবিকৃত