Daruharidra
  • ধান্যগৃহ
  • কবিতা
  • গল্প
  • গদ্য
  • প্রবন্ধ
  • উপন্যাস
Daruharidra
  • ধান্যগৃহ
  • কবিতা
  • গল্প
  • গদ্য
  • প্রবন্ধ
  • উপন্যাস
Daruharidra
No Result
View All Result
Home গদ্য

শিবাশিস চট্টোপাধ্যায় || অষ্টম পর্ব

গদাধরের বাউদিয়া || ধারাবাহিক

Daruharidra by Daruharidra
23/08/2021
in গদ্য
11
শিবাশিস চট্টোপাধ্যায় || অষ্টম পর্ব
207
VIEWS

 

গৌরীপুরে দুর্গাপুজোর নিজস্ব এক ঐতিহ্য রয়েছে। শহরে দেবী মহামায়ার দু-দুটো মন্দির— তার মধ্যে একটি নগরের কেন্দ্রে, প্রায় রাজপ্রাসাদ-সংলগ্ন, যেন গিরিরাজ কন্যা গৌরীর শ্বশুরালয়, অপর মন্দিরটি একটু সাদামাটা, যার অবস্থান আধা কিঃমিঃ দূরে, মহামায়া মাঠের একদম পূর্ব-সীমানায়। এটিই যেন গিরিরাজগৃহ— গৌরীর বাপের বাড়ি। যদিও দেবী-বিগ্রহ একটিই, যেটি সারা বছর ভক্তকুলের পুজো গ্রহণ করে রাজবাড়ি-সংলগ্ন মন্দিরে। দুটো মন্দিরেই দেবী পালা ক’রে থাকেন। পুজোর দিনক’টা বাপের বাড়িতে কাটিয়ে পূজোর শেষে আবার স্বস্থানে ফিরে যান। তবে ধাতব বিগ্রহের পুজো ছাড়াও, বিগ্রহের অনতিদূরে অবস্থানরত শোলার দুর্গার পুজোই হচ্ছে প্রাচীন পরম্পরার পুজো, যা এখনও পালিত হয়ে চলেছে। দুর্গাপুজোর প্রাক্কালে দেবী বিগ্রহকে রীতিমতো শোভাযাত্রা করে, ঢাক-ঢোল বাজিয়ে এক মন্দির থেকে আরেক মন্দিরে আনা হয়। আমাদের ছোটবেলায় দেখেছি বেলবরণের দিনেও আরেক মিছিল যাচ্ছে গদাধরের ঘাটে, যে মিছিলে একদা ভক্তরা ছাড়াও অংশগ্রহণ করত প্রায় কুড়ি-পঁচিশটা সুসজ্জিত হাতি। এর মধ্যে কয়েকটা, যাকে বলে, কুনকি হাতি। তবে সব ক’টা হাতিই মধ্যমকুমার লালজির, পুজোর ক’দিন আগেই ডুয়ার্স সহ বিভিন্ন জঙ্গলস্থিত ক্যাম্প থেকে হাঁটিয়ে তাদের গৌরীপুরে আনা হত। সে যাই হোক, দুর্গাপুজোর মহাষষ্ঠীর দিনে বেলবরণে হাতির শোভাযাত্রা ছিল দেখার মতো। এখনও মনে পড়ে বেলবরণের শোভাযাত্রার সেই হাতির মিছিল। শোভাযাত্রায় যোগদানের আগে সারাদিন ধরে সে হাতিগুলিকে মাঠের ধারে বসিয়ে চন্দন-সিঁদুর প্রভৃতি দিয়ে সাজানো হত। সময়ের সাথে সাথে অবশ্য হাতির সংখ্যা কমতে থাকে। আমাদের ছোটবেলায় আমরা দু-তিনটি হাতির বেশি দেখিনি। শোভাযাত্রা যখন আমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে যেত, আমার ছোটবোন মৌ কোনও কোনও বার মাহুতের হাত ধরে লাফিয়ে চড়ে বসত সোজা হাতির পিঠে, হাওদার ওপর। মৌ বরাবরই একটু দামাল প্রকৃতির। আমি শান্ত, দূর থেকে লীলা দেখি জীবনের। তবে আমার মনেও হাতিভ্রমণের সাধ ছিল, তবে অন্য অনেক সাধের মতো সেটাও আজ অবধি অপূর্ণই রয়ে গেছে। এখন আর সেই রাম নেই, অযোধ্যা নেই, জমিদারি নেই, ঠাঁটবাটও নেই। কারণ, পুজোর মধ্যমণি মধ্যমকুমার লালজিই নেই। পূর্বের আড়ম্বর কমতে কমতে প্রায় তলানিতে ঠেকে গেছে সেই কবেই।

তবে আমাদের ছোটবেলাতেও পুজোর রাজকীয় জাঁকজমক কিছুটা অন্তত টিকে ছিল। কারণ তখনও লালজি বেঁচে ছিলেন এবং বহাল তবিয়তেই ছিলেন। লোকমুখে লালজি, প্রকৃত নাম প্রকৃতীশ চন্দ্র বড়ুয়া, চলচ্চিত্রাভিনেতা প্রমথেশ বড়ুয়ার ভাই। প্রমথেশ বড়ুয়ার পরিচয়েই শুধু নয়, তিনি নিজেও ছিলেন স্বনামধন্য এবং একজন আন্তর্জাতিক মানের হাতি শিকারী ও হাতি বিশেষজ্ঞ। হাতিকে বশ করার, বশ করে পোষ মানানোর গুপ্তমন্ত্র তাঁর জানা ছিল। দেশ-বিদেশের শিকারীরা তাঁর কাছে হাতি শিকার ও হাতিকে পোষ মানানোর কলাকৌশল শিখতে আসতেন। পাহাড় থেকে লোকালয়ে ক্ষুধার্ত বন্য হাতির দল যখন খেত-খামার তছনছ করতে করতে নেমে আসত, তখন ডাক পড়ত লালজির।

মধ্যম উচ্চতা, কাঁচা সোনার মতো গায়ের রঙ, টিকলো নাক, মোটা পাকানো গোঁফ, পরনে সর্টস ও গায়ে হলুদ বা লাল ফতুয়া আর মাথায় নেপালী টুপি— দেখতে অত্যন্ত সুদর্শন। রাজ পরিবারের উত্তরপুরুষদের অনেকেই সর্টস পরতেন, মাথায় নেপালী টুপিও— যা ছিল আসলে স্টেটাস সিম্বল। আলাদা করে চিনে নেয়াও যেত। সেই লালজি, পুজোর ক’দিন কিন্তু তাঁকে কোনোদিন সর্টস পরতে দেখিনি। ঈষৎ লালে ছোপানো ধুতি কেটে ছোট করে পরতেন। পুজোর দিনক’টি ছিল মহা ধুমধামের, মন্দিরের পনেরো-কুড়িজন ঢাকি, এখানকার ভাষায় ঢাকুয়া, তারা সারাদিন ঢাক বাজাত। পুজোর ক’দিন যে কী  হৈ হৈ রৈ রৈ ব্যাপার!

শ’য়ে শ’য়ে পাঁঠাবলি হত, লালজি নিজেই, এমনকী প্রায়বৃদ্ধ বয়সেও, পাঁঠাবলি দিতেন। পুজোর পশুবলির উদ্বোধন প্রতি বছর তাঁর হাত দিয়েই হত। লালজির পাঁঠাবলি দেখতাম ঘোরলাগা চোখে, একটার পর একটা। পুরোহিত ফুল-চন্দন-সিঁদুর সহ মন্ত্র পড়তেন হতভাগা ছাগলগুলোর মাথায়, তারপর পাশে সরে দাঁড়াতেন। তারপরই ফিনকি দিয়ে রক্ত আর ঢাকের বাদ্যি! সেদিনের শিশুচোখে দেখা বলিদৃশ্য আজও আমি চোখ বুজলেই দেখতে পাই। উৎসবের চেহারাটি এখনও মোটামুটি একই আছে, যদিও সেদিনের মতো একের পর এক পাঁঠাবলি এখন আর হয় না। সেকালের সে জমকালো পুজোও আর নেই। শুধু অবক্ষয়ের প্রেতমূর্তির মতো কোনোক্রমে টিকে আছে সুপ্রাচীন দেবালয় ও নাটমন্দির। আর আছে বিস্ফারিত শিশুচোখে দেখা অতীত— ধড়বিচ্ছিন্ন মুণ্ডের মতো যা কোনও একলা দুপুরে জিভ ছুড়ে দেয়, প্রাণান্ত ব্যা ব্যা করে।

মহামায়া মন্দিরের উত্তরকোণ ঘেঁষে তখন দাঁড়িয়ে আছে সদ্য গজিয়ে ওঠা আরেকটি মন্দির। সে মন্দিরের মাথায় লাল টালি, বাঁশের বেড়া, সামনে, চ্যাগারের গেটের দুদিকে দুটো রক্তজবা গাছ। এক ঘোর তান্ত্রিক, কোত্থেকে এসেছিলেন কেউ জানে না, প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এই কালী মন্দির। সবার মুখে মুখে তাঁর নাম হয়ে গিয়েছিল লালসাধু। এই লালসাধুর কালীমন্দিরে সারা বছরই ফ্রীতে গাঁজা-ভাঙ সেবনের পাকাপোক্ত ব্যবস্থা। ফলে শিষ্য-ভক্তদের চোরাগোপ্তা আনাগোনা সারাদিন। বস্তুত সারা বছর এই কালীবাড়িটিই শুধু জেগে থাকত। দুর্গাপুজোর পরপরই দেবীবিগ্রহ স্থানান্তরিত হয়ে মূল মন্দিরে চলে যায় আর মা গৌরীর বাপের বাড়ি খা খা করে আর বিশাল মাঠ অন্ধকার হয়ে যায়। এইভাবে দিন যায় আর  সময়ের ঝুলকালি জমে। ভাঙাচোরা নাটমন্দিরে আশ্রয় পায় স্মৃতিভ্রংশ পাগল-পাগলিরা। আমার মনে পড়ে জয় গোস্বামীর সেই অমর কবিতা—

“পাগলি তোমার সঙ্গে নাইট্যশালা জীবন কাটাব”।

   আরেক সাধুর কথাও আমার খুব মনে পড়ে মাঝেমাঝে। তিনি অটলবাবা। আমরা ছোটরা ডাকতাম হলুদসাধু; তাঁর হলুদবর্ণ পোষাকের জন্য। তখনকার গৌরীপুরে কবিরাজ, হোমোপ্যাথ, ফেরিওলা, বাউল, পাগল, ভবঘুরেদের সাথে সাথে বিচিত্র সব সাধুদের আনাগোনা ছিল। কেউ তান্ত্রিক, কেউ বৈষ্ণব, কেউ যোগী তো কেউ আবার ফকির।

    গৌরীপুরে পদার্পণের পরই সেই সাধুদের অনেকেরই প্রথম আশ্রয়স্থল ছিল আমাদের বাড়ির বহির্মহল। বাবার বদান্যতায় তখন কিছুদিনের জন্য সেটা ধর্মশালা হয়ে উঠত। লালসাধুও প্রথম এসে বাড়ির এই বহির্মহলেই দীর্ঘদিন ধরে ছিলেন। খাওয়া-দাওয়া ফ্রী। সাধুসেবায় বাবা ছিলেন চিরকালের দরাজ-দিল মানুষ। পরে অবশ্য লালসাধু লালজির অনুমতি নিয়ে মহামায়ার মাঠে নিজের দোচালা মন্দির করে চলে যান। শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ মিশনের এক সন্ন্যাসীর কথাও আবছা আবছা মনে পড়ে। তিনিও সে ঘরে ছিলেন প্রায় এক বছর। বাবা সাধুভক্ত। সাধুদের ধরে আনতেন, সাধুসেবা করতেন অভাবের মধ্যেও। একদিন এলেন হলুদ বস্ত্র পরিহিত অটলবাবা নামের সেই যোগী। দীর্ঘদেহী, মাথায় মস্ত জটাজাল, সুঠাম শরীর। মিষ্টি মুখখানায় গভীর হাস্যোজ্জ্বল দুটি চোখ।

    অটলবাবার কথা বেশ স্পষ্টই মনে পড়ে। বিশেষ একটি ঘটনার জন্য স্মৃতিতে যেন দাগ কেটে দিয়ে গেছেন তিনি। এখনও মানস চোখ দেখি, তাঁর শরীরের আনাচে-কানাচে থেকে যোগদ্যুতি ঠিকরে বেরুচ্ছে। শুনেছি পূর্বজীবনে উত্তর-ভারতের সাধু-বলয়ের কোনও মঠের মঠাধ্যক্ষ বা মোহন্ত ছিলেন তিনি। মঠের জন্য হাতি কিনতে এসেছিলেন গৌরীপুরে। ভারত বিখ্যাত শোনপুরের মেলায় (বিহার) হাতি দাম-দর করতে গিয়েই লালজির সাথে তাঁর পরিচয় হয় আর সেই পরিচয়ের সূত্র ধরেই কিছুদিনের মধ্যে তাঁর গৌরীপুরে আগমন। পরবর্তীতে মঞ্চায়িত হবে নিয়তির এক নিষ্ঠুর ছলনা, হয়ত সেজন্যই হলুদ সাধুকে আসতে হয়েছিল এই অতিদূর আসাম-ভূখণ্ডে।

    হাতিশিকারী ও বিক্রেতা হিসেবে গৌরীপুর রাজ এস্টেটের মধ্যমকুমার লালজির তখন প্রায় বিশ্বজোড়া খ্যাতি। গৌরীপুরও তো চিরকালই হাতির জন্য বিখ্যাত। সেদিনের কথা মনে পড়ছে। আমরা তখন বেশ ছোটো। অটলসাধু দীর্ঘদিন হাতিলাভের আশায় গৌরীপুরে পড়ে আছেন। আশ্রম-জীবন চুলোয় গেছে, একেবারে কপর্দকশূন্য অবস্থা। এদিকে হাতিও তাঁর কপালে জুটছে না কিছুতেই। শুধু আশ্বাসের পর আশ্বাস। সাধুও নাছোড়। হাতি না নিয়ে কিছুতেই আর মঠে ফিরে যাবেন না। তাঁর সম্মানের প্রশ্ন। এদিকে হাতির দেখা নেই। স্বভাবে অটল সাধু কিন্তু ছিলেন খুব মিশুকে প্রকৃতির। হিন্দি ছাড়া আর কোনও ভাষাই জানতেন না বলতে গেলে। লালসাধুর সঙ্গে প্রথম প্রথম বেশ সখ্য গড়ে উঠেছিল তাঁর। একসঙ্গে খাওয়া-দাওয়া, গঞ্জিকা সেবন, এক টালির ছাদের নীচে বাস ও পাদুকা-ভ্রমণ। পরে অবশ্য লালসাধুর পিতপিতানি স্বভাবের জন্য ও কখনও কখনও চিমটা উঁচিয়ে ভীতি প্রদর্শন করার কারণে সম্পর্ক কিছুটা তিক্ত হয়ে যায়।

      লালসাধু ছিলেন খাস বাংলা, অটলসাধু পুরো খড়িবোলি। কেউ কারো ভাষা ঠিক বোঝেন না। ফলে যা হয়… মনোমালিন্য। লালসাধুর চোস্ত মুখ— গালিগালাচে সিদ্ধহস্ত। মা কালীর ভক্তের মাথা ও মুখ দুটোই তো বেশ গরম থাকে। অটলসাধু শান্ত, স্নিগ্ধ যোগীপুরুষ— স্বাভাবিকভাবেই ঝগড়ায় পেরে ওঠেন না এই লালচেলি, ঘোর শাক্ত, রক্তবর্ণ-নয়ন সাধুর সাথে। তবে আপাতকঠিন লালসাধু মানুষ হিসেবে বড় প্রেমময় ছিলেন ভিতরে ভিতরে। সেটা পরে বুঝেছি। খুব আবদার করাতে দোলের দিনে একবার আমাদের ভাঙের গুলিও দিয়েছিলেন খেতে। খুবই সুস্বাদু, তবে খাওয়ার পর নেশা চড়ে যাওয়ায় আমি ও আমার বন্ধুদের কারোরই সারাদিন আর হুঁশ ছিল না। মিশুকে স্বভাবের জন্য অটলসাধুর অসম্ভব জনসংযোগের ক্ষমতা ছিল।  বাড়ি বাড়ি ঘুরে বেড়ান, গপ্পোসপ্পো করেন জমিয়ে। গৃহস্থ বাড়ির রান্নাঘর পর্যন্ত ছিল তাঁর সীমানা। আর, সাধুদের মধ্যে যা সচরাচর দেখা যায় না— খুব ক্যারিকেচার জানতেন। বাংলা বলতে পারতেন না একদম। কিন্তু লালসাধুর শ্রীমুখনিসৃত বাংলা হুবহু, এমনকী গলার টোন, বাচনভঙ্গি সহ, নকল করে গৃহস্থ বাড়িতে পরিবেশন করে হাসির রোল তুলতেন। এখনও কানে বাজে, অটলসাধুর উচ্চারণে, লালসাধুর চিমটা উঁচোনো সেই বাণী— “চিমটা দিয়ে কিমটা বানিয়ে দেব’ ( ‘কিমটা বানানো’ কী আমি ঠিক জানি না। হয়ত ‘কিমাটা’, মানে কাউকে চিমটার আঘাতে বা খোঁচায় কেটে ফালাফালা করা আর কী!)

  মাঝেমাঝেই  মনে পড়ে অটলসাধুকে। আদর করে ছোটবেলায় আমাকে ডাকতেন ‘শিবুগুরু বদমাশ’। একটু যখন বেড়ে উঠেছি গায়েগতরে, তখনও। হয়ত তাঁর প্রভাবেই সেই ছোট্ট বেলায় আমিও সাধু সাজতাম চুপিচুপি। কপালে লাল তিলক— যেন শ্মশানচারী ঘোর তান্ত্রিক। এখন তো বয়স বেড়েছে অনেক, তবে সে ঘোর এখনও কাটেনি।

   যা বলছিলাম। হাতির আশায় দীর্ঘকাল বসে থাকবার পর অবশেষে একখানা হাতি পেলেন অটলবাবা। একখানাও ঠিক নয়, আধখানা বলাই বোধহয় সঙ্গত, কারণ সেটা পূর্ণবয়স্ক হাতি ছিল না, ছিল হস্তিশাবক। শাবকটির নাম রেখেছিলেন ‘রামু’। এবার সে হাতির ছানাটিকে, পোষ মানিয়ে, বাঁচিয়ে, বড় করে তুলে, তবেই মঠে নিয়ে যাওয়া সম্ভব। আরও শক্ত চ্যালেঞ্জের মুখে পড়লেন অটলসাধু। বাচ্চা হাতিকে পোষ মানানো কঠিন কিছু নয়। ঋষি পালকাপ্যর রচনা পড়ার দরকার পড়ে না তার জন্য। যদিও ‘হস্তিবিদ্যার্ণব’ পুঁথি এখনও কোথাও কোথাও সংরিক্ষত আছে বলে শোনা যায়। গৌরীপুর ও সন্নিহিত গাঁ-গেরাম ঘুরে ঘুরে লোকের কাছে চেয়েচিন্তে হাতিকে কচি কলাগাছ খাইয়ে বেড়াতেন আমাদের হলুদসাধু। হস্তিশাবকটি আসলে একদম দুগ্ধপোষ্য, কলাপাতা ভাল ক’রে চিবিয়ে খেতে পারে না। খিদের জ্বালায় কিছু কিছু খায়, আবার খেলেও ঠিকঠাক হজম করতে পারে না। মহা ফাঁপরে পড়লেন অটলবাবা। বাচ্চা হাতি রামুই যে তখন একমাত্র ধ্যানজ্ঞান তাঁর।

   সাধুকে মায়ায় ধরল। যে মায়ার বাঁধন ছিঁড়ে একদিন সংসারের বাইরে বেরিয়ে এসেছিলেন, সেই মায়াই নবরূপে উপস্থিত হল। সাপে যেভাবে একটু একটু করে ব্যাঙ গেলে সেভাবে মায়া তাঁকে গ্রাস করতে লাগল। শাবক হাতিটিকে তিনি মাঠের দক্ষিণে, ইঁদারার পাশে বেঁধে রাখতেন আর এক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকতেন সেই দিকে। আমরাও কখনও কখনও অটলবাবার পাশে, ঘাসের ওপর বসে দেখতাম সে দৃশ্য। হাতি শাবকটির জন্য কলাপাতার ব্যবস্থা কোনোমতে হলেই বা কী? তার যে চাই কাড়ি কাড়ি দুধ! কিন্তু এতো দুধ কোথায় পাবেন সাধু? ছলছল চোখে সাধু একদিন পাশে বসিয়ে বললেন— শিবগুরু বেটা, বচ্চা হাথিনে মুঝে মা সমঝ লিয়া। রাতভর শোনে ভি নেহি দেতা, দুধ মাঙ্গতা হ্যায়, পর মেরে বাট মে দুধকা এক বুন্দ ভি তো নেহি। প্রেম তো বহত হি হ্যায়, লেকিন প্রেম সে পেট তো নেহি ভরতা। দেখ, ভগবান নে মুঝকো ক্যায়সা বেরহম মা বনা দিয়া!

   অবাক হয়ে শুনি হলুদ সাধুর কথা। সব শব্দ ঠিক বুঝতেও পারি না। জিজ্ঞাসা করি— হলুদ সাধু, ও হলুদ সাধু, তুমি তো বাবা, মা কী করে হবে?

কিছুটা আন্দাজে ধরতে পারলেও বাসায় ফিরে মাকে জিজ্ঞাসা করলাম, মা ‘বেরহম’ মানে কী? উত্তর দিলেন বাবা। খাটে শুয়ে আছেন, হাতে ভিক্টর হুগোর— ‘আ হাঞ্চব্যাক অফ নোতরদম’। বই থেকে ঈষৎ চোখ তুলে বললেন, ‘বেরহম’ মানে যার হৃদয়ে ‘রহম’ নেই, মানে দয়া নেই। বাবার উত্তর শুনে অবাক হয়ে ভাবতে থাকি, হলুদ সাধু এতো ভাল, আর ওর বুকে দয়া নেই, এ কখনও হয় নাকি!

   কিন্তু হাতিশাবকটি বাঁচল না শেষ পর্যন্ত। সাধুর ভিতর মা পেয়েছিল হাতির ছানাটি, কিন্তু দুধ পায়নি একফোঁটা। শাবকটি যেদিন মারা যায় মহামায়ার মাঠে সেদিন শ’য়ে শ’য়ে লোক জড়ো হয়েছিল।

অটলসাধু চুপচাপ বসেছিলেন এক কোণে, তবে থেকে থেকেই আবার হাউমাউ করে গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদছিলেন।মহামায়া ময়দানের দক্ষিণকোণে হাতিছানাটিকে সমাধিস্থ করা হয়। শাবক রামু সাধুকে ছেড়ে চলে গেল চিরদিনের জন্য। কিন্তু মায়া গেল না। সাধু বাঁধা পড়লেন।

      তাঁর আর ফেরা হল না উত্তর ভারতের সেই নাম-না-জানা মঠে। ক্ষোভে, অভিমানে গৌরীপুরেও আর থাকলেন না। নতুন ক’রে ডেরা বাঁধলেন নিকটস্থ পাগলাহাটে। যাবার আগে জনে জনে বলে গিয়েছিলেন— কভি নেহি আউঙ্গা, আর কোনোদিন আসবেন না এ শহরে। মরদ কা বাত, হাথি কা দাঁত— ইত্যাদি ইত্যাদি।

      এই ঘটনার অনেকদিন পর, আমরা মাঠে খেলছি। আমি, রিজু, হরিয়া, ভুলুয়া, গৌরীয়া সবাই মিলে। কাঁচা জম্বুরা পিটিয়ে নরম ক’রে গরীবের ফুটবল। জম্বুরা গাছই আমাদের ফুটবল বৃক্ষ তখন। খেলতে খেলতে কখন সন্ধে হয়ে গেছে। ফেরার সময় লক্ষ করলাম মাঠের দক্ষিণের ইঁদারার কাছটাতে কী যেন একটা নড়ে উঠল। একটু এগিয়ে গিয়ে অবাক চোখে দেখলাম— হলুদ সাধু। শাবক হাতির সমাধির পাশে নিস্তব্ধ হয়ে বসে আছেন, অন্ধকারে।

      অন্ধকারেও আমাকে চিনতে পারলেন–” রামু বেটাকো দেখনে আয়া, শিবুগুরু। মা হু না! দো দিন সে মন বহত তরস রহা থা।”

      এই সাধু পাগলাহাটেই থেকে গিয়েছিলেন আমৃত্যু। ডেরা বেঁধেছিলেন এক গরীবের কুটিয়ায়। হাতি নিয়ে নিজের মঠে তো আর ফেরা হয়নি। খুব আক্ষেপ ক’রে একবার বলেছিলেন, মঠের সবাই হয়ত ধরেই নিয়েছে, ‘মোহান্তজি, পয়সা লেকর ভাগ গিয়া’। সাধু বিয়েও করেন শেষমেষ— স্থানীয় এক রাজবংশী বিধবা মহিলাকে। সন্তানের পিতাও হন। কিন্তু মৃত হস্তিশাবক রামু কি তার ‘পিছা’ ছেড়েছিল? কে জানে?

    অটলসাধুর কথা মনে পড়লে আরেকটি ঘটনার কথাও আমার মনে পড়ে। আমাদের পরলোকগত দাদুর (ঠাকুর্দা) একটা পেল্লায় সাইজের অলেস্টার ছিল। দাদু ছিলেন অটল সাধুর মতোই দীর্ঘকায়। কাঁধ থেকে পা ঢেকে যায় এমন লম্বা অলেস্টার! আমরা ভাইবোনরা কেউই তো তেমন লম্বা নই, ফলে অলেস্টারটি কারোর গায়েই হয় না। ঘরে পড়ে থেকে দামি শীতের পোষাকটি প্রায় নষ্ট হবার যোগাড় । এ জিনিসের আর চলও নেই তেমন আজকাল। একদিন মা-ই কথাটা পাড়লেন। অটলবাবাকে যদি দিতে পারতাম বেশ হতো! সাধু মানুষ। বুড়ো হয়েছেন। শীতে কষ্ট পান নিশ্চয়ই খুব। আমি জানতাম অটলসাধু পাগলাহাটে থাকেন; তবে কোনও কোনও হাটবারে গৌরীপুরেও তাঁর দেখা পাই। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অভিমান ঝরে গিয়েছিল, হয়ত।

দেখা হলে আগের মতোই ‘শিবুগুরু বদমাশ’ বলে জোরে হাঁক পাড়েন। একদিন দেখা হওয়াতে মায়ের নাম করে নিমন্ত্রণ করি। সেদিন সময় না হলেও অল্প কয়েকদিন বাদেই এলেন। একা। অলেস্টার পেয়ে যারপরনাই খুশি। এরও দীর্ঘদিন পরে আর একবার তাঁর সাথে আমার শেষ দেখা হয় গৌরীপুর নারী-সমিতির মোড়ে। মনে হল, বাসের জন্য দাঁড়িয়ে আছেন। তখন বক্সিরহাট, তামাহাটের বাস নারী-সমিতির মোড় ছুঁয়ে যেত। পুকুরপাড়ে নতুন বাসস্ট্যান্ড। মাথায় সে বিশাল জটা নেই, চোখদুটো ঢুকে গেছে গর্তে। তোবড়ানো গাল, মুখের চামড়া কুঁচকে-মুচকে গেছে। নেড়া মাথায় হাত ঠেকিয়ে বললেন— মুণ্ডন কর লিয়া, শিবুগুরু বেটা। পাশে দাঁড়ানো বছর দশেকের ছেলেটিকে দেখিয়ে করুণ হাসলেন একটু— মেরা বেটা, লক্ষণ। গায়ের হলুদ বস্ত্র ঈষৎ ফিকে ও মলিন হলেও, তখনও টিকে রয়েছে লক্ষ করলাম। এরপর আর সাধুকে দেখিনি।

    শহর গৌরীপুরে বেশ কয়েকটি হাতির কবর এখনও বিদ্যমান। একটি সেকালের বিখ্যাত হাতি প্রতাপ সিং-এর, সেটা রয়েছে মাটিয়াবাগ প্যালেসের টিলার মাথায়। সিমেন্টে বাঁধানো সমাধি-ফলক, তাতে নাম লেখা। টিলার নীচে আরও দুই বিখ্যাত হাতির কবর— একটির নাম ছিল জং বাহাদুর, অপরটির শিবজি। চতুর্থ কবরটি রয়েছে চড়কবাড়ির মাঠে। রাজার জামাই মুকুন্দ বড়ুয়ার পোষা এই হাতিটি প্রকৃতপক্ষে ছিল একটি বিশালকায় দাঁতাল। বিজয় সিং নামের এই হাতিটিই ছিল এ জীবনে আমার দেখা উচ্চতম হাতি, যে হাতি, কথিত আছে, এক নির্জন জ্যোৎস্না রাতে কবর থেকে উঠে এসে তাড়া করেছিল স্থানীয় ব্যক্তি বিদ্যা চৌধুরীকে। ভীতিবিহ্বল হয়ে তার কয়েকদিনের মধ্যেই তিনি মারা যান। বিদ্যাবাবুকে চিনতাম। আমার বড়দাদার বন্ধু রতন চৌধুরীর বাবা। সত্য-মিথ্যা জানি না, তবে এ কাহিনী একসময় তুমুল আলোড়ন তুলেছিল। পঞ্চম কবরটি হলুদ সাধুর সন্তানসম আদরের হস্তিশাবক রামুর; বর্তমানে প্রতিমা পাণ্ডে অডিটোরিয়ামের পাশে, উঁচু উঁচু জঙ্গলা ঘাসে প্রায় ঢাকা পড়ে আছে হয়ত। কোনও ফলক নেই, নাম নেই, তাই সঠিক স্থান নির্ণয় করাও দুষ্কর।

    অনেকদিন ভেবেছি, যে রাতে জ্যোৎস্না হলুদ হবে, সে রাতে একা একা হস্তিশাবক রামুর কবর খুঁজতে যাব। স্তব্ধ, জঙ্গলা ঘাসের গালিচায় বসে সেদিনের মতো আজও কি গোপনে অশ্রু বিসর্জন করতে আসেন, হারিয়ে ফেলা ছোটবেলার সে বিচিত্র সাধু?

Tags: উত্তর-পূর্বগদাধরের বাউদিয়াধারাবাহিক গদ্যশিবাশিস চট্টোপাধ্যায়
Previous Post

প্রবুদ্ধসুন্দর কর || দ্বাত্রিংশ পর্ব

Next Post

অমিতাভ দেব চৌধুরী || সপ্তদশ পর্ব

Daruharidra

Daruharidra

Next Post
অমিতাভ দেব চৌধুরী || সপ্তদশ পর্ব

অমিতাভ দেব চৌধুরী || সপ্তদশ পর্ব

Comments 11

  1. অমিতাভ দেব চৌধুরী says:
    10 months ago

    অসাধারণ!! অসাধারণ!!! এটা আমার পড়া বেস্ট এপিসোড।

    বানান-বিভ্রাটগুলি সারিয়ে নিও । রাজেশ খুব পরিশ্রমী, ওকে বলো।

    Reply
    • Sibasish Chatterjee says:
      10 months ago

      অশেষ ধন্যবাদ, অমিতাভদা। ভাল থাকবেন।

      Reply
  2. উৎফল ত্রিবেদী says:
    10 months ago

    পড়তে পড়তে বারবার “কোথায় পাব তারে”মনে পড়ছিল। কি অসাধারন ভাষা এবং অনবদ্য বিস্তার।

    Reply
    • Sibasish Chatterjee says:
      10 months ago

      দাদা, অশেষ ধন্যবাদ। ভাল থাকুন।

      Reply
  3. রবীন বসু says:
    10 months ago

    চমৎকার সাবলীল লেখা। অনেক অভিনন্দন জানাই বন্ধু।

    Reply
    • Sibasish Chatterjee says:
      10 months ago

      অনেক ধন্যবাদ, বন্ধু। ভাল থাকবেন।

      Reply
  4. সৌমিত্র চক্রবর্তী says:
    10 months ago

    অসম্ভব পরিশ্রমের ফসল এই লেখা। পড়তে পড়তে সেই সময় স্পষ্ট দেখা যায়। খুব ভালো লেখেন আপনি।

    Reply
    • Sibasish Chatterjee says:
      10 months ago

      ভাল লাগল আপনার মন্তব্য। অনেক ধন্যবাদ।

      Reply
  5. P Bhattacharjee says:
    10 months ago

    All characters appeared live by your writi skills. Keep going.

    Reply
  6. SNEHASISH CHATTERJEE says:
    10 months ago

    অসাধারন !! গৌরীপুরের দুর্গাপূজা…. দেবী মহামায়ার বাপের বাড়িতে আগমন…. ঐতিহ্যময় বেলবরণ….. নাটমন্দির…. লাল সাধু…..অটল সাধু….. সব চোখের সামনে জলজ্যান্ত ! দারুন !! দারুন !!!

    Reply
  7. Sibasish Chatterjee says:
    10 months ago

    অনেক ধন্যবাদ, মেজদা

    Reply

Leave a Reply Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

No Result
View All Result

RECENT POSTS

মেখলা পরা মেয়ে || শ্রীযুধাজিৎ || অন্তিম পর্ব

মেখলা পরা মেয়ে || শ্রীযুধাজিৎ || অন্তিম পর্ব

15/04/2022

সঞ্জয় চক্রবর্তী || অন্তিম পর্ব

09/04/2022
মেখলা পরা মেয়ে || শ্রীযুধাজিৎ || দ্বাবিংশতি পর্ব

মেখলা পরা মেয়ে || শ্রীযুধাজিৎ || দ্বাবিংশতি পর্ব

08/04/2022

সঞ্জয় চক্রবর্তী || নবম পর্ব

02/04/2022
মেখলা পরা মেয়ে || শ্রীযুধাজিৎ || একবিংশতি পর্ব

মেখলা পরা মেয়ে || শ্রীযুধাজিৎ || একবিংশতি পর্ব

01/04/2022

সঞ্জয় চক্রবর্তী || অষ্টম পর্ব

27/03/2022
মেখলা পরা মেয়ে || শ্রীযুধাজিৎ || বিংশতি পর্ব

মেখলা পরা মেয়ে || শ্রীযুধাজিৎ || বিংশতি পর্ব

25/03/2022
সঞ্জয় চক্রবর্তী || সপ্তম পর্ব

সঞ্জয় চক্রবর্তী || সপ্তম পর্ব

20/03/2022
মেখলা পরা মেয়ে || শ্রীযুধাজিৎ || উনবিংশতি পর্ব

মেখলা পরা মেয়ে || শ্রীযুধাজিৎ || উনবিংশতি পর্ব

18/03/2022
ষষ্ঠ পর্ব || সঞ্জয় চক্রবর্তী

ষষ্ঠ পর্ব || সঞ্জয় চক্রবর্তী

13/03/2022

RECENT VIDEOS

https://www.youtube.com/watch?v=77ZozI0rw7w
Daruharidra

Follow Us

আমাদের ঠিকানা

দারুহরিদ্রা
কুঞ্জেশ্বর লেন
(বরাকভ্যালি একাডেমির নিকটবর্তী)
নতুন ভকতপুর, চেংকুড়ি রোড
শিলচর, কাছাড়, আসাম
পিন-788005

ডাউনলোড করুন

সাবস্ক্রাইব

Your E-mail Address
Field is required!
Field is required!
Submit
  • আমাদের সম্পর্কে
  • লেখা পাঠানো
  • যোগাযোগ

Copyright © All rights reserved Daruharidra | Development by Prosenjit Nath

No Result
View All Result
  • ধান্যগৃহ
  • কবিতা
  • গল্প
  • গদ্য
  • প্রবন্ধ
  • উপন্যাস
  • সাক্ষাৎ পাতা
  • অনুবাদ পাতা
  • আর্কাইভ
  • আমাদের সম্পর্কে
    • লেখা পাঠানো
    • যোগাযোগ

Copyright © All rights reserved Daruharidra | Development by Prosenjit Nath