একদিন স্কুলে অজিত সিংহ স্যার আমাদের কয়েকজনকে ডেকে নিয়ে অঙ্ক ও ফিজিক্যাল সায়েন্স নিয়ে কিছু টিপস দেওয়ার পর বললেন, চিন্তা করিও না। মাধ্যমিকে আরও বেশি পাইবায়। স্যারকে বললাম, বাংলাতে একটা গ্রাম্য প্রবাদ আছে স্যার। হইছে পোলা বাপ ডাকে না আর হইব পোলা বাপ ডাকব? হা হা করে হেসে উঠলেন স্যার। ক্লাস টেন হাফপ্যান্ট পরেই কাটিয়ে দিয়েছি। মাধ্যমিক পরীক্ষার জন্যে একটি ফুলপ্যান্ট বানানো হল। কালো বেলবটম। পরীক্ষার ভেন্যু ফুলছড়ির কমলপুর বয়েজ স্কুল। শুরুতেই ইংরেজি। পরীক্ষার্থীদের জন্যে বরাদ্দ হয়েছে একটি টি আর টি সি বাস। পনেরো কিলোমিটার বাসে করে ভেন্যুতে যাওয়াটাও বেশ রোমাঞ্চের। রুমে ঢুকে দেখি, আমার পেছনেই প্রশান্ত। একেকটি রুমে কুড়িজন পরীক্ষার্থী। ইংরেজি সিলেবাসে তখন গুটিবসন্ত ও ডক্টর জেনারের ভ্যাকসিন আবিষ্কার নিয়ে একটি গল্প ছিল। যথারীতি সেই গল্পটি থেকে প্রশ্নের উত্তর লিখতে গিয়ে গোয়ালিনী শারা নেমিসের নামটিও লিখে ফেললাম। যদিও পাঠ্য গল্পটিতে গোয়ালিনীর নামের উল্লেখ কোথাও ছিল না। অন্য কোথাও নামটি পেয়েছিলাম। বাংলা সেকেন্ড পেপার পরীক্ষার দিন বুঝতে পারলাম, বাংলা ব্যাকরণ নিয়ে প্রশান্তর প্রস্তুতি খুব একটা ভালো নয়। একটু পরপরই আমাকে জিজ্ঞেস করছে। প্রশান্তকে ফার্স্ট ডিভিশন পেতেই হবে। হালাহালি স্কুলের মান সম্মান জড়িত। কুড়ি নম্বরের ব্যকরণের উত্তর বলে দিলাম প্রশান্তকে। অবশ্যই সতর্কতার সঙ্গে। ইনভিজিলেটর ঘুণাক্ষরেও টের পাননি। অঙ্ক পরীক্ষার আগের দিন রাত প্রায় সাড়ে নটা নাগাদ গোপ স্যার বাড়িতে এসে হাজির। সি গ্রুপের একটি অঙ্ক আমি প্রায়ই ভুল করতাম। স্যার এসে আবার সেটিই করতে দিলেন। আবার সেই ভুল। স্যার আবারো সতর্ক করে গেলেন। পরীক্ষার দিন প্রশ্নপত্র খুলে দেখি, সেই হতচ্ছাড়া অঙ্কটিই এসেছে। পরীক্ষার হল থেকে বেরিয়ে বুঝলাম আমি সেই ভুলটিই আবারো করে এসেছি। ভয়ে গোপ স্যারকে বলিনি। শেষের পরীক্ষার দিন হল থেকে বেরিয়ে বুঝে গেছিলাম, ফার্স্ট ডিভিশন পাবই। আগের প্ল্যান অনুযায়ী আটজন মিলে কমলপুর সিনেমা হলে হিন্দি ছবি দেখতে গেলাম। বিনোদ মেহেরা নায়ক। কমলপুর সিনেমা হলটি স্বপনপুরীর মতোই বাঁশের তরজার বেড়া। কাঠের বেঞ্চ। সিনেমা শেষ হতে প্রায় সন্ধ্যা পেরিয়ে গেছে। টার্মিনাসে গিয়ে দেখি শেষ টি আর টি সি বাস চলে গেছে। মঙ্গল সিংহের প্রাইভেট বাসও নেই। হেঁটেই ফিরতে হবে। কমলপুর থানার কাছাকাছি এসে হঠাৎই পঞ্চু বলল, চল জয়দেবের জামাইবাবুরে পাই নি দেখি। সহপাঠী জয়দেবের জামাইবাবু কমলপুর থানার ও সি। হালাহালিতেই বাড়ি। খুব সম্ভবত বন্দের বাড়ির দিকে। জয়দেবের দিদি মিত্রা আমাদের দুই ক্লাস উপরে পড়ত। কমলপুর থানা থেকে একটা কালো কিম্ভূত ভ্যান প্রায়ই হালাহালি যায়। কপাল ভালো, সেই গাড়িটা আজ যাবে। তবে রাত আটটায়। সিনেমা দেখার ব্যাপারটা সবার বাড়িতেই জানত। বাড়ি ঢুকতে ঢুকতে রাত প্রায় সাড়ে আটটা।
পরের দিনই আড্ডায় আলোচনা হল এই দীর্ঘ তিনমাসের ছুটিতে কিছু একটা করতে হবে। নাটকের কথা ওঠতেই সবাই লাফিয়ে উঠল। মানবেন্দ্রদের বাড়ির পাশে একটি বাঁশের বেড়ার সিনেমা হল ছিল। ছবিঘর। খুব বেশিদিন চলেনি। হলটি থেকে গিয়েছিল। স্কুলের ক্যাম্পাস হলে নাটক দেখার আগে আমি প্রথম নাটক দেখেছিলাম ছবিঘরে। মারীচ সংবাদ। অরুণ মুখোপাধ্যায়ের লেখা রাজনৈতিক নাটক। মারীচ সংবাদ নাটকে একটি গান ছিল–
বন থেকে বেরোল টিয়া
সোনার টোপর মাথায় দিয়া
কোথা হতে আসে পাখি
কোথা যায় উড়িয়া
সব জানতে পাবে সিয়ার কাছে
সিয়া সিয়া সিয়া সিয়া সিয়া…
এই সিয়া, মেরিবাবা কোডগুলো বাবাকে জিজ্ঞেস করে জানতে পেরেছিলাম। বামপন্থীদের মাথায় তখন আমেরিকার সি আই এ-র ভূত। সোভিয়েত রাশিয়াকে লাল স্বর্গ বলে প্রচার ও আমেরিকাবিদ্বেষ তুঙ্গে। জুন্টুদাদের বাড়িতে সোভিয়েত দেশ ম্যাগাজিনটি রাখা হত। দামি চকচকে কাগজে ছবি। মজার মজার কার্টুন ছাপা হত। আগরতলাতে তখন সোভিয়েত রাশিয়ার এজেন্ট সি পি আই-র হরিহর সাহা। বনমালিপুরে লম্বাটে একটি বেড়ার ঘরে হরিহর সাহার অফিস ও বইয়ের দোকান ইসকাস। রাশিয়ান সাহিত্যের বইপত্র পাওয়া যেত। মেডিক্যাল সায়েন্সের বইপত্রও রাখতেন। মাঝেমাঝে প্রোজেক্টারে দেখানো হত রাশিয়ান সাদাকালো সিনেমা। পরে আগরতলার চ্যাংড়া ছেলেরা হরিহর সাহার নাম রেখেছিল হরিভস্কি।
হালাহালিতে খোঁজাখুঁজি করেও ভালো নাটকের বই পাওয়া গেল না। একদিন অফিস টাইমে কয়েকজন বাইসাইকেলে চলে গেলাম মানিকভাণ্ডার লাইব্রেরিতে। লাইব্রেরিটি ছিল সমাজশিক্ষা দপ্তরের। লাইব্রেরিয়ান যতীন্দ্র দত্তচৌধুরী খুবই অমায়িক। আসার উদ্দেশ্য শুনে নাটকের বইভর্তি একটি সেলফ দেখিয়ে দিলেন। সবাই চাইছিলাম ব্যতিক্রমী নাটক করতে। অনেক নাটকের বইয়ের ভিড়ে একটি বই জ্বলজ্বল করছিল। হাওয়ার্ড ফাস্টের স্পার্টাকাস। সবাই লাফিয়ে উঠলাম। এটাই করব। কার্ড করা হল। বিকেলে সহপাঠী বন্ধুরা সবাই মিলে মিটিং। সিদ্ধান্ত হল পঞ্চুর দাদা বাবুলদা থাকবে নির্দেশনায়। আলো দুলাল চ্যাটার্জি। মেক আপ ও অন্যান্য সহযোগিতা বিজয় চক্রবর্তী। মিউজিক ডিরেক্টর গকুলজি গোপালজি। সবাইকে নিয়ে নাটকটি পড়া হল। দীর্ঘ নাটক। এডিট করতে হবে। বাবুলদা দায়িত্ব নিলেন। প্রাইমারি স্কুলের হেডমাস্টারকে অনুরোধ করে একটি ক্লাসঘর নেওয়া হল রিহার্সালের জন্যে। একমাত্র সিনিয়র ক্লাস টুয়েলভের রসরাজ ঘোষ। নাটকের চরিত্রগুলো নিয়ে চিন্তাভাবনা চলছে। স্পার্টাকাস চরিত্রে অভিনয় করবে রসরাজদা। রসরাজদার স্বাস্থ্যও বেশ পেটানো। বেঁকে বসল সজল। সাফ জানিয়ে দিল স্পার্টাকাসের চরিত্র ওকেই দিতে হবে। নয়তো অভিনয় করবে না। গ্রুপে সজল ও কমলেশেরই অভিনয়ের অভিজ্ঞতা রয়েছে। বাকি সবাই আনকোরা। যদিও সজলের চেহারায় গ্ল্যাডিয়েটরের ছোপছাপই নেই। সজল লম্বা কিন্তু স্বাস্থ্য ভালো নয়। শেষ পর্যন্ত কেউ আর ঝুঁকি নিতে চাইল না। সজলকেই স্পার্টাকাসের রোল দেওয়া হল। এবার আসল সমস্যা। ভেরিনিয়া ও নাতালিয়ার চরিত্রে কারা অভিনয় করবে? ভেবেচিন্তে দুজনকে পাওয়া গেল। সহপাঠী রীতা দত্ত। জুনিয়র কৃপালী দে। মহাবীর চা-বাগানে গিয়ে রীতার বাবাকে সহজেই রাজি করানো গেল। সজলকে নিয়ে গেলাম কৃপালীর বাবাকে রাজি করাতে। ভদ্রলোক স্পার্টাকাস সম্পর্কে জানেন। অভিনয়ের সম্মতি দিলেন মেয়েকে। ভেরিনিয়া করবে কৃপালী। রীতা, নাতালিয়া। রসরাজদাকে দেওয়া হল মার্কাস লিসিনিয়াস গ্রাকাসের পার্ট। ডেভিডের চরিত্রে সঞ্জীব। অন্ধ বৃদ্ধের চরিত্রে কমলেশ। ক্রীতদাসের চরিত্রে মানবেন্দ্র, আমি ও বিভাংশু। অভিজিৎ, প্রদীপ, রাজুকে দেওয়া হল সিনেটরের রোল।
স্পার্টাকাস ছিলেন একজন রোমান ক্রীতদাস। বিদ্রোহের আগে তাঁর জীবনের অনেক তথ্যই আজও অজানা। ঐতিহাসিকদের মতে, স্পার্টাকাসের জন্ম রোমান সাম্রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত থ্রেস অঞ্চলের এক গ্রামে। তরুণ স্পার্টাকাস রোমান সেনাবাহিনীতে চাকরি পেয়েছিলেন। কিন্তু পরে অজ্ঞাত কারণে তাঁকে সেনাবাহিনী থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। অনেকের মতে, তিনি সেনাবাহিনী থেকে পালিয়ে ডাকাতদলে যোগ দেন। তাই তাঁকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। পরে স্পার্টাকাস রোমান সেনাদের হাতে ধরা পড়েন। চাকরিচ্যুত স্পার্টাকাসের ঠাঁই হল ক্রীতদাস বিক্রির হাটে এবং সেখানে তিনি বিক্রি হয়ে যান। বেশ কয়েক বছর ক্রীতদাস হিসেবে জীবনযাপন করেন তিনি। তৎকালীন রোমে শক্তিশালী ক্রীতদাসদের বাছাই করে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ দিয়ে গ্ল্যাডিয়েটর হিসেবে তৈরি করা হত। এই গ্ল্যাডিয়েটরদের রোমের বিভিন্ন জায়গায় মল্লযুদ্ধে ব্যবহার করা হত। সেই নৃশংস খেলায় গ্ল্যাডিয়েটররা বাধ্য হত আত্মরক্ষায় অন্য গ্ল্যাডিয়েটরদের হত্যা করতে। খেলার শেষে একমাত্র জীবিত গ্ল্যাডিয়েটরকে বিজয়ী ঘোষণা করা হত। ক্রীতদাসের শেকল থেকে মুক্ত স্পার্টাকাস জড়িয়ে পড়লেন রোমান পাশবিকতার ফাঁদে। গ্ল্যাডিয়েটর হিসেবে শুরু হল তাঁর অভিশপ্ত অধ্যায়। কিন্তু খুব শিগ্গিরই বিদ্রোহ করে বসলেন তিনি। এই পাশবিক হত্যাযুদ্ধ তাঁর কাছে সম্পূর্ণ অনৈতিক বলে মনে হল। তাঁর ভেতরে অসন্তোষ এবং বিদ্রোহের আগুন জ্বলতে শুরু করেছিল। সহচর হিসেবে আরো কিছু বিদ্রোহী গ্ল্যাডিয়েটরকে দলে ভেড়ালেন তিনি। আশেপাশের বিভিন্ন জায়গা থেকে অনেক ক্রীতদাসও যোগ দিল তাঁর সঙ্গে। স্পার্টাকাসের তত্ত্বাবধানে ভিসুভিয়াসের পাদদেশে চলতে থাকল ক্রীতদাসদের সামরিক প্রশিক্ষণ। ততদিনে সমগ্র রোমে স্পার্টাকাসের বিদ্রোহের খবর ছড়িয়ে পড়েছে। রোমের বিরুদ্ধে স্পার্টাকাসের নেতৃত্বে দাস গ্ল্যাডিয়েটরদের বারবার এই যুদ্ধের ঘাত প্রতিঘাত নিয়েই নাটক স্পার্টাকাস।
রিহার্সালের প্রথম সন্ধ্যায়ই কোথা থেকে যেন বাঘা বিজন এসে হাজির। জুলজুল করে তাকিয়ে পুরোটা রিহার্সাল দেখল। পরের দিন বিজন আবার এসে হাজির। ওকে নিতেই হবে নাটকে। অভিনয় করবে। একে ওকে গিয়ে বলছে। আমি বাঘার রামচিমটির ভয়ে সরে সরে থাকছি। শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত হল বাঘা বিজন নাটক শেষ হলে স্টেজে নাচবে। এরপর থেকে বিজন রোজ রিহার্সেলে। রিহার্সেলের চা খায় আমাদের সঙ্গে। আড়ালে গিয়ে ফিরোজ বিড়ি ফুঁকে আসে। প্রায় একমাস রিহার্সেলের পর দেখা গেল অনেকেই বেশ ভালো অভিনয় করছে। সঞ্জীবের মতো ইন্ট্রোভার্ট ছেলে যে এত ভালো করবে ভাবিনি। নাটকের দিনক্ষণ ঠিকঠাক। কমলপুর মহকুমা শাসকের কাছ থেকে লিখিত অনুমতি নেওয়া হল। আমাদের স্কুলের ভেতরের মাঠে স্টেজ হবে। টিকিটের দাম চার আনা। পঁচিশ পয়সা হলেই সরকারকে ট্যাক্স দিতে হয়। নাটকের আগের দিন এক বিপত্তি। ডাক্তারের জরুরি অ্যাপয়েন্টমেন্ট। বিভাংশুকে আগরতলা যেতেই হবে। তাও নাটকের দিনে। কে করবে ক্রীতদাস আকিসার রোল? তাও আবার একটি মৃত্যুদৃশ্য। বিজয়দা বলল, আমি করমু। একমাসের রিহার্সেলে গোটা নাটকটাই বিজয়দার মুখস্থ। যদিও আকিসার অভিনয় খুব বেশি সময়ের নয়। এদিকে মহাবীর বাগানে অজন্তা ইলোরাদের কোয়ার্টারের দেওয়ালে কে যেন লাল রং দিয়ে স্পার্টাকাস নাটকের বিজ্ঞাপন লিখেছে। সজলেরই কাজ হবে হয়তো। নাটকের আগের দিন সকাল থেকেই আমরা স্কুলমাঠে। সামার ভ্যাকেশনের ছুটি। স্টেজ বাঁধার কাজ চলছে। দুজন বেরিয়ে পড়লাম রিকশায় মাইক বেঁধে। আমার মাথায় তখন ঘুরছে স্বপনপুরীর অ্যানাউন্সার চিত্তর মাইকিং। গলার স্বর অদ্ভুতভাবে পালটে রিকশায় বসে গোটা হালাহালি মাইকিং করে বেড়ায় চিত্ত। হেলায় সময় নষ্ট না করে সপরিবারে চলে আসুন আপনাদের প্রিয় প্রেক্ষাগৃহ স্বপনপুরীতে। চিত্তর কায়দায় আমিও মাইকিং করে যাচ্ছি। আগামীকাল হালাহালি ক্লাস টুয়েলভ স্কুলের মাঠে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ফ্যান্টাস্টিক নাটক স্পার্টাকাস। হেলায় সময় নষ্ট না করে সপরিবারে চলে আসুন। নাকফুলে মাইকিং করতে করতে ফিরছি। বাড়ি থেকে বেরিয়ে এল আর এস পি-র অহীন্দ্র ভট্টাচার্যের চ্যালা দীপক। তেড়ে এসে রিকশা থামিয়ে ধমক। আরেকবার যদি স্পার্টাকাসরে ফ্যান্টাস্টিক কও তে খুব খারাপ হইব। মনমেজাজ বিগড়ে গেল। স্কুলমাঠে ফিরে এসে সবাইকে ঘটনা জানালাম। সহপাঠী প্রদীপের চোখমুখ লাল। আমাদের অপমান! প্রদীপ এমনিতেই সাহসী ছেলে। ঘাউরা। লাফিয়ে রিকশায় উঠে মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে রিকশাওয়ালাকে বলল, এই চলো নাকফুল। দীপকের বাড়ির সামনে রিকশা দাঁড় করিয়ে পরপর দশবার শুধু একই মাইকিং করে গেল। ফ্যান্টাস্টিক নাটক স্পার্টাকাস। ফ্যান্টাস্টিক নাটক স্পার্টাকাস। বিপদ আঁচ করতে পেরে দীপক অবশ্য আর বাড়ি থেকে বেরোয়নি। রাতে স্টেজ রিহার্সাল চলছে। এমন সময় স্কুলমাঠে ঢুকে পড়ল এক বাঙালি সি আর পি এফ জওয়ান। স্টেজে তখন আমি। ক্রীতদাস মোজারের অভিনয় করে চলেছি। হঠাৎই আমাকে থামিয়ে দিয়ে সেই জওয়ান মোজারের সংলাপ বলতে বলতে মাঠে অভিনয় শুরু করল। বোঝা গেল মদ খেয়ে টং হয়ে আছে।
নাটকের দিন সকাল থেকেই উত্তেজনা। অনেকদিন পর হালাহালিতে নাটক। দর্শক যে ভেঙে পড়বে, বোঝাই যাচ্ছিল। দুলালদা ইলেক্ট্রিক্যাল কাজ নিয়ে ব্যস্ত। বাবুলদা ও বিজয়দা স্টেজ দেখে নিচ্ছে শেষবারের মতো। দুপুরে বাড়ি থেকে খেয়েদেয়ে সবাই তাড়াতাড়িই স্কুলে পৌঁছে গেছি। মেক আপের জিনিসপত্র, কস্টিউম সবই এসে গেছে। চাপা একটা টেনশনও কাজ করছে। মাঝেমাঝেই সংলাপ আউড়াচ্ছি মনে মনে। হঠাৎই বিকেল থেকে তুমুল ঝড়বৃষ্টি। সবারই মনখারাপ। এতদিনের পরিশ্রমে ঈশ্বর জল ঢেলে দিলেন! মহাবীর থেকে গকুলজি-গোপালজি ও রীতা আসতেই পারেনি। নাটক ভেস্তে যাওয়াতে বাঘা বিজনকে উদভ্রান্তের মতো দেখাচ্ছে। কিছুই করার নেই। আবহাওয়া ভালো থাকলে কাল দেখা যাবে। মনখারাপ নিয়েই রাতে ঘুমিয়ে পড়লাম।
পরের দিন সকালে চকচকে রোদ। আকাশে কোথাও বৃষ্টির সম্ভাবনা নেই। সকালে সবাই চলে এল স্কুলমাঠে। আজ নাটক হবেই। গকুল, রীতা, কৃপালীকে খবর পাঠানো হল। বিকেলে একে একে দর্শকেরা আসছে। সবার মেক আপ শেষ করে বিজয়দা নিজের মেক আপও করে নিয়েছে। বাকি সব রং বিজন মেখে নিয়েছে মুখে ও চুলে। সন্ধ্যা সাড়ে ছটায় নাটক শুরু হল। মাঠে প্রায় তিনশো দর্শক। বাবুলদা প্রম্পটার। প্রথম দৃশ্যের পরই সহপাঠী কয়েকজন গ্রিনরুমে এসে দেখা করে গেছে। বলে গেছে, অভিনয় ভালো হচ্ছে। আকিসার মৃত্যুদৃশ্যে নিহত বিজয়দা স্টেজে শুয়ে পড়লে আমরা কয়েকজন ক্রীতদাস আকিসাআআআ বলে হুমড়ি খেয়ে পড়লাম। বিজয়দা ফিসফিসিয়ে আমাদের বলল, তোরা চিৎকার করে কান্নাকাটি কর। রাত নটা নাগাদ নাটক শেষ হল। দর্শক তখনো বসে। বাঘা বিজনের ডান্সের খবর হালাহালিতে চাউর হয়ে গিয়েছিল। আমরাও ঘোষণা দিলাম। সজল ও কমলেশ গাইল কোন শালা বলে আমায় চাষা/ বাসা আমার রাজপুরীতে/ আলুভাতে বেগুনপোড়া পান্তাভাতে ঘি। হারমোনিয়মে গকুলজি। তবলায় গোপাল। দর্শকদের মধ্যে হাসির রোল আর হাততালি।
ক্রমশ…
দারুণ !!
রাসেল ক্র’র অভিনীত গ্লাডিয়েটরস মুভিটা খুবই প্রিয়, বহুবার দেখা। এই পর্ব পড়তে পড়তে সেই মুভিতে ফিরে গেলাম।
অবশেষে নাটক হয়েছিলো, ভালো লেগেছে।
দারুণ
খুব ভালো লাগছে দাদা ।
বাঃ
খুব উপভোগ করলাম এই পর্ব। দারুণ! সময়ে পড়া হয়নি।