
৬২.দারুহরিদ্রা : এই যে অনেকেরই এরকম অভিযোগ থাকে, আমরা সর্বহারা (অবশ্যই কবিতা লেখালেখির ক্ষেত্রে), আমাদের দিকে কলকাতার সাহিত্যের লেখক, প্রতিষ্ঠিত কবি, বড় কবিরা ফিরেও তাকান না ব্লা ব্লা ব্লা…। আপনার মত কী? এইসব আর্তি একজন প্রকৃত কবির পক্ষে রীতিমতো অপমানজনক? তিনি সৎ এবং প্রকৃত কবি হলে এধরনের প্রবণতা থেকে নিজেকে সবসময়ই যোজন ক্রোশ দূরে রাখবেন? মানে একজন প্রকৃত কবিকে কে পাত্তা দিল, কে দিল না, কোন পত্রিকায় তাঁর লেখা ছাপা হল বা আদৌ হল না এসবে তাঁর কোনও আগ্রহই থাকবে না, তাই তো?
অমিতাভ : হ্যাঁ, তাই। শেষপর্যন্ত যদি আমাদের সূর্য রেড জায়েন্টেই পরিণত হয়, তাহলে তো মানব সভ্যতার ধ্বংস অনিবার্য। খণ্ড সময় যাকে সত্য বলে মানছে, মহাসময়ের কাছে তো তা মিথ্যা। মায়া। বিভ্রম। সভ্যতাই যদি না থাকে তাহলে তো শিল্পও অবিনশ্বর নয়! শুধু মানুষের মরণশীলতার চেয়ে তুলনায় প্রকৃত শিল্পের আয়ু একটু বেশি দীর্ঘ— এইমাত্র। শেলী’র ওজিম্যান্ডিয়াস অব ইজিপ্ট কবিতাটি মনে করো। খ্যাতির জন্য কামড়াকামড়ি রাজনৈতিক নেতাদের শোভা পেলেও, প্রকৃত শিল্পীর শোভা পায় না। জি সি কলেজে কয়েকবছর আগে দেশ পত্রিকার তৎকালীন সম্পাদক হর্ষ দত্ত মশাইকে নিয়ে বিদগ্ধজনেরা একবার একত্রিত হয়েছিলেন। আমিও গিয়েছিলাম। আমার সঙ্গে ছিল আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাবিভাগের অধ্যাপক রাহুল দাস ও রামানুজ গুপ্ত কলেজের অধ্যাপক তমোজিৎ সাহা। সেই সভায় জনৈক শিক্ষক— তোমরা যেরকমটা বলছ— ঠিক সেরকম প্রশ্ন তুলে আমাদের অনেককে লজ্জায় ফেলে দিয়েছিলেন। করুণাপ্রার্থনা বা অনুগ্রহযাচ্ঞা বা অধিকার আদায়ের দাবী কোনও কবি বা শিল্পীর ক্ষেত্রে শোভন নয়। পুরস্কার ভিক্ষা করব কেন, অধিকারবলে আদায় করব কেন? নিজেদের দুর্বলতা দিয়ে নয়, সামর্থ্যের জোরে অর্জন করে নেব। যদি অর্জিত নাও হয় কোনও পুরস্কার, তাতেও কিছু যায় আসে না। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের চেয়ে অনেক কম সামর্থ্যের পশ্চিমী ঔপন্যাসিক নোবেল পেয়েছেন। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে নোবেল দেওয়া হয়নি। তাতে কি তাঁর কিছু ক্ষতিবৃদ্ধি হয়েছে? সাহিত্যের ইতিহাস তো পুরস্কার অর্জনের ইতিহাস নয়, প্রতিভার ইতিহাস। পুরস্কার-টুরস্কার ইত্যাদিকে আমরা ভিক্ষাবৃত্তি ও দাবীদাওয়ার পর্যায়ে নিয়ে গেছি বলেই এগুলো নিয়ে রাজনীতি হয়। আর উত্তর-পূর্বের বাংলাসাহিত্য নামক মঞ্চটিও এসবের জন্য শেষপর্যন্ত একটি রাজনৈতিক মঞ্চেই পরিণত হতে চলেছে। আমি হতাশ।
৬৩.দারুহরিদ্রা : পপুলার কালচার সম্পর্কে আপনার মতামত?
অমিতাভ : যেমন প্রতাপের রাজনীতি থাকে, তেমনই সাহিত্যের মূলস্রোতেরও একটা প্রতাপ থাকে। কখনও কখনও সেই প্রতাপটা অসহ্য হয়ে ওঠে। অনেকের মতো আমিও তখন মুখ ফিরিয়ে নিই পপুলার কালচারের দিকে। তার মানে কিন্তু আমি আজকের এই দিস্তা দিস্তা কুকাব্য আর বস্তা বস্তা বাজে গল্পকে বোঝাচ্ছি না। এ ব্যাপারে আমি এলিটিস্ট। আমি বোঝাচ্ছি— এই যেমন অবাস্তব, গাঁজাখুরি, হাস্যকর সমস্ত প্লটের হিন্দি ছবিকে, আর প্যারালিটরেচার বলে যাদের অভিহিত করা হয় সেই সব সাহিত্যশাখাকে। যেমন, ডিটেকটিভ ফিকশন, থ্রিলার, ফ্যান্টাসি, হরর কাহিনী, ভৌতিক গল্প-উপন্যাস, সায়েন্স ফিকশন এসবকে। এসব আমার খুব প্রিয়। আমি ভূতের গল্প পেলে, ডিটেকটিভ উপন্যাস পেলে গীতবিতান পর্যন্ত সরিয়ে রেখে দেব। এই আসক্তির জন্যই মাসকয়েক আগে বরাক উপত্যকার এক বিস্মৃত লেখকের সন্ধান পেলাম। নামটাই রোমাঞ্চকর। এডওয়ার্ড ব্রায়ান বাদশা। কী সুন্দর নাম, না? ঠিক যেন অদ্রীশ বর্ধন। লিখতেন এ ডি বাদশা নামে। কলকাতার জনপ্রিয় পত্রপত্রিকায়। এই যেমন ‘মাসিক গোয়েন্দা’য়, ‘নবকল্লোল’-এ। লিখতেন মূলত গোয়েন্দাকাহিনীই। ভদ্রলোক ছিলেন সিআইডি ইন্সপেক্টর। লিখতেন কলকাতার পত্রপত্রিকায়; থাকতেন করিমগঞ্জে। এঁরা ছিলেন খ্রিস্টান।
এবারে অন্য প্রসঙ্গে ফিরে আসি। হিন্দি ছবি? আমরা বড়-ই হয়েছি হিন্দি ছবি দেখে: মেরা নাম জোকার, শোলে, আরাধনা, হরেকৃষ্ণ হরেরাম, হাতি মেরা সাথী, ববি— এসব দেখে। এসব সিনেমা নিয়ে এখনও আমি নাট্যকার ও অভিনেতা শেখর দেবরায়ের সঙ্গে হইচই আড্ডা দিই। আজকালকার হিন্দি সিনেমাও আমার খারাপ লাগে না। এই সেদিনই খুব মন দিয়ে ধোনির বায়োপিক দেখলাম। তবে আমি কিন্তু আজকালকার ওয়েব সিরিজ নিতে পারিনি। সেক্স-ক্রাইম-ভায়োলেন্স দুঃস্বপ্নের মতো তাড়া করে ফেরে বেশিরভাগ ওয়েব সিরিজকেই। ‘রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও খেতে আসেননি’ সিরিজটি দেখতে গিয়ে আমার আক্ষরিকভাবেই বমি পেয়েছে। আমার ‘উদাসমহল শূন্যগলি’ লেখাটি পুরোটাই পপ কালচার নিয়ে।
৬৪.দারুহরিদ্রা : এই যে আপনি আমাদের সাক্ষাৎকারটা দিচ্ছেন এরকম দীর্ঘ সাক্ষাৎকার এর আগে কোথাও কি আপনার নেওয়া হয়েছে?
অমিতাভ : হ্যাঁ, একবার দিয়েছি। আমার অনুজপ্রতিম কবিবন্ধু আগরতলার প্রদীপ মজুমদার তার পত্রিকা ‘কাগজের নৌকা’য় আমার একটা দীর্ঘ সাক্ষাৎকার ছাপিয়েছিল। চুয়াল্লিশ পৃষ্ঠার। প্রদীপ আমাকে খুব ভালোবাসে বলেই অতোটা আমল দিয়েছিল। আমিও তার ভালোবাসাকে সবসময় মর্যাদা দিই। সামান্য কবি আমি, জানি, আমার এসবের যোগ্যতা নেই। কিন্তু ভালোবাসা তো আর যোগ্যতা-অযোগ্যতা মাপে না! তোমরাও নিজ গুণে ভালোবেসে আমাকে এত উচ্চাসনে বসিয়েছ। তবে তোমাদের ইন্টারভিউটা অনেক বড়ো এবং এতে আত্মজৈবনিক কথা অনেক বেশি এসেছে। তোমাদের ভালোবাসারও কোনও তুলনা হয় না।
৬৫.দারুহরিদ্রা : এবারে আপনাকে কিছু একেবারেই ব্যক্তিগত প্রশ্ন করছি। আপনার প্রিয় ফুল?
অমিতাভ : কদম। ‘বাদল দিনের প্রথম কদমফুল’। জানো আমরা ছোটোবেলায় কদমফুল নিয়ে খেলেছি?
৬৬.দারুহরিদ্রা : প্রিয় রং?
অমিতাভ : কালো। ‘তিমির-অবগুণ্ঠনে বদন তব ঢাকি, কে তুমি…’
৬৭.দারুহরিদ্রা : প্রিয় ঋতু?
অমিতাভ : বর্ষা।
‘শতেক যুগের কবিদলে মিলি আকাশে
ধ্বনিয়া তুলিছে মত্তমদির বাতাসে
শতেক যুগের গীতিকা।‘
৬৮.দারুহরিদ্রা : প্রিয় পানীয়?
অমিতাভ : হুইস্কি। ‘ধর’ হুইস্কি-সোডা আর মুর্গি-মটন’।
৬৯.দারুহরিদ্রা : প্রিয় খাবার?
অমিতাভ : আমার প্রিয়তম খাবার এখন সম্ভবত আর এই পৃথিবীতে নেই। সেই পাথরের থালায় (আমরা যাকে বলতাম খাদা) একবারে নিরিমিষ মতে সেই সোনামুখের ডাল থেকে শুরু করে কাঁঠাল বিচি দিয়ে রাঁধা নালিয়া শাঁকের গিঁঠ, পোস্তর বড়া, মোচার ঘণ্ট ইত্যাদি। সঙ্গে গোবিন্দভোগ চালের ধোঁয়া–ওঠা ভাত। মানে এককথায়, বাঙালি ঠাকুরমাদের রন্ধনশিল্পজাত সেই অমৃত।
৭০.দারুহরিদ্রা : প্রিয় সময়?
অমিতাভ : সূর্যাস্ত।
‘দিবসের শেষ সূর্য
শেষ প্রশ্ন উচ্চারিল
পশ্চিমসাগরতীরে,
নিস্তব্ধ সন্ধ্যায়—
কে তুমি ?
পেল না উত্তর।।’
৭১.দারুহরিদ্রা : আপনার মতে মানুষের জীবনের সবচেয়ে বড় প্রতিবাদ কী হতে পারে?
অমিতাভ : ভালোবাসা। অর্থাৎ ঘৃণাকে জয় করা। ঘৃণার রাজনীতিকেও।
৭২.দারুহরিদ্রা : আপনার মতে একজন মানুষের জীবনের সবচেয়ে বড় আশ্রয় কী?
অমিতাভ : জানি না। তবে আমার নিজের শেষ আশ্রয় সুর।
‘পাছে সুর ভুলি এই ভয় হয়–
পাছে ছিন্ন তারের জয় হয়॥
পাছে উৎসবক্ষণ তন্দ্রালসে হয় নিমগন, পুণ্য লগন
হেলায় খেলায় ক্ষয় হয়–
পাছে বিনা গানেই মিলনবেলা ক্ষয় হয়॥
যখন তাণ্ডবে মোর ডাক পড়ে
পাছে তার তালে মোর তাল না মেলে সেই ঝড়ে।
যখন মরণ এসে ডাকবে শেষে বরণ-গানে, পাছে প্রাণে
মোর বাণী সব লয় হয়–
পাছে বিনা গানেই বিদায়বেলা লয় হয়॥’
৭৩.দারুহরিদ্রা : মানুষের সবচেয়ে বড় অস্ত্র?
অমিতাভ : নৈঃশব্দ্য।
৭৪.দারুহরিদ্রা : আপনার জীবনের কোনও আপশোষ আছে? কিংবা না–পাওয়া?
অমিতাভ : হ্যাঁ, আছে। আমার অকালপ্রয়াতা স্ত্রীর গাওয়া কোনও সম্পূর্ণ গান রেকর্ড করে রাখা হয়নি। আমাদের দু‘জনের ছাত্র দেবর্ষি রায়চৌধুরী আর আমার প্ল্যান ছিল ওর অবসর গ্রহণের পর গান রেকর্ড করে আপলোড করার। হঠাৎই ওর মারণ রোগ ধরা পড়ে। সবকিছু উল্টোপাল্টা হয়ে যায়।
আরেকটা আপশোষ হল নিজেকে যতটুকু প্রচারের আলোয় আসতে দিয়েছি, ততটাও না–দিয়ে, শান্তমনে, পৃথিবীর মহৎ সাহিত্যের আরও অনেককিছু পড়ে ফেলতে পারতাম! আয়ুর অনুমতি পেলে, অবসরগ্রহণের পর থেকে তাই শুরু করব। মাঝে মাঝে মনে হয় নিজের কথা না–ভেবে আমাদের বিজিৎকুমার ভট্টাচার্য আর সুজিত দাসের মতো একএকটা পত্রিকা প্রকাশের স্বপ্ন হয়েও তো বেঁচে থাকতে পারতাম আমি!
৭৫.দারুহরিদ্রা : নিজে একজন কবি হিসেবে আপনি কবিদের শেষলেখাকে কীভাবে দেখেন?
অমিতাভ : কোনও প্রকৃত কবির কাছে শুরুটা আদৌ গুরুত্বপূর্ণ নয়। পরিণতিপ্রাপ্তি ও সমাপ্তির গুরুত্ব অপরিসীম। দুজন কবির কথা এই মুহূর্তে মনে পড়ছে। রামপ্রসাদের শেষ লেখা কোনটি তা আমরা আর কিছুতেই নির্ণয় করতে পারব না। যে কয়েকটি গানকে তাঁর শেষ পর্যায়ের লেখা বলে ধরা হয়, (কারও কারও মতে নীচের এই চারটে গান রামপ্রসাদের জীবনের শেষদিকের লেখা) :
‘তিলেক দাঁড়া ওরে শমন, বদনভরে মাকে ডাকি।
আমার বিপদকালে ব্রহ্মময়ী, এলেন কিনা এলেন দেখি।।’
‘বল দেখি ভাই কি হয় ম’লে।
এই বাদানুবাদ কর সকলে।।’
‘কেবল আসার আসা, ভবে আসা, আসা মাত্র হলো।
যেমন চিত্রের পদ্মেতে পড়ে, ভ্রমর ভুলে র‘লো।।’
‘তারা! তোমার আর কি মনে আছে।
ওমা এখন যেমন রাখলে সুখে, তেম্নি সুখ কি পাছে।।’
এদের মধ্যে আমি ধরি ‘কেবল আসার আসা, ভবে আসা, আসা মাত্র হলো’ গানটিকেই। সম্ভবত পান্নালাল ভট্টাচার্যের সৌজন্যে। পান্নালাল এই গানটি গেয়েছেন ভৈরবী রাগে। ভৈরবী রাগটি এসেছে, সম্ভবত ভারতবর্ষের সিন্ধুপ্রদেশের মেষপালকদের গীত সুর থেকে। বাংলায় এসে তা এক আশ্চর্য কোমল রূপ নিয়েছে। কিন্তু এতো করুণ ভৈরবী আমি আর কখনও বোধহয় শুনিনি। সেই যে রবীন্দ্রনাথে আছে না ‘শরৎ-শিশিরে-ভিজে ভৈরবী নীরবে বাজে’? ভৈরবীকে ভেজা বলে ভাবার কথা রবীন্দ্রনাথ ছাড়া কারও মনে হওয়ার কথা নয়। আর রবীন্দ্রনাথেরও শেষ লেখা ছিল ‘তোমার সৃষ্টির পথ’ কবিতাটি। রামপ্রসাদের এই গান আর রবীন্দ্রনাথের শেষ লেখার শুরু— দুইয়ের মধ্যে, বছর দুয়েক আগে, আমি এক অদ্ভুত সাদৃশ্য খুঁজে পাই। রামপ্রসাদের ইষ্টদেবতা ছিলেন কালী। কালী এক অদ্ভুত দেবতা। কালী। কালো। কাল। মানে মহাকাশ। সময়। শূন্য–রূপা। আমার সবসময় মনে হয়, কালীচেতনা আসলে ব্রহ্মাণ্ডচেতনা। ‘ব্রহ্মাণ্ড ছিল না যখন মুণ্ডমালা কোথায় পেলি?’ এই প্রশ্নের আজও কোনও উত্তর মেলেনি। হয়ত এর উত্তর রবীন্দ্রনাথের ওই লাইনটি:
‘…ঘটে যা তা সব সত্য নহে। কবি, তব মনোভূমি
রামের জনমস্থান, অযোধ্যার চেয়ে সত্য জেনো।”
রামপ্রসাদ সেন ওই গানটিতে বলছেন ‘চিত্রের পদ্মেতে পড়ে ভ্রমর ভুলে র’লো।’ এই জীবনদর্শন আমাকে আবার প্লেটোর সেই রিয়্যালিটি ও অ্যাপিয়ারেন্স প্রসঙ্গে ব্যবহৃত গুহার রূপকের কথা মনে করিয়ে দেয়। তারপরই রামপ্রসাদ তাঁর ইষ্টদেবতাকে বলছেন ‘নিম খাওয়ালে চিনি বলে মা কথায় করি ছল।’ আর রবীন্দ্রনাথ তাঁর শেষ লেখার শুরুতে কী লিখলেন? এর শুরুতেই অনন্ত বিশ্ববিধানের প্রতি তাঁরও এক সংশয় গোপন রইল না :
‘মিথ্যা বিশ্বাসের ফাঁদ পেতেছ নিপুণ হাতে
সরল জীবনে!’
এই কবিতার শেষ যে খাতেই যাক না কেন, শুরুর ওই সংশয়ের সঙ্গে আমি রামপ্রসাদের ওই গানটির নিম-কে চিনি বলে খাওয়ানোর ছলনাটুকুকে এক করে দেখি। মনে হয় এই সংশয়, বিশ্ববিধানের ওপর এই অনাস্থা তাঁদের সারাজীবন মন্থন করেই কেবল উঠে আসতে পারে। প্রসঙ্গত, রবীন্দ্র-কবিতাটিতেও কিন্তু সৃষ্টির পথে জাল ছড়িয়ে রেখেছেন একজন ‘ ছলনাময়ী’ই। একজন নারীই। রামপ্রসাদের কালীরই মত। কেন? জন্ম মেয়েরাই দেয় বলে? সে যাই হোক, আমার মতে এই ‘তোমার সৃষ্টির পথ’ কবিতার শুরুর আর্তিটাই আসল। বিশ্ববিধানের দিকে ধাবিত ওই সংশয়, ওই অবিশ্বাস—- ওটাই আসলে মৌলিক। বাকিটা প্রত্যাবর্তন। নিজের কমফোর্ট জোনে।ভয়েভয়ে উচ্চারণ করলাম। কেউই মানবেন না জানি। রবীন্দ্রনাথকে যে আমাদের জন্য সবসময় রাবীন্দ্রিক হতেই হবে, তাই না? তাহলে তাঁর নিজের আঁকা ছবির রবীন্দ্রনাথ কী করে এত অরাবীন্দ্রিক হন?
আমি তো অতি সাধারণ কবি। আমার নিজের শেষ কবিতা নিয়ে বিন্দুমাত্র ভাবনাটাবনা নেই। যা লিখেছি সব হাওয়ায় উড়ে যাবে। এসো, এখানে এতদিনের এই আড্ডা সমাপ্ত হোক। চলো, আমাদের সময়ের এক অন্যতম প্রধান কবি, সদ্যপ্রয়াত অগ্রজপ্রতিম গৌতম বসুর ‘অন্নপূর্ণা ও শুভকাল’ বইটির শেষ কয়েকটি লাইন (লাইন নয় তো, যেন আধুনিক মন্ত্র !)
আমরা একসঙ্গে উচ্চারণ করি :
‘যে জানে শেষাংশ কীভাবে গীত হবে, সেই জন সমাপ্তির রাজা
সেই বিদ্যা একমাত্র বিদ্যা, আমি মূঢ়
আমার সঙ্গে বলো, অন্নপূর্ণা ও শুভকাল।’
“যে জানে শেষাংশ কীভাবে গীত হবে সেইজন সমাপ্তির রাজা”