Daruharidra
  • ধান্যগৃহ
  • কবিতা
  • গল্প
  • গদ্য
  • প্রবন্ধ
  • উপন্যাস
Daruharidra
  • ধান্যগৃহ
  • কবিতা
  • গল্প
  • গদ্য
  • প্রবন্ধ
  • উপন্যাস
Daruharidra
No Result
View All Result
Home গদ্য

শিবাশিস চট্টোপাধ্যায় || নবম পর্ব

গদাধরের বাউদিয়া || ধারাবাহিক

Daruharidra by Daruharidra
30/08/2021
in গদ্য
8
শিবাশিস চট্টোপাধ্যায় || নবম পর্ব
234
VIEWS

 

রাজন্যশাসিত গৌরীপুর তো আমাদের প্রজন্ম দেখেনি; আমরা মানুষ হয়েছি, বলতে গেলে, অস্ত রবির আলোয়। সূর্যাস্তের পরেও তো কিছু আভা থাকে, যার কণামাত্রই হয়ত মাখা যেতে পারে শরীরে। কিন্তু কেমন ছিল সে অস্তাভা? স্বপ্নের মতো এক দুপুরে ঘুঙুরের শব্দে আমার ভাতঘুম ভেঙে গেল। শব্দ অনুসরণ করে দৌড়োতে দৌড়োতে চলে গেলাম বাইরের ঘরে। গিয়ে দেখলাম দাদা-দিদিরা সব গোল ক’রে দাঁড়িয়ে আছে, কেউ গান গাইছে, কেউ হাততালি দিচ্ছে—

মোর পায় পায় ঘুঙুরা বাজে রে

ও মুই কেমনে বায়রা যাং

ঘরে মোর শ্বশুর, বায়রা মোর ভাসুর ও…

 

গানের তালে তালে মাঝখানে দাঁড়িয়ে আপনমনে গোয়ালপাড়িয়া নৃত্য করছে রূপাদি। রূপাদি তখন বড় জোর ক্লাস এইট। রূপাদি ও তাঁর বোন কঙ্কা হচ্ছে প্রমথেশ বড়ুয়ার দুই নাতনি। দুই বোনই রীতিমতো নজরকাড়া, ডাকসাইটে সুন্দরী। চোখে-মুখে, চেহারায় তুমুল আভিজাত্যের ছাপ। ফলে, একবার দেখলেই শহরের কিশোর-যুবারা প্রেমে পড়ে যেত। তবে সামনে গিয়ে দাঁড়ানোর সাহস খুব কম ছেলেরই হত। গৌরীপুর এমনিতেই সুন্দরী মেয়েদের জায়গা আর সেটা সারা আসাম জানে। ভূপেন হাজারিকার গানও আছে এ নিয়ে। কঙ্কা আমাদের বন্ধু আর আমরা একই ক্লাসে পড়ি। তবে কঙ্কা ও আমার বোন মৌ পড়ে মেয়েদের স্কুলে। আরেকদিনের ঘটনা। তুঁতফল খাব বলে বন্ধুর সঙ্গে বেরিয়েছি দুপুরবেলায়। গৌরীপুর গার্লস হাইস্কুলের কাছে একটি বাড়িতে দেখি আমারই এক বন্ধুর দিদি আপনমনে গান ধরেছে আর কতগুলি ছোট্ট মেয়ে নাচছে—

ঝিকো ঝিকো করি রে

আঞ্চলে বান্ধিয়া রে,

ঝিকো ঝিকো করি রে

আঞ্চলে বান্ধিয়া রে,

যায় নীলীমণ গৌরীপুরের হাট রে

নীলীমণ নীলাইও না,

জোড়া কদমের তলে বৈসো রে

নীলীমণ নীলাইও না…

 

এই হল গিয়ে সেই অস্ত সূর্যের আভা, যার কথা বলছিলাম একটু আগে। প্রতিমা পাণ্ডে তখন খ্যাতির মধ্য গগনে, সশরীরে বর্তমান। মাঝে মাঝে ফাংশনে, এছাড়াও এখানে-ওখানে, তাঁর দেখা পাই। একটা ব্যাপার খুব চোখে পড়ার মতো ছিল, সেটা হল, প্রতিমা পাণ্ডের চোখে গরীব-ধনী ছিল না। আমাদের বাড়িতেও আসতেন প্রায়ই, আড্ডা দিতেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা, গান গাইতেন গুণ গুণ করে আর ফাঁকতালে চলে আসতেন রান্নাঘরে। এসেই মাকে বলতেন— বৌদি কী রেঁধেছ?

  সেকালের গৌরীপুর বিখ্যাত ছিল শিল্প-সাহিত্য চর্চার কেন্দ্র হিসেবে। রাজাবাহাদূর প্রভাতচন্দ্রের কলানুরাগের কথা তো সুবিদিতই। তিনি নিজেও ছিলেন শিল্পী, বিশেষ ক’রে তবলা-বাদক হিসেবে খ্যাতিমান। তাঁর আমলে সঙ্গীতের বড় বড় ওস্তাদদের গৌরীপুরে আমন্ত্রণ ক’রে এনে জমিজিরেত দান করে বসিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে কেউ স্থায়ীভাবে থেকে গেছেন, কেউ বা আবার ফিরেও গেছেন নিজের জায়গায়। আজ প্রতিমা পাণ্ডের সুবাদে গোয়ালপাড়িয়া লোকসঙ্গীত চর্চার কথাই শুধু লোকে জানে, কিন্তু ঘটনা হল, গণসঙ্গীত থেকে শুরু ক’রে শাস্ত্রীয় সঙ্গীত-নৃত্য-বাদ্যর নিয়মিত জলসা বসত মাটিয়াবাগ প্যালেসে। এই মাটিয়াবাগ প্যালেস তৈরি করা হয়েছিল গৌরীপুর শহরের উত্তরকোণে, পাহাড়ি এক টিলার ওপর। একদিকে লাউখাওয়া বিল, অপরদিকে এই টিলা। ওপরে অপরূপ সৌন্দর্যে ঘেরা একটি প্রাসাদ, রাজা বাহাদুর ভালবেসে যার নাম রেখেছিলেন ‘হাওয়াখানা’। সেই ‘হাওয়াখানা’, যে ইমারত সর্বাঙ্গে কালক্ষত নিয়ে ধুঁকে ধুঁকে টিকে রয়েছে আজও, একদা তার মহলগুলি নৃত্যগীতবাদ্যে, মানুষিক ভালোবাসায় গুঞ্জরিত ছিল। সে সময় রাজপ্রাসাদ থেকে ধুলোয় নেমে এসে মাটির মানুষের গানে, মাহুতের গানে, মৈশালবন্ধুর গানে গলা মেলাচ্ছেন কিশোরী বা সদ্যযৌবনা প্রতিমা পাণ্ডে (বুচু) আর তাঁর বোন প্রতিভা বিশ্বাস (দুখু) নাচছেন লোকায়ত সুরের তালে তালে।

   ভূপেন হাজারিকা তখন খ্যাতির সিঁড়ি বেয়ে ধীরে ধীরে উঠছেন। তিনিও কতো যে এসেছেন এই জনপদে, অতিথি হয়েছেন রাজপরিবারে, তার ইয়ত্তা নেই। সারাদিন-সারারাত ধরে শুধু গান আর গান। আজ, বেশ কয়েক যুগের এপারে দাঁড়িয়ে যখন ভাবি, মনে পড়ে ভাস্কর চক্রবর্তীর সেই কবিতা:

পঁচিশ বছর আগেকার

মুখ যেন জাপানী অক্ষর

বাজুবন্ধ মৃদু বেজে ওঠে

গান গান গান শুধু গান

 

ছোট এক ঘরে শুয়ে আজ

মনে পড়ে প্রেমিক ছিলাম

(স্মৃতি-৩, আকাশ অংশত মেঘলা থাকবে)

 

সে যাই হোক, শোনা যায়, শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের এহেন একটি জলসায় নাকি সশরীরে হাজির ছিলেন  তবলার কিংবদন্তী উস্তাদ কেরামুতুল্লা খাঁ সাহেবও। পরে রাজা বাহাদুরের এক পুত্র, অজয় বড়ুয়া, ওস্তাদ কেরামুতুল্লার কাছে নাকি নাড়াও বেঁধেছিলেন, যদিও পরের দিকে অজ্ঞাত কারণে তবলা চর্চা আর অব্যাহত রাখেননি। ঢাকানিবাসী আরেক প্রখ্যাত তবলিয়া পণ্ডিত প্রসন্ন কুমার সাহাবণিক, রাজানুগ্রহবশত একদা গৌরীপুরবাসী হয়েছিলেন। যখন তবলা ও মৃদঙ্গ (পাখোয়াজ) শেখার কোনও বই বাজারে ছিল না, তখন ‘তবলা তরঙ্গিনী’, ‘মৃদঙ্গ প্রবেশিকা’ নামের সেকালের বিখ্যাত গ্রন্থদ্বয় তিনিই রচনা করেন। ‘মৃদঙ্গ প্রবেশিকা’-এর ভূমিকায় অন্য আরও কয়েকজনের সঙ্গে গৌরীপুররাজের প্রভূত অবদানের কথা তিনি নিজেই লিখে গেছেন।

“…আসাম গৌরীপুরাধিপতি সঙ্গীত-বিদ্যানুরাগী শ্রীযুক্ত রাজা প্রভাতচন্দ্র বরুয়া বাহাদুর মহোদয় পুস্তকের আগাগোড়া দেখিয়া ও সংশোধন করিয়া ছাপাইতে উৎসাহ দিয়াছেন, তাহাদের উৎসাহে উৎসাহিত হইয়া এই দুরূহ কার্যে ব্রতী হইয়াছি।”

প্রসঙ্গত বলি, লখ্নৌর ভাতখণ্ডে সঙ্গীত বিদ্যাপীঠের লিখিত পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে (কোন ইয়ারের পরীক্ষা মনে নেই) একবার দেখি পণ্ডিত প্রসন্ন সাহাবণিকের জীবনী লিখতে দেয়া হয়েছে। গানের বাড়ির ছেলে আমি– একটু তবলা, একটু গানও যে না জানি এমন নয়— অন্তত দোহারকির কাজটা করি গানের আসরে। তখনও আমার স্কুলজীবনের ইতি হয়নি। হঠাৎ আমার মাথায় স্ট্রাইক করল একটা ব্যাপার, যারা প্রশ্নের উত্তর লিখছে তারা জানে তো যাঁর জীবনী লিখছে সে মহান শিল্পীমানুষটি পৃথিবীর ধুলো মাখতে মাখতে এসেছিলেন এ শহরেও একদা, হেঁটে বেড়িয়েছিলেন এর ধুলোময় পথে পথে, একা–  “Didst tread on earth unguess’d at…”

প্রত্যেককে জিজ্ঞাসা করে দেখলাম কারুরই এ খবর জানা নেই, এমনকি গানের শিক্ষক-শিক্ষয়িত্রীদেরও। কী আর করা!

অনেক লেখক-গবেষকেরও যাতায়াত ছিল এখানে, যেমন ‘আ সোশ্যাল হিস্ট্রি অফ কামরূপ’ রচয়িতা নগেন্দ্রনাথ বসু বা ‘প্রাচীন কামরূপীয় কায়স্থ জাতির ইতিবৃত্ত’ -এর লেখক হরিনারায়ণ দত্ত বরুয়া’। এই দুই বিখ্যাত গ্রন্থ রাজা বাহাদুর প্রভাত চন্দ্রের পৃষ্ঠপোষকতা ও আর্থিক সহায়তা না থাকলে লিখিত হয়ে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হত না। অনেকানেক দিগগজ পণ্ডিতও গৌরীপুরে থাকতেন। তারানাথ বাচস্পতি, ষড়ানন তৰ্কতীৰ্থ, লক্ষ্মীপতি তৰ্কশাস্ত্ৰী— এছাড়াও, একজন মহামহোপাধ্যায়ও ছিলেন। এঁদের মধ্যে একমাত্র লক্ষ্মীপতি তৰ্কশাস্ত্ৰীকেই আমার ছোটবেলায় চাক্ষুষ করার সৌভাগ্য হয়েছে। তখন তিনি অশীতিপর বৃদ্ধ।

  সে যাই হোক, রাজ-পরিবারের উদার দৃষ্টিভঙ্গির ফল হয়েছিল সুদূরপ্রসারী। কিংবদন্তী অভিনেতা প্রমথেশ বড়ুয়া, লোকসঙ্গীত শিল্পী প্রতিমা পাণ্ডে বড়ুয়া, লোকসংস্কৃতি গবেষক নীহারবালা বড়ুয়া— এঁরা সকলেই ছিলেন রাজ পরিবারের সন্তান। কিন্তু শিল্পকলা, সঙ্গীত আদি চর্চার আবহ তো শুধু রাজ পরিবারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না! রাজাশ্রিত সাধারণ মানুষ, রাজ-কর্মচারীদের মধ্য থেকেও অনেকেই এই উদার, মুক্ত পরিবেশে নিজ নিজ সুপ্ত গুণাবলীর বিকাশের পথ খুঁজে পেয়েছিলেন। অনেকেরই পরবর্তী প্রজন্মে এর সুফল লাভ হয়েছে, এরকমও দেখা গেছে। কবি তারাপদ রায়ের ঠাকুরদা যোগেশ রায় বহুকাল এখানেই থেকে গিয়েছিলেন, যদিও শেষের দিকে চলে যান। তবে তিনি চলে গেলেও এই রায় বংশের কেউ কেউ এখানেই থেকে গেছেন। সঙ্গীতকার বাপী লাহিড়ীদের নিজস্ব জোত ছিল ব্রহ্মপুত্রের দক্ষিণপারে, চর এলাকায়। তাঁর নিকটাত্মীয়দের অনেকেই এখনও ধুবড়িবাসী।

  একদা রাজ এস্টেটের দেওয়ান হয়ে এসেছিলেন বাবু দ্বিজেশ চক্রবর্তী, কবি অমিয় চক্রবর্তীর বাবা। সেই সুবাদে, অমিয় চক্রবর্তীর শিশু-কিশোরবেলা ও প্রাক-যৌবনকাল, পনেরো বছর বয়স পর্যন্ত, এখানেই কাটে। এখানের পি সি ইনস্টিটিউশনের ছাত্র ছিলেন, যদিও ম্যাট্রিক পাশ করেন হেয়ার স্কুল থেকে ১৯১৬ সনে। কিশোর অমিয় চক্রবর্তী তখন রবীন্দ্রনাথ, জর্জ বার্নার্ড শ’, রোমা রোলাঁ সহ বিশ্বের তাবড় তাবড় মানুষকে, বিশেষ করে সাহিত্যিক ও দার্শনিকদের, চিঠি লিখছেন। সে চিঠি পড়ে তাঁরা নাকি বুঝতেই পারতেন না যে পত্রলেখক একজন কিশোর মাত্র। রবীন্দ্রনাথকে নিয়মিত চিঠি লিখতেন তিনি— সেই পত্রাবলীর কয়েকটি গৌরীপুরের নারী সমিতি-সংলগ্ন কোয়ার্টারে বসে লেখা। রবীন্দ্রনাথ সেসব চিঠির উত্তরও দিতেন। পরে কবির আমন্ত্রণে রবীন্দ্র সচিব হয়ে তিনি ঘুরে বেড়াবেন দেশে দেশে, নিজেও হয়ে উঠবেন স্বকীয়তাসম্পন্ন, আধুনিকতার অগ্রদূত কবি, আলোকময় বক্তৃতা দিয়ে বেড়াবেন, অধ্যাপনা করবেন ইংলেন্ড-আমেরিকায়, আর ক্রমে হয়ে উঠবেন ‘বিশ্ব নাগরিক’। রোগশয্যায় কবি তাঁকে উদ্দেশ্য করেই লিখবেন–

  “হে বন্ধু নতুন ক’রে

  আরোগ্যের স্বাদ দিলে মোরে

  …   … …

  অকৃত্রিম তোমার মিত্রতা,

  তোমার বুদ্ধির বিচিত্রতা

  ভূয়োদর্শনের তব দান

  বন্ধুত্বেরে করে মূল্যবান”

  

রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘সহজ পাঠ’, প্রথম ভাগের নবম পাঠে ঔ-কারের ব্যবহার শেখাতে অমিয় চক্রবর্তীর

‘গৌরীপুর’-এর কথাই কি লিখেছিলেন? গৌরীপুরের সাথে গৌহাটির উল্লেখে এ বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ বিশেষ নেই।

“তুমি কী ক’রে এলে গৌর?

নৌকো ক’রে।

কোথা থেকে এলে?

গৌরীপুর থেকে।–

পৌষমাসে যেতে হবে গৌহাটি।”

 

রবীন্দ্রনাথকে লেখা অমিয় চক্রবর্তীর একটি চিঠিতে গৌরীপুরের বাড়ির সম্মুখের রাস্তায় (রূপসী রোড) ব্রহ্মপুত্রাভিমুখী অশোকাষ্টমীর স্নানযাত্রীদের হুবহু একটি ছবি রয়েছে, যে ছবিটি বর্তমানেও অপরিবর্তিত রূপেই প্রায় প্রত্যক্ষ করা যায়। আমরাও সকলেই কম-বেশি সে ছবিটির সাথে পরিচিত। আরও অনেক চিঠির সাথে সে চিঠিটিও ‘কবির চিঠি কবিকে’ শিরোনামে দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল।

অমিয় চক্রবর্তী কি ছেলেবেলার গৌরীপুরকে ভুলতে পেরেছিলেন? ছেলেবেলার বন্ধুদের? সম্ভবত না, কারণ বিদেশিনী স্ত্রী হৈমন্তীকে (হিয়োর্ডিস সিগার্ড) নিয়ে তিনি তাঁর বাল্যবন্ধু রাজপরিবারের আরেক আত্মীয় সন্তোষ বড়ুয়ার অতিথি হয়ে এসেছিলেন একবার। কৈশোর, প্রাক-যৌবনের আড্ডাস্থল চুন-সুরকি নির্মিত ‘পাকাপুল’এ গিয়ে আবার বসেছেন দুবন্ধু মিলে, শেষবেলায়। সূর্য তখন অস্তাচলগামী, দুই বন্ধু অপলক তাকিয়ে থেকেছেন বিশাল ভেরভেরির মাঠের দিকে। তারপর গৌরীপুর বাজারস্থিত প্রবোধ চক্রবর্তীর নস্যি, চিমনির দোকানের হাটবারের আড্ডায় যোগ দিয়েছেন সন্তোষ বড়ুয়া, মণি বড়ুয়া, বুধু বড়ুয়াদের সঙ্গে। স্বভাবগত দার্শনিকতার ছোঁয়া তাঁর বহু কবিতায়; তবু ‘মাটি’ শীর্ষক কবিতায় গৌরীপুরের হাট আর ‘গৌরীপুর, আসাম’ কবিতায় গৌরীপুরের বর্ষার ছবি, বিশেষ করে ধুবড়ির নিকটস্থ ব্রহ্মপুত্রের উল্লেখ আছে, যদিও স্থানিকতার মাত্রা ছাড়িয়ে ব্যক্তিগত দার্শনিকতায় তা ইউনিভার্সাল হয়ে উঠেছে–

…বৃষ্টি ঝরে চৈতন্যের বোধে

আবার আকাশ ভরে রোদে

তারি জন্য শিশু আঙিনায়

দৌড়ে খেলে, হাট বসে, গৌরীপুরে জমে ব্যবসায়

(মাটি)

বা

…ক্ষুদে পুঁটিমাছ বা সাঁপলার সঙ্গ-স্রোতে

ডোবা সংসারে ভাসছি, ঘুরছি, জাগছি; নিবিড় ঢেউ–

এবারে কি বন্যায় হারাবে গ্রাম,

সব জল এক হবে ঐ ব্রহ্মপুত্রে, ধুবড়ির কাছে–

(গৌরীপুর, আসাম)

 

গৌরীপুর টোলের এক পণ্ডিতের কাছে, সম্ভবত ষড়ানন তর্কতীর্থ, অমিয় চক্রবর্তী প্রাইভেটে সংস্কৃত সাহিত্যের নিবিড় পাঠ নিয়েছিলেন বলে শোনা যায়। তাছাড়া ভাওয়াইয়া-চটকা প্রভৃতি লোকগান, গোয়ালননি নৃত্যগীত, মনসার গান, জারি-সারি-বাউলের আসরে গিয়ে হানা দিতেন সেই ছেলেবেলায়। শৈশবে ঈষৎ চঞ্চল ছিলেন, যদিও দাদা অরুণ চক্রবর্তীর আত্মহত্যার ঘটনার অভিঘাত, চূড়ান্ত শোক তাঁকে, তাঁর স্বভাব ও মননকে একেবারে বদলে দেয়। আর, গৌরীপুরে যে বাস করেছে কোনোদিন, সে জানে, জীবনের ভেতরের জীবনের খোঁজ তাঁর অন্তরাত্মায় হানা দেবেই।

কবিতার মস্ত সূর্য অস্ত গিয়েছে তারপর। তবে লেখক, কবি, শিল্পীরা তারপরও ছিলেন। শীলভদ্রর কথা তো আগেই লিখেছি। আরেকজন কবি ছিলেন অখিল বড়ুয়া— আমার ছোটবেলার বন্ধু বুবুলির বাবা। মানুষটা ছিলেন আদ্যোপান্ত কবি, যাকে বলে। ভবঘুরের মতো ঘুরে বেড়াতেন আর স্বরচিত কবিতা আবৃত্তি করতেন, এমনকি কারুর দোকানের সম্মুখে দাঁড়িয়েও। বড় গলায় বলতেন— আমি পাঁচ-পাঁচটি ভাষায় কবিতা লিখি। একদিন সন্ধেবেলা রাহুল বড়ুয়ার টিভির দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে তিনি আবেগমথিত কণ্ঠে স্বরচিত কবিতা আবৃত্তি করছেন। আমি অবাক হয়ে শুনছি। কবিতায় ব্যবহৃত একটি শব্দ ছিল ‘মসিলিপ্ত’, যা তিনি বেশ জোর দিয়ে উচ্চারণ করেছিলেন। ব্যস, আমার মাথায় গেঁথে গেল শব্দটা। স্কুলের দিদিমণি অশোকা চক্রবর্তীকে জিজ্ঞাসা করলাম ইংরেজির ক্লাশে। দিদিমণি বাংলা ও ইংরেজি— দুটো বিষয়েই তুখোড়। বললেন, ‘মসি’ মানে কালি, এবার নিজে নিজে মানেটা বোঝার চেষ্টা কর। তারপর বললেন—

“শব্দটা অবসলিট হয়ে গেছে, এখন আর তেমন চলে না। কোথায় পেয়েছিস?”

পূর্বাপর সব জানালাম। শুনে বললেন—

“অখিল ভাল লেখে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথেই আটকে থাকল। কিছুতেই আর বেরোতে পারল না।”

মনে মনে তখন কেবলই ভাবছি, অখিলকাকু রবীন্দ্রনাথ থেকে কিছুতেই বেরোতে পারছেন না, এর মানে কী? হঠাৎ মনে পড়ে গেল বন্ধু হরিয়ার কথা। ছোট থেকেই দুরন্ত সাঁতারু সে। আমাকে সাঁতার শেখাবে ক’রে জোর ক’রে নিয়ে যেত গদাধরের জলে। ডুবসাঁতার দেবার চেষ্টা করছি দেখে একদিন বলল—

“ডুবসাঁতার দিবি না একদম, বলে দিলাম। খবরদার। লতায় পা আটকে গেলে আর উঠতে পারবি না। আমার পা একবার ফেঁসে গিয়েছিল। একটুর জন্য বেঁচেছি”

অশোকা দিদিমণির কথা শুনে ভাবতে বসলাম— কবি অখিল বড়ুয়ার পা-ও কি ডুবসাঁতার দিতে দিতে হরিয়ার মতোই কোথাও আটকে গেছে?

সেকালে আরও দুজন কবি ছিলেন গৌরীপুরে। একজনের নামটা জানি— ফকির চাঁদ মণ্ডল। ফকিরচাঁদ বাজারের ফর্দ লেখার কাগজে পদ্য লিখতেন, মূলত সমসাময়িক রাজনৈতিক বিষয় ও দেশভাগ নিয়েই লিখতেন। দেশভাগের জ্বালা-যন্ত্রণার কথা অন্ত্যমিলে লিখে বাজারে, ঘাটে, যত্রতত্র পরিবেশন করতেন। পড়তে বিশেষ ভাল লাগত না, তবে যখন তিনি নিজে আবৃত্তি করতেন তখন চারিদিক গমগম করত।

বিভিন্ন সভা-সমিতিতে তিনি পকেটভর্তি রোল করা কাগজে লেখা কবিতা নিয়ে সবার আগে হাজির হতেন আর ফাঁক পেলেই কর্মকর্তাদের ঠেলেঠুলে মাইকের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেন।

দ্বিতীয়জনকে সাধক কবি বলাই বোধহয় সঙ্গত। তাঁর বাড়িতে প্রতিষ্ঠিত ছিল জগদ্ধাত্রী বিগ্রহ— সেই নিয়েই বেলা কেটে যেত মানুষটার। গৌরীপুর ৪ নম্বর ওয়ার্ডের কোথাও থাকতেন। তাঁর পুজোও ছিল মন্ত্রহীন, যাকে রাগানুগা বলে, সেরকম। কোনও ব্রাহ্মণ পুরোহিতকে ডেকে এনে দান-দক্ষিণা, ভোজ্যাদি দিয়ে বিদেয় করার ক্ষমতাও তাঁর ছিল না। দেখতে ছোট-খাটো, ময়লা ধুতি-ফতুয়া পরনে, কিন্তু চোখদুটো ছিল পাঁড় মাতালের মতো । দেখতাম, মাঝে মাঝেই বগলতলায় হলদেটে রঙের মোটা দিস্তা কাগজের খাতা চাপা দিয়ে বাবার কাছে আসতেন। খাতাভর্তি হিজিবিজি লেখা— তাঁর মতে কবিতা। লেখার অমন বহর দেখে বাবাও আঁতকে উঠতেন। শত শত লেখা, পঙক্তিগুলো দেখতে সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের কবিতার মতো। আসলে ঠিক কবিতাও হয়ত বলা যায় না, সেগুলো বন্দনা-গীতি বলাই ভাল। বাবার চোখের সামনে সেই বিশাল খাতা মেলে ধরে বলতেন:

“মাস্টর, একটু দেইখা দিতে হইব। বই করুম।”

বাবা হয়ত জিজ্ঞাসা করলেন, বেশ তো, করুন না… আমি আবার কী দেখব? তবু হাল ছাড়ে না সেই মাতাল, কিছুতেই। বলে ওঠে—

“গোপনে একখান কথা কই, আপনে জ্ঞানী মানুষ, আপনে বুঝবেন, আমি না, মা-ই ল্যাখে এইসব… খালি এট্টু বানানডা দেইখা দিবেন, ব্যস।”

বাবার হাতে তো সময় ছিল না একদম, স্কুল, ছাত্র পড়ানো, নোট তৈরি, একাধিক সমবায় সমিতির মিটিং, এছাড়াও আরও কতো কাজ। তা এখন এত এত লেখার বানান ঠিক করা তো চাট্টিখানি কথা নয়। তবু হয়ত রসিকতা করে বলেই ফেললেন—

“আপনার মা এত কিছু জানে, আর বানান জানে না?”

কিন্তু সেই কবি রসিকতা বুঝতেন কিনা কে জানে। জোরে, মাথা ঝাঁকিয়ে, শিশুর মতো বিশ্বাসে অবলীলায় বলতেন—

“এক্কেরে ঠিক ধরসেন, মাস্টর, মায়ে আমার বানানডা জানে না। অবশ্যে, নিজেই আবার স্বীকারও যায়।”

বাবা এইসব কথা শুনে অবাক হতেন, মজাও পেতেন। লোকটা দাবি করছে, মা জগদ্ধাত্রীই কবিতাগুলো লিখেছেন। আবার লেখায় অসংখ্য বানান ভুল, কারণ মা নাকি বানান জানেন না, আর এটা মা নিজেই তাঁর ভক্তের কাছে স্বীকারও করেন।

বাবা তখন কবির খাতার পাতা ওল্টাচ্ছেন। তারপর হয়ত বললেন—

“কিন্তু একটা ব্যাপার কিন্তু তবুও বুঝলাম না। আপনার মা নিজেই নিজের বন্দনা করবেন কেন?”

মাতাল কবির উত্তরটা ছিল বড় অদ্ভুত—

“আমিও তো তাই ভাবি, মাস্টর। কিন্তু এই কথা জিগাইলে আর কথা কয় না। বিশ্বাস করেন, এই এত এত লেখা… আমি একা কি নামাইতে পারি, সম্ভব?… হাতে ব্যথা ধইরা গেসে। রাইতে নিসিন্দা পাতা বাইট্টা লাগাইতে হয়!”

মনে আছে, যখন তখন সেই কবি এসে হাজির হতেন। তখন তাঁর সামনেই কিছু কিছু লেখার বানান বাবা ঠিক করে দিতেন, কিন্তু মস্ত খাতা সংশোধনের দায়িত্ব নেয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল না। কিন্তু বাবাকে আড়ালে বলতে শুনেছি, লোকটা শিশুর মতো সরল আর এই সরলতাই সাধকের লক্ষণ। কারণ, ঈশ্বর বালক-স্বভাব। এখন মাঝে মাঝে মনে হয়, সে যুগে কী অদ্ভুত মানুষ সব ছিলেন। এরপরেও সেই কবি বাবার পিছনে পিছনে ঘুরে বেড়াতেন। হয়ত কোনও সকালবেলায়, চায়ের দোকানে, সামনে আধগ্লাস গরম চা, বাবা সিগারেট ধরাতে যাচ্ছেন। সেকালের ক্যাপ্সটান ফিল্টার। সেই কবি সেখানেও হাজির— মাস্টর, ও মাস্টর। বাবা পালিয়ে বেড়াতেন।

অনেকদিন পর একবার গিয়েছিলাম তাঁর বাড়িতে, একটু বড় হয়ে। তাঁর একটা কথা খুব ভাবিয়েছিল সেই সময়। এরকমই কিছু একটা বলেছিলেন, আবছা আবছা মনে পড়ে—

“নদীতে নৌকা বাইচ খেলতাসি–পার নাই, পৌঁছানোও নাই–ছুট”

 

একথা বলেই দৌড়ে কোথায় যেন চলে গেলেন।

Tags: উত্তর-পূর্বগদাধরের বাউদিয়াধারাবাহিক গদ্যশিবাশিস চট্টোপাধ্যায়
Previous Post

প্রবুদ্ধসুন্দর কর || চতুস্ত্রিংশ || অন্তিম পর্ব

Next Post

মেখলা পরা মেয়ে || শ্রীযুধাজিৎ || দশম পর্ব

Daruharidra

Daruharidra

Next Post
মেখলা পরা মেয়ে || শ্রীযুধাজিৎ || দশম পর্ব

মেখলা পরা মেয়ে || শ্রীযুধাজিৎ || দশম পর্ব

Comments 8

  1. অমিতাভ দেব চৌধুরী says:
    10 months ago

    ওহে ভাই শিবাশিস, এ এক দুরন্ত কিছু হয়ে উঠছে ।

    Reply
    • Sibasish Chatterjee says:
      10 months ago

      🙏🙏🙏

      Reply
  2. Kamal Chakraborty says:
    10 months ago

    অসম্ভব ভালো লেখা। লিখতে লিখতে একসময় ব‌ই প্রকাশ করা দরকার।

    Reply
    • Sibasish Chatterjee says:
      10 months ago

      ইচ্ছে তো আছে বই করার। দেখি। আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ।

      Reply
  3. Puspendu Bhattacharjer. says:
    10 months ago

    ইতিহাসের ছত্রে ছত্রে জীবনকে খুঁজে পাচ্ছি।

    Reply
  4. SNEHASISH CHATTERJEE says:
    10 months ago

    গৌরীপুর ! গৌরীপুর !! আমাদের গৌরীপুর !!! শৈশবের গৌরীপুর !!! যৌবনের গৌরীপুর !!! ……অজস্র সুমধুর স্মৃতি……..’সেই দিনের কথা …সে কি ভোলা যায় ?’
    এতো চমৎকার ভাবে লিখেছিস….…প্রত্যেকটি পর্ব ….পড়ছি আর অবাক হচ্ছি…… দারুণ !!!

    Reply
    • Sibasish Chatterjee says:
      10 months ago

      থ্যাঙ্কস, মেজদা

      Reply
  5. সৌমিত্র চক্রবর্তী says:
    10 months ago

    অসাধারণ চারণ পর্ব।

    Reply

Leave a Reply Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

No Result
View All Result

RECENT POSTS

মেখলা পরা মেয়ে || শ্রীযুধাজিৎ || অন্তিম পর্ব

মেখলা পরা মেয়ে || শ্রীযুধাজিৎ || অন্তিম পর্ব

15/04/2022

সঞ্জয় চক্রবর্তী || অন্তিম পর্ব

09/04/2022
মেখলা পরা মেয়ে || শ্রীযুধাজিৎ || দ্বাবিংশতি পর্ব

মেখলা পরা মেয়ে || শ্রীযুধাজিৎ || দ্বাবিংশতি পর্ব

08/04/2022

সঞ্জয় চক্রবর্তী || নবম পর্ব

02/04/2022
মেখলা পরা মেয়ে || শ্রীযুধাজিৎ || একবিংশতি পর্ব

মেখলা পরা মেয়ে || শ্রীযুধাজিৎ || একবিংশতি পর্ব

01/04/2022

সঞ্জয় চক্রবর্তী || অষ্টম পর্ব

27/03/2022
মেখলা পরা মেয়ে || শ্রীযুধাজিৎ || বিংশতি পর্ব

মেখলা পরা মেয়ে || শ্রীযুধাজিৎ || বিংশতি পর্ব

25/03/2022
সঞ্জয় চক্রবর্তী || সপ্তম পর্ব

সঞ্জয় চক্রবর্তী || সপ্তম পর্ব

20/03/2022
মেখলা পরা মেয়ে || শ্রীযুধাজিৎ || উনবিংশতি পর্ব

মেখলা পরা মেয়ে || শ্রীযুধাজিৎ || উনবিংশতি পর্ব

18/03/2022
ষষ্ঠ পর্ব || সঞ্জয় চক্রবর্তী

ষষ্ঠ পর্ব || সঞ্জয় চক্রবর্তী

13/03/2022

RECENT VIDEOS

https://www.youtube.com/watch?v=77ZozI0rw7w
Daruharidra

Follow Us

আমাদের ঠিকানা

দারুহরিদ্রা
কুঞ্জেশ্বর লেন
(বরাকভ্যালি একাডেমির নিকটবর্তী)
নতুন ভকতপুর, চেংকুড়ি রোড
শিলচর, কাছাড়, আসাম
পিন-788005

ডাউনলোড করুন

সাবস্ক্রাইব

Your E-mail Address
Field is required!
Field is required!
Submit
  • আমাদের সম্পর্কে
  • লেখা পাঠানো
  • যোগাযোগ

Copyright © All rights reserved Daruharidra | Development by Prosenjit Nath

No Result
View All Result
  • ধান্যগৃহ
  • কবিতা
  • গল্প
  • গদ্য
  • প্রবন্ধ
  • উপন্যাস
  • সাক্ষাৎ পাতা
  • অনুবাদ পাতা
  • আর্কাইভ
  • আমাদের সম্পর্কে
    • লেখা পাঠানো
    • যোগাযোগ

Copyright © All rights reserved Daruharidra | Development by Prosenjit Nath