ছোটবেলা থেকেই খালে-বিলে ঘুরে বেড়ানোর স্বভাব ছিল আমার। সাথে বন্ধু হরিয়া, কখনও রিজু, বুবুলি বা চাটু। কত দূর-দূর চলে যাই একেকদিন— বেশির ভাগটাই পায়ে হেঁটে, কখনও বা আবার কারুর সাইকেলের পেছনে, ক্যারিয়ারে বসে। ঘাসফুলের মধু খাই, সর্ষের মতো দেখতে শেয়ালকাঁটার বীচি জমাই হাফপ্যান্টের পকেটে। এদিকে বাড়িতে সারাদিন চলে গানের রেওয়াজ, তবলার টুংটাং। ছোটবোন মৌ সকাল-সন্ধে গলা সাধে নিয়ম ক’রে, দাদা তবলায় হাত পাকানোর জন্য জান লড়িয়ে দেয়।
বড় দাদা খুব ছোট থেকেই তবলা শিখতে শুরু করেছিল। তবলায় তাঁর হাতেখড়ি হয়েছিল স্থানীয়
তবলিয়া, গুরু নরেশ শীলের কাছে। নরেশ শীলের ছোটখাটো চেহারা, চোখে মোটা খয়েরি চশমা, গায়ে সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবী। এই নরেশ শীল ছিলেন পণ্ডিত মতিয়ালালের সমসাময়িক আরেকজন সঙ্গীতাভিলাষী। দু’জনের গুরুও ছিলেন একজনই— গদাধর তীরের পাঁচচূড়া মন্দিরের স্বামীজি। স্বামীজি শাস্ত্রীয় সঙ্গীত, তবলা, সেতার সবকিছুতেই পারঙ্গম ছিলেন। তারপরেও স্বামীজির প্রকৃত নাম-ধাম আজও কেউ জানে না; উদ্ধার করার চেষ্টাও কেউ করেছে বলে শুনিনি।
সে যাই হোক, নরেশ শীলের তবলার হাত বড় মিষ্টি— তাঁর বাজানো বোল— তিরকিট তাক তাক থেকে লহড়া পর্যন্ত— এখনও চোখ বুজলে শুনতে পাই। মুখেও খুব দ্রুত তবলার বোল বলতেন, যেমন ভাল তবলিয়ারা বলে থাকেন, —আর সে বোলের উচ্চারণ ছিল অনেকটা হিন্দীভাষীদের মতো। মুখে বোল, সাথে ডানহাত দিয়ে বাঁ-হাতের তালুতে তালি বা চাটি— হাতের আঙুলে যেন ঝড়ের মুদ্রা। তবে তাঁর দু’হাত থেকে সুমিষ্ট তবলা বাদন নির্গত হলেও তবলায় তিনি নিজে কিন্তু খুব বেশিদূর যে এগোতে পেরেছিলেন তা বলা যায় না। না পারার কারণটাও সেই একই— তীব্র সাংসারিক অভাব-অনটন। কত যুগ আগের কথা সেসব। তখন অভাবই জীবনের অলংকার ছিল। দু-তিনজন ছাত্রকে তবলা শিখিয়ে কি আর সংসার চলে? অনেক তবলার মাস্টারকে দেখেছি তবলা বাজিয়ে বা শিখিয়ে পেট চলে না বলে নতুন ক’রে গান শিখে গানের মাস্টার বনে গেছেন। তাতে ছাত্র না হোক, কিছু ছাত্রী অন্তত জুটে যায়। নরেশ শীল ছিলেন হার্ডকোর— এরকম আপস কোনোদিন করেননি। তবলা বাজাতে গেলে গান তো একটু জানতেই হয়। সেটুকু জানতেন, তার বেশি নয়। তুলনামূলক ভাবে লোভনীয় বিবেচনায় কেউ গান শিখে গানের মাস্টারি করার প্রস্তাব দেয়াতে মুখ কালো করতে দেখেছি তাঁকে। যে আপস জানে না, তাঁর কাছে আপসের প্রস্তাবও যে কী কষ্টের ভুক্তভোগী না হলে জানা যায় না।
একবার আমাদের বড়দাকে যখন তবলা শেখাচ্ছিলেন, সহানুভূতির ছলে স্থানীয় এক নামজাদা লোক, সম্ভবত তাঁর শুকনো মুখ, মলিন বেশভূষা দেখেই, তাঁর কাছে অনুরূপ প্রস্তাব করে বসেন। প্রস্তাব শুনে তিনি চুপ করে থাকলেন একটুক্ষণ, কারণ এরকম ক্ষেত্রে আপাত সহানুভূতির পেছনে তো অপমান করার স্পৃহাই কাজ করে বেশি। তারপর অনুচ্চ স্বরে দাদার দিকে তাকিয়ে শুধু বললেন—
বুঝলি বাবলু, যতদিন বিড়ি আছে দুনিয়ায়, বিড়া ছাড়ুম না।
বিড়া মানে যার ওপর ডুগি-তবলা থিতু ক’রে বসিয়ে বাজানো হয়। খড় গোল ক’রে পেঁচিয়ে কাপড়ে মুড়ে তবলার বিড়া বানানোর রীতি। ‘বিড়া ছাড়ুম না’— এ কথার অর্থ খুব স্পষ্ট। আর বিড়ি যে কতো জীবন বাঁচিয়েছে, তা গাঁয়ের দিকের নারী-পুরুষরা নিজের জীবন দিয়েই জানেন।
শুনেছি নরেশ শীলের ‘দুবলা-পাতলা’ স্ত্রী সারাদিন বাঁশের ঘরের চাতালে বাঁশের কুলো কাঁখে ক’রে বসে বসে আপনমনে বিড়ি বাঁধতেন। নরেশ শীল নিজেও বিড়ি বাঁধতে বসে যেতেন অবসর সময়ে, তবে কিছুটা লোকের চোখ বাঁচিয়ে, লুকিয়ে। গুরু বিড়ি বাঁধেন— এ কথা চারদিকে রটে গেলে দুর্বল পেশা আরও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। তবে ‘গোপন কথাটি রবে না গোপনে’– চিরদিন কিছুই গোপন থাকে না। লোকের কানাকানি থেকেই কথাটা এক সময় আমাদের কানেও পড়েছিল। বাবা শুনেই সঙ্গে সঙ্গে বড়দাদাকে বলেছিলেন—
বিড়ি বাঁধলেও গুরু গুরুই হয় রে। বিড়ি বাঁধার কথা জেনে মানুষটার প্রতি আমার শ্রদ্ধা আরও বেড়ে গেল। শোনো, গুরুর প্রতি শ্রদ্ধার অভাব যেন তোমার মধ্যে কোনোদিন না দেখি। গুরু মন্দ হলেও গুরু, ভাল হলেও। ধনী হলেও যেমন, গরীব হলেও তাই। এই শ্লোকটা মনে রেখো– ‘যদ্যপি আমার গুরু শুঁড়িবাড়ি যায়, তথাপি আমার গুরু নিত্যানন্দ রায়’।
আমার মা-কেও বাবা প্রায়ই বলতেন–
তবলা শেখাতে এলে নরেশকে শুধু চা-বিস্কুট নয়, পেটভরা খাবার দেবে। কে জানে সারাদিন ওর পেটে কিছু পড়ে কি না! হয়ত খালি পেটেই এবাড়ি-ওবাড়ি ঘুরে বেড়ায়!
নরেশ শীলের তবলা শিক্ষা অসম্পূর্ণ ছিল। অভাব ছাড়াও শিক্ষা অসম্পূর্ণ রয়ে যাবার আরেকটি কারণ হল পাঁচচূড়া মন্দির থেকে তবলায় গুরু স্বামীজির হঠাৎ অন্তর্ধান ও পরবর্তী সময়ে এমন কোনও গুরু খুঁজে না পাওয়া যিনি বিনে পয়সায় শেখাবেন। স্বামীজি বড় উদার ছিলেন— টাকা-পয়সা বা অন্য বিশেষ কিছুর কোনও চাহিদা ছিল না তাঁর। গাঁজা-ভাং-ও সেবন করতেন না। কেউ কিছু দিলে সহজে নিতেনও না। বলতেন—
আমার আকাশবৃত্তি। অন্নসংস্থানের জন্য আমি সন্ন্যাস নিইনি। আমার গানের শ্রোতা সেই ‘অলখ নিরঞ্জন’। শিখতে চাইলে শেখো, নইলে— ভাগো হিঁয়া সে।
বড়দাদার তবলা-শিক্ষার প্রথম গুরু ছিলেন এই নরেশ শীল। তারপর আরও দু-তিনজন গুরু এসেছিলেন, কেউ কেউ বিখ্যাতও। এরকম করেই সময় বয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ একদিন খবর এলো বড় দাদার গুরু নরেশ শীল গত হয়েছেন। লোকমুখে শুনেছি— তাঁরও টিবি ছিল। যথারীতি চিকিৎসা হয়নি। বিড়ি শ্রমিকদের মধ্যে যক্ষা ও শ্বাসকষ্টজনিত রোগের বাড়বাড়ন্তের জন্যই সম্ভবত পরবর্তী সময়ে সমাজ কল্যাণ বিভাগ থেকে এতদঞ্চলে স্থায়ী ডাক্তার নিয়োগ করা হয়।
এরই কয়েক বছর পর দৃশ্যপটে এলেন বেনারস ঘরানার প্রখ্যাত তবলিয়া পণ্ডিত সামতা প্রসাদের শিষ্য বীরু চক্রবর্তী। তিনি কলকাতা থেকে মাসে একবার ক’রে গৌরীপুরে আসতেন। কলকাতা থেকে গৌরীপুর— মাঝে, স্থানে স্থানে তাঁর প্রচুর ছাত্র। গৌরীপুরে এসে উঠতেন সুভাষ পল্লীর আকাশ সাহার বাড়িতে । দুদিন, কখনও তিনদিন পর্যন্ত থাকতেন গৌরীপুরে। আমার বড়দা ও তাঁর বন্ধুরা সকলেই একে একে তাঁর শিষ্য বনে যান।
ধুবড়ির পণ্ডিত বিহারীলাল প্রসাদের কথা আগেই বলেছি একটু। জেলার বিভিন্ন স্থানে আসা-যাওয়ার পথে প্রায়ই ঢুকে পড়তেন আমাদের বাড়ি। রাগসঙ্গীত ছাড়া আর কিছু চিনতেন না। একদিন এলেন তাঁর বড় পুত্র নন্দু— পরে যিনি পরিচিতি লাভ করবেন পণ্ডিত ব্রিজ কিশোর প্রসাদ নামে। মনে আছে, বাড়ির মস্ত উঠোনে আমরা বন্ধুরা মিলে জম্বুরা দিয়ে ফুটবল খেলছিলাম সেদিন দুপুরবেলায়। কানে আসছিল তবলা লহড়ার তুমুল আওয়াজ। খেলা থামিয়ে ছুটে গেলাম সবাই। ঘরে ঢুকে দেখি কুড়ি-বাইশ বছর বয়সের শ্যামবর্ণ একটি ছেলে তবলায় বসেছে। তীব্র গতির বাদন, তাঁর হাতের আঙুল প্রায় দেখাই যাচ্ছে না। তবলায় একপ্রকার যেন ঝড় তুলে দিয়েছেন। সেই আমার অবাক হয়ে তবলা শোনা। এভাবেও কেউ তবলা বাজাতে পারে! বাক্স্ফূর্তি হচ্ছিল না। এভাবেই দিন চলে যাচ্ছিল আমাদের।
এর কিছুদিন পরেই শান্ত, সমাহিত এই অঞ্চলে ‘আলু’ নামে একটা অদ্ভুত রোগ এল। সে রোগের ঠ্যালায় মানুষের গান, ভান সবই প্রায় চলে যাবার জোগাড়।
অদ্ভুত রোগ কেন— সেটা পরে বলছি। আনন্দবাজার পত্রিকা সম্ভবত এ নিয়ে একটা হেডলাইনও করেছিল— ‘কোচবিহার রোগ’। দু-চারদিনের মধ্যেই সমগ্র উত্তরবঙ্গ ও আসামের পুরোনো গোয়ালপাড়া জেলায় এই রোগ দ্রুত টাইফুনের মতো ছড়িয়ে পড়তে শুরু করল। ভারতব্যাপী গণেশ ঠাকুরের দুগ্ধপানের ঘটনাটিরও বহু আগের কথা। পাথরের মূর্তির দুগ্ধপানের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যায় ‘সারফেস টেনশন’ প্রভৃতির কথা পরে জেনেছিলাম। সেটা ছিল অন্য ব্যাপার, কোনও রোগ নয়। বিপরীত পক্ষে, এটা ছিল রোগ— এবং সন্দেহ নেই, মনোরোগ— মাস হিস্টিরিয়া। মানসিক রোগের শারীরিক উপসর্গ থাকেই এবং এ রোগের ক্ষেত্রেও প্রবল ভাবে তা দেখা দিচ্ছিল। মনের সাথে দেহের কী গভীর সম্পর্ক। অবশ্য তখন এ বিষয়টা কেউ তলিয়ে দেখছিল না— ফলে একটা গুজব মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়েছিল বিশাল এক অঞ্চলে। তখনকার দিনে সোশ্যাল মিডিয়া ছিল না, তবে অল পাওয়ারফুল গুজব ছিল।
অদ্ভুত শারীরিক উপসর্গ নিয়ে হঠাৎ রাস্তায়, ঘাটে লোকেরা বসে পড়ছিল, ভয়ে চিৎকার করছিল, গোঙাচ্ছিল আর চারপাশ থেকে চেনা-অচেনা লোকজন ছুটে এসে সে লোকের মাথায় ঢালতে শুরু করছিল বালতি বালতি জল। যেখানে জলের ব্যবস্থা নেই, পাতকুয়ো বা পুকুর থেকে পাইপ দিয়ে সাইফোনিং করে টেনে নিয়ে আক্রান্তর মাথায় ঢালা জল। আমরা দাঁড়িয়ে দেখতাম, আক্রান্ত তাঁর একহাত লুঙ্গির ভিতরে চালান ক’রে অণ্ডকোষ চিপে ধরে মাথা নিচু ক’রে বসে আছে। ব্যাপার কী! অণ্ডকোষে ব্যথা? তাহলে মাথায় কেন জল ঢালা! আর চারপাশের লোকেরা, দেখছি, হয়ত সারি পেতে দাঁড়িয়ে জল বয়ে আনছে মহামায়ার মাঠের নাতিদূরস্থ কুয়ো থেকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় দীর্ঘদিন মিলিটারি ক্যাম্প ছিল এই মাঠে। তখন দু-দুটো কুয়ো খনন করা হয়েছিল— লাল রঙ, সিমেন্টের বাঁধানো পৈঠা। দীর্ঘদিন যাবৎ অব্যবহৃত, ফলে ঘোলা, নোংরা, বিষাক্ত জল— সেই জলই ঢালা হচ্ছিল হিস্টিরিয়াগ্রস্ত রোগীদের মাথায়।
দেখলে মনে হবে যেন আগুন লেগেছে কোথাও। কানাঘুষো শুনতে পেলাম এ রোগে নাকি পুরুষের অণ্ডকোষ হারিয়ে যায়— অর্থাৎ ভেতরে ঢুকে যায়। আশ্চর্য তো! আপাতপ্রবল পুরুষতন্ত্র কতো দুর্বল আসলে— ভেতরে ভেতরে ভঙ্গুর— সামান্য গুজবেই যা হারিয়ে যেতে পারে। বাইরে বড় বড় দাঁত, নখ ও নখর, কিন্তু ভিতরে ভয়, বিকার, পঙ্গুত্ব। আমরা সব বন্ধুরা হাফপ্যান্ট-স্যান্ডো গেঞ্জি পরে মাঠে-ঘাটে রুগি দেখে বেড়াই। মজাই পেতাম এসব দেখে।
পণ্ডিত বিহারী লাল সেদিন বাড়িতে এসেছেন ফেরার পথে। সবে গান ধরেছেন একটা। আলাপ চলছে। এরই মধ্যে কিছু লোককে আমাদের বাড়ির কুয়ো থেকে বলা নেই কওয়া নেই বালতি বালতি জল নিয়ে দৌড়ে যেতে দেখা গেল এক অবনত মস্তক, লুঙ্গি-পরিহিতর দিকে।
এদিকে অমন গভীর গানে বাধা পড়ে যাচ্ছে। হৈ হৈ হৈ হৈ চারদিকে। আমরাও কিছুটা বিচলিত।
পণ্ডিতজি গান থামিয়ে বলে উঠলেন— ইয়ে কোই বিমারি নেহি, মনকা বহম হ্যায়…
গানা গাও। ডুব যাও। মন কা বিমারি, বহম সব ভাগ যায় গা।
কে একজন তর্ক জুড়ে দিল। তাঁর মতে, মনের রোগ নয়, এটা নাকি আসলেই রোগ। পণ্ডিতজি শুধু গান নিয়ে থাকেন, তাই বুঝবেন না। কী একটা খারাপ হাওয়া এসেছে। পেপারেও নাকি লিখেছে।
পুরুষেরা মনে মনে কী সব ভাবছে, মানে মনের ‘বহম’-ই তো, আর সাথে সাথেই তাঁদের জননাঙ্গ আক্রান্ত হচ্ছে। আশ্চর্য রোগ, আশ্চর্য সময়।
পণ্ডিতজি সে লোকের কথা শুনে আকাশের দিকে মুখ তুলে তখন হাসছেন শিশুর মতো:
দুখ দে কর ভি সওয়াল করতে হো
তুমি ভি গালিব কেয়া কমাল করতে হো
Nicely depicted. 👍
Thanks