স্কুলবাড়িটার ভিতরে ছোট ছোট ক্লাশরুম। কোনও কোনোটায় আবার চাটাইয়ের বেড়া। মেঝেতে মাদুর পাতা, নীচে পুরু পোয়াল বিছানো। পোয়াল মানে খড় বা বিচালি। স্কুলবাড়িটার ভেতরে ঢুকে তো পড়েছি, কিন্তু তখনও আমার চোখে একগাদা ঘুম লেপ্টে রয়েছে। একটি রুম বড়দের একটি দল দখল করেছে। সেখানে ছোটদের প্রবেশ নিষিদ্ধ।
ঘুম ঘুম চোখে রতনদার পাশে গিয়ে বসে পড়লাম। রতনদা খুব আমোদপ্রিয়, মজার মানুষ, বিশেষ ক’রে ছোটদের মধ্যে খুব জনপ্রিয়। আমার দুই দাদাও বসে পড়েছে দেখলাম ইতোমধ্যে। বড়দের জন্য রয়েছে আলাদা রুমের ব্যবস্থা। বাঁশের বেড়ার ফাঁক দিয়ে দেখলাম সে ঘরে তাস পেটানোর আয়োজন চলছে রীতিমতো। আরেকটি বড় হলঘরের মতো ছিল। সে ঘরে ধবধবে পাশবালিশে মাথা এলিয়ে, এক পায়ের ওপর আরেক পা তুলে, শুয়ে শুয়ে ইংরেজি পেপার পড়তে শুরু করেছিলেন পান্ডে স্যার— ইংরেজির অধ্যাপক গৌরীশংকর পান্ডে। তাঁর ডান পাশে বসে ছিলেন জনজাতীয় অবয়বের এক অচেনা মানুষ— সবাই যাকে ‘বন্ধু’ বলে সম্বোধন করছিল। সে যে কার বন্ধু, কেন বন্ধু, কবে থেকে বন্ধু বুঝলাম না। এমনও হতে পারে তার নামই ছিল ‘বন্ধু’। সবাই তাকে ডাকছিল ওই নামে— শুধু ‘বন্ধু’ বলে— সাথে দাদা বা কাকা কিছু নেই। ভালোবাসার ডাক যেমনই হোক, তাতে শ্রদ্ধার অভাব থাকে না। আমরা ছোটরাও খুব হাসছিলাম তাঁর চালচলন, কথাবার্তা আর হাবভাবে। ‘বন্ধু’ বলে ভাবছিলাম, ‘বন্ধু’ সম্বোধনে ডাকছিলাম তাঁকে। একটা ব্যাপার ছিল লক্ষনীয়— অদ্ভুত আদব-কায়দা আর সদাহাস্যময়তার জন্য সকলের মন তিনি জয় করে নিয়েছিলেন মুহূর্তেই।
‘বন্ধু’— ভদ্রলোক ছিলেন খুবই রগুড়ে, কথায় কথায় ‘হুইস্’ বলেই তুমুল হাসিতে ফেটে পড়ছিলেন। আর হাসতে হাসতে প্রায় বসেই পড়ছিলেন মেঝেতে। আরেজন ছিলেন, স্যাদলা ধরা দাঁত সমসময় বেরিয়ে আছে, এরকম। সম্ভবত তাঁর পদবী ছিল শীল। হাটুর ওপর ধুতি, কথায় কথায় হাসছিলেন তিনিও আর মাঝে মাঝে দুচারটি ইংরেজি বাক্যাংশও তাঁর স্যাদলা ধরা দাঁতের ফাঁকফোকর দিয়ে বেরোচ্ছিল। এই যেমন ‘সো হোয়াট’, ‘হোয়াট নেক্সট’। বুঝলাম গড়গড় ক’রে ইংরেজি বলতে অক্ষম হলে এরকম খুচরো ইংরেজি মানি পার্সে রাখা ভালো। তাতে ইজ্জত বাড়ে, অন্যের সম্ভ্রম আদায় করা সহজ হয়। স্যাদলা ধরা দাঁতের সেজন হয়তো একটু ‘কারণ’ও গিলে থাকবেন। বড় হয়ে সত্যি সত্যিই আমার মনে হয়েছে অনেকদিন, ইংরেজি গড়গড় ক’রে বলতে পারার একটা বড় কারণ হচ্ছে ‘কারণ’। দেখেছি সে জিনিস পেটে পড়লে ইংরেজি ফেটে বের হয়, গলগল ক’রে। মাঝে মাঝেই তিনি সাহেবি কায়দায় বলে উঠছিলেন— হু’ইল বেল দ্য ক্যাট, হু’ইল বেল দ্য ক্যাট। ক্যাট তো বেড়াল, তবে কোন বেড়াল, কী বেড়াল, কেনই বা বেড়াল, কে ঘণ্টা বাঁধতে চাইছে, কে সেটা পারছে না— সেসব কিছুই জানার উপায় ছিল না, অবকাশও ছিল না। চেষ্টাও করিনি অবশ্য। তবে এক বন্ধু শেষে বেড়ালের রহস্য উদঘাটন করতে সক্ষম হয়। যা জানা গেল, বেড়াল হচ্ছে বিলিতি মাল, যা খুব সহজলভ্য ছিল না সে যুগে। কর্মকার পদবীর একজনের সে বিষয়ে কিছু গবেষণা ছিল হয়ত— যে জান বুঝহ সন্ধান। তিনি প্রতিবার হাত তুলে তার সক্ষমতা জানাচ্ছিলেন, মানে, তিনিই পারবেন ঘণ্টা বাঁধতে। সে কালে ওয়াইন শপের কাউন্টারে গিয়ে দাঁড়ানোটা অনেকের জন্যই ছিল রীতিমতো অস্বস্তিকর। আর এখন তো ডালভাত।
আমার তখন হৈ-হুল্লোড়ে চোখভর্তি ঘুম টুটে যাবার জোগাড়। তবে সে পরিবেশে আকস্মিকভাবে উচ্চারিত এ ধরণের কথাগুলো ছিল তাৎক্ষনিকভাবে অতীব আনন্দদায়ক। পিকনিক পার্টিতে যে যেভাবে আনন্দ পায় নেবে। সেটা সেকালেই রীতিতে পরিণত হয়ে গিয়েছিল।
কারুর কারুর হাতে, লক্ষ করছিলাম, মারফি রেডিও, ৫০৫.৫২ মিটারে বাজছে— বাংলা গান। অনেকেই ছিলেন যাঁদের চিনি, বাবার বন্ধু বা বন্ধুস্থানীয়। তাদের মধ্যে বিশেষ একজন আমার মনে প্রবল ছাপ ফেলেছিল, যাঁর প্রকৃত নাম আমার বা আমাদের কারুরই জানা ছিল না। জানা ছিল না, কারণ জানার তো প্রয়োজনই হয়নি। প্রয়োজন হয়নি, কারণ তাঁর তো অন্যরকম একটা নাম আগে থেকেই ছিল আমাদের কিশোর-কিশোরী মহলে। আড়ালে-আবডালে তাঁকে আমরা চোখ টেপাটেপি ক’রে ডাকতাম ‘শেয়ালে-খাওয়া বুড়ো’। এখানে বলে রাখি, এই ‘শেয়ালে-খাওয়া বুড়ো’ আমাকে দীর্ঘদিন ধরে হন্ট করেছে, এমনকি পরবর্তী জীবনেও। ছোটগল্পও লিখেছিলাম একটা— ‘আমি এবং আমি’— এই শিরোনামে, যে গল্প পড়ে প্রখ্যাত গল্পকার শেখর দাশ একদিন ফোন করেছিলেন আমায়। সে যাই হোক, লোকটার গায়ের রঙ ছিল মিশমিশে কালো, তার ওপর, মুখের ডানদিকটা ছিল ভীষণ রকম বিকৃত— কোঁচকানো চামড়া, খোবলানো মাংস ঝুলে আছে যেন। বড়দের মুখে শুনেছি, ছোটবেলায় নাকি তাঁর মুখের অর্ধেকটায় ছুঁচালো দাঁত বসিয়ে মাংস তুলে নিয়েছিল পল্লীগ্রামের শেয়াল। বুড়ো বলে ডাকলেও আদতে মানুষটা ততোটা বুড়োও কিন্তু ছিলেন না। বয়স ৫৫-৫৬-ই বড়জোর, তাঁর বেশি কোনোমতেই নয়। কম কথা বলেন, হাসেন আরও কম— আর কথা বললে, কদাচিত যদি হাসেনও, লক্ষ করেছি, মুখটা কেমন বেঁকে যায়।
ভদ্রলোককে চিনতাম আগে থেকেই। তবে পারতপক্ষে কাছে ঘেঁসতাম না। বাড়িতে ঢোকা দেখলেই দূরে পালিয়ে যেতাম। তিনি লক্ষ করলেও কিছু বলতেন না মুখে।
ছোটবেলা মানেই তো নানা রকমের ভয়। ছোটবেলা পাগলকে ভয় পায়, হেলমেটধারী পুলিশ বা সেনাকে ভয় পায়, বেতহস্ত শিক্ষকের রক্তচক্ষুকে ভয় পায় আর সর্বোপরি ভয় পায় অন্ধকারকে। যা কিছু অচেনা, অজানা তাই আসলে অন্ধকার। ছোটদের ভয়গুলিকে বড়রা তেমন ভয় পায় না, যেমন বড়দের ভয়গুলিকেও মোটেও ভয় পায় না ছোটরা। বেকন লিখেছিলেন— “Men fear death as children fear to go in the dark”… ছোটদের অন্ধকারভীতি যেমন, তেমনই বড়দের মৃত্যুভয়। মৃত্যুও অন্ধকারই তো আসলে, তবে অন্ধকারে ভয় পেলেও ছোটরা কিন্তু মৃত্যুভয় জানে না। জীবনের এতো প্রাণপ্রাচুর্য যেখানে— মৃত্যুর সেখানে একপ্রকার প্রবেশাধিকারই থাকে না, বলতে গেলে। তারপরও হয়ত অনধিকার প্রবেশ করে মৃত্যু— তবে সে মৃত্যু নিজেই মলিন— তার কোনও গরিমা নেই। হয়ত একটা গল্প রেখে যায়, পেছনে। এইটুকুই।
‘শেয়ালে খাওয়া বুড়ো’কে আমরা ভয় পেতাম। যদিও তাঁর কাঁধে ঝোলানো ব্যাগে ভালো ভালো বই থাকত। ক্রিস্টোফার ইসারউডের ‘রামকৃষ্ণ অ্যান্ড হিজ ডিসাইপলস্’ বের করে আমাদের বহির্মহলের ঘরে একদিন তাঁকে একমনে পড়তেও দেখেছি। ভাল মানুষ, সন্দেহ নেই। শুধু মুখের একদিকটা ক্ষতবিক্ষত, এই যা। বাবাকেও দেখেছি মুগ্ধ হয়ে তাঁর কথা শুনতে, তাঁর কাছ থেকে বই চেয়ে নিয়ে পড়তে।
কিন্তু তখন কি আর অতশত বুঝি?
ভয়টা মনে গেঁথে গিয়েছিল আমাদের।
ছোটবেলায় অস্বাভাবিক কিছু নজরে পড়লে যা হয়। অস্বাভাবিকতাও এক ধরণের অন্ধকারই তো, যদিও অন্ধকার কিন্তু খুব স্বাভাবিক ঘটনা জীবন ও জগতে। পরিণত বয়স অবশ্য অন্যরকম। সব বিষয়কেই তখন র্যাসনালাইজ করে দেখার ক্ষমতা জন্মায়। তুচ্ছাতিতুচ্ছ বিষয়ে তখন মনে আর অহেতুক ভয় থাকে না।
শেয়ালে খাওয়া বুড়ো, হাতে সিগারেট, আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। কেউ নেই সেখানে, শুধু একটা এবড়ো খেবড়ো রাস্তা, নিঝুম পড়ে আছে। তাঁর হাতে সিগারেটের আলো, ঝিমোচ্ছে। একটু আড়াল খুঁজে হিসু করতে গিয়েছিলাম, তাও ভয় ভয় ক’রে। আড়ালও একরকম অন্ধকার… তার ওপর যদি আবার হাতছানি দিয়ে ডাকে জীবনের অজানা, অচেনা দিগন্ত! কী হবে! সে যাই হোক, বুক দুরুদুরু, কাছে গেলাম। তিনি আধখাওয়া সিগারেটটা ছুঁড়ে ফেলে দিলেন দূরে—
“আমারে কি তোমার ভয় লাগে, খোকা?”
কী মায়াবী, স্নেহময় স্বর! তবুও আমার পা কাঁপছিল। তাঁর হয়ত সেটা চোখেও পড়ে গিয়েছিল। কিন্তু তিনি স্নেহভরে আমার মাথায়, চুলে হাত বোলাতে লাগলেন। হাতটা নরম আর উষ্ণ।
“আগে আমার নিজের ছেইলেডাও আমারে দেখলে ভয় পাইতো। অখন, বড় হইছে, তাই আর পায় না। আসো, তোমারে ভয়কে জয় করার একখান মন্ত্র শিখায়া দেই। শুনো, ভয়রে জানলে আর ভয় থাকে না। ভয়রে জানার চেষ্টা কইরো। দেখবা, ভয় লেজ গুটাইয়া পলায়া যাইবো। মনে থাকবো তো, কথাডা?”
মাথা নাড়ালাম যন্ত্রের মতো। কিছু দেখলেন কিনা জানি না। তবে তখনও তিনি বলেই যাচ্ছিলেন একনাগাড়ে।
“যখন ছোট আছিলাম, আমার মুখখানের অর্ধেকডা শিয়ালে খাইছিল। তাই তোমরা ভয় করো। বড় হইয়া দেখবা এক এক কইরা জীবনডারে কতো জানোয়ারে খায়— কেউ পাঁজরা খায়, কেউ হাড়, কেউ নাড়িভুঁড়ি। সব খাওয়া কি আর চোখে দেখা যায়, খোকা! কিন্তু আমি তো বাইচ্চা আছি অখনো, মরি তো নাই!”
আমি অবাক হয়ে শুনছি তাঁর কথাগুলো। কান খাঁড়া হয়ে গেছে। আর ভয়ও লাগছে না একদম। এরকম কথা তো কোনোদিন শুনিনি, আগে কেউ বলেওনি। ছোটদের কেউ বলেও না, বোধহয়।
“শুনো, একখান কথা কই— কুনোদিন কিছুরে ভয় খাইও না। মানুষরে মারে তার ভয়।”
বলেই তিনি দ্রুতপায়ে চলে গেলেন কোথায়। এদিকে দাঁড়িয়ে আছি একা, ঈষৎ অন্ধকারে। কিন্তু মনে হচ্ছিল, সব অন্ধকার যেন নিমেষে আলো হয়ে গেছে।
হিসু করবার কথা ছিল। ভুলে গেছি। সব ব্যথা, বেগ, চাপ কী এক ম্যাজিকে নিমেষে ভ্যানিশ।
আমার মনের ভিতর আলো হচ্ছে, কানের ভিতরে বারবার বেজেই চলেছে অন্ধকারের, অজানার শেষ কথাগুলো— মানুষরে মারে তার ভয়, মানুষরে মারে তার ভয়…
আগে একটা পর্ব পড়েছি l খুব ভালো লেখা l শুভেচ্ছা লেখককে l
সুন্দর ঝকঝকে লেখা। অভিনন্দন জানাই।🙏❤️