“রাত কত হল? উত্তর মেলে না।” সুবর্ণরেখা ছবিতে বীণার তারে আঙুল চালিয়ে, অমোঘ অনুরণন তুলে ঈশ্বর চক্রবর্তী যখন মৃত্যুর তোড়জোড় করছিলেন, জানালা দিয়ে উঁকি মেরে হরপ্রসাদের এই ভীষণ উক্তি। এখন এই মধ্যরাত্রি পার করে, যখন, আমার ইয়ার বাড থেকে মন্দ গৎ সিতারখানি, নিখিল ব্যানার্জির সেতার চুইয়ে পড়ছে, ঠিক তখনই এই মোক্ষম কথাটি বেজে ওঠে এই শহরে ছড়িয়ে পড়ল।
রাত কতটুকু হল? আর কত বাকি? উত্তর কার কাছে? কমই হবে, জীবনের বেশি অংশ তো পার করে এসেছি। এই চলার লাচাড়ি বা ত্রিপদী, কার কোন কাজে লাগবে, চিবুকে হাত রেখে ভাবতেই হচ্ছে। এই পৃথিবীতে এই পর্যন্ত যত লেখা হয়েছে, এরপরও কি কিছু লেখার আছে? কখনো মনে হয়, নেই, আবার মনে হয়, জীবন তো গড়ায়, আর সৃষ্টির কোন শেষ নেই। হয়তো আছে। নাহলে, ম্যাকবেথের পর ইউলিসিস হতো না। এলিয়টের পর অক্টাভিও পাজ।
তবে সকলসময় আমার নিজেকে নিয়েই সংশয়। কী ই বা আছে এই জীবনে, ক্ষণজন্ম, ফাঁকা যাপন। কোন কিছুই নেই। সকলেরই যেমন অনুল্লেখনীয় গল্প আছে। আমার গল্প ওই সকলের মতো। এখন রাত কত হইল? অনেক, না, গভীর? ঘুম কেড়েছে কে? যারা চলে গেছে আমাকে একা ফেলে, না, রাতের পরিমাপ? ব্যালকনির মানিপ্ল্যান্ট কি আমার দিকে ঝুঁকে, আমার মনের ভেতর যে মন্দ গৎ, সেটা বুঝতে চাইছে?
সুনসান সড়ক। তবুও কিছু মানুষ ঘুরে বেড়ায়। ওদের বাড়িঘর নেই! কী খোঁজে, পরশপাথর! সেই অন্বেষনের ভাগ আমারো চাই। কুয়াশা নামছে চুইয়ে। দুজন লোক, আগুন ঘিরে বসে রয়েছে। নিখিল ব্যানার্জির বাদন শেষ। এখন একটু ডেভিড গিলমোরের কাছে যাই, কমফোরটেবলি নাম্ব। হঠাৎ বোবা সব, অসাড়, স্থবির। এই রাত, মানিপ্ল্যান্ট, সড়ক, শহর, একাকী মানুষ, আমি। উত্তর মেলে না। ওই মানুষটির গল্প পড়ব, যে এই রাতে খুঁজছে কী যেন। ওই দুইজনের গল্প শুনব, আগুনকে ঘিরে উত্তাপ নিচ্ছে, কীসের উত্তাপ, জীবনের! ভালোবাসার! আমার গল্প কী ওদের মতো, একটু? ছিরিছাঁদ নেই, বা বলার মতো কোন কাহিনি নেই।
উইশ, ইউ ওয়ার হিয়ার, সবচাইতে ডিপ্রেসিং পঙক্তি। বিষাদও, ভালোবাসার গভীর খাদও। ভালোবাসা, তোর জোর কত? তুই কি ধ্বংসের সংকেত? না-হলে পোড়ে কেন ট্রয় নগরী, কেন ক্লিওপেট্রা গরল নেন শরীরে, সীজার, না অ্যান্থনি? আবার ফিরি, দেখি, এক বিকলাঙ্গকে রাস্তা পার করাচ্ছে একটি বালক। দেখি, ভ্রমর এসে বসেছে ফুলে, দেখি, প্রথম বৃষ্টিপাত হৃদয় ভরে নিচ্ছে তৃষিত মাটি। দেখি আকাশের বাদল দেখে স্বর্গীয় হাসি কৃষকের মুখমণ্ডল জুড়ে। আরো কত কত অমোঘ, কত দীর্ঘশ্বাস, চোখ ভেজানো জল, বুকে জমা কষ্টের দলা, একটি জীবন গড়ায়। প্রশ্ন একটাই, রাত কত হইল!
যে জীবন নিয়ে সাতকাহন ফাঁদতে বসেছি, সে অন্যরকমও হতে পারত। পম্পেই নগরী। আহ নেপলস্ ভিসুভিয়াসের এক ছোবলে শেষ। অনেক অনেক দিন পরে, সেই ধ্বংসাবশেষের শূন্য করতালির ভেতর, ধ্বনিহীনতার ভেতর, অতিকায় নিঃশব্দতার ভেতর ইকোস, গিটারের হামিং। আর কেউ নেই, আমি ও বন্ধু কজন। সুর প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে। মৃত মানুষেরা অলক্ষ্যে জাগে।জাগে প্রহর, জাগে প্রাচীন শতাব্দীর প্রবাহসকল।দেবদূতেরা এসে বসে পড়ে এদিক ওদিক। ঈশ্বরও আমোদিত হন। পৃথিবী মুড়ে যায় সুরের ধ্বনি, প্রতিধ্বনিতে।
একটি জীবন হতে পারত, অপেরা গায়ক। অপেরা হাউজে দাঁড়িয়ে যখন স্বরক্ষেপে বিদীর্ণ করতাম পৃথিবীর বুক, ঠিক তখন তুমি, তুমি প্রিয়তমা, কার্লি স্টেপ কাট ব্লোন্ডি চুল, নীল চোখ, লাল দস্তানা, লাল গাউন, পরে মুগ্ধতার দৃষ্টির তীক্ষ্ণ অব্যর্থ তির হানতে আমার হৃদয়ের মাঝখানে। হৃদয় থেকে ফিনকি দিয়ে বেরোত, ভালোবাসার রক্তলাল পাঁপড়িসকল। একটি জীবন হতে পারত বাউলগান, দেহতত্বের আবেশে। দিন গুজরানোর পর, আকাশ থেকে নেমে আসত একমুঠো চাল, খানিকটা ডাল, নুন, দুএকটা পটল, আলু। জগাখিচুড়ি হতো বেশ স্বাদু, আর গান, হৃদয় খুলে খুলে, দেহ ছিঁড়ে ছিঁড়ে।
একটি জীবন হতে পারত শক্তির কবিতার পঙক্তি। ‘রঙের সমুদ্রে ব্রেস্ট স্ট্রোক দিতে দিতে ভেসে যাব, একা সাফল্যে সুদূরে।’ রং, ভীষণ ছোট্ট অথচ তার গভীরতার পরিমাপ অসাধ্য। আমাদের এই পৃথিবীর রং নীল, আকাশের, বেদনারও, গরলেরও গাঢ় নীল। রক্তরাঙা গোলাপ, হৃদয়ের গভীর আনন্দের ক্ষত, হলুদ, মায়ের করুণ হাতে লেগে চমৎকার সংসারছবি। গোলাপি, মেয়েটির প্রথম প্রেমের লজ্জার গাল। গখ, পিকাসো, লুত্রেকের মতো রঙের ভেতর ব্রেস্ট স্ট্রোকের অবিরাম সন্তরনের জীবন।
একটি জীবন হতে পারতো বোহেমিয়ান। পায়ের তলায় সর্ষে নিয়ে ছিটকে গড়ানো এই পৃথিবীর বুকে। ভোকাট্টা ঘুড়ির মতো দিশাহীন দুলতে দুলতে যাওয়া। কোন গন্তব্য নেই। যেখানে খুশি, সব গাছের ছায়ায় আমার বাড়ি। আজ এখানে পা, তো কাল অন্য কোথাও ঘুম।কখনো কুয়াশা মেখে পাহাড়ের চড়াই উৎরাই, কখনো অরণ্যের রহস্যময় সবুজের অন্দরে, কখনো এক নির্জন দ্বীপে। কখনো হিমালয়ের শৃঙ্গদের সঙ্গে অতীব প্রণয়।
একটি জীবন হতে পারত স্টিভ ম্যাকুইন, আলপাচিনো, ডিকাপ্রিও। হারলি ডেভিডসনে গ্রেট এসকেপ, ড্রাগ লর্ডের অন্যরকম ছেলে। থ্রিলের জীবন।ডায়মন্ড ইন ব্লাড পেতে গিয়ে সেই নারী, যাকে এগিয়ে আসা মৃত্যুকে স্পষ্ট দেখতে পেয়ে, জীবনের অন্তিম মুহূর্তে বলা যেতেই পারে বুকে দীর্ঘকাল লালিত সেই অমোঘ উচ্চারণ, পৃথিবী এখনো কত কত সুন্দর যার জন্যে, সেই গভীর ভালোবাসার কথা, সহজভাবে, ‘আই আ্যম হ্যাপি, আই মিট ইউ।’
আরো আরো কতো না জীবন, সহস্র জীবন, লক্ষ জীবন, লক্ষাধিক জীবন ছড়ানো, চরাচরে। টুক করে সেইসব অজস্র জীবনের যেকোনো একটা জীবনের গল্পে ঢুকে পড়ে বেশ হাত পা ছুঁড়ে আরাম করতে পারতাম।আরাম! একটি কাহিনি মনে পড়ছে।
একটি লোক, সাগরের তিরে ছায়ার নিচে বসে মনের আনন্দে সিগারেট টানছে। দোহারা গড়ন, সাদামাটা পরিধেয়। না-আঁচড়ানো চুল, খোঁচা খোঁচা দাড়ি। সিগারেটে একেকটা টান দেয়, আর আবেশে চোখ বুজে আসে। এক ভদ্রলোক, তাকে ওই অবস্থায় দেখতে পেয়ে বললেন, ‘আপনি এরকম মিছে সময় নষ্ট না-করে আরো কাজ করতে পারতেন।’ সেই লোকটা ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তারপর?’ ভদ্রলোক বললেন, ‘যত কাজ করবেন, তত উন্নতি, ততটাই পয়সা।’ আবার সেই একই জিজ্ঞাসা, ‘তারপর?’ ‘তখন তো আপনার অনেক টাকা পয়সা হয়ে যাবে। আর কোন চিন্তা থাকবে না। হাত পা ছড়িয়ে আরাম করবেন।’ সেই লোকটা তখন ভদ্রলোকের দিকে চরম বিস্ময়ে তাকিয়ে বললেন, ‘তো এখন কী করছি? এখনও তো আরামই করছি।’ এরকম সহজ সরল জীবন, হতেই পারত আমার।
ভিনসেন্ট ভ্যান গখকে প্রায়ই চলে আসেন আমার বাড়ি। ছোট্ট জীবন, ছবির জীবন। এক সুন্দর সকালে কী যে মনে হলো, এই পৃথিবীকে আমার আর দেওয়ার কিছু নেই।
বুকে রিভলবার ঠেকিয়ে জাস্ট ঘোড়াটা দাবালেন।দুহাজারেরও বেশি ছবি, যার বেশিরভাগটাই শেষ দু’বছরে আঁকা। মনে হলো, ওনার যা কাজ ছিল, সব ফুরিয়েছে। এই পৃথিবীকে দেওয়ার মতো আর কিছু নেই। এমনি এমনি বেঁচে থাকার কোন মানে হয়! চলে যাওয়াই ভালো।পৃথিবীর ভার কিছুটা হলেও কমবে। এই যে জীবন আমার, গড়ায়, সে কোন চালচুলোর জন্যে! খাও, টাইম পাস করো, ঘুমোও, ঘুম থেকে উঠে আবার সেম টু সেম। এই জীবন রাখারই কী প্রয়োজন। কিন্তু রিভলবার তো দূর অস্ত, অন্য কোন উপায়ের কথাও ভাবাই যায় না। জীবন এত প্রিয়, মায়ার সুতোয় বাঁধা।
তবু, ওই জীবনগুলি, ওই ফুল ও কাঁটার সাথসঙ্গত।ওই তীব্র বেদনা এবং গভীর ভালোবাসার দিবারাত্রি। ওই নিঃসঙ্গতার পাগলা হাওয়া, ওই সৃষ্টির শিখরের সঙ্গে করমর্দন, কী যে পাগল পাগল প্রেম, ওই প্রেমেই মরণ হোক, সৃষ্টি শেষে মৃত্যু তো অবধারিত, হোক না একটু পাগলামি। কাজ শেষ, তাই যাব। মনের খুব অন্দরে অনেক মেঘ, জলভরা, সেখানেই বৃষ্টিপাত। ভাল্লাগছে না এই আলো, হাওয়া। যাব। গেলেন তো এভাবে অনেকেই। গখ, ভ্লাদিমির, প্লাথ…।
“সেবার একটি দেশলাইয়ের বাক্স কিনতে বেরিয়ে ভুটান চলে গেসলুম।”- এর শক্তি। “পায়ের তলায় সর্ষের” সুনীল।” অরণ্যের দিনরাত্রি”-র সেই চার বন্ধু। নেশার সঙ্গে একটি জীবনের সখ্য, অথচ, সৃষ্টির চন্দ্রসূর্যতারা, সেই ঋত্বিক, মান্টো, গুরু দত্ত।
জীবন হতেই পারত, দ্যা রেভেনেন্ট-এর মতো।সারভাইবাল, শুধু বাঁচা। এরকমও তো জীবন রয়েছে কতো শত, যারা শুধু একটু বেঁচে থাকতে চাইছে! একটুখানি শ্বাসের চলাচল। হয়তো একমুঠো ভাত, একটুকরো আকাশ, ছাদ ফুঁড়ে, খানিকটা আরোগ্য। একটা লড়াই শুধু, মারাত্মক সেই যুদ্ধ, যার শেষে কোথাও বেজে উঠতে পারে কতকিছু।
একটি জীবন হিসেবে গরমিল। হতেই পারত পুবের হাওয়ার মতো নির্মল, সুন্দর। সারাদিনের দৌড়ঝাঁপ, ঘাম, টেনশন সেরে মেয়েটি যখন রাত্রির আকাশের তারাদের ডেকে ডেকে বলে, যখন সে পুরো একা, বলে, “বল তো সই, আমার জীবনেই সবকিছু কেন এত ব্যাঁকা, এত বেজোড়? আমি তো চাইনি এমন। একটুখানি ভালো থাকব বলেই তো সেই কোন সকালে বেরিয়েছি। ভালো দিলি, ভালো থাকতে তো দিলি না।
তাহলে, যে জীবনটি পেলাম, সে নিয়ে কি আমি খুশি নই? এই যে রাত, নিস্তব্ধতা, ইয়ার বাডে এখন আর আমার চয়েস নেই, নিজের ইচ্ছেমতো কী কী যেন বাজছে।পাল্টাই। অ্যানাদার ব্রিক ইন দ্যা ওয়াল।
প্রশ্ন ঘুরে ফিরে। খুশি নই? কে আমি? এক বৃহৎ ধারাবাহিকের একটি পরমাণু। সেই যে আমার পূর্বপুরুষ, গুহার ভেতর যে ওনার হাতের ছাপটি, সেই থেকে আজ, এই মুহূর্ত, তারও আগামী, যতদিন এই নীল গ্রহ, এক অতিকায় কনটিনিউয়াসের পরমাণু আমি। আমার মৃত্যু নেই। এই যে ফুরিয়ে আসছে যে জীবন, তোমার, খুশি তো তুমি, সঞ্জয়?
ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে দেখতে পেলাম, নিচে রাস্তায়, মৃত বন্ধুরা এসে দাঁড়িয়ে হাতছানি দিয়ে ডাকছে, “ওববে সঞ্জয়, আয়, আর কত? গ্লাস, জল, হুইস্কি, অরণ্য, সমুদ্র, পাহাড়, দোল দুর্গোৎসব সব তৈরি।”
জাগে কে,অন্ধকারের আলোয়?
রাইত কত হইল?
উত্তর মেলে না।
উত্তর মেলে কি?
এই অপার বাংলায়, অতীব কালো অন্ধকারের ভেতর, জীবনজোড়া এক অনিঃশেষ ভালোবাসা বয়ে যায়, যেন বসন্তের মৃদুমন্দ বাতাস, জড়ায়, জোরে জড়িয়ে ধরে, তার বাহুপাশ থেকে কোন মুক্তি নেই।
MORNING SHOWS THE DAY
খুব আন্তরিক লেখা । মন কেড়ে নেবে ।
❤️❤️❤️
অসাধারণ। মন কেড়ে নিলো।