জন্মমুহুর্ত কোনটা? মাতৃযোনির পথ দিয়ে বেরিয়ে এই আলো হাওয়া রোদ্দুরে প্রথম আলো,প্রথম বাতাসের চলাচল,শরীরময় মেখে প্রথম ক্রন্দন, টুক করে একটি পরিবারের আনন্দউচ্ছল অলিন্দে ঢুকে পড়া। কোনটা সেই মুহূর্ত? যে সময়কালে একটি শুক্রাণু, একটি ডিম্বাণুর সঙ্গে মিলিত হচ্ছে,একটি প্রাণের আবাহনে,জন্মমুহুর্ত সে কি! অথবা সেই সময়,যখন আস্তে আস্তে একটি মানবদেহ গড়ে উঠছে নিভৃতে,ধীরে,একাকী।কোন সময় ঠিক? এই যে হঠাৎ গড়ে ওঠা শিশু হৃদপিণ্ডটি কোন যেন অদৃশ্য যাদুবলে জেগে ওঠে তার কর্মটি শুরু করল,সেই সময়ই জন্মকাল?উত্তর দেবে কে? উত্তর তো মেলে না।
ঠিক কোনসময়,কোন মুহুর্তে, কোন ঋতুর আঁচলের উড়ানের ভেতরে,খুব সঙ্গোপনে আমার পিতার শুক্রাণু, মাতার ডিম্বানু কে নিষিক্ত করে এই আমি,আমি সঞ্জয়কে আবাহন করেছিল,সে-কথা তো আর সঞ্জয়ের জানার কথা নয়। একটি ঘটনা ঘটল,এক কবি যাকে দুর্ঘটনা বলেছেন,নতুন একটি প্রাণের সম্ভাবনা জাগল।
কেমন সেই প্রাণ? কে গড়ে আকার? এই যে হাত পা,মাথা,হৃদপিণ্ড, ইত্যাদি ইত্যাদি,কে বলে দেয়,ঠিক এইভাবে গড়ো।জিন,ক্রমোজম? মুখের আদল,শরীরের রং,সে তো জিনবাহিত,কিন্তু আকার? সে কি একটি বিশেষ প্ল্যান?কার? এই যে সেল,টিস্যু, একটা স্ট্রাকচার, কার পরিকল্পনা?
এইসকল সমূহ প্রশ্ন নিয়েই একটি জীবন গড়ে ওঠে,ধীরে। মাতৃগর্ভে আমার শরীর ও প্রাণ এইভাবেই আকার পাচ্ছিল,আস্তে আস্তে। এরপর এল সেই মহার্ঘ্য সময়।যেদিন আমি এই আলো হাওয়া রোদ্দুরে টুপ করে খসে পড়লাম।খসে পড়েই হয়ে গেলাম সিলেটি বাঙালি।
” আঁধার-অপসৃত পটভূমি কেবল সেই রক্তগোলাপ
আর ওই তাপস শিশু বিস্ময় আর পূজা আর একাগ্রতা–
বেজে উঠছে প্রথম ছন্দ।”
এই এসে যাওয়ার পূর্বে একটি কাহিনি রয়েছে।এক অপরাধবোধ। সারভাইবাল এর সেই রেভেনেন্ট,সেই কাস্ট এওয়ে এসেছিল কি সেদিন? ডারউইনের,সারভাইবাল অফ দ্যা ফিটেস্ট? কেন আমার প্রতিটি জন্মদিনে, কেক-এর ওপর দু’ফোঁটা অশ্রু পড়ে।উৎসবের ভেতর,মৃত্যুর পালকও ওড়ে বেড়ায়।কেউ জানে না।জানি আমি।
আমার পিতার দুইটি শুক্রাণু, মায়ের দুটি ডিম্বানুর সঙ্গে মিলিত হয়ে,অথবা মায়ের নিষিক্ত হওয়া ডিম্বানুই দু’ভাগ হয়ে আমরা দুই সহোদর ছিলাম,মাতৃগর্ভে।সেভাবে দেখতে গেলে, আমি একা ছিলাম না তো সেই মুহূর্তে। দোসর ছিল,বন্ধু ছিল,ভাই ছিল।আর নাড়ি? দুটো।একই প্ল্যাসেন্টায় আলাদা দুটি ব্যাগে না একই থলেতে আমরা দুজন,এই রহস্যের কিনারা,সেইসময়ের রিপোর্ট এবং ডাক্তারের কাছে,যা এইসময়ে চলে গেছে বিস্মৃতির আড়ালে।প্রয়োজনও নেই জানার।শুধু শিরোনাম হিসেবে এটাই বলা চলে,আমরা ছিলাম টুইনস্।
আমরা হতে পারতাম,নকুল সহদেব।হতে পারতাম অশ্বিনী ভ্রাতা।হতে পারতাম রমুলাস আর রেমাস। জুড়য়া সিনেমার দুই সলমন খান।প্রায় যদি একই চেহারার হতাম,একটু হলেও কনফিউশন থাকত।একজনের দুষ্টুমির শাস্তি অন্যজন পেত।একজনের প্রেমিকা যদি আরেকজনের হাত ধরত! কী কেলেঙ্কারিই হতো তা না হলে।
তবে তার আর প্রয়োজন হয়নি। মাতৃগর্ভ থেকে আমি এই সঞ্জয় একাই এই পৃথিবীতে পা রেখেছিলাম।সেও উইথ দ্যা হেল্প অফ আ্য সিজার।হ্যাঁ, আমি ছিলাম সিজারিয়ান বেবি।এখন ফরসেপ ডেলিভারি, সিজারিয়ান অপারেশন দুধভাত হয়ে গেছে।সন্তান জন্মানোর হরেকরকম ব্যবস্থাপনা।আই ভি এফ দিয়ে টেস্ট টিউব বেবির দিন আমরা সেই কবেই পেরিয়ে এসেছি। এখন তো আবার সারোগেট মাদারের জমানা।আমি যখন জন্মালাম,লোকে বোধহয়,সিজারিয়ান অপারেশন শুনলেই,”ওমা!” বলে আঁতকে উঠত।স্রেফ ধাই দিয়ে আঁতুড় ঘরে কত যে প্রসব করানো হতো একসময়!
এন্টারটেইনমেন্ট হিসেবে, সেটা তখন কত বড় ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল,সে আমি বলতে পারব না,কিন্তু অনেক বাড়িতেই,বাড়ির গৃহিণী ফি বছরই একটা করে সন্তান জন্ম দিতেন। দু একটি আবার মারাও যেত।আমার বাবারা পাঁচ বোন ও তিন ভাই ছিলেন। কেউ মারা গেছে কি না, আমার জানা নেই।
ফিরে যাই সেই সারভাইবালের কাহিনিতে।দুই সহোদর ছিলাম মাতৃগর্ভে, সে,আগেই বলেছি।আমার জন্ম না হওয়া, যদি প্রসবকালকেই জন্ম বলে ধরে নিই; সেই ভাই মৃত ছিল প্রসবকালীন। ওর কণ্ঠকে জড়িয়েছিল নাড়ির কঠিন ফাঁস। এতটাই তীব্র ছিল যে ভাই আর শ্বাস নিতেই পারল না।বন্ধ হয়ে গেল হৃদস্পন্দন,রক্তের,শ্বাসের চলাচল।একটি প্রাণ যখন নিভৃতে গড়ে উঠছিল, এক দীর্ঘ যাপনের প্রস্তুতি নিচ্ছিল, পথ চলার পূর্বেই সে মিলিয়ে গেল অনন্তে।ফিরে গেল সেই দেশে, যেখান থেকে সে ক’দিনের জন্য বেড়াতে এসেছিল।
আমাকে একা রেখে গেল কেন! কেন আমার পাশে থাকল না এই একটি মাত্র জীবনে?অভিমান করে চলে গেল,না কি বুঝেছিল যে,একজন,একজনই দাবিদার এই আলো হাওয়া রোদ্দুরের।তাই এই স্যাক্রিফাইস।বড় ছিল কী,আমার চাইতে, জানি না।বড়ই হবে হয়তো, ছোটর জন্যে স্নেহ,ভালোবাসা, স্বভাব অনুযায়ী নিম্নগামী,রেখে গেল।আর আমি,এই আমি সঞ্জয়, স্বার্থপরের মতো একা একা চলে এলাম, এই নীল নীল অদ্ভূত সুন্দর এক গ্রহে।
জন্মদিনে মধ্যরাত্রির পর, যখন একটু আগে,মোমবাতির আলো নিভিয়ে,কেক কেটে পরিবারের সঙ্গে কিছু আনন্দিত মুহুর্ত কাটিয়ে আমি একটু একা হতে চাইছি,নিজের সঙ্গে কথা বলার জন্য, তখন সে আসে,ভাই আমার।চারিদিকে খানিকটা নৈঃশব্দ্য, প্রগাড় কালো রাত্রি।ওপরে অসংখ্য তারা।সে আসে ধীর পায়ে,আমার চোখে,জল হয়ে। বলে,”কী রে ভাই,একা একা? আমিও তো রয়েছি আজকের দিনে, জীবিত নই যদিও,ছিলাম তো। ছেলেবেলায় মায়ের হাতের ধানদুব্বো আমার মাথায়,বাবার মাংস কিনে আনার আনন্দে আমি নেই কেন,ভাই?”
আমার নিজেকে তখন হত্যাকারী মনে হয়।মনে হয়,নিজে বাঁচার জন্যে নাড়ির ফাঁস ওর গলায় আমিই পরাইনি তো?মানব সম্ভবত সবচাইতে ভালোবাসে নিজেকেই।সেই নিজেকে ভালোবাসার বলে বলীয়ান হয়ে,আমি হইনি তো হত্যাকারী? নিছক দুর্ঘটনা কি?যদি তাই হয়,ভাই ছিল, নেই।ওই আকাশের সবচাইতে উজ্জ্বল তারা হয়ে বড় হওয়ার সুবাদে কী আশীষ দেয়, আমাকে,সকলসময়! চোখে চোখে রাখে?হোঁচট খেলে কি ওর বুকও কাঁপে? উত্তর মেলে না।
আমার প্রতিটি জন্মদিনে তাই আমি একটি মৃত্যুদিনও পালন করি,নিভৃতে,একা একা।একদিকে খুশির বেলুন ওড়ে,অন্যদিকে,চোখে জলের সুরমা।
এভাবেই আমার চলার শুরু।ডিগবয়ের তৈলশোধনাগারের হাসপাতাল থেকে,এই শহর,যা দ্রুত পাল্টে গেছে।বেশিরভাগ মায়েরা প্রসবকালীন সময়ে, বাপের বাড়িতে থাকেন। সেই নিয়মে, ডিগবয়ে আমার অনেক মামাদের বাড়ি,যদিও নিজের মামা একজনই,চলে আসেন আমার মা।আর ডিগবয় হয়ে গেল আমার জন্মস্থান। জন্মেই আমি সিলেটি বাঙালি।জন্মেই আমি ব্রাহ্মণসন্তান।জন্মেই আমার উপাধি চক্রবর্তী। আমি হিন্দু।আমি রামরুদ্র চক্রবর্তীর বংশের দীপ।পিতা সুধাময়ের বংশের উত্তরাধিকার।মাতা রমলা চক্রবর্তীর বংশও তো!সে যাকগে।টুক করে খসে পড়ার পরই আমার কোন চয়েস নেই।সবই নির্ধারিত।
কী হয়েছিল এই পৃথিবীতে তখন? রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মশতবর্ষ।বার্লিন ওয়াল গড়ে তোলা হচ্ছে।দুই জার্মানিকে আলাদা করতে।এখানে ওয়াল,আর আমার বাংলায় রেডক্লিফ সাহেবের হাত,বিচ্ছেদ ঘটাতে,কেটে ফেলতে। জর্জ ক্লুনিও চলে এসেছেন এই নীল নীল গ্রহে।আর য়ুরি গ্যাগারিন,এই পৃথিবী প্রদক্ষিণ করে দেখে ফেলেছেন কতটা আলো ও অন্ধকার। মাতৃভাষাকে ভালোবাসতে গিয়ে বীর শহিদের বুকের রুধিরে ভাসল শিলচর রেলস্টেশন। বাংলা মায়ের কোলে ঢলে পড়ল এগারোটি তাজা প্রাণ।ফিদেল কাস্ত্রো ঘোষণা করছেন তিনি কমিউনিস্ট। রবার্ট ফ্রস্ট কবিতা পড়ছেন কেনেডির সামনে।বব ডিলান গান গাইছেন নিউইয়র্কে।বিটলস্ এই প্রথম গান গাইছে জনসমক্ষে।হাংরিরা ইস্তেহার লিখছেন।মারা যাচ্ছেন গ্যারি কুপার। সত্যজিৎ রায়ের “তিন কন্যা”, অড্রে হ্যাপবার্নের “ব্রেকফাস্ট এট টিফানি” মুক্তি পাচ্ছে, সিনেমা হাউজে। আরো কত না কত ঘটনার ভেতর আমি ঢুকে পড়লাম।আমি কি শুধু আমার জন্মবর্ষের ঘটনার সঙ্গে যুক্ত হলাম,সে তো নয়।জড়িয়ে পড়লাম মানবের সমস্ত ক্রিয়াকাণ্ডের সঙ্গে,চাই বা না চাই।
দু দুটো মহাযুদ্ধ,দেশভাগ,অগুনতি মানুষের জাস্ট এমনি মরে যাওয়া,সেই আমার পিতৃপুরুষ,সেই যে গুহামানবটি,সেই চলা থেকে আজ এই সময় এবং আরো আরো আগামী, তারই একটি তৃণ হয়ে চলে এলাম। মানবের পথের যে পাঁচালি,তার সুরের একটি পরমাণু, মানব সভ্যতার যে পাচিল,পিঙ্ক ফ্লয়েডের গানের মতো,আ্য ব্রিক ইন দ্যা ওয়াল হয়ে পড়ে রইলাম।একদিন হয়তো শ্যাওলালাঞ্ছিত হয়ে পড়ে থাকব,চোখের অন্তরালে।তবুও, এই জীবন, তোমাকে সেলাম।
“জরায়ু ত্যাগের পরে বিস্তীর্ণ আলোকে এসে শিশু
সৃষ্টির সদর্থ বোঝে,নিজস্ব পিপাসা,ক্ষুধা পায়।”
এই তার শুরু।থামবে কোথায়? সে কি জানে? শুধু চলা।বিরামহীন চলা। সে জানে, একটি নির্দিষ্ট গন্তব্য আছে।কিন্তু, কবে,কোথায়,কখন,কীভাবে,সে কি জানে?
শুধু এইটুকুন জানি,এসে গেছি আমি খরবায়ু,এসে গেছি পাহাড়ের সমদল,এসে গেছি পিতার হাওর,তার জল।এসে গেছি একটি কুঁড়ি,দুটি পাতা,এসে গেছি হাসন রাজা,এসে গেছি রাধারমণ,এসে গেছি ভাতে সিদল। এসে গেছি বরাকভ্যালি এক্সপ্রেস,এসে গেছি ঘুম ঘুম হাফলং হিল,এসে গেছি জাটিঙ্গায় পাখিদের আত্মহনন।এসে গেছি সমতলে ভয় আর অপমানের জীবন যাপন।
ভালোবাসা ছিল না? ছিল তো খুব,ভিজি এখনো।পিতামহ শুনেছি খুব প্রেমিক পুরুষ।লিখেছেন দুটি উপন্যাস,”স্নেহের বাঁধন”, “নারীশক্তি বা অশ্রুমালিনী।” প্রবন্ধ, কবিতাও।আর আমার পিতামহীকে চিঠিতে লিখছেন,খণ্ডা়ংশ জুড়ে দিয়ে বলছি।
“বিরহে কেবল তোমারই ভাবনায় দিন যাইতেছে।তাই বিরহের গান,নতুন হইয়া মনে উঠিতেছে। আকাশে চাঁদ হাসিতে দেখিলে মনে হয়-” আজি এ যামিনী মধুর হাসিনী,পরাণে এমন আকুল পিয়াসা, সে যদি গো ভালোবাসিত।
তুমি হয়ত মনে কর এখন আমি খুব শান্তিতে ঘুমাইতেছি কারণ ছেলেমেয়ের কান্না শুনিতে হয় না।কিন্তু তুমিই এখন আমার সকল শান্তি চুরি করিয়া নিয়াছ।
বাদলি দিনে সকল স্বামী স্ত্রী যুগলে যুগলে নিরালা নিঝুম ঘুমে মগ্ন থাকে,আর আমি শূন্য বিছানায় একাকী কোল বালিশটা বুকে লইয়া ছটফট করিয়া কাটাই।”
জেনেছি, মায়ের দিকে আমি চৈতন্যদেবের কুড়িতম বংশধর। আমিও কি ভালোবাসায় মগন,উত্তরাধিকার সূত্রে! তবে মানবপ্রেমই শ্রেষ্ঠ এই জীবনে,এটা মানি।
শুরু হলো পথচলা।
“দুপাশের অভ্যর্থনাকারীদের মাঝ দিয়ে হেঁটে
বিদেশী ব্যক্তির মতো কে জানে কোথায় যেতে হবে।”
খুব ভালো লাগলো,বড়ো টাচি লেখাটা।
এখন বোধ হয় জীবনের টুকরো টুকরো অংশ cum জীবনী লেখার সময় হলো।
সু ব্রত
হৃদয়ে ছুঁয়ে গেল আপনার লেখা।লিখে যান।