কথায় বলে,স্মৃতি সতত সুখের।আমার কাছে খুবই দুঃখের। ওই মধুর পুষ্পকে ধরে রাখতে পারিনা।ফাঁকি দিয়ে চলে যায়,সেই জোছনার গানের মতো।তার মিষ্ট পাঁপড়িসকল,শুকনো হয়ে ঝরে যখন,সৌরভ থাকে না।শুকিয়ে কাগজ।হারিয়েও যায় একসময়।কখনো কোন বইয়ের পৃষ্ঠা ওলটালে হঠাৎ সে আমার সামনে আসে,মৃত।কী ছিল,কী ছিল যেন!
কে যেন বলেছিল,মুহুর্ত বাঁচো।যে অতীত তুমি ফেলে এসেছ,তাকে পাল্টাতে পারবে না। নস্টালজিক হয়ে বর্তমানকে হারিয়ে ফেল না।যে ভবিষ্যত অজানা,অচেনা,রহস্যময় এক বাড়ি,তাকে আগ বাড়িয়ে ভাবতে যেও না।অতীতের হা হুতাশ,ভবিষ্যতের শঙ্কা এবং স্বপ্নকে জড়িয়ে ধরতে গিয়ে আমরা বর্তমানের মিঠাসকে হারিয়ে ফেলি।অতএব,বাঁচো,মুহূর্ত বাঁচো। স্মৃতি আমার খুবই দুর্বল।অনেকেরই স্মৃতিশক্তি খুব প্রখর।অতীতকে খু়ঁড়ে আনতে ওস্তাদ।তাকে আমি প্রণাম জানিয়ে আমার অক্ষমতাকে মেনে নিচ্ছি।এই পৃথিবীতে চলে আসার পর,যখন শিশু থেকে বালক,সেই পর্বে কী হয়েছিল, আমার জীবন থেকে অনেকটাই উধাও।মনে থাকা সময়েও বিস্মৃতির ঘুণ, অনেক কিছুকেই পুরো খণ্ডহর বানিয়ে দিয়েছে।
সো,অনেক কিছুই নেই,তবে যা আছে,সামান্যই।দেখি কতটা খুঁড়ে আনা যায়,কাদামাটিজল।এই স্মৃতি আউড়াতে আউড়াতে মনে পড়ে গেল,যুগান্তর চক্রবর্তী, স্মৃতি বিস্মৃতির থেকেও কিছু বেশি।
“যেন ভূতগ্রস্ত মাঠে নিয়ত অলীক দায়ভাগ
নিতে হবে,সময় হতেছে ক্রমে বাতাসের সমসাময়িক।”
এই যাপনের ভূতগ্রস্ত মাঠে দারুণ ফুটবল খেলা।কখনো সোজা শট,কখনো ড্রিবল করে এগিয়ে যাওয়া।কোথায়? গোলপোস্টের দিকে,আবার কী!সময়কে বাতাসের শিরের মুকুট বানিয়ে স্রেফ চুপ করে বসে থাকা।
বসে থাকলে হবে?খুঁড়ে আনতে হবে না? এক্সকাভেশন।কী করে খোদাই হবে,কোদাল নেই,শাবল নেই,শুধু অক্ষম দুই হাত আর গবেট এক মাথা।যারা জানতেন,সেই কবেই চলে গেছেন না-ফেরার এক দেশে। দিয়েও যাননি আমাকে গল্পসকল।স্মৃতিও দুশমনি করেছে। দেখি, কোন পথে কতদূর, কতদূর এই চরণযুগল ধায়।
ডিগবয় থেকে যে কোথায় উড়ে গেলাম,কখনই বা গেলাম,বয়স কতো,কোন মাস,কোন ঋতু, সেইসব সময়েরা আজ বিস্মৃতির অতলে। কী আসে যায়।কতকিছুই তো অন্তর্হিত। গেলই বা একটুকরো জীবন হারিয়ে।পুরোটাই বা হারালে কী?
পুরনো দুটো ছবি আছে,সেইসময় সকলেরই হয়তো থাকত।একটিতে শিশু আমি পাশবালিশ জড়িয়ে অবাক চোখে পৃথিবীকে দেখছি।যেন মনে মনে ভাবছি,বেশ তো ভালোই ছিলাম দূর আকাশে।তোমরা কেন আমাকে টেনে নামালে।সেই সময় আমি সম্ভবত,ডিগবয়। পরের ছবিতে সেই অবিকল আমি মায়ের পদ্মমাসির কোলে।তিনি আমার দিদিমার বন্ধু।আমার দাদামশায়ের অকাল মৃত্যুর পর,মেয়ে ও ছেলের প্রতিপালন,নিজেকে সম্মুখ লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত করার নিমিত্ত নার্সের চাকরি নিয়েছিলেন দিদিমা।তো সেই পদ্মমাসিও ছিলেন নার্স।
যেমন হয়,সন্তানেরা একটু বড় হওয়া পর্যন্ত মায়ের সঙ্গেই দাদুর বাড়িতে থাকে।আমিও সেরকম থেকে একদিন চলে এলাম বাবার বাড়ি।বাবার বাড়িকেই নিজের বাড়ি বলে।মেয়েদের যেমন, বাপের বাড়ি আর শ্বশুরবাড়ি।নিজের বাড়ি কি থাকে? শিলচর শহর,কবির শহর,এগারো শহীদের পুণ্যভূমি,ছোট্ট সিলেট। সেখানে আমি গামলায় বসে স্নান করি।এটা বড়দের একটা শখ,আমোদ।শিশু খিলখিল করে হেসে জলকেলি করবে,তাই দেখে বড়রা আনন্দিত হবে।
একান্নবর্তী সংসারে সূর্যোদয় থেকে চন্দ্রের নজরে থাকা গহীন রাত্রি অব্দি কাজ আর কাজ।আমার মায়ের শুনেছি দম ফেলারও ফুরসত ছিল না। সব কাজ ফুরোলে,ঠাকুমার পায়ে তেল মালিশ করতে হতো,যতক্ষণ না পর্যন্ত, তিনি সমাপ্তি ঘোষণা না-করতেন।মা যখন শুতে যেতেন,কী থাকত শরীরে,মনে?চোখ জুড়ে অগাধ ঘুম,এক পৃথিবী ক্লান্তি, না বাবার সঙ্গে কথা বলার অবসর,প্রেম? বাবা কি অপেক্ষা করতেন মায়ের জন্য? অপেক্ষা করতে করতে কি বাবাও ঘুমের অতলে ঢলে পড়তেন? বাবার সঙ্গে মায়ের কথা হতো কখন? দুটি প্রাণের কথা?
আমার চাইতে বেশি আমার স্ত্রী মায়ের গল্প জানে। মা ওকেই বলে গেছেন,সেইসময়,সেই যাপন।সে অন্য গল্প,মায়ের গল্প।একদিন আরামের তেলমালিশ নিতে নিতে ঠাম্মা ঘুমিয়ে পড়েছেন ভেবে মা চলে যাওয়াতে পরের দিন বিচার বসে। খাপ পঞ্চায়েত এর অন্য সংস্করণ কী আমাদের বৃহৎ পরিবারেও ছিল।ভালোবাসা ছিল না?
শুনেছি,এই শিশু আমার খেয়াল রাখার দায়িত্ব সস্নেহে নিজের হাতে তুলে নিয়েছিলেন আমার পিসিমণি ও ওনার মেয়ে,আমার বড়দি। আমার এখনো মনে আছে শিলচর শহরে একটি জ্বরের রাত।বিজলিবাতি নেই।লম্ফের আলোকের করুণ বিস্তারের ভেতর ঘোর জ্বর শরীরে নিয়ে শুয়ে রয়েছে এক অবোধ বালক।সেইসময় আমি একটু বড়।বাবা মায়ের সঙ্গে অন্যত্র থাকি।কোন এক ছুটিতে এসেছি,বাবার দেশ।জ্বরে প্রলাপ বকছি। সারারাত আমার অসুখের শিয়রে জেগে কপালে জলপট্টি দিয়ে গেলেন পিসিমণি,পাশে ঠায় বসা বড়দি।
এই পিসিমণির খুবই কষ্টদায়ক অসুখ হয়েছিল।সারাটা জীবন প্রায়,বৈধব্যের যন্ত্রণা ভোগ করে,একেবারে শেষ দিন কয়টি পরবাসে,এক অচিন আলো হাওয়ায় ভাড়াবাড়ির একটুকুন কোণে শ্বাস নিতে নিতে একদিন শ্বাস ফুরলো।শেকড় উপড়ানোর ভবিতব্য বোধহয় নিতে পারেননি।যে বরাকের জলে অবগাহনের কথা ছিল,তিনি আমার পিসিমণি, একদিন একা একা,খুব ধীর লয়ে নেমে গেলেন ব্রহ্মপুত্রের জলে। তখন,ঠিক তখন অদূরে এক উদাস মাঝি তার বৈঠা হাতে নিয়ে,আকাশের বিষণ্ণতার দিকে মুখ তুলে হৃদয় থেকে খুঁড়ে আনল ভাটিয়ালি,”অকূল দরিয়ার মাঝে আমার ভাঙা নাও রে মাঝি বাইয়া যাও রে।”
বড়দিও তো উড়ান দিল দক্ষিণের দেশ।শেকড় উপড়ানোর সময় তোর কষ্ট হয়নি দিদি? বেশ তো ভালোই ছিলি। বরাকের কোল,সাদারগুড়ো,পানসুপারি আর হররোজ দোল। যেখানেই পা রাখি,সেটাই কি দেশ হয়ে যায়?হয়ে যায়, নিজের বাড়ি? সম্ভব,বড়দি?
সারাজীবন একরকম আলো,হাওয়া, রৌদ্র,হঠাৎ পাল্টে গেল,সেও যখন সূর্যাস্ত খুব কাছাকাছি।জীবন কি তাহলে এরকম,মানবজনম? তুইও তো একদিন না-ফেরার সেই উড়ান ভরলি,চলে গেলি তোর আলপনাশোভিত দেশ,তার উঠোনে।
আমাকে দিন ক্ষণ জিগ্যেস করবেন না স্যার,ওসব আমার কোনকালেই মনে থাকেনা,এই এখনো।আমাদের কবে প্রথম দেখা হয়েছিল,প্রথম চিঠি কোন তারিখ,মাস,ঋতু,না স্যার প্লিজ।”আজ যদি আমায় জিগ্যেস করো,” তো বলব,”দ্যা শ্বোশাঙ্ক রিডেম্পশন”-এ,আ্যন্ডি ডাফ্রেসনে বলেছিল,সে প্যাসিফিক ওশেনের তীরে ম্যাক্সিকান কোস্টাল টাউন জিহাটানেযোয় যাবে।ম্যাক্সিকান রা প্যাসিফিক ওশেনকে নিয়ে বলে,আ্য প্লেস উইথ নো মেমোরি।যদি এরকম হতো,কোন স্মৃতিই থাকতো না,বেশ হতো।শেষ ট্রেনের বিলাসখানির কথা ও কাহিনিও লিখতে হতো না।শুধু বর্তমান থাকত,কোন অতীত নেই,ভবিষ্যত কে-ই বা জানে!
তিনসুকিয়া এলাম।বয়স কত,জানিনা। বাবা কোয়ার্টার পেলেন।পাশের বাড়িতে অনেক লোক।আমার লালটু মার্কা চেহারা,ফোলাফোলা গাল।সবাই টিপে আদর করে,খাওয়ায়,ভালোবাসে।আমাদের বাড়িতে এক কেয়ারটেকার ছিল,নাম ভুলে গেছি।সারাদিন ধুলো মাখি।একদিন বাবার নির্দেশে সে আমাকে পাঁজাকোলা করে,ধরে বেঁধে নিয়ে বাড়ি থেকে ক’হাত দূরত্বের স্কুলে নিয়ে ঢুকিয়ে দিল।ব্যস,শুরু হয়ে গেল আমার স্কুলজীবন।তিনসুকিয়া বঙ্গীয় বিদ্যালয়।বর্ণপরিচয়,না সহজপাঠ, জানা নেই।কীভাবে ভর্তির প্রক্রিয়া হলো জানিনা,আমার কোন স্কুল ব্যাগ,জলের বোতল ছিল কিনা জানিনা।দু একটা বই,আর শ্লেট অবশ্যই ছিল।না-হলে কমলা খাওয়ার দাবি জানানোর পর পিতার নির্দেশে কমলা বানান কোথায় লিখতাম?বানান শুদ্ধ হলেই তবে কমলার রস,জিভে।
এক মাঘবিহুর উরুকাতে বাড়ির পাশের মাঠে বাবার নিমন্ত্রণ।বাবার আঙুল ধরে আমিও গুটিগুটি এগোচ্ছি। অতিকায় ভয়ের এক দলা, বুকে।আমি বুঝে গেছি,”ওরা” আলাদা।আমাদের মতো নয়।ওখানে ভয় আছে।এরকম কেন মনে হলো জানিনা।বরুয়াদের বাড়ি যাওয়ার জন্য তো আমি বাড়ির সবার মাথা খেতাম।বরুয়ারা তো “ওরা” ছিল না।এ কেমন দ্বন্দ!হতে পারে উরুকার রাতের নিমন্ত্রণ ছিল একদিনের,অপরিচিত মানুষ,ভাষা,লোকসংস্কৃতি। আর বরুয়াদের বাড়ি ছিল প্রাণের টান।তো,সেই উরুকার ভোজ কিন্তু খেলাম বাপবেটায়,আমাকে আদরও করল দু তিনজন।বাবাও আড্ডা দিলেন একটু।তবে আমরা খুব বেশি সময় থাকিনি।খেয়েই ফিরেছি।মনে আছে শীতের আমেজ নিতে আগুন জ্বালানো হয়েছে।তাপও নিয়েছি।পরের দিন সকালের জন্য মেজিও তৈরি ছিল,এবং অবশ্যম্ভাবী হিসেবে ছিল ভেলাঘর। এই আমার জীবনের প্রথম উরুকা।
কী সেই টান?টান।জীভনভর মিউজিক।এত রকমের মিউজিক্যাল ইনস্ট্রুমেন্ট ছিল ওদের বাড়ি যে আজ আর মনে নেই।তবে একটা ইনস্ট্রুমেন্ট এখনো মাঝে মাঝে ঘুমিয়ে পড়া রাতে এসে ঢুকে পড়ে বুকের ভেতর।ব্যাঞ্জো।ছেলেবেলার সেই ব্যাঞ্জোর সুর এখনো শুনতে পাই।পরবর্তীকালে যখন আমাদের তুমুল হৈ হল্লার জীবন,বেশ কয়েকটা বলিউড মুভিতে এই ব্যাঞ্জো বাজনা শুনেছিলাম,আর তখন আমার বুকের ভেতর ঢুকে পড়েছিল এক টুকরো তিনসুকিয়া।
বাড়ির অনতিদূরে ছিল এক সরোবর।সেখানে পদ্ম ফুটত।ঠিক যেন পড়ার বই থেকে উঠে এসে সরোবরটি এখানে বিশ্রাম নিচ্ছে।
তিনসুকিয়ায় আমার জীবনের প্রথম দুটো জিনিস হলো, যদিও পর্বটি ছোট ছিল।
আমারও একদিন পাখি সব করে রব-এর সকাল ছিল,হ্যাঁ, সাজি হাতে ফুল তোলা ছিল,বৈতালিকের গান ছিল। ফেরিওয়ালার ডাক ছিল।কোথায় ছিল,তিনসুকিয়া,শিলং, শিলচর,গুয়াহাটি? মনে নেই।
জিহাটানেযো সিমড্রম।
সঞ্জয়দা ,খুব ভালো লাগছে পড়তে।পুরোটা একসাথে পড়ার অপেক্ষা করবো।