শিলং যখনই বেড়াতে যাই,শহরে ঢুকলেই মনে হয়,এই তো,এই তো আমার দেশ। চারদিকে পাইনের বিস্তার, কেমন মনভালোর গান খুব মৃদুস্বরে গুনগুনায়।আমরা বলতাম সরল গাছ।আর ওই ছোট ছোট ঝর্নার বয়ে যাওয়া,যেন শৈশবের স্বপ্নময় সময়কে তুলে এনে আমার সম্মুখে রাখে।বলে,এই রাখলাম বাতিদান,এবার ইরশাদ বলে শুরু হোক।
তিনসুকিয়া থেকে উড়ে এসে পাহাড়ের পদতল।আমি হয়ে গেলাম মেঘবালক।শরীরময় মেঘ মেখে ঘুরে বেড়াই সবুজ সবুজ টিলা,উঁচুনিচু পথ।অনেকেই উমপ্লিং-এ ছিল।তখন কেন দেখা হয়নি আমাদের? হয়তো হয়েছিল দেখা,হয়তো একে ওপরের সঙ্গে করমর্দনও করেছি,বুকে জড়িয়ে ধরেছি।তখন তো আমাদের আর এইরকম পরিচয় হয়নি, আমি সঞ্জয়, তুমি অমিতাভ,সে গৌতম ভট।
উমপ্লিং জলের রাজ্য, এখানে ঝর্না লুকিয়ে থাকে,খুঁজে বের করতে হয়,তখন সে খিলখিলিয়ে হাসে।আর ওর হাসি দেখলে বালকের মনে স্বর্গের খুশির চ্ছটা লাগে।মন ময়ূর হয়ে পেখম মেলে।
উমপ্লিং-এ উপর আর নিচ দুই ভাগ আছে, এই দুই ভাগের বর্ডার হলো একটি মন্দির।যতদূর মনে আছে,শনি মন্দিরই হবে।আমরা থাকতাম ওপরের ভাগে। ততদিনে আমার একটি ছোট্ট ভাইও এল।এর আগে,হ্যাঁ, মনে পড়ছে,কোন একসময় ডিব্রুগড় ছিলাম কিছুদিনের জন্য।আমার আরেকটি ভাই এর আসার কথা ছিল,আমাদের সঙ্গে থাকবে বলে।সেও ফিরে গেল নিজের দেশে।ডিব্রুগড়ের ছোট্ট দুটো স্মৃতি।এক হলো,সাগরের মতো ব্রহ্মপুত্র।ওই কূল দেখা যায় না।আরেকটি হলো,কোন এক বাজার।বাবার সঙ্গে গিয়েছি।হঠাৎ মানুষেরা ভীষণ ছোটাছুটি শুরু করল।একটা বুক হিম করা হল্লা।আমি তো একেবারে নিস্পন্দ দাঁড়িয়ে রয়েছি।বাবা আমাকে কোলে করে,ছুটে এক নিরাপদ যায়গায় নিয়ে গেলেন।এতটুকু মনে আছে,আমি ভীষণ ভয় পেয়ে গেছিলাম।এইরকম অভিজ্ঞতা জীবনে প্রথম।দাঙ্গা শুরু হলো কী? কেউ যদি এক্ষুনি এসে দা এর এক কোপে আমার মাথাটা শরীর থেকে টুকরো করে দেয়!
কিছুক্ষণ পর বোঝা গেল,দাঙ্গা টাঙ্গা কিছু নয়,একটা ষাঁড় খেপে গিয়ে এই কাণ্ড ঘটিয়েছে।
ডিব্রুগড়ে জীবনানন্দ এসেছিলেন।সিটি কলেজের চাকরি চলে গেছে।এসেছিলেন কাকার বাড়ি,ওনারই আমন্ত্রনে।চাকরি নেই,একটা কিছু ব্যাবসা করতে,তিনি সাহায্য করবেন।খুড়তুতো বোন শোভনার প্রেমে পড়েছিলেন তিনি।তখন ওনার বয়স তিরিশ।শোভনার ষোল সতেরো হবে। আমি কেন চল্লিশ বছর আগে জন্মালাম না ডিব্রগড়ে! জীবনানন্দ আর শোভনা হাত ধরাধরি করে, ডিব্রু নদীর তিরে হাঁটতেন অলস বিকেলে,আর আমি বালক অপু নেচে নেচে বেড়াতাম ঠিক ওদের সম্মুখে। আমি, শোভনা আর জীবনানন্দ,কী রোমাঞ্চকরই না হতো! ব্রহ্মপুত্রের জলে এখনো মিশে রয়েছে এক অসামান্য কবির পদচ্ছাপ,গভীর ভালোবাসার গহীন অনুভূতির রিনরিন।
আমার ভাই এসেছে,সেলিব্রেশন তো বনতা হ্যায়।
কিন্তু, কীভাবে?এতো ছোট্ট ছেলের কাছে টাকাপয়সা থাকার তো কথা নয়।আর সেলিব্রেশনের জন্য অর্থ চাই।অর্থ ছাড়া সবই অনর্থ। অতএব সময়ের অপেক্ষা। একদিন বিছানার তোষক কী করে যেন উঠিয়ে তো থ। এত্ত টাকা! তোষকের নিচে সমস্ত বিছানা জুড়ে পড়ে রয়েছে দশ টাকার নোট।ব্যস,সমস্যা শেষ। এত দশ টাকার মধ্যে একটা,মাত্র একটা সরিয়ে নিলে কেউ টেরটিও পাবে না। যেমন ভাবা,তেমন কাজ।একটা দশ টাকার নোট পকেটে চালান করে আমি রাজা। এরপর বন্ধুদের সগৌরবে তলব,চল,পার্টি।অনেকটা আজকের সুরে।কী যে খেয়েছিলাম সবাই মিলে,আজ আর মনে নেই।তবে এটা মনে আছে যে একটা খাবার লালমোহন ছিল।যদিও লালমোহন বাবু বা জটায়ুর সঙ্গে পরিচয় অনেক পরে।আর ছিল কাঠি লজেন্স,যার মধ্যে বিড়ি লজেন্সটাই ফেভারিট ছিল।পার্টি টার্টি করে বাড়ি ফেরার সময় ভাইয়ের জন্য নিয়ে এসেছিলাম একটা টেনিস বল।গোল বাঁধল এখানেই। বল কী করে আনলি,টাকা কোথায় পেলি,এইসকল প্রশ্নবানের ভেতর গবেষণা চলল,এবং শেষে আমার চৌর্যবৃত্তি ধরা পড়ল।এরপরের বাবার দেওয়া শাস্তি কী ছিল মনে নেই,কিন্তু ভয়ানক যে ছিল,সেই ফিলটা এখনো আছে।
লতা মঙ্গেশকর প্রয়াত। তিনি আর নেই ভাবলেই চারিদিক কেমন স্ট্যান্ডস্টিল হয়ে গেল।গুগাবাবা-র গানের সেই আফটার আ্যফেক্ট। আমার সময় ফুরিয়ে আসছে তাহলে।কোকিলকণ্ঠী এই গায়িকাকে সম্ভবত শিলঙেই শুনেছিলাম।বাবার গানের শখ ছিল।নিজেও বেশ ভালো লোকসঙ্গীত গাইতেন।আমাদের বাড়িতে একটি ঢাউস রেডিয়ো ছিল।আমার গান শোনার কোন শখ নেই তখন।বাড়িতে পড়াশোনার জন্যে কঠিন শাসন।ফাঁক পেলেই আদাড়েবাদাড়ে ঘোরা।ঘুরবোই বা না কেন? প্রকৃতি দু’হাত উজাড় করে এত্ত দিয়েছে।টিলা খুঁড়লেই জল।প্লাম, নাসপাতি ঝুলছে গাছে,মাটি খুঁড়লেই শফলাং। স্কুয়াশ,আর চালকুমড়োর মতো দেখতে “মেরো” নামের একটা সব্জি তো খাটের তলায় অনাদরে গড়াগড়ি খেত।সেই থেকে স্কুয়াশের প্রতি আমার চরম বিতৃষ্ণা।
আশীষদের বাড়ির উল্টোদিকে,একটু উঁচু জায়গায় খেলার মাঠ।সেখানে আমরা ফুটবল নিয়ে দাপাদাপি করি।বৃষ্টির দিনে তো আর কোন কথাই নেই,ফুটবল ইজ আ্য মাস্ট।খেলাশেষে মাটির ওপরের পাতা দেখে শফলং চিনি,মাটি খুঁড়ে বের করি,সাদা রঙের সরু,লম্বা একটি ফল,মিষ্টি,পরম সুখে খাই। আরেকটা ফল ছিল, নাম ভুলে গেছি,বেশ টক।সেটা এমনিতে পাওয়া যেত না,কিনতে হতো।সেও খুব লোভনীয় ছিল।এখনো শিলং যাওয়ার সময় নংপোতে পাওয়া যায়।আর শিলং-এ তো আকছার।সেই মাঠে খেলার শেষে কোন কোন দিন আমরা ড্রিলও করতাম,খাকি প্যান্ট ও সাদা শার্ট পরে। তখন জানতাম না, কারা,কী। পরে বুঝলাম,রাষ্ট্রীয় সেবক সঙ্ঘের কঠিন অনুশীলন।
আমার এক মাসি থাকতেন উমপ্লিং-এ। মিলি মাসি। ওদের বাড়ির ফ্লোর কাঠের।আমরা বলতাম প্ল্যাংকিং।মাটি থেকে বেশ উঁচুতে ফ্লোর।নিচে ফাঁকা।সেই ফাঁকা জায়গাটা আমাদের খেলার জন্য তোফা স্পেস। তো ওই কাঠের ফ্লোর বিশেষ ধরনের মোম দিয়ে ঘসে ঘসে এমন চকচকে করে রাখতেন,যে চলাফেরা করতেই ভয় করত।এই না পিছলে পড়ে যাই।এই মাসির বাড়ি আমি যেতাম একটা লোভে,গোল গোল নানা রঙের সাগুর পাঁপড় খেতে।মাসিকে আমি ভয় পেতাম।যদিও মাসি ভয়ানক নন। চোখের কোনে অলওয়েজ আ্যকট্রেস সাধনার মতো কাজল টানা।বড় বড় চোখ।সুন্দর।হাসিতে প্রচুর পরিমানে মিষ্টি।সবসময় সেজেগুজে থাকেন।পাটভাঙা শাড়ি পরেন।কথাও বলেন বেশ ভঙ্গি করে। আমার মা যখন বারো বছরের সেরিব্রাল স্ট্রোকের জীবন গ্রহণ করলেন,সব পাল্টে গেল,ভাষাও।তখন আমার মিলি মাসি ফিরে এসেছিলেন।সবারই নাম তখন মিলি,এমনকি জিনিসপত্রের নামও। মা কাউকে ডাকছেন,নাম যা ই হোক,মিলি। কিছু খেতে চাইছেন,মিলি।
উমপ্লিং-এ আত্মীয় বলতে একমাত্র মিলিমাসি,লাবানে মামাবাড়ি।মাসতুতো মামা বলে যদি কিছু থাকে,তো সেই মামাবাড়ি এরকমই।সেখানে আমার যথেষ্ট দাবি। খুব আবছা মনে পড়ছে,কোন এক মাসির মেয়ে,নাম ছিল মলয়া।নামটা ঠিক মনে আছে।শিলংয়েই কোন এক জায়গায়,ঘন পাইন বন,মাসির বাড়ি,আমি ভাইফোঁটা নেব।মলয়া দেবে।দিদিই বলা যায়,একটু বড়ই।তো মলয়াকে শাড়ি পরতে হবে।সে খুব নারাজ।ওই কর্মটি ওর পোষাচ্ছে না।মুখ রাগে থমথম করছে।মেঘালয়ের সমস্ত মেঘ যেন ওর মুখে এসে জমেছে। আমি তো মলয়ার মুখ দেখে ভয় পেয়ে গেলাম। ফোঁটা না-দিয়ে যদি কিলটিল মেরে দেয়? রক্ষা, ওসব কিছুই হয়নি। ছোট্ট দিদি আমার গম্ভীর মুখেই,সুন্দর শাড়ি পরে,খুবই স্নেহে ভাইফোঁটা দিল আমাকে। সম্ভবত এটাই আমার প্রথম ভাইফোঁটা। মলয়াদিদি আমার খুব বেশিদিন বাঁচেনি।কী এক হঠাৎ অসুখে, অল্প বয়সে এই নীল নীল গ্রহ,পাইনের বনের শোঁশোঁ হাওয়া,ঝর্নার অবিশ্রান্ত গুনগুন থেকে দূরে চলে গেল একদিন,কোন এক অচেনা দেশে।
মামাবাড়ি দুই মামা, চারজন মাসি।আমি গুবলুগাবলু, আদর খাই। এখানে আমার হারিয়ে যেতে নেই মানা।আমি হারাই পাইনের মর্মরে, ঝর্নার কুহু কুহু তানে।এক অচিনপুরের স্বপ্নালোকে কোথায় কোথায় চলে যাই। সে এক বর্ননাহীন পৃথিবী,ভালোলাগা শিরশির করে প্রবাহিত শিরদাঁড়ায়। দিনের আলোয় পাইন গাছ গল্প জুড়ে আমার সঙ্গে।রাতের নিস্তব্ধতার ভেতর,ঝর্নার সুর ভিনদেশী অন্ধকারের সঙ্গে সেরে নেয় তার এই জন্মের কথপোকথন।
মামাবাড়ি আদর আমি চিরকাল পেয়ে এসেছি,এই এখনো,যদিও অনেকেই প্রয়াত। যে কয়জন বেঁচে আছেন,মামা,মাসি। সিনেমার নেশা ধরাল তো এক মামা।সেদিনও এক বিয়েবাড়িতে ওনাকে পেয়ে বললাম,আমাকে বিগড়ে দেওয়ায় তোমারই হাত ছিল,তুমি জানো সেটা।মামা মুচকি হাসলেন।ডিগবয়ে আমার এক দাদুর বিশাল বাংলো ছিল।তিনি কালাসাহেব না কী যেন ছিলেন।আমার মামা মাসিরা আমাকে খেলার পুতুল পেয়ে ঘাড়ে চেপে বসল। দুধ এবং গাজর নামক দুই বিস্বাদ খাদ্য আমাকে চেপে খাওয়ানোর জন্যে সদাবস্ত ছিল,এটাই একমাত্র স্মৃতি।আরো কী কী এক্সপেরিমেন্ট আমার ওপর চলেছিল,মনে নেই।তবে সুখের স্মৃতিও রয়েছে।বাথটাবে জলকেলির সুখ আমি মামাবাড়িতেই প্রথম পাই।
উমপ্লিং-এ শ্রাবণের ঝুলন আমাদের কাছে দুর্গাপূজা থেকেও বেশি আকর্ষণীয় ছিল।রীতিমতো প্রতিযোগিতা হতো।প্রাইজও দেওয়া হতো।এখানেও মোহনবাগান ইস্টবেঙ্গলের মতো,উপরপাড়া, নিচের পাড়ার মধ্যে রেষারেষি। নিচের পাড়া একটু স্ট্রং ছিল।টেকনিক্যালি ওরা আমাদের থেকে এগিয়ে,কিন্তু ফিল-এ আমরা বেটার। তো আমরা আমাদের।মতো,ওরা ওদের।ঝুলনের অনেক আগে থেকেই আমরা তৈরি হতে থাকি।কাঠের মিল থেকে কাঠের গুড়ো বয়ে এনে নানা রঙে রাঙানো হয়,ঝুলনের পথঘাট,মাঠ,ইত্যাদি ঠিকঠাক আ্যফেক্ট দেওয়ার জন্য। পাহাড়টা আমাদের সবসময় ভাবাতো।এক একদিন একেকরকম।পূর্ণিমার দিন সব স্পেশাল।পাহাড় হতো তুলো দিয়ে,মানেটা হচ্ছে হিমালয় ফিল,বরফাবৃত।সাজানো,এমনকি প্রসাদেও বোঁদে,ভুজিয়া।সেদিন আবার বিচারকরা আসতেন।প্রাইজ পেতে হবে তো।তবে যতই রেশারেশি থাকুক,আমরা কিন্তু নিচের পাড়ার ঝুলন দেখতে যেতাম।রিনা ও কুমকুম ও ঝুলন করতো।রিনাকে দেখতে পুরো ডল।পাতলা গড়ন,মিষ্টি চেহারা, চশমা পরত।ওই বয়সেই ওকে দেখলে বুকে এক ভালোলাগা নীরব ঝর্নার মতো বয়ে যেত।
ঝুলনের পর আমাদের দ্বিতীয় ভালোবাসা পৌষ সংক্রান্তি। মেঘপাহাড়ের দেশে উরুকা নেই।মেড়ামেড়ি আছে।আমাদের ভেলাঘরই মেড়ামেড়ির ঘর। কাঠের টুকরো দিয়ে ইংরেজি টি-র মতো বানানো হতো,এরপর, মন চলো রে পাইনের বন। শুকনো সরলপাতা কুড়িয়ে বস্তায় ভরো।আমাদের মেড়ামেড়ির ঘর,বাঁশের পলকা বাঁধুনি,শুকনো স্কোয়াসের ডাল,পাতায় আবৃত এবং ঘরভর্তি সরলপাতা। প্রচণ্ড শীতের রাত,বেশিসময় থাকার অনুমতি নেই। বাড়িতে মিষ্টি আলু,চানার পিঠা,পাটিসাপটা বানানো হচ্ছে।পিঠেপুলি তো হবে,নকল সিগারেটে টান হবে না,বাবাদের মতো? বাবলা,আশীষ,আমি।বাবলাকে তো বাঙালি বলে মনেই হয় না।স্কটল্যান্ড অফ দ্যা ইস্ট-এর স্কোটিস কিড। এরকম ফর্সা বাঙালি এর আগে দেখিনি।দুই গাল এতটাই লাল যেন কেউ দুটো প্লাম এনে রেখে গেছে।তো মহানকর্মটি যত তাড়াতাড়ি পারা যায় শুরু আর শেষ করা উচিত।শুকনো স্কোয়াশের ডাল কেটে সেই কখন সিগারেট প্রোডাকশন শেষ।বাড়ি থেকে চেয়ে নিয়ে আসা দেশলাই কাঠি জ্বালিয়ে আমাদের গোপন গোপন,উত্তেজনাময় কাজটি শুরু।ঠিক বড়দের মতো ধরার স্টাইল,সেরকমই ফোঁকার ভঙ্গি, সেরকমই ধোঁয়া ছাড়া।আহ! কী সুখ! সিগারেট টানে কি এর চাইতেও বেশি?
সেটা পরখ করতেই আমি ও বাবলা প্ল্যান শুরু করলাম।স্কোয়াশের নিরীহ ডাল ছেড়ে এবার সত্যিকারের পুরুষের মতো আসলের স্বাদ চাই।
মেড়ামড়ির ঘরে ফেক সিগারেট টানার গল্প শেষে আসল সিগারেট টানার ইচ্ছেটা আসলে একটা কথাই,রহস্য।বড়রা টানলে কেউ বকে না। ওদের অবাধ স্বাধীনতা।ছোটরা টানলেই যত রাজ্যের গোলমাল।ছোটরা নেশা করবে কেন,চকলেট খাবে,এ কী!
বিস্তর গবেষণা চলল।সিগারেট টানার জন্যে সিগারেট তো চাই। সেটা কী ভাবে জোগাড় হবে? তাছাড়া একটি গোপন জায়গারও দরকার।এই দুষ্কর্মটি করার পর কারো সামনেও যাওয়া যাবে না।মুখের গন্ধে ধরা পড়ার সমূহ সম্ভাবনা। আমার বাবা সিগারেট খান, বন্ধুর বাবাও।উৎসটা সেখানেই।কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, ওনারা যদি গুণে রাখেন,তাহলে একটি কম হলে হল্লা র সম্ভাবনা প্রবল। আমার বাবা ভীণ অর্গেনাইজড,বন্ধুর বাবা বাউলগোছের।অতএব পারমুটেশন কম্বিনেশনের পর এই সিদ্ধান্তে পৌঁছনো গেল যে,বন্ধুর বাবার সিগারেটের প্যাকেট থেকে একটা হাতসাফাই করতে হবে।
অবকাশও পেয়ে গেলাম।এক মধুর দিবসে বন্ধুর ঘর খালি।ওর বাবা অফিসে।মা বোনও কোথায় যাবে।ফিরতে দেরি হবে।ঘরের জানলাটি খোলা রেখে আমরা দুজন উঁচু খাটের তলায় ঢুকলাম। সিগারেটাগ্নি বন্ধুই করল। নাম্বার টেন সিগারেট।টেনেই মুখ বন্ধ করে জানালার গরাদ দিয়ে ধোঁয়া বের করল।আমি ওত কষ্টসাধ্য প্রক্রিয়ায় গেলাম না।স্রেফ টানলাম আর জানলা দিয়ে ধোঁয়া ছাড়লাম।কান দুটো উত্তেজনায় লাল।নিষিদ্ধ জগতের অভিজ্ঞতা পেয়ে গেলাম।সামান্য নেশাও হয়েছে।
এমন সময় সব এলোমেলো করে, অপ্রত্যাশিতভাবে চলে এলেন বন্ধুর মা।এবং আমাদের দুঃসাহস দেখে একেবারে ফ্রিজড।এরপরের কাহিনি হলো,অনাহার এবং বন্দীজীবন একটি কক্ষে।তবে একটি দয়া তিনি করেছিলেন, আমাদের এই অতিশয় দুষ্কর্মটি তিনি কাউকে বলেননি।মাত্র সাতবছর বয়সে আমার প্রথম সিগারেটে টান।
রবীন্দ্রনাথের সঙ্গেও প্রথম দেখা এই উমপ্লিং-এই।স্কুলের রবীন্দ্রজয়ন্তী। “বীরপুরুষ” আবৃত্তি করব বলে আমি রেডি।হঠাৎ একজন কে যেন বাধ সাধলেন।”না,এত বড় কবিতা তো আর আবৃত্তি করতে দেওয়া যায় না। সবাই কিছু না কিছু করবে।একজন যদি তিনজনের সময় নিয়ে নেয়,তাহলে কী করে হবে?” আমাকে নস্যাৎ করার পর আমি কেঁদেকেটে একসা।অনেকেই এসে অনেক বোঝানোর পর আমি ওই কাঁদো কাঁদো মুখেই পাঠ করলাম,”রবিবার।”আরো একশ বছর আগে জন্মালে হয়তো কোন ফাগুনের মনকেমন করা বিকেলে আমরা বসতাম মুখোমুখি, কত কথা হতো,কত গান,এমন হলো না কেন?
আমাদের খেলা ছিল ফুটবল,কাঠের পাটাতনের গাড়িতে বসে ঢালু পথ বেয়ে নেমে যাওয়া।দেশলাইয়ের বাক্সে মৌমাছি ধরে কানের পাশে নিয়ে গুনগুন শোনা,ভুট্টাবাগানে ঢুকে গাছের ভুট্টাই কামড়ে কামড়ে মুখভর্তি কচি ভুট্টার দুধ ঠোঁট বেয়ে গড়িয়ে পড়া। আর লাটিম খেলা।এটাই দ্যা বেস্ট।বাজার থেকে কেনা লাটিম তত জোরদার নয়। বানানো টা রাজা। ওকে কেউ হারাতেই পারেনা।লাট্টু ঘোরে বনবন,কখনো মাটিতে, কখনো হাতে। কখনো অন্য লাটিমকে টুকরো করে ফেলে।
কাহিনি অনেক। একদিন ইন্দ্রপুরীর সামনে কুকুর তাড়া করে,সেই থেকে কুকুরকে ভয়।একদিন জল সাপ্লাই-এর জন্যে ফায়ার ব্রিগেডের গাড়ির নিচে ঢুকে যাওয়া,প্রথম মৃত্যুভয়। একদুপুরে বাবলা ও আমার, মানবের প্রথম যৌনমিলন দৃশ্য দেখে পাশের টিলাতে পালিয়ে যাওয়া।পুলক ফিসফস করে বলল,আমার মামা নকশাল,প্রথম অজানা ভয়।রাতে বাড়ির বাইরে একগামলা জল রাখা।পরের দিন সকালে শুভ্র বরফ।অনাবিল আনন্দ।আগুনে বিছেকে বাঁচিয়ে প্লাম পেড়ে খাওয়ার দিন,নাসপাতি গাছে ঢিল ছুঁড়ে নাসপাতি কুড়নো, দিদি দুর্গাবিহীন এ যেন গ্রীষ্মের দুপুরে কাঁচা আম মাখা,কাশের বন্যার ভেতর ডুবে যাওয়া, রেলগাড়ি দেখার আনন্দ।
কাহিনি অনেক।ইন্দ্রপুরীর দোকানে ছোট্ট মিষ্টি বনরুটির দিকে লোভনীয় থাকিয়ে থাকা,টমেটোকে অসমীয়াভাষী সবজি বিক্রেতার “বিলাহি লব” কথা শুনে একদৌড়ে মায়ের কাছে গিয়ে,”মা,মা,সবজির লগে বিলাই(বেড়াল) ও বেচের”,বলা। রেশনের দোকানে গিয়ে আমার প্রথম বাজার,কোটা অনুযায়ী চিনি না এনে বাবার বকুনি খাওয়া।আর সেই অবিস্মরণীয় দিন।যে চাঁদকে ডেকে,মা মাসি পিসি দিদিরা আমাকে কোলে নিয়ে বলতেন,”আয়,আয় চাঁদমামা, টিপ দিয়ে যা।”টিপ তো কাজলের। ধেবড়ে না-যায় তার জন্যে পাউডার লেপা।সেই চাঁদমামার শরীর থেকে এসেছে পাথর,এই মেঘপাহাড়ে।বাবার আঙুল ধরে সারি পেতে দেখতে যাওয়া।
বয়েস সাত।এইটুকুন সময়েই কত না “প্রথম” আমার।এমনকি ভালোবাসার যে রিনরিন সুর, সেও একটু হলেও জানা হয়ে যায় রাজুদা,সিলেটি বাঙালি আর ডারলং, খাসি মেয়ের প্রেমকাহিনি দেখে ও শুনে।প্রথম চুরিও শেখাল মেঘের আলয়। লক্ষ্মীপুজোর রাত। চুরি করছি সবজি,গৃহস্থবাড়ি থেকে।পরের দিন পিকনিক।না না,এটা দ্বিতীয় চুরি,প্রথম তো ভাইয়ের জন্য সেলিব্রেশনের।
আমি ঠিক বাঙালিও নই,পদ্মা, মেঘনা,গঙ্গা নেই।ইলিশ, চিংড়ি নেই।মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গল, মিষ্টি দই,নবীনচন্দ্র দাসও নেই। চারাপোনা কাটাপোনা নেই,জলসাঘর নেই,নেই বাতিদান,ওড়নি,আদ্দির পাঞ্জাবী, গিলে করা। অন্যরকম বাঙালিয়ানা।কিছুটা সিলেটি,কিছুটা স্কোটিশ। শেষ বিকেলে কং(খাসি নারী) ফিরছে কাজ সেরে,খাসি পুরুষটি মাথায় হ্যাট,কামড়ে ধরা পাইপ,হাতে গিটার,কান্ট্রি সঙ্গ গাইছে একমনে।আমি আউড়ে যাচ্ছি,”ওয়ে, আর, লাই,সান”। মাথা ঝুঁকিয়ে খাসি নারীকে বলছি,”মামি কুবলাই ম।”মনে হচ্ছে কোনো ইউরোপিয়ান কান্ট্রিসাইড,আমি অজস্র মেষ,-এর পালক,রাখাল।
সোসো থাম জানিনা,নংক্রেম উৎসবে যাইনি কখনো,কোথায় ছিলেন লাপিনসাই,গৌতম, অমিতাভ!লুই মোজো শুনিনি কখনো।ভাস্করের কবিতার মতো,মেঘই ঝুঁকে থাকতে দেখেছিলাম জানলার কাছে।”এখানে বৃষ্টি বারোমাস,এখানে মেঘ গাভীর মতো চরে”-র চেরাপুঞ্জিও যাইনি।বিরেনবাবুর কথা ধার করে বলি,”চেরাপুঞ্জি থেকে ভায়া শিলং-অবাশ্বাস্য আঁচলের খুঁটে/পাঠাও যে মেঘ…” সেই মেঘের গুড়ো মেখেই আমার ওই স্বপ্নালোক।
না,তখনো, “উই আর খাসি বাই বার্থ, ইন্ডিয়ান বাই আ্যকসিডেন্ট”, কনসেপ্ট আসেনি।
খুব ভালো লাগলো।