নিশ্চিন্ততার আনন্দে, এমন বিহবল হয়ে পড়েছে যে তার গলা দিয়ে কথা বের হয় না। তার হয়ে শুভ্রেন্দুই উত্তর দেয়।
—হ্যাঁ মা, আমি এখানে আছি।
—উ, তােকে নিয়ে আর পারি নে, জ্বর গায়ে এই ঠাণ্ডায় আবার ছাতে গিয়েছিস?
মমতাময়ীর কণ্ঠ সরে যায় রান্নাশালের দিকে। শুভ্রেন্দু শান্ত গলায়
—আচ্ছা, অমন করে ছুটে এলে কেন বলত?
—ভয়ে
—ভয়!
—হ্যাঁ ভয়! ভীষণ ভয়! এত ভয় যে তােমাকে বলে বােঝাতে পারব না! যে ভয় আমাদের হােষ্টেল সুপারিন্টেণ্ডেন্ট ললিতাদির ভয়কে আকুটি কেটে, হােষ্টেল পালিয়ে আমায় এখানে তোমার কাছে ছুটিয়ে এনেছে।
বিহবল স্বরে বলে শিবানী।
—কিন্তু এমন মারামারি হানাহানির মধ্যে তুমি কেন পালিয়ে এলে? তারা কি ভাবছে বলত?
—ভাবুক। তাদের ভাবায় আমার কিছু আসবে যাবে না কিন্তু সেখানে পড়ে থাকলে তােমার ভাবনা ভাবতে ভাবতে আমি দম আটকে হাটফেল করতুম।
—কিন্তু আমার জন্যে গুণ্ডাদের অত্যাচার সয়ে অত কষ্ট পেয়ে তুমি না এলেও পারতে।
—না, পারতাম না। কেননা তুমিই যে আমার সব।
অদ্ভুত এক তৃপ্তি ভরে বলে ও।
—মাঝে মাঝে আমার মনে হয় শিবানী, তােমার মত এক অসামান্যার উপযুক্ত হবার মত কি গুণ আমার আছে।
—“কোন গুণ নাই তার কপালে আগুন”।
—এমন, সিরিয়াস কথার মধ্যেও রসিকতা করতে ইচ্ছে যায় তােমার?
—রসিকতা নয়—এই আমার জীবনের খাঁটী কথা। তুমি ছাড়া আমি আর কিছু বুঝি না, কাউকে বুঝি না। তুমি আমার মনের ঠাকুর, প্রাণেরও। ভালবাসার ক্ষেত্রে আমি wild. আমার প্রেম বসন্ত। কোন বাধা, কোন ভয় আমি মানতে রাজি নই।
শিবানীর কথায় অসীম দৃঢ়তা।
—তুমি আমায় অবাক করলে।
—হ্যাঁ, করলুম—কিন্তু একটা কথা জিজ্ঞেস করি-পথে গুণ্ডাদের হাতে পড়েছিলাম আমি—কত কিছুই ত করতে পারে তারা আমাকে নিয়ে—তােমার মনে কোন প্রশ্ন নেই এ জন্যে।
—না। আমি ছােট হতে পারি, কিন্তু আমার মন অত ছোট নয় শিবানী। আমি জানি—তুমি, তােমার দেহ, তােমার মন, সব কিছু মিলিয়ে যে তুমি সে তুমি খাঁটী সােনার মতই কবিতা তুমি কাঞ্চনদ্ধা।
শিবানীর মনের মধ্যে মধুর একটা এষণা। সুন্দর একটা শিহরণ বইয়ে দিলে শুভ্রেন্দুর একথা। আঁচলটা গলায় জড়িয়ে হঠাৎ ও প্রণাম করে বসল শুভ্রেন্দুকে।
—এ আবার কি?
—একটা প্রণাম করলাম। বলছিলে না তুমি ছোট, প্রণাম করতে করতে মনে মনে বললাম তােমার মত ক্ষুদ্রের কাছে ক্ষুদ্র হয়ে যেন থাকতে পারি জীবন ভর।
শিবানীর কথা শেষ হতে না হতেই একটি অপরিচিত লোক বাড়ীর সামনের দিক থেকে হাঁকে।
—শুভ্রদা, বাড়ী আছেন?
ডাকটা শোনামাত্ৰ শিবানীর মনের মধ্যেটা হ্যাক করে ওঠে।
—দেখি কে যেন ডাকছে আমায়।
বলে শুভ্রেন্দু সিঁড়ির দিকে পা বাড়াতে যায়, কিন্তু শিবানী দুহাত প্রসারিত করে তাকে বাধা দিয়ে দৃপ্ত কণ্ঠে বলে—
—না, তােমায় যেতে হবে না, যেতে দেব না। যা বলবার আমি বলছি গিয়ে।
কথা শেষ করেই শাড়ির আঁচলে চোখের জল মুছতে মুছতে সিঁড়ি বেয়ে নেমে যায় উদ্ভাসিতা শিবানী।
যে লােকটি শুভ্রেন্দুকে ডাকতে এসেছিল তার মুখােমুখি গিয়ে দাঁড়ায় সে। তার মুখের দিকে চেয়ে বলে–
—কি চাই?
—আমাদের শান্তি কমিটির মিটিং হবে, তাই শুভ্ৰেন্দুবাবু যদি একবারটি…
কথা শেষ হতে দেয় না শিবানী তার, রহস্যপূর্ণ স্বরে তীর্যকভাবে চেয়ে বলে:
শুভ্রেন্দুবাবুর নিজেরই দেহে শান্তি নেই ত’ শান্তি কমিটিতে যাবেন কি করে। তিনি বিশেষ অসুস্থ।
—ওঃ, আচ্ছা, কানাইদাকে গিয়ে তাই বলিগে।
—হ্যাঁ তাই বলবেন।
সাইকেলে উঠে শাঁ করে বেরিয়ে যায় লোকটি।
শিবানী। ছাতের সিঁড়ির মুখে ফিরে এসে দেখে শুভ্রেন্দু নেমে আসছে। সে নেমে এলে রােষকণ্ঠে বলে:
—তােমায় না পইপই করে বলে গেলাম বিছানায় শুয়ে থাকতে, উঠে পড়েছ কেন?
মমতাময়ী: ততক্ষণে তার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছেন, শিবানীকে সমর্থন করে সে বলে:
—ঠিকই ত’। এই একটা ভারি অসুখ গেল, আর আজই যদি অত্যাচার শুরু করিস
—না মানে মাথাটা একটু ধরেছিল কিনা তাই ছাতে গিয়েছিলুম
বলতে বলতে অপরাধীর মত ধীর পায়ে শুভ্রেন্দু এগিয়ে যায় নিজের ঘরের দিকে। শিবানী ইতিমধ্যেই ঘরে গিয়ে বিছানা বালিশ ঠিকঠাক করে দিয়েছে। শুভ্রেন্দু শুয়ে পড়লে সে আর একবার থারমােমিটার দিয়ে জ্বর পরীক্ষা করে দেখে জ্বর আর বাড়ে নি। যা ছিল তাই আছে। তাপযন্ত্র আলমারিতে যথাস্থানে রেখে দিয়ে শুভেন্দুর দিকে চেয়ে শিবানী দৃঢ় স্বরে বলে:
—কানাইদাদের শান্তি কমিটিই তােমাকে শেষ করবে, এই আমি বলে দিলুম।
—অর্থাৎ তুমি বলতে চাও ওরা আমায় মেরে ফেলবে
—হ্যাঁ, সেইটাই আমি সন্দেহ করি।
দৃঢ় স্বরে বলে শিবানী।
—‘মরণ রে তুহু মম শ্যাম সমান
হেসে হাল্কা স্বরে বলে শুভ্রেন্দু।
—মরণে যদি অত সাধ অধ্যাপক মশাইয়ের আমাকে নিয়ে মিলিত জীবন শুরু করার স্বপ্ন দেখেছিলে কেন?
কণ্ঠস্বরে ঝাঁজ মিশিয়ে বলে শিবানী। এ কথা শুনে শুধু বােঝে যে সে চটেছে। তাই চুপ করে যায়। কিন্তু শিবানী চুপ করে না। বলে :
—আবার যদি দেখি বিছানা ছেড়ে উঠে ছাতে বেড়ানাের বিলাসিতা করছ, তবে আমি ঠিক দেয়ালে মাথা কে রক্তগঙ্গা বইয়ে দেব, হ্যাঁ।
কথা শেষ করে শিবানী রাগত পায়ে ঘর ছেড়ে উঠানে নামে, উঠান ছেড়ে খিড়কী দিয়ে বেরিয়ে যায় ও। অন্ধকার গ্রাম্য পথ বেয়ে হন হন করে ও আবার এগিয়ে চলে কানাইয়ের বাড়ীর উদ্দেশ্যেই।
ও যখন কানাইদের বাড়ীর খিড়কীর কাছে আসে তখন কানাইয়ের শোবার ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মিণিবালাকে। ছেলেকে রাত্রির আহার সেরে নেয়ার তাগিদ দিতে এসেছিল সে।
—অ কানু, আয় বাবা খেতে। সব যে জুড়িয়ে গেল।
—-আঃ বলছি ত’ এখন বিরক্ত করােনা
জড়ানাে অস্পষ্ট কণ্ঠে বলে কানাই।
—তুমি যা রান্না করেছ, ওসব বাজে জিনিস খেতে সময় নষ্ট করবার মত সময় আমার নেই
–কি জানি, কি যে সব ছাই পাঁশ খাস। বলে গজ গজ করতে করতে মিণিবালা নিজের ঘরের দিকে চলে যায়। ঠিক এই অবসরই খুঁজছিল শিবানী। সে কানাইকে একলা পেতে চায় একটু বুঝতে চায়—বােঝাতে চায় তাকে কিছু। কানাইয়ের ঘরের দিকে যাবার জন্য পা বাড়াতেই ও অন্ধকার একটা ধাড়ি ইঁদুরের ঘাড়ে পা দিয়ে শিউরে ওঠে! আঘাত পেয়ে সে জীবটা ‘চিঁ চিঁ’ শব্দ করতে করতে কুতকুতে পায়ে ছুটে পালায়। শিবানীর গাটা ঘিন ঘিন করে। চারিদিকের বাতাসে একটা গন্ধ। নাকে আঁচল চাপা দিয়ে ও এগিয়ে যায় সন্তর্পণে। বেশ উঁচু দাওয়ার ঘর কানাইয়ের। তিনটে সিঁড়ি ভেঙ্গে বারান্দায় উঠতে হয়। এগিয়ে যায় ও দরজার কাছে। তাতে চাপ দেবার আগে একটু থম্কে দাঁড়ায়। ভাবে, ঘরের ওধারে এক মাতাল মানুষ, তার মত এক সােমত্ত মেয়ে যে স্ব-ইচ্ছায় যাচ্ছে তার কাছে, এতে কতটা মনের জোর থাকা উচিত, কতটা সতর্ক হয়ে যাওয়া উচিত তার। মুহূর্তের অসতর্কতায় কী না হতে পারে। ড্রেস দিয়ে পরা শাড়ির আঁচল খুলে পিঠ বুক ঢেকে এনে প্রান্তটা গুজে দেয় বাঁ হাতের নীচে কোমরে। হৃৎপিণ্ডের অস্বাভাবিক ওঠা নামা নিয়ে ও এগিয়ে গিয়ে চাপ দেয় ভেজানাে দরজার পাল্লায়। কব্জায় কি কি শব্দ হয়—শুনে বুঝি ভেতরের মানুষটা উৎকর্ণ হয়—নেশার মধ্যেও জড়ানাে স্বরে বলে:
—কে বাবা আবার?
দরজাটা খুলে ফেলে শিবানী পরমুহূর্তেই। চৌকাঠের ফ্রেমে যে সুন্দর নারীমূর্তিটি দেখে কানাই কাকতি তার নেশা-ঘাের চোখে তার সে রূপ কত সময়ই ত’ তার সারাটা মন জুড়ে থাকে। কিন্তু রক্ত-মাংসের শরীরে সেই শিবানী আজ তারই ঘরে এই রাতে অভিসারিণী হয়ে এসেছে নাকি? সত্যি না স্বপ্ন? বাস্তব না কল্পনা? কায়া না সবটাই মায়ার ছলনা? দু’হাতের পিঠ দিয়ে চোখটা ঘষে নেয় কানাই। তাতেও চৌকাঠের ফ্রেম থেকে শিবানীর মূর্তি মুছে না যাওয়ায় ডান হাত দিয়ে সে বাম হাতে চিমটি কেটে দেখে যে তার এখনও স্বাভাবিক জ্ঞান আছে কিনা। কানাইয়ের মনের ভাবান্তর যেন শিবানী তার চিন্তার দর্পণে দেখে ফেলে। মনটাকে সে আরও প্রত্যয়দৃঢ় করে। এগিয়ে একটি পা রাখে ঘরের মধ্যে, তারপর আর একটি। দুহাতে দরজার পাল্লা ভেজিয়ে দিয়ে তাতে পিঠ রেখে দাড়ায়। মিষ্টি হেসে বলে:
—অবাক হচ্ছ, না কানাইদা?
—আঁ-আঁ-হ্যাঁ-না-না।
—বসতে বলবে না আমায়?
—মাইরী, সে কি না বলে পারি। বস বস।
বলতে বলতে কানাই তার বিছানার পরিষ্কার চাদরটা দুহাতে সাফ করে দেয় সাততাড়াতাড়ি।
—না থাক, তােমাকে কষ্ট করতে হবে না। আমি ঐ চেয়ারটাতেই বসি।
যথা সম্ভব দুরত্ব বজায় রেখে বসতে বসতে অপর পক্ষের সম্মতির অপেক্ষায় না থেকে শিবানী চেয়ারটায় তার নিতম্ব রক্ষা করে।
-আমি ঠিক এখনও বুইলে, বিশ্বাস করতে পারছি না শিবানী যে তুমি আমার ঘরে—এত রাতে। মানে…
—তুমিই বল কানাইদা, সমস্ত মন প্রাণ দিয়ে তুমিও কি এই ভাবে আমি কোনদিন আসবে তােমার কাছে—আশা করনি। শােনামাত্র একটা হিঁক্কাসহ হেসে ওঠে কানাই। বলে:
—হ্যাঁ, তা অস্বীকার করব না। বুইলে, সত্যি তা করেছিলাম।
—তবে আর অবাক হচ্ছ কেন? তােমার ইচ্ছাশক্তিরই আজ এর হল–মনে করছনা কেন।
—আচ্ছা, তুমি জান, শুভ্রের কি জ্বর হয়েছে?
—ওর নাম আর মুখেও এনাে না—শুনলেও পাপ। হাজার হলেও ওরা বিদেশী—ওরা বঙ্গাল। আমাকেই ও তােমার ভয়ে শিখিয়ে দিয়েছিল জ্বর হয়েছে বলে বলতে।
কথাটা বলে শিবানী কানাইয়ের মুখে সন্ধানী দৃষ্টিতে চেয়ে তার প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করে। আর শিবানীর মুখে শুভ্রের নিন্দা শুনে আনন্দে কানাইয়ের ছাতফাটানাে অট্টহাসি হেসে উঠতে ইচ্ছা কিন্তু তা না করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে ও বলে:
—সেই বুঝলে তুমি, কিন্তু কত দেরীতে।
—ভুল ত মানুষেই করে কানাইদা, তবে সে ভুল শােধরাবার সুযােগ দেবে না আমায়?
—তুমি করবে ভুল, এ হতেই পারেনা। না না, ঠিকই ত’ ও তােমার উপযুক্ত পাত্রই ছিল—বিদ্যায় বুদ্ধিতে আমার চেয়ে অনেক অনেক বড় ও। কিন্তু ঐ এক দোষ-মানে এক ভাঁড় দুধে এক ফোটা চেনা-ও যে বঙ্গাল।
—আমি না হয় ভুল করেছি কিন্তু ও আমার নানা কথায় ভুলিয়ে কেন ওর প্রতি আকৃষ্ট করল? কি বলব কানাইদা, আমি যদি একটা ছােরা পেতাম…
দাঁতে দাঁত ঘষে বলে শিবানী।
—সত্যি? মাইরী। ও নিয়ে তােমায় ভাবতে হবে না ও কাজ আমিই সেরে নেব।
বলতে বলতে বিছানার তােষকটা তুলে লােহার যে কালো জিনিসটি বার করে কানাই, তা দেখে শিউরে ওঠে শিবানীর সারা দেহ-মন। বিস্ময় কণ্ঠে বলে:
—রিভালভার
—হ্যাঁ, রিভালভার। আজই আমি ওর মাথার খুলি উড়িয়ে দেবার ব্যবস্থা করেছিলাম। কিন্তু কাপুরুষটা এলাে না শরীর অসুস্থ বলে।
শােনামাত্র শিবানীর শিরদাঁড়া বেয়ে একটা হিমপ্রবাহ মাথা থেকে যেন পা পর্যন্ত নেমে মাটিতে মিশে যায়।
—আমার একটা কথা রাখবে কানাইদা?
-একটা? তােমার একশ’টা কথা রাখতে হলেও রাখব। বুঝলে, কানাই কাকতির দিল আছে—সে বঙ্গাল শুভ্রেন্দুর মত কাপুরুষ নয় শিবানী।
বুকে দু’বার চাপড় মেরে বলে কানাই।
—ওকে যদি মারতেই হয় আমি মারব
—আমার বুকে যে কি জ্বালা কানাইদা, একটা বঙ্গালকে কিনা আমি…
—বেশ, তুমি যদি আমার কাজটা করে দিতে চাও, কথা দিচ্ছি, করবে। কিন্তু তুমি রিভালভার ছুড়তে ত জান না।
—না জানি, শিখে নেব তােমার কাছ থেকে।
—তবে কাল সন্ধ্যায়-নদীর ধারের শিমুল গাছটার কাছে যেখানে বঙ্গাল শুভ্রেন্দু আর তােমার ছােট বেলার খেলাঘর ছিল, চলে যেও। সেখানে তোমাকে শিখিয়ে দেব রিভালভায় ছুড়া।…
—বেশ, তাই যাব।
বলে হাত বাড়িয়ে বিছানা থেকে শিবানী রিভালভার তুলে নিল।
—ওকি, ওটা নিয়ে যাচ্ছ কেন?
—আমার কাছেই থাক না, কাল নিয়ে যাব শাড়ির আড়াল করে।
আবেশমাখা স্বরে কি সুন্দর করে বলে শিবানী।
—বেশ বেশ তাই নিয়ে যেও।
হেসে দরাজ স্বরে বলল কানাই। যেন এ মুহূর্তে শিবানী চাইলে গােটা পৃথিবীটাই সে তাকে দান করে দিতে পারে।
কানাইয়ের ঘর থেকে বেরিয়ে ঝিঁঝিঁ ডাকা অন্ধকার পথে জোনাকীর আলােয় পথ দেখে সন্মােহিতের মত ছুটে চলে শিবানী। এতক্ষণে তার মনে হয় যে সে কি দুঃসাহসিক কাজ সমাধা করে এল। এ কথা মনে হতেই সারা গায়ে ওর বিন্দু বিন্দু ঘাম বেরােতে থাকে। ভয়ানক ক্লান্ত মনে হয় নিজেকে।
বাড়ীতে এসে সন্তর্পণে নিজের ঘরে ঢােকে ও। সুটকেশ খুলে তাতে রিভালভারটা চালান করে দিয়ে চাবিটা আঁচলে বেঁধে নেয়। তারপর ঘর থেকে বেরুতেই রুণীবালা অনুযােগ করে:
—কিরে আবার কোথায় চললি? সেই এসে অবধি কোথায় যে টো টো করে ঘুরছিস?
শুভ্রদার আবার জ্বর এসেছে যে মা। তাই একবারটি দেখে আসি গে।
উদ্ধেগকণ্ঠে অনুনয় করে বলল শিবানী।
—এতক্ষণ তবে কোথায় ছিলি?
—এতক্ষণ ত পাড়ার মেয়েদের সঙ্গে দেখা করতে গেছিলাম। কানাইদের বাড়ী যাবার কথা গােপন করে বলে ও।
—-আচ্ছা মেয়ে যা হক, তাের কি ভয়ডর বলে কিছু থাকতে নেই।
—আমার মনে ইয়া মস্ত বড় একটা যে ভয় আছে না মা যাতে ছােটখাটো ভয়কে ভয়ই মনে করিনে।
দুহাত প্রসারিত করে হেসে বলে মায়ের কথাটার গুরুত্ব লাঘব করে শিবানী আবার শুভ্রেন্দুদের বাড়ীর পথে অন্ধকারে অপহৃত হয়ে গেল।
শুভ্রেন্দুর ঘরে ঢুকে তার কপালে হাত রেখে জ্বর পরীক্ষা করে দেখে শিবানী। মনে হয় বেশী বাড়েনি। জ্বরের তাপ কিছুটা কমেছেই বুঝি। আশ্বস্ত হয় সে। হাতটা সরিয়ে নিতে গিয়ে বাধা পায়। ততক্ষণে শুভ্রেন্দু তার হাতটা দিয়ে শিবানীর হাত চেপে রেখেছে।
—এই, কি হচ্ছে?
—কী ঠাণ্ডা তােমার হাত! কপালটা জুড়িয়ে গেল।
অনেকটা সময় এইভাবে বয়ে গেল। শিবানী বলে।
—লক্ষ্মীটি, না, আর নয়। ঘুমিয়ে পড়।
বলে হাত সরিয়ে শুভ্রেন্দুর গায়ের চাদর ভাল করে টেনে দেয়। মশারী ফেলে, তােষকে গুজে দেয় তার প্রান্ত। হারিকেনের শিখাটা কমিয়ে দিয়ে দোর ভেজিয়ে বেরিয়ে আসে ঘর থেকে।
নোট : বানান অবিকৃত