.
পাহাড় থেকে নেমে এলেন সমতলে,পিতা আমার।সেই সঙ্গে আমি,ভাই,মা।গুয়াহাটি শহরের রিহাবাড়ি বিলপার এলাকার ভাড়া ঘরে আমাদের ঠাঁই হলো।একটাই রুম,সেখানেই ঘুমনো,রান্নাবান্না।টিউবওয়েল পাম্প করে জল তুলি।ইলেকট্রিসিটি নেই। সন্ধ্যে হওয়ার আগেই মা হ্যারিকেন মুছে টুছে,কেরোসিন তেল ভরে রাতের জন্য তৈরি।আমি মাকে জড়িয়ে ঘুমোই,আর ভেতরে ভেতরে কাঁদি,উমপ্লি়ং-এর জন্যে,মেঘের জন্যে,কুয়াশার জন্যে,ফেলে আসা দেশবাড়ির জন্যে।এখন ভাবি, দেশভাগের সময় যারা সব ছেড়েছুঁড়ে এসেছিলেন তাদের কষ্ট কি আমার মতো ছিল,না, আরো আরো বেশি?
এ কেমন দেশ,কেমন ভাষা।পাহাড় সব কত্ত দূরে।বন্ধুও নেই।ভাড়াবাড়ির মালিকের বাড়ি আসে “দৈনিক অসম” পত্রিকা।সেখানে প্রথম পাতার কার্টুন দেখা,পড়া আমার নেশা তখন। সন্ধ্যার সময় রাস্তার পোস্টে লাগানো মাইক থেকে খবর ছড়িয়ে পড়ছে শহরে।”বাতরি পড়িছু লিলি দাস মালিকে।আর পেলাম মাইকেলের বাড়ি।আ্য মিউজিক্যাল হোম।
বন্ধু নেই কেউ।একা একাই থাকি আর শিলং যেতে চাই আবার।পল্টনবাজারের বেঙলি হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলে ভর্তি করানো হয় আমাকে।মনের ভেতরে গভীর শঙ্কা নিয়ে স্কুলে যাই।সম্পূর্ণ নতুন দেশ,নতুন মানুষ,নতুন ভাষা।আমার শিলংকে যদি তুলে এনে এখানে বসানো যেত,বেশ হতো।ক্লাশে আমি নতুন ছেলে,র্যাগ হওয়ার প্রচুর সম্ভাবনা,হলো ও তাই।আমার ভাষা শুনে ক্লাশের অন্য ছেলেরা বিদ্রূপের হাসি হাসতে লাগল। আমি হঠাৎই ভীষণ একা হয়ে গেলাম।
আমার পিসতুতো দিদি,রাঙাদি আমাদের ভাড়াবাড়ির পাশেই থাকত।দুই ভাগ্নে,তিন ভাগ্নি।বড় ভাগ্নের সঙ্গেই ভাব জমল আমার। এই একাকী জীবনে এক সঙ্গী। প্রায়ই দিদির বাড়ি যাই।আড্ডা হয়,অনেক মানুষ আসেন,বিচিত্র সব মানুষ।দেখি, শুনি।অভিজ্ঞতা বাড়ে।শ্রাবণ মাসে মাসজুড়ে পদ্মপুরাণ পড়া হয়,লাচাড়ি, ত্রিপদী।মনসা পুজো হয়,ধুমধাম করে।রাস্তার ওপারে বাপিদের বাড়ি।আমরা দারিয়াবান্দা খেলতাম।ছেলে মেয়েরা মিলে।
ভাগ্নে ও ওর বন্ধুদের সঙ্গে আমিও জুড়ে যাই সরস্বতী পুজোয়। পদ্মফুলের ওপর দাঁড়ানো সরস্বতী ইজ আ্য মাস্ট।পদ্মফুল থাকতেই হবে।দাবি আমাদের।
এরকমই এক পুজোয় আমার ইচ্ছে হলো রাজপথে শোব।অবশ্যই মধ্যরাতে।চিৎ হয়ে শুয়ে গুনব তারা,দেখব চাঁদ।ওত রাতে গাড়িঘোড়া চলার চান্স খুব কম যদিও,একজনকে তো চাই, যে খেয়াল রাখবে।আমি কী করে জানব কে কোথায়,কোন গাড়ি,আমি তো চা়ঁদতারায়। এক ভাগ্নে ও তার এক বন্ধু রেডি,ব্যাপারটা ওদের মনে ধরেছে। ওরা বলল,রাজি।প্রতিমা আনা হয়ে গেছে।সাজানো হচ্ছে মণ্ডপ।আসলে একটা সুযোগও,বাড়ির শাসনের মুঠো থেকে মুক্তি আর যা ইচ্ছে করার অবকাশ।আমি,শিলঙে শফলাং কুড়োন,ঝর্না আবিষ্কার বালক,উঁচুনিচু টিলা দিয়ে দৌড়ে বেড়ানো এক বালক,সেই আমার প্রথম দুষ্টুমি, সমতলে,এক নতুন দেশে,এই শহরের রাজপথে হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়লাম। ওপরে কি ভ্যান গঘ-এর “স্ট্যারি নাইট?”
বিলপারের ভাড়াবাড়ি থেকে একদিন চলে এলাম রিহাবাড়ি পোস্ট অফিসের লেন-এ।দণ্ডী দত্ত লহকর।রিটায়ার্ড সুপারইন্টেনড অফ পুলিস। ওনার বাড়ি।পাকা বাড়ি,ইলেক্ট্রিসিটি রয়েছে।বাথরুমের জল যাওয়ার ফুটো বন্ধ করে,কলের জল ছেড়ে আমার সুইমিংপুল।বিকেলে, সন্ধের আগে ফিরে আসে সব ঘোড়াগাড়ি।ওতে চেপে একটু বেড়ানো,আমার খেলা।
স্কুলে কিছু বন্ধু জুটল।সিলেটির সঙ্গে সঙ্গে নতুন ভাষাও শিখতে লাগলাম।খামু,যামু,কই যাস,কী করস।আমাদের পাড়াটা একটু কসমোপলিটন টাইপ।ইতিমধ্যে আমরা পাশেই একটি কাঠের দোতলা বাড়ির উপর তলায় শিফ্ট হলাম।কসমো পাড়াতে নানা ভাষাভাষী এবং বিত্তবান লোকের বাস।কিছু ছেলে মেয়েরা আবার দার্জিলিং, কালিম্পং-এ পড়ে।ছুটিছাটায় বাড়ি ফেরে।একটি কালো মোটা ছেলে আমার বেশ বন্ধু হয়ে গেল।
আমাদের বাড়ির উল্টোদিকে একটি পাকা বাড়ি।আমি বলতাম পুনিদের বাড়ি।শালিমার কোম্পানির অফিস এবং পুনিদের বাড়ি ছিল ওটা,অদ্ভূত বাড়ি।পুনির বাবা পাক্কা সাহেব।ওলওয়েজ স্যুটেডবুটেড।পুনির ছোট বোন মুন্নি কেমন উদাস উদাস ভাব।দিদি শিখা পুরো দিদির মতো,স্নেহ এবং শাসনের প্রাচুর্যে ভরা। দুই দাদা, উজ্জ্বল এবং সজল।উজ্জ্বল বাবার মতো,স্টাইলিস্ট, ডনবস্কো স্কুলে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ে।সজল বাউল টাইপ।বেঙলি স্কুলে পড়ে।আর পুনি হচ্ছে টমবয়।ডাকাবুকো।সবসময় আমাদের সঙ্গেই লেগে থাকা।
তখন ক্রিকেটের খুব উন্মাদনা।বিশেষ করে স্কুল ক্রিকেট।কামরূপ আ্যকাডেমি,ডনবস্কো, আর,বেঙলি স্কুলের মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই।কে কাকে হারাতে পারে।আমাদের স্কুলের সামনে ফাঁকা জায়গায় ম্যাট বিছিয়ে প্র্যাকটিস চলে।কালো গোপাল আমাদের জোয়েল গার্নার।ছয় ফুট লম্বা,কালো চকচকে শক্তপোক্ত হাতে ঝাঁ চকচকে লাল বল।ছুটছে যেন আগুনের গোলা।সজলদার স্টাইল পুরো গাওস্কার।আশীষদা,বরুণদা,রতন ওরাও আছে।আমাদের কে আটকায়!সেই একই পরিবারের উজ্জ্বলদা ডনবস্কোর আ্যন্ডি রবার্টস।কর্ণ,অর্জুন।একবার এখানে অল ইন্ডিয়া স্কুল ক্রিকেট হয়েছিল নিউফিল্ডে।এখন যেটা সাই কমপ্লেক্স।তখন তো আমাদের কাছে ওইদিনগুলি উৎসব।দিনের পর দিন উন্মাদনা।ঘরবাড়ি ছেড়ে দিয়েছি।শুধু ক্রিকেট আর ক্রিকেট।আমাদের পাড়ায় খেলার জায়গার অভাব ছিল না।যেখানেই মন যায়,স্ট্যাম্প পুঁতে চলো মন,ক্রিকেট।একটা খতরনাক বোলিং আ্যকশন ছিল,মিডল স্ট্যাম্প অফ ব্রেক।পম আর প্রদীপ মাস্টার করেছিল ওই আ্যকশন।আমি তো ওপেনিং ব্যাটসম্যান।শিখে গেছিলাম কী করে মোকাবিলা করতে হয় ওই মারাত্মক স্পেল।এতই ক্রিকেটপাগল ছিলাম যে,ইন্ডিয়ার খেলা হলেই হলো।স্কোরশিট রেডি করে বসে যেতাম রেডিয়োর সামনে টেস্ট ম্যাচের সময়।নিউফিল্ডে অনেক ফ্রেন্ডলি ম্যাচ হতো।এতই জুনুন যে সাত সকালে উঠে পিচ দখল করতে হতো।ভালো পিচ। পল্টনবাজারের বাবলা আর এল ও জি স্কুলের নাম ভুলে যাওয়া বোলার ত্রাস ছিল।ওদিকে আবার কংক্রিটের ওপর ম্যাট বিছিয়ে খেলা।শীতের সকালে ঝাঁ চকচকে বল গোলার মতো ছুটে।কোথায় পড়ে কোন দিকনির্দেশে যাবে অনুমান করা কঠিন।আর সেই দায়িত্ব পালন করতে হতো আমাকে।খালি পা,জুতো নেই।সাদা শার্ট প্যান্ট নেই।অন্যরা কতো ধুপদুরস্ত।একটা আ্যশ কালারের প্যান্টকেই সাদা বলে চালানো আর দিদিমার বানানো সাদা ক্রসেটের টি-শার্ট পরেই আমার ক্রিকেট।একটা প্যাড,গার্ড ও গরীব গ্লাভস।
আমাদের পাড়ার পাশেই রকেট ফিল্ড বলে একটা মাঠ ছিল,সেটা এখন ঘন বসতিপূর্ণ।সেখানেই আমাদের স্বপ্নের ফুটবল।আমি লেফ্ট স্টপার ব্যাক।আ্যগ্রেসিভ।আমাকে টপকে যাওয়া সহজ নয়।চিলড্রেনস পার্কে ভূপালকে আটকাতে গিয়ে আমার বাঁ পায়ে একটা টেনিসবলের মতো ফুলে যায়।সেটা ইম্পরট্যান্ট নয়,ভূপালকে আটকেছি,এটাই খুশি।মানুষের জীবনে এইম ইন লাইফ থাকে হয়তো।না থাকলেও স্কুলের পরীক্ষায় রচনা লিখতে হয়।আমার এইম ইন লাইফ ছিল ভূপাল হবো।ভূপাল স্ট্রেসলন প্যান্ট পরে।ইস্ত্রি করা শার্ট।জুতো পরে, পকেটে সিগারেটের প্যাকেট।রকেট ফিল্ডের বাগানে জুয়ো খেলার জন্যে ওর পকেটে প্রচুর পয়সা।আর কী চাই,জীবনে!একবার ভূপাল হতে পারলে লাইফ জিঙ্গালালা।
আমাদের কত না খেলা। শীতের দিনেই বেশি।জালানদের বাড়ির ছোট ছেলে মহেশ আসতো সেইন্ট পলস্ থেকে।অসমের প্রখ্যাত টিম্বার মার্চেন্ট ছিলেন মহেশের বাবা।পরবর্তীকালে ওনাকে মুক্তিপণের জন্য অপহরণ করে আলফা।পাঞ্জাবি পুত্তর দীপক প্রিন্স আসতো কালিম্পং থেকে।ওদের দুই বোনই তখন দারুণ স্টাইলিশ।আর ওদের মা ছিলেন হেমামালিনীর কপি ক্যাট।সবার বাড়িতেই আমার সাদর নিমন্ত্রণ।অবাধ গতিবিধি।পাড়ার ভালো ছেলে।কীভাবে যে ভালো ছিলাম,আজও জানিনা।ওদের বাড়ির উৎসব পার্বনে আমিও আমন্ত্রিত।আর ছিল শিকারিয়া রা।জি এস রোডে অসম ফ্লাউর মিলের লাল রঙের বিশাল কারখানা আজও স্বমহিমায় দাঁড়িয়ে। কোন এক ব্যাঙ্কের উচ্চপদস্ত অফিসারও ছিলেন দীপকদের বাড়ির ওপরের তলায়।ওনার ছেলে সমু আমাদের বন্ধু, মেয়ে সিমি, রোগা,ফর্সা, ঠাণ্ডা টাইপের।আমাদের সঙ্গে মিশত না, খেলত না।শুধু অবাক চোখে তাকাত। আর ছিল পুনি। এদের জন্মদিনে আমি ও যেতাম।প্রাচুর্যের উৎসবে নিজেকে কেমন যেন বেমানান লাগত।এটা আমার নিজের অনুভূতি ছিল,যদিও ওরা আমাকে সাদরেই গ্রহণ করত।একবার সিমির জন্মদিনে আমার দিকে এমনভাবে তাকাল যে, আমি কোথাও লুকোতে চাইলাম।লোহরি উৎসবে আগুনে আহুতি দেওয়ার জন্য সামগ্রী আমার হাতেও তুলে দিয়েছিলেন ওদের মা,”বেটা,তু ভি ডাল।” ওরা ভাই বোনেরা আমার দিকে তাকিয়ে এমন ভালোবাসামাখা হাসি ছুঁড়েছিল যে,আজও সেই উষ্ণতা অনুভব করি।ওদের বিত্তের অবস্থান থেকে আমি যদিও সতেরো মাইল নিচে ছিলাম,কেউই কখনো অনুভব করতে দিত না।দীপকের সঙ্গে আমার বেশি সখ্য।গাল দুটোতে যেন হিমাচলের আপেল এনে কেউ বসিয়ে দিয়েছে।পুরো মাসুম সিনেমার যুগল হংসরাজ। বিটলস্-এর আ্যবে রোড আ্যলবাম মহেশই ওদের লং প্লেয়িং রেকর্ডপ্লেয়ারে প্রথম শুনিয়েছিল। খেলার কথায় ফিরি।
আইসপাইস।সবাই লুকোবে, একজন খুঁজবে।তিন তিনটে বিল্ডিং-এর গলিঘুঁজিতে লুকোনোর ঢেড় জায়গা।সেই সঙ্গে রয়েছে পাঁচিল টপকে স্থান বদল।শীতের সকালে মার্বেল, গরমের দুপুরে সুতোয় মাঞ্জা দেওয়া,ঘুড়ি ওড়ানো,ফুটবল, ক্রিকেট তো রয়েছেই।আরেকটা খেলা ছিল,নাম ভুলে গেছি।সাতটি পাথর একটার পর একটা রাখা হতো।দুটো দল।হাতে একটা টেনিস বল।একদল পাথরের আকৃতি ভাঙবে বল ছুঁড়ে,আরেক দল পাথর সাজাবে আগের মতো।অন্যদল সেই কর্মে বাঁধা দেবে।সাইকেলের টায়ার চালানো তো খুবই সাধারণ ব্যাপার।সাইকেল চালানোও একদিন শিখে ফেললাম।নিজের তো ছিল না,অন্য কার যেন।প্রথমে হাফ প্যাডল,এরপর ফুল,মানে সিটে বসে।পড়ে গিয়ে হাত পা ছড়ে যাওয়াটা ছিল কমন ব্যাপার।কিন্তু শিখে যাওয়ার পর যে থ্রিল শরীরে বয়ে গেল,সে শুধু অনুভবের।
এখানে একটি কথা মনে পড়ায় বলেই ফেলি।কোনও একসময় আমরা রিহাবাড়ি মিলনপুরেও ছিলাম,আচার্যদের বাড়ি।ওদের বাড়ি রাস উৎসব হতো।রাস শেষ হলে আমি পেতাম রাধাকৃষ্ণের একটি মূর্তি।পাশেই ছিল হেনা গাঙ্গুলির বাড়ি।কেউ থাকত না,পরিত্যক্ত। অনেকে ওই বাড়িকে হানা বাড়ি বলত।তিনি নাকি নকশাল ছিলেন।এই দ্বিতীয়বার নকশাল শব্দটা শুনে বুক কেঁপেছিল।আচার্যদের বাড়িতে পুজোআচ্চা লেগেই থাকত।পঞ্চগব্য বানানোর জন্যে গোমূত্রের প্রয়োজন।এখন যেখানে ডিজিপি অফিস,পুলিসের কোয়ার্টার,সেইসময় প্রকাণ্ড মাঠ, গরু চরে বেড়ায়।আমি হাতে কচুপাতা নিয়ে গরুর পেছনে দৌড়োই।কচুপাতা ঘসে ঘসে গোমূত্র সংগ্রহ করা বেশ কষ্টসাধ্য ব্যাপার,খুবই শ্রমের।সেই পাড়ায় আমাদের একটা খেলা ছিল।অনেকরকমের সিগারেটের প্যাকেটের কভার কেটে রাখতাম।চার্মিনার,নাম্বার টেন,ক্যাপস্টেন,রিজেন্ট,আরো কী কী মনে নেই।এরপর গোল,ফ্ল্যাট পাথরের চাকতি দিয়ে খেলা শুরু।একজন ছুঁড়ে ফেলল একজায়গায়,আরেকজন ঠিক ওর চার ইঞ্চি পাশে ছুঁড়তে হবে।পারলে, লুকিয়ে রাখা সিগারেট কভার ওর,না-পারলে,যতটা ছিল ওই মুঠোয়,সেটা দিতে হবে।
বাবা নির্মলেন্দু চৌধুরীর গান গাইতেন বাড়িতে।ঘাটে কেউ ছিল না,সে ছিল আর,রবীন্দ্রসংগীতও গাইতেন,তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা।আর আমাদের ঢাউস রেডিয়োতে,যার এক বিশাল এন্টেনাও ছিল,বিবিধভারতী আর বিনাকা গীতমালা।প্রতি বুধবার রাত আটটায়, ভাইয়ো আর বহনো বলে চলে আসতেন আমিন সাহনি।আমি ওই সময়টায় রেডিয়োর সামনে থেকে নড়তামই না।প্রত্যেক সপ্তাহের হিট গান আর আমিন সাহনির সম্মোহনী কণ্ঠ।আমাদের বাড়িতে রেডিয়ো ছাড়া বিনোদনের অন্য কোন মাধ্যম ছিল না।মহেশ,দীপক,প্রিন্সের বাড়িতে লংপ্লেয়িং রেকর্ডপ্লেয়ার ছিল।ছোট বড় দুই ধরনেরই রেকর্ড বাজত।বারবারা স্ট্রেইসেন্ড,বনি এম,বিটলস্,আবা,এলভিস প্রিসলি ওদের ওখানেই শোনা।ওদের কাছে আসত “সান” ম্যাগাজিন।সিঙারদের ফুলপেজ পোস্টার থাকত।কখনো আমারও ভাগ্যে দু’একটা জুটে যেত।
অসমের মুখ্য শহরে থাকার সুবাদে,আমাদের বাড়িতে আত্মীয়স্বজনদের ভিড় লেগেই থাকত।মা রান্নাঘরেই কাটাতেন,বাবা অফিস।আর আমি ড্যাংড্যাং করে ঘুরে বেড়াতাম,ছেড়ে দেওয়া গরুর মতো।তবে দিদিমা যখন আসতেন,আমার খুশি আর দেখে কে।রাতে দিদিমার পাশে ঘুমোতাম গল্প শুনতে শুনতে।গরমের দিনে আমাদের মাত্র একটি ফ্যান অন্য ঘরে ছিল,দিদিমা আমাকে হাতপাখার হাওয়া দিতেন।আমার গৌরী সেনও ছিলেন দিদিমা।যত রাজ্যের সব লোভনীয় জিনিস সব ওনার স্পনসর।আমার দুষ্টুমির জন্যে যখন বাবার তীব্র শাসন নেমে আসত,তখন এই দিদিমাই আমাকে সমূহ প্রহার থেকে বাঁচানোর চেষ্টা চালাতেন।আমার জন্যে শীতের দিনে ফুলকপি আর সিম-এর যে তরকারি বানাতেন,সমুদ্র মন্থনের শেষে দেবতারা খুব সম্ভব এই অমৃতই সংগ্রহ করেছিলেন।একবার পাড়ার মোড়ের দোকানদার বাজে ধরনের সিঙারা দিয়েছিল বলে,খুব ধমক খেতে হয়েছিল ওনার, আমার দিদিমার কাছে।ছোটা বলকে পচা সিঙারা দে দিয়া।আমার সমস্ত দুষ্টুমিকে আড়াল করে রাখতেন,সায় দিতেন,মোটকথা আমার সবকিছুতেই ওনার দৃঢ় হ্যাঁ ছিল।আমার বিরুদ্ধে কোন কথাই শুনতে চাইতেন না।আমার প্রথম ভালোবাসা আমার দিদিমা।কিন্তু উনি মারা যাওয়ার সময় ওনার অসুখের শিয়রে গিয়ে দাঁড়াতে পারিনি আমি,এই অনুশোচনা আজ অব্দি রয়ে গেছে।একদিন খুব সিগারেট খাওয়ার শখ হলো।পাই কোথায়? বাবা যে সিগারেটগুলো শেষ হওয়ার আগেই ফেলে দিতেন,সেই টুকরোগুলো সংগ্রহ করে ভেতর থেকে তামাক বের করলাম।এরপর একটি কাগজে মুড়ে সিগারেট তৈরি হলো।অতিকায় এক দুঃসাহসিক কাজ করে ফেললাম এবারে।বাথরুমে ঢুকে নবনির্মিত সিগারেটে টান দিই আর জানলা দিয়ে ধোঁয়া বের করি।শিলঙের কথা বেবাক ভুলে গেছি ওই নিষিদ্ধ কর্মে।ফলে,যখন বাথরুম থেকে বেরোলাম,তামাকগন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে।বাড়ির কাজের মাসি মনোরোমা,নাক টেনে এমন ভাবে আমার দিকে তাকাল যে,গন্ধটা তো সন্দেহযুক্তই এবং তুমি ধরা পড়ে গেছ শ্রীমান।চোখের অনেক কাকুতি মিনতির পর মনোরমার করুণা জাগ্রত হলো এবং আমার এই কুকাণ্ডটি আর প্রচার করল না।দিদিমা থাকলে তখন মনোরমাকে এক ধমকে চুপ করিয়ে দিতেন।যেন সিগারেটে টান কোন ঘটনাই নয়।ওই লেবেঞ্চুস খাওয়ার মতোই সরল।
সম্প্রতি প্রয়াত নারায়ণ দেবনাথ।কে তিনি?জানিই না।আমি জানি শুকতারায় বাঁটুল দি গ্রেট,হাঁদা-ভোঁদা,আমি জানি, কিশোরভারতীর নন্টে-ফন্টে।মাত্র দুই পাতায় ছবিতে পুরো একটা গল্প।আমাদের হি-ম্যান।দুষ্টের যম। এত টানত,যে বুঁদ হয়ে থাকতাম।বড়রাও।
যেহেতু ব্রাহ্মণসন্তান, আমাকে দ্বিজ হতে হবে।ব্রাহ্মণদের নাকি দু’বার জন্ম হয়।দ্বিতীয়বার পৈতের সময়।তো আমারো দ্বিতীয় জন্ম নেওয়ার সময় হয়ে এল।বাড়িতে তোড়জোড় শুরু।শিলচর থেকে আচার্য হিসেবে আমার জ্যাঠামশাই এলেন।আর পুরো সিম্ফনির কন্ডাকটর হয়ে গেলেন আমার মামা মামি।পাড়ায় নেমন্তন্ন করা হয়ে গেল।নতুন একটা জিনিসের অপেক্ষায় সবাই টেনসড্।আমি তখন মাথা মুড়িয়ে ভগবানের অন্যরূপ।কীরকম দেবতা দেবতা ভাব।বন্ধুদের বললাম,আমাকে ছোঁয়া যাবেনা,দেখাও যাবে না।তোরা এখন অচ্ছুৎ।প্রথম ভিক্ষা মা দিলেন।পরে অন্যরা।এটা পুণ্য।এই ভিক্ষায় সংগ্রহ সামগ্রী দিয়েই আমার কৃচ্ছ্রসাধন। যেদিন আমার সংযমকাল শেষ হলো,সেদিন আমার ধুতি পাঞ্জাবি পরে বরবেশ।আমিই মূখ্য আকর্ষণ।নিজেকে খুব ইম্পরট্যান্ট মানুষ মনে হচ্ছে।আমার দ্বিতীয় জন্ম হলো,আমি পুরো ব্রাহ্মণ এখন।ফলে একটা লাভ হলোএই যে,আমাকে দিয়ে লোকে পুজোআচ্চা করাতে চাইল।দণ্ডী দত্ত লহকরের স্ত্রী, মা কে খুব স্নেহ করতেন।সেই স্নেহপরবেশ হয়ে তিনি মাকে একটি অষ্টধাতুর ঘট দিয়েছিলেন।আমি ব্রাহ্মণ হওয়ার আগে পর্যন্ত মা সেই ঘটে বিপদনাশিনীর পুজো করতেন।প্রতি মঙ্গলবার আর শনিবার বিশেষ পুজো।একটা করে নারকেল।ফলে,মাসে আমাদের বাড়িতে আটটা নারকেল হতো।এত নারকেল কে খায়,অতএব আমাদের খাটের নিচ নারকেলময় হয়ে গেল।তো, আমার পৈতের পর শনি,মঙ্গলবারের পুজোর দায়িত্ব আমার কাঁধে পড়ল।নারকেলের সঙ্গে দক্ষিণা পাওয়ার প্রাপ্তিযোগও ঘটল।
প্রথমে ববি,পরে জুলি।এই দু’টি সিনেমা তখনকার দিনে তহলকা মাতিয়ে দিয়েছিল।যেহেতু কনটেন্ট আ্যডাল্ট,এবং অপ্রাপ্তবয়স্কদের সিনেমা হাউজে প্রবেশ নিষিদ্ধ,সেহেতু আমাকে বাদ দিয়েই বাবা মা সিনেমা দেখতে গেলেন এবং আমি কিছু সময়ের জন্য পূর্ণ স্বাধীনতা পেয়ে গিয়ে যা মনে হয় তাই করলাম।কী করেছিলাম,আজ আর মনে নেই,তবে স্বাধীনতার স্বাদ কী,সেটা পুরোই পেয়ে গেলাম।
হঠাৎই একদিন শোনা গেল, যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে।কীসের যুদ্ধ,কার সঙ্গে,কেন যুদ্ধ, বালক মনের এত জিজ্ঞাসার উত্তর কারো কাছেই যেন ছিল না।একটা চাপা আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছিল শহরে।প্রায় সবার বাড়িতে জানলা,ভেন্টিলেশনে,কালো কাগজ লাগানো হলো। ঘরের আলো যাতে বাইরে যেতে না পারে।আকাশমার্গে বিমান হামলার আশঙ্কায় আমাদের রাত কাটে।যখন তখন বেজে ওঠে সাইরেন।এমতবস্থায় আমাদের খেলাধুলোর আনন্দেও অশনিসংকেত নামল।একদিন খবর এল,যুদ্ধ শেষ।পূর্ব পাকিস্তান এখন এক স্বাধীন রাস্ট্র।আমরা সবাই স্বস্তির শ্বাস ফেললাম।সুখের দিন সমাগত।
কিন্তু দেবতা অলক্ষ্যে হাসিলেন কথাটি আবার এক পরম সত্য বলে প্রমাণিত হলো।মামাবাড়ি তেজপুর গেলাম বাড়ির সবাই।বেশ খাচ্ছিদাচ্ছি,মৌজমস্তি করছি,একদিন হঠাৎ কোন এক মিছিলে কারা যেন হামলা করল।ব্যস,সঙ্গে সঙ্গে শহরের এদিক ওদিক জ্বলে উঠল আগুন।ঘরদোর জ্বলছে।আবার আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল।রাত নামল।চারদিক থমথমে।কারফিউ দেওয়া হয়েছে।মামাবাড়িতে আমরা ঘরদোরের আগল আরো মজবুত করলাম।হঠাৎ একটি পাথর এসে পড়ল বাড়ির টিনের চালে।আমাদের ঘুম উড়ে গেল।হঠাৎ যদি আক্রান্ত হই।একটা শব্দ শুনে জানলার পর্দা সরিয়ে দেখা গেল আর্মি মার্চ করছে।যাক,এখন আর চিন্তা নেই।কিন্তু ভাবলে কী হবে।আতঙ্ক তো রয়েই গেল।পরের দিন সকালে মামার এক পরিচিত বাড়ি এলেন।পুলিশের লোক।অভয় দিলেন।ওদিকে মামা ও বাবা ওনাকে ধরলেন,পান সুপারি জর্দা এনে দিতে হবে।এদের অনুপস্থিতিতে দিন গুজরান মুশকিল।চাল নয়,ডাল নয়,পান।বোঝো।দু’তিনদিন পর পরিস্থিতি যখন স্বাভাবিকের দিকে,আমরা ট্রেনে চেপে বাড়ি ফিরছি।পথে,ট্রেনের জানলা দিয়ে মাঝেমধ্যে দেখা যাচ্ছে,গ্রামের পোড়া বাড়ি, গার্হস্থ্য।মানুষেরা কোথায়! পালিয়ে বেঁচেছে,না,মারা গেছে।
গুয়াহাটি ফেরার দিনকয়েক পরে পরিস্থিতি এখানেও থমথমে হয়ে এল।শঙ্কা, অবিশ্বাসের ভেতর দিনগুলি,রাতগুলি।একসময় এখানেও কারফিউ।আমরা রাত জাগি,ছোট্টো,তবুও জাগি।এরকম সময়ে অভয় দিতে এলেন আরেক মামা,মুকুরমামা।এই মামাদের বাড়ি ছিল রিহাবাড়িতেই।মামা মাসিরা সব স্টাইলিস্ট।দাদু ও পুলিসে। হরে কৃঞ্চ হরে রাম ফিল্ম রিলিজড্।দেবানন্দ ছা গয়া।লেটেস্ট ফ্যাশনের ড্রেস পরে মামা মাসিদের টুইস্ট।আমি হাঁ করে তাকিয়ে থাকি।সেই মামা একরাতে আমাদের বাড়ি এসে কোমর থেকে পিস্তল বের করে বাবাকে দেখিয়ে বলল,জামাইবাবু,নো টেনশন।পিস্তল দেখে আমার চোখ চকচক করে উঠল।হাতে নেওয়ার তীব্র বাসনা দেখে মামা বললেন,নে।বলেই আমার হাতে রাখলেন।এত্ত ভারী!চালায় কীভাবে!এরপর আমাকে বোঝানো হলো,কোনটা ম্যাগাজিন,সেফটি লক,প্রসেস কী চালানোর।
একদিন ভোর রাতে আমরা ট্রেনে চেপে শিলচর রওয়ানা দিলাম।রেলওয়ে মেল সারভিসের রেলের ডাব্বা,এস ফর্টি।সেখানে বাবার চলন্ত অফিস আর আমরা।স্টিম ইঞ্জিন, কয়লার গুড়ো উড়ে আসে।লামডিং আসতেই স্টেশনের দেওয়ালের গায়ে শুকিয়ে যাওয়া রক্তের দাগ।মানুষের রক্ত,কিন্তু অজানা,অচেনা।কেউ ছিল,আমাদের মতো মানুষ।লামডিং ছাড়ালেই মন ভরে যাওয়া চারিপাশ।ঘুম ঘুম হাফলং।কুয়াশায় মোড়া হারাঙ্গাজাও,টানেল,জাটিঙ্গা,পাখিরা কেনো নিজেকে শেষ করে দেয় এতো মনোরম পরিবেশে!কী দুঃখ ওদের?বালকের মুগ্ধ চোখ,সব কালো রাত্রি মুছে ফেলে।বরাকভ্যালি এক্সপ্রেস পাহাড়লাইনে চলে ধিকধিকিয়ে আর রূপকথা রচিত হয়।
শিলচর।বাবার দেশ।কবির শহর।আমাদের বৃহৎ পরিবারে গাদাগুচ্ছের মানুষ।অজস্র ভাইবোন।রাত গাঢ় হওয়ার আগেই সব ঘুমে কাদা।এক একজনকে ঠেঙ্গিয়ে ওঠাতে হয় খাওয়ার জন্য।পাঁকঘরে দিদিরা শুটকি বাটে,গরম গরম ডাল ভাত রাঁধে।বারান্দাজুড়ে পিঁড়ি পাতা হয়।আমরা অমৃত খাই,অমৃত। আমাদের বাড়িতে অমরাদাদি বলে একজন ছিলেন।নিজের পরিবার ছেড়ে তিনি আমাদের পরিবারেরই এক সদস্য হয়ে গিয়েছিলেন।অমরাদাদিকে বলা যায় মুশকিল আসান।সুপুরি গাছে তরতর করে চড়ে সুপুরি পাড়া, চোর ছেচ্চরকে তাড়া করা,বাড়ির সবার খেয়াল রাখা,যত রকমের কঠিন কাজ করা,ছোটরা বাঁদরামি করলে শাসন, এককথায় পুরো এক প্যাকেজ।ওনার সঙ্গে আমার তিনটে স্মৃতি।সুপুরি গাছে ওঠে সুপুরি পাড়ছেন,আমি নিচে কুড়োচ্ছি।কয়েকদিন নরসিংহ স্কুলে পড়তে গেছি,আসা যাওয়া ওনার সঙ্গে হেঁটে হেঁটে।আর সব কাজ ফুরোলে রাতে ওনার বিনোদন ছিল হুঁকো টানা।তিনি টানতেন আর আমি ওনার সামনে বসে মুগ্ধচোখে তাকিয়ে থাকতাম।একদিন সুযোগ বুঝে আমি সেই নিভন্ত হুঁকোয় টানও দিয়েছিলাম।উফ,কী তেতো।
পাড়ার মোড়ের দোকানের সোডার বোতলের প্রতি আমার গ্রীষ্মকালে দারুণ লোভ ছিল।রেস্ত কম থাকলেও কখনো কখনো স্বপ্নপূরণ হয়ে যেত।রাঙাদা প্রতি সন্ধ্যায় ওদের কাঠের দোতলার ঘরে তবলা বাজাত,আমি সামনে বসে মাথা দোলাতাম।গরমের দুপুরে ওর সঙ্গে ছিপ নিয়ে মাছ ধরতে যেতাম সামনের বড় পুকুরে।আমি পুঁটি মাছ ধরতাম,রাঙাদা,শোল।ধনদা আস্ত পাঁঠা কেটে ছুলে পুরো সাফ করত।কী নিপুণ শিল্প।বড়দি আর পিসিমণি কলাগাছ দিয়ে আমাকে সাঁতার শেখানোর প্রচুর চেষ্টা করেছিল,আমি সেই যুদ্ধ থেকে পালিয়ে যাই।সাঁতার শেখা আমার আর হলো না।বেশিরভাগ সময় পিসিমণির পাশেই ঘুরঘুর করতাম।আমার ভালো লাগত ওনার সঙ্গে থাকতে।এখনকার মতো আ্যটাচড্ ওয়াশরুম তখন ছিল না।বড় বাইরে যাওয়ার জন্যে বাড়ির শেষমাথায় পুকুরপাড়ে ছিল সেই ব্যবস্থা।জলাজঙ্গল,সাপখোপের ভয় মাড়িয়েই যেতে হতো।বিখ্যাত গান্ধীমেলায়ও গিয়েছিলাম একবার কার হাত ধরে যেন।এই গান্ধীমেলায় আমার বাবার সঙ্গে মায়ের প্রথম দেখা হয়।শিলচরে শক্তিপদ থাকতেন,আমি জানব কী করে, ছোট ছেলে!
খুব ভালো লাগলো সঞ্জয়দা।